রোদরঞ্জন পর্ব-২০+২১

0
388

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

বর্ষার শেষ সময় এখন। অথচ বাইরের আকাশ দেখলে মনে হয় বর্ষাকাল শুরু মাত্র। হাত বাড়িয়ে কয়েকটা কদম ফুল ছিঁড়ে নিলো ইনান। আর কয়দিন পর আর দেখা যাবে না এই ফুল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অন্যান্য দিন হলে ইনান রুমে গিয়ে ঘুম দিতো কিংবা বই নিয়ে বসে পড়তো। কিন্তু আজ ভাল্লাগছে না। সে অন্য চিন্তায় মশগুল। বিমর্ষ হয়ে ইনান বারান্দায় সারি বেঁধে রাখা ফুলগাছের পাশে বসল। তার মন বিক্ষিপ্ত, বিষণ্ন। কারণটা জেহফিল। দুইদিন আগেও যেই জেহফিলকে তার মনে হয়েছিল মন ভালো করার ঔষধ, আজ সেই জেহফিলই তার মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জেহফিল বদলে গেছে। অনেকটাই বদলে গেছে। জেহফিলের এই পরিবর্তিত রূপের সাথে ইনান পরিচিত না। প্রথম প্রথম ঠিক থাকলেও আজকাল জেহফিল কেমন ডমিনেটিং হয়ে যাচ্ছে। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এখানে যাওয়া যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না, গেলেও হাজারো কৈফিয়ত দেয়া লাগে। আমাকে ছাড়া কেন গিয়েছ, কোথায় গিয়েছ, কার সাথে গিয়েছ, এই জামা পড়া বাদ দাও, এই জুতা এখন থেকে পড়বে না, ঐ ছেলের দিকে কেন তাকিয়েছ, এটা খাওয়া যাবে না, আনহেলদি, এর সাথে কথা বলবে না…আরো কতো কী… ইনান প্রথমে এগুলোকে কেয়ার হিসেবে নিতো। তারও ভালো লাগতো জেহফিলের এই কেয়ার করা। কিন্তু এসব যত্ন অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গেলে গলায় ফাঁসের মতো বিঁধে। অতিরিক্ত চিনিতে যেমন ডায়বেটিস হয় তেমন অতিরিক্ত ভালোবাসা ভালো না থাকার কারণ হয়, অন্তত ইনানের কাছে তেমনটাই লেগেছে। ইনানের মনে হয় এই বুঝি জেহফিল হঠাৎ করে এসে ইনানের গলা চেপে ধরে বলবে, “আমাকে না বলে শ্বাস কেন নিয়েছো?”

জেহফিল আর আগের মতো দুষ্টুমি করে না, আগের হাসিখুশি জেহফিল নেই। এখনকার জেহফিল হাসলেও ইনানের কাছে ভাণ মনে হয়। যেই হাসিতে চোখ হাসে না সেটা অবশ্যই মিথ্যে হাসি! জেহফিলের চোখের ভাষা ইনান বুঝে না, কখনোই বুঝতে পারেনি.. চেষ্টা করেছে অনেক, কিন্তু জেহফিল যেন কোনো খোলস দ্বারা নিজেকে ঢেকে রেখেছে।

কয়েকদিন আগে জেহফিলকে ইনান বলেছিল এই বাড়িটা বিক্রি করে শহরে বাড়ি নিতে। বলার কারণ হচ্ছে এই জায়গাটা পরিত্যক্ত এবং নির্জন। আশেপাশে সিঙ্গেল দোকানও নেই। ইনান এমন পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত না। তাই সে চেয়েছিল শহরে যেতে, ঐখান থেকে ভার্সিটি একাডেমি দুইটাই কাছে হবে। আশা যাওয়ারও সুবিধা আছে। কিন্তু জেহফিল ডিরেক্ট না করেছে‌। তার ব্যস্ত নগরীতে থাকতে ভালো লাগে না, কোলাহল, চেঁচামেচি, বিশেষ করে মানুষ – সে এড়িয়ে চলে এসব। ইনানের এক মুহুর্তের জন্য জেহফিলকে অসামাজিক মনে হয়েছিল, পরে ভেবেছে, জেহফিল তো ছোটো থেকেই একা, বাবা মা ছাড়া বড় হয়েছে, তাই একা থাকাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু একটা মানুষ কতক্ষন পারে এভাবে একাকীত্ব সহ্য করতে? জেহফিলকে বললেই বলে, আমি থাকতে তুমি একা কিসের? ইনান বুঝাতে পারে না জেহফিলকে নাকি জেহফিল নিজেই বুঝতে চায় না, তা ভেবে পায় না‌ সে।

গত রাতে জেহফিলের সম্পর্কে ইনানের ধারণা বদলে গেছে একটা ঘটনার মাধ্যমে। তারপর থেকেই ইনান উদ্বিগ্ন হয়ে আছে জেহফিলের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে, ভাবতে বসেছে জেহফিল আসলেই তার জন্য সঠিক ছিল কিনা…

ইনান গত রাতে রুমে বসে জেহফিলের চেঞ্জ হওয়া নিয়ে ভাবছিল। তখন হঠাৎ মনে পড়ল বাবাকে আজ সারাদিনে কল দেয়া হয়নি। ডায়ালে গিয়ে বাবাকে কল দিবে এমন সময়ে জেহফিল কোত্থেকে এসে ইনানের হাত চেপে ধরে, মোবাইল নিয়ে যায় ঝট করে, সন্দেহী চোখে বলল,

‘কাকে কল দিতে নিচ্ছিলে?’

ইনানের মুখ চুপসে যায়, আবার জেহফিলের কোন নাটক দেখবে!!

‘বাবাকে।’

‘কেন?’

ইনান অবাক হয়ে বলে, ‘কেন কী আবার? কথা বলব।‌’

‘কথা বলা লাগবে না, কী বলবে আর? কেমন আছো, কী করছো এসব ছাড়া!’

‘তো আমি আমার বাবার খোঁজ নেব না?’ বিস্মিত গলা ইনানের।

‘না।’

জেহফিলের জবাবে ইনান হতভম্ব। সে ফোন নিয়ে নিতে চাইল। তার আগেই বিরাট শব্দ হলো। হাত দিয়ে কান চেপে ধরল ইনান। চোখ খুলে দেখল ফ্লোরে তার ফোনের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। ইনানের চোখ চলে গেল অন্ধকারে থাকা জেহফিলের দিকে। চোখ যেতেই আঁতকে উঠল ইনান। জেহফিল ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অপ্রকৃতিস্থের মতন লাগছে দেখতে। চোখ দুটো রক্তিম। জেহফিল ইনানের কাছে এগিয়ে ইনানের দুই বাহু আঁকড়ে ধরল। ইনানের মনে হলো তার বাহুতে কেউ দুটো পাথর চাপা দিয়েছে এত ব্যথা! কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘জেহফিল!’

জেহফিল উন্মাদের মতো রাগে কাঁপছে। তার শরীরের কাঁপুনি ইনানকে ভয়ে কাঁপাচ্ছে।

‘তোমার বাবা ম’রে গেছে?’ জেহফিল গম্ভীর গলায় বলে।

ইনানের ভয় উবে গেল, তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘কীহ!’

জেহফিল কানে হাত দেয়, ‘চেঁচাবে না সোনা। আমার এসব ভালো লাগে না।’

ইনান জেহফিলের কথায় তোয়াক্কা করল না, ‘আপনি কী বলেছেন একটু আগে? এসবের মানে কী?’

জেহফিল স্থির চোখে তাকায়, ‘তোমার বাবা ম’রলে তোমার ফুফি নিশ্চয়ই ফোন দিয়ে খবর জানাত। যেহেতু তোমার বাবা ম’রেনি তার মানে ভালোই আছে। তাই এসব আদিখ্যেতার কোনো দরকার নেই..’

সাথে সাথে জেহফিলের গালে সপাটে চড় দিলো ইনান। এই জেহফিলকে সে চেনে না। জেহফিলের এই রূপের সাথে সে পরিচিত না।

‘আপনার মানসিকতা এতটা বাজে! ছিঃ জেহফিল! নিজের বাবা- মা থাকলে ঠিকই মর্ম বুঝতেন।’

জেহফিল ঘাড় কাত করে ইনানের দিকে রুদ্র মূর্তি ধারণ করে তাকাল। তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ইনানের তেজস্বী রূপ ফুস হয়ে গেল। ভীত সন্ত্রস্ত হলো সে।

জেহফিল এক পা করে এগোচ্ছে ইনানের নিকট। তারপর তার শক্ত হাত ইনানের নিকট আসতেই চোখ বন্ধ করে নিলো ইনান, জেহফিলের শক্ত হাতের চড় খাওয়ার জন্য নিজের নরম গাল রেডি রাখল। কয়েক পল পেরোনোর পর জেহফিলের হাতের ছোঁয়া ইনানের গালে নয় বরং ইনানের হাত ধরল আলতো ভাবে। চোখ খুলে ইনান দেখল জেহফিল ইনানের ডান হাতে আঙুল দিয়ে চাপছে। ইনান বুঝল না জেহফিলের কারবার। সে তো ভেবেছিল তার চড়ের বদলে জেহফিলও একটা দিয়ে দিবে। কিন্তু জেহফিল ইনানের হাত ধরে ক্লেশ নিয়ে বলল,

‘তোমার হাতটা এত তুলতুলে, আমার তো মনে হলো তুমি আমাকে থাপ্পর না, আদর করে দিয়েছো।’

এই বলে ইনানের হাতে চুমু দেয়া শুরু করল। ইনান হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। জেহফিলকে সে বুঝতে পারে না। কী করে না করে ইনানের কল্পনাতীত।

.

.

‘বাটারফ্লাই! সোনা, তুমি কোথায়?’

জেহফিলের আদুরে গলায় ইনানের হুশ ফিরে। গতকালের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে কখন জল গড়িয়ে পড়ছিল খেয়াল করেনি সে। ইনানের মোবাইল জেহফিলের জিম্মায়। বাবার খোঁজটাও নিতে না পেরে সারারাত ছটফটানিতে কেটেছে।

ইনান দেখল জেহফিল বারান্দায় এসেছে। তার পরনে অ্যাপ্রোন, হাতে খুন্তি। ইনান ঢোক গিলে, ইনান কোনো অসঙ্গত কথা বললে জেহফিল যদি খুন্তি দিয়ে মারে? জেহফিল দেখার আগেই দ্রুত চোখ মুছে নেয় সে।

জেহফিল ইনানকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে দ্রুত এসে কোলে তুলে নেয়।

‘বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আনার ইচ্ছে আছে নাকি?’

ইনান জবাব দিলো না। জেহফিল ইনানের হাত কদমগুচ্ছ দেখে ইনানের গালে হাত দিয়ে বলল,

‘তোমার কদমফুল খুব পছন্দের তাই না সোনা?’

ইনান এবারও নিশ্চুপ। জেহফিলের হাসি হাসি মুখ কঠিন হয়ে গেল,

‘একবার বলেছি না প্রশ্ন করলে সাথে সাথে উত্তর দিবে।’

জেহফিলের শক্ত কণ্ঠে ইনান নড়েচড়ে উঠে। তাই জেহফিল আবারও হেসে বলল,

‘এবার বলো আর কী কী ফুল পছন্দ তোমার?’

‘সব ফুলই পছন্দ।’ ধীরে ধীরে বলল ইনান।

‘যদি তোমার কাছে দুইটা অপশন থাকে, একটাতে আমি আরেকটাতে সব ফুল তাহলে তুমি কোনটা বেছে নেবে?’

জেহফিলের অযৌক্তিক এবং বাচ্চামি কথায় ইনান বিরক্তির শ্বাস ফেলে।

‘এটা কোনো প্রশ্ন হলো?’

‘আমি না ফুল?’

‘জেহফিল, কীসব বাচ্চামো..’

‘আমি. না. ফুল?’ থেমে থেমে বলল জেহফিল। তার ধূসর চোখদুটো কঠোর।

‘আপনি।’

সাথে সাথেই স্মিত হাসল জেহফিল। জেহফিলের এই মুখের এক্সপ্রেশন চোখের পলকের মতো বদলাতে দেখে ইনান হতবাক হয়, জেহফিলের কোনো মুভিতে কাস্ট করা উচিৎ, এত দ্রুত তো চোখের পলকও পড়ে না..

.

.

‘স্ট্যাচুর উইংস গুলো ঠিকঠাক লাগানো হয়নি। দেখেছিস?’

‘হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি, আর পাখার স্ট্রাকচার স্মুথ হয়নি।’

‘পাখার দায়িত্বে কে ছিল?’

‘তাজবীর।’

তাদের কথোপকথনের মাঝে ভারী পুরুষালী কণ্ঠ শোনা‌ গেল,

‘আমাকে নিয়ে কী কথা হচ্ছে?’

সবাই পেছনে ঘুরল। চাবি আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে লম্বা এক সুপুরুষ সটান হেঁটে তাদের সামনে আসলো, এক হাতে চশমা খুলে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘এখন চুপ কেন? দলবল নিয়ে কী বলা হচ্ছে আমার নামে?’

দলের একমাত্র মেয়েটি টিয়া বলল, ‘তুই না উইংসের দায়িত্বে ছিলি?’

‘কঠিন কাজের দায়িত্বে এই তাজবীর ছাড়া আর কে থাকবে?’ তাজবীর গর্বের হাসি হাসল।

‘এইজন্যই তো বাঁশটাও খাব আমরা।’ দলের আরেকটা ছেলে বলল।

আঙুলে চাবি ঘুরানো বন্ধ করে দিল তাজবীর। ছেলেটার সামনে এসে তার কলারে হাত দিয়ে ময়লা মোছার মতো করে হাত বুলাল।

‘নাম কী?’

‘আকাশ।’

‘আমাদের দলে নতুন নাকি?’

ছেলেটি উপর নিচ মাথা নাড়াল। তাজবীর পাশে থাকা টিয়াকে ইশারায় বলল,

‘এই মাল আমাদের গ্রুপে জয়েন করল কবে?’

‘আজ।’

তাজবীর ছেলেটির কলার ঠিক করে দিলো, ছেলেটির দিকে চেয়ে টিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ছোটভাইকে ম্যানারস শিখিয়ে দিস, বিশেষ করে তাজবীরের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তার উপর স্পেশাল ক্লাস নিবি। বোঝা গেল?’

টিয়া ঢোক গিলে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলল। ছেলেটি তাজবীরের কথার পিঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরেকজন ছেলে আকাশকে টেনে কাঁধে দিয়ে বলল,

‘টেনশন নট বিগ ব্রো। নতুন তো, শিখে যাবে।’

এই বলে ছেলেটাকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল।

তাজবীর চুল ব্যাকব্রাশ করে বলল,

‘এবার বল কী‌ নিয়ে এত আলাপ?’

মাহিন বলল,

‘পাখাগুলো ঠিকমতো বসেনি মনে হয়, বাঁকা হয়ে গেছে শুকানোর..’

তাজবীর হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিলো, অভিজ্ঞ চোখে মূর্তিটাকে পরখ করতে লাগল। সেই সময়েই আকাশ ছেলেটা বলে উঠল,

‘এটার সমাধান জেহফিল স্যার ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না মনে হ…আহ!’

ছেলেটি কপাল চেপে ধরল। টিয়া আকাশকে থামানোর পূর্বেই তাজবীর তার দিকে চাবির রিংটা ছুঁড়ে মেরেছে। মাহিন ফিসফিস করে বলল,

‘তুমি এত কথা বলতে গেলে কেন? বলেছি না চুপ থাকতে?’

আকাশ দ্বিধাগ্রস্ত চোখে চায়, সে বুঝলো না তার ভুল কোথায়। টিয়াও ফিসফিস করে বলল,

‘তাজবীরের সামনে জেহফিল স্যারের নাম কখনো বলবে না, জেহফিল স্যার তাজবীরের দুচোখের বিষ।’

আকাশ ঘটনার কিছুই বুঝল না। তাই অগত্যা চুপ করে রইল। কিন্তু তাজবীর চুপ রইল না। আকাশের কাছে এসে আকাশের কপালে প্রতিটা শব্দের শেষে আঙুল দিয়ে ঠোকা দিতে দিতে বলল,

‘আমার কোনো কাজ ঠিক বা বেঠিক হলে আমি দেখব, অন্য কাউকে ডেকে এনে আমার কাজের বিচার করার মতো চিন্তা আর কখনো তোর এই ছোট্ট মাথায় যাতে না আসে। গট ইট?’

মাহিন আকাশকে চিমটি কাটে হ্যাঁ বলার জন্য। তাই বাধ্য হয়ে তাজবীরের অগ্নিমূর্তির সামনে নত হতে হলো তাকে, বাধ্য বাচ্চার মতো হ্যাঁ বলল।

‘কী হচ্ছে এখানে?’

জেহফিলের ডাকে তাজবীর ছাড়া সবাই তটস্থ হয়ে গেল। তাজবীর পেছনে ফিরে দেখারও প্রয়োজনবোধ করল না। মাহিন পরিস্থিতি সামলাতে হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘কিছু না স্যার, আমরা স্কাল্পচার নিয়ে গবেষণা করছিলাম জাস্ট।’

‘গবেষণা করতে এত চিৎকার চেঁচামেচি করা লাগে?’ ধমকের সুরে বলল জেহফিল।

‘সরি স্যার।’

এর মধ্যে আকাশ যেন সুযোগ পেল, ফট করে বলে দিলো,

‘স্যার, উইংসে সমস্যা আছে, আপনি নিজ চোখে দেখেন, স্মুথনেসে প্রবলেম আর ঠিক মতো বসানো নেই।’

তাজবীর হুমকির চোখে তাকাল। বাকি সবাইও বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইল আকাশের দিকে।

জেহফিল স্কাল্পচারের দিকে এক পলক তাকায়, তারপর মাহিনের দিকে চেয়ে বলে,

‘আজ আমার সময় নেই বলে তোমাদের কাজ দেখতে পারলাম না, তাই বলে ছাড় দিচ্ছি না। কালকে এসে যাতে সব ঠিকঠাক দেখি।’

কারো বুঝতে বাকি রইল না জেহফিল কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। সবাই নিরবে মাথা নাড়ায়।

‘ওকে স্যার।’

জেহফিল চলে যাওয়ার সময় থেমে ঘাড় পেছনে ফিরিয়ে বলল,

‘পেস্ট ঠিক মতো মেশালে স্মুথনেস পাওয়া যাবে আর ভেতরের পাইপ আরো বাঁকা করতে হবে।’

এই বলে সে চলে গেল। তাজবীর সাথে সাথেই গর্জে এসে আকাশের মুখে ঘুষি মারে। আকাশের উপরে সবার রাগ উঠলেও এই মুহুর্তে কেউ ঝামেলা চাইছে না। মাহিন আকাশকে ধরে তাজবীরের দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে গেল। টিয়া সহ বাকিরা তাজবীরকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

মাহিন এসে বলল,

‘তাজবীর, তোর উচিত তাড়াতাড়ি উইংসগুলো ঠিক করা। কাজে লেগে পড়, নাহলে আবার জেহফিল স্যার…’

‘স্টপ ইওর ড্যাম মাউথ।’ তাজবীর দাঁত কটমট করে বলে, ‘আমার সামনে ঐ লোকটার নাম নিতে বারণ করেছি না?’

টিয়া এবার অধৈর্য হয়ে বলে, ‘প্রবলেমটা কী তাজবীর? জেহফিল স্যার তোর কী এমন ক্ষতি করেছে যে তুই ওনাকে দেখতে পারিস না? একদিন না হয় তোকে অপমান করেছিল, তবে অপমানেরও কারণটাও যাথযথ ছিল, তুই কাজ না পারলে স্যার নিশ্চয়ই তোকে মাথায় তুলে তুলে কাজ শেখাবে না? টিচাররা স্টুডেন্টদের বকে বকেই পড়া শেখায়।’

‘মাথার টিচার। অন্যান্য স্যারেরা তো ঠিকই ধরে ধরে কাজ শেখায়, যেখানে এই লোক ধমক ছাড়া কথা বলে না।’

‘জেহফিল স্যার এমনিতেও একটু গম্ভীর দেখিস না? উনি ধমকালেও ওনার কাজ অন্যান্য টিচারদের থেকে বেস্ট। আর ঐ লোক কী হ্যাঁ? স্যার হয় আমাদের।’

‘নিজের সমবয়সীকে স্যার কেন ডাকতে হবে?’

টিয়া চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল, ‘বাই এনি চান্স, তুই কি জেহফিল স্যারকে হিংসা করিস?’

তাজবীর ক্ষুব্ধ চোখে তাকায়, ‘আমি কেন জেলাস হবো?’

‘না মানে, তোর সমবয়সী স্যার, ওনার এই বয়সেই এত অ্যাচিভমেন্ট, যেখানে তুই মাত্র স্টুডেন্ট আর অর্জনের খাতাও শূন্য..’

‘টিয়া, নিজের ভাগ্যের উপর সন্তুষ্ট হ যে তুই মেয়ে, নাহলে আমার হাতের মার একটাও মাটিতে পড়তো না।’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তাজবীর।

টিয়া চুপ করে গেল। তাজবীর মাটির বস্তা পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উঠে চলে গেল।

‘তুই ওরে আবার রাগাতে গেলি ক্যান?’ মাহিন বলল।

টিয়া সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘এই ছেলেটা আসলে যে কী! ভালোর সময় এতো ভালো যেন মাদার তেরেসার মেল ভার্সন, আর খারাপের সময় এত খারাপ যেন ইবলিশ মানুষ রূপে এসেছে…’

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২১
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

ভার্সিটির ক্লাস শেষে ইনান আর তার এক ক্লাসমেট পাশের ক্যাফেতে গিয়েছিল‌ ঠান্ডা কিছু কেনার জন্য। আকাশে মেঘ ধরলেও আবহাওয়া গরম। তার উপর ইনান জেহফিলের জোরাজুরিতে ফুল স্লিভ আর ফুল নেকের জামা পরেছে, পায়ে শু, গরমের থেকে বাঁচতে ঠান্ডা কিছু কেনার আশায় ক্যাফেতে গিয়েছে। গল্প করতে করতে বের হতেই ইনানের সামনে জেহফিল আচম্বিতে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ সামনে আসায় ইনান ভয় পেয়ে যায়।

‘ভুতের মতো এভাবে সামনে আসেন কেন?’ ইনান বুকে হাত দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল।

‘কাজ শেষ?’ জেহফিলের গম্ভীর গলা।

‘হুম।’

ইনানের ক্লাসমেটের হাত ইনানের এক হাতের মধ্যে ছিল। তার দুজনই হাত জড়াজড়ি করে ধরে ঘনিষ্ঠভাবে হাঁটছিল। মেয়েরা একসাথে হাঁটলে যা হয় আরকি! ইনান আর তার ফ্রেন্ড সামনে আর পেছনে জেহফিল।

আচানক পেছনের থেকে জোর ধাক্কায় ইনানের হাতের মধ্যে থাকা তার ফ্রেন্ডের হাত ছিটকে যায় আর সে পড়ে যায় রাস্তায়। ঘটনার আকস্মিকতায় ইনান প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠে, কেননা এখনি রাস্তার কাছ ঘেঁষে গাড়ি গিয়েছে। ভাগ্য ভালো গাড়িটা হঠাৎ মোড় নিয়েছে নয়তো ইনানের ফ্রেন্ডের দেহ থাকত এই পাশে আর কাটা মাথা থাকত রাস্তার অপরপাশে।

ইনান তড়িৎ গতিতে তার ফ্রেন্ডকে তুলে উঠায়, মেয়েটার ডান হাত রাস্তার সাথে ঘেঁষে ছিঁলে গেছে, কপালে চোট পেয়েছে। জেহফিল তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

‘সরি, পেছন থেকে মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে ব্যালেন্স‌ হারিয়ে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি।‌ ঠিক আছেন আপনি?’

ইনান জেহফিলকে বড়সড় ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। দেখছে মেয়েটা আহত আর সে কিনা বলে- ঠিক আছেন আপনি? ইনান বোতল বের করে তার ফ্রেন্ডের ক্ষতস্থানে পানি ঢালতে লাগল। আর জেহফিলকে ইশারা করল গাড়ি নিয়ে আসতে। ইনানের মেজাজ চটে গেল জেহফিলের কোনো নড়চড় না দেখে। কেমন নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন আজই পৃথিবীতে এসেছে, কিচ্ছু জানে না।

‘জেহফিল!! গাড়ি নিয়ে আসুন। হারি আপ।’

এবার যেন ইনানের কথায় জেহফিলের টনক নড়ল। গাড়ি আনার বদলে গাড়ি থেকে এইড বক্স নিয়ে আসল। ইনান যেন পাগল হয়ে গেল রাগে। কিন্তু এখন প্রথম কাজ হলো মেয়েটাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া। তাই জেহফিলের হাত থেকে ছোঁ মেরে বক্স নিয়ে দোকানের বেঞ্চিতে বসিয়ে মেয়েটার হাত ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগল‌। যদিও দুর্ঘটনাটা গুরুতর না, তাও ইনানের বারবার মনে হতে লাগল ও’কে হসপিটালে নিয়ে যেতে।

তার কিছুক্ষণ বাদে জেহফিলের আরেক অমানবিক রূপের সাথে পরিচিত হলো ইনান। জেহফিল তাকে তাড়া দিচ্ছে গাড়িতে উঠতে, ইনান ভেবেছিল হসপিটালে নিয়ে যাবে, তাই ফ্রেন্ডকে নিয়ে দ্রুত উঠে পড়ে। জেহফিল সেই মুহুর্তে কিছু না বললেও বড় রাস্তায় উঠে ইনানের ফ্রেন্ডকে নেমে যেতে বলে, কারণ সে হসপিটালে না, একাডেমিতে যাবে। জেহফিলের এমন নির্দয় কাণ্ডে ইনানের লজ্জায় মাথা কাটা গেল। জেহফিলকে ইশারা ইঙ্গিতে বললো হসপিটালে নয়তো তার ফ্রেন্ডের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু জেহফিল যেন ইনানের ইশারা বুঝেইনি এমন ভাবে গাড়ি থামিয়ে মেয়েটার নামার অপেক্ষা করছে। মেয়েটার বিব্রতবোধ বুঝতে পেরে ইনান শেষমেশ না পেরে বলেই ফেলল,

‘সাত নং রোডে চলুন, ওর বাসা ওখানেই।’

ইনানকে আবার লজ্জার আর অস্বস্তির সাগরে ডুবিয়ে জেহফিল সরাসরি বলল,

‘দেরি হয়ে যাবে ওখানে গেলে। তোমার ফ্রেন্ডকে বলো এখান থেকে গাড়ি নিয়ে যেতে।’

ইনান অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে রইল। অসহায় চোখে মেয়েটার দিকে তাকাল। বান্ধবীর চোখে অপ্রত্যাশিত অপমানে ছোট হয়ে যাওয়ার ভার সইতে পারছে না ইনান। তার ফ্রেন্ডের চোখের তারায় অপমানের ছায়া ইনানের নজর এড়ালো না, হয়তো এই ধরনের নিষ্ঠুর আচরণের মুখোমুখি এই প্রথম। মেয়েটি‌ দ্রুত ইনানের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে সে শুধু দেখতে পেল ইনানের ফ্যাকাশে মুখের আওয়াজ ছাড়া সরি বলা।

মেয়েটি অন্য গাড়িতে করে চলে যাওয়ার পর ইনান চড়াও হলো জেহফিলের উপর।

‘এইসব কী ধরনের আচরণ জেহফিল?? একটা মেয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে তাও আবার আপনার জন্য, সেখানে দয়া দেখানো দূরের কথা, আপনি কিনা মাঝ রাস্তায় মেয়েটাকে বের করে দিলেন? এতটা অমানবিক আচরণ কেন আপনার? মন বলতে কি কিছু নেই?’

জেহফিল নিশ্চুপ। সে গাড়ি থেকে নেমে পিছনের সিটের দরজা খুলে দিলো। পানির বোতল নিয়ে মেয়েটা যেই সিটে বসে ছিল সেখানে ঢেলে দিলো। ইনান হতবাক হয়ে জেহফিলের কাণ্ডকারখানা দেখছে। জেহফিল টিস্যু নিয়ে ভালোভাবে সিট মুছল, যেন সিটে এক বস্তা কাঁদামাটি ছড়ানো ছিল। ইনান ভাবতে লাগল জেহফিলের ওসিডি আছে কিনা।

কাজ শেষে জেহফিল ইনানের পাশের দরজা খুলল। ইনানের মুখের কাছে মুখ এনে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকল। ইনান বুঝল না জেহফিলের এমন করার কারণ। ইনানকে অবাকের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে দিয়ে জেহফিল বোতলের শেষ পানিটুকু সজোরে ইনানের মুখে ছুঁড়ে মারল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল ইনান‌। তার মুখ হা হয়ে আছে বিস্ময়ে।

‘জেহফিল!’

জেহফিল বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ইনানের ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা সরিয়ে দুই আঙ্গুলের মাঝে চেপে ধরল ঠোঁট। ইনান ব্যথায় শব্দ করে উঠল, তাও জেহফিল ছাড়ল না। চাপে ইনানের ঠোঁটের রক্ত সরে সাদা হয়ে গিয়েছে, দুই মিনিট পর জেহফিল ছেড়ে দেয়। ঠোঁটে রক্ত জমাট বেঁধে আগের চেয়েও টকটকে লাল হতেই জেহফিল ইনানের ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। ভালোবাসার ছোঁয়ার বদলে রাগান্বিত কামড়ে ইনানের ঠোঁটে দাগ বসে গেল। জেহফিল সরে এসে ইনানের লালচে দাগ পড়া অধরে তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে বলল,

‘তোমার ফ্রেন্ডের লাক আছে বলতে হয়, মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে। অ্যান্ড ইয়েস, আমার মন আছে বলেই তোমাকে ভালোবাসি বাটারফ্লাই। যদি কোনো ডাউট থাকে আমি প্রমাণ দিতে রাজি আছি।’

ঠোঁটের ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় জেহফিলের প্রথম লাইনের মিনিং বুঝতে পারল না ইনান। জেহফিল ইনানকে ছেড়ে সিটে এসে বসল।

.

আজকের ক্লাসে তোয়া এসেছে। মেয়েটা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সবাইকে কাজ শেখাচ্ছে। আজকে জেহফিল আসবে না, কারণ তার আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে এই সময়। ইনান ক্লাস শেষ হওয়ার বিশ মিনিট আগেই বেরিয়ে পড়ল। তার মন বিক্ষিপ্ত। তার ফ্রেন্ডের সাথে জেহফিলের কড়া আচরণ ভুলতে পারছে না। কলেজে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবে সে??

এদিক সেদিক হাঁটতে হাঁটতে ইনান তিন তলার লম্বা বেলকনিতে এসে পৌঁছল। কিছুক্ষণ পর পর তার বুক চিরে অজানা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকা ইনান খেয়াল করল না তার পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়ে তাকে সূক্ষ্ম চোখে পরখ করছে।

‘আবারও হারিয়ে গিয়েছেন?’

পেছনে কারো অকস্মাৎ আওয়াজে চমকে উঠে ইনান। পিছু ফিরে দেখে ঐদিনের টোলওয়ালা ছেলেটা স্নিগ্ধ হাসছে। ইনানের মন বিষণ্নতায় ডুবে থাকায় এই ছেলের স্নিগ্ধ হাসি ইনানের গভীরতা ছুঁলো না। বরং ইনান প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। তার চোখেমুখে ফুটে উঠল তা। চোখ ঘুরিয়ে ইনান রেলিংয়ে ফিরে তাকায়।

তাজবীর অফিস রুমের দিকে যাচ্ছিল কিছু কাজে। তখন তার চোখ পড়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক রূপসী কন্যার দিকে। তাজবীর নজর ফিরিয়ে হাঁটতে নিলে হঠাৎ মনে আসে মেয়েটিকে তার চেনা চেনা লাগছে। আরেক পলক তাকাতেই চিনে যায়। সেদিনের হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি। আজকেও আবার হারিয়ে গেছে কিনা জানতে তাজবীর তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। ভেবেছিল দাঁড়িয়ে থাকলে মেয়েটি তার উপস্থিতি টের পাবে। প্রায় ছয় মিনিট পরও যখন মেয়েটির হেলদোল দেখল না তাই নিজ থেকেই বলে উঠল,

‘আবারও হারিয়ে গিয়েছেন?’

মেয়েটি চমকানো দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকায়। ডাগর ডাগর চোখের ঔদাসীন্য চট করে ধরে নেয় তাজবীর। ঘন পল্লবে ঢাকা বিমর্ষ চোখজোড়া হঠাৎ করেই তাজবীরের অন্তঃকরণে ঝড় তোলে। মেয়েটার মন খারাপের কারণ জানার ঝড়। তাজবীর কিছু বলার আগেই লক্ষ্য করল মেয়েটার চোখে বিরক্তি ভাব। তাকে দেখেই কি বিরক্ত হয়েছে? তাকে দেখে মানুষ বিরক্তও হয়? বিশেষ করে মেয়ে মানুষ?? ভাবল তাজবীর।

কাশি দিয়ে আবারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। তার কাশি যে ইচ্ছে করেই দেয়া হয়েছে তা ঢের বুঝতে পারল ইনান। তাই বিরক্তির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কপালে ভাঁজ ফেলে ‘চ’ কারান্ত বিরক্তির শব্দ তুলে ছেলেটার পানে চাইল। চোখ দুটোয় অদৃশ্য প্রশ্ন, “কী চাই?”

তাজবীর বুঝল ইনানের চোখের প্রশ্ন। তাই হালকা হেসে বলল,

‘আই থট আপনি আবার হারিয়ে গেছেন ঐদিনের মতো। নেভারমাইন্ড। আমার বোঝার ভুল।’

‘দ্যান লিভ নাউ।’ ইনান কঠোর সুরে বলল।

আবারও হাসল তাজবীর। হাসির সাথে তার ডান গালে সুন্দর গর্ত হয়ে হাসিটাকে দ্বিগুণ সুন্দর করে তুলছে।

‘নো নিড টু বি সো রুড। অপরিচিত মানুষের সাথে রুড বিহেভ করবেন না, তার মনে খারাপ ধারণা হতে পারে। বাই দ্য ওয়ে, আপনার কি কোনো কারণে মন খারাপ? এত রেগে আছেন? ঐদিন তো আপনাকে দেখে শান্তশিষ্ট ভেবেছিলাম।’

ইনানের মন খারাপের মাঝে তাজবীরের ভালো কথা গুলো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। ইনান বিচলিত মস্তিষ্কে আজগুবি ভাবনা টোকা দিলো। ভাবল ছেলেটা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ইনানের সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করছে, এই ভাবনা তার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিলো।

‘এই মিয়া, জ্ঞান দিতে বলছি? ভাগেন এখান থেকে, যতসব ফাতরা!’

তাজবীরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তার সামনে কেউ মন খারাপ করে থাকলে সে সবসময় তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। হোক পরিচিত কিংবা অপরিচিত। আর এই মেয়েটা পনের বিশ মিনিটের জন্য পরিচিত তার কাছে। মেয়েটার মুখ দেখে তাজবীর আন্দাজ করে নিলো মেয়েটার ভারী মন খারাপ। সে শুধু বিনয়ী হওয়ার চেষ্টা করছিল, এ ছাড়া তো আর কিছুই না!! আজকাল দেখি মানুষের ভালোও করতে নেই।

তারা যেখানে কথা বলছিল সেটা একটা গলির মতো। সেই গলির মাথার সামনে দিয়ে কেউ একজনের দ্রুত পায়ে হাঁটার শব্দ হলো। লোকটা এক সেকেন্ডের মাথায় এই পাশ হতে ঐ পাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার দ্রুত চলার কারণে বোঝা গেল না লোকটি কে, তবে ইনানের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলছে এক্ষুণি চলে যাওয়া লোকটা থামবে আর দুই পা পিছু হটে গলির দিকে তাকাবে। ইনানের ইন্দ্রিয়কে প্রমাণিত করে ঐ লোকটার হাঁটার আওয়াজ থেমে গেল। ইনান সতর্ক হয়ে উঠে। পিছু হাঁটার আওয়াজ শোনা যাওয়ার পূর্বেই ইনান এক ছুট লাগাল। চোখের পলকে সে সিঁড়ি মাথায় চলে গেল। ইনান দৌড়ঁ দিয়ে যখনই আড়াল হলো ঠিক তখনই, একদম ঠিক তখনই গলির মাথা থেকে জেহফিল দুই পা পিছু হটে গলিতে তাকায়। দেখতে পায় তাজবীর রেলিংয়ের পাশ ফিরে একা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার যে মনে হলো তার বাটারফ্লাইও এখানে ছিল!! সে তো ভুল হতে পারে না! বিশেষ করে বাটারফ্লাইয়ের ক্ষেত্রে! শকুনের ন্যায় তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে বেলকনিতে ভালোভাবে চোখ বুলায়, মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা তাজবীরকে ছাড়া তো আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না!

যখন কাউকেই দেখল না তখন তাজবীরকে ফেলে সে আবারও নিজের মতো সামনের দিকে পা বাড়ায়। গুণে গুণে আট পা আগানোর পর তার শার্ট চেপে ধরে পেছন থেকে কেউ একজন। ঝট করে পেছনে তাকাতেই দেখে ইনান এক হাত হাঁটুতে রেখে হাঁপাচ্ছে।

‘আপনি..আপনি কোথায় ছিলেন? সেই কতক্ষণ ধরে খুঁজছি।’ ইনান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। জেহফিল ইনানকে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলো,

‘কোথায় ছিলে তুমি?’ ভারী কণ্ঠে বলল জেহফিল।

শান্ত হয়ে আসলে ইনান জেহফিলকে নিয়ে হাঁটা শুরু করে, বলে,

‘আপনাকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলাম, ভবনটা পুরো গোলক ধাঁধার মতো, আমার কাছে তো সব ভবনই এক রকম লাগে। আমি সিরিয়াসলি ভেবেছি আমি হারিয়ে গেছি। থ্যাংক গড, আপনাকে পেলাম।’ ইনান ঠোঁটে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করল। সফলও হলো।

তারপর জেহফিলকে জড়িয়ে ধরল। জেহফিলকে একটু আদর আদর কথা বললে শান্ত হয়ে যাবে। জেহফিল ইনানের গাল ধরে নিজের কাছে নেয়,

‘সোনা, আর কখনও একা একা অফিস থেকে বের হবে না। তুমি জানো আমি কতটা টেনশনে থাকি তোমাকে না দেখলে? আর কক্ষণও যাবে না আমাকে না বলে, কেমন?’ জেহফিল ইনানের চুলে হাত বুলায়।

ইনান বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। সেই মুহুর্তেই তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি খেলে গেল। জেহফিলের বাহু দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘দোষটা তো আপনারই।’

‘আমি কী করেছি?’

ইনান দুঃখ পাবার ভান করে বলে,

‘আজ যদি মোবাইলটা থাকত তাহলে তো আপনাকে কল করলেই পেয়ে যেতাম। আমার এত দৌঁড়াদৌঁড়ি করাও লাগতো না। যদি কোনো বিপদে পড়তাম কী হতো বলেন তো? এইখানের কোনো ছেলে যদি আমাকে অসহায় পেয়ে ক্ষতি করত?‌ মোবাইলটা থাকলে কিন্তু এসব হতো না।’

ইনান জেহফিলকে টেনশনে ফেলে আড়চোখে তার দিকে তাকায়। জেহফিল কোনোভাবে যদি তার চাল বুঝে যায় তাহলে সে শেষ!! তাই জেহফিলকে আরো টেনশনে ফেলতে ইনান মোবাইল না থাকলে আজ কি কি ক্ষতি হতে পারত সব বলতে লাগল।

‘ঠিকাছে সোনা, তোমাকে মোবাইল দিয়ে দিবো‌। তবে তোমাকেও কথা দিতে হবে তুমি আমাকে না বলে কোথাও যাবে না।’

ইনান ভেতরের উপচে পড়া খুশিকে খুব কষ্টে থামাল, বলল,

‘আচ্ছা প্রমিস।’

জেহফিলকে কোনো সন্দেহ না করতে দেখে ইনান মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এবার বাবার সাথে একটু কথা বলতে পারবে।

.

.

ভোরে কোনো কিছুর আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে ইনান। আওয়াজটা বারান্দার দিক থেকে আসছিল। তখন আকাশ পাতাল এক করে বৃষ্টি হচ্ছিল। চারিদিক অন্ধাকারে ছেয়ে গেছে। ইনান ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় গিয়ে নিচে তাকানো মাত্রই তার ঘুম কর্পূরের মতো উড়ে গেল। নিচে ঝোপঝাড়ে ঢাকা অন্ধকার জলাশয়ের কাছে জেহফিল দাঁড়িয়ে। তার হাতে কতগুলো ফুলের গাছ। ইনান বারান্দায় তাকালো। ফুলের টব আছে কিন্তু একটাও গাছ নেই। ছয়টা টব ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে, মাটি চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে অত্যাধিক ক্রোধের সাথে গাছগুলো তুলে ফেলা হয়েছে।

জেহফিলের দুই হাতের মুঠোয় গাছগুলো প্রাণহীন অবস্থায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। ইনানের চোখ বড় বড় হয়ে গেল যখন দেখল জেহফিল একটা একটা করে ফুলগুলো হাতে পিষে মাটিতে ফেলছে। দৃশ্যটা দেখে ইনানের মাথায় ‘পশু’ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ মাথায় আসলো না।

ইনানের তখন চোখ গেল কয়েক টুকরো করা কদম গাছের দিকে। ফুল গাছগুলো পায়ে পিষে জেহফিল এগোলো কদম গাছের দিকে। জেহফিল একটা একটা করে কদম ফুল জুতোর তলায় গর্জন করে হিংস্রভাবে পিষে দিচ্ছে। যেন বহুদিনের ক্ষোভ মেটাচ্ছে। বৃষ্টিতে তার ঘাড় অবধি চুলগুলো কপালে, ঘাড়ে লেপ্টে আছে, শরীর চুপচুপে ভেজা। তার চৌকশ ধারালো মুখশ্রী অপ্রকৃতিস্থের মতো লাগছে। জেহফিলের কাজে আপনাআপনি ইনানের মুখ থেকে জোরে আওয়াজ বেরিয়ে আসল।

ইনানের আওয়াজ বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ থেকে জোরে ছিল কিনা ইনান জানে না, তবে ইনানের আওয়াজ শোনা মাত্র কদম ফুলের উপর থাকা জেহফিলের শক্ত ভারী পা থেমে যায়। ধীরে ধীরে ঘাড় কাত করে ইনানের দিকে চায়। জেহফিলের চেহারার দিকে তাকানো মাত্রই ভয়ের শীতল স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। ঠিক এই চাহনি.. ঠিক এই চাহনিতেই প্রথম দিন রাস্তা থেকে রেস্টুরেন্টে ইনানের দিকে তাকিয়ে ছিল জেহফিল‌। জেহফিল বাঁকা হাসে আর কী যেন বিড়বিড় করতে থাকে। ইনান কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে জেহফিলের হাসি দেখে। সে ভেবে পায় না এই মুহুর্তে জেহফিলকে কী বলবে, সুন্দর নাকি ভয়ঙ্কর!!‌

ইনানের দিকে তাকিয়ে থেকেই জেহফিল একের পর এক কদম ফুলে পা মাড়াতে থাকে। যেন ইনানকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইনানের পছন্দের জিনিস নষ্ট করছে।‌ ইনানের মাথা ঘুরে উঠল। বৃষ্টিতে সেও ভিজে গেছে। ইনান জানে না, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা নাকি জেহফিলের নির্মম রূপ দেখার পর ইনানের মাথার ভেতরটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। আবছা হয়ে আসে চারিদিক। বৃষ্টিতে চোখ খুলে রাখাও দায় হয়ে পড়েছে। শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফ্লোরের সাথে ইনানের মাথায় আঘাত লাগবে এই সময়ে শক্ত এক হাত এসে ইনানের মাথা ধরে ফেলে। ইনানের ছোট্ট শরীরটাকে তার দানবের মতো বুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ইনান শুধু অস্পষ্ট কণ্ঠ শুনতে পায় সেই মানুষ রূপী দানবটার গর্জন,

‘আমার বাটারফ্লাই.. তুমি শুধু আমার..শুধু.. শুধুই আমার। তোমার প্রায়োরিটির লিস্টে টপে থাকা ব্যক্তি বা বস্তুটি শুধুই আমি, আমি এবং আমি। যদি কেউ এই আমাকে ক্রস করতে চায় তাহলে তার অবস্থাও হবে তোমার প্রিয় ফুলগুলোর মতো…মৃ’ত…’

.
.
চলবে..