রেড হার্ট পর্ব-০৩

0
1

#রেড_হার্ট❤️
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
#পর্ব_তিন

অস্থির হয়ে বড়সড় রুমটায় পায়চারি করছে বকুল। বেশ চিন্তা হচ্ছে তার। ফুপু শাশুড়ি কে তো পাঠালো শশুড় বাবা কে খবর টা জানাতে। কিন্তু আদতেও কি তার মেডিকেলে চান্স হবে? মেডিকেল যে তার স্বপ্ন! আদর্শ ডাক্তার হওয়া তার লক্ষ্য। চান্স না পেলে তো পূরণ হবে না। বাবা-মা…

চমকে উঠলো সে। অপূর্ণ কথাটা পূর্ণ করলো মিনমিনিয়ে, ‘বাবা-মায়ের তো কত সাধ ছিলো আমায় তারা সাদা এপ্রোনে দেখবে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। রেজাল্টের দিনই বাবা-মা দুজনেই আল্লাহর কাছে। সে এগিয়ে গিয়ে বেলকনিতে পা বাড়ালো। দো’তলা থেকে আকাশ টা পরিষ্কার দেখাচ্ছে। বকুল সেদিক পানে তাকিয়ে থাকে। বাবাকে তার ভীষণ মনে পড়লো। তার পড়াশোনা নিয়ে মায়ের চেয়ে বাবা’ই বেশি সিরিয়াস ছিলেন। সেকেন্ড পজিশনে চলে গেলেও কেন প্রথম পজিশনে যেতে পারেনি, সেটার জবাবদিহিতা করতে হতো। বাবা তাকে সহ মাকেও খুব বকতো। তবে সপ্তাহ খানেক যেতেই আবার ঠিক হয়ে যেতো। আজ তার খুব ইচ্ছে হলো বাবা থাকুক। মেডিকেলে এলাও না হলে খুব করে বকুক। মারুক। মা এসে আগলিয়ে নিক। কিন্তু… মা-বাবা কয়েক ঘন্টা আগেই তাকে একা রেখে পালিয়ে গিয়েছেন। আচ্ছা.. শুধু কি তার মা-বাবা হারিয়েছে ? না’তো। গোটা এক পরিবার সে হারিয়েছে। দাদি বাড়িতে যখনই ফুফুরা ভাইয়েরা আসতো। তখনই সৌরভ ভাই তাকে ‘ডাক্তার আপা’ ছাড়া কথাই বলতো না। আজ তার রেজাল্টের দিন। পরিবারহারা। শুণ্য পথের পথিক

ভাবতেই তার শব্দ করে কান্না বেরিয়ে এলো। নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। কতক্ষণ ই বা নিজেকে দমিয়ে রাখা যায়? যেখানে সব হারিয়ে সে শূণ্য। খালেকুজ্জামান আংকেল না থাকলে কি তার পরিণতি হতো। অস্তিত্ব থাকতো তার? কিন্তু এই যে কাকতালীয়ভাবে সেখানে উপস্থিত থাকা, বিলের ছুঁতো ধরে বাইরে বেরিয়ে আসা এইগুলো সৃষ্টিকর্তার মতেই হয়েছে। নাহলে এ বাড়ির বউ সে হয় কীভাবে?

কান্নারা তার গলায় দলা পাকালো। মুখ চেপে ধরলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে অভিমানির সুরে বললো,

-“বাবা! ও বাবা! তোমার বকুল তোমাকে ডাকছে। শুনতে পাচ্ছো? নিজে তো আমায় ফাঁকি দিলে। খুব তো আমার রোজকার খাওয়ার শখ ছিলো তোমার। তাহলে একা করে কেন দিলে? খুব বকলেও তো তুমি আমায় প্রচন্ড ভালোবাসতে, তাহলে দূরে কেন চলে গেলে? দুদিন আগেও তো এক্সাম দিতে নিয়ে যাওয়ার সময় খুব করে বলেছিলে, ‘মেডিকেলে চান্স পেলে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’ আমি যখন বললাম যদি না পাই তাহলে? তখন তুমি বলেছিলে,‘না পেলে একটা খারাপ সারপ্রাইজ আছে।’ তাহলে এবার বলো, চান্স পেলে বা না পেলে সেই সারপ্রাইজ টা কে আমায় দেবে? তুমি খুব বাজে বাবা। নাহলে গোটা ১৮ বছর আমায় স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেই চলে যেতে? কক্ষনো’ই না। তুমি খুব খারাপ আব্বু!”

শব্দ করে কেঁদে উঠলো বকুল। হাটু ভাঁজ করে রেলিং ঘেষে বসে পড়লো। অসহায় লাগছে আজ তার। সে আজ সফল হলেও কেউ কিছু বলবে না আর বিফল হলেও কিছু বলবে না। আল্লাহ কেন তাকেও মেরে ফেললো না? কেনো তাকে বাঁচিয়ে রাখলো? আল্লাহ কি জানেন না যে সে বাবা-মা ছাড়া একা,নিঃস্ব!

দরজার সামনে এসে দাড়ালেন ভ্রমের মা-বাবা আর ফুপু। ফুপু দরজায় টোকা দিলেন। ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো না। এভাবে মিনিট দুয়েক পের হলো। ফুপু কিছু না বলেই ভেতরে ঢুকলেন। বাথরুম থেকে পানির টিপটিপ শব্দ হলো। অর্থাৎ বকুল বাথরুমে তাই ডাকের সাড়া দেয়নি। ফুপু এগিয়ে গিয়ে ভ্রমের মা-বাবা কে আনেন। বাবা বিছানায় বসে ল্যাপটপ টা অন করতে বসলেন। তখনই বাথরুমের দরজা খুলে বের হয় বকুল। টাওয়াল দিয়ে হাত-মুখ মুছছে সে। মনে মনে শান্তি পেলো। অন্তত তারা বুঝতে না যে বকুল কাঁদছিলো। মূলত যারা তাকে আশ্রয় দিয়েছে তাদের সামনে নিজের অসহায়ত্ব সে প্রকাশ করতে চায়না। তাই দরজায় টোকা পড়ার সাথে সাথেই সে বাথরুমে চলে গিয়েছিলো।

বিনীত স্বরে ভ্রমের বাবা কে বলতে লাগলো,

-“আংকেল…”

-“আমি জানি কি বলবে। তার আগে নিজের রেজাল্ট জেনে নাও। দুপুর পেরিয়ে রাত হতে চললো আর তুমি রেজাল্ট ই জানতে পারো নি!”

ভ্রমের বাবার এমন শাসনপূর্ণ আচরণে বকুল হাসলো। মুচকি হেসে টাওয়াল টা রেখে হাটু ভাঁজ করে ফ্লোরে বসে। আর ভ্রমের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“আমি রোল নাম্বার বলছি আংকেল, আপনি দেখুন।”

ভ্রমের বাবা কিছুটা থেমে বকুলের দিকে তাকাকেন। তারপর মুচকি হেসে ল্যাপটপে মনযোগ দিলেন। রোল নাম্বার সহ যাবতীয় তথ্য দিয়ে সাবমিট করা হলো। প্রথমবারে নেটওয়ার্ক ফেইল দেখালো । বকুল হাত মুঠ করে চোখ বন্ধ করে আছে। মেডিকেলে চান্স পাওয়া না পাওয়ার খবর শুনে সে হার্ট ফেইল করতে প্রস্তুত।

দ্বিতীয়বারে ভ্রমের বাবা ইনপুট দিলেন। বড় স্ক্রিন টায় বকুলের একটা ছবিসহ স্কোর এবং রেজাল্ট শো করলো। ভ্রমের বাবা কিছু বললেন না। চুপ থাকলেন। এদিকে ভ্রমের ফুপু আর মা’ও উঁকি দিয়ে রেজাল্ট দেখে নিয়েছেন। ভ্রমের বাবা ইশারায় তাদের না করলেন তাই তারা চুপ রয়ে যায়। মিনিট খানেক সময় পেরোনোর পরেও যখন ভ্রমের বাবার কোনো কথা বললেন না তখন বকুল মাথা তুলে চোখ খুলে তাকায়। ভ্রমের বাবা মুখটা পানসে করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। সে বুঝে ফেললো। মলিন হাসলো। বাবা-মায়ের কোনো ইচ্ছাই সে পূরণ করতে পারলো না। ব্যর্থ হয়ে গেলো সে। তাই বুলি ফুটিয়ে উপস্থিত তিনজনকে মলিন কণ্ঠে শোধালেন,

-“আমি জানতাম! এইটা হওয়ার ই ছিলো। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না! ছেহ!”

উঠে দাঁড়িয়ে যায় সে। হাঁটা ধরে বাহিরে যাওয়ার। যদিও সে বাড়ির কোনো কিছু সম্পর্কে অবগত নয় তবুও এই ঘরে আর মন টিকলো না। তখনই ভ্রমের ফুপু তাকে ধমকের সুরে শোধালেন,

-“এই মেয়ে! বেশি পাকা পাকা কথা বলো তুমি। আগে নিজের রেজাল্ট টা দেখে যাও।”

সে দাঁড়িয়ে যায়। চান্স পায়নি তো লজ্জার বিষয় এখন আবার স্বচোখে সেটা দেখবে? অসম্ভব! চোখে জল আসলো তার সেইসাথে তৃষ্ণাও পেলো। তাই শুকনো একটা ঢোক গিলে নিলো । ভ্রমের বাবা কে উদ্দেশ্য করে অশ্রুসিক্ত গলায় শোধালো,

-“আংকেল। প্লিজ ডোন্ট ইনসিস্ট মি। বাবা-মাকে তো হারালাম, স্বপ্ন আর এমন কি? আমি একটু বাহিরে গেলাম!”

কাজের মেয়ে আয়না এক মগ কফি হাতে ভ্রমের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে প্রবেশের জন্য সে দরজায় শব্দ করলো। সাথে সাথে অনুমতি পেলো। প্রবেশ করলো রুমে। ভ্রম বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করছে। আয়না কফিটা টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে গেল। ভ্রম তা বুঝে ফোনে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করে,

-“কিছু বলবে?”

-“ইয়ে…”

-“হুম। বলো।”

-“রাগ করবেন না তো ভাইজান?”

-“শিউর দিতে পারছিনা। বলে ফেলো।”

-“তাহলে যাই গা।”

-“এইটা আমার রুম। আমার অনুমতি নিয়েই রুমে প্রবেশ আর বাহির হবে। এখন ডিসিশন তোমার। এইখানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে কানে ধরবে নাহলে যা বলার তা বলে চলে যাবে।”

আয়না শুকনো ঢোক গিললো। না বলে উপায় নেই। ভ্রম ভাইকে যেমন ভয় পায় তেমন তার মুখোমুখি দাড়িয়েও সত্য কথা বলে দিব্যি ছুটে চলে যায়। আজও সেটা করবে। তাই বেশ জোরেসোরেই বলে উঠে,

-“আমার ভাবি কিন্তু দেখতে মেলা সুন্দর। একদম বক্কুল ফুলের মতোই। অনেক মাশা’আল্লাহ। আপনে কিন্তু জিতছেন ভাই।”

একদিকে কথা শেষ অন্যদিকে আয়না উধাও। পালিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। বেশ ধুরন্ধর মেয়েটা। কিছু বলতে নেবে তখনই কল আসে তার ফোনে। ইয়াদের কল। সময় নষ্ট না করে রিসিভ করে ফেলে। চোখ-মুখে বিরক্তি নিয়ে ইয়াদকে শোধায়,

-“কি হয়েছে ইয়াদ? এই টাইমে কল?”

-“আরে মামা, একটা নিউজ দিতে তোকে ভুলেই গিয়েছি। ”

ইয়াদের উৎফুল্লতায় ভ্রম খানিকটা ভাবুক হলো। পরক্ষণেই সময় নষ্ট না করে জিজ্ঞাসা করলো,

-“কি নিউজ ভাই?”

-“এবারে মেডিকেলের ব্রেকিং নিউজ পড়েছিস?”

-“না রে! এই বিয়ের চক্করে সব মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। সবে ফোনটা নিয়ে বসলাম আর তুই কল দিলি।”

-“আরে শোন না! এবারে মেডিকেলে গত চার বছরের রেকর্ড ভেঙেছে।”

-“ওয়াট? মানে তুই বলতে চাইছিস…”

-“হ্যাঁ, ভাই। এবারে মেডিকেলে ফার্স্ট হয়েছে একটা মেয়ে। আর সবচেয়ে দারুণ খবর হচ্ছে মেয়েটা ডিএমসি রেখে এমএমসি তে এপ্লাই করেছে।”

-“সিরিয়াসলি? হাউ ফানি! ডিএমসি রেখে এমএমসি!”

-“নিশ্চয়ই মেয়েটার মধ্যে কোনো স্পেশালিটি আছে।”

-“থাকতেই পারে। নাহলে এরম কাজ কেউ করে..?”

-“হুম!”

-“হুম।”

-“ওহ, তোকে মেয়েটার নামই তো বলা হলো না। মেয়েটার নাম হচ্ছে…. ”

টুট!টুট!
কলটা কেটে গেল। ভ্রমের ফোন অফ হয়ে গিয়েছে, চার্জ শেষ। ফোনটা হাতে রেখেই দু-তিনিবার কপালে ঠেকালো। নামটাও আর শোনা হলো না। কি আর করার! বিষাদ জীবনের বিষাদের অবসান ঘটাতে আয়নার বানানো কফির মগ টা হাতে নিয়ে বেলকনিতে গেলো। কফির মগে এক চুমুক দিয়ে খাওয়ার আগেই তা ভ্রমের কাশির জন্য পড়ে গেলো। বাহিরে রিপোর্টারদের হুলস্থুল। ঠেলাঠেলি করে মেইন গেইটে কোনো রকমে টিকে আছে। দূর থেকে আরো রিপোর্টার দৌড়ে দৌড়ে আসছে। আচমকা এমন পরিস্থিতি নজরে আসতেই তার এমনটা হল। অতঃপর চোখের পলকেই নরমাল একটা পরিবেশ মুহুর্তেই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে পরিণত হল। মাথায় প্রশ্ন জাগলো, ‘বাড়িতে হঠাৎ রিপোর্টার…. আচ্ছা বাবা কিছু করেনি তো?’

এই প্রশ্ন মাথায় আসার সাথে সাথে ভ্রমের সকল বিরক্তি উবে গেলো। মস্তিষ্ক গ্রিন কার্ড দিলো। ফাইনাললি মেয়ে চুরির অপরাধে তারা বাবা ওরফে সনামধন্য বিজন্যাসমেন খালেকুজ্জামান তালুকদার গ্রেফতার হচ্ছেন। আগামীকাল পেপারে প্রথম পৃষ্ঠায় তাহলে বাবার ভুড়িওয়ালা একটা ছবি আপলোড হবে। শিরোনামে থাকবে,‘মেয়ে চুরি করেছেন বাবার বয়সী খালেকুজ্জামান!’

কথাটা ভাবতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ভ্রম। মিনিট কয়েক হেসে নিলো, তারপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে নিজেকেই শোধালো,

-“যত যাইহোক নাটকে এটেন্ড হওয়া চাই।”

অতঃপর আর দেরি না করেই সে দ্রুত পায়ে দৌড়ালো। বাবার মানসম্মান ধ্বংস হওয়া যে সে নিচ চোখে দেখবে।

#চলবে?