রোদরঞ্জন পর্ব-২৬+২৭

0
176

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৬
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

ইনান বিধ্বস্ত। তার আর পুতুলের মাঝে কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না সে। এই পুতুলের জীবন ইনান দমবন্ধ করে দিয়েছে। সে খুব ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জেহফিল থেকে কিছুদিন দূরে থাকার। এমনি এমনি তো এই ধরনের সিদ্ধান্ত কোনো স্ত্রী নেয় না তাই না? ইনানও এমনি এমনি নেয়নি।‌ তার লাইফ হেল জেহফিল নামক বিষাক্ত পুরুষটা।

কাল যখন একাডেমি থেকে ফিরছিল তখন ইনান গাড়ির জানালা খুলে আনমনেই বাইরে দৃষ্টিপাত করেছিল। শীতল আবহাওয়া উপভোগে ব্যাঘাত ঘটায় জেহফিল। কথা নেই বার্তা নেই জানালার কালো কাঁচ উঠিয়ে দেয়। ইনান জেহফিলের দিকে তাকানো মাত্রই ভড়কে গেল। ক্ষুব্ধ চোখে জেহফিল তাকে দেখছে।

‘খুব ভালো লাগে তাই না?’

ইনান বোকা বনে গেল। জেহফিলের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না।

‘কী ভালো লাগবে?’

‘পরপুরুষকে দেখতে? ঐ ছেলের দিকে এভাবে তাকিয়েছিলে কেন? আমার থেকেও বেশি সুদর্শন তাই?’

ইনান স্তম্ভিত। কীসের ছেলে, কোন ছেলে, আল্লাহই ভালো জানে!! ইনান সেই উদ্দেশ্যে আবারো বাইরে নজর দেয়। মাথা ঘুরানোর আগেই জেহফিল ইনানের ঘাড় ধরে ফেলে। শক্ত করে ধরে ইনানকে নিজের দিকে ফেরায়।

‘আবারও ঐ ছেলের দিকে নজর দিচ্ছ কেন? আমাকে এখন আর ভালো লাগে না?’

‘আজব কথাবার্তা! কোন ছেলেকে আমি দেখছিলাম? আমার চোখ, আমিই জানি না?’

‘মিথ্যে বলবে না বাটারফ্লাই। আমি স্পষ্ট দেখেছি তুমি ঐ ছেলেটার দিকে তাকিয়েছিলে।’

জেহফিলের বারবার এক কথা বলায় ইনান এতই বিরক্ত হলো যে বলল,

‘ভালো হয়েছে দেখেছি, তো কী হয়েছে? ঐ ছেলেকে গিয়ে কি আমি চুমু খেয়েছি? না ও’কে হাত দিয়ে কাছে ডেকেছি? সামান্য চোখ যেতেই পারে পথচারীদের উপর! এতে রিয়েক্ট করার কী আছে?’

জেহফিলের শরীর রাগে কাঁপতে লাগল যখন তার মস্তিষ্কে এক কুৎসিত দৃশ্য ভেসে উঠল। তার বাটারফ্লাই ঐ ছেলেটাকে চুমু দেয়ার দৃশ্য। ইনান কীভাবে এই কথাটা বলতে পারল? বলার সময় নিশ্চয়ই ঐ ছেলের কথা ইনানের মাথায় ঘুরছিল! ঐ ছেলেটাকে চুমু… নাহ! জেহফিল আর ভাবতে পারল না। রাগে কম্পিত হাতে ইনানের ঘাড় ছেড়ে দিলো ঝাড়ি মেরে। তারপর গাড়ি চালাল হাইস্পিডে যে ইনানের আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। হাজার বারণ সত্ত্বেও জেহফিল স্পিড কমায়নি। পুরোটা সময় ইনান জান হাতের মুঠোয় রেখে এসেছিল।

বাড়ির সামনে আসতেই জেহফিল ক্ষিপ্রবেগে ইনানের হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে উপরের তলায় নিয়ে আসে। ইনানের আকুতি তার কানে যায়নি। ইনানকে নিয়ে খাটের উপর বসায়,

‘ছাড়ুন, হাতে লাগছে।’

জেহফিল ছাড়ল না। ইনানকে খাটে রেখেই সে হঠাৎ ক্লজেট থেকে কিছু জামা কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকল। ওয়াশরুমের দরজা আটকানোর সময় কী মনে করে আবার বেরিয়ে আসলো। এসে ইনানের কোমর ধরে নরম খাটের উপর ছুঁড়ে মারে। ইনানের উপর উঠে বসে তার গা থেকে ওড়নাটা টান দিয়ে নিয়ে ইনানের দুই হাত মাথার কাছে নিয়ে হেডবোর্ডের সাথে বেঁধে দেয়। ইনান ভয় পেয়ে যায়‌। জেহফিল যদিও তার স্বামী, তাও জেহফিলের জোরজবরদস্তি তার ভালো লাগে না। পূর্বের নম্র, নিষ্পাপ, দুষ্টু জেহফিলকে সে ভালোবেসেছিল, এই ক্রোধান্বিত, উন্মাদ, পাগল জেহফিলকে নয়।

কিন্তু ইনানের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে জেহফিল ইনানের উপর থেকে সরে গেল। সোজা চলে গেল‌ ওয়াশরুমে। বেরিয়ে আসলো বর্তমান পরিহিত জামাকাপড় বদলে। এখন পরনে তার গ্রে শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স। হাতে দামী ঘড়িটা পরল। ঘাড় অবধি লম্বা চুলগুলোর উপরিভাগ পেছনে নিয়ে ঝুঁটি করল। শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খুলে, শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ইনানের কাছে এসে দাঁড়াল।

জেহফিলকে এত গরম লাগছিল যে ইনান সত্যিই বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। বিশেষ করে চুলগুলো পেছনের দিকে ঝুঁটি করায় আর শার্টের হাতা গুটানোয় তাকে হট চকলেট বয় বললেও ভুল হবে না। পুরাই মাখন! উষ্ণ বালক!

‘লুক অ্যাট মি বেবিগার্ল।’ জেহফিল প্রগাঢ় শ্বাস নিয়ে বলল।

ইনান তো হা করে চেয়েই ছিল। প্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল, কিন্তু সেই দুর্বলতা কেটে গেল যখন জেহফিল চকলেট বয় থেকে ব্যাড বয়ে রূপান্তর হলো।

‘এখন ভালো করে দেখে বলো, সেই ছেলেটার থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে না আমাকে?’

ইনান মুখ থুবড়ে পড়ল যেন। জেহফিলের উপর ক্ষণ সময়ের জন্য জন্ম নেওয়া মুগ্ধতা কেটে গেল নিমিষেই।

‘মানে?’

‘ঐ ছেলেটাও গ্রে শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট পরেছিল। উপরের তিনটা বোতাম খোলা ছিল। আমিও তেমনভাবে পরেছি। এখন বলো, কে বেশি হট? আমি না ঐ জানোয়ার?’

ইনান নির্বাক। কর্কশ গলায় বলল,

‘হাতের বাঁধন খুলুন।’

‘ডোন্ট অর্ডার মি।’ জেহফিলের কড়া কণ্ঠ।

‘আপনাকে অর্ডার করছি না, বলছি এসব পাগলামি বাদ দিয়ে আমার হাতের বাঁধন খুলুন।’

‘আমার এসব পাগলামি মনে হয় তাই না?’ জেহফিল কেমন অদ্ভুত গলায় বলল, ‘তাহলে পাগলামির চূড়ান্ত ধাপটা অতিক্রম করি না হয়?’

ইনান নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে রইল। কিছু একটা ঠিক লাগছে না। মনে হচ্ছে জেহফিল কোনো অঘটন ঘটাবে। ইনানের ভাবনা শেষ হতে দেরি জেহফিলের অঘটন ঘটাতে দেরি নেই। সে এসে ইনানের হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে বেঁধে দিলো। তারপর ক্লজেট থেকে সবকয়টি জামা কাপড় বের করল।

সেই রাতে ইনান ঘুমাতে পারল না। জেহফিল প্রতিটা ড্রেসে নতুন লুকে ইনানের সামনে আসলো। যত শার্ট, প্যান্ট, কোট, টিশার্ট, স্যুট টাই, যা ছিল সব পরে পরে ইনানের সামনে র্যাম্পওয়াক করতে লাগল। আর বারবার এক কথা জপ করতে লাগল, “আমাকে সুন্দর লাগছে?” “হ্যান্ডসাম লাগছে?” “ঐ ছেলের থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম আমি?” “এটা কেমন?” “বাটারফ্লাই?”

ইনানকে ঘুমাতে দিলো না জেহফিল। ইনান চোখ বন্ধ করলেই তার বাঁধন আরো টাইট করত জেহফিল। যার কারণে ঘুমাতে ভয় পেত ইনান‌। না জেহফিল নিজে ঘুমালো সারা রাত, না ইনানকে ঘুমাতে দিলো। জেহফিলের প্রত্যেকটা লুকে ইনান ফিদা হতো যদি না তার সাথে জেহফিলের নরমাল সম্পর্ক থাকত, কিন্তু জেহফিল যে নিজ হাতে ঐ রিলেশনটা শেষ করেছে…

.

.

তারপর থেকে আরো বেশি চেঞ্জড জেহফিল। আগে যেখানে রোজ বাবার সাথে ফোনে কথা বলতো, সেখানে সপ্তাহে তিনদিন চারমিনিট করে কথা বলার সুযোগ পায়। তাও জেহফিলের সামনে, লাউড স্পিকারে। আর কিছুদিন পর দেখা যাবে সপ্তাহে একদিন একমিনিট করে কথা বলতে দিবে। ইনান কীভাবে থাকতে পারবে বাবার সাথে কথা না বলে?

ইনান ছটফট করত জেহফিলের হাতের মুঠোয় থেকে। সারাক্ষণ জেহফিলের চোখের সামনে থাকতে হতো। গোসলও করতে হতো জেহফিলের সাথে, কিংবা দরজা খুলে। একাডেমিতে যাওয়া হতো সপ্তাহে একদিন। কলেজে তো যাওয়া হতোই না। বাকি দিনগুলো জেহফিল ইনানের সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। ঘুমের থেকে উঠে জেহফিল ইনানকে পাশে না পেলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলত। অস্থির হয়ে ইনানকে ডাকতে থাকবে যতক্ষণ না ইনান সামনে এসে ধরা দেয়। বলতে গেলে একটা সেকেন্ডও ইনান নিজেকে দেয়ার সময় পায় না। একটু নিজে একা থেকে কিছু ভাববে সেই স্বাধীনতাও তার নেই। বারান্দায় গেলে জেহফিলও তার পিছু পিছু চলে আসে। রান্নাঘরে গেলেও সুরসুর করে চলে আসে। ইনান দম ফেলার সুযোগ পায় না। দম নিতে না নিতেই জেহফিল হাজির। ইনানের মনে হয় জেহফিল মুখে না বললেও মনে মনে বলে,

“আমাকে না বলে শ্বাস নিয়েছ কেন সোনা?”

ইনান আতঙ্কে থাকে পুরোটা সময়। কখন না জানি সত্যি সত্যি জেহফিল তার নাক চেপে ধরে শ্বাস নেয়ার জন্য।

ইনান আর্টরুমে বসে পটারির কাজ করে আর জেহফিল তাকে দেখিয়ে দেয়। কাজের সময় জেহফিল একদম প্রফেশনাল। কোনো ফাঁকি দেয় না, ইনানকেও দিতে দেয় না। ইনানের সামনে বসে কড়ায় গন্ডায় কাজ উসুল করে। এই দিকটা ভালো দেখে তো বাকি খারাপ দিকগুলো এড়িয়ে যাওয়া যায় না, তাই না?

কাজের সময়টুকু ছাড়া ইনান যখন নিজের বানানো কোনো জিনিসকে খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করে, কিংবা সারাদিন মুগ্ধ হয়ে সেই জিনিসটার প্রতি চেয়ে থাকে, জেহফিল সেটাকে টুকরো টুকরো করে দেয়। যেমন, জেহফিল একটা মগ বানিয়েছিল, খুব সুন্দর, লতানো ফুলের। ইনানের মগটা এত ভালো লেগেছিল যে সে সারাটাক্ষণ হাতে নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। সেটা জেহফিল সহ্য করতে পারেনি। মগটা নিয়ে বারান্দা থেকে নিচে এমন জোরে আছাড় মারল যে মগের টুকরো অংশগুলোও দেখা গেল না।

জেহফিল তখন ইনানের কাঁধ ঝাঁকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘আমি বলেছি না কোনো কিছুতে অতিরিক্ত আকৃষ্ট হবে না আমি ছাড়া? কথা কানে যায় না কেন?’

.

আবার জেহফিল ইনানকে কোথাও কোলাহলপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যায় না। মেলা হয়, মেলাতেও না। তার মানুষজন বিরক্ত লাগে। জেহফিল মানুষ দেখলেই কেমন নাক সিঁটকায়। ইনানকে নিয়ে যাবে নদীর কাছে, তাও অসময়ে। আবার রাস্তার পাশের ফুচকা, চটপটির দোকান থেকে কিছুই খেতে দেয় না। বলে, এগুলো অস্বাস্থ্যকর। তাই জেহফিল নিজেই ঘরে বানিয়ে দেয়। তবুও, ঘরের আর বাইরের ফুচকার মধ্যে তফাৎ আছে অনেক।

জেহফিল ঘোরার জন্য যেই জায়গাটা সবচেয়ে বেশি প্রেফার করে তা হচ্ছে জঙ্গল। তার নাকি জঙ্গল সবচেয়ে শান্তির জায়গা মনে হয়। নিরিবিলি, নির্জন। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে একবার নিয়ে গিয়েছিল। ইনান এত ভয় পেয়েছিল যে সারাটা সময় জেহফিলের হাত জড়িয়ে ধরেছিল। অথচ জেহফিলের চোখের তারায় ঝিকমিক করছিল আনন্দ, যেটা দেখে ইনান আরও বেশি ভয় পেয়েছিল।
.

.

‘আই নিড স্পেস জেহফিল।’

জেহফিল তার নিউ স্কাল্পচারের জন্য পেস্ট তৈরি করছিল।গভীর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে ইনানের বলা বাক্যটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করায়। মসৃণ কপালে ভাঁজ ফেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইনানের দিকে তাকায়‌,

‘হোয়াট ডিড ইউ সে?’ হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ায়।

ইনান জেহফিলের চোখে চোখ রাখে। দৃঢ় গলায় বলে,

‘আই নিড স্পেস জেহফি..’

ইনানের কথা শেষ হবার আগেই জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে পেস্ট হাতেই। গরম চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,

‘শুনিনি, আবার বলো কী বললে?’

ইনান ঢের বুঝতে পারল জেহফিলের হুমকি। ইনান বুকে সাহস সঞ্চয় করল। জেহফিলের শক্ত আঙুল তার গাল চেপে ধরায় মুখ নাড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। ইনানের কাছে স্পষ্ট যে জেহফিল তাকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে না।

ইনান জেহফিলের হাত সরালো।

‘যদি কথাটা আবার না শুনতে চান তাহলে আমাকে ফ্রিডম দিন।’

‘আমি তোমাকে ফ্রিডম দেই না?’ জেহফিল অবাক গলায় বলল, ‘কোন ব্যাপারে ফ্রিডম দেই না?’

‘অনেক ব্যাপারেই। তবে আমার আপাতত বাবার সাথে কথা বলার ফ্রিডম লাগবে।’

‘ইউ অলরেডি হ্যাভ দ্যাট।’

‘না, কথা বলার সময় আপনি কাছে থাকবেন না।’

‘সরি। পারব না।’ জেহফিলের তৎক্ষণাৎ জবাব।

‘তাহলে আমাকে স্পেস দিন।’

‘তাও পারব না।’

ইনান চোখ বন্ধ করে ম্লান গলায় বলল, ‘আমি ক্লান্ত আপনার আচরণে, আপনার ব্যাবহারে, আপনার ভালোবাসায়‌। আমি আর এই লাইফ লিড করতে পারছি না। এই জীবন আমার জন্য নয়। আমি এভাবে বন্দী থাকতে পারছি না। আই নিড ফ্রিডম। সোজা কথায় বলতে গেলে, আমার ডিভোর্স চাই।’

ইনান চোখ খুলল। জেহফিলের দিকে চাইতেই আঁতকে উঠল সে। জেহফিল রাগে গর্জন করছে, ঘাড় কাত করে তার দিকে হিংস্র চোখে চেয়ে আছে।

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

ঘোর অন্ধকারে ঢেকে আছে রুমটা। চারিদিক গা হিম করা নিস্তব্ধতা। ক্ষণকাল বাদে বাদে ইঁদুরের চিঁ চিঁ আওয়াজ করে দৌড়ানোর শব্দ কানে ঠেকছে।

নিচতলার পরিত্যক্ত গোডাউনে ইনান বন্দী। বন্দী করে রাখা হয়েছে। তমসাচ্ছন্ন রুমে বাহির থেকে আসা আলোর ছিটেফোঁটাও নেই।

ইনান ঘামে জবজবে। শুষ্ক গলাটাকে ঢোক গিলে ভেজানোর বৃথা চেষ্টা করছে। ভ্রু জোড়ায় আতঙ্ক উঁকি দিচ্ছে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে ভয়ে। একটু পর পর হেঁচকি তুলে কাঁদছে।

দুই হাত হাতড়ে হাতড়ে রুমটার মাঝখানে হেঁটে দরজা খুঁজছে। জেহফিল তাকে যেই দরজা দিয়ে এনেছিল সেই দরজা। কিন্তু যতবারই এক পা আগাচ্ছে ততবারই মনে হয় সে এখনো এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।

তখন ডিভোর্সের কথা বলার পর জেহফিল ইনানকে টেনেহিঁচড়ে অন্ধকার গোডাউনে নিয়ে আসে। সিঁড়িঘরে কোনো তেমন আলো না থাকায় ইনান গোডাউনের ভেতরটা ভালো করে দেখতেও পারেনি তার আগেই জেহফিল তাকে ছুঁড়ে মারে রুমের মধ্যে। ইনানের হাত এত শক্ত করে ধরেছে যে ব্যথায় টনটন করে উঠে জায়গাটা। ইনান কিছু বলার আগেই জেহফিল গোডাউনের গেইট আটকে দেয়। গেট আটকানোর সময় আবছা চোখে ইনান দেখে জেহফিলের চোখমুখের অস্বাভাবিকতা, ওষ্ঠাধর শব্দহীন বিড়বিড় করছে, চোখ দুটো রক্তিম অথচ নিদারুণ বিষাদে নিমজ্জিত। মুখের এক্সপ্রেশন প্রকাশের জন্য কোনো সঠিক শব্দ ইনানের ডিকশনারিতে নেই। ঠিক বুঝল না ইনান, জেহফিল কি রাগে কাঁপছে নাকি কান্নায়…!

যতবার শরীরের শক্তি কুলোয় ততবার ইনান জেহফিলকে ডেকেছে। এখন গলা শুকিয়ে কাঠ। একটু পানির আশায় বুক হাহাকার করছে। জেহফিলের সাড়া পাওয়া যাবে না সে জানে, কেননা ইনানকে এখানে রেখে যাওয়ার পর জেহফিলের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কিংবা নামার আওয়াজ শুনতে পেয়েছে সে। জেহফিল কি উপরে গিয়েছে নাকি বাসা থেকে বের হয়েছে ইনান ঠাওর করতে পারছে না।

চোখ খুললেও আঁধার, বন্ধ করলেও আঁধার। এমন না যে ইনান অন্ধকারে ভয় পায়। আগে বাড়িতে কত কারেন্ট যেত, তখন তো সেই অন্ধকারেও ইনান শুয়ে থাকত। তার বাবা আসতো লাইট হাতে। কিন্তু এখনের পরিস্থিতি যে আলাদা! এখন বাবাও নেই। চারিদিকে না আছে কোনো প্রতিবেশী, আর না আছে এই ফাঁকা রাস্তায় কারো চলাচল।

ইনানের ভয় করছে। ভীষণ ভয়! সে জানে না আদৌ জেহফিল আছে কিনা বাসায়। নাকি ইনানকে এই পরিত্যক্ত, নির্জন, ভুতুড়ে বাড়িতে একা ফেলে গেছে! এই ভাবনা ইনানকে ভয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

যেই ইনান ভূতের ভয় পেত না সেখানে এখন সেই হাস্যকর ভয়টাই পাচ্ছে। এই অন্ধকারেও মনে হচ্ছে তার পাশে কোনো অশরীরীর হাঁটাচলা। ইনান এলোমেলোভাবে হাত নাড়ানোর ফলে সিলিং থেকে বয়ে আসা কিছু একটা ইনানের মুখে লাগল। ইনান জিনিসটা হাত দিয়ে ধরে ধরে দেখল একটা দড়ি। আর দড়িটার নিচের দিকে গোল হয়ে আছে, মানে.. ফাঁ’সির মতো দড়ি বেঁধে রাখা হয়েছে। ইনান আতঙ্কিত হয়ে ছিটকে দূরে সরে যায়। পায়ের সাথে কিছু একটা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নোংরা মেঝেতে। জেহফিলের থেকে একবার শুনেছিল, এই গোডাউনের মালিকের বেশ কয়েকজন কর্মচারী কাজের সময় আগুনে পুড়ে মারা যান। মালিকের গাফলতির কারণেই। মালিক অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে গোডাউনে এসেই গলায় ফাঁস দিয়ে‌ আত্মহ’ত্যা করে। তাই এই বাড়িটার দাম এত নিম্ন।

ইনানের মনে হলো সেই গোডাউনের মালিক এবং কর্মচারীদের পোড়া আত্মা ইনানের পাশে ঘুরঘুর করছে। বিকৃত চেহারা নিয়ে ইনানকে চোখ দিয়েই মৃ’ত্যুর তীর ছুঁড়ে মা’রছে।

এই মুহূর্তে ইনানের সবচেয়ে বেশি অসহায় লাগল। জঙ্গলের এই নির্জন বাড়িতে বিয়ে হয়েছে পর্যন্ত কখনোই ভয় পায়নি সে। ভয় না পাওয়ার কারণ জেহফিল। দুহাতে এমনভাবে ইনানকে আগলে রেখেছিল যে ইনানের কখনো মনেই হয়নি তারা দুজন যে নিরিবিলি, নিস্তব্ধ, গভীর জঙ্গলের মাঝে বসবাস করছে। জেহফিল যে কখনো সেই ভাবনাটুকু ইনানের মনে আনতেই দেয়নি। পরিস্থিতি যাই হোক, জেহফিল কখনোই ইনানকে একা বাসায় রেখে কোত্থাও যায়নি।‌ তাই জেহফিলের প্রস্থানে এতদিনের না হওয়া ভয়টা ইনানকে জাপটে ধরেছে। এই নিস্তব্ধপুরীতে সে একা…

ইনানের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল ভয়ে। ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল প্রতিটি শিরা উপশিরায়। ফ্যাকাশে হলো মুখ। কপাল বেয়ে ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে পড়তে বুকের জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে। অস্থির হয়ে ইনান জেহফিলকে ফ্যাসফ্যাসে গলায় ডাকল। কিন্তু নিজের আওয়াজ নিজের কানেই পৌঁছাল না। যেন বোবা কথা বলছে। ইনান শত চেষ্টা করেও কথা বলতে পারল না।

বসে থেকে মাটিতে হাত রেখে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগুতে লাগল ইনান। এগোনোর সময় বাড়ি খেল একটা ভাঙা চেয়ারের সাথে। ব্যথা এবং ভয়ের মিশ্রণে ফুঁপিয়ে উঠল ইনান। আবারও হামাগুড়ি দিয়ে এগোলে। এবার হাতের উপর দিয়ে নিমিষেই কিছু একটা পিছলে চলে গেল। শিউরে উঠে চিৎকার দিয়ে ইনান পিছু হটল। এটা কি সাপ নাকি ইঁদুর বুঝতে পারল না। ইঁদুর হলে তো আওয়াজ করত। সাপই তো এত চিকন আর পিচ্ছিল হয়। ইনানের মুখ নীল হয়ে উঠল। দ্রুত ভাঙা চেয়ারটা খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোনদিকে সেটা বুঝতে না পারায় কাঁচুমাচু হয়ে দ আকৃতিতে বসল। অতিরিক্ত ভয়ে ইনান এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

মনে মনে সে জেহফিলকে ডাকছে। জানে না কেন, তবে এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে জেহফিলের কথাই তার মাথায় আসলো। সে ডাকছে জেহফিলকে,

‘প্লিজ, জেহফিল, বাঁচান আমাকে। দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। জেহফিল…’ ইনানের কথা গলাতেই আটকে আছে। মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না।

কেঁদে উঠার তিন সেকেন্ডের মাথায় গেইট ক্যাড়ক্যাড় আওয়াজ করে খুলে গেল। ইনান ঘোলা চোখে দেখল সুঠামদেহী জেহফিল গোডাউনে প্রবেশ করেছে। ইনান তার অসাড় হাত বাড়াল। এই আশায় জেহফিল তাকে ধরবে। তাকে এই আজাব থেকে বের করবে। কিন্তু জেহফিল তা করল না।‌ বরং গেইট বন্ধ করে দিলো।

ইনান ডাকল জেহফিলকে। কথা ইনানের ঠোঁটের আগাতেই আটকে গেল। অন্ধকারে জেহফিলকে না দেখা গেলেও তার হাঁটার আওয়াজ শব্দ তুলছে। তার নিকট আসছে জেহফিল। ইনান অনুভব করল জেহফিল হাঁটু মুড়ে তার কাছে বসল। ঘাড়ে অনুভব করল উষ্ণ নিঃশ্বাস। বোধহয় আরেকটু কাছে আসলো জেহফিল, কারণ ইনানের নাকে বারি দিলো জেহফিলের স্ট্রং পারফিউমের সুবাস। তার গলার এক ইঞ্চি দূরে মুখ রেখে গভীর শ্বাস টানল জেহফিল। যেন ইনানের ঘ্রাণ একটানে নিয়ে নিতে চাচ্ছে।

ইনান চোখ বন্ধ করল‌। যেই মনস্টার থেকে ছাড়া পেতে চেয়েছিল সেই মনস্টারকেই এখন সে মনে মনে অনুরোধ করছে বাঁচানোর জন্য।

ইনান টের পেল জেহফিলের দূরে সরে যাওয়া। জেহফিল সেই ভাঙা চেয়ারটা ইনানের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে রেখে বসলো।

ইনান ফিসফিস করে ডাকল,

‘জেহফিল!’

জেহফিল জবাব দিলো না। তবে গাঢ় শ্বাস বেরিয়ে আসার শব্দ পেল ইনান। তার মনে হলো, যেন জেহফিল তার ডাকে সাড়া দিয়েছে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে।

জেহফিল চেয়ারে আর ইনান মাটিতে বসে রইল। প্রায় অনেক অনেকক্ষণ। না ইনান কোনো কথা বলল, না জেহফিল। তবে ইনানের ভয় কেটে গেছে, পুরোপুরি। সে আস্বস্ত হয়ে বসে রইল। এক ঘন্টা কেটে যায় নিঃশব্দে। জেহফিলের গাঢ় নিঃশ্বাস আর ইনানের মৃদু নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। ইনান নিশ্চিত জেহফিল ঘুমোচ্ছে না।‌ কেননা সে টের পাচ্ছে জেহফিলের দৃষ্টি তার উপর।

এই এক ঘন্টায় ইনান একটা টু শব্দও করল না ভয়ে। কারণ ভয়ই যে নেই। অথচ যখন জেহফিল তাকে এখানে রেখে গিয়েছিল তার পাঁচ মিনিটের মাথায়ই ইনানের চিৎকার চেঁচামেচি, হাহাকারে পরিবেশ ভারী হয়ে গিয়েছিল। আর এখন সে স্বস্তি নিয়ে বসে আছে।

আরো পঁচিশ মিনিট পর ভস করে ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল। কাঠি হাতেই জেহফিল উঠে দাঁড়ায়। আগুনের মৃদু আলোয় ইনান দেখল গোডাউনটা অন্ধকারের চেয়েও আলোতে বেশি ভয়ানক। যেন হরর মুভির পুরোনো বাড়ি।

আগুন নিভে যায়। ফের অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারপাশ। জেহফিল ইনানের সামনাসামনি বসে। ইনানের ডান হাত ধরে নিজের বুকে ঠেকায়। জেহফিলের হাত অসম্ভব ঠাণ্ডা। ইনানের হাত ধরে তাকে নিজের কোলে বসালো।

ভারী গলায় বলল,

‘বলতে পারবে তুমি কেন এতক্ষণ ভয় পাওনি?’

ইনান চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায় আঁধারে ঢাকা জেহফিলের মুখটায়। জেহফিলের কথা মাথায় ঢুকছে না। জেহফিল আবারো বলল, গভীর শ্বাস টেনে,

‘দেড় ঘণ্টা আগেও চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছ। অন্ধকার তখনো ছিল, এখনো আছে। তবে এখন কেন ভয় পাচ্ছ না?’

ইনান চুপ করে থেকে বলল,

‘কারণ এখন আপনি আছেন।’

‘এক্সাক্টলি বেবিগার্ল।’ জেহফিলের কণ্ঠ নরম হয়,

‘তোমার দুনিয়াটাও ঠিক এমনই। এতক্ষণ এই অন্ধকারে তুমি একা ছিলে। জানতে যে আশেপাশে কেউ নেই। তারপর আমি আসলাম। তুমি শুধু উপস্থিতিটাই দেখেছ, না কোনো আওয়াজ, না কথা। আমার উপস্থিতিই তোমাকে শান্ত করল। অথচ পরিবেশ পরিস্থিতি কিন্তু একই। আঁধার, নিরব। শুধু যুক্ত হয়েছে আমার উপস্থিতি। ভয় কমলো তোমার। বিশ্বাস ছিল তোমার যে আমি থাকলে তোমার ক্ষতি হবে না। আমার উপর নির্ভর হয়েই তোমার ভয় দূর হলো। এটাই তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি। তুমি আমাকে ছেড়ে থাকলে তোমার জীবনটাও এমন অন্ধকার হবে বাটারফ্লাই। আশেপাশে মানুষ থাকলেও তুমি আঁধারেই তলিয়ে যাবে। ভয় পাবে। যখন আমি থাকব, তখন ভয় তোমাকে ছুঁতে পারবে না। এই যেমন আমি এতক্ষন কাছে ছিলাম বলে তুমি ভয় পেলে না, তেমন।’

জেহফিলের যুক্তিতে ইনান বোকা বনে গেল। হতভম্ব হয়ে বলল,

‘এখানে অন্য কেউ থাকলেও আমি ভয় পেতাম না।’

জেহফিল ইনানের গালে হাত রাখে, ‘সত্যি করে বলো তো, তোমার অচেতন মন কি শুধুমাত্র আমার আসার অপেক্ষাতেই ছিল না?’

ইনান নিশ্চুপ থাকে। এটা সত্যি যে জেহফিল ছাড়া অন্য কারো কথা তার মাথায় আসেনি।

‘তাই বলে তো এই না যে আপনি থাকলেই আমি ভয় পাবো না? আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আমি ভয় পেতাম না।’

‘যদি অন্য কেউ থাকত তাহলে তুমি কি তার উপর বিশ্বাস করতে পারবে যতটা আমার উপর করো? তুমি অজান্তেই আমাকে নিজের জীবনের চেয়েও বিশ্বাস করো বাটারফ্লাই। তুমি মানো কিংবা না মানো। অন্য কেউ আমার জায়গায় থাকলেও তোমার মনের একাংশে ভয় খেলা করত। আমি কি মিথ্যে বলছি?’

ইনান প্রত্যুত্তর করল না। জেহফিল যা বলছে ঠিক বলছে। কোথাও না কোথাও সে জেহফিলকেই আশা করছিল, জেহফিল তার বাটারফ্লাইয়ের ক্ষতি করবে না এই বিশ্বাসটাও তার আছে।

জেহফিল মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করল। ইনানকে কোলে তুলে নিয়ে দোতলায় যেতে যেতে বলল,

‘আমার জীবনটা যেমন তোমার উপর নির্ভর করে, তেমনি তোমার জীবনটাও আমার উপর নির্ভরশীল। অদৃশ্য বাঁধনে তুমি আমি আটকা পড়েছি। এই বাঁধন মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্তও খোলার নয় বাটারফ্লাই।’

‘খুলতে চাইলেই সম্ভব।’

ইনান আনমনেই বলে ফেলল কথাটা। যখন দেখল জেহফিল সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়েছে তখন তার দিকে ফিরল। জেহফিলের চোখে আবারও বিষাদময় হিংস্রতা নামল।

‘প্লিজ বেবিগার্ল। এই ধরনের কথা তোমার মুখে যাতে আর না শুনি। আমি তোমাকে শাস্তি দিতে চাই না, ভালোবাসতে চাই। তোমাকে শাস্তি দিলে যে আমি নিজেই শাস্তি পাই।’

ইনান জেহফিলের তখনকার কথায় ডুবে গিয়েছিল যে নিজের মধ্যে ছিল না ইনান। ভুলে গিয়েছিল জেহফিলের হিংস্রতা। এখন আবার জেহফিলের হিংস্রতা ফিরে এসেছে।

সেই মুহুর্তে ইনান বুঝে গেল জেহফিলের আরেকটি গুণ। ম্যানিপুলেট করার গুণ। কথার মাধ্যমে মানুষকে বশ করা। যেই গুণের প্রথম শিকার ছিল তার বাবা, নাহলে কি একদিনেই কারো হাতে মেয়ে তুলে দেয়া যায়? দ্বিতীয় শিকার ইনান নিজে। যার শিকার কয়েকবার হলেও এখন সে বুঝতে পারছে। মুহুর্তের মাঝে জেহফিল কাউকে হাতের মুঠোয় রেখে নাচাতে পারে তার ক্ষমতা দ্বারা।

ইনান বুঝে গেল যে তার নিস্তার নেই। সে দক্ষ অথচ হিংস্র শিকারির কাছে বন্দী হয়েছে…
.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৭ [বোনাস]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
ইনান খাটে বসামাত্র হাতে ঠাণ্ডা অনুভব করল। নিরুদ্বেগ চাহনিতে হাতে তাকাতেই পিলে চমকায়। রক্ত! তার হাতে রক্ত। দেখল তার জামাতেও রক্ত লেগে আছে। ইনান হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেক করে। কোথাও কেটে গেল কিনা। কিন্তু কেটে গেলে তো সে ব্যথা পেত। ইনান তন্নতন্ন করে খুঁজেও শরীরের কোনো অংশে আঘাতের চিহ্ন পায়নি। হঠাৎ মাথায় আসে জেহফিলের হাত যেখানে যেখানে স্পর্শ করেছে সেখানেই রক্ত। মানে জেহফিলের রক্ত!

জেহফিল ইনানকে রুমে দিয়ে আর্ট রুমে চলে গেছে। জেহফিলের প্রতি ইনানের ভালোবাসা পাহাড়সম অভিমানে ঢাকা পড়লেও স্বামীর প্রতি কর্তব্য তাকে টেনে নিলো জেহফিলের কাছে। রুমের দরজা খুললে বিদঘুটে এক দৃশ্যে চোখ আটকে যায় ইনানের। জেহফিল ইনানের পোর্ট্রেট আঁকছে ক্যানভাসে, তুলির বদলে তর্জনী, রঙের বদলে রক্ত, আর প্যালেটের জায়গায় জেহফিলের হাত। ইনানের হাত মুখে চলে যায়। জেহফিলের হাত কাটা। পরপর কতগুলো আঘাতের চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। ইম্যাচিওর কাপলের প্রেমে ঝড় আসলে প্রেমিক প্রেমিকারা যেমন ব্লেড দিয়ে হাত কাটে, তেমন কতগুলো পোঁচ কারি জেহফিলের হাতে। এখনো তাজা রক্ত গলগল করে হাত বেয়ে ফ্লোরে পড়ছে টুপটুপ করে।

ইনান রক্ত দেখতে পারে না। তার উপর সেই রক্ত দিয়েই জেহফিল তার ছবি আঁকছে দৃশ্যটা হজম হলো না ইনানের। সে তেড়ে গিয়ে ক্যানভাসটা উল্টে ফেলল। কালো রঙের কৌটা থেকে সবগুলো রঙ ঢালল নিজের রক্তিম ছবির উপর। হাত দিয়ে লেপ্টে পুরো ক্যানভাস কালো করে তবেই থামল ইনান। ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে জেহফিলের দিকে চায় সে,

‘এসব কী ধরনের পাগলামো?’

জেহফিল অট্টহাসি হাসল। হাত ভর্তি রক্ত, সেদিকে খেয়াল নেই তার। হুট করে তার হাসি থামিয়ে বিষণ্ন মুখে চাইল ইনানের দিকে। তার চেহারায় অসহায়ত্ব, নিগুঢ় হতাশা দেখে ইনানের বুক ধক করে উঠল। জেহফিলকে সে সবসময় স্ট্রং দেখে আসছে। এভাবে ভেঙে পড়তে দেখেনি।

জেহফিল ম্লান গলায় বলল,

‘এক ঘন্টা ছাব্বিশ মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড তুমি আমার চোখের আড়ালে ছিলে বাটারফ্লাই। ঐ বদ্ধ গোডাউনে চিৎকার করছিলে সাহায্যের জন্য। আমি নিজেকে কত কষ্টে তোমার কাছে যাওয়া থেকে সামলেছি জানো? তোমাকে কষ্ট দিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম আমি। তাই নিজের হাত কাটলাম তোমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তিস্বরূপ।’

ইনান মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। এতদিন ধরে যেই মানসিক কষ্ট দিয়েছে জেহফিল সেই শাস্তি নিজেকে দিলো না কেন? শুধু শরীরের কষ্টটাই চোখে পড়ছে? মনের না?

জেহফিল হঠাৎ উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ইনানের কাছে ছুটে আসল। রক্তমাখা হাতে ইনানের গাল ধরে অস্থির হয়ে বলল,

‘একটু হেল্প করবে আমায় বাটারফ্লাই?’ স্কাল্পচারের ধারালো ছু’রিটা নিয়ে ইনানের হাতে দিলো, ‘আমার হাতটা একটু কা’টবে? আমি যখন নিজের হাত কেটেছি তখন একটুও ব্যথা পাইনি। তাহলে তো আমার কোনো শাস্তি পাওয়াই হলো না! তুমি…তুমি একটু সাহায্য করো না সোনা! ছু’রিটা দিয়ে হাতটা কা’টো আমার। তোমার দেয়া আঘাত যদি একটু গায়ে লাগে আমার! প্লিজ…’

জেহফিল ইনানের হাত ধরে ছু’রিটা নিজের হাতে ছোঁয়ায়। ইনান তড়িঘড়ি করে হাত সরিয়ে ফেলতে চায় তবে পারে না। জেহফিল জোর করে হাত আঘাত করতে চাইছে। ইনানের এমনিতেই মাথা ঘুরছে এত রক্ত দেখে, ধস্তাধস্তি করার পর ইনান ছু’রিটা ফেলে দিয়ে অনুরোধ করে জেহফিলকে,

‘পাগলামি করবেন না, হাতটা ব্যান্ডেজ করুন জেহফিল। প্লিজ। রক্ত সহ্য করতে পারছি না। মাথা ঘুরাচ্ছে।’

ইনানের মাথা ঘুরানোর কথা শুনে থামে জেহফিল। ইনান উঠতে নেয় এইড বক্স আনার জন্য। জেহফিল তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়।

‘আমি যাচ্ছি। তোমার কিছু করতে হবে না। শুধু আমার সামনে বসে থেকো। চোখ বন্ধ করে হলেও।’

জেহফিল রুমে গিয়ে হাত ব্যান্ডেজ করে নেয়। ইনান বারবার বলছিল হাত গভীর করে কেটেছে কিনা, হাসপাতালে নেয়া লাগবে কিনা। জেহফিল বলল এসব কিছুই করতে হবে না, এমনি ঠিক হয়ে যাবে।

ডিনারের জন্য ইনান নিজেই রান্না করল। জেহফিল কিচেন কাউন্টারে বসে আছে। একটু আগেও ইনানের সাথে রাগারাগি করেছে ইনানের রান্না করা নিয়ে। ইনান শুনেনি। মানবিকতার বিচারে সে কখনো অসুস্থ একজন মানুষকে রান্না করতে দিতে পারে না।

জেহফিল নিষ্পলক ইনানকে দেখছে। তার বাটারফ্লাই এত স্নিগ্ধ! কান্নার পর চোখমুখ ফুলোফুলো হয়ে আছে। চোখজোড়া আর গাল দুটো গোলাপী। কী মিষ্টি লাগছে দেখতে! তার বাটারফ্লাইকে কি সে আরো কাঁদাবে? এই কোমল চেহারা দেখার জন্য?

জেহফিলকে খাইয়েও দিতে হলো। যদিও জেহফিলের বাম হাত আঘাতপ্রাপ্ত, তাও সে নিজের দুই হাতকে অক্ষম বলে দাবি করল ইনানের নিকট।‌ অগত্যা ইনান খাইয়ে দিলো জেহফিলকে।

.

পরদিন থেকে সেই একই রুটিন। যেন কাহিনী একই বৃত্তে চক্রাকারে ঘুরছে। খাও,দাও, ঘুমাও, চোখের সামনে থাকো, ভালোবাসো, যাবে না কোথাও, রাগারাগি।‌ আবারও খাও, দাও, ঘুমাও… লুপ!

দীর্ঘশ্বাস!!

সারাদিন নিরব জঙ্গলের মাঝে থাকতে ভালো লাগছে না ইনানের। একটু নিজের বাড়িতে যেতে মন চাইছে। শহরে যেতে, চেনা জায়গায় গিয়ে আনন্দ করতে। এমনকি তার ফ্রেন্ডদেরও মিস করছে সে। যতই স্বার্থপর হোক তারা, ইনানের ফ্রেন্ড তো!!

বাড়ির বাইরেও বের হতে পারে না জেহফিলের অনুমতি ছাড়া। ইনান কথার অবাধ্য হলে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে জেহফিল। আবার নিজেই সব পরিষ্কার করে। ইনানের দমবন্ধ হয়ে আসছে। যেন সে সোনার খাঁচায় আটকে আছে। যেই খাঁচা বাইরে থেকে দেখতে চাকচিক্যময় মনে হলেও ভেতরে থাকা পাখি ছটফট করছে খোলা আকাশে ডানা ঝাপটানোর জন্য।

.

ধোঁয়াটে কুয়াশা পরিবেশ জুড়ে। আবহাওয়া শীতের জানান দিচ্ছে। এই মাসেই বোধহয় শীত শুরু হবে।

আকাশে থালার মতো চাঁদ। জোৎস্নার আলোয় স্নানের উদ্দেশ্যে ইনান মিনি ছাদে এসে দাঁড়ায়। কতদিন এভাবে চাঁদের আলো গায়ে মাখা হয় না!!

ইনান প্রাণভরে শীতল বাতাস টেনে নিয়ে নিজের অন্তরাত্মাকে শীতল করল। এই আবহাওয়ায় এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না।

ইনান পারল না আর চাঁদের আলো উপভোগ করতে। জেহফিল এসে তাকে টেনে নিয়ে গেল রুমে। দরজা জানালা আটকে পর্দাও টেনে দিলো। ইনানের তৃষ্ণার্ত মন হাহাকার করে উঠল চাঁদের আলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য।

জেহফিল ইনানকে শুইয়ে নিজেও ইনানের বুকে মাথা রাখল। ইনান জেহফিলের মাথা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল। জেহফিল বিরক্ত হয়।

‘তুমি চাঁদের জন্য আমাকে সরিয়ে দিচ্ছ?’

‘দিচ্ছি। কী করবেন এখন? চাঁদকে গিয়ে খু’ন করবেন?’

‘সেই ক্ষমতা থাকলে তো কবেই চাঁদকে ধ্বংস করে দিতাম?’

‘জেহফিল!’

‘ইয়েস প্রিন্সেস?’

‘আপনি বদ্ধ উন্মাদ।’

‘শুধু তোমার জন্য।’

‘কেন এমন করছেন আমার সাথে? আমি কি পুতুল?’

‘নাহ, তুমি আমার বাটারফ্লাই।’

‘তাহলে কেন বাটারফ্লাইকে উড়তে দিচ্ছেন না? কেন গলায় সুতো বেঁধে রেখেছেন?’

‘তোমার ভুলেই যে তুমি আমার কাছে বন্দী বাটারফ্লাই। রোদরঞ্জনের বি’ষ পান করেছ তুমি। বি’ষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তোমার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। পড়ে আছো শুধু রোদরঞ্জন ফুলের উপরে। এর দায়ভার কি আমার? বেবি বাটারফ্লাই?’

ইনানের কণ্ঠ জড়িয়ে আসলো। জেহফিল ঘুরেফিরে দোষটা ঠিক তার উপরেই দিচ্ছে।

ইনানের কান্না দেখে জেহফিল তর্জনী‌ দিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো।

‘কাঁদবে না বাটারফ্লাই। অকারণে কান্নার অধিকার নেই তোমার। তুমি তো হাসবে। আমার মতো ভাগ্যবান স্বামী পাওয়ায় তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। তাহলে কেন এই কান্না?’

জেহফিল ইনানের গালে হাত বুলিয়ে হঠাৎ করে ঘাড় চেপে ধরে,

‘কাঁদবে আমার কষ্টে। তোমার নয়। তোমার তো কোনো কষ্ট নেই। আমি তো তোমাকে কষ্টে রাখছি না! তুমি সুখে আছো। কাঁদবে সুখের কান্না। ঐ কান্নার অধিকার আছে তোমার। বুঝলে?’

ইনান সাথে সাথেই জেহফিলের পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল। হেঁচকি তুলে কাঁদতে আরম্ভ করল সে। মিনতি করে বলল,

‘প্লিজ… জেহফিল… আমি একটু শান্তি চাই। একটু শান্তি দিন আমায়। একটু ভালো থাকতে দিন। এখনো ভাবার সময় আছে..’

জেহফিলের মাথা দপ করে জ্বলে উঠল। ইনানের টুঁটি চেপে দাঁড় করায়। গর্জন করে বলে,

‘আমি তোমাকে শান্তি দেই না? হ্যাঁ? তোমাকে ভালো থাকতে দেই না? কীভাবে এই কথা বলতে পারলে তুমি? কীভাবে এই কথা তোমার ভাবনাতে এলো? বুক কাঁপল না একবারও? কী না করেছি তোমার জন্য! তোমার পছন্দের সবকিছু তোমার পায়ে এনে ফেলেছি। যা যা আবদার করতে সব। পুরো পৃথিবীটাকে তোমার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছি। নিজের থাকা, খাওয়া, ঘুম সব স্যাক্রিফাইস করে তোমাকে মাথায় তুলে রেখেছি। মাটিতে পা ফেলতে দেইনি নোংরা লাগবে বলে, ফুলের টোকাও লাগতে দেইনি। তাও বলছ আমি তোমাকে ভালো রাখি না? সুখে থাকতে দেই না?’

ইনানের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে জেহফিল ছেড়ে দিলো। বার কয়েক কেশে ইনান নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। অঝোর ধারায় কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। সে তো এই সুখ চায়নি! সে তো চেয়েছে একটু স্বাভাবিক কাপলের মতো বেঁচে থাকার সুখ!

ইনান ফুঁপিয়ে কাদতে লাগল। জেহফিল তীব্র গলায় বলল,

‘কান্না থামাও। এক মিনিটের মধ্যে কান্না না থামালে খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলব।’

মুহুর্তের মাঝেই ইনান মুখ চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করল। এর চেয়ে খারাপ কিছু সহ্য করার ক্ষমতা নেই তার।

জেহফিল ইনানকে খাটের উপর ফেলে ইনানের শরীরের উপর ভার ছেড়ে দেয়, ইনানের গলায় চুমু দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘সরি তোমাকে ব্যথা দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি যা বলেছি তার একটা কথাও মিথ্যে নয়। এটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না বাটারফ্লাই। সময় আছে হাতে, তুমিই তো বললে, তাই তোমার উচিত হাতে থাকা সময়ের মাঝেই এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া, ভাগ্য কে মেনে নেওয়ার।’

ইনান সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে। আসলেই কি সে ভাগ্যকে মেনে নিতে পারবে?

.

.

গভীর রাত। হাড় হিম নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারিদিকে। অন্ধকারে ইনান খুব সাবধানে ক্লজেটের দরজাটা খুলল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে খাটে ঘুমানো জেহফিলের দিকে তাকালো। কফির সাথে ঘুমের ঔষধ মিক্স করে দেয়ায় জেহফিলের ঘুম এত সহজে ভাঙবে না মনে হচ্ছে। ঘুমের ঔষধ পেয়েছিল জেহফিলের বক্স থেকেই, আগে ঘুম না আসলে জেহফিল ঘুমের ঔষধ খেত।

ইনান পা টিপে টিপে হেঁটে জেহফিলের কাছে যায় আবার। চেক করে নেয় আসলেই ঘুমাচ্ছে কিনা। যখন নিশ্চিত হলো জেহফিল গভীর ঘুমে মগ্ন তখন ফিরে আসলো ক্লজেটের কাছে। খুঁজতে লাগল হ্যান্ডকাফ। পেল না। খুঁজে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। তাই ইনান একটা ওড়না নিয়ে জেহফিলের কাছে গেল। হেডবোর্ডের সাথে সাবধানে জেহফিলের দুইহাত বাঁধল, টাইট করে। খুব সতর্ক হয়ে। তারপর নিজের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস হ্যান্ডব্যাগে ভরে নিলো। পালানোর জন্য যা যা লাগবে সবই নিলো। মোবাইল পেল না নিজের। জেহফিলের মোবাইলটা জেহফিলের পিঠের নিচে। জেহফিলকে সরানো মুখের কথা না। তাই ইনান জেহফিলের মোবাইল খুঁজতে গেল না আর।

দরজার কাছে এসে একবার পিছু ফিরে দেখল ঘুমন্ত জেহফিলকে। কী নিষ্পাপ মুখশ্রী! ঘুমের সময় নিষ্পাপ লাগলেও আদতে এই মানুষটি নিষ্ঠুরতায় কলুষিত।

ইনান ফিসফিস করে বলল,

‘ক্ষমা করবেন জেহফিল। আমি এই জীবনে অভ্যস্ত হতে পারব না। পারব না ভাগ্যকে মেনে নিতে। আমার ঠিকানা আপনি নন। আমার ঠিকানা মুক্ত আকাশে, সেখানে আপনি আমার জন্য জেলখানা…’

.
.
চলবে…