রেড হার্ট পর্ব-২১+২২+২৩

0
3

#রেড_হার্ট❤️
#পর্ব_একুশ
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা

বকুল, তার শশুড় আর শশুড়ের বন্ধু বাহিরে থেকে বাসায় ফিরেছে ঘন্টাখানেক হলো। এসেই শাশুড়ির অগোচরে আয়োজন করেছে অনুষ্ঠানের। ছোট খাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠান যাকে বলে। ভদ্রলোক খালেকুজ্জামান স্ত্রী’র জন্য নিয়েছেন লাল শাড়িতে সাদা সুতোয় ডিজাইন করা অসম্ভব সুন্দর দেখতে একটি শাড়ি। আর ওনার বন্ধু নিয়েছে একটা গোয়েন্দার বই। তবে বলা যায়, ভদ্রলোক নিজেও যেমন ডিটেকটিভ ঠিক তেমন উপহার’ই নিয়েছেন বন্ধুর বউয়ের জন্য বটে!

খালেকুজ্জামান তাড়া দিয়ে বকুলকে বলকেন,

“কিরে মা! আর কতক্ষণ? হাতে সময় আছেই তো দশ মিনিট!”

শশুড়ের কথায় বকুল চেয়ার ছেড়ে দাড়ালো। টেবিলে রাখা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট টা নিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে গেল। মুখের সামনে তুলে ধরে চোখের ইশারায় বুঝিয়েও ফের বললো,

“জি বাবা। আর মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে। যান তো আপনি! চট করে এই পাঞ্জাবী টা পড়ে আসুন তো!”

খালেকুজ্জামান বউমার কথায় অবাক হয়ে যান। অবাকের সুর বজায় রেখেই জিজ্ঞাসু হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,

“পাঞ্জাবী?”

মৃদ্যু হাসলো বকুল। বাবার হাত টা টেনে প্যাকেট ধরিয়ে দিল। তারপর বললো,

“বা রে! আমার মায়ের জন্মদিন আর আমার বাবা সাজবে না? মার্কেটে এইটা দেখেই মনে হয়েছিল যে পাঞ্জাবী টা আপনার গায়ে না পড়লে খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাবে। তাই তো মায়ের জন্য উপহার কেনার পাশাপাশি আপনার জন্যেও সামান্য একটা পাঞ্জাবী নিয়ে নিয়েছি। পড়বেন না?“

খালেকুজ্জামান সাহেবের চোখ’দুটো ছলছল করে উঠলো। কথাগুলো অল্প তবে এর গভীরতা যে বিশালে পরিণত হয়েছে! তিনি নিজের কাপাকাপা হাতটা বকুলের মাথায় রাখলেন। ধরা গলায় বললেন,

“খুব ভাগ্য করে তোর মতো মেয়ে আর বউমা দুটো’ই একসাথে পেয়েছি রে! আমি খুব ভাগ্যবান বল?”

“আহা! তা বলছেন কেন? আমি আমার এক মা-বাবা পরিবার হারিয়েও যে নতুন করে নতুন মা-বাবা আর পরিবার পেলাম, যত্ন কেন নেব না? আপনি তো আমার শশুড় কম, বাবাই বেশি!”

খালেকুজ্জামান এগিয়ে এসে বকুলের হাত দুটো ধরলেন।

“দিন যতই যাচ্ছে, তুই আমার মেয়ের অভাব পূরণ করে দিচ্ছিস মা। দোয়া করি খুব ভালো থাক। সবটুকু সুখ তোর হোক!”

“অনেক হয়েছে। এবার যাও তুমিও রেডি হয়ে আসো বকুল।”

ফুফু বিন্তি বকুলকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতেই এগিয়ে আসলেন এদিকপানে। পড়নে ওনার বকুলের দেওয়া লাল শাড়ি। যা দেখে বকুল বেশ উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“ মা-শা-আল্লাহ ফুপু। কি দারুণ লাগছে তোমায় দেখতে। বলো? কারো নজর না লাগুক!”

বিন্তি আলতো হেসে বকুলকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন মাকে সাজিয়ে এসেছি বারবার বলছে এই মধ্যরাতে কোথায় যাবো কোথায় যাবো। এবার তুমি গিয়ে সামলাও!

বকুল প্রতিত্তুরে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে মাথা দুলিয়ে এই ঘর থেকে প্রস্থান ঘটালো।
তারপর……

~~

“মোহনীয়তা ছাড়িয়ে বলছো মায়া করছি কেন? ভালোবাসা নয় এটা?”

ভ্রম বকুলের খুব নিকটে চলে আসলো। একপর্যায়ে ভ্রমের আঙুল স্পর্শিত হলো বকুলের গালে। তবুও দূরত্ব রইলো খানিক। ভ্রম সেটা বুঝতে পেরেই নিজের নতো ঝুকে এগিয়ে এসে সামান্য দূরত্ব টাও ঘুচিয়ে নিল। বকুল হাঁসফাঁস করতে লাগলো। ভ্রমের গা থেকে তীব্র অ্যালকোহলের গন্ধ আসছে। যা তার নাক ভেদ করে ঝাঝালো অনুভূতির সৃষ্টি করছে। তার পক্ষে সহ্য করা খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সামান্য সিগারেটের গন্ধ যে মেয়েটি নিতে পারেনা, সে কিভাবে পারবে এই গন্ধ কে আপন করতে।

এদিকে বকুলের নাড়াচাড়া ভালো লাগলো না তার। কণ্ঠস্বরে মৃদ্যু রাগ সংযোজন করে শোধালো,

“সমস্যা কিহ! নড়ছো কেন?”

এবার ভ্রমের মুখ থেকেও দূর্গন্ধ আসতে শুরু করলো। সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো।

“বলছি না দূরে সরুন? গা থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে!”

“উম! গন্ধ… গন্ধ বেরুচ্ছে? তা তো বেরোবেই আমি তো আর তোমার সন্তানের বাবা নই! তাই না বলো? সরবো না আমি, দেখি! তুমি কি করে আমাকে নিজের থেকে সরাও।”

বলেই আরেকটু কাছাকাছি গেল। বকুল দেয়ালের সঙ্গে সিটিয়ে থাকলো। খানিক সেকেন্ড দম আটকে নাক মুখ কুচকে বিরক্তিতে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ভ্রমকে ধাক্কা মারলো। বেশ কয়েকবার সেভাবে ধাক্কা দেওয়ার পর ভ্রমের শক্তি আর কুলোলো না। নেশাক্ত দেহখানি নিমিষেই সরে গিয়ে পড়ে যেতে নিল। কিন্তু সাথে সাথে আটকে দিল বকুল। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে যেভাবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল, ফের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েই নিজের কাছে শক্ত করে ধরে রাখলো। ততক্ষণে ভ্রম জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। নেতিয়ে পড়লো বকুলের কাধের ওপর।

ভ্রমের ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস বকুলের গলায় আছড়ে পড়ছে। তবে এতে আবেশের বিপরীতে বিরক্তি ধরা দিল। পুরুষ লোকের ভার যেমন কোনো সাধারণ নারীর পক্ষে বহন করা সম্ভব না। ঠিক তেমন বকুলের পক্ষেও অসম্ভব হয়ে উঠলো। না পেরে একটানে বিছানায় ছুড়ে দিল। ব্যাটা ভ্রম যে তাকে জড়িয়ে ছিল, তাও শক্তভাবে তা খেয়ালই ছিল না বকুল রাণীর মাথায়। যার ফলে সে নিজেও ভ্রমের সাথে সাথে বিছানায় গিয়ে পড়েছে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আজব ব্যাপার তো! নেশা করেছে নাকি নেশা ধরাচ্ছে। চুইংগামের মতো লেপ্টে কেন রয়েছে! মস্তিষ্কে প্রশ্নের বিপরীতেই সঙ্গে সঙ্গে ‘চ’ সূচক শব্দ তুললো আর বলে উঠলো,

“এই লোকটা’ও না! এই আমাকে ছাড়ুন। আপনার গার্লফ্রেন্ড আমরিন সামনে দাঁড়িয়ে। কেটে তো একদম কুচি কুচি করে দেবে। ছাড়ুন!”

বকুলের বেশ কয়েকবার ধমকে ভ্রম সাড়া দিল না। না পেরে যখন হাফ জিরোতে গেল। তখনই লক্ষ্য করলো ভ্রম বিরবির করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। নেশার ঘোরে নাকি মানুষ সত্য কথাই বলে, তাই আজ বোধহয় ভ্রম’ও সত্য কথা বলবে! সুতারাং মিস দেওয়া যাবেনা কোনোভাবেই। তাই বেশ আগ্রহ নিয়েই এগিয়ে গিয়ে ভ্রমের মুখের কাছে কান এগিয়ে নিল। বেশ খানিকক্ষণ পর কেবল সে এইটুকুই বুঝলো। ভ্রম একটা কথাই বলছে, ‘পর/কিয়া করিনি আমি! বিলিভ মি বকুল’।

হঠাৎই চিৎকারের আওয়াজ পাওয়া যায়। গলাটা আয়নার। চিৎকার টা খুব কাছ থেকেই শোনা যাচ্ছে! বকুল সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো সরানোর আগেই আয়না বলে উঠলো,

“আহারে আপা! থুক্কু থুক্কু। ভাবি। না কইয়্যা রুমে আইসা পড়ছি। ভুল হইয়্যা গেছে। কিন্তু কথাখান হইলো আপ্নেরা এগ্লা করবেন তো দরজা আটকাইবেন না? সবচেয়ে বড় কথা লাইট জ্বালাই রাখছেন কেন? আমি লাইট আর দুয়োর দুটোই দিয়্যা গেলাম। চালায়া যান। কেউ আম্নেগো বিরক্ত করিব না। আমি আয়না সুন্দরী ডায়না, নিজে খারোই থাইক্যা পাহারা দিমু, কেউ আসবার পাবো না। গেলাম আমি। গু আহিড আপামণি থুক্কু ভাবি।”

বলেই আয়না রুমের লাইট আর দরজা আটকে দিল। বকুল বেক্কল বনে গেল। ভ্রমের বিরবির করে বলা কথা শোনার চক্করে বকুল যেভাবে এগিয়ে গিয়েছিল, তাতে তার চুলগুলো সামনে এসে তার মুখমণ্ডল ঢেকে নিয়েছি। তবে কি আয়না এইটাকেই এইটা ধরে…! হায় খোদা! চিত্ত চিরে কয়েক গুণ হতাশা বেরিয়ে গেল। বেশ কায়দা করে নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে সে বেরিয়ে আসলো ভ্রমের কবল থেকে। ভ্রম তো ঘুমে কাদা! এবার সে কোমড়ে হু’হাত ঠেকিয়ে শত দুঃখ কষ্টেও ভ্রমকে গা/লি না দিয়ে পারলো না। মৃদ্যু আওয়াজ তুলে শোধালো,

“হাতির এক বছরের দামা দামা বাচ্চার ওজনের মতো একটা মানুষ। ওতো ওজন নিয়া ঘুমায়, হাটে কেমনে? ডাক্তারিই বা কেমনে করে? আরেহ! একটা জিনিস, ও যে মটকা তাইলে ওর ভুড়ি বাইর হয়না ক্যা? কোন গরুর ওষুধ ওয় খায়! আর ম/দ খেয়েছেন তো? সকাল হোক! আপনার’ও হচ্ছে আর আমড়া-টামড়া’র ও হচ্ছে!

চলবে ইন’শা’আল্লাহ।

#রেড_হার্ট❤️
#পর্ব_বাইশ
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা

আকাশ ভেদ করে বাহিরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ। সাথে তাল দিচ্ছে বকুল’ও। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র অশ্রু। মিহানের খারাপ লাগলো। জানলা ছেড়ে এগিয়ে এসে দূরত্ব ঘুচিয়ে ফ্লোরে হাটু ভাঁজ করে বসে পড়লো। বুঝতে পারলো এর অনুভূতি অনেক কষ্টের কিন্তু তার উপলব্ধি করার সামর্থ্য হলো না। কেবল শব্দ সাজিয়ে জিজ্ঞাসু হয়ে বললো,

“তারপর কি হলো?”

বকুল নড়েচড়ে বসলো। মিহানের কথায় বাস্তবে ফিরলো। এতোক্ষণ তার জীবনের অমূল্য অংশের ব্যাখ্যা দিচ্ছিলো ছোট্ট একটা পাখির কাছে। বোঝাচ্ছিল তার দুঃখ, কষ্টের গভীরতা। ছেলেটা তার কথা বুঝছে কিনা কে জানে! তবে কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনছে। যা তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে। যাকগে! সব চিন্তা বাদ দিয়ে বকুল মিহানের প্রতিত্তুর করলো,

“তারপর? অনেককিছু পরিবর্তন হলো। আস্ত একটা মানুষ হারিয়ে গেল জীবন থেকে, খোদা কাছের দু’জন কে নিয়ে নিলেন। আমার মামনি আর আব্বু কে! হয়ে গেলাম নিঃস্ব! এখন না আছে মা-বাবা আর না আছে শশুড় শাশুড়ি। আছো কেবল এই তোমরা!”

বকুল কথাখানা সমাপ্তি টানতেই রুমে প্রবেশ করলো ফুপু বিন্তি। হাতে তার উঁকি দিচ্ছে তেলের বাটি আর বোতল। তিনি নিঃসংকোচে এগিয়ে এসে বললেন,

“বকুল! আয় তো মাথায় তেল দিয়ে দিই, মাথা টা ঠান্ডা থাকবে। রাতে আবার শ্যাম্পু করে নিস।”

মিহানের সাথে বলা কথার প্রসঙ্গ ছেড়ে ফুপুকে উত্তরে বললো,

“এখন?”

ফুপু বাটি আর তেল দুটো বাড়িয়ে ইশারায় দেখালেন।

“তো আর কখন? মিহাদ উঠে গেলে পরে?”

“বাহিরে তো বৃষ্টি। মিহাদের যদি ঠান্ডা লাগে, অসুখ করে?”

ফুপু বকুলের কথার উত্তর দিলেন না। টেবিলের বুকে এটে থাকা চেয়ার টা টেনে সোজা বকুলের পেছনে বসলেন। বকুল বিছানাতে বসা ছিল। অতঃপর ফুপুর গম্ভীর সুরে মিহানের জন্য আদেশ,

“মিহান! মামির জন্য পিড়ি এনে দাও দ্রুত।”

আদেশ পেয়ে মিহান কালবিলম্ব না করেই ছুট লাগায় বাহিরে। ফুপু পূর্ণদৃষ্টি ফেলে বকুলের পানে অপলক চেয়ে রইলেন। হঠাৎই শান্ত পলক ফেলে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বলতে শুরু করেন,

“বকুল। আর কত অতীত কে আকঁড়ে থাকবে বলো? তুমি যা হারিয়েছো আমিও তা’ই হারয়েছি। কেবল সম্পর্ক টা একদমই নিজের, নিজের রক্তের।”

ছোট্ট মশারির ভেতর ঘুমন্ত মিহাদের দিকে একপল তাকান তিনি। আবার বলতে শুরু করলেন,

“ এই বংশের এই একজন ই আছে। মিহাদ! ওর অযত্ন করবে তুমি?”

ফুঁপিয়ে উঠলো বকুল। সে চায় না অতীত স্মরণ করতে। কিন্তু এই বৃষ্টির দিন এলেই তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় সব, বুকের তাজা ক্ষত আরোও তাজা করে দেয়। সব অশান্তি অশান্তি লাগে, চারিদিক টা মনে হয় কালো মেঘে ঢাকা। কোত্থাও কোনো শান্তি নেই। ভালোলাগা, ভালোবাসা নেই। বুকে চাপা মৃতের হাসি নিয়েই ফুপুকে প্রতিত্তুরে বললো,

“সে সাধ্যি আমার আছে ফুপু? যাকে ভালোবাসলাম, যার অস্তিত্ব গর্ভে নিলাম তাকে জানানোর আগেই সৃষ্টিকর্তা আমার থেকে তাকে কেড়ে নিলেন। মা-বাবার অভাব পূরণ যাদের দিয়ে করলাম, তাদের ও হারালাম! এখন আমি একে হারাবো? নাহ! না,না কখনোই না। জীবন দিয়ে আগলে রাখবো। ভ্রমকে ভালোবাসতে পারিনি তো তাতে কি হয়েছে, পুরোটা ভালোবাসা আমার মিহাদ সোনা পাবে।”

শেষের কথাটুকু একটু তৃপ্তিতার সাথে বললো বকুল। তখনই মোড়া নিয়ে হাজির হয় মিহান। জনাব খালেকুজ্জামানের খালাতো ভাইয়ের নাতি। নাম তার মিহান। বয়স হবে বারো-তেরো। শহরে তার বড় ভাইয়ের সাথে এখানে আসা। ভাই তো তার গুরুত্বপূর্ণ কাজে গিয়েছে যে জন্য এখানে তার একাই থাকা। এসেছিল ময়মনসিংহ শহর টা পুরো ঘুরে দেখবে। কিন্তু এখানকার তিক্ত অতীত তাকে বিষিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। এইতো কিছুক্ষণ আগেই বকুলের সাথে এইটা ওইটা গল্প করছিল। কথার প্রেক্ষিতে যখন বকুল অসত্য কথাটি প্রকাশ করে ফেলে। তখনই কৌতূহলী মিহান তাকে চেপে ধরে। ছেলেটা বাড়িতে এসেছে তিনদিন। তিনদিনের দুদিন সময় লাগিয়েছে সবাইকে আপন করে নেওয়ার জন্য। থাকবে আরো চারদিন। অথচ সে হেলদোল নেই। ভাব জমিয়েছে ফুপু বিন্তির সাথে, খুনসুটি তে মেতে থাকে আয়নার সাথে। বলা যায় মৃত বাড়ি তার স্পর্শে একটু প্রাণ পেয়েছে। তাইতো ফুপু বিনা দ্বিধায় ওমন ফরমায়েশ দিয়ে দিলেন, আর ছেলেটাও বাধ্য হয়ে মেনে নিল।

মিহান মোড়াটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিয়ে দাড়ালো। ফুপু বললেন,

“অনেক তো দুষ্টুগিরি হলো! এবার যাও পড়তে বসো? আয়না কে নিয়ে বসো। আমি আসছি। মেহমান বলে কিন্তু ছাড় পাবেনা! ”

মিহান হাসিমুখে আচ্ছা বলে তা ধিন তা না তা ধিন তা না গাইতে গাইতে বের হলো৷ এখানকার মানুষ, আবহাওয়া, পরিবেশ সবই তার মনে ধরেছে। এতোদিনে দাদু তবে ভালো একটা জায়গাতেই পাঠিয়েছেন। তার বাসায় তো ভাইয়া সব সময় কড়া শাসনে রাখে, মা-বাবা তাদের কাজের সূত্রে দেশের বাহিরে বাড়িতে কেবল দাদু আর সে। যা একেবারেই বোরিং টাইম। কিন্তু এইখানে সে মানিয়ে নিতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় কথা তাকে সবাই তার মতন করেই এক্সেপ্ট করে নিচ্ছে, সেইসাথে সেরকম ভাবে ট্রিট ও করছে। মিহানের বোধগম্য হয়না কেন যে এই লোকগুলোর জীবন থেকে মানুষ হারিয়ে গেল। নিশ্চয়ই নিঃসন্দেহে মানুষগুলো কত্তো ভাগ্যবান ছিল?

“ফুপু?”

বকুলের আমচকা ডাকে ফুপু কান খাড়া করলেন।

“বলো।”

“আমরিন এরম টা করে কি পেল বলো? ও নিজেও এই পৃথিবীতে নেই। আমি কার থেকে কি নেব বলো? কোথায় দুঃখ আটবো? ওর বেশি বাড়াবাড়ির কারণে এলোমেলো হয়ে গেল আমার জীবন। নাহলে আমাদের সুন্দর একটা সংসার হতো, অস্বাভাবিক নিয়মে মা হতাম না যদিও এই নিয়ে আফসোস নেই কিন্তু লোকটার সাথে জনমের পর জনম কাটানোর এক আমরণ তৃষ্ণা রয়েছে!”

ফুপু ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। ভাইছেলে কে হারিয়েছেন একবছর হলো। বুকে কষ্ট তিনি চেপে রাখেন কেবল বকুলের সার্বিক দিক ভেবে। নাহলে স্বজন হারানোর দুঃখ কি একান্তই বকুলের। নাহ! তারও! সেদিন তার ভাবির জন্মদিন ই ছিল তাদের শেষ দিন। একই সাথে হামলে পড়া হয় বকুলের ওপর আর বাড়িতে সেট করা হয় বোম! ফলস্বরূপ তারা পায় এক অকল্পনীয় ভয়ানক উপহার। যা বয়ে বেড়ানোর বয়স হয়েছে এক। বকুল বৃষ্টির দিন এলেই নিজেকে একাকি করে দেয়। অতীত তাকে সেই মুহূর্ত গুলো বারবার স্মরণ করে দেয়।

ফুপু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকায় আরাম বোধ করলো সে। বাহিরের বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর দিকে একপল তাকিয়ে চোখ বুঝে নিল। অনিচ্ছা সত্ত্ব্বেও ফিরে গেল অতীতে।

ভ্রম নেশা পান করায় ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। যা আমরিন জানতো না। ভ্রম কে মেসেজ যখন দিয়েছে তখন রিপ্লাই পায়নি। তাই ভেবেছে সে হয়তো বাহিরে। তাই এই মুখ্যম সুযোগ কাজে লাগায় আমরিন। প্রথমে খু/ণ করে তাকে হেল্প করা ডাক্তারটিকে আর তারপর চেষ্টা চালায় বকুলের ওপর। ওকে তিলে তিলে মারতে আগে গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করার ফন্দি আটে। সিড়িতে তেল ফেলে রাখে। আর বকুল পা দেওয়া মাত্রই গড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে। যা দেখতে পায় আয়না। সে ডেকে এনে দ্রুত বিন্তি কে জানায়। ফুপু জনাব খালেকুজ্জামান কে ডাকতে বললে আয়না জানায় ওনার আর রিনা বেগমের রুমের দরজা আটকে দেওয়া। বকুলের ও পেইন হচ্ছিল খুব। তাই তাদেরকে বিরক্ত না করেই দায়িত্ব নিয়ে চলে যায় হসপিটালে। আমরিনের কাজ’ও হয়ে যায়। আর সে বোম সেট করে। কিন্তু বিপত্তি বাধে তখন, যখন টাইমারে ১ মিনিট সেট করতে গিয়ে ০.১ সেকেন্ড সেট করে ফেলে। ফলস্বরূপ সে সহ বাড়ির সকলেই ব্লাস্টে মা/রা যায়। পরবর্তীতে পুলিশ আসলে দুটো বডির কঙ্গাল উদ্ধার করে নিয়ে যায়। যার একটি পুরুষ ও অপরটি মহিলার। কিন্তু থাকার কথা ছিল দুটো পুরুষ আর একটা মহিলার। আর এ থেকেই বোঝা যায় রহস্য আটকে রয়েছে কোথাও। বকুল আবার যাবে সে বাড়িতে। নিরুদ্দেশ হওয়া অতীত কে টেনে হিচড়ে গর্ত থেকে বের করবে। কিন্তু কোলের সোনাবাবু টার জন্য সে পেরে উঠছেনা। নিজেকে সময় দিচ্ছে আর রহস্য কেউ!

চলবে ইন’শা’আল্লাহ।

#রেড_হার্ট❤️
#পর্ব_তেইশ
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
“মামণি! ও মামণি! মামণি?”
বাহিরে থেকে সারাফাত এসেছে। শহরের কাজ তার শেষ। আর এসেই সোফায় ব্যাগ টা রেখে এইভাবে হাকডাক করছে। বিন্তি ছিলেন উপরের তলায়। মিহান কে গোসল করিয়ে এলেন। সারাফাতের গলা পেয়েই,
“কি হয়েছে রে! এতো চেচামেচি কিসের। বাহির থেকে এসেছিস, আগে বোস। তারপর তোর সব কথাই শুনছি।”
বলতে বলতে নিচে নামলেন। তখনই হাজির হয় স্বয়ং মিহাদ। ফ্রিজ থেকে ম্যাঙ্গো জুস নিয়ে ভাইয়ের বরাবর বসে।
“এসেই হাতামি শুরু করেছিস? এইজন্যই আজ আমার দিনটা ভালো যাবেনা। ”
বিচ্ছুর কথায় প্রতিত্তুর করলো না সারাফাত। বিন্তি এসে তার হাতে শরবতের গ্লাস টা ধরিয়ে দিলেন। গতকাল বৃষ্টি হয়ে আজ কড়া রোদ উঠেছে। ঘেমে নেয়ে সকলের অবস্থা একাকার! সারাফাত এক চুমুকে সেটা পান করে নিল। নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিজেকে থামিয়ে নিল। উঁকিঝুঁকি দিয়ে রুমগুলো চেক করে নিল। কাঙ্খিত মানুষ টি কে পাওয়া গেল না। এগিয়ে না গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। বিন্তি এটা ওটা ঠিক করছেন।
“মামণি? চ্যাম্প কোথায়? ”
বিন্তি একপলক সারাফাতের দিকে তাকালেন। ফের কাজে মনযোগ দিয়ে উত্তর দিলেন,
“আর কই! মায়ের কাছেই। আজ ছেলেটার শরীর ভালো নেই। বোধহয় জ্বর-টর আসবে। যা গিয়ে দেখে আয়।”
সারাফাত আর প্রতিত্তুর করলোনা। সময় নষ্ট না করে উপরে যাবার জন্য পা বাড়ালো।

উপরে উঠতেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ দৃঢ় হলো। আওয়াজ টা মিহানের। সারাফাত দ্রুত পা চালালো। রুমে প্রবেশ করতেই যা ভেবেছিল তাই হলো। মিহান এক নাগাড়ে কেদেই চলেছে। থামবার নাম নেই। আর অধৈর্য মা ধৈর্য নিয়ে তাকে থামানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই কয়দিনে সে বাহিরে থাকলেও বছরে আনাগোনা করেছে অনেকবার। সে থেকেই মিহানের প্রতি সে অন্যরকম একটা টান অনুভব করে। ভালোবেসে সে তাকে চ্যাম্প ডাকে। তবে তার আর মিহানের সম্পর্ক টা যতটা গভীর তার থেকে খুব সামান্য গভীর মিহানের মায়ের সাথে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয়না দু’দণ্ড!
“চ্যাম্প! কি হয়েছে আসো আমার কাছে। বকুল বাবুকে আমার কাছে দাও।”
পরিচিত এক কণ্ঠস্বর শুনে বকুল পেছন ফেরে তাকায়। যাকে ঠাহর করেছিলো সে’ই! পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বোকাসোকা চাহনি দিল। আর ওদিকে মিহান কেঁদেই চলেছে। সারাফাত বুড়ো আঙুল কপালে ঘষলো। কালবিলম্ব না করে নিজ দায়িত্বে মিহান কে নিয়ে নিল।
আর অসম্ভব এক ঘটনা ঘটনা ঘটলো। মিহানের কান্না সাথে সাথে থেমে গিয়েছে। চোখ দুটো তার টলমল করছে, ঠোঁট গুলো লালচে হয়ে গিয়েছে। সারাফাত তার নরম তুলতুলে হাতখানা নিজের গালে লাগালো। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে মিহান বোধহয় ব্যাথার পরিবর্তে আনন্দ পেল। খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো। তারপরই খিলখিলানো হাঁসি। ছেলেটা হয়েছে পুরো ভ্রমের মতোন!
সারাফাত মিহানের কপালে হাত রাখলো। খানিকটা উষ্ণ অনুভব করলো সে। বকুলকে উদ্দেশ্য করে শোধালো,
“বাবুর মনেহয় জ্বর হবে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।”
বকুল সারাফাতের কথাটা শুনলো। কিন্তু প্রতিত্তুর করলো না। বিছানায় রাখা লোশনের বোতল টা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলে রাখতে রাখতে ছোট্ট করে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে। সন্ধ্যায় যাবো!”

সারাফাত আর মিহাদ। সম্পর্কে তারা ভাই। বিন্তিদের বাড়িতে সে অনেকবার আসলেও মিহাদ এলো প্রথম। এতোদিনের আনাগোনা তেও বকুল তাকে কেন যেন পছন্দ করেনা। তার কাছে মনে হয় সারাফাত ছেলেটা তাকে এক্সট্রা কেয়ার করে। মিহানের কাছাকাছি আসে। এইযে না বলে রুমে ঢুকে পড়া, যখন-তখন মিহান কে নিয়ে নিজের রুমে থাকা, এইসবই তার কাছে রহস্য রহস্য লাগে। লোকটা পেশায় একজন psychiatrist. তবুও ছুটি নিয়ে ময়মনসিংহে ছুটে আসা ভালো লাগেনা তার। মনে হয় লোকটা তার জন্যই আসে। কিন্তু কেন!
আর ওনি এমন সময়ই যোগাযোগ করা শুরু করেছেন, যখন তার মিহাদ তার কোলে আসে। কিন্তু ওতো কিছুর সাথে ওনাকে কেন ও পেচাচ্ছে! আনমনেই নিজেকে বকে নিল বকুল। যতসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা তার! মিহাদ আর সারাফাত চলে গেলেই সে রহস্য উন্মোচন করতে রওয়ানা দেবে। বাবু নাহয় কয়েক ঘন্টার জন্য থাকবে বিন্তি ফুপুর সাথে।
অতঃপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো ধরণীর বুকে। সারাফাত মিহান কে নিয়ে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। বকুলের জন্য অপেক্ষা করছে তারা। এখনো ও রেডি হচ্ছে। ফুপু বিন্তি এসে সারাফাতের পাশে বসলেন। কোলে থাকা মিহানের হাতে আঙুল রেখে এটা সেটা বলতে লাগলেন। মিহান ও নতুন নতুন সব আওয়াজ করছে। তখনই আসে মিহাদ। হাতে তার খুন্তি। সারা শরীরে বালি মাটি লেগে আছে। প্রচণ্ড উৎফুল্লতায় বিন্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ভাইয়ার মামণি আর আমার খালামণি, তোমার বাগান আমি আর আয়না আপু মিলে ঝকপক তকতক করে দিয়েছি। এবারের মতোন তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম!”
মিহাদের কথা শুনে বিন্তি ঘার বাকিয়ে তাকায়। তারপর আয়না কে উদ্দেশ্য করে শোধায়,
“কি? তুই মিহাদ কে কেন এইসবে ঢুকিয়েছিস? ও আমাদের অতিথি না?”
আয়না প্রতিত্তুরে কিছু বলার আগেই মিহাদ ফের বলে উঠে,
“মামণি! নো বকা, অনলি হ্যাপি হ্যাপি! আমি গোসলে যাই। ”
দস্যিপনা স্বভাব নিয়েই মিহাদ ছুটে চললো নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে। অতঃপর বকুল এসে হাজির। ফুপুকে দেখে বলে উঠে,
“ফুপু? রেডি হওনি! ডাক্তারের কাছে যাবো না আমরা? আমি কি একা মিহানকে শামলাতে পারবো?”
“বোকা মেয়ে! আমার বাড়িতে একটা স্পেশাল কাজ আছে। তুই আর সারাফাত ডাক্তারের কাছে গিয়ে আয়। আমি, আয়না আর মিহাদ বাড়িতেই আছি!”
“আরে…”
বকুলের নাক-চোখ কুচকানো কথার সমাপ্তি টানার আগেই ফুপু বিন্তি কড়া গলায় আদেশ দিলেন।
“কিছু শুনতে চাচ্ছিনা। তাড়াতাড়ি বের হও! মিহানের শরীরে জ্বর টা ভালোভাবেই ছাড়িয়েছে। দেরি করা যাবেনা। দ্রুত যাও। ”
অতঃপর শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বকুল সারাফাত লোকটির সাথে ছেলেকে নিয়ে হসপিটাল গেল।

ডাক্তার সাহেব মিহানের কপালে হাত রেখে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে নিলেন। বেশ ভালোই জ্বর এসেছে ছেলেটার গায়ে। ডাক্তার স্টেথো টা গলায় ঝুলিয়ে বকুল আর সারাফাতের উদ্দেশ্যে বলেন,
“ওর তো ভালোই জ্বর এসেছে। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি ওগুলো খাইয়ে দেবেন। আর এখনকার জ্বর তো একদম ভাইরাসের মতোন। আপনি তো একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট, আই হোপ আপনি কিছুটা হলেও বুঝবেন। ”
বকুল প্রতিত্তুরে মাথা নাড়ালো। বললো,
“ঠিক আছে। তবে আরেকটা বিষয় জানানোর ছিল। জি বলুন! মিহান দু’মাস ধরেই সময়ে-অসময়ে কান্না করে। কিন্তু এর আগে কখনোই এমন হয়নি। তবে ও ওনার কাছে যাওয়ার সাথে সাথে কান্না থামিয়ে দেয়। এটা কি কারণে হতে পারে?”
ডাক্তার সাহেব কিছুটা ভাবুক হলেন। কিছু সময় পর বলে উঠেন,
“ বাবা তো, তাই বাবার কাছে গেলে থেমে যায়। ”
এমন কথায় হকচকিয়ে গেল বকুল। হালকা কেশে উঠলো সারাফাত। বকুল প্রতিত্তুরে জোরপূর্বক হেসে বললো,
“না নাহ! ওনি ওর বাবা নয়। একচুয়ালি ওনি ওর বাবার কাজিন। ওর বাবা আমাদের মাঝে আর নেই!”
“ওহ! আ’ম এক্সট্রিমলি সরি। তবে.… যেহেতু এই টাইমে বাচ্চারা বাবার প্রতি আকর্ষণ বেশি দেখায় সেজন্য ও ফাদার ফিগার পেয়ে শান্ত হয়ে যায় আর প্রয়োজন অনুযায়ী না পেলে কান্নাকাটি করে।”
ডাক্তারের ছোট্ট উত্তর। অথচ ভেতর ভেতর বকুল শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে কি সে মিহান কে বাবার অভাব পূরণ করে দিতে পারছেনা? সে কি ব্যর্থ মা?
চলবে ইন’শা’আল্লাহ।