রূপসাগরে মনের মানুষ পর্ব-০১

0
115

#রূপসাগরে_মনের_মানুষ
#লেখিকাঃইশা আহমেদ
#সূচনা_পর্ব

“অবনীকে পাওয়ার জন্য আমি যা করতে হয় সব করবো। তবুও আমার ওরে লাগবে,ইমাদ তুই বল না কি করবো আমি। ওকে ছাড়া একটা মুহুর্ত ও কল্পনা করা সম্ভব না। ভালো আমি ওরে বাসছি যখন ওরে আমার লাগবে। অবনীকে আমার হতেই হবে”

বাইশের যুবকের আর্তনাদে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটা মানুষের চোখে পানি। বর্তমান যুগেও এমন করে কেউ ভালোবাসতে পারে তা কল্পনা করা যায় না। ইমাদ যুবকটির বেস্টফ্রেন্ড। সেও কাঁদছে! কি করবে তার বেস্টফ্রেন্ড রূপি ভাইয়ের এই অবস্থার জন্য কিছুটা হলেও সেই দায়ী। ইমাদ কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। কিই বা বলবে ছেলেটা। ভালোবাসার জ্বালা, যন্ত্রণা কেমন সে জানে। সে বুঝতে পারে ভালোবাসার মানুষরে হারানোর যন্ত্রণা। সেও বেসেছিলো তবে হয়তো মাহাদের মতো নয়। মাহাদ অবনী নামক রমনীটিকে যে পাগলের মতো ভালোবাসে। গত তিনটা বছর পাগলের মতো এক তরফা ভালোবেসে গিয়েছে। এই তো ছ’মাস আগে বহু কষ্টে রাজি করিয়ে ছিলো অবনীকে। প্রেম ভালোই চলছিলো কিন্তু গতকাল অবনী ধরা খেয়েছে তার আম্মুর কাছে এই নিয়েই যোগাযোগ বন্ধ তাদের। এই যে আজ রাস্তায় চিৎকার করে কাঁদছে। ইমাদ শত চেষ্টা করেও বুঝাতে পারলো না মাহাদকে। মাহাদ একা একাই আওড়াতে থাকলে,,,

“তোমারে আমি ভালো যখন বাসছি, আমার আমি করেই ছাড়বো। তুমি আমার হবা মানে আমারই হবা। তোমারে আমার মতো ভালো আর কেউ বাসবো না আমার রানী। তুমি আমার হবা আমার! তোমাকে আমি আমার করবোই। যেই হাত আমি ধরছি একবার তা কীভাবে ছাড়ি। তুমি ভরসা যখন করছো আমি তোমার সেই বিশ্বাস ভরসা কীভাবে ভাঙবো”

ফাঁকা রাস্তায় হাত পা মেলে শুয়ে পরলো মাহাদ। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে আওড়াচ্ছে অবনীর নামখানা। ইমাদসহ বাকি বন্ধুরা তাকিয়ে আছে মাহাদের দিকে। বন্ধু হয়ে বন্ধুর এমন যন্ত্রণা কেউ সহ্য করতে পারছে না। রাহান ইমাদকে বলল,,,“আর কত? কাল থেকে এমন করে যাচ্ছে। সকাল থেকে না খাওয়া। ও তো মরে যাবে। ইমাদ ধর ওকে,কিছু খাওয়াতে হবে না হয় মরে যাবে ও। জাওয়াদ যা তো বিরিয়ানি নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আসবি, বাইক টান দিয়ে যাবি আর আসবি।”

জাওয়াদ কথা শোনা মাত্রই বাইকে বসে টান দিয়ে চলে যায়। ইমাদ ধীর পায়ে গিয়ে বসে পরলো মাহাদ পাশে। মাহাদ আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাহান সহ বাকি দুই বন্ধু ফাহিম আর মুবিন বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দুই বন্ধুকে একটু একা ছাড়লো। মাহাদকে সামলাতে একমাত্র ইমাদই পারবে তাই তারা দূরে রইলো। ইমাদ ক্ষীণ কন্ঠে শুধালো,,

“এই ভাবে চললে হবে? তুই না অবনীকে ভালোবাসিস তো এমন করতিছিস কেনো? না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানে কি মাহাদ মেয়েটা তরে ভালোবেসে এতো কষ্ট করতিছে আর সেই তুই তার প্রতিদান কি দিচ্ছিস না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস আর কাঁদতেছিস? এমন করলে হবে? তোর এখন শক্ত থাকতে হবে। লড়াই করতে হবে। তুই এইগুলো করছিস অবনী জানলে কি কষ্ট পাবে না? কেনো করছিস এইসব? ঠিক হ। খেয়ে নে, এরপর সবাই মিলে বসে একটা সমাধান বের করি। এইভাবে হয় না মাহাদ। তুই সকাল ধরে না খাওয়া এমন করলে হবে? মরবি তুই? চল ব্রিজ দিয়ে লাফ দে”

ইমাদের কথা শেষ হতেই জাওয়াদ এসে উপস্থিত হলো। সে যে খুব জোরে চালিয়ে গিয়েছে তা তার আসার সময় দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ইমাদ টেনে তোলে মাহাদকে। ইশারায় সবাইকে আসতে বলে কাছে। সবাই এসে গোল হয়ে বসে পরে। পাঁচ বন্ধু মিলে মাহাদকে বুঝিয়ে খাইয়ে দেয়। বন্ধুত্ব বোধ হয় এটাই। কিছুক্ষণ আগেই যেখানে ছয় জন যুবকের মাঝে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিলো এখন তা হাসা হাসিতে রূপ নিয়েছে। সবার মাঝে থেকে মাহাদের একটু ভালো লাগছে। সবাই ওকে একটু ভালো রাখার জন্য অজানা উদ্দেশ্যে বাইক চালানো শুরু করলো। কিছুটা সময় মাহাদকে খুশি রাখার প্রচেষ্টা করলো পাঁচ বন্ধু।

বন্ধ রুমের বিছানা ঘেঁষে বসে আছে এক রমনী। উষ্কখুষ্ক চুল, মলিন চেহারা সব মিলিয়ে বিদঘুটে অবস্থা তরুনীর। আঁখি জোড়া বেয়ে গড়িয়ে পরছে অশ্রুকণা। ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। কাছে ফোনও নেই যে তার প্রিয় মানুষের সাথে কথা বলবে। কি অবস্থা কে জানে মানুষটার। অবনী আলগোছে হাত বাড়িয়ে আঁখি জোড়া মুছলো। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দিলো। যদিও বা পেছন হতে বন্ধ করা দরজা। তবুও কেউ যেনো না আসতে পারে এর ব্যবস্থা করলো। মাহাদের কি অবস্থা ভাবতেই বুক কেঁপে উঠলো অবনীর। পুরুষটা তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। এক কথায় পাগলের মতো ভালোবাসে। পাগল ও বোধহয় নিজেকে একটু ভালোবাসে, কিন্তু মাহাদ তাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। আর যাই হোক না কেনো সে মাহাদকে ছাড়তে পারবে না। যেই লোকটা তাকে নিজের থেকেও ভালোবাসে তাকে কিভাবে ছাড়বে সে। পালাবে দরকার হয় তবুও মাহাদকে সে ছাড়বে না। আর সে তো এমন নয় যে বাচ্চা বা এটা তার আবেগের বয়স। সে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। তবুও তার আম্মু আর ভাই কেনো এমন করছে বুঝলো না অবনী।

অবনী ঠিক করলো সে আর কাঁদবে না। এবার নিজেকে শক্ত করবে। এরপর যা হয় দেখা যাবে। সে সব বুঝে শুনেই সিন্ধান্ত নিয়েছে। বাবা মা এক সময় মেনে নিবে। তবে প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেলে তাকে ফিরে পাওয়া যাবে না। এর জন্য সে মাহাদকেই বেছে নিয়েছে। ওয়াশরুম থেকে নিজেকে ফ্রেশ করে বের হলো। ফোনটা নিয়ে নিয়েছে তার মা। বিছানায় বসে ভাবতে শুরু করলো কি করা যায় এখন। তখনই দরজায় সশব্দে আওয়াজ হলো। অবনী বুঝলো কেউ দরজা ধাকাচ্ছে। দরজা খুলতেই রুমে প্রবেশ করলো তার আম্মু ওয়াহিদা পারভীন। অবনীকে দেখে শক্ত কন্ঠে বললেন,,,

“দরজা লাগিয়েছিস কেনো?”

“ইচ্ছা হয়েছে লাগিয়েছি। কি বলার আছে বলো না হয় যেতে পারো”

ওয়াহিদা পারভীন মেয়ের এমন উদাসীনতায় ক্ষিপ্ত হলেন ভীষণ। তবুও নিজেকে শান্ত করে বললেন,,,“খেয়ে নে চল। সকাল থেকে কিছু খাসনি। রাত অনেক হয়েছে খেয়ে নে”

“আমি খাবো না যাও তুমি”

এবার ওয়াহিদা পারভীন ভীষণ চোটে গেলেন। মেয়েকে থাপ্পড় মেরে বসলেন। এরপর ক্ষিপ্ত গলায় বললেন,,,
“লজ্জা করছে না এভাবে কথা বলতে? দোষ করার পরও এভাবে কথা বলছিস? ওই ছেলের আছে কি? কি পাইছিস ওর মধ্যে হ্যাঁ তাই বল। ওই ছেলে চাকরি করে যে তোকে খাওয়াবে?”

এবার অবনীও কিছুটা মেজাজ দেখালো। সেও মৃদুস্বরে চিৎকার করে বলল,,,
“আমি ছোট বাচ্চা নই। আমি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী। গায়ে হাত তুলছো কেনো? আমি আমারটা বুঝি নিজের লোভকে সামলাও। আমি ওরে ভালোবাসি। আমার টাকা পয়সার দরকার নাই। তুমি কি সবাইকে নিজের মতো মনে করো? টাকা দেইখে ঝুলে পরবো আমি অন্য লোকের গলায় নিজের প্রেমিককে ধোঁকা দিয়ে। তোমার তাই মনে হলে তুমি ভুল। আমি ওরে ভালোবাসি যখন ওরে আমি ছাড়বো না বুঝলা তোমাদের যা করার দরকার হয় কইরা নাও। আমি ওরে ভালোবাসছি ছাড়ার জন্য না বুঝছো?”

“অবনী”

ওয়াহিদ বেগম বিকট চিৎকার করে উঠলেন। অবনী তবুও ভয় পেলো না। সে সত্য বলতে ভয় পায় না, যা সত্য সে তা বলবেই। ওয়াহিদা বেগম ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,,,
“অতিরিক্ত বার বেরেছিস তুই। তোর বাপ আসুক আজ। তোর একটা ব্যবস্থা না করলে হচ্ছে না”

“তোমার যা করার করে নাও। ভালো যখন আমি বাসি তখন মাহাদরে ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। আমি এখন বলি তুমি আব্বুরে ছাইড়া দাও পারবা? পারবা না কারণ তুমিও ভালোবাসো আব্বুরে, তেমন আমিও বাসি। তাহলে সমস্যাটা কি?”

অবনীর এমন কথায় কিছুটা শান্ত হলো ওয়াহিদা পারভীন। তবুও রাগ ক্ষোভ কমলো না।চাপা কন্ঠে চিৎকার করে শুধালো,,,
“সমস্যা হইলো ওই কিছু করে না। তোরে খাওয়াইবো কি? আমার একমাত্র মেয়েকে আমি ওমন ছেলের হাতে তুলে দেবো তাই বলে”

“আম্মা ও আমারে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমি ওরে ছেড়ে দিলে ও মরে যাবে। আমি কীভাবে নিজ হাতে নিজের ভালোবাসাকে খুন করবো। পারবো না আম্মা তোমরা যাই করো না কেনো ওরে আমি ছাড়বো না”

ওয়াহিদা পারভীন আবারও একটা থাপ্পড় বসালেন মেয়ের গালে। তাতেও অবনীর মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। ওয়াহিদা বেগম অধৈর্য্য হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। অবনী বিছানায় বসে পরলো ধপ করে। টিনশেড রুমখানায় মৃদু বাতাস প্রবেশ করছে জানালা দিয়ে। অবনীর হলদেটে গালখানা লালবর্ণ ধারণ করেছে। মানসিক যন্ত্রণার চেয়ে কি শারিরীক যন্ত্রণা বেশি হয়! মোটেও না তার ভেতরের যন্ত্রণার কাছে এ যন্ত্রণা তুচ্ছ।

“তোমারে আমি এ জীবনে ছাড়বো না মাহাদ। ভালো যখন বাসছি আমি তোমারই হবো। তুমি তোমার অবনীর উপর একটু ভরসা রেখো”

#চলবে~