#রেড_হার্ট❤
#পর্ব_দুই
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
ভ্রম তড়িৎগতিতে নিজের পা চালাচ্ছে। রাগে ফোস ফোস করছে। রাগের চোটে শরীরে ঘাম নেমে আসলো। ড্রয়িংরুমে পা দিতেই জনাব খালেকুজ্জামান কে ভ্রমের নজরে এলো। একজন লোক যিনি কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসছেন খালেকুজ্জামানের সাথে সাথে। সে দাঁড়িয়ে গেলো। ভ্রু কুচকে লোকটাকে চেনার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। তখনই খালেকুজ্জামান বাড়ির মহিলাদের হাঁক ছেড়ে বললেন,
-“কোথায় সবাই? কাজী সাহেব এসে পড়েছেন। বকুলকে নিয়ে আসো।”
ভ্রম এবার বুঝলো। লোকটা কাজী সাহেব। পা বাড়ায় ভ্রম। চৌকাট পেরোনোর আগেই ভ্রমের বাবা মুখ খুললেন। কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন,
-“কোথায় যাচ্ছো?”
বাবার কাঠকাঠ গলায় খানিকটা বিরক্ত হলো সে। চুপ করে হাঁটা ধরলো। তখনই নিয়ে আসা হয় বকুল কে। ভ্রম আবারো কি ভেবে যেন দাঁড়িয়ে যায়। হঠাৎ মস্তিষ্ক একটা প্রশ্ন জাগালো, ‘তুই চলে গেলে বিয়েটা কি তোর বাবা করবে?’ । থেমে যায় সে। কিন্তু এইখানে ডিরেক্ট দাঁড়ানো যাবে না। তাই কোনো একটা ছুঁতা ধরে বকুলের পাশ কেটে উপরতলায় চলে গেল।
বকুল কে ভ্রমের বাবার সামনে বরাবর সোফাটায় বসানো হলো। পড়নে তার গোলাপি, সবুজ কম্বিনেশনের কাঞ্জিভরম শাড়ি, খোঁপায় গোঁজা রজনীগন্ধার গাজরা, সরু ঠোঁটে নুড লিপস্টিক, চোখে কাজল। ভ্রমের বাবা মেয়েটাকে একনজর দেখে বললেন,
-“মাশা’আল্লাহ! কারো নজর না লাগুক আমার মেয়ের উপর।”
ভ্রমের বাবা রিনি বেগমের দিকে তাকালেন। গম্ভীর কন্ঠস্বরে শোধালেন,
-“তোমার গুণধর পুত্র কে ডাক দাও!”
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ভ্রমকে নিচে আসতে দেখা যায়। এগিয়ে যায় মা-চাচি রা। ভ্রমের হাতে একটা পাউচ। উদ্দেশ্য এইটা প্রমাণ করা যে সে পাউচের জন্যই ফের উপরে গিয়েছিল। পাউচের চেইন খুলতে খুলতে বাবাকে উত্তর দিলো,
-“আমি তো এই বিয়েটা করছি না মিস্টার খালেকুজ্জামান। আমি গেলাম!”
উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন বাবা। ক্ষেপলেন বোধহয়। মেজাজ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“বিয়েটা তাহলে করবে না?”
-“নো ওয়ে!”
ভ্রমের ছোট্ট উত্তর। ভ্রমের বাবা কিছু বললেন না। পুনরায় নিজ জায়গায় বসে পড়লেন। নাক,মুখ কুচকে কাজী সাহেব কে বললেন,
-“কাজী সাহেব, বিয়ে পড়ান আপনি।”
কাজী সাহেব বিব্রত হলেন। পাত্র বলছে বিয়ে করবে না আর বাবা বলছে বিয়ে পড়াতে। তিনি কি করবেন তা বুঝে উঠার আগেই ভ্রম আবারো জেদ নিয়ে বললো,
-“আমি তো করছি না এই বিয়ে।”
-“তো তোমাকে জোর কে করছে?”
-“তাহলে বিয়ে পড়াতে বলছো কেন?”
-“আমি বিয়ে করবো। তাই!”
খালেকুজ্জামানের কথায় সকলেই ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু বকুল স্বাভাবিক। কোনো রিয়াকশন নেই তার মাঝে। থাকার কথাও না। তখন যাওয়ার আগে খালেকুজ্জামান এই পরিস্থিতি সম্পর্কে তাকে অবগত করেছিলেন। ভাগ্য হারিয়ে নতুন পরিচিতি পাওয়ার জন্যই সে সবটা চুপ করে হজম করে নিচ্ছে। এই বিয়েটা ছাড়া তার বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। নাহলে ওরা তাকে মেরে ফেলবে।
চোখে ভেসে উঠলো মা-বাবার মৃত্যুর আগের দৃশ্য। যেখানে ঘটনাস্থলে সে দেয়ালের দরজাটায় লুকিয়ে ছিলো। সাথে সাথে নিজের দুহাত কচলাতে থাকে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস চালায়। তখনই শোনা গেলো কাজী সাহেবের কণ্ঠ। তিনি বিয়ে পড়াচ্ছেন। এক পর্যায়ে বলে উঠলেন,
-“বলো মা কবুল?”
বাড়ির সকলেই স্তম্ভিত। রিনি বেগম কেবল চোখের পলক ফেলে স্বামীর পানে চেয়ে আছেন। কি এমন কারনে তিনি এই মেয়েটা এ বাড়ির সদস্য করতে চাইছেন? মনের প্রশ্ন মনেই পড়ে রইলো। ভ্রম’র সহ্য হলো না। এই বয়সে মায়ের সুখ কেড়ে নেওয়ার মতো ভুল সে ছেলে হয়ে করতে পারেনা। মেনে না হয় নেবে ফুপুর প্ল্যান। এই ভেবে সে ব্যাগ টা ফ্লোরে ছুড়ে এগিয়ে যায় সামনে। ছেলের এমনটা করায় বাবা ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন। বাবার দিকে পরোয়া করলো না। সোজা কথায় বললো,
-“আংকেল, এই বিয়েটা হবে না। আপনি আমার জন্য কাগজ রেজিস্ট্রি করুন। বিয়েটা আমি করছি।”
কাজী সাহেব খালেকুজ্জামান আর তার ছেলের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। বাবা খানিকটা ভাব দেখিয়ে বললেন,
-“এখন বিয়ে করতে এসেছো কেন?”
-“আমার ইচ্ছে! বাবার বয়সী বাবা হয়েই থাকো। একদম দু’নম্বরি করবে না।”
খালেকুজ্জামান আর কিছু বললেন না। বাড়ির মহিলাদের ও অন্তর তৃপ্ত হলো। এদিকে বাবা প্রশান্তির হাসি হাসলেন। কেননা, সবটা তার পরিকল্পনা মাফিক ই হলো। অতঃপর বিয়ে পড়ানো হয় বকুল, ভ্রমের। বকুল সময় নিয়ে কবুল বললেও ভ্রম দ্রুত কবুল বলে দেয়। তাড়াতে নয় বরং বিরক্তি তে। বকুলের মুখে মলিন হাসি। অবশেষে সে মিসেস ভ্রম! মিসেস ভ্রম পদবী টা না জানি কতদিন তার সাথে থাকবে! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো তার।
-“কাজী সাহেব?”
-“হ্যাঁ বাবা বলো।”
-“বলছি যে, এই মেয়েটা এখন আমার বউ তো?”
-“হ্যাঁ, হ্যাঁ!”
ভ্রম উঠে দৌড়ে চলে গেলো উপরতলায়। বকুল থমকালো। ভ্রমের বলা কথাটা অন্যরকম হলেও হতে পারতো। চমকে উঠলো সে।নিজের এমন ভাবনায় অবাক হলো। তার তো আইডেন্টিটি প্রয়োজন ছিলো আর হয়েও গেলো। এবার বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
-“রিনি আমার সাথে ঘরে এসো। আর বিন্তি বকুল কে নিয়ে ঘরে যাও।”
•
ভ্রমের ঘরের দরজা লাগানো। ভেতরে সে ল্যাপটপে ইয়াদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। কথার এক পর্যায়ে সে বলে,
-“মামা! ওর নাম যদি বকুল না হয়ে কবুল হতো তাইলে আর এই নাকট টা করতেই হতো না আমার বাপ কে। নাম ধরে ডাক দিতাম সেও নিজের নাম উচ্চারণ করতো। ভেরি সিম্পল বিয়ে!”
ভ্রমের কথায় শব্দ করে হেসে উঠে ইয়াদ। হাসতে হাসতেই বলে,
-“যা বলেছিস না মামা? একদম!”
-“হু…”
ভ্রমের উদাসীন উত্তর। ইয়াদ হাসি থামিয়ে বললো,
-“বিয়েটা তাহলে করেই ফেললি। লাস্টে বাকি থাকলাম শুধু আমি!”
-“মজা নিস না একদম। এইসব জিনিস আসলেই বাজে।”
-“হ মামা, নিজে বিয়া কইরা তো সেই ফিল নিতাছো আর আমারে কও এইসব ভালা না। হুম…?”
-“আচ্ছা শোন, আমার বিয়ের কথা কাউকেই বলবি না।”
-“কেন কেন?”
– “কারণ জানতে হবেনা। না মানে না। মরে গেলেও কাউকে বলবি না।”
-“ওকে জান।”
-“হাফ লেডিসগিরি বন্ধ কর। আমি ডিস্ট্রাবড আছি।”
-“আচ্ছা। আসছিস কবে?”
-“আর কবে! আগামীকাল ই আসছি।”
-“আর আসতে হবে না রে তোকে।”
ইয়াদের কথায় ভ্রম জিজ্ঞাসু হয়ে তাকিয়ে রইলো। ইয়াদ হেসে বললো,
-“আমাদের হেড স্যার আমাদের গোটা টিম কে ময়মনসিংহে ট্রান্সফার করেছেন। এবার আমরা আসছি তোর কাছে।”
ভ্রম চুপ রইলো। কিছু বলার মতো খুজে পেলো না। বেছে বেছে সব ঝামেলাই কি তাকে পোহাতে হবে? কি জানি! ভেবেছিলো মেয়েটার থেকে দূরে থাকবে আর ছ’মাস পর ডিভোর্স দিবে আর এখন? ঝামেলা ওকে বাড়িতে দিয়ে গেল৷
-“আচ্ছা তোরা আয় সাবধানে।”
-“ঠিক আছে, তোর জিনিসপত্র’ও তো আনবো।”
-“আচ্ছা!”
•
রিনি বেগম অভিমানী মুখ করে তাকিয়ে আছেন ফ্লোরে। খালেকুজ্জামান সহধর্মিণী কে এক পলক দেখলেন। এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। নরন গলায় বললেন,
-“অভিমান করে না রিনু।”
-“তোমার তো বিয়ে করার শখ জেগেছে, যাও। বিয়ে করো। মেয়ের বয়সী কাউকে।”
সহধর্মিণীর এমন কথায় খালেকুজ্জামান হাসলেন। আর বললেন,
-“আমি তো আমাদের ছেলেকে চিনি। তাই না বলো? বকুল যে মেয়েটা আছে না? ওর বাবার কাছে আমি চিরঋণী। তাহলে ওর খারাপ সময়ে বাবা হয়ে পাশে থাকবো না।”
-“তাহলে ওকে বিয়ে করে?”
-“আরে পাগলী ওকে বিয়ে করতে বলা ঘটনা আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম তাই তখন চুপটি মেরে বসেছিলো। ওর ও একটা পরিচয় দরকার।”
-“কেন?”
-“ওর মা-বাবা সহ পুরো পরিবার সিলিন্ডার ব্লাস্টে মারা গিয়েছে। বেঁচে আছে শুধু ও। একদম এতিম। কোথায় যাবে বলো?”
-“কার কথা বলছো তুমি?”
-“ফারদিনের কথা মনে আছে? ”
-“হ্যাঁ! যিনি তোমার বেস্টফ্রেন্ড আর তোমাকে ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো?”
-“হ্যাঁ।”
-“কি হয়েছে ওনার?”
-“দুদিন আগেই তো বিজন্যাস ট্যুরে গেলাম না? সেখানে ফারদিনের সাথে দেখা। ওর বাড়িতে ওয়েডিং ফাংশন ছিলো। আমাকে খুব জোর জবরদস্তি করে নিয়ে যায় সেখানে। তারপর যাই। ফারদিন ওর মেয়ে বকুলের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো। মুহূর্তেই আমি আর বকুল একদম ফ্রেন্ড হয়ে যাই। মূলত ফারদিনের মতোই বকুল। আমরা বিকালে একসাথে বিলে গিয়েছিলাম শাপলার বেট তুলতে। ফারদিনকে সারপ্রাইজ দেবো বলে। কারন শাপলার বেট ওর অনেক পছন্দ ছিলো। সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু যখন শাপলার বেট নিয়ে ফিরলাম তখন কেবল জলন্ত্ব বাড়ি দেখতে পেলাম। আর….”
কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় টোকা পড়ল। খালেকুজ্জামান সাড়া দিলেন,
-“কে?”
-“ভাইয়্যা আমি। বিন্তি।”
-“ওহ, আসছি।”
স্ত্রীক্ব নিজের বাহু থেকে মুক্ত করে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
-“বকুল বলছিলো যে ওর আজ মেডিক্যাল রেজাল্টের দিন। রেজাল্ট কি হয়েছে সেটা ও দেখতে চাইছে।”
খালেকুজ্জামান খুশিতে আট্টিখানা হলেন। মেয়েটা মেডিক্যাল ও দিয়েছে। মনে মনে দোয়া করলেন যেনো মেয়েটার মেডিকেল হয়ে যায় আর যেনো এই মেডিকেলে ভর্তি হতে পারে। তিনি আর সময় নষ্ট করলেন না। দ্রত হাত্যে টেবিলের ল্যাপটপ টা নিয়ে রিনি বেগম কে ইশারা করে সাথে নিয়ে চললেন বকুলের ঘরে। তাদের পা অনুসরণ করলো ফুপু বিন্তি।
#চলবে