#রেড_হার্ট❤️
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
#পর্ব_১
রুমে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে । কেবল শোনা যাচ্ছে ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। দরজার ফাঁক দিয়ে একজন মহিলা চোখ রাখলেন। দু’জন ব্যক্তিকে দু’দিক করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। পরিস্থিতি ভয়ানক! ব্যক্তিরা সম্পর্কে বাবা-ছেলে। ভেতরের গুমোট পরিবেশ থেকে মহিলাটি মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ সরিয়ে আনেন। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ভয়ে মহিলার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। বুলি ফুটিয়ে মহিলা টি বাকীদের শোধালেন,
–“ ভাইজান আর খালু দুইজনেই চেইত্তা আছে খালা! ”
•
বেশ খানিকক্ষণ তর্ক করে যখন ব্যক্তিটি প্রস্থান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ঠিক তখনি নিজের ছেলের গলার আওয়াজ পেলেন।
–“ জনাব খালেকুজ্জামান! আমি এই বিয়েটা করছি না। ”
ছেলের কন্ঠে স্পষ্ট রাগ। তাতে কি? তিনিও খালেকুজ্জামান তালুকদার! তিনিও রাগ করতে পারেন এবং মেজাজ ও দেখাতে পারেন। এই ভেবেই তটস্থ পায়ে ব্যক্তি টি নিজের ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন।
–“ কত ভালো শিক্ষা তোমার হ্যাঁ ? বাবাকে নাম ধরে ডাকছো ? ”
–“ ডাকার মতো কাজ করবেন কেনো? ”
–“ বিয়েটা তুমি করছো এটাই ফাইনাল। ”
–“ আপনি ভুলে যাচ্ছেন কে আমি !? ”
খালেকুজ্জামান ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভ্রু কুচঁকালেন। বুলি ফুটিয়ে বললেন,
–“ কি ভুলে যাচ্ছি আমি হ্যাঁ? ”
উদভ্রান্ত ছেলেটা বাবার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো,
–“ আমি! ইহান তালুকদার ভ্রম। ”
–“ তো? ”
বাবার এমন হেয়ালি উত্তরে রাগান্বিত স্বরে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
–“ আমি ইহান তালুকদার ভ্রম মিস্টার খালেকুজ্জামান ! যাকে তাকে বিয়ে করার মতো ছেলে আমি না। আমার রেপুটেশন বলে অনেক কিছু আছে। কোত্থেকে একটা বস্তির মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে কর বললেই বিয়ে করবো নাকি? ”
ছেলের এমন বেয়াদবি আচরণে নিজেকে আর থামিয়ে রাখতে পারলেন না খালেকুজ্জামান। তড়িৎবেগে হাত উঠান ছেলের গালে। পরপর দুটো থাপ্পড় দিয়ে তাকে শোধালেন ,
–“ হ্যাঁ ! তোকে বিয়ে করতেই হবে। এইটা আমার ডিসিশন ! আমার বাহিরে আর একটা কথাও বলবি না। ”
বাবার হাতের থাপ্পড়ে দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে পড়তে গেলেও নিজেকে শামলে নেয়। গালে হাত দিয়ে দাঁড়ায় কাঠিন্য চেহারায় বাবার দিকে তাকায়। তিরিক্ষি মেজাজ ভ্রমের। যাকে বলে অল্পতেই রেগে যায়। সেখানে এতোকিছুর পরেও আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। মুখ খুললো নিজের। লাগামহীন অনুপযুক্ত একটি কথা বাবাকে হুংকার দিয়েই বললো।
–“ বিয়ে বিয়ে করে কেন আমার মাথাই খাচ্ছো ? বিয়ের যখন এতোই শখ তখন নিজে বিয়েটা করে ফেলো না? ”
খালেকুজ্জামান চকিতে ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলে হয়ে বাবাকে এইসব কথাবার্তা …? হতবিহ্বল হয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। অনায়াসেই তিনি পরের পরিস্থিতি বুঝে ফেললেন। ছেলেকে তার হারে হারে চেনা। কথা বাড়ালেই পরিস্থিতি খারাপ হবে। তার চেয়ে বরং কৌশলে মেয়েটাকে তার ঘরের বউ করতে হবে। যেকোনো মূল্যে…করতেই হবে! তাই তিনি বুদ্ধি খাটালেন। খানিকটা চোরের উপর বাটপারি। সামনে তাকাতেই স্টিলের আলমারি টা দেখতে পেলেন। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আলমারিতে লাথি মারেন। ফলস্বরূপ আলমারিটা সত্যি সত্যিই খানিকটা ডেবে যায়! এরপর বড় বড় কদম ফেলে দরজা খুলে বেড়িয়ে যান তিনি। যাওয়ার পথে এ বাড়ির মহিলাদল কে দেখলেন। দরজার একটু অদূরেই তারা কেমন একটা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
খালেকুজ্জামান রাগ নিয়েই সরাসরি রিনির কাছে গেলেন। তার স্ত্রী। ভ্রমের মা! আদেশের সুরে বললেন,
–“ শোন! আয়না কে দিইয়ে বকুল কে বিয়ের জন্য তৈরি করতে পাঠা এখনিই। আমি কাজী সাহেব কে নিয়ে আসছি। বিয়ে পড়ানো হবে বিকেল চারটায়। তোর ছেলেকে রেডি হতে বল। যথাসময়ে তাকে না পেলে বিয়েটা আমিই করবো । ”
কথা শেষ। এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি তটস্থ পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এদিকে মিসেস রিনি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কি বলে গেলেন তার স্বামী ? ছেলে বিয়ে না করলে তিনি ব,বিয়ে করবেন…? কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন। ছুটে আসলো বাকীরা। ততক্ষণে খালেকুজ্জামান চক্ষোগোচর হয়ে গিয়েছেন।
•
চোখে অশ্রুরা এসে ভীড় জমিয়েছে , যে কোনো মুহূর্তেই সেগুলো ভূমি স্পর্শ করবে। কিন্তু তার আগেই বাম হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ কচলিয়ে নিলো মেয়েটি। হ্যাঁ! মেয়েটি বকুল। ঘন লাল-কালো লম্বা কেশ, ডাগর ডাগর আঁখি, সরু ঠোঁটের অধিকারীনি মেয়েটি আজ চোখের জল ফেলছে। ফলস্বরূপ তার ঠোঁটের পাশে কালো কুচকুচে তিলটায় চোখের পানি চিকচিক করছে।
বাবা-মায়ের বড্ড আদুরে মেয়ে সে। ছোট থেকেই রাজকুমারীর মতো বড় হয়েছে। বাবা ঢাকার সনামধন্য একজন আইনজীবী, আর মা গৃহিনী। কয়েকদিন আগেও যে পরিবার টা হাসি-খুশি ছিলো আজ মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। একটি ঘটনা তাকে থামিয়ে দিয়েছে। সেইসাথে তাকে ম্যাচিউর করে দিতেও দু’বার ভাবেনি। তাইতো সে’ও নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। একটাই প্রশ্ন! ‘এখন কি হবে তার ?’
দরজায় আওয়াজ আসলো। সে নড়েচড়ে চোখের জল মুছে উঠে দাড়ালো। ভাঙা কণ্ঠেই উত্তর দিলো,
-“আসুন!”
উত্তর পেয়েই রুমে প্রবেশ করলেন তার সবচেয়ে উপকারী বন্ধু। জনাব খালেকুজ্জামান! তার জন্যেই মৃত্যুর দুয়ার থেকে বাঁচতে সক্ষম হয়েছে সে। বিনীত স্বরে লোকটিকে শোধালেন,
-“চিন্তা করো না মা। আমি আছি!”
-“জি আংকেল।”
সে কেবল মাথা নিচু করে খালেকুজ্জামান কে উত্তর দিলো। ব্যক্তি টি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকে বললেন,
-“মা! তৈরি হয়ে যাও।”
খালেকুজ্জামানের কথার কোনো কিছুই বুঝলো না সে। প্রশ্ন করলো,
-“জি আংকেল?”
-“তোমাকে আমার পরিবারের সদস্য হতে হবে যে!”
সে চকিতে বাবার বয়সী লোকটির দিকে তাকালো। কি বোঝাতে চাইছেন তিনি? উত্তর খুঁজতেই লোকটির পানে তাকালো। তাহার চোখে-মুখে স্নিগ্ধ হাসি লেপ্টে আছে। সে এর মানে বুঝলো না।
মেয়েকে চুপ থেকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন,
-“তোমাকে আমি আমার পুত্রবধূ করতে চাই মা। না করো না প্লিজ।”
সে থমকালো। লোকটা তাকে কি করুণা করছে? তাই সোজাসোজি জিজ্ঞাসা করলো,
-“করুণা করছেন আংকেল?”
তিনি মেয়ের কথায় শব্দ করে হাসলেন। মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বললেন,
-“এইটা ভালোবাসা মেয়ে আর করুণা করলে কেউ বিয়ে দিয়ে করে নাকি?”
সে চুপ। সত্যিও তাই। কথা বাড়ালো না তাই। খালেকুজ্জামান ফের বললেন,
-“শোনো মেয়ে! তোমার বাবা-মা ডাকের অভাব দিতে চাই না। তাই সব হারিয়ে ফেললেও হারিয়ে দিতে চাইছি না।”
সে চুপ। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। চেনা নেই জানা নেই হুট করে কাউকে বিয়ে করে ফেলবে সে? তার ভাবনার মাঝেই খালেকুজ্জামান প্রশ্ন করলেন আবারো,
-“দ্বিতীয় মা-বাবা হিসেবে কি মেনে নেওয়া যায় আমাদের?”
লোকটি যেন প্রশ্ন নয় তাকে প্রস্তাব দিলেন। চোখে আবারো পানি এলো তার। সব হারিয়ে বসেছে সে। জীবিনের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছে। আর তার মধ্যে পুনরায় নতুন কিছুর প্রস্তাব। মনোনিবেশ করতে পারবে কি সে..?
•
ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন মা। মাকে কাছে পেয়েই রাগ যেনো বেড়ে গেলো ভ্রমের। তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়ে ক্ষেপে গিয়ে বললো,
-“সমস্যা কি মা তোমাদের? আমায় কি শান্তিতে বাঁচতে দেবে না? বাবার কওয়া নেই জানা নেই ওমনি একটা মেয়েকে বিয়ে করতে বললেই কি করে ফেলবো? তোমরা কি জানতে না আমি মেনে নেবো না? তবুও কেনো…? এমনিতেও এই লোকটার সাথে আমার ছোট থেকেই বনে না। তার উপর বিয়ের মতোন এতো ভেলুএবল একটা ডিসিশন হাওয়ার মতো নিলেই হয়ে গেলো? করবো না আমি। করবোই না!”
কথা শেষ করেই বাবার ভেঙে দেওয়া আলমারির দরজায় সেও একটা লাথি দিলো। সাথে সাথে ধরে ফেলে বাকী দুজন। একজন বলে উঠে,
-“শান্ত হও ভ্রম। বাবার সাথে কি কথা হলো বলবে তো? তারপর তো আমরা বুঝবো। তিনি তো বাড়ির কাউকেই বিয়ে নিয়ে কিছু জানান নি।”
ভ্রম খানিকটা চুপ থাকলো। আস্তে আস্তে বাবার সাথে তখনকার হওয়া কথা বলতে শুরু করে। সব শুনে তো রিনি বেগমের মাথায় হাত! ছেলে যেমনটি একগুঁয়ে বাবাও তার দ্বিগুণ। চট করে ধরে ফেললেন তাকে কি করতে হবে। তাই ছেলেকে খানিকটা নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“কি করবি ভেবেছিস?”
মায়ের কথায় ভ্রমের থমথমে মুখখানা দেখা গেলো। হয়তো সে ভাবছে। কি করবে। চাচিরাও একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। ছেলের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তারা কিছুটা শঙ্কিত। তখনই ভ্রম ফট করে বলে দেয়,
-“বিয়েটা আমি একদমই করছি না মা-কাকিমা’রা। কোনো প্রশ্নই উঠে না!”
উপস্থিত মা-কাকিমা’রা চমকালেন। এমনটাই হওয়ার ছিলো যে! ছেলেকে রাজী করানোর সাধ্য তাদের নেই। তবুও বিফল চেষ্টা চালালেন। রিনি বেগম ইশারা দিলেন ভ্রমের ফুপু বিন্তি কে। বিন্তি ইশারা তে সায় জানালেন। ভ্রম কাউকে মানুক আর না মানুক তার ফুপু কে সে অগ্রাহ্য করতে পারেনা। এবার, এগিয়ে আসলেন ফুফু। ভাইপো কে শোধালেন,
-“দেখ বাবা! শান্ত হয়ে একটু ভেবে দেখ?”
-“ফুপু তুমিও?”
-“হ্যাঁ, আমিও।”
-“তোমার থেকে এটা আশা করিনি আমি!”
ভ্রমের কাঠকাঠ গলায় বলা কথাটা ফুপু আমলে নিলেন না। তিনি দরজা আটকিয়ে বিছানায় এসে বসলেন। নিজের মতো করে ভাইপো কে টেনে নিজের কাছে বসালেন। ভাইপোর দৃষ্টি স্থীর অন্যদিকে। ফুপু শোধালেন,
-“বাবা শোন। জানিস তো তোর বাবা কেমন? তুই যদি আজ বিয়ে না করিস তাহলে বিয়েটা তোর বাবা করবেই। তুই কি…?”
ফুপুর কথা শেষ করতে দিলো না ভ্রম। হুংকার দিয়ে উঠলো। চিল্লিয়ে বললো,
-“ওনার বিয়ের শখ জেগেছে তো করুক না। আমাকে কেন টানছে?”
কাকিমা এগিয়ে এসে ভ্রম’র পিঠে হাত বুলালেন। ফুপু গলা ঝেড়ে নিলেন। ফের শোধালেন,
-“তুই কি তাহলে এই বয়সে মায়ের সতিন কে দেখতে চাস? চাস মা কষ্ট পাক?”
ভ্রম দমে গেলো। সুযোগ হলো তার ফুপুর। ফুপু তাকে নরম গলায় বললেন,
-“আমার কাছে একটা ব্যাট্যার প্ল্যান আছে! শুনবি?”
ভ্রম উত্তর দিলো না। ফুপু আরেকটু এগিয়ে বসলেন। ভ্রমের হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
-“বলছিলাম যে বিয়েটা করেই ফেল।”
ভ্রম তেঁতে উঠলো। চোখ তুলে বিরক্তি নিয়ে ফুপুকে কিছু বলতে যাবে, তার সাথে সাথেই ফুপু বলে উঠলেন,
-”সংসার করতে হবে এমন তো কথা না! জাস্ট বিয়েটা কর। নিজের মতো ঢাকায় চলে যা। তারপর ছ’মাস পর এসে পাক্কা ডিভোর্স টা দিয়ে দিবি। ঝামেলা শেষ! মা’কেও বাবার অন্যায় বিচার থেকে বাঁচালি আর আমাদেরকেও!”
ভ্রম চুপ রইলো। ফুপুর বলা কথাগুলো বোধহয় ভাবছে। এদিকে মা-কাকিমা’রা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। অতঃপর সকলেই বিন্তির কথায় সায় জানালো। কেবল অপেক্ষা করলো ভ্রমের উত্তরের। মিনিট কয়েক নিরবতা পালন করা হয়। তারপরই উঠে দাঁড়ায় ভ্রম। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় টেবিলের কাছে। দাঁড় করানো ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দরজার দিকে যেতে থাকে। আর বলে যায়,
-“ভ্রম অলয়েজ ফলোস হিজ উওন ওয়ে!”
চলবে।