রোদরঞ্জন পর্ব-৩৪+৩৫

0
154

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩৪
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা

[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.

ভোরের আলো তখনো ফুটেনি। চারিদিক ছেয়ে আছে হালকা কুয়াশায়। এই অসময়ে জানালার ধারে বসে হলদে রঙা পাখিটি একাধারে সুর মিলিয়ে ডাকছে। মিষ্টি সুরের গান কানে যেতেই ইনানের ঘুম হালকা হয়ে যায়। আড়মোড়া ভেঙে দুহাত ছড়িয়ে দেয়। হাই তুলে উঠে বসে। ঘুম ঘুম চোখেই হাতড়ে হাতড়ে জেহফিলকে জাগানোর জন্য হাত বাড়ায় সে। ফাঁকা খাটে হাত পড়তেই পিলে চমকায় ইনানের। ঘুম উবে যায় মুহূর্তেই। জেহফিল নেই। কোথায় গেল সে? ইনানের বুক কেঁপে উঠে। অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে জেহফিলের ঘুম বেড়েছে। যেখানে ইনানের আগে ঘুম থেকে উঠত এখন সেখানে দেরি করে ঘুম ভাঙে তার।

ইনান কয়েকবার জেহফিল বলে ডাকল। সাড়া পাওয়া গেল না। জেহফিলের ক্রাচও নেই কোথাও। রুম থেকে বের হওয়ার আগে কী মনে করে বারান্দায় যায় সে। দেখল জেহফিল বারান্দার কাউচে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সাদা শার্টের বোতাম সবগুলো খোলা, বলিষ্ঠ শরীর চোখে লাগার মতো। বুকের উপর পড়ে আছে ছোট ক্যানভাস, পাশে রঙ তুলি। এ যেন ফিকশনাল কোনো ক্যারেক্টার! ইনানের আগমন জেহফিল যেন চোখ বন্ধ করেই টের পায়, চোখ খুলে মাথা কাত করে ইনানের দিকে চায় শান্ত নয়নে। এক মুহুর্তের জন্য হৃদস্পন্দন থমকে যায় ইনানের। এই যে ইনানের উপস্থিতি চোখ বন্ধ করেও টের পাওয়া, এ যেন সেই আগের জেহফিল! ইনান ঢোক গিলে তড়িৎ পায়ে জেহফিলের কাছে এসে বলল,

‘এতবার ডাকলাম আপনাকে, সাড়া দেওয়া গেল না?’

জবাব এলো না অপরপক্ষ থেকে। বরং সে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ইনানের দিকে। তার চোখে মুগ্ধতা। ধীর গলায় বলল,

‘তোমাকে খুব প্রীটি লাগছে বাটারফ্লাই।’

অপ্রত্যাশিত প্রশংসায় ইনান অপ্রস্তুত হয়ে গেল। লজ্জাও পেল সে। বারান্দার গ্লাসে নিজেকে চেয়ে দেখল, তার চুল এলোমেলো, পরনের নাইটির হাতা ঠিক নেই। তাও জেহফিলের চোখে সবসময়ের জন্য সুন্দর! ভালো লাগল এই ভেবে যে জেহফিল আগের মতো স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরে ধীরে।

ইনান গিয়ে জেহফিলের পাশে বসল। জেহফিলের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘সত্যি করে বলুন তো জেহফিল, আমাকে কী সবসময়ই সুন্দর লাগে? নাকি মন যোগানোর জন্য বলেন?’

বুকে থাকা ইনানের হাত শক্ত করে চেপে ধরল জেহফিল। গভীর চোখে চেয়ে ইনানের হাতে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এই মৃদুমন্দ শীতের বাতাসেও ইনান তার শরীরে বয়ে চলা উষ্ণতা টের পেল। জেহফিল ইনানের হাত ঠোঁটে রেখেই বলল,

‘তুমি আমার কাছে সবসময়ই সুন্দর বাটারফ্লাই। তুমি যেমনই থাকো, যেই অবস্থাতেই থাকো না কেন, আমার চোখে তোমাকে স্বর্গীয় পরীর মতো লাগে।’

একটু থেমে জেহফিল ইনানের গালে হাত রাখে। মোহাবিষ্টের ন্যায় গাঢ় স্বরে বলল,

‘You’re like a dream that became reality, even the universe pales to your beauty.’

বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাস যেন ইনানের মনে দোলা দেয়। গাল কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় রক্তিম হয়ে যায়। তার অন্তঃকরণে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়তে থাকে। জেহফিল জানে না যে তার এই ছোটো ছোটো কিছু কমপ্লিমেন্ট ইনানের কাছে ঠিক কতটা মিন করে। জেহফিলের সামান্য একটা ভালোবাসাময় কথাতেও ইনানের সব খারাপ লাগা, দুশ্চিন্তা কর্পূরের মতো উড়ে যায়, সারাটা দিন হৃদমাঝারে অচেনা ভালো লাগার সুর গুণগুণ করে গান গাইতে থাকে।

ইনান মুচকি হেসে জেহফিলের বুকের সাথে মিশে গেল। আগে যেখানে শান্তি পেত না, যার থেকে ছোটার জন্য মন সারাদিন ছটফট করত, আজ তার বুকে মাথা না রাখলে ঘুম আসে না, তার সাথে না মিশলে শান্তি লাগে না। ভালোবাসা কী অদ্ভুত! যাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত, আজ তাকেই মনেপ্রাণে আগলে রাখতে মন চায়।

.

.

‘বাবা, তোমাকে আমি বারবার বলেছি, আমার পক্ষে সম্ভব না জেহফিলকে ছেড়ে থাকা। এমন তো না যে উনি প্যারালাইজ হয়ে গেছে বা অন্য কিছু। সামান্য ভেঙেছে। আল্লাহ না করুক এখন যদি আমারও সেইম অবস্থা হতো তখন কি তুমি চাইতে জেহফিল আমাকে ছেড়ে চলে যাক?’

‘মামনি এসব কথা বলে না।’

‘বাবা তোমার কী হয়েছে বলো তো? যেই তুমি জেহফিলকে এত পছন্দ করতে সেই তুমি এখন জেহফিলকে আমার থেকে দূরে সরাতে চাচ্ছ!’

ইনানের অসন্তোষ গলা। ইফাজ খান চিন্তিত মুখে ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। তিনি ভালো করেই বুঝতে পারছেন তার মেয়ে কথা শুনবে না। নাছোড়বান্দা মেয়ে, তার জানা আছে। কিন্তু এভাবে তো আর চলে না।

‘দেখো ইনান, আমি বলছি না জেহফিলকে ছেড়ে দিতে, তুমি আমার কথা বোঝার চেষ্টা করছো না। অ্যাক্সিডেন্ট শুধু জেহফিলেরই হয়নি। তোমারও হয়েছে, তোমারও রেস্টের প্রয়োজন। তুমি যদি সবসময় জেহফিলের সেবাই করে যাও তাহলে তোমার সেবা করবে কে? এইখানে তোমার কিংবা জেহফিলের কারোই ভালো ট্রিটমেন্ট হচ্ছে না। শহর থেকে এত দূরে বাড়ি, কখন কী হয়ে যায়, বলা তো যায় না! তার উপর জেহফিলও এখন ঠিক অবস্থায় নেই যে কিছু হলে এগিয়ে আসবে। এই নির্জন বাড়িতে থাকাটা অনেক রিস্কের ব্যাপার। আমি শুধু বলছি তুমি নাহয় জেহফিলকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসো। আমাদের বাড়ি তো এই বাড়ির চেয়েও দ্বিগুণ বড়ো। কেউ থাকেও না বাড়িতে। তার চেয়ে ভালো হয় না জেহফিলকে ওখানে রেখে চিকিৎসা করানো?’

‘বাবা, আমি তোমার মেয়ে, তোমার ইন্টেনশন ভালো করেই বুঝি। তুমি ভাবছো জেহফিলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তাহলে আমাকে দেখবে কীভাবে! কিন্তু বাবা এটা একদমই ভুল। ওনার আর্টের একেকটার দাম সারাবছরের ইনকামের সমান। আর্ট করতে তো আর পা লাগে না তাই না? কিন্তু তোমার মন মানে না। তোমার একটা স্ট্রং ক্যারিয়ারের ছেলে দরকার ছিল।’

ইফাজ খান বুঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘ইনান, মামনি আমার, আমাকে ভুল বুঝো না‌। আমি…’

ইফাজের কথা কেটে ইনান বলল, ‘তুমি আমাকে ঐ পাখির পালকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছো তাই তো?’

ইফাজ থতমত খেয়ে গেলেন, ‘মোটেই না। আমি আরো যোগ্য পাত্র খুঁজব তোমার জন্য।’

ইনান তাচ্ছিল্য করে হাসল, ‘এই না বললে আমি তোমাকে ভুল বুঝলাম, কিন্তু এখন তো সত্যিটা বলেই দিলে যে তুমি আমাকে জেহফিল থেকে দূরে সরাতে চাও।

ইফাজ খানের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো ইতিউতি করতে লাগল।

‘অনেক হয়েছে বাবা। তুমি এবার যেতে পারো। রাত হয়ে আসছে। জেহফিল উপরে অপেক্ষা করছেন। ওনার ঔষধের টাইম হয়ে গেছে।’

‘তুমিও ঔষধ ঠিক মতো নিচ্ছো তো মা?’ স্নেহের গলায় বললেন ইফাজ।

‘নিচ্ছি।’

এই বলে ইনান গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। এতক্ষণ তারা গাড়ির ভেতরেই বসে কথা বলছিল। জানালায় মাথা নিয়ে ইনান বলল,

‘তুমি কি শিওর তুমি উপরে যাবে না?’

ইফাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হাঁটু ব্যথা করছে।’

‘জেহফিলকে দেখবেও না?’

‘আবার তো আসছিই।’

ইনান ছোট্ট করে শ্বাস নিলো, ‘এসো, দেখে যেও তোমার জামাইকে। কিন্তু বাবা প্লিজ, বারবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলবে না। জেহফিল এসবে আনকম্ফোর্টেবল ফিল করে, কোথাও এতদিন থেকে চিকিৎসা নেয়া, তাও যদি হয় শ্বশুরবাড়ি, এসব ওনার পছন্দ না।’

ইফাজ খান মাথা নাড়ালেন শুধু। তারপর ইনানকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

ইনান খোলা আকাশের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। জীবনটা কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউই বলতে পারে না। ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে কাঁপন ধরালে হাত দুটো দিয়ে নিজেকে আলিঙ্গন করে নেয়। বাড়ির গেটে ঢুকতে নিলেই হঠাৎ চোখ যায় বারান্দার দিকে। বারান্দার পর্দা উড়ছে, মনে হচ্ছে কেউ একজন মাত্র ভিতরে গেল। জেহফিল কি তবে তার জন্য অপেক্ষা করছিল?

________

ইনান রাতের রান্না করে জেহফিলের কাছে যায়। জেহফিল চাদর গায়ে ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল।

ইনানের বাবা যাওয়ার পর থেকে জেহফিল কোনো রিয়েক্ট করেনি। এমনকি ইনানের বাবা কী জিজ্ঞেস করেছে বা কিছুই জানতে চায়নি সে। এখন যদি আগের সাইকো জেহফিল হতো তাহলে হাজারটা প্রশ্ন করে ভাসিয়ে দিতো। ইনানকে একা নিচে যেতে দিতো কিনা তাও সন্দেহ।

ইনান গিয়ে তার পাশে বসে হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরে। জেহফিলকে চোখে চশমা দেওয়ায় প্রফেসরের মতো লাগছে। মারাত্মক সুদর্শন! জেহফিলের গালে নাক ঘষে আহ্লাদী সুরে ইনান ডাকল,

‘জেহফিল!’

জেহফিলের হাত থমকে গেছে ল্যাপটপের উপর। ইনানের উষ্ণ শ্বাস তার গালে, গলায় আছড়ে পড়ছে। ইনানের চুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ তার নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। হঠাৎ করে ইনানকে জড়িয়ে ধরল জেহফিল, শক্ত করে কিন্তু পরম যত্নে। যেন ইনানকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলবে। গালে গলায় হালকা চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল ইনানকে। ইনান আদুরে বিড়ালের মতো জেহফিলের আদর নিতে লাগলো। তার গলা জড়িয়ে ইনান গভীর গলায় বলল,

‘আমি আপনাকে কখনো ছেড়ে যাবো না জেহফিল। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আপনার পাশে সবসময় থাকবো আমি।’

জেহফিল ইনানের চুলে বিলি কাটতে আরম্ভ করলো। ইনান জেহফিলের বুকের মাঝে ডুবে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আপনাকে ভালোবাসি জেহফিল…খুব..খুব ভালোবাসি।’

.

.

মাঝরাতে ইনানের ঘুম ভাঙে। জেহফিলের ঔষধের কারণে সে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ইনান কফি বানিয়ে জেহফিলের মাথার কাছে এসে বসে। বারান্দার পর্দা বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে চারিদিক। ঠিক সেই মুহূর্তে ইনানের একটা জিনিস নজরে পড়ল। রুমের লাইট বন্ধ করে সে বারান্দার দরজার পিছনে এসে উঁকি দিলো। তার নজর তাদের বাড়ির সাথের পুকুরের পাশের দোতলা ঘরটায়। এই ঘরটা দুইমাসেই কমপ্লিট হয়ে গেছে‌। তাদের বারান্দার মুখোমুখি ঐ বাড়ির বারান্দা। ইনান ধারণা করেছিল বাড়িতে কেউই নেই হয়তো। কেননা বাড়ি হওয়া অবধি রুমে কোনো লাইট জ্বলতে দেখেনি। কিন্তু এখন একটা অস্বাভাবিক ঘটনা চোখে পড়ল তার।

তাদের মুখোমুখি সেই বারান্দায় চাঁদের আলোয় কারো ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। লম্বা-চওড়া এক অবয়ব। ইনান চোখ ছোখ ছোট করে দেখার চেষ্টা করল। গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। তার বারান্দায় অন্ধকার। ইনান বারান্দায় এসে দাঁড়ানো মাত্রই ঐ ছায়ামূর্তিটিও ইনানের দিকে ঘুরল। এবং জ্যোৎস্নালোকিত আলোয় তাদের দুচোখ মিলিত হলো। যদিও কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ইনানের কেন যেন মনে হলো ঐ পাশের অবয়বটিকে সে চেনে…আর সেই অবয়বটিও তাকে চেনে…

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩৫
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা

[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.

অসময়ে বৃষ্টি নামাটা ইনান সবসময় পছন্দ করলেও আজকে ভালো লাগছে না। খুব দরকারে শহরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি তাকে আটকে দিলো। শীত প্রায় শেষ হবে হবে ভাব। হয়তো শীতের শেষটা জানান দিতেই বর্ষার আগমন। ইনান হতাশ শ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ায়। কারেন্ট নেই। বিকেল হলেও ঢালা বৃষ্টির কারণে মনে হয় এখন মাঝরাত।

মোম হাতে রুমে ঢুকে দেখল জেহফিল অন্ধকারে টুলে বসে হাতে কিছু একটা নিয়ে গভীর মনোযোগে কিছু একটা দেখছে। ইনান এগিয়ে যায় কাছে। জেহফিলের ঘাড় অবধি সিল্কি চুলগুলো বাহির থেকে আসা হিমশীতল বাতাসে কপালে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, ঠোঁট হালকা চেপে মনোযোগী চাহনিতে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, বিজলি চমকানো আলোয় দেখার চেষ্টা করছে কিছু একটা। ইনানের মন চাইল সারাজীবন যদি জেহফিলকে এভাবে তাকিয়ে দেখা যেত। জেহফিলের অতুলনীয় সৌন্দর্য এত মনকাড়া, যে ইনানের মাঝে মাঝে ভয় হয় জেহফিলকে বাইরে নিয়ে যেতে। যদিও সে জানে, জেহফিল তাকে ছাড়া কখনো দ্বিতীয় নারীর দিকে চোখ তুলে চাইবে না, কিন্তু অন্যান্য নারী তো ঠিকই তাকাবে। নিজের এমন অচিন্তনীয় ভাবনায় নিজেই চমকালো ইনান। সে কবে থেকে জেহফিলের মতো এত পজেসিভ হওয়া শুরু করেছে? এত জ্বেলাস হলো কবে থেকে? সে তো দেখছি এখন জেহফিলের ফিমেল ভার্সন হওয়া শুরু করে দিয়েছে!!

ইনান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল তার এই আজগুবি ভাবনা। মোম হাতে জেহফিলের কাছে গিয়ে হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল।

হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে দাঁড়ানো ইনানের দিকে তাকালো জেহফিল। ইনানকে দেখে স্নিগ্ধ হাসলো জেহফিল।

বিনিময়ে হাসি প্রদান করে ইনান বলল, ‘কী করছেন?’

হাতে থাকা মোমবাতি জেহফিলের হাতের কাছে নিয়ে দেখল একটা চিকন তুলি। ইনান ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘স্পেশাল কিছু আছে নাকি তুলিতে?’

‘অভিশাপ।’ শীতল গলায় বলল জেহফিল। তুলির দিকে নজর নিবদ্ধ।

‘বুঝলাম না?’

দীর্ঘ সময় নিয়ে শ্বাস টেনে সটান হয়ে বসল জেহফিল। চোখের চশমাটা টেবিলের উপর রেখে একহাতে ইনানের কোমর জড়িয়ে তার বুকে মাথা রাখল। কম্পিত ইনান জেহফিলের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে লাগল।

‘মনে আছে বাটারফ্লাই…’

থামল জেহফিল। ইনানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে চিবুক ইনানের বুকে ঠেকিয়ে চোখে চোখ রাখল জেহফিল। এই মুহূর্তে জেহফিলকে কতটা আদুরে দেখাচ্ছিল ইনান যদি বর্ণনা করতে পারতো! ক্যামেরা সাথে থাকলে সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাপচার করে নিতো দৃশ্যটা।

‘আমি তোমাকে একটা শাস্তি দিয়েছিলাম।’

সম্বিৎ ফিরল ইনানের, ‘কী শাস্তি?’

‘রক্ত দিয়ে আমার নাম লেখতে বাধ্য করেছিলাম তোমাকে।’

ইনানের মনে পড়ল সেই নিকৃষ্ট দিনের কথা। গা কেঁপে উঠল তার। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,

‘এখন এসব কথা কেন? বাদ দিন না!’

জেহফিল ইনানের বুকে মুখ গুঁজল,

‘আ’ম সরি বাটারফ্লাই, রিয়েলি রিয়েলি সরি। আমার…আমার এসব করা উচিত হয়নি…প্লিজ, মাফ করে দাও সোনা, প্লিজ পাখি…’

জেহফিলের কথা শ্রবণমাত্রই হতভম্ব হয়ে যায় ইনান। জেহফিল যে এসবের জন্য সরি বলবে সে কল্পনাতেও আনেনি। সত্যিই, সে কখনো জেহফিলের থেকে সরি আশা করেনি। জেহফিল সরি না বললে সে বুঝতেও পারত না যে মনের এক কোণে ঠিকই চাইছিল জেহফিল যাতে অনুতপ্ত হয়। বিয়ের আগে নিজের ভবিষ্যৎ পার্টনারকে নিয়ে যেসব আশা করতো তা যেন এই মুহূর্তে জেহফিলই পূরণ করছে। তার কল্প পুরুষের মতো হয়ে উঠছে জেহফিল, ধীরে ধীরে।

পরিতৃপ্ত মনে ইনান জেহফিলের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেল,

‘আপনি যে অনুতপ্ত তাতেই আমি খুশি জেহফিল। এতবার সরি বলতে হবে না।’

জেহফিল হাতের তুলিটাকে দুমড়েমুচড়ে চুরমার করে দিলো। এই তুলি দিয়ে সে বাটারফ্লাইকে কষ্ট দিয়েছিল…

বৃষ্টির তোড়ে ইনানের ঠিকই নজরে আসলো ঐ পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে তাকিয়ে থাকা সেই অবয়বটাকে।

ইনান বাঁকা চোখে চেয়ে রইল সেদিকে। তার মুখাবয়ব কঠোর। ঐ পাশের মানুষটির কোনো হেলদোল দেখা দিলো না তাতে। সে অদ্ভুত চোখে ইনানের দিকে চেয়ে রইল, কেমন যেন সেই অদ্ভুত দৃষ্টি! চাহনিটা ইনানের ভালো লাগলো না, গা ছমছম করে উঠল তার। সে দ্রুত বারান্দা আর রুমের মাঝের পর্দাটা টেনে দিলো। এতে অপরপক্ষ অপমানবোধ করলে করুন গে…

.

.

রাত আটটা। জেহফিলকে রেখে ইনান নিচে এসে অপেক্ষা করছিল তার বাবার জন্য। গেটের কাছে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাবার চলে আসার কথা এক্ষুনি। ছাতার মাথাটা ফ্লোরের সাথে ঠকঠক করে আওয়াজ তুলে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইনান, হাতে ফ্ল্যাশ লাইট। তার বাবা সপ্তাহে কমপক্ষে তিন চারদিন এসে দেখা করে তার সাথে। কখনো তার পছন্দের খাবার নিয়ে আসে, কখনো সাথে পরিচিত এক ডাক্তার আঙ্কেলকে নিয়ে এসে চেকাপ করায়। ইনানের বাবা কোনো কমতিই রাখতে চান না তার মেয়ের জীবনে।

বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে ইনানের গায়ে। শীত লাগছে অনেক। জ্যাকেট টেনে আরো ভালো করে পরে নিলো।আকাশ পাতাল এক করে দেয়ার মতো ঝড় বইছে। ইনান দোয়া করছে বাবা যাতে এই ঝড়ে না আসে। রাস্তাঘাট ভালো না। কখন কী হয়! ইনানের ভাবনাকে প্রমাণ করে দিয়ে তার সেল ফোন বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং শব্দে।

‘সরি আম্মু, আজকে আসতে পারছি না। মন খারাপ করিও না কেমন?’

‘সমস্যা নেই বাবা। এই ঝড়ে আসার দরকার নেই। অবস্থা ভালো না।’

বাবার সাথে কথা বলে ইনান ভেতরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। ঠিক সেই সময়ে পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায় সে,

‘কেমন আছো ইনান?’

তড়িৎ পেছনে ফিরে সে। এই নির্জন জায়গায় সে সে আর জেহফিল ছাড়াও যে অন্য একজন থাকে, তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না কে সে।

মোবাইলের ফ্ল্যাশ সরাসরি ছাতা মাথায় ধরে থাকা ব্যক্তির দিকে তাক করলো। লোকটি হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে নিলো আচানক আলো চোখে লাগায়। তার পরনে কালো রঙের গলা ঢাকা লং কোট, চুলগুলো হালকা ভেজা। গালে সেই টোল পড়া হাসি।

ইনান মোবাইলটা সাইডে সরিয়ে নিয়ে বললো,

‘কী চাই?’

‘চিনেছো আমাকে?’

‘না চেনার কিছু নেই মিঃ তাজবীর।’

‘বাহ! নামটাও মনে আছে দেখছি! তা কেমন আছো?’

‘আপনি আমার ফ্রেন্ড? আপনাকে আমি ভালো করে চিনি?’ ইনানের দায়সারা কণ্ঠ।

‘সরি?’

‘যা বলছি তার উত্তর দিন।’

‘ওয়েল, নাহ, চিনো না।’

‘তাহলে কোন সাহসে আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন?’

তাজবীর হাসলো। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। সে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,

‘প্রথম আসলাম। ভেতরে আসার জন্য বলবে না? এভাবে গেস্টকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখছো বৃষ্টি দিয়ে, এই তোমার ম্যানার?’ কপট বিরক্তি সুরে বলল তাজবীর। যেন তাকে দাঁড় করিয়ে ইনান অনেক বড় অভদ্রতামি করেছে।

ইনান গেটের কাছে হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়ালো এবার। যেন সে তাজবীরকে ভেতরে না ঢোকানোর পণ নিয়েছে।

তাজবীর উচ্চশব্দে হেসে ফেলল ইনানের কাণ্ড দেখে। বৃষ্টির পানিতে আছড়ে আছড়ে পা ফেলে ইনানের কাঁধে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল তাজবীর। তার এহেন দুঃসাহসিকতায় ইনানের মুখ হা হয়ে গেল।

‘উফফ, ভিজে গেলাম, ভেতরে ঢুকে চা খাওয়ার জন্য বলবে না?’

‘আশ্চর্য মানুষ আপনি!’

‘আই নো।’ বুক ফুলিয়ে বলল তাজবীর।

‘কী চাই সেটা বলেন।’

‘উপরে যাই চলো।’ তাজবীর সিঁড়িতে পা দেওয়া মাত্রই ইনান তার শার্ট টেনে আগের জায়গায় নিয়ে আসলো।

‘প্রবলেমটা কী আপনার? এত সেধে সেধে কথা বলতে আসার মানেটা কী?’

‘আমার প্রবলেম এই যে…’ কথায় বিরতি দিয়ে হঠাৎ বলল, ‘ আমার প্রবলেমটা পরে বলছি। আগে বলো তোমার মাথার কী স্ক্রু ঢিলা?’ তার কণ্ঠে কৌতুক।

‘কীহহ!’ তাজবীরের কথার আগামাথা বোধগম্য হলো না ইনানের। রাগ বেড়ে যাচ্ছে তার।

‘ওকে বাদ দাও, তোমার মানসিক সমস্যা জানা আমার জন্য এক সেকেন্ডের ব্যাপার। তোমারটা বাদ দেই। আমার প্রবলেমটা বলি।’

বলে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ইনানের চোখের দিকে তাকালো সে, ‘প্রবলেমটা হচ্ছে, জেহফিলের সাথে তোমাকে দেখতে পারছি না আমি।’

‘আজব! দেখতে বলেছে কে আপনাকে? চোখ বন্ধ করে থাকেন, তাহলেই তো হয়!’

‘পারবো না, সিরিয়াসলি ইনান। তোমাকে একটা কথা বলি। জেহফিল ভালো ছেলে নয়। ওর..ওর মাথায় না, কোনো প্রবলেম আছে আই গেস। সিরিয়াস মেন্টাল প্রবলেম। ওর থেকে যত দূরে থাকবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল।’

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩৫ [অতিরিক্ত]
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা

[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.

‘আপনার সাথে জেহফিলের কী শত্রুতা?’

তাজবীর জবাব দেয়, ‘কী শত্রুতা আবার? আমি ভালো মানুষ ভাই, কারো সাথে সাপে নেউলে সম্পর্ক নেই আমার।’

‘নইলে জেহফিলের সম্পর্কে বাজে কথা বলছেন কেন?’

হতাশ শ্বাস ফেলে বাইরে তাকায় তাজবীর। ঝুমঝুম শব্দে ধরণীর বুকে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে। ইনানদের দোতলার বাসা অন্ধকার। কারেন্ট চলে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে বিজলি চমকানোর আলোতে রাস্তার ধারের জঙ্গল গুলোকে দানবদের বাসস্থানের মতো দেখায়, দেখলেই গা ছমছম করে। যেন এক্ষুনি ভয়ানক আকৃতির বিদঘুটে দানব এসে খুবলে খাবে। এরকম একটা ভয়ানক জায়গায় জেহফিল একা কীভাবে থাকতো? ভয় লাগতো না? আশেপাশে কোনো পাড়া প্রতিবেশীও নেই। ম’রে পড়ে থাকলেও তো কেউ জানবে না। এখন এই মেয়েটাও কীভাবে পারে থাকতে!!‌ এদের কি একটুও ডরভয় নেই??

‘লিসেন ইনান। তোমার লাইফে ইন্টারফেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো না, আর নেইও। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে আমার না চাইতেও তোমার উপর পাহারাদারি করতে হচ্ছে।’

‘পাহারাদারি?’ কিছুটা বিস্মিত হলেও কণ্ঠে প্রকাশ করল না ইনান, ‘তা জেহফিল কি আপনাকে আমার পাহারাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে নাকি?’

‘আশ্চর্য! তুমি কীভাবে জানলে?’ অবাক হওয়ার ভান ধরল তাজবীর। মুখ চেপে হাসছে সে।

ইনান চোখ উল্টিয়ে বলল, ‘ওহ ওয়েট, জেহফিল কেন দিবে, আপনারা কেউ কাউকে তো দেখতেই পারেন না। তাহলে আপনি কার কথায় আমার উপর নজর রাখছেন?’ হাত বুকের কাছে নিয়ে ভাঁজ করে বলল সে‌।

রহস্য নিয়ে হাসলো তাজবীর। ইনানের কাছে এক পা এগিয়ে আসে, পিছু হটে ইনান। তার এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না আর। এমনিতেই গত কাল এই ছেলের চাহনি তার ভালো লাগেনি, তার উপর এখন অদ্ভুত ধরনের কথা। তাজবীর হাঁটুতে হাত রেখে ইনানের মুখ বরাবর ঝুঁকল, মেয়েটা এতো ছোটো!

‘এই, দূরে। দূরে যান, দূরে যেতে বলেছি। খ্যাক করে উঠে ইনান। বুকে সাহস জোগাড় করার চেষ্টা করতে লাগল সে। ভয় পাবে না, কিছুতেই না।

কিছুটা বিরক্ত হয় তাজবীর,

‘তুমি নিজেকে কী ভাবো বলো তো?’

‘পরী।’

‘আজব একটা মেয়ে!’ বিড়বিড় করে বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে, ‘যাইহোক। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই ইনান। আমি তোমার ক্ষতি করবো না। বিনা বেতনের কামলা খাটতে আসছি। তা-ই খেটে চলে যাব সময় আসলে। সুতরাং আজাইরা ভয় পাওয়ার নাটক করবা না আমার সামনে।’

অপমানিত বোধ করল ইনান, ‘নাটক করলাম কখন? অচেনা মানুষ এমন অদ্ভুত বিহেভ করলে যে কারোরই ভয় লাগবে।’

‘আর একটা অচেনা মানুষের কাছে নিজেকে যে স্বেচ্ছায় সারাজীবনের জন্য বিলিয়ে দিলে তাতে ভয় লাগল না?’

‘জেহফিল অচেনা নয়। ওনার সম্পর্কে সবই জানি আমি।’

‘শুধু পারিবারিক, আর্থিক অবস্থা জানলেই চলে না। একটা মানুষের সাথে সারা জীবন কাটাবে আর তার সম্পর্কে ভালো মতো না জেনেই বিয়ে বসবে?’

ইনান ধারণা করল, তাজবীর জানে না যে সে কী অবস্থায় বিয়ে করেছে। মেবি তাজবীর মনে করেছে ইনান পারিবারিকভাবে জেহফিলকে বিয়ে করেছে। যদি জানতো তাহলে এই কথা বলতো না। তাও সে বলল,
‘কী জানার কথা বলছেন বলেন তো?’

‘জেহফিল তোমার সাথে যেই বিহেভ করে, মানে যেমনটা একাডেমিতে দেখলাম, তার সম্পূর্ণ বিপরীত সে। ও অ্যাগ্রেসিভ। লাইক, নিজের পছন্দ মতো কোনো জিনিস না হলে ও খুব হিংস্র হয়ে যায়, আমার অনেকগুলো স্কাল্পচার ভেঙেছে ও, সামান্য ত্রুটি থাকলেও। স্যার বলে কিছু বলতে পারি না। আর ওকে দেখে যা মনে হয়, ওর আর কোনো হিংস্র জন্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’

‘জানি।’ নির্বিকার জবাব।

‘জানো!’ যেন আকাশ থেকে পড়ল তাজবীর, ‘জেনেবুঝেও কীভাবে ওর মতো একটা মানুষকে বিয়ে করলে।’

‘শুনেন ভাই, কীভাবে বিয়ে হয়েছে না হয়েছে, সেটা বড় কথা না। বড় কথা হচ্ছে আমাদের অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে। যা হয়েছে তা আপনি কিংবা আমি তো আর চেঞ্জ করতে পারবেন না, তাই না? সো ওসব নিয়ে কথা বলারও কোনো দরকার নেই। জেহফিল হিংস্র পশু তা প্রথম থেকেই জানি, তাও আমি তাকে ভালোবাসি। আপনার বলা না বলায় কিচ্ছু যায় আসবে না। তাই বলছি, এসব আবোলতাবোল না বকে ভাগেন, ফুটেন এখান থেকে। এমনিতেই অনেক টাইম নষ্ট করেছেন আমার। আর না। জেহফিল অপেক্ষা করছে।’

ইনান ছাতার মাথা দিয়ে তাজবীরের পেটে ঠেলতে ঠেলতে তাকে গেটের বাইরে বের করে দিলো। তাজবীর দ্রুত ইনানের ছাতাটা কেড়ে নিয়ে মেলে ধরল। এই মেয়ে এত নিষ্ঠুর। সে আরো অনেক কিছুই বলতো। তার মনে অনেক খটকা আছে ইনানকে দেখে। কিন্তু এই বৃষ্টির মাঝে আর থাকাটা সম্ভব না। বাতাসে ছাতা ভেঙে যাওয়ার যোগাড়।

ইনানকে উদ্দেশ্য করে শেষ কথা বলল,

‘ইউ গাইজ আর সিক, রিয়েলি ভেরী সিক। তুমিও কম না, মানসিক সমস্যা আছে তোমার। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও। ঠিক হয়ে যাবে।’

সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তখনই পিছন থেকে ইনানের ডাক শোনা গেল।

‘ওয়েট, বললেন না তো কে আপনাকে বিনা বেতনে হায়ার করেছে আমাকে পাহাড়া দেয়ার জন্য?’

তাজবীর পেছনে না ঘুরে শুধু মাথাটা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

‘আছে একজন। একটা হিন্ট দেই। তাকে কিন্তু তুমি চিনো।’

এই বলে দাঁড়ালো না। গটগট পায়ে বিজলির আলোয় হেঁটে চলে গেল।

ইনান যেন বাঁচল। কারেন্ট চলে যাওয়ায় মোবাইলের লাইট অন করে উপরের সিঁড়িতে পা বাড়াতেই কেউ একজন তার কোমর শক্ত করে চেপে ধরে মুখ চেপে ধরল।

অতর্কিত আক্রমণে ইনানের হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়। আগন্তুক তাকে টেনে হিঁচড়ে নিচ তলার গোডাউনে নিয়ে গিয়ে নোংড়া মেঝেতে আছড়ে ফেলে দেয়‌। ইনান চিৎকারের সুযোগটুকুও পায় না, তার আগেই আগন্তুক চেপে বসে ইনানের পেটের উপর। এক হাতে ইনানের হাতদুটো ধরে আরেক হাতে ইনানের পরনের টপ ছিঁড়তে শুরু করে। মুখ ছাড়া পেয়ে ইনান আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে, কিন্তু হায়! গগণ কাঁপানো বজ্রপাতের আড়ালে তার চিৎকার চাপা পড়ে যায়। যেন আকাশটাও ইনানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইনানের চিৎকারের সাথে পাঞ্জা লড়ছে।

সেই মুহূর্তে গোডাউনের ভাঙা জানালা দিয়ে বিজলির আলোয় হামলাকারীর মুখ দেখতে পায় ইনান। আত্মা কেঁপে উঠে তার। শরৎ! তার ফ্রেন্ডদের একজন।

ইনান জেহফিলের নাম ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকে। শরৎএর থাবার মধ্য থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দেয়। ইনানের বৃথা চেষ্টা দেখে শরৎ কুৎসিত হাসলো।

‘অনেক দিন পর পাইছি তোরে মা*। এত সহজে ছাইড়া দিমু ভাবছোস? তোর কোন নাগররে ডাকবি ডাক, দেখি আসে কিনা। শুয়োরের বাচ্চা, কম জ্বালাস না আমারে। তোর বাপ আর তুই আমার জীবনটারে নরক বানায় ফেলছোস। আজকে সব শোধ তুলমু। এমন অবস্থা করমু না, তোর অবস্থা দেইখা তোর বাপ ফাঁ’সি দিবো মিলায় নিস‌।’

শরৎতের চোখ চকচক করছে, জিভ দিয়ে এমন আওয়াজ করছে যেন কোনো সুস্বাদু খাবার তার সামনে। ভয়ে ইনানের চেহেরার রং সরে গেল। চিৎকার চেঁচামেচি করলে কেউ তো আসবেই না বরং তার শক্তি লস হবে। শরৎতের লালসার শিকার থেকে বাঁচতে শেষবারের মতো বলল,

‘শরৎ, ভাই আমার প্লিজ, মাফ করে দে আমাকে। তোর পায়ে পড়ি দোস্ত, প্লিজ কিছু করিস না।’ ইনান আকুতি মিনতি করে বলল।

শরৎ অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল, যেন ইনান কোনো মজার জোকস বলেছে, ‘ওরে শালি, এখন বিপদে পইড়া তোর ভাই, দোস্ত হইয়া গেলাম!’ ইনানের গাল চেপে ধরল দুই আঙ্গুলে, ‘কিন্তু এখন তো আমি ভাইয়ের মতো কোনো কাজ করতাম না ইনান সোনা, এখন করব তোমার হাজব্যান্ডের মতো কাজ।’

ইনানের গালে হাত বুলিয়ে বলল। গা যেন ঘিনঘিন করে উঠল ইনানের। শরৎ ইনানের থেকে হাত সরিয়ে তার শার্ট খুলে ফেলল। ইনানের টপের বুকের অগ্রভাগ টেনে ছিঁড়ে ফেলল সহসা। বক্ষবন্ধনী স্পষ্ট দেখা গেল তার। ইনান ডুকরে কেঁদে উঠল। জেহফিল ছাড়া অন্য পুরুষের ছোঁয়া তার শরীর স্পর্শ করবে ভাবতেই গা গুলিয়ে গেল। শরৎ তার মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে ইনানের বুকের সামনে ধরল, ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজিয়ে লোভাতুর চাহনি মেলে ধরল ইনানের বক্ষভাঁজে।

ইনান ক্রন্দনরত গলায় একাধারে মিনতি করেই যাচ্ছে। এর চেয়ে ম’রে যাওয়াই ভালো আছে।

‘নাহ, এমনে মজা পাইতেছি না। ভালো কইরা দেখতে হইব।’

এই বলে ইনানের ইনার খোলার জন্য কাঁধে হাত দিতেই শরৎ তার মাথায়। উহ্ শব্দ তুলে মাথার পেছনে চেপে ধরল সে। ফ্ল্যাশ অফ হয়ে গেছে‌। সেই সময় পেছন থেকে কেউ একজন শরৎএর চুলের গোড়া মুঠোয় বন্দী করে তাকে উপড়ে ফেলল ইনানের উপর থেকে। শরৎ কুঁকড়ে গেল ব্যথায়। মাথায় হাত দিয়ে দেখল তার চেপে ধরা চুলগুলো নেই, তার জায়গায় লাল রঙের তরল গড়িয়ে পড়ছে।

‘কোন কুত্তা’র বাচ্চা…’ তার গলার স্বর চাপা পড়ে গেল লোকটি যখন পা দিয়ে তার গলা চেপে ধরল শক্ত করে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তার। হাঁপরের মতো হাঁসফাঁস করতে লাগল সে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় আবছা চোখে চেয়ে দেখল তার যমদূতকে…

.
.
চলবে…