#রেড_হার্ট❤️
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
#পর্ব_আট
আমরিনের মা-বাবার আবদারে অবাক হয়ে পারলো না ভ্রম। তার কাছে তার বন্ধুমহল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেই থেকেই আমরিনের প্রতি দায়িত্ববোধ ছিল, কিন্তু তা যে এই অব্দি এগোবে তা ভাবনার বাহিরে ছিল। কন্ঠে মার্জিত ভাবটা যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে আমরিনের মা-বাবা দুজনকেই উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করে,
-“আপনারা জানেন আমি বিবাহিত?”
ভ্রমের প্রশ্নে চমকে যায় আমরিনের মা-বাবা। ভ্রম কি তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলো? অতিরিক্ত চিন্তায় আমরিনের মা মুখ ফসকে কথাটা বলে দিলেন,
-“দেখো বাবা। তোমার অতীত নিয়ে আমাদের সমস্যা নেই। আমরা শুধু চাই আমার মেয়েকে তুমি বিয়ে করো। আমার মেয়েটা বেঁচে যাক! প্লিজ বাবা।”
মা সমতুল্য অন্য আরেক মায়ের কথায় ভ্রম কেবল মাথাটা উপর-নিচ করল। মুখে জোরপূর্বক হাসি রেখে পুনরায় তাদেরকে জিজ্ঞাসা করল,
-“আন্টি এইটাতো আমার প্রশ্ন না!”
আমরিনের মা যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল ভ্রমের কথাটা। তাই ইনিয়ে বিনিয়ে ওনি অনেক কিছু বলার চেষ্টা করল। শেষমেষ ধৈর্য হারা হয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল সে। মেজাজ তার ভীষণ চটে আছে। তবুও সে অপমাণ করতে নারাজ। অন্তত এই তার পারিবারিক শিক্ষা না!
-“আংকেল এবং আন্টি! আমি আপনাদের কে কি কিছু জিজ্ঞাসা করেছি?”
আমরিনের মা-বাবা পুনরায় চুপ করে গেলেন। পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভ্রমের দিকে তাকিয়ে আছে তারা। তাই সে আবারও তাদেরকে ক্লান্তহীনভাবে জিজ্ঞাসা করল,
-“আপনারা জানেন না আমি বিবাহিত? ”
-“হুম! জানি।”
আমরিনের বাবার দুই শব্দে এক বাক্যে উত্তর। সে পুনরায় চেয়ারে বসে পড়লো। তাদের দিকে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলো,
-“তাহলে?”
-“শোনো বাবা। জানি অন্যায় প্রস্তাব কিন্তু তুমি আমার কোল খালি করে দিও না। ও আমার কলিজার টুকরো। শূণ্যতা নিয়ে বড় হয়নি কখনো ও। তুমি প্লিজ ওকে ওটা দিও না।”
এইবারে চরম বিরক্ত হলো সে। মুখে ‘চ’ সূচক শব্দ বের করে আনলো। বললো,
-“লুক আন্টি আংকেল! আমি কখনো আপনাদের মেয়ে আমরিনকে কোনো আশা দিইনি। ইভেন ওর জন্য আমি ফ্রেন্ডশিপের এই অবধি যা যা করেছি সব বন্ধুত্বের খাতিরেই করেছি। ওকে আমি বন্ধুত্বের চোখে ছাড়া আর কোন চোখেই দেখি না।”
-“ঠিক আছে বাবা। আগে দেখোনি এখন দেখো!”
ভ্রমের চোখে মুখে অবিশ্বাসের রেখা ছড়িয়ে পড়ল। এ কেমন মা বাবারে! মেয়ে যাকে পছন্দ করে সে বিবাহিত তা জেনেও মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে ছেলের কাছে।
-“শোনো এমন তো না যে তোমাদের বিয়ের কয়েক মাস বা কয়েক বছর হয়েছে। এইতো সেদিন বিয়ে হল! এক কাজ কর তুমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে আমরিনকে বিয়ে করে নাও। আমার আমরিন সে মেয়ের মতো রেকর্ড না করতে পারলেও সে তোমার পর সেকেন্ড পজিশনে ছিলো। তার উপর আমার মেয়ে কোনো অংশেই কম না। তারপরেও তুমি কে……”
বিরক্ত হলো সে। এক হাত উচিয়ে,
-“থামুন প্লিজ!”
বলে থামিয়ে দিল। এবার সে বুঝতে পারছে কেন আমরিন বিগড়ে যাওয়া মেয়ে। নিজেকে আর দমিয়ে রাখলো না। কড়াকড়া কথা শোনাতেই মুখ খুললো,
-“আন্টি আপনার লজ্জা করেনা?”
ভ্রমের ক্ষ্রিপ্ত কন্ঠে বলা কথায় চমকালো মা-বাবা দুজনেই। সে তাদেরকে বলার সুযোগ দিলো না। নিজ থেকেই চোখ-মুখ কুচকে তাদের শোধালো,
-“আপনি তো একটা নারী। একজন নারী হয়ে তার সংসার ভাঙার জোগার করছেন? কীভাবে? মানলাম আমরিন আপনার একমাত্র মেয়ে, কিন্তু যার সংসার ভাংতে চাচ্ছেন সেও তো কারোর একমাত্র মেয়ে, তাইনা? আচ্ছা… এইটা বলুন! আপনাকে কেউ ছাড়তে বললে আপনি ছাড়বেন আপনার স্বামীকে?”
চুপ মেরে গেলো তারা। ফের প্রশ্ন ছুড়লো ভ্রম,
-“বলুন?”
কোনো কথারই উত্তর দিলেন না। শুধু ভাবুক ভঙ্গিতে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে। হাল ছাড়লো না সে। ফের,
-“ওর ব্যাকগ্রাউন্ড কিংবা সৌন্দর্য দেখে আমি বিয়ে করিনি। বিয়েটা ফ্যামিলির পছন্দে হয়েছে। তাই আপনার প্রথম লজিক ফেইল! দ্বিতীয় লজিক এই জন্য ফেইল কারন সে আমার দু’দিন কিংবা একদিন কিংবা এক সেকেন্ডের জন্য হলেও সে আমার স্ত্রী, আমার অর্ধাঙ্গিনী! কোনো ক্যারেক্টারলেস ছেলে আমি নই যে কেউ আমাকে ভালোবাসলেই তাকে ভালোবাসা উজার করে দেবো।”
বলে থামলো। রুমে কথাগুলো কেবল বাড়ি খেলো। ইয়াদও চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনছে। ভ্রমকে আজ তার অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন বন্ধুত্বের গন্ডি পেরিয়ে এই ভ্রম বোঝদার হয়ে উঠেছে।
-“আমি ছেলে। অনেকেই আমায় ভালোবাসবে, স্বাভাবিক! ভালোবাসতেই পারে। আর ভালোবাসা অপরাধ নয়। তবে কেউ ভালোবাসলেই যে আমার তাকে ভালোবাসতে হবে এই লজিকটা একদম ভিত্তিহীন! তাহলে পুরুষের পুরুষত্ব থাকলো কই? পুরুষের পুরুষত্ব তো এক নারীতেই প্রকাশ পায়। তাই নয় কি? ভালোবাসা সবাইকে দেওয়ার জিনিস নয়। এইটা অনেক যত্নের! ভেবে-চিন্তে নির্দিষ্ট – বিশ্বস্ত কাউকে দিতে হয়।”
ভ্রমের কথায় আমরিনের বাবার চোখ-মুখ কিছুটা শক্ত হল। তাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-“প্রস্তাব নাকোচ করছো?”
-“অবশ্যই!”
-“কারণ?”
-“আমার ঘরে বউ আছে। তাই!”
-“বউটাই যদি না থাকে?”
ভ্রু কুচকালো ভ্রম। উদভ্রান্ত মেয়ের উদভ্রান্ত বাবা কি ডেঞ্জারাস বকুলকে মেরে ফেলার চিন্তা করছে? মনে মনে ভেবে নিলেও বুলি ফুটিয়ে গলার স্বর উঁচু করে তাদের উদ্দেশ্যে বললো,
-“শুনুন আমরিনের বাবা, আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বউয়ের আগেও কেউ ছিলো না আর পরেও কেউ থাকবে না, সুতারাং আমার জীবনে বউয়ের অনুপস্থিতি থাকলেও বউবিহীন আমার নজর অন্য কোথাও যাবেনা। আমি প্রফেশনাললি ইহান তালুকদার ভ্রম। আর বাড়িতে বকুলের জামাই! বুঝেছেন? খুব ভালোবাসি আমি আমার বউকে। শি ইজ মাই হার্ট। #রেড_হার্ট❤️!”
এদিকে শেষের কথাটা শুনে কিছুটা ভিমড়ি খেলো ইয়াদ। শা–লা! গতকালই না ওকে বললো এই বিয়ে সে মানে না, বকুল যত যাই করে নিক না কেন ওকে বউ হিসেবে স্বীকৃতি দেবেই না, এখন মশাই একদম পাব্লিকলি নিজেকে বউপাগল প্রুভড করছে। কি সাংঘাতিক রে বাবা!
তখনই ইয়াদের হাতে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো। ফোনটা ভ্রমের। হয়তো কাজের কিছু। তবে ব্যাপারটা এখানে না ঘাটিয়ে ‘আসছি’ বলে রুম থেকে প্রস্থান করলো। এদিকে আমরিনের বাবা-মা তার কথা শুনলেন। প্রশ্ন করলো আমরিনের মা,
-“আংকেল থেকে হঠাৎ আমরিনের বাবা বলছো?”
-“আপনাকেও আমরিনের মা বলবো!”
-“চমকে উঠে তারা দুজনেই।”
ভ্রম এতক্ষনে মুচকি হাঁসলো। শান্ত চাহনি নিক্ষেপ করে উত্তর দিলো,
-“এতোক্ষণ আংকেল ছিলেন, কিন্তু আমার বউকে সরিয়ে দিয়ে নিজের মেয়েকে বসানোর সিদ্ধান্ত যখন নিলেন তখন থেকেই আমরিনের মা-বাবা হয়েছেন আপনারা। আমার আংকেল হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। কেননা আমার কোনো আংকেল’ই আপনাদের মতো বিবেক–হীন না! তারা কখনো তাদের মেয়েকে আমাকে বিবাহিত জেনেও লেলিয়ে কিংবা পশ্রয় দিতেন না।”
অতঃপর আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে থেকে ‘আসি’ বলে দ্রুত পায়ে সে জায়গায় ত্যাগ করলো। পেছনে পড়ে রইলো অবাককরা দুটি মুখ। আজকের পর হয়তো তারা নিজেদেরকে শুধরে নেবে আর নয়তো ভয়ানক পথের দিকে এগিয়ে নেবে।
•
হসপিটালের বেডে বসে এরকম আশ্চর্যজনক লাইভ বকুল দেখবে, তা দুঃস্বপ্নে কেন কল্পনাতেও ভেবে দেখেনি। চরম অবাকতায় থ হয়ে দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে আছে। ঘন্টাখানেক আগে আমরিনকে নিয়ে তৈরি হওয়া রাগ নিমিষেই উবে গেল।
দৃষ্টি ন্যাস্ত করলো হাতে থাক ফোনটার উপর। ‘Ihan Talukder Bromo’ আইডি থেকে একটা লাইভ করা হয়েছিলো। খানিক সময় আগেই লাইভ টা শেষ হয়েছে। হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত লাইভ সেটি! নাহলে হুট করে দৌড়াতে দৌড়াতে লাইভ শেষ করার মতো ছেলে তো ভ্রম না। সোশ্যাল ইমেজ তার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তবে একটা প্রশ্ন থাকেই! ফোনটা যার হাতে ছিলো সে যদি ভ্রম হয় তাহলে সোফায় খানিকটা এগিয়ে হাটুঁতে ভর দেওয়া ব্যক্তিটি কে? মুখ দেখা তো যায়নি। কিন্তু পোশাক-আশাক বলে দিচ্ছে লোকটা ভ্রম! এ-ও বোঝা গেলোনা কথাটা প্রকৃতপক্ষে কে বলেছে। ফোন ধরে রাখা ব্যক্তি নাকি বসে থাকা ব্যক্তি!
ওর স্পষ্ট মনে আছে আজ সকালে ভ্রম হোয়াইট স্কাই ব্লু কালারের চেক শার্ট আর জিনস পড়ে গিয়েছিলো। সুতারাং বসে থাকা ব্যক্তি টি ভ্রম। তখন বলা কন্ঠ টাও ভ্রমের মতোন ঠেকলো। আচ্ছা ভ্রম কি এগুলো কাউকে বলছিল নাকি অন্যকিছু?
অন্যমনস্ক হয়ে সে এইসবই ভাবছিল আর হাতের স্পর্শ লেগে প্রিভিয়াস লাইভ পুনরায় ওপেন হলো। কথাগুলো রিপিট হচ্ছে–
-“শুনুন আমরিনের বাবা, আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বউয়ের আগেও কেউ ছিলো না আর পরেও কেউ থাকবে না, সুতারাং আমার জীবনে বউয়ের অনুপস্থিতি থাকলেও বউবিহীন আমার নজর….”
চমকে গিয়ে ফোনের অফ বাটনে ক্লিক করে ফোনটা অফ করে ফেললো। ভীষণ লজ্জা লাগলো তার। গাল দুটো আবারো গরম হয়ে গিয়েছে। তখনই একটা নার্স প্রবেশ করে কেবিনে। মুচকি হেসে তিনি এগিয়ে আসছেন।
-“ম্যাম! আপনিই ভ্রম স্যারের ওয়াইফ #রেড_হার্ট?”
হকচকিয়ে গেলো বকুল। চোখ বড় বড় করে তাকালো নার্সের দিকে। নার্সটা মুখের হাসি প্রসারিত করে শোধালেন,
-“ আই মিন বকুল, রাইট? কি বলুন তো! ইতোমধ্যেই আমিসব সবাই ব্রেকিং নিউজ দেখে নিয়েছে। তবে আমি কিন্তু ওনার অনেক বড় ফ্যান! সত্যি বলতেই হয় আপনি কিন্তু খুব লাকি।”
#চলবে?