রোদরঞ্জন পর্ব-১২+১৩

0
194

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১২
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য]

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
ইনান রুমে নেই। বাড়িতে আসামাত্র যে ইফাজ সাহেবের সাথে কথা বলতে গিয়েছে এখন অবধি আসার নাম নেই। জেহফিল দোতলায় ইনানের মাঝারি সাইজের রুমটায় ভূতগ্রস্তের ন্যায় ঘোরাফেরা করছে। ইনানের বেডরুমে একটা খাট, পড়ার টেবিল, ড্রেসিং টেবিল আর ওয়ারড্রোব ছাড়া কিছুই নেই। সে ইনানের ড্রেসিং টেবিলে রাখা প্রতিটা জিনিসের নাম মুখস্থ করছে আর ছবি তুলছে। যাতে ইনানের সব মেকআপের জিনিস কিনে দিতে পারে। তার মেয়েদের সাজগোজের জিনিসপত্র সম্পর্কে আইডিয়া নেই।

পড়ার টেবিলও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। তখন চোখ যায় কালার পেপার মুড়ানো ভিন্টেজ একটা ডায়েরীতে। ডায়েরীটা সবার নিচে, প্যাকেট খুলে ডায়েরীটা খোলার সাথে সাথেই কতগুলো ভাঁজ করা কাগজ তার পায়ের উপর পড়ল। জেহফিল একটা কাগজ উঠিয়ে খুলতেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কাগজে লেখা ‘ভালোবাসি’। সবগুলো কাগজ খুলে একই লেখা দেখতে পেল। এই একটা ওয়ার্ড ছাড়া আর কিছুই নেই। না লেখা কে লিখেছে এটা। শুধু তাই নয়, ডায়েরীর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তও এই একই কথা লেখা। হলদে কাগজটা মুহুর্তেই দুমড়ে মুচড়ে গেল জেহফিলের হাতের মুঠোয়। পকেটে পুড়ে আবারো তদন্ত চালালো ইনানের পড়ার টেবিলে। সন্দেহজনক তেমন কিছুই পেল না। ইনানের ঘরের ছোট বড় যত আসবাবপত্র আছে সবগুলাতেই জেহফিল তীক্ষ্ণ চোখে তল্লাশি করল।

.

.

ড্রয়িং রুমে ইফাজ বসে ছিলেন। হাতে তার খবরের কাগজ। জেহফিল এসে ইফাজ খানকে একা বসে থাকতে দেখে সারা ঘরে চোখ বুলায়। জেহফিলের উপস্থিতি টের পেয়ে ইফাজ জেহফিলের দিকে তাকান। জেহফিলের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি দেখে ইফাজ চট করেই বুঝে যান ও কী খুঁজছে।

‘ইনানকে খুঁজছো?’

জেহফিল ইফাজ খানের দিকে দৃষ্টিপাত করে। মৃদু হেসে পাশের সোফাতে গিয়ে বসে।

‘জি।’

‘বাইরে ফুটবল খেলতে গেছে।’

জেহফিল ভ্রু কুঁচকে বাইরে তাকাল, হালকা বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে ইনান খেলতে গেছে? তাও আবার ফুটবল? কাদের সাথে? ছেলে না মেয়ে? এলাকার বড় বড় ছেলে নাকি? ইনান খেলার সময় সবাই কি তার দিকে নজর দিয়েছে? ইনানের হাসিমুখ দেখে কি ছেলেরা মুগ্ধ হয়েছে? এসব ভাবনা আসতেই জেহফিলের মাথা দপদপ করে জ্বলা শুরু করে। ইনানকে খোঁজার উদ্দেশ্যে সোফা থেকে উঠতে নিবে এমন সময় মেইন দরজা খোলার আওয়াজ হয়‌। ইনান এসেছে, একহাতে ফুটবল আরেকহাতে কপাল ডলতে ডলতে ঘরে ঢুকছে। পরনের জার্সি আর প্যান্ট কাঁদায় মাখামাখি।

ইনানের মুখ গম্ভীর।‌ চোখ নিচু করে ড্রয়িং রুমকে পাশ কাটিয়ে উপরে যেতে নিলেই ইফাজ তাকে ডাক দেয়।

হঠাৎ করে বলে, ‘তুমি কি মারামারি করে এসেছো?’

ইনান‌ মাথা নিচু করে রাখল।

‘কথার জবাব দাও! তুমি কি এখনো বাচ্চা? খেলতে গিয়ে মারামারি করো? এই স্বভাব কি তোমার যাবে না?’

ইনানের কপাল ফুলে লাল হয়ে আছে। তা দেখে জেহফিল হাত শক্ত করে মুঠ করে ধরল। তার বাটারফ্লাইকে মা’রার মতো বুকের পাটা কার দেখতে হবে।

এর মাঝে ইনান রাশভারী গলায় বলল,
‘ঐ ভুটকিই আমাকে আগে মেরেছে। সবাই দেখেছে আমি গোল দিয়েছি আর ও কিনা বলে আমি গোল দেইনি।’

জেহফিল একটু স্বস্তি পেল ইনান মেয়েদের সাথে খেলেছে বলে।

ইফাজ হালকা ধমক দিলেন, ‘তাই বলে মারবে?’

‘ও আগে আমার মুখে ফুটবল ছুঁড়েছে। পরে কপালে ঠুয়া দিয়েছে।’

এবার জেহফিল মুখ খুলল, ‘আর তুমি কী করলে?’

মিনমিন করে ইনান বলল, ‘চুল ধরে টেনে তিনটা চড় মেরেছি…চারটা।’

ইফাজ মুখ খুললেন ইনানকে বকা দেওয়ার জন্য, তার আগেই জেহফিল হেসে বলল, ‘দ্যাটস মাই গার্ল। ব্রাভো!’

ইফাজ কিছুটা অবাক চোখে তাকালেন জেহফিলের দিকে। এই ছেলেটা ইনানকে প্রশ্রয় দিলে মাথায় চড়ে বসবে ইনান। আরও ডানপিটে হবে। ইনান নিজেও বিস্মিত। এই প্রথম কেউ তার মারামারিকে সাপোর্ট করল।

‘ভুল কিছু করোনি। কেউ কিছু দিলে তাকে ডাবল ফিরিয়ে দিতে হয়। এটাই নিয়ম।’

জেহফিলের কথায় ইনান আরো আশকারা পেল। ফ্যাকাশে মুখ মুহুর্তেই রং ফিরে পেল। দাঁত বের করে হেসে বলল,

‘আই নো রাইট? আমি কখনো ভুল করতেই পারি না।’

‘যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও।’ ইফাজ বলল।

ইনান চলে যেতেই জেহফিলও ইফাজ খানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে গেল।

ইনান ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল জেহফিল থুতনিতে হাত রেখে বসে আছে। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। চশমা দিলে জেহফিলকে গম্ভীর প্রফেসরের মতো লাগে।

‘হ্যালো।’

চিন্তা ছুটে জেহফিলের। ইনানকে দেখে ইনানের হাত ধরে নিজের গালে ছোঁয়ায়।

‘কী ভাবছেন?’

জেহফিল কিছু না বলে টেবিল থেকে ডায়েরীটা ইনানের সামনে ধরে।

‘এটা কী?’ ইনানের প্রশ্ন।

ডায়েরীটা যেই পেপারে মোড়ানো ছিল সেটাও তুলে ধরে জেহফিল। এবার ইনানের মনে পড়ে, এই প্যাকেটটা পলক তার জন্মদিনে দিয়েছিল। কিন্তু ইনান খুলেইনি, যেভাবে ছিল ওভাবেই ফেলে রেখেছিল।

ইনান ডায়েরীটা খুলতেই মুখ ঝুলে গেল। পলক এসব কী লিখেছে? এইজন্যই কি জেহফিলের মুখ গোমড়া?জেহফিল কি ভুল বুঝল?

‘কে দিয়েছে এটা?’

ইনান মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বলল, ‘আরেহ, ফ্রেন্ডরা এটা গিফ্ট করেছিল, ইচ্ছে করেই খুলিনি, জানতাম আজেবাজে কিছুই হবে।’

ইনান মিথ্যে বলে কথা কাটিয়ে গেল সহজেই। সে চায় না পলকের ব্যাপারে জেহফিলকে কোনো কথা বলতে, জেহফিল যদি মাইন্ড করে?

‘ওহ হ্যাঁ, কালকে এখান থেকে যাওয়ার সময় হসপিটালে যাবো।’

‘ভুলে যাও।’

ইনা কপাল কুঁচকে তাকাল। তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জেহফিল বলা শুরু করল,

‘শরৎ ভালো ছেলে নয়।’

‘মানে?’

জেহফিল মোবাইল বের করে একটা ছবি ইনানকে দেখাল। ইনান অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখল, মাতাল শরৎ আর কয়েকটা ছেলে মা’র খাচ্ছে। আর যে মা’রছে সে আর কেউ নয়, ইনানের বাবা ইফাজ খান!

জেহফিল মোবাইলটা সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ওর ক্যারেক্টার প্লাস পার্সোনালিটি একটাও ভালো না।’

‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ও’কে আমি ভালো ছেলে ভাবতাম।’ হতভম্ব গলায় বলল ইনান, ‘অথচ ওর ফ্যামিলি কত হাই স্ট্যাটাসের! ওর বাবা মা জানলে তো মুখে চুনকালি পড়বে।’

‘এইজন্যই ছবিটা শুধু ওর বোনের কাছে পাঠিয়েছি। ওয়ার্নিংয়ের জন্য।’

ইনান সন্দেহী চোখে তাকাল জেহফিলের দিকে, ‘আপনি ও’কে চিনেন কীভাবে? এমনকি ওর ফ্যামিলিকেও?’

সরল স্বীকারোক্তি জেহফিলের, ‘তোমার সব ফ্রেন্ডের খবর আমার জানা। শুধু তোমাকে সেইফ রাখার জন্য।’

একটু থেমে জেহফিল বলল, ‘তোমার কোনো ফ্রেন্ডই ভালো না। ভার্সিটিতে উঠেছ, তাই প্রথম প্রথম সব ফ্রেন্ডকেই এমন আপন লাগবে, ধীরে ধীরে বুঝবে, সবাই-ই স্বার্থপর। অ্যান্ড ইয়েস, শরৎয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ ব্রেক করবে।’

‘এতো সোজা?’

জেহফিল ইনানের চুল কানের পিছনে রাখলো, ‘চাইলেই সহজ। শরৎ ড্রাগ অ্যাডিক্টেড বলেই বলছি না, তোমার বাবার উপর রাগ ঝারতে ও তোমার ক্ষতি করতেও চেয়েছিল, জঙ্গলের কথা মনে নেই?’

ইনান চোখ ছোট ছোট করে তাকায়, ‘আপনি বলতে চাইছেন ও-ই আমাকে ধাক্কা দিয়েছে?’

‘এখনও বলা লাগবে?’

ইনান বিশ্বাসই করতে পারছে না। শরৎ তার এত বড় ক্ষতি করবে। ওয়েট, এখন তার কাছে পুরোটা ক্লিয়ার। এইজন্যই শরৎ ঐদিন জঙ্গলে যাওয়ার জন্যই এত তাড়া দিয়েছিল আর ইনানের সাথে কেমন রুক্ষ আচরণ করছিল?

‘তারমানে ও-ই ঐদিন আমাকে বার্থডেটে ঐ ভয়ানক পুতুল পাঠিয়েছিল?’ ইনানের মুখ হা হয়ে গেল।

জেহফিলের মনে পড়ল যেই কালো রং করা টেডিটা সে তার বাটারফ্লাইয়ের বার্থডেটে উপহার দিয়েছিল, এবং যেটা বাটারফ্লাই ছুঁড়ে ফেলেছিল বারান্দা দিয়ে। ঠোঁট চেপে বলল, ‘হতেও পারে।’

তবে জেহফিল একটা সত্যি কথা ইনানের নিকট চেপে গেল। শরৎএর উদ্দেশ্য ছিল না ইনানকে মা’রার। তার উদ্দেশ্য ছিল ইনানের সম্ভ্রমহানি করার। কেননা শরৎ আগে থেকেই ইনানকে কিছুটা পছন্দও করত। সে এক ঢিলে দুই পাখি মা’রতে চেয়েছিল। কিন্তু সেইদিন বৃষ্টি থাকায় সুবিধা করতে পারেনি। ইনানকে ধরার সাথে সাথেই কাঁচা রাস্তায় পা পিছলে ইনান পড়ে যায়। এই কথাটা সে কখনোই ইনানকে বলতে পারবে না। যখন সে শুনবে তার কাছের বন্ধু তার সর্বনাশ করার চেষ্টা করেছিল সেটা মেনে নিতে পারবে না ইনান, ভেঙে পড়বে এবং ট্রমায় চলে যাবে, আর তা জেহফিল সহ্য করতে পারবে না কখনোই। কিছু সত্য না বলাই ভালো।

.
রাতেরবেলায় ঘুমাতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। ইনানের খাটটা সিঙ্গেল খাটের থেকে একটু বড়। দুজন চিকনা চাকনা মানুষ ঘুমাতে পারলেও জেহফিলের মতো লম্বা, বিশালদেহী মানুষ একাই এই খাটে ঘুমাতে পারবে, ইনানের আর জায়গা হবে না‌।

এদিকে ইনান অন্যরুমের ব্যবস্থাও করতে পারবে না। বাবা কোনোভাবে যদি জেনে যায় তাহলে অন্যকিছু ভাবতে পারেন, মনে মনে কষ্টও পাবেন।

ইনান বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছে কী করা যায়। কোনো আলাদা ম্যাট্রেসও নেই। থাকলেও তা ইনানের বাবার রুমে। ওইখান থেকে আনাটাও ঝুঁকিপূর্ণ। আবার ইনানের রুমে সোফাও নেই। জেহফিলকে সে নিচে ঘুমাতে দিতে পারে না। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু। প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে এসেই জামাই যদি নিচে ঘুমায় তাহলে এটা ইগোতে লাগবে ইনানের। জেহফিলও ইনানকে কিছুতেই নিচে ঘুমাতে দিবে না। ফলাফল, দুজনকেই খাটে চেপেচুপে ঘুমাতে হবে।

ইনান খাটের এক কোণায় শুয়ে মাঝখানে কোলবালিশ রাখতে চাইল, কিন্তু কোলবালিশ রাখলে আবার জেহফিলের জায়গা হবে না।

তাই অসহায় হয়ে বলল,’আচ্ছা আপনি ঘুমান। আমি বই পড়ে ঘুমাব।’

এই বলে ইনান উঠে পড়ার টেবিলে চলে গেল। উদ্দেশ্য জেহফিল ঘুমালে সে ঘুমাতে যাবে।

জেহফিল গুড বয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ইনানের শোয়ার জায়গাটা দেখে বাঁকা হাসল। এইজন্যই তো সে এখানে এক রাতের জন্য আসতে রাজি হয়েছিল। যাতে ইনান বাধ্য হয়ে জেহফিলকে নিজের পাশে নিয়ে ঘুমায়। প্ল্যান সাকসেসফুল!

জেহফিল দুই মিনিটের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার বুকের উঠানামা দেখেই ইনান কনফার্ম হলো জেহফিল পুরোদস্তুর ঘুমে। তাই সে লাইট বন্ধ করে ল্যানটার্ন জ্বালিয়ে খুব সাবধানে নিজের জায়গাটায় গিয়ে শুলো। জায়গাটা এত ছোটো যে ইনান এদিক ফিরলে জেহফিলের বুকে গিয়ে পড়বে, আর ওদিক ফিরলে সোজা ফ্লোরের সাথে কিস করবে।

জেহফিলের শরীর থেকে ম্যানলি ঘ্রাণ ইনানের নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বাইরে শীতল ওয়েদার, আর পাশে এই উষ্ণ লোকটা। ইনান মনের তোলপাড়কে থামানোর চেষ্টা করে চোখ বন্ধ করল। তার ঠিক কয়েক পলের মধ্যেই ইনান তার বুকের উপর শক্ত কিছুর ছোঁয়া অনুভব করল। তড়াক করে চোখ খুলে দেখল জেহফিলের হাত তার সর্বনাশের উপরে। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম ইনানের। গলা থেকে চিৎকার বেরোনোর আগেই এক হাতে মুখ চেপে ধরল ইনান। শিট শিট শিট! এটা কী হলো? ইনান কাঁপতে লাগল মৃগী রোগীর মতো। মাথা ঘুরিয়ে জেহফিলের দিকে তাকালো। ইনানের ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে জেহফিল কী আরামে ঘুমাচ্ছে! ইনান জেহফিলের হাত আস্তে ধরে সরানোর চেষ্টা করতেই জেহফিল ঘুমের ঘোরে ইনানের গলায় মুখ রাখল। শুধু তাই নয়, ইনানের সর্বনাশে রাখা হাত আরো দৃঢ় হলো।

ইনানে লজ্জায় বিহ্বল হয়ে পড়ে রইল। সারা শরীরের রক্ত এসে তার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। কান টকটকে লাল হয়ে গেছে। ইনান শ্বাসটাও নিতে ভুলে গিয়েছে যেন। শরীরে শিহরণ বয়ে যায় জেহফিলের উষ্ণ নিঃশ্বাসে। গলা শুকিয়ে কাঠ। শুষ্ক গলায় বার কয়েক ঢোক গিলে। ইনান আর যাই হোক না কেন, সে তো একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে‌! এই ধরনের আবহাওয়ায় জেহফিলের মতো গরম বালক, যে কিনা তার স্বামী, এত কাছে, এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ইনানের শরীর জেগে উঠবে। যদি জেগে না উঠে তাহলে তো সে মেয়ের কাতারেই পড়বে না। ইনানের মনে কুচিন্তারা এসে হানা দিতে লাগল। বেডশিট শক্ত করে একহাতে চেপে ধরল। মন বলতে লাগল জেহফিলের কাছে না যেতে, কিন্তু শরীর? সেটা তো আর মন মানবে না, অন্তত এই ধরনের অবস্থায়।

এর মাঝে ইনানের পিঠের নিচে জেহফিলের আরেক হাত ঢুকে গেল। পুরো কোলবালিশের মতো জেহফিল ইনানকে জড়িয়ে ধরে আছে। ইনান থরথর করে কাঁপতে লাগল। এই প্রথম সে কোনো ছেলের এতটা কাছাকাছি। আর এই প্রথম তার শরীরের গভীরে কেউ হাত ছোঁয়ালো।

জেহফিল যদি তার মনের এসব ডার্টি ভাবনা সম্পর্কে অবগত হয় তাহলে ইনানের আর দুনিয়ায় বেঁচে থাকা লাগবে না। এই ভাবনা মাথায় আসতেই ইনান নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনে। জেহফিলের হাত ধরে বুকের উপর থেকে সরিয়ে দেয়। পিঠের নিচে থাকা হাত সরাতেই জেহফিল অন্যদিকে ফিরে, আর সঙ্গে সঙ্গেই ইনান তার বুকে আছড়ে পড়ল। জেহফিলের শক্ত বুকের সাথে ইনানের থুতনিতে ব্যথা লাগে। নিজেকে সরাতে চেয়েও একটু নড়তে পারলো না জেহফিল জড়িয়ে ধরে থাকার কারণে। অগত্যা ইনান আর ফাইট করল না।

জেহফিলের সুশ্রী চেহারায় তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর দৃষ্টি ফিরালো জেহফিলের গলার অ্যাডাম অ্যাপলের দিকে। ইনানের খুব লোভ হলো তা ধরার। সিনামাতে যখন নায়কদের অ্যাডাম অ্যাপল দেখত মনে মনে ঢোক গিলত সে। নিজের ফিউচার হাজব্যান্ড নিয়ে সে যে কত বাজে বাজে চিন্তা করে রেখেছিল.. আর এখন হাজব্যান্ড চোখের সামনে থাকা অবস্থায় সে কিছুই করতে পারছে না!! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইনান।

নাহ! এসব ভাবলে শয়তান আরো গেড়ে বসবে। কোনো দুঃখের কোনো ঘটনা মাথায় আনার চেষ্টা করল খারাপ চিন্তাভাবনা দূরে রাখতে। কিছুটা সফলও হলো অবশ্য। কিন্তু পেটে থাকা জেহফিলের শীতল হাত ইনানকে সফল হতে দিলো না। ইনান এবার নিজের হাতে জোরে জোরে তিনচারটা কামড় দিলো, ব্যস, এবার ব্যথায় আর জেহফিলের ছোঁয়ার কথা মাথায় আসবে না। মাথায় আসলেই এভাবে কামড় দিবে।

জেহফিলের বুকের উপর ইনানের শরীর যখন ঘুমে ঢলে পড়ল তখন চোখ খুলল জেহফিল। চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে নিয়ে ইনানের দিকে তাকায়।

তার ইচ্ছে করছিল ইনানকে চেপে শরীরের সাথে মিশিয়ে নেয়ার কিন্তু সে এটা করবে না। যদিও জেহফিলের জন্য কষ্টকর হয়ে যায় তবে সে সয়ে নিবে। ইনানকে বাধ্য করবে নিজ থেকে জেহফিলের কাছে আসার। আর যদি না আসে তাহলে প্রতিটা মুহুর্ত ইনানকে গভীর যন্ত্রণায় পোড়াবে, যেই যন্ত্রণায় পুড়ে ইনান ভিক্ষা করবে জেহফিলের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য।

ইনানের কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এভাবে নিজেকে আর কতদিন দূরে রাখতে পারো আমিও দেখব বেবিগার্ল।’

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

ঘুম থেকে উঠে নিজেকে জেহফিলের বুকে আবিষ্কার করে ইনান। জেহফিলের দুই হাত ইনানকে দড়ির মতো পেঁচিয়ে রেখেছে যাতে সে পড়ে না যায়। ইনান চোখ আধবোজা রেখেই অপরপাশে ফিরল। ফেরার পথেই দেখতে চাইল জেহফিলের চোখ বন্ধ কিনা। যখন দেখল বন্ধ তখন ধীরে ধীরে জেহফিলের হাত সরাল পিঠ থেকে। তারপর আস্তে করে উঠে যেতে লাগল। তখনো ইনানের দুই পা জেহফিলের দুই সাইডে এবং ইনান জেহফিলের পেটের উপর বসে ছিল। যখন সে এক পা একটু নাড়ালো তখনই জেহফিল চোখ খুলল এবং সময় ব্যয় না করেই বাঁকা হেসে বলল,

‘পজিশনটা পারফেক্ট।’

ইনান বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে ছিল, কথাটার মানে বোঝামাত্রই তড়িৎ গতিতে খাট থেকে নেমে গেল। তার গাল রাঙা হয়ে উঠেছে। এই জেহফিল তাকে প্রতিটা সময় এত লজ্জা দেয় কেন?

‘আবার একটু বসো বাটারফ্লাই, ভালোই লাগছিল দেখতে।’

জেহফিলের টিজ করা কথা শুনে ইনান কোনোমতে কথা পাশ‌ কাটনোর জন্য বলে, ‘আপনিও তো দেখি আজ ঘুমের ঘোরে হাঁটতে গেলেন না, ব্যাপার কী?’

‘কাল সারারাত একজন পরী আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল, পরীর এত শক্তি দেখে ঠিক করেছি প্রতি রাতে হানি নাটস খাব পরীকে শান্ত করার জন্য।’

জেহফিলের ডাবল মিনিংয়ের কথা শুনে ইনানের কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল, জবাব না দিয়ে দৌঁড়ে বাথরুমে ঢুকে দুই হাতে কান চেপে ধরল। কান থেকে যেন ধোঁয়া বেরোচ্ছে এতটা গরম। ফাজিল বদ লোক একটা, এত ঠোঁটকাটা লোকটা, খালি ইনানকে লজ্জায় ফেলবে।

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে জেহফিলকে রুমে দেখল না। নিচে গিয়ে দেখল জেহফিল আর তার বাবা বসে বসে চা খাচ্ছে আর রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করছে। জেহফিলের মার্জিত ভঙ্গিতে বসা দেখে ইনান মনে মনে নিজেকে বকল। একা একা বড় হয়েও জেহফিলের মধ্যে ম্যানার্সের কমতি নেই, আর সে, আলালের ঘরের দুলালি, ম্যানার্সের জন্য সবসময় বাবার কাছে বকা খায়।

ইনান‌ ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে গিয়ে দেখল সব টেবিলের উপর সাজানোই আছে। খাবার সাজানোর ধরণ এলিগ্যান্ট দেখেই বুঝল জেহফিল তৈরি করেছে। ইশ কী লজ্জা, জেহফিল ঘরের জামাই হয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছে আর সে কিনা ঘন্টা ধরে ফ্রেশ হচ্ছিল। এত উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা কেন তার??

.

.

গাড়ির জানালায় হাত রেখে তাতে মাথা দিয়ে বসে আছে ইনান। গুণগুণ করে গান গাইছে আর গোধুলির রাঙা মেঘ উপভোগ করছে। মনটাও ফুরফুরে লাগছে। তার এই সুন্দর ক্ষণ হঠাৎ বাঁধা পায় জেহফিলের কথায়,

‘তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের বলোনি আমাদের বিয়ের কথা?’ রাস্তায় দৃষ্টিপাত করেই সে প্রশ্ন করে।

ইনান চুলগুলো ভাঁজ করে কানে পেছনে গুঁজে। সোজা হয়ে বসে সিটে হেলান দিয়ে বলে, ‘না।’

‘কারণ কী?’

ইনান ইতস্ততবোধ করে। কারণ তো অনেকগুলোই আছে, কয়টা বলবে।

‘কেউ প্রশ্ন করলে তার জবাব না দেওয়াটা অভদ্রতা। এসব আমি পছন্দ করি না।’ জেহফিলের গম্ভীর কণ্ঠ।

‘ইশে..মানে..’

জেহফিল ব্রেক কষে সজোরে। ইনান প্রশ্নাতুর চোখে তাকায়।

‘বাটারফ্লাই। তুমি কি কোনো কারণে এই বিয়ে নিয়ে হ্যাপি না?’

জেহফিলের চোয়াল শক্ত। চেহারা আবেগশূন্য। স্টিয়ারিংয়ে রাখা হাত শক্ত হয়। ইনান জানালার বাইরে তাকায়। একটু পর আকাশ তিমিরে ছেঁয়ে যাবে।

ইনান প্রথম প্রথম এই বিয়েতে সত্যিই খুশি ছিল না। জেহফিলের জোরজবরদস্তি করে হুমকি দিয়ে বিয়ে করাটা কেউই কখনো অ্যাপ্রিশিয়েট করবে না। কিন্তু তার বাবার থেকে যখন জেহফিলের অতীত জানল, নিজেকে জেহফিলের জায়গায় চিন্তা করল তখন কিছুটা হলেও তার হৃদয় নরম হয়েছে। ভাবল যা হওয়ার হয়ে গেছে, যেহেতু জেহফিলের কোনো স্ক্যাম নেই, বাবারও সম্মতি আছে তাই জেহফিলকে মেনে নেওয়াই যায়। তবে জেহফিলের সাথে এই এক সপ্তাহ থেকে বুঝেছে, জেহফিল প্রচণ্ড কেয়ারিং এবং লাভিং। সকাল হতে রাতের রান্নাটাও পর্যন্ত সে করে। ইনানের যা যা পছন্দ সব এনে দেয়। তার কোনো বাজে অভ্যাস ইনানের চোখে পড়েনি। একজন গার্ডিয়েনের মতো ইনানকে আগলে রাখছে। আর সবচেয়ে বড় কথা ইনানকে এই কয়দিন ভুলেও জেহফিল বাজেভাবে ছোঁয়নি। যদিও ইনানকে টিজ করার জন্য দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে, তবে এটা স্বাভাবিক হাজব্যান্ড ওয়াইফের মধ্যে। এই স্বভাবগুলোর জন্যই জেহফিলের প্রতি ইনানের আকর্ষণ বাড়ছে।

ইনানের সম্বিত ফিরল যখন দেখল জেহফিল হাইস্পিডে গাড়ি চালানো শুরু করেছে। তার মুখ থমথমে। ইনান দ্রুত কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল,

‘আপনি যা ভাবছেন তার কিছুই না, আমি আসলে ওদের বলতে চাইছি না.. কারণ.. কারণ আমি আপনাকে নিয়ে ফান করেছি ওদের কাছে।’

গাড়ি আচমকা থামল। তাল সামলাতে না পেরে ইনান পড়ে যেতে নিচ্ছিল আর জেহফিল ইনানের মাথায় এক হাত দিয়ে ধরে ফেলল। তাকে বসিয়ে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, ‘এক্সপ্লেইন।’

‘আসলে আপনাকে যখন ফার্স্ট ক্লাসে দেখেছিলাম তখন আমাদের সবার কাছেই আপনাকে উইয়ার্ড অ্যান্ড অ্যারোগেন্ট লেগেছিল। আমাদের সার্কেলের সবাই-ই আপনাকে নিয়ে ঠাট্টা করত, অবশ্য তার জন্য আমিই..মানে আমি দায়ী ছিলাম, আপনাকে নিয়ে মজা করতাম আমিই বেশি, ওরা যদি এখন জানে সেই আপনিই আমার হাজব্যান্ড ব্যাপারটা আমার জন্য খুবই এম্বারাসিং। ওর আমাকে নিয়ে মজা করবে.. আর আমি তো ওদের ফ্রেন্ড তাই জানি ওদের মজা করার ওয়েটা খুবই জঘন্য তাই এই ব্যাপারে বলিনি।’

ইনান মাথা নিচু করে গড়গড় করে বলে দিলো।

‘দ্যাট‌ মিনস আমাকে‌ নিয়েও তুমি জঘন্য মজা করেছিলে?’

ইনান চোখ উপরে তোলার সাহস পেল না, আসলে ওর মধ্যে ভালো খারাপ সব গুণই আছে। যেহেতু গ্রুপের লিডার ইনান, তাই তার আশকারাতেই ফ্রেন্ডরা জেহফিলকে নিয়ে মজা করার সুযোগ পেয়েছিল।

‘আরেকটা কারণও আছে।’ ইনান মিনমিন করে বলল।

জেহফিল চুপ করে রইল। কিন্তু তার কঠিন চোখ ইনানকে আদেশ দিচ্ছে বলা চালিয়ে যেতে।

‘আরেকটা শর্ত ছিল কেউ যদি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই বিয়ে করে বা রিলেশনে জড়ায় তাহলে সে লুজার।’

‘ডোন্ট টেল মি তুমি নিজেই এই শর্তটা দিয়েছিলে!’

ইনান গলার সাথে চিবুক মিশিয়ে রাখে। জেহফিলের আর বুঝতে বাকি‌ রইল ন।

‘এখন… ওরা যদি জানে আপনার কথা আমার মানসম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে।’

ইনানের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। সে যে কার ফাঁদে পড়ে এসব গ্রুপ রুলস বানাতে গেল খোদা মালুম!

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে ইনানের কানে শুধু জেহফিলের তিরস্কার পৌঁছাল, ‘তোমার ফ্রেন্ড সার্কেলের প্রতিটা ছেলেমেয়েই অসভ্য এবং বেয়াদব।’

অপমানে ইনান কাঁচুমাচু মুখ করে বসে রইল। সার্কেলের প্রতিটা ছেলেমেয়ের মধ্যে সেও তো পড়ে, তারমানে কি জেহফিল তাকেও অসভ্য এবং বেয়াদব বলল? তবে ভুল কিছুই তো বলেনি, আসলেই তো সে অসভ্য। কিন্তু জেহফিলের মুখ থেকে এই কথাটা শুনতে ইনানের এত খারাপ লাগছে কেন? ইনান ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। জেহফিল যখন গম্ভীর হয়ে যায় তখন এত ভয়ঙ্কর লাগে দেখতে যে কেউ বিশ্বাসই করবে না এই লোকটা যে দুষ্টুমিও করতে জানে। জেহফিলের থেকে এতদিন এত ভালোবাসা পেয়ে হুট করে এই কথাটা শুনতে একটু কষ্টই লাগছে।

জেহফিলের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আটটা বেজে গেল। সারা রাস্তা ইনান একটা কথাও বলল না। বাতাসে দমবন্ধ করা অস্বস্তি এড়াতে ইনান ঘুমানোর ভং ধরে পড়ে রইল। জেহফিলের বাড়ির সামনে গাড়ি থামলেও সে একইভাবে শুয়ে রইল, এখন হুট করে উঠে পড়লে তার অভিনয় ধরে ফেলবে সে। তাই অপেক্ষা করতে লাগল জেহফিলের তাকে জাগানোর।

জেহফিল ইনানকে না জাগিয়ে যখন গাড়ি থেকে নেমে গেল, ইনানের এত কষ্ট লাগল! বুকের ভেতর ছুরি গাঁথার মতো অনুভূতি হতে লাগল। ইনান আসলেই বাড়াবাড়ি করে সবসময়, কী দরকার ছিল জেহফিলকে নিয়ে মজা করার?

জেহফিলকে তার পাশের দরজা খুলতে দেখে চোখ বন্ধ করে নিলো আবার। জেহফিল তাকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে। যাক, একা এই জঙ্গলে তো আর ফেলে যায়নি। কিন্তু জেহফিল কি আসলেই রাগ করে আছে? তার স্বাভাবিক মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। সরি বলতে হবে।

জেহফিল ইনানকে খাটে শুয়িয়ে তার রুমে চলে গেল। জেহফিল যেতেই ইনান উঠে বসল। মাথা চেপে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। সে কেন জেহফিলকে সত্যি কথা বলতে গেল? মিথ্যে বলায় তো সে পি এইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেছে, তখন মিথ্যে বলল না কেন? তবে তখন জেহফিলের শীতল অথচ কঠিন কথার তোপে পড়ে ইনান মিথ্যে বলার সাহস পেল না। যেন সে তখন টিচারকে পড়া না দিতে পারার জন্য কৈফিয়ত দিচ্ছিল।

তখন ইনানের ফোন বেজে উঠল তারস্বরে। দেখল তার ফ্রেন্ডরা গ্রুপ কল দিয়েছে। ইনান হ্যালো বলার সাথে সাথেই ফারার চিৎকার করা কিছু তিক্ত কথা কানে বাড়ি খেল,

‘এতটা সেলফিশ কীভাবে হতে পারলি তুই ইনান? তোর ফ্রেন্ড হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছে একদিন হলো আর তুই দেখতেও আসলি না? হসপিটালে তো আসতে পুরো একদিন লাগে না, আর না তোর কোনো ব্যস্ততা আছে। তাহলে মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করা বন্ধুর কথা একটাবারও তোর মনে পড়ল না?’

ফারার কথা শেষ হতেই মুগ্ধর কথা শোনা গেল, সেও একই সুরে বলছে,

‘তোর তো কোনো ব্যস্ততা নেই ইনান, খালি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বাপের টাকা উড়ানো ছাড়া। গাড়ি করে আসতেও তো দশমিনিটের বেশি লাগত না। তাও কেন আসলি না? না আসলি, একটা ফোনও তো করতে পারতি শরৎএর খবর নেয়ার জন্য, নাহয় একটা মেসেজ, নাকি সেটা করারও সময় ছিলো না তোর? তুই এত সেলফিশ কীভাবে হতে পারলি? কালকে তো শরৎএর দুর্ঘটনা শুনে পারিস না কেঁদে দেস, তাহলে একটা দিন চলে গেল ওর খবর নিলি না কেন? এত গিরগিটির মতো রং বদলাচ্ছিস কেন?’

বন্ধুদের ঝাঁঝালো কথা শোনার সাথে সাথেই ইনানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। ফারা কেন, তার ফ্রেন্ডদের কেউই এই পর্যন্ত তার সাথে এত শক্ত ভাষায় কথা বলেনি। এখন হঠাৎ দুই ফ্রেন্ডের কঠিন কথাগুলো শুনে ইনানের নিজেকে কেমন দিশেহারা লাগছে। ইনানকে কথা বলার সুযোগটাতো অন্তত দিবে? গলায় কান্নারা দলা পাকিয়ে গলা ব্যথা করছে, বহুকষ্টে ইনান বলতে চাইল শরৎএর তাকে ধাক্কা দেওয়ার কথা, ফ্রেন্ড হয়ে তার ক্ষতি করার কথা। তাকে সেই সুযোগও দেয়া হলো না।

তার আগেই ফারা চেঁচিয়ে হুমকি দিলো, ‘রাত দশটার মধ্যেই হসপিটালে আসবি। যেখানেই থাকিস না কেন, যদি না আসিস তাহলে সত্যিই বুঝব তুই গিরগিটি, সেলফিশ আর ফেক।’

ফারা লাইন থেকে চলে গেল, ইনান কান্নারত চোখে বিদ্রূপ হাসল, ইতোমধ্যে তাকে গিরগিটি সেলফিশ তো বলেই দিয়েছিল, নতুন করে আবার কী বলবে?

মুগ্ধ বলল, ‘তোর থেকে এটা আসা করিনি ইনান। সিরিয়াসলি, আমরা সবাই সবার বিপদে এগিয়ে আসি। যেখানে শরৎ গুরুতর আহত সেখানে তোকে দেখি ফেসবুকে খাবারের পিক পোস্ট করতে। তোর কি আসলেই বিবেক বলতে কিছু আছে? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করিস।’

এই বলে কেটে দিল সে। ইনান ফোন হাতে নিয়ে পাথরের মতো বসে রইল। ফ্রেন্ড হিসেবে শরৎএর জন্য যতটা মায়া লেগেছিল, ওর বাজে উদ্দেশ্য শোনার পর ততটাই ঘৃণা লেগেছিল। তাই ইচ্ছে করেই সে শরৎকে দেখতে যায়নি। যদি গিয়ে শরৎএর গায়ে হাত তুলত সেই ভয়ে। ইনানের ফোন আবার বেজে উঠল।

রোবটের মতো রিসিভ করল সে, প্রথমেই শুনতে পেল দীর্ঘশ্বাস, তারপর মিহি কণ্ঠের এক মেয়ের শান্ত গলা,

‘শরৎ তোমাকে দেখতে চাইছে, তাড়াতাড়ি চলে এসো।’

ফোন কেটে গেল আবার। এই কণ্ঠ চিনতে তার অসুবিধা হয় না। টিভিতে সারাদিন এই মেয়ের এড দেখতে পায় সে। শরৎএর বোন রুহি। ইনান থম মেরে বসে রইল, ফ্রেন্ডদের কথাগুলো তার হজম হচ্ছে না, মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে তার। ইনান খাটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল।

জেহফিলের কথাটা তার কাছে এখন সত্যি মনে হলো, “ভার্সিটিতে উঠেছ, তাই প্রথম প্রথম সব ফ্রেন্ডকেই এমন আপন লাগবে, ধীরে ধীরে বুঝবে, সবাই-ই স্বার্থপর।”

আসলেই সব স্বার্থপর। তাকে তার ফ্রেন্ডরা অলরেডি সেলফিশ,‌গিরগিটি বলেই দিয়েছে, তাও ইনানের পক্ষের কথা না শুনে। ইনান যাবে না। কিছুতেই যাবে না। এমন বাজে ফ্রেন্ড তার লাগবে না। কে কী বলে সে দেখে নিবে। ভার্সিটি গেলে যদি তারা ইনানকে কথা শুনাতে আসে তবে সেও রেডি থাকবে শরৎএর ড্রাগ নেওয়া ছবি দেখাতে। সে ভেবেছিল শরৎয়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারের দোহাই দিয়ে ছবিটা কাউকে দেখাবে না। কিন্তু যদি ওরা বাড়াবাড়ি করে তবে সে বাধ্য হবে শরৎএর ছবিটা দেখাতে। ইনান মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। কান্না থামাতে পারছে না সে। এত আঘাত সহ্য করতে পারছে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল নিরবে।

জেহফিল দরজা খুলতে নিয়েছিল ইনানকে খেতে ডাকার জন্য। ইনানের ফোনে কথা শুনে দরজা পুরোটা না খুলেই হালকা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনতে লাগল। লাউডস্পিকারে থাকায় তার বন্ধুদের প্রতিটা কথা জেহফিলের কানে আসল। চোখের চশমা এক হাতে ঠিক করে নিঃশব্দে দরজাটা আটকে দিলো। টেবিলে খাবার গুছিয়ে চাবি হাতে বেরিয়ে গেল। মেইন দরজায় তালা মেরে নিচের তলার অন্ধকার গোডাউন থেকে বড় ভারী একটা ব্যাগ নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে রাখল। ড্রাইভিং সিটে বসে ঘাড় দুইদিকে কাত করে ঘাড়ের হাড় ফুটাল। রিল্যাক্স হয়ে বসে গাড়ি চালানো শুরু করল হাইস্পিডে।

.
.
চলবে…