রিমঝিম বৃষ্টি পর্ব-১৩

0
23

রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা

১৩.

রিমঝিম ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে, গালে কান্নার দাগ স্পষ্ট। সকালের নাস্তা কেউ খায় নি। রুবায়েত সকালেই বের হয়েছে। কিছুই ভালো লাগছে না, রাগের মাথায় কেন যেতে রাজি হয়ে গেল? রুবায়েত বা এত উৎসুক কেন ওকে এখান থেকে বিদায় করতে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো ওর মামার ফোন।

“আস সালামু আলাইকুম মামা, কেমন আছেন? কখন আসবেন?”

“অলাইকুমুস সালাম, মা, আজ সম্ভব না। একটা কাজ পরে গেছে, যেখানে যাচ্ছি মোবাইল নেটওয়ার্ক ভালো না। তাই জানিয়ে রওয়া দিচ্ছি৷ জামাইকে ফোন করেছিলাম ফোন ব্যাস্ত। আমি ইন শা আল্লাহ কাজ সেরে যখন আসতে পারব ফোন করব।”

“আমি জানিয়ে দিব, আপনি চিন্তা করবেন না।”

রিমঝিম ভাবছে কি করবে! এই বাসায় ও থাকবে না অসম্ভব। কিন্তু গ্রামেই থাকবে, কেন রুবায়েত চায় ও চলে যাক? তাছাড়া চেয়ারম্যানের ষড়যন্ত্রের বিষয়টাও আছে। ব্যাগ হাতে বের হয়ে যায়। আজ আকাশ পরিষ্কার, সকালের মেঘ কেটে গেছে। পুরো উঠানে নজর বুলিয়ে নিল। মায়া কি অদ্ভুত জিনিস, কত আপন হয়ে গেছে এই জায়গাটা ওর। আর কি আসা হবে?

গিট্টুর নানি ওকে সাদরে গ্রহণ করলো। টিনের ঘর, বুড়ী একাই থাকে, ছোট এক চিলতে উঠান তাতে কত যে গাছ, পাশ দিয়েই একটা সরু নালা বয়ে যাচ্ছে। অল্প বয়সে বিয়ে, পান খায় বলে বয়স্ক লাগে৷ পাঁচ ছেলে আর এক মেয়ে, সবাই যার যার মত, ছেলেরা সব শহরে থাকে। গিট্টুর মা দুই ঘর পরেই থাকে। সব শুনে পান খাওয়া মুখে হাসলো

“মাইয়া মানুষরের এত রাগ ভালা না মাইয়্যা, পুরুষ মানুষ হইলো আসল জিনিস, স্বামী সম্পদ। আর শুনছস, ময়নাই হউক আর চেয়ারম্যানই হউক, কিছু না কিছু করবই করব।”

রিমঝিম হাসে, “ মেয়ে মানুষের রাগ থাকতে নেই তাই বলে? সংসার তো দুজনের খালা তাহলে একজনই কেন সম্পদ।”

ওর এত ভারী ভারী কথা বুঝে না গিট্টুর নানি, বলে “খাড়াও ভাত রান্না করি।”পালা একটা মুরগি ধরতে চায়। মনের ভিতরে তার চিন্তাগুলো ডালপালা মেলে, সহজ সরল ডাক্তার আর তার ভালো মানুষ বউ। কি হবে এদের?

রিমঝিম ঘরে মন খারাপ করে বসে আছে৷ ফোনটা বারবার দেখছে। একটা ফোন ও তো করতে পারতো রুবায়েত। কান্নাগুলো চোখের কিনার ছাড়িয়ে গালে জায়গা করে নিল। নাক টেনে স্যুটকেস খুললো, একটা ডায়েরি খুঁজে পাচ্ছিলো না কিছুতেই। পরে রুবায়েতের ড্রয়ারে ওর জামা কাপড় এর ভেতরে পায়। নাহ! এটাতে নতুন কিছুই লিখা নাই। স্যুটকেস খুলে ডায়েরি দুইটা খুঁজতে গিয়ে স্যুটকেস শুদ্ধ উলটে পরে গেল।
আরে ধুর, জামাকাপড় তুলতে গিয়ে খেয়াল করে ডায়েরিটা খুলে পড়ে আছে একদম শেষ পাতাটা খোলা তাতে কিছু লিখা।
দ্রুত তুলে নেয়, হৃদপিণ্ডের গতি সচল হয়।
তারিখ নাই কোন।

আমার স্বপ্ন:
আজ ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখেছি, রিমঝিমকে নিয়ে। স্বপ্ন বলতে নেই, আমি বলব কি সেটা ভাবতেও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, একটা শিরশির অনুভূতি। চেয়ারম্যান যে রকম মানুষ আমি তাকে বিশ্বাস করি না, করি না ভরসা এই গ্রামের মানুষকে। তারা নিজেদের নারীদের ই তুলে দেয় ঐ পিশাচের হাতে। উফ! আমি কি করব? রিমঝিমকে চলে যেতেই হবে। জানি ও রাজি হবে না।
প্রিয় রিমঝিম,
কখনো নিজের রুবায়েতের কথা ত্যাড়ামি না করে মেনে নিলে কি খুব ক্ষতি হতো? তুমি কি ভাবো আমি তোমার সঙ্গ উপভোগ করি না?
তুমি জানো, আমি আগে ভাবতাম, মানুষ কীভাবে বিয়ের পর একসাথে দিনের পর দিন কাটায়? একঘেয়েমি লাগে না? বিরক্তি আসে না?
কিন্তু বিয়ের পর বুঝলাম… এই সম্পর্কটাই এক অন্যরকম অনুভব, যদি কেউ সত্যিই হৃদয় দিয়ে অনুভব করে।

আমি একাচোরা মানুষ, তবু তোমার সব দুষ্টু-মিষ্টি কান্ড, তোমার খুনসুটি, তোমার আদর… সবকিছুর ভেতর আমি এক গভীর প্রশান্তি খুঁজে পাই।
বিয়ের পর এক রাতে হঠাৎ জেগে অনুভব করি তুমি আমার মুখে এঁকে দিচ্ছো শত আদর। সেই অনুভূতি কেমন ছিল, তা ঠিক ভাষায় বোঝাতে পারব না।
স্পর্শটা ছিল শারীরিক, কিন্তু সেটা উত্তেজনা নয় দিচ্ছিলো প্রশান্তির ছোঁয়া। এরপরও আমি বহুদিন ওই মুহূর্তগুলো উপভোগ করেছি।তুমি ভেবেছ আমি ঘুমিয়ে গেছি। অথচ আমি চুপচাপ থেকে তোমার ভালোবাসা সঞ্চয় করেছি নিজের ভেতরে।

তোমার রান্না শেখা, রান্না করতে গিয়ে তোমার,নাকে-মুখে ময়দা মাখিয়ে ফেলা,তোমার গুনগুন করে গান গাওয়া, তোমার চুড়ির শব্দ,সবই আমার খুব আপন লাগে।

তোমার ভালো-মন্দ মিলেই তো তুমি আমার রিমঝিম।তুমি যখন রাগ করো, অযথা সন্দেহ করো, অস্থির হয়ে টেনশন করো,তখন আমি বিরক্ত হই ঠিকই, কিন্তু ঠিক তখনও আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তোমাকে নিয়ে এক অদ্ভুত টান আমার, যেটা হয়ত নিজেও বুঝিনা তোমাকে বোঝাতে পারিনা।
তুমি কিন্তু সহজেই বলো “আই হেট ইউ”, আমি কেন তা পারি না?

কাল তোমার সাথে আমার কঠিন হতেই হবে। তোমার নিরাপত্তার জন্য। আমার যা হয় হবে, বেঁচে থাকলে তোমার রুবায়েত আবার তোমার মন স্পর্শ করবে ইন শা আল্লাহ।

রিমঝিম কাঁদতে কাঁদতে ই ডায়েরি ভরে পাগলের মত “আই হেট ইউ” লিখে যাচ্ছে।

___________________

রুবায়েতের বাড়ি ফিরতে ফিরতে, সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল, রিমঝিমের মামার ফোনে কল যাচ্ছে না। অবশ্য ব্যস্ত ছিল দুইবার দিয়েছে, এখন আবার ফোন করলো। নাহ! টেনশন হচ্ছে, রিমঝিম কেও দুইবার ফোন দিয়েছে ফোন ধরেনি। আনমনে হাসলো যেই রাগ, ফোন ধরবে না সম্ভবত। মনে মনে বললো তুমি নিরাপদ থাকলে আমিও নিশ্চিত।
বাসায় এসে দেখে টেবিলের উপর নাস্তা ঢেকে রাখা, সেটা দেখে খিদা টা মাথাচাড়া দিল। রুটি আর ভাজি সকালের। নষ্ট হয় নি। খেতে খেতেই নজরে আসলো পানির গ্লাসের নিচে চাপা দেওয়া একটা কাগজ।দ্রুত কাগজটা টেনে নিল, হৃদপিন্ডের গতি দ্রুত হল, রিমঝিমের চিঠি নিশ্চিত অনেক অভিযোগ আর অভিমানে ভরা।

অপ্রিয় তুমি,

তোমার সাথে যখন সংসারটা শুরু করি, তোমাকে তখন আমি ভালোবাসতাম না। কিন্তু, বিয়ের প্রথম দিনেই কীভাবে যেন আমার হৃদয়ে তোমার জন্য অনেকগুলো আবেগ এসে ভিড় করলো। তুমি যখন ঘুমিয়ে থাকো, তখন খুব ভালো লাগে জানো? তোমার মুখে তখন আমি শত শত আদর একে দিই। বুঝেছো কখনো? না, যেমন কখনো আমাকে বোঝোনি।

আমি জানি, আমার অনেক দুর্বলতা আছে। মানসিকভাবে আমি দুর্বল একজন মানুষ, নিজের যা কিছু আছে তা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। একান্তই নিজের করে রাখতে চাই। আর তুমি তো আমার একান্তই, তাই না?

কাল পর্যন্ত আমি এটাই ভাবতাম। কিন্তু তুমি…নির্মম ভাবে আমারসেই বিশ্বাসটাকে ভেঙে দিয়েছো। তুমি ডাক্তার রুবায়েত, তুমি এখন সবার। অথচ তুমি হতে পারলে না কেবল আমার।

একটা কথা বলি, ময়নার থেকে সাবধানে থাকবে। ও তোমাকে ফাঁসাতে পারে। চেয়ারম্যানের সঙ্গে ওর গোপন কথাবার্তা আছে, ওর কথায় সহজে ভেসে যেও না। আমি এসব এমনি বলছি না। আমার সন্দেহকে দোষ দিও না, ছোট মনকে দোষ দিও না।

অনেক কথাই ছিল বলার, কিন্তু তুমি তো শুনলে না, শুনতে চাওও না।
আমি জানি না, আমাদের সম্পর্ক আবার কখনো আগের মতো হবে কিনা। ভালোবাসা একা যথেষ্ট নয়, একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার হয় বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, আর অন্তরের পাশে থাকা।

তুমি বারবার আমার মনকে আঘাত করেছো, মনটাই আস্তে আস্তে মরে গেছে যেন।
ভালো থেকো, নিজের যত্ন নিও।
আর হ্যাঁ… আই হেট ইউ।

— রিমঝিম,
যে তোমার হতে চেয়েছিল।

চিঠিটা পড়ে রুবায়েতের মন বিষাদে ছেয়ে গেল। আবার ফোন করলো রিমঝিমকে। নাহ! ফোন তুলছে না।

হঠাৎ মুকুল উঠানে বলে উঠলো, “ডাক্তার , তাড়াতাড়ি হানে আইছেন, ময়নাপুর কী হইতাছে জানি না!”

রুবায়েত সচরাচর বিরক্ত হয় না, কিন্তু এবার হয়ে গেল।পান থেকে চুন খসলেও কি ডাক্তারকে ডাকতে হবে? বসে থাকে যায় না। পাঁচ মিনিট পর আবার আয়নার কন্ঠ,

“ডাক্তার সাহেব, তাড়াতাড়ি আইসেন, ময়নাপুর শরীরডা কেমন অয়তাছে!”

ময়নার ঘরটা আধারে ঢাকা। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই ভাইবোনকে দুইশত টাকার বিনিময়ে মিথ্যা বলিয়ে ডাক্তারকে ডেকে এনেছে সে। জানালাগুলো বন্ধ করে দিল…আজ দরজাটাও বন্ধ হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাতাসে যেন কিসের ষড়যন্ত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও কি পারবে? ঠোঁটের উপরে ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরল। পারতেই হবে! যে খেলায় নেমেছে, সে খেলায় ‘আধা-আধি’ বলে কিছু নেই।

ময়নার বাসার কাছাকাছি এসে রুবায়েত আবার রিমঝিমকে ফোন করল। ঠিক করল, এবার যদি ফোন না ধরে, তবে ও সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে যাবে। না, এবারও ধরছে না। ফোনটা পকেটে ভরে রাখল, আজকের রাতটা যেন একটু বেশিই অন্ধকার।

রুবায়েতের মনে সন্দেহ জাগে,ময়নাকে সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। ওর ক্ষতি করবে, সেটা ভাবে না ঠিকই, কিন্তু মেয়েটার হাবভাব একদম পছন্দ হয় না তার। যাই হোক, বাইরে থেকে সালাম দিল।

“ভেতরে আসেন…” কাঁপা কণ্ঠে বলল ময়না।

রুবায়েত ভেতরে ঢুকে একটু বিরক্ত হল। ঘরটা একদম অন্ধকার।

“বাতি জ্বালাও। তোমার মা কোথায়?”

কোনো উত্তর নেই।

হঠাৎ দরজাটা পিছন থেকে টান দিয়ে বন্ধ করে দিল ময়না। সঙ্গে সঙ্গে রুবায়েতের শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“ডাক্তার সাহেব, আপনে আমারে ছাড়েন! আপনে কি করতাছেন, মা-বাপ ঘরে নাই, এই সুযোগ নিতাছেন?”

তার গলাটা এখন বেশ জোরে। শব্দটা যেন বাইরে পৌঁছায়,সে চেষ্টাই করছে।

রুবায়েতের মস্তিষ্কে পুরো বিষয়টা ঢুকতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। তারপরই বুঝতে পারল,ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে সে। যে ফাঁদের কথা রিমঝিম তাকে চিঠিতে জানিয়েছিল।

ময়না তখন একটানা চেঁচাচ্ছে, “ছাড়েন ডাক্তার! আপনে খারাপ মানুষ, আমারে জোর করতাছেন! আমারে কেউ বাঁচান!”

সেই মুহূর্তেই দরজায় ধাক্কা পড়তে শুরু করল।

“দরজা খোল! ডাক্তারের বাচ্চা, আমরার মাইয়ারে নষ্ট করবি!”

বাইরের কণ্ঠ রুক্ষ, প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ছে।

রুবায়েত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ময়নার দিকে তাকিয়ে বলল,

“সারা জীবন শুনেছি, মানুষ নাকি যার খায়, তারই ক্ষতি করে! নাটক করেও যে কেউ সত্যিকারের মানুষকে ফাঁসাতে পারে আজ বিশ্বাস হল। এখন এই নাটকটা বাদ দাও, দরজা খোলো। আমি সব রকমের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। আল্লাহই জানেন, আমি দোষী না নির্দোষ।”

ময়নার চোখে একটু অস্থিরতা দেখা দিল, কিন্তু সে নিজের অভিনয় থামাল না। বাইরে লোকজনের শব্দ আরও ঘন হয়ে আসছে। হয়তো এক মুহূর্ত পরেই দরজা ভেঙে ফেলা হবে।

এই মুহূর্তে সময় থমকে আছে যেন।

____________________

চেয়ারম্যানের বাড়ির আম গাছের নীচে হাত বাধা অবস্থায় রুবায়েত পড়ে আছে। আমের গন্ধ চারিদিকে, সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আকাশে আজ একটা মস্ত বড় চাঁদ, মনে হচ্ছে পূর্ণিমা। রুবায়েতের ঠোঁট ফেটে রক্ত, মাথা ফেটে রক্ত চশমাটা বাঁকা হয়ে আছে।

চেয়ারম্যান চেয়ারে বসে হুক্কা টানছে, সে আজ বেজার খুশি, অনেক দূরে ময়না দাঁড়িয়ে আছে তরুর সাথে। থর থর করে কাঁপছে। ও বুঝতে পারে নাই এরা রুবায়েতকে এভাবে মারবে।

“ ছি: ডাক্তার! ডাক্তার হইছস আর কি করছস! চুপচাপ গিয়া মেয়ে মানুষের মধু খাইস! তোর এই কাণ্ড সবারে দেখামু, তোরে লেইন্যা লেইন্যা উদাম কইরা মুখে কালি মাখাইয়া গাঁওঘর ঘুইরামু!”

রুবার কিছু বলে না চুপ করে থাকে। কিন্তু ময়না চিৎকার করে ওঠে, “ এইরকম কোন কথা নায় হইছে।”

পাশে দাঁড়িয়ে তরু ওর হাতে চাপ দেয়, “তর কাম রেই বিয়া করা, বিয়া কর! এত গপ গাইস ক্যান? চেয়ারম্যানর রাগ নাই নি!”

ছোট্ট ময়না অনেক পরে যেন উপলব্ধি করল ও শুধু দাবার ঘুটি ছিল। চোখ ফেটে পানি পরতে লাগলো কত বড় পাপ করে ফেলেছে। আল্লাহ ওরে মাফ করবে না।

চেয়ারম্যান পিচিক করে উঠানে থুথু ফেলল, “তর বউডা আমার ভালো লাগছিল, আর যে হবে তুমার বউ এখন!” বলে ময়নার দিকে তাকায়। “তারেও আমার পছন্দ। একজোন রে ভোগে পইলেই হইব।” গা দুলিয়ে হাসে।

রুবায়েত এখনো কিছু বলে না, শুধু শব্দ করে ওখানে থুতু ফেলে, রক্ত মিশ্রিত থুথু। যে ডাক্তার একসময় এই গ্রামের মানুষের ক্ষত সারিয়ে দিত, সে আজ ক্ষতবিক্ষত। আল্লাহকে শুকরিয়া জানায় যে রিমঝিম কে এই জায়গা থেকে দূরে পাঠাতে পেরেছে। ওর জন্য এখন মৃত্যু শ্রেয়, অন্য কাউকে বিয়ে করা…চোখে পানি চলে আসে।

দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে, চেয়ারম্যান খুব আনন্দিত, গ্রামে খবরটা দিতে লোক পাঠিয়েছে।

______________________
হেডমাস্টারের মন খারাপ, ভাবতে পারছে না ডা:রুবায়েত তেমন কিছু করতে পারে। রাগে সামনে নেওয়া ভাতের থালা ঠেলে দিল, “ সব ষড়যন্ত্র।! কানে বাজছে উনার ছোট ছেলের পড়া কবিতা,

“ আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে।”

দ্রুত হাতে শার্ট পড়ে নিল, আজ জলে থেকেই কুমিরের সাথে যুদ্ধ করবে। সকাল হতেই হবে।বের হয়ে গেল, আজ তার ছাত্রদের তার বড্ড প্রয়োজন।

মৎস্যপল্লিতে বাতাস ভারী। গ্রামের মানুষজনের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়েছে। কারও চোখে ভয়, কারও চোখে আগুন।

এক বৃদ্ধ বসে ছিলেন হাওড় পাড়ে। পানির দিক তাকিয়ে বললেন,
“আগেই কইছিলাম চেয়ারম্যান ছাইড়া দিব না ওরে! ধরা খাইবো একদিন।”

এক মাঝি বলে,
“জলত থাকলে কুমিরের লগে যুদ্ধ করন যায় রে?”

সালাম হঠাৎ বৈঠা তুলে দাঁড়ায়, চোখে আগুন।
“কেন যাব না? কুমির হইলেও ডাঙ্গা ত উঠতে হইবো, আর আমরা আইতাছি। আমি আছি ডাক্তারের পক্ষে!”

আলতা, ধীরে ধীরে সামনে আসে। মুখে পোড়া ক্ষত চোখে বিদ্যুৎ।
“আমিও থাকমু।”
পেছনে এসে দাঁড়ায় অনেকে, আরও নারীরা বলে উঠে আমরাও। এই কথার পর যেন একটা একটা ঢেউ ছুটে যায় পাড়ায়। উঠে দাঁড়ালো কিছু পুরুষ যাদের ঘরের নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে, তারাও আজ রক্তে জ্বালা অনুভব করছে। একটা সুযোগ তারা পেয়েছে। এই গ্রামে যেন একটা বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল, পুরুষ থেকে নারী সবাই হাতে লাঠি এবং বৈঠা তুলে নিল।

একজন পুরুষ, চোখে জল, মুখে ক্ষত, চিৎকার করে বলে ওঠে,
“আমার বউরে যে নিয়া গেল! বউডা সেই শোকে মরল।আজ সেই বিচার লইতেই হইবো! আর বসে থাকুম না!”

আরেকজন বলে,
“একজনের বোঝা যদি দশজন না নেয়, তাইলে মানুষ কই?”

নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, কিশোর সবাই এগিয়ে আসে।
কারণ আজ তারা বুঝে গেছে,এই লড়াই শুধু একজন রুবায়েতের জন্য না, এই লড়াই তাদের নিজেদের জন্যও।

আজ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শুধু বৈঠা আর লাঠি না, দাঁড়িয়ে আছে একেকটা আগুন।

ওদিকে গ্রামের আরেকদিকে রিমঝিম এবং গিট্টুর নানি, গ্রামবাসীর সামনে দাঁড়িয়ে,

“আমার স্বামীর চরিত্র খারাপ না, আমি তাকে বিশ্বাস করি সে এই কাজ করতে পারে না। আপনাদের জন্য লোকটা গায়ের রক্ত পানি করছে, চেয়ারম্যান কে চিনেন না? আপনাদের কি কোন দায় নেই।” বলতে বলতে রিমঝিম কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে, কেন রাগ দেখালো? রুবায়েত ওকে কতবার ফোন করেছে একটা ফোনও কেন ধরল না। এ জীবনে কি আর কখনো রুবায়েতের কণ্ঠ শুনবে রিমঝিম।

গিট্টুর নানি ভাঙ্গা গলায় চিৎকার করে, “তোরা হেই লইগা কেচা হইয়া থাকবি, মরবার লাগি একবার মরলে কী অয়! মরনের এত ডর কিসের?”

_____________

রাতে নিস্তব্ধতা চিরে, কিছু মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছে, গ্রামের মানুষ চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকের হাতে লাঠি অথবা অন্য কিছু। হাসমত এসে চেয়ারম্যান এর কানে কানে খবরটা দেয়। চেয়ারম্যানের মুখে হাসি ফুটে ওঠে,

“আরে ডাক্তার যাদের জন্য রক্ত পানি করলা তারাই তোমাকে মারতে আসতেছে।”

রুবায়েত এবার মুখ তুলে তাকায়, মৃদু হাসে,
“ মান সম্মান হারানো, আর এই বেইমান মেয়েটাকে বিয়ে করার থেকে, এরকম মৃত্যু ভাল। তাতে হয়তো কখনো আমার স্ত্রী আমার অবস্থাটা বুঝবে।” রুবায়েত এবার পাগলের মত হাসতে থাকে। ভাবে আর কখনো কি রিমঝিম এর সাথে দেখা হবে।

এদিকে ক্রোধে পাগল গ্রামবাসী, চেয়ারম্যান বাড়ির উঠানে প্রবেশ করে। চেয়ারম্যান তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে, “ দেখো তোমাগো ডাক্তার কি আকাম ডা করছে। কি শাস্তি দিবা বল!” তবে ভিড়ের
মাঝে ডা:রুবায়েতের বউকে দেখে চমকে যায়।

রিমঝিমকে দেখে রুবায়েত একটা মাথা ঝাড়া দেয়, নিশ্চয় ওর আবার ভ্রম হচ্ছে। ঐ তো রিমঝিম হাতে লাঠি।

ময়না এবার চিৎকার করে ওঠে, “ সব ষড়যন্ত্র, ডাক্তার নির্দোষ…আর কিছু বলার আগে একটা রাম থাপ্পড় খায় তরুর হাতে। নীচে পড়ে কান্নায় ভেঙে পরে কি লজ্জা কি অপমান ওকে বিয়ে করার চেয়ে নাকি মৃত্যু ভালো।

জনতা একযোগে চিৎকার করে ওঠে, “ “ডাক্তারের উপরে ভরসা আছেগা, চেয়ারম্যানরে তয় উপর একদমই না। আইজকা থেইক্কা তুই শেষ!”

রুবায়েতের দৃষ্টির সামনে, জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে চেয়ারম্যানের উপরে। ও একজন ডাক্তার, বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। লাভ হয় না, চেয়ারম্যানের সাঙ্গ পাঙ্গরা সব পলায়, খানিক পরে উঠানে পড়ে থাকে ক্ষতবিক্ষত চেয়ারম্যানের দেহ।

রুবায়েত উঠে দাঁড়ায়, রিমঝিম কোন ভ্রম না সত্যি, এইতো ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আর বলছে “আই হেট ইউ,” “আই হেট ইউ।” আজকের রিমঝিম এর মুখে- “আই হেট ইউ” রুবায়েতের খুব মিষ্টি লাগছে।

#রিমঝিম_বৃষ্টি
#কাজী_জেবুন্নেসা

চলবে….