#রেড_হার্ট❤️
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
#পর্ব_চার
বকুল একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। মা-বাবা কে হারিয়ে তার উপর তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ করে তা স্বচক্ষে দেখার ক্ষমতা তার হবেনা। একপ্রকার ভ্রমের বাবার কথাটা উপেক্ষা করলো সে। ফুপু বিন্তি বিরক্ত হলেন। মেয়েটা এমন কেন? বারবার বলা হচ্ছে রেজাল্ট টা নিজ চোখে দেখুক সে জায়গায় মেয়েটা কি করছে? বেয়াদবের মতো নিজের জেদ বজায় রাখছে। তিনি আর নিজাকে দমিয়ে রাখতে পারলেন না। ভ্রমের বাবার হাত থেকে ল্যাপটপ টা নিয়ে তার চোখের সামনে ধরে। সে বেখেয়ালি তে দৃষ্টি ফেলে ল্যাপটপে, সাথে সাথে দৃষ্টি স্থীর হয় মেরিট পজিশন এ। পিলে চমকে উঠলো তার। ফুপুর হাতের ল্যাপটপ টা নিজের কাছে নিয়ে নিলো। ল্যাপটপের স্ক্রিনে তার হিজাব পরিহিত ছবি শো করছে আর পাশেই স্কোর সাথে মেরিট পজিশন এবং এলোটেড কলেজ। স্কোর ৯৪, পজিশন ১, এলোটেড কলেজ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ। বিশ্বাস হলো না। চোখ কচলে নিলো। তাকালো উপস্থিত সবার দিকে। ভ্রমের বাবা-মায়ের মুখে মুচকি হাসি। খুশিতে কি বলবে ভাষা হারিয়ে ফেললো। এতোক্ষণ চোখের কোণের পানিটা টপ করে পড়লো ল্যাপটপের কি-বোর্ডের উপর। কেবল স্ত্রীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় ল্যাপটপে। মেয়েটা অনুভূতিশূণ্য হয়ে গিয়েছে একদম।
ভ্রমের বাবা কিছু বলতে আসবে ঠিক তখনই দৌড়ে আসে দারোয়ান। লোকটা এসেই হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলছে,
-“বাইরে গেইটে দেখেন গিয়া স্যার। রিপোর্টার রা হুলস্থুল লাগাইছে। মেইন গেইট পার করে ভেতরে এসে গেছে কিন্তু বাড়ির মেইন দরজা লাগাই দিছি। আপনে চলেন তাড়াতাড়ি। পরিস্থিতি খুবই বাজে।”
দারোয়ানের কথায় খালেকুজ্জামান কেবল মুচকি হাসলো। ‘চলো’ বলে দারোয়ানের সাথে নিচে যেতে উদ্যত হলো। আর ইশারায় বকুলকে আসতে বললো। বকুল কেবল অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে মাথা দুদিকে নাড়ালো।
•
“ হ্যালো এভ্রিওয়ান। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি মেডিকেলের গত চার বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে দেওয়া এইবারের প্রথম স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীর বাড়িতে। অনেক খোঁজা খুঁজির পর আমরা তার ঠিকানা জানতে পেরেছি। প্রাইভেসি নিরাপত্তায় তারা ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যে তারা’ই আমাদের সামনে আসবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আমাদের সাথে আপনারাও অপেক্ষা করুন। শীঘ্রই আমাদের মধ্যে সেই স্বর্ণযুবতী কে দেখতে পাবেন। ”
এইরকম করে নানা কথাবার্তা নিজেদের মতো বলা শুরু করেছে রিপোর্টার রা। তারা উৎসুক জনতা কে আরো উৎসাহী করে দিচ্ছে। ম্যাক্সিমাম রিপোর্টার রা লাইভে অবধি’ও এসেছে। এদিকে ভ্রম উপর থেকে বাহিরে রিপোর্টারদের দেখলো আর নিচে এসে সদর দরজা আটকানো দেখলো। নিশ্চয়ই তার বাবা পিঠ বাঁচাতে দরজা আটকে রেখেছেন? ভাবতেই হেসে দেয় সে। বাবার পিঠ খালি করার জন্য তো সে আছেই। মেয়ে চুরি করে তার সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া তাই না? এবার পালা তার। উচিত শিক্ষা দেবে এই জাতশত্রু বাবা কে। তাই আর দেরি না করে সে দরজা টা খুলে দেয়। সাথে সাথে রিপোর্টার রা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। সাথে সাথে প্রশ্ন আসে,
-“এই যে মিস্টার। আপনি বকুল আহমেদের কি হোন? যদি আমাদের সাথে শেয়ার করতেন। আমাদের জানার চেয়েও অধির আগ্রহে মুখিয়ে আছে উৎসুক জনতা। আর বকুল আহমেদ ই বা কোথায়? ওনাকে ডেকে দিন প্লিজ। আমরা ওনার ইন্টারভিউ নেবো।”
একজন রিপোর্টারের এমন প্রশ্নে বাকী রিপোর্টার’রাও স্বমস্বরে মতামত জানায়। তারপর আরো প্রশ্ন আসতে থাকে ভ্রমের কাছে। সে বোকা বনে গিয়েছে। সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। বকুল? এ আবার কোত্থেকে এলো? নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে শান্ত হয়ে মিডিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে,
-“আপনারা এক্সাক্ট কি কারনে এসেছেন সেটা বলুন।”
থেমে যায় হইহুল্লোড়। ক্যামেরা ভালোভাবে ফোকাস হয় ভ্রমের দিকে। এইসব মিডিয়া ক্যামেরা বেশ ভালোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারে ভ্রম। তাই তাকে এইসব কাঁবু করতে পারলো না। তবে প্রশ্নের তালে তালে একের পর এক ছবি উঠছে তার।
-“আরে। আমাদের আসার কারণ সম্পর্কে কি আপনি জানেন না? আমরা এখানে এসেছি এবারে মেডিকেলে ফার্স্ট হওয়া শিক্ষার্থী বকুল আহমেদের কাছে। প্লিজ ওনাকে আসতে বলুন।”
ভ্রম ভাবলো হয়তো তারা একি নামে গুলিয়ে ফেলছে। তাই হয়তো না জেনেই বস্তির মেয়েটাকে এইভাবে হাইপে তুলছে। এই ভেবে আবারো উত্তরে বলে,
-“দেখুন আপনারা যারা বকুল নামের মেয়েকে খুঁজছেন সে এখানে থাকেনা।”
অন্য রিপোর্টারের প্রশ্ন,
-“কেনো বিশ্বাস করবো আপনার কথা?”
-“কারনটা খুব সিম্পল। একটু মনে করলে আশা করি আপনারা আমাকে চিনতে ভুল করবেন না। গত পাঁচ বছর আগের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় প্রথম আমি’ই হয়েছিলাম। ইহান তালুকদার ভ্রম আমি। বর্তমানে এখন আমি ডিএমসি তে আছি। বাকীটা আপনারাই বুঝে নিন।”
ভ্রমের কথা শেষ হওয়া মাত্রই গুঞ্জন শুরু হলো উপস্থিত সকলের মাঝে। সত্যিই তো! তারাও খেয়াল করেনি ভ্রম কে। তারা নিশ্চিত হতে আবারো জিজ্ঞাসা করে,
-“বকুল তাহলে নেই এইখানে?”
ভ্রম কিছু বলতে নিবে তার আগেই তার বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। গম্ভীর কন্ঠস্বরে বলে,
-“জি, বকুল এইখানেই আছে।”
বিভ্রান্ত হলো উপস্থিতিরা। এগিয়ে এসে ছেলের পাশে দাড়ালেন খালেকুজ্জামান। তিনি বিভ্রান্তির সমাপ্তি করতে নিজ দায়িত্বে বললেন,
-“আমি খালেকুজ্জামান তালুকদার। বকুলের প্রেসেন্ট গার্ডিয়ান। বকুলকে আমি দুপুরের দিকেই আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। একটু প্রবলেম হওয়ায় আমরা ওর রেজাল্ট নিতে পারিনি। তবে কিছুক্ষণ আগে আপনাদের আসার আগেই আমরা বকুলের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত হই। আর ও হচ্ছে ভ্রম। আমার ছেলে। নামের মতোই সারাক্ষণ ভ্রমে থাকে। তাই ও এতোকিছু জানেনা। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন ও আসছেন”
মিডিয়া এবার শান্ত হলো খানিক। নিজেদের মতো করে চ্যানেলে আপডেট দিতে লাগলো। এদিকে ভ্রমের রাগ হওয়ার পাশাপাশি বিভ্রান্তি ধরা দিলো। মানে যে মেয়েটাকে সে একটু আগে বিয়ে করেছে সে মেয়েটাই তো বকুল। আর সেই কি এবারের রেকর্ড ভেঙেছে? মনের প্রশ্ন মনেই রইলো। বিশ্বাস হলো না তার। একটা বস্তির মেয়ে শেষ অবধি…
তখনই বেরিয়ে আসে বকুল। ইতোমধ্যেই তার ফেইস পরিচিতি পাওয়ায় রিপোর্টার রা তাকে চিনতে ভুল করলো না। রিপোর্টার রা হুড়মুড়িয়ে মাইক সামনে ধরে। একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে তারা আর বকুল কেবল মুচকি হেঁসে উত্তর দিতে থাকলো।
সবার প্রশ্ন শেষ। এবার প্রশ্নের কায়দা অন্যদিকে মোড় টানলো। অধিক কৌতূহলে একজন বকুলকে উদ্দেশ্য করে একটা প্রশ্ন করেই ফেললো,
-“আচ্ছা পার্সোনাল একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
-“জি,করুন।”
বকুলের মিষ্টি হেসে দেওয়া উত্তর।
-“এইটা তো আপনার ইন্টারভিউ। তাহলে আপনি এইখানে কনের সাজে কেন? এইটা কি আপনার কোনো ইচ্ছে নাকি অন্যকিছু? যদি একটু বলতেন।”
এতোক্ষণ বকুলের হাসি-খুশি মুখটায় আধার নামলো। কি জবাব দেবে এর? কোনো ভাষা তার শব্দকোষে নেই যা মিলিয়ে সে এইটার উত্তর দেবে। তাই সে চুপ করে রইলো কিন্তু রিপোর্টার রা থেকে নেই। তারা জিজ্ঞাসা করছেই। এদিকে ভ্রমের শরীরে ঘাম ছুটছে। রিপোর্টার রা তো ইতোমধ্যেই… ইতোমধ্যেই কি তারা তো লাইভ দেখাচ্ছে। আর মেডিকেল সম্পর্কিত কোনো তথ্য’ই তো ডিএমসি মিস দেয়না। এটা তো অবশ্যই দেবেনা। তাহলে কি সবাই জেনে যাবে মেয়েটা ওর বউ?
গলা শুকিয়ে আসলো তার। এ কেমন বিপত্তি রে বাবা। নাটক দেখতে এসে নিজেই জোকার হয়ে গেলো যে! বিরক্তিতে চ’ সূচক শব্দ বের হলো তার মুখ থেকে। কেন যে পন্ডিতি করে কথা বলতে গিয়েছিল কে জানে। এখান থেকে চুপচাপ চলেও যেতে পারবেনা। অপমান তারই হবে। কিন্তু বাবা মুখ খুললে তার অপমান নিশ্চিত। আগে এখানকার ইমেজ বাড়ানো দরকার, কমানো নয়।
তাই নিজ অবস্থান থেকে দ্রুত এগিয়ে বকুলের পাশে দাঁড়ায়। পিঠে হাত রেখে মুখে মুচকি হাসির রেখা টেনে উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে শুকনো ঢোক গিলে মিডিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“একচুয়ালি এক্সিডেন্টলি আমরা একটু আগেই ব,বিয়ে করেছি। ওর ব্যাপারে ওতোকিছু জানতাম না তাই প্রথমে ওরকম বিহেভ করেছিলাম। অন্যথায় সব ঠিক আছে।”
উপস্থিত সকলের মাঝেই উত্তেজনা শুরু হলো আবারো। যার থেকে রেকর্ড শুরু হয়েছিল সেই কিনা বিয়ে করেছে রেকর্ড ভেঙে দেওয়া মেয়েকে? হোয়াট আ কুয়েনসিডেন্স!
•
ডিনারে সকলেই একসাথে খেতে বসেছে। টুকটাক এটা ওটা নিয়ে কথা হচ্ছে। হঠাৎই খালেকুজ্জামান বকুলের অতীত নিয়ে কথা উঠালেন। তিনি মিসেস রিনি বেগম কে যতটুকু বলেছিলেন ততটুকু তাদেরকে বলে আবার বলতে শুরু করেন,
-“জ্বলন্ত বাড়ি দেখে কাউকে বাঁচাতে গিয়েও পারলাম না। অনেক ভেঙে পড়ে বকুল। ওকে শামলাতে শামলাতে ততক্ষণে চলে আসে পুলিশ। তাদের কে তদন্ত করতে দিয়ে চলে আসলাম বকুলকে নিয়ে। পুরো পরিবার ওখানেই জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। ওর দাদা-বাড়ি, নানা-বাড়ির সকলেই.. ”
বকুল ফুঁপিয়ে উঠলো। ভ্রম বাদে চমকে উঠলো সকলেই। ভ্রমের বাবা বকুলের হাতে হাত রাখলেন। আশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন।
-“এক পরিবার হারিয়েছো কিন্তু আরেক পরিবার যে পেলে? এই পরিবারকে ভালোবাসতে হবেনা?”
খালেকুজ্জামানের সাথে সাথে ভ্রমের মা,ফুপু, চাচি শ্বান্তনা দিলেন। তবে টু শব্দ করলো না ভ্রম। কিন্তু তেতে উঠলো তখনই যখন ফুপু আয়না কে আদেশ দেয়, ‘বকুলের একটা লাগেজ আছে, ওটা ভ্রমের রুমে শিফট করে দিয়ে আয়। কিচ্ছুক্ষণ আগেই ওটা হোস্টেল থেকে আনিয়েছি। ’
খাবার মাখতে মাখতে দাঁতে দাঁত চেপে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে,
-“ও কি আমার ঘরেই থাকবে বলে ডিসিশন নিয়েছো?”
-“অবশ্যই! তোমার বউ কার ঘরে থাকবে ভাবছো?”
বাবার একরোখা উত্তর। সাথে সাথে চেয়ারে লাথি মেরে উঠে দাঁড়ায় সে। ভাতের তালা টা জোড়ে ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে। কাচের থালা হওয়ায় সেটা ভেঙে যায় আর শব্দ হয় প্রকট। চিল্লিয়ে বলে উঠে,
-“আমি কি একবারো ওকে বউ হিসেবে স্বীকার করেছি? বলেছি ও আমার বউ? কেন ওকে জোড় করে আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছ?”
#চলবে?