রোদরঞ্জন পর্ব-৮+৯

0
171

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

ইফাজ সাহেব বাসায় ফিরে ইনানকে আহত অবস্থায় দেখে ভেঙে পড়েন। জঙ্গলের কাহিনী বলার মতো পরিস্থিতি না থাকায় ইনান অবশ্য সত্য মিথ্যা বানিয়ে একটা কাহিনী বলে দিয়েছে। দুইটা শক একসাথে নিতে পারবেন না ইফাজ তাই ইনান ব্যাপারটা চেপে গেল।

ভোর ছয়টা। আকাশে মেঘ না থাকলেও গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে। বারান্দায় থাকা বিভিন্ন জাতের ফুলগুলো ইনানের সাহচার্যের অভাবে অভিমানে পাতা নেতিয়ে রেখেছে। ইনানের কি সেই খেয়াল আছে? তার বিচরণ যে এখন চিন্তার জগতে।

ইনান বারান্দায় চেয়ারে দ আকৃতিতে মাথা হাঁটুতে রেখে বসে আছে। চিন্তায় মাথার তার সব ছিঁড়ে আসছে যেন। বাবাকে কী বলবে? বাবা যদি মেনে না নেয় তাহলে কি জেহফিল ভিডিওটা‌ সত্যি…? নাহ!‌ ইনান মাথা চেপে ধরে বসে থাকে। যে করেই হোক বাবাকে মানাতে হবে। না মানালে তার সম্মান তার বাবার সম্মান দুটোই ধূলোয় মিশে যাবে। ইনানের ভাবনার মাঝেই তারস্বরে মোবাইল বেজে উঠে। আসার সময় জেহফিল ইনানকে নিউ মোবাইল কিনে দিয়েছিল। ইনান ফোন কানে নেয়। বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলে,

‘কেন‌ ফোন করেছেন?’

‘আমার বউকে ফোন করতে কারণ লাগবে নাকি?’

জেহফিলের জবাবে চুপ থাকে ইনান।

‘বাই দ্য ওয়ে, বাবাকে মানানোর চেষ্টা কত দূর?’

বাব্বাহ!! জেহফিল তো দেখি এক পা এগিয়ে। এখনই ইনানের বাবাকে বাবা ডাকা শুরু করেছে! ম্লান গলায় বলল,

‘এইতো, চলছে..’

‘চলছে…’ জেহফিলের অট্টহাসি শোনা গেল অপর প্রান্ত হতে, ‘বাসায় গিয়েছ পর্যন্ত তো বারান্দাতেই বসে আছো। বাবাকে মানিয়েছো কখন আবার?’

ইনান কিছুটা চমকায়। ইনানকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই জেহফিল আলতো সুরে বলে,

‘তোমার চমক লাগা দৃষ্টি‌ খুবই লোভনীয়, বাটারফ্লাই।’

ইনান এক মুহুর্ত কী যেন ভেবে চকিতেই রাস্তায় দৃষ্টিপাত করে। জেহফিল গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ইনানকে দেখছে। চোখে চোখ পড়া মাত্রই জেহফিল চোখ টিপে ঠোঁট গোল করে চুমু ছুঁড়ে দেয় ইনানকে।

‘আপনি এখানে কী করছেন?’

‘আমার বউকে নিতে এসেছি।’

ইনান চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রাখে হতাশায়। চ কারান্ত বিরক্তির শব্দ তুলে বলে,

‘বিকেল তো এখনো হয়নি তাই না? আপনি চলে যান এখন। বাবা আরেকটু পর বের হলে আপনাকে দেখলে সমস্যা হবে।’

‘কী সমস্যা হবে? বাবাকে দেখলে ভালো মন্দ কথা বলব। যতই হোক, তার একমাত্র জামাই। ইগ্নোর করতে পারবেন না।’

‘প্লিজ জেহফিল। আপনার দুটো পায়ে পড়ি। সময় দিন না আমাকে জেহফিল! দুটো দিন সময় দিন আমাকে? প্লিজ।’ কণ্ঠে অনুনয় ইনানের।

এবার জেহফিলের ঠাট্টা ভরা কণ্ঠ শক্ত হলো, ‘কোনো সময় দেওয়া যাবে না। আজকের মধ্যেই যদি তুমি কথা না বলেছো…বাকিটা আর বলতে হবে না তোমাকে নিশ্চয়ই?’

‘আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে তাই না? তাহলে এখন কেন এত ইনসিকিওরিটি? আমি তো চলে যাচ্ছি না কোথাও! একটু রয়েসয়ে বাবাকে বুঝাই?’

‘তুমি আমার বাহুডোরে আবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই বাটারফ্লাই। তোমার বাবা সহজ সরল মানুষ, ওনাকে বোঝাতে হাইস্ট দুই ঘন্টা লাগবে, দুই দিন নয়। আর কোনো কথা না জান। তুমি এক্ষুনি বাবার সাথে কথা বলবে। রাখছি।’

জেহফিল ফোন‌ রেখে দিলো। ইনানের দিকে ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে গাড়ি রেখেই কোথায় যেন চলে গেল।

.
ইফাজ খান আজ ডিউটিতে একটু দেরিতেই যাবেন। কেননা তিনি কেস পলকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। ছেলেটা তাকে আইডল হিসেবে মানে। পলক একটা জেম! বুদ্ধিমান ছেলেটা এভাবেই কাজ চালাতে থাকলে বহুদূর যেতে পারবে।

ইনান গত এক ঘন্টা ধরে বাবার রুমে বসে আছে। ইফাজ খান বারবার বলেছিল কিছু বলতে চায় কিনা। কিন্তু ইনান বলবে বলবে করেই এক ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছে।

স্নেহপূর্ণ গলায় তিনি বললেন,’আম্মু, তোমাকে কেন এত টেন্সড দেখাচ্ছে? এমন কোনো কথা বলতে চাও যেটাতে তুমি হেজিটেট ফিল করছো?’

ইনান হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল।

‘টেইক ইওর টাইম দ্যান। তবে একটা কথা মনে রাখবে, আমি তোমার বাবা হওয়ার আগে তোমার বেস্টফ্রেন্ড। যা বলবে নির্দ্বিধায় বলবে।’

ইনান সোফা থেকে উঠে পা টেনে টেনে সোফায় গিয়ে বসল, ইফাজ খানের পাশে। ইফাজ খান ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,

‘তুমি কেন কষ্ট করে আসতে গেলে বাচ্চাপরী? বাবাকে বললে বাবা কি যেতাম না? বাবা কি বুড়ো হয়ে গেছি যে হাঁটতে পারবো না?’

ইফাজ খানের আদুরে ডাক শুনে ইনানের কান্না চলে আসলো। তার এত ভালো বাবাকে কীভাবে সে মিথ্যে বলবে? ইনান বাবাকে জড়িয়ে ধরল। ইফাজ হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ইনানের চুলে। ইনান রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,

‘আমি…আমি অনেক খারাপ বাবা..আমি অনেক খারাপ!’

ইফাজ খানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল মেয়ের এমন কথা শুনে। মেয়েকে তিনি কখনোই ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। ছুটির দিনেও তাকে ডিউটিতে থাকতে হয়। সারাদিনে তিন চারঘন্টা কিংবা তারও কম সময় মেয়ের সাথে থাকতে পারেন। বলতে গেলে গত তিন বছরে ইনান একা একাই বড় হয়েছে। তিনি কি কোনোভাবে মেয়েকে কষ্ট দিয়ে ফেললেন?

‘এভাবে বলবে না মা। তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো বাচ্চা।’

ইনান মাথা তুলল। কান্না চেপে ভেজা গলায় বলল,

‘বাবা..আমি..আমি একটা বড় কাজ করে ফেলেছি।’

‘কাজটা কি অনেক খারাপ?’

ইনান মাথা নাড়ালো উপর নিচ।

‘কাজটা কি আমাকে কষ্ট দেওয়ার মতো?’

ইনান আবারও মাথা নাড়ল।

‘কাজটা তোমাকে হ্যাপি করেছে?’

ইনান এবার স্থির। তারপর সময় নিয়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল।

‘তাহলে আমাকে বলতে পারো বাচ্চাপরী। যেই কাজটা আমার মেয়েকে হ্যাপি রাখে সেটা অবশ্যই ভালো কাজ। শুনো আম্মু, কে তোমার করা কাজে হ্যাপি থাকলো নাকি না সেটা ভাববে না একদম, তোমার সুখটাই মেইন।’

বাবার মন শান্ত করা কথাতে ইনান নিজেকে স্বাভাবিক করল। মাথা নিচু করে ধীর গলায় বলল,

‘আমি একজনকে পছন্দ করি।’

ইফাজ খানের বুক থেকে যেন ভারী কোনো পাথর নেমে গেল। তিনি তো ভেবেছিল বড় কোনো অঘটন ঘটেছে।

‘কাউকে ভালো লাগাটা কোনো খারাপ কাজ নয়। তুমি কাউকে পছন্দ করো এটা অবশ্যই ভালো খবর। তবে দেখার বিষয় হচ্ছে যাকে পছন্দ করো সে কি সঠিক মানুষ কিনা।’

ইফাজ খান থামলেন। আবার বললেন, ‘তবে তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। তুমি সবসময় বেস্টটাই চুজ করবে। কারণ তুমি ইফাজ খানের মেয়ে ইনান খান।’

গর্বিত গলায় বলল ইফাজ। ইনান কান্নার মাঝেও হেসে দিলো।

‘তোমাকে হাসিতেই মানায় আম্মু। যেই পরিস্থিতিই হোক না কেন, সবসময় হাসবে। ইওর স্মাইল ইজ দ্য বিগেস্ট ম্যাজিক।’

ইনানকে হালকা দেখে ইফাজ এবার বললেন,

‘এবার কি জানতে পারি সেই লাকি মানুষটা কে?’

‘বাবা..’ ইনান দোনোমনা করে বলল, ‘উনি আমার ভার্সিটিতেই পড়েন। পাঁচ ইয়ারের সিনিয়র। আমাদের সম্পর্কের বেশ কয়েক মাস হয়েছে। সরি বাবা এতদিন লুকানোর জন্য, আমি খুব ভয়ে ছিলাম।’

শেষে দিয়ে ইনান মিথ্যে বলল।

‘নাম কী তার?’

‘জেহফিল। মাস্টার্সের স্টুডেন্ট তিনি।’

‘তাকে বলো আমার সাথে দেখা করতে।’

‘আচ্ছা।’

ইনান আরেকটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল,

‘আমি যদি তোমার থেকে কিছু একটা চাই তুমি কি দিবে?’

‘সেটা কি ঐ প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে?’

‘হুম।’

‘তুমি কি তাকে হালালভাবে পেতে চাও?’

ইনান এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালো। বাবা তার মনের কথা এক চুটকিতেই কীভাবে ধরে ফেলেছে! ইনান মাথা নিচু করেই রাখল, জবাব দিলো না।

ইফাজ মেয়ের হাত ধরলেন, ‘তোমার পছন্দের উপর আমার ভরসা আছে সবসময়। কিন্তু মা, বিয়েটা জানো, একটা বড় ব্যাপার। আমি আমার রাজকন্যাকে অন্যের হাতে তুলে দিবো, আর সে যদি তোমার মতো প্রিন্সেসের যোগ্য না হয়,‌বাবা হয়ে আমি তা কীভাবে মানব? আগে তাকে আনো, কথা বলি, খোঁজ খবর নেই। যদি দেখি সে তোমার যোগ্য, তাহলে আমার আপত্তি থাকবে না।’

ইনান উঠে দাঁড়ায়।

‘বাবার কি তোমাকে ধরে দিয়ে আসতে হবে?’

‘আমি পারবো বাবা।’

ইনান দরজার কাছে গিয়ে পেছন ফিরল, ইফাজ সাহেব মেয়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। ইনান ধরা গলায় বলল,

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা।’

‘তোমার থেকেও তোমাকে ভালোবাসি বাচ্চাপরী।’

.

.

ইনান ড্রয়িংরুমে বসে আছে। তার সামনে জেহফিল। জেহফিলকে এত ভদ্র দেখাচ্ছে যে ইনান তাজ্জব বনে গেল। গুড বয়দের মতো ফর্মাল শার্ট প্যান্ট পরে আছে, মাথার চুল পরিপাটি করে সাজানো। তার মুখটাও হাসি হাসি, সাথে হাসছে তার ধূসর চোখজোড়া। কোনো নার্ভাসনেসের চিহ্নটুকুও নেই। যেন সে তার বহুদিনের রেখে যাওয়া স্ত্রীকে নিতে এসেছে।

ইফাজ সাহেব রুম থেকে বের হওয়া মাত্রই জেহফিলকে দেখে চমকে গেলেন। জেহফিল নিজেও যেন অনেক চমকালো এমন ভান করে তাকালো সে। ভদ্র ছেলেদের মতো দাঁড়িয়ে ইফাজ খানের কাছে এসে সালাম দিলো হ্যান্ডশেইক করে।

অবাক চোখে চেয়ে ইফাজ বললেন, ‘তোমাকে আমি চিনি। তুমি না সে যে আমাকে ঐদিন রাতে সাহায্য করেছিলে?’

জেহফিল অমায়িক হাসে, ‘জি আঙ্কেল।’

কয়েকদিন আগে, রাতে ইফাজ সাহেব একটা কেস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। কেসটা নিয়ে এত টেনশন করছিলেন তিনি যে গাড়ি চালানোর মাঝেই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো গাড়িও খারাপ হয়ে যায়। মাঝ রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা বোধহয় দ্বিতীয়টা নেই। তখন এত বৃষ্টি হচ্ছিল!! ঠিক সেই সময় দেবদূতের মতো উদয় হয় জেহফিলের। জেহফিল ঐ রাস্তা দিয়েই ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছিল। ইফাজ খানকে গাড়িতে অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখে ছুটে এসে সিপিআর দেয়।

ইফাজ খান স্বাভাবিক হলে এই ঝুম বৃষ্টির মাঝেও ছেলেটা নিজে টইটুম্বুর ভিজে ইফাজ খানের গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিল। তারপর তাকে প্যাসেনজার সিটে বসিয়ে ইফাজ খানের বাড়িতে এসে পৌঁছে দেয়। রাস্তার মাঝে জেহফিল যখন জিজ্ঞেস করেছিল তার এত টেনশনের কারণ ইফাজ তখন‌ সব ঘটনা খুলে বলে। জেহফিল সবটা শুনে ইফাজকে শান্তনামূলক বাক্য শোনায়। ইফাজ খানকে আগে কেস থেকে সরিয়ে অন্যান্য বিনোদনমূলক কথায় ব্যস্ত রাখে। কথার মাঝে সে এমন চমৎকারভাবে ইফাজকে কেসের ব্যাপারে উৎসাহ দিল যে ইফাজ খান সেই মুহূর্তেই ম্যাজিকের মতো কেসটা সল্ভ করে ফেললেন। টেনশন মুক্ত হন তিনি। ভেতরটা তুলার মতো হালকা লাগছিল জেহফিলের সাথে কথা বলে। ইফাজ খানের এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল জেহফিল কোনো ম্যাজিশিয়ান সাইকিয়াট্রিস্ট। কী সুন্দর তার বলার ধরণ! প্রতিটা কথা কী সাজানো! কী বিনয়ী!

পরে অবশ্য জেহফিলের জীবন সম্পর্কে সবটুকু জানলেন তিনি। জেহফিল একজন আর্টিস্ট, এবং অনাথ। বাবা মা ছাড়াই ছোটো থেকে বড় হয়েছে একা। তা শুনে এত মায়া লাগল ইফাজ খানের যে তার বলতে ইচ্ছা করছিল, ‘তুমি চাইলে আমাকে বাবা ডাকতে পারো।’

.
ইনান কিছুটা বিস্মিত হলো জেহফিল আর বাবা যে আগে থেকেই পরিচিত তা জেনে। আর জেহফিলের যে এতো ভালো সাইড আছে তা শুনে দ্বিগুণ চমকায় সে। ভালো শব্দটা যেন জেহফিলের সাথে যায়ই না।

ইফাজ খান সোফায় বসলে জেহফিল নিজ থেকে উঠে চায়ের কাপ তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইফাজ খান জেহফিলের আন্তরিকতায় তো আগেই মুগ্ধ ছিলেন, এখন যেন আরো গভীরভাবেই জেহফিলের মায়ায় পড়লেন তিনি। বাবা মা ছাড়া বড় হওয়া সন্তান সাধারণত বখে যায়, যার ঠিক সম্পূর্ণ উল্টো জেহফিল। তার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ডিসিপ্লিন।

‘আঙ্কেল, আগে যদি জানতাম আপনি আমার প্রিয়তমার বাবা তাহলে বোধহয় ঐদিন আপনার কেয়ার আরো বেশি করেই নিতাম। যদি সেদিনের যত্নে কোনো ভুল হয়ে থাকে মাফ করবেন।’ জেহফিলের নম্র সুর।

ইফাজ খানের মন‌ গলে গেল নিমিষেই। এত কোমল মন কারো হয়? তিনি মেয়ের স্বামী হিসেবে জেহফিলকে দেখলেন। ছেলেটার মধ্যে আন্তরিকতার কমতি নেই। যখন হ্যান্ডশেইক করছিল তখন হালকা নিচু হয়ে জেহফিল তার হাতটা শ্রদ্ধা জানিয়ে বুকেও রেখেছে। তারপর ইফাজ খানকে বসিয়ে নিজে বসল, ইনানের পা সাবধানে চেয়ারে রাখল। তারপর ইনানের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে নিজেই টেবিলে রাখল। আর সবচেয়ে মনকাড়া ব্যাপারটা হলো, জেহফিল একবারের জন্যও ইনানকে তার নাম ধরে ডাকেনি, ডেকেছে, ‘আমার প্রিয়তমা’ নামে। এই ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলো ইফাজের নজর এড়ালো না। তিনি জেহফিলের চোখে তার মেয়ের জন্য যেন খাঁটি ভালোবাসা দেখতে পেয়েছেন!

আর এদিকে ইনানের মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। জেহফিলের এ কোন রূপ দেখছে সে? এ কি আদৌ জেহফিল নাকি তার কোনো জমজ ভাই? কী নিষ্পাপভাবে জেহফিল কথা বলছে তার বাবার সাথে! গতকালের রাগী, সাইকো জেহফিলের সাথে আজকের নম্র ভদ্র জেহফিলের তফাৎ অনেক।

.
বিশ মিনিটেই জেহফিল ইফাজ খানকে নিজের হাতের মুঠোয় করে ফেলল। ইনান চোখ বড় বড় করে দেখছিল কীভাবে জেহফিল মাত্র কয়েক মিনিটে তার বাবার ব্রেইনওয়াশ করিয়ে দিয়েছে!! স্মুথলি হ্যান্ডেল করেছে সব। ব্রেইনওয়াশ যে কতটা মারাত্মক তা ইনান হাড়ে হাড়ে টের পেল! এদিক দিয়ে অবশ্য ইনানের সুবিধা হলো যে তাকে বাবার কাছে মিথ্যা বলতে হলো না।

ইফাজ খান যেহেতু জেহফিলের ব্যাপারে এ টু জেড সবই জানেন সেহেতু তার আর কোনো অমত থাকলো না। আর এমন একজন দায়িত্ববানের হাতে মেয়ে দিয়ে ম’রলেও তিনি শান্তিতে থাকবেন।

ইফাজ সাহেব তাদের বিয়ে আরও এক সপ্তাহ বাদে দিতে চাইলে জেহফিল সেখানেও ব্রেইনওয়াশ করিয়ে দিলো তার। সে একা থাকে, ছোটো থেকেই একা থেকে এখন আর প্রিয় মানুষকে ছেড়ে থাকতে চায় না সে। তার নাকি কষ্ট হয়। ব্লা ব্লা ব্লা…

সন্ধ্যাতেই জেহফিল কাজী ডেকে এনে তাদের দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে সেরে ফেলল। এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা হয়ে গেল যে ইফাজ কাউকেই বলতে পারল না।‌ অবশ্য ইনানই বারণ করেছে, বিয়ের ব্যাপারে কাউকে জানাতে। ইফাজ কারণ জানতে চাইলে ইনান বলল সময় আসলে সে সবাইকে বলবে, তবে আপাতত যাতে এই বিয়ের খবর আর কারো কানে না যায়।

ইফাজ মেয়েকে এখনই দিতে চাইলেন না। কিন্তু সেখানেও জেহফিলের ব্রেইনওয়াশ। ইনানকে বিদায় জানানোর সময় বাবা মেয়ে এত কাঁদল! তবে ইফাজ খান সন্তষ্ট হলেন মেয়েকে সঠিক মানুষের হাতে তুলে দিয়ে। তার বিশ্বাস জেহফিল কখনো তার মেয়েকে ফুলের টোকাও লাগতে দেবে না।

.

.

গাড়িতে বসে ইনানের কান্না থামছেই না। এই দুইদিনে তার জীবনের মোড় বদলে গেল চোখের পলকে। আসলেই, সৃষ্টিকর্তা যে কার কপালে কী রেখেছে তা কেউই বলতে পারে না। এই না সেদিন ইনান প্ল্যান করল ফ্রেন্ডরা সবাই মিলে ট্যুরে যাবে। একা একা বিদেশ ঘুরবে। তারপর বিদেশি বড়লোক একটাকে ধরে বেঁধে বিয়ে করবে। অথচ এখন!! ইনানকেই ধরে বেঁধে বিয়ে করে ফেলল এক জেহফিল নামক বিষ!!

ইনান হঠাৎ জেহফিলের দিকে ফিরে থু মারল। জেহফিল রাগল না, বরং হাসল। জেহফিলের পার্সোনালিটি ইনানকে বারবার বিভ্রান্ত করে দেয়। সে ধরতে পারে না আসল জেহফিলকে।

জেহফিল ইনানকে জোর করে ধরে নিজের কোলে বসিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করল। এক হাত পেটে রেখে আরেক হাতে ড্রাইভ করতে করতে বলল,

‘আমাদের বাসর রাতে যদি গোলাপের বদলে বেলীফুল থাকে কেমন লাগবে? তোমার বেলীফুল সবচেয়ে বেশি পছন্দ তাই না বাটারফ্লাই?’

তারপর নিজ মনে বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি আর একা নই দুনিয়াতে, আমি আর একা নই…’

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
জেহফিল অনবরত বাথরুমের দরজায় কড়া নেড়েই যাচ্ছে। ইনান গোসলের নামে যে গেছে, আধঘন্টা হয়ে গেছে মেয়েটার বেরোনোর কোনো খবর নেই। এদিকে বৃষ্টির কারণে কারেন্টও নেই। অন্ধকারে একা কী করছে এতক্ষণ? ভেতর থেকে পানির আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না। জেহফিল হাইপার হয়ে যাচ্ছে টেনশনে। বারবার বাথরুমের দরজায় ধাক্কাচ্ছে আর অস্থির গলায় বলছে,

‘বাটারফ্লাই প্লিজ দরজাটা খুলো, অনেকক্ষণ হয়েছে, আর কত টেনশনে রাখবে আমাকে? প্লিজ সোনা, শুধু দরজাটা খুলো, আমি ভেতরে যাব না প্রমিস, বাহিরেই থাকব লাইট হাতে, তুমি খুলোনা দরজাটা! এত কেন অভিমান বাটারফ্লাই?’

ইনান দরজা খুলল না। ভেতর থেকেই কান্নারত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,

‘আপনি একটা জঘন্য মানুষ। স্বার্থপর। নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে একটা মেয়ের সম্মান নিয়ে খেলতেও আপনার বাঁধে না।’

জেহফিল এবার বুঝল ইনানের রাগের কারণ।

‘এই সামান্য কারণে তুমি বের হচ্ছো না? গড! এত বোকা কেন তুমি?’

‘আপনার মতো মানুষের কাছে এসব সামান্য হতে পারে, আপনি কী বুঝবেন এসবের? মেয়ে হলে ঠিকই বুঝতেন।’

‘আচ্ছা, বাইরে বের হও, তারপর যা ইচ্ছে করো, তাও প্লিজ বের হও। আই ক্যান এক্সপ্লেইন।’

জেহফিলের আরও পীড়াপীড়িতে ইনান শেষ পর্যন্ত দরজা খুলল। ইনানকে বের হতে দেখে জেহফিল জড়িয়ে ধরতে চায় তাকে। ইনান বাঁধা দেয়। কঠোর স্বরে বলে,

‘কী এক্সপ্লেইন করবেন? বলুন। সময় অল্প।’

ইনানকে জড়িয়ে ধরতে না পেরে জেহফিল ছটফটানি শুরু করে। যেন এখন জড়িয়ে ধরতে না পারলে সে ম’রেই যাবে। মিনতি করে বলে,

‘তার আগে একটু জড়িয়ে ধরি? একটু? হালকা করে? নাহলে আমি শান্তি পাবো না।’

‘আগে এক্সপ্লেইনেশন।’ কড়া জবাব ইনানের।

জেহফিল মাথার চুল শক্ত করে চেপে ধরে। সে রাগতে চায় না এখন। বড় বড় ঢোক গিলে ধাতস্থ করে নিজেকে সে।‌ পারে না, নিজের ইমোশন আড়ালে রাখতে ব্যর্থ হয়। ইনানের অনুমতি ছাড়াই জোর করে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ইনানকে। ইনান জেহফিলের বাহুডোরে থেকেই সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি শুরু করে।‌ জেহফিল ইনানকে জড়িয়ে ধরেই খাটের উপরে নিয়ে বসায়। বালিশে আধশোয়া হয়ে ইনানের পিঠ তার বুকে হেলান দিয়ে বসে। পেছন থেকে ইনানকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘নাউ আই ক্যান এক্সপ্লেইন।’ মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলো সে। হলুদ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল রুমটা। তারপর মোবাইল হাতে নিয়ে সেই ভিডিওটা প্লে করে।

ইনান ইতোমধ্যেই কান্না‌ শুরু করে দিয়েছে। জেহফিল ইনানকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে,

‘ট্রাস্ট মি বাটারফ্লাই। ঐদিন তোমার সাথে খারাপ কিছুই করিনি। শুধু তোমার পেটেই হাত দিয়েছি বিশ্বাস করো। এর বেশি কিছুই করিনি। এই দেখো আমি ভিডিওটা ডিলিট করে দিচ্ছি। তোমার সামনেই।’

জেহফিল ফোল্ডার থেকে এমনকি ট্রাশ ক্যান থেকেও ভিডিও ডিলিট করে দিলো।

তারপর ইনানকে নিজের মুখোমুখি বসাল, ইনানের হাত দুটো চেপে ধরে নিজের বুকে রাখল। অসহায় গলায় বলল,

‘আমি সত্যিই সরি বাটারফ্লাই। আমি জানি যা করেছি খারাপ করেছি। কিন্তু ঐ মুহুর্তে..ঐ মুহুর্তে কী যে হলো, আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমাকে নিজের করে পাওয়াটাই তখন মেইন ফোকাস ছিল। তাই খুব বাজে একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না, তাও ক্ষমা চাইছি।’

জেহফিল ইনানের ছোট্ট মুখটা নিজের দুহাতের মাঝে নিলো, ‘তুমি কি ভেবেছ? আমি এই ভিডিওটা সত্যি সত্যি অনলাইনে ছেড়ে দিতাম? আমি খারাপ হতে পারি, কিন্তু আমার ভালোবাসার মানুষের সম্মান নিয়ে কখনো ছেলেখেলা করতে পারি না, এতটাও বাজে নই আমি বাটারফ্লাই। আমি শুধু তোমাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে ভিডিওটা বানিয়েছিলাম, যাতে তুমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাও।’

ইনান ফোঁপাচ্ছে। জেহফিলের করা কাজটায় সে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

‘তুমি..তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও? কী শাস্তি দিবে বলো? মাথা পেতে নেব সব। কী শাস্তি পেলে তুমি খুশি হবে…?’

জেহফিল এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজে। তারপর বেডসাইড ড্রয়ার খুলে ধারালো ব্লেড নিয়ে হাতে পোঁচ মারা শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় ইনান।

‘কী করছেন এসব?’ চেঁচিয়ে উঠে ইনান।

ততক্ষণে জেহফিলের সাত আটটা পোঁচ মারা শেষ। সে বিড়বিড় করে বলছিল, ‘আমার বাটারফ্লাই, আমাকে ক্ষমা করো… বাটারফ্লাই… ক্ষমা করো..’

ইনান জোর করে জেহফিলের হাত ধরে থামালো। জেহফিলের হাত থেকে রক্ত টুপটুপ করে ঝরে পড়ে সাদা বেডশিটটাকে রঞ্জিত করে তুলছে। ইনান মাথা ঘুরাচ্ছিল রক্ত দেখে।

‘এইড নিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি।’

‘তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো বাটারফ্লাই?’

জেহফিলের চোখে ব্যথার ছাপ নেই। সে আকুল হয়ে আছে ইনানের ক্ষমা পাওয়ার জন্য।

‘আপনি প্লিজ এইড বক্স আনবেন? আমার মাথা ঘুরছে রক্ত দেখে।’

জেহফিল নিজের জন্য না বরং ইনানের কথাতেই বক্স নিয়ে বসল।

‘তুমি নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিবে? একহাতে পারব না।’

জেহফিলের হাত ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় ইনানের অন্য হাতে নজর গেল। মোমের আলোয় দেখল জেহফিলের বাম হাতেও ব্লেডের কাটা দাগ। পুরোনো মনে হচ্ছে দেখে। এমনকি ডানহাতেও আগের কাটা দাগের চিহ্ন আছে। একটা দুইটা দাগ নয়, চিকন ব্লেডের অসংখ্য দাগ জেহফিলের হাতে। দেখে মনে হয়, নির্মমভাবে একাধারে হাত কেটেছে।

ইনান কৌতুহল মেশানো চাহনিতে জেহফিলকে প্রশ্ন করল,

‘এত কাটা দাগ কিসের?‌ আপনি এর আগেও হাত কেটেছেন?’

জেহফিল চুপ থাকল।

‘বলছেন না কেন?’

‘হুম।’

‘কেন‌ কেটেছেন।’

‘সরি।’

‘আজব, সরি বলছেন কেন, জিজ্ঞেস করেছি কেন কেটেছেন?’

জেহফিল মৃদু শ্বাস ফেলে এইড বক্স সরিয়ে ইনানের কাছ ঘেঁষে বসল। ইনানের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

‘দুনিয়াতে একা থাকা অভিশাপ। সেই অভিশাপে অভিশপ্ত আমি। অভিশপ্ত ছিলাম..তুমি আসার আগ পর্যন্ত। এখন আর একা নই আমি।’

‘একা থাকলে মানুষ হাত কাটে? এই প্রথম শুনলাম।’

জেহফিল কাঁধ থেকে মাথা উঠালো। ইনানের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘বাটারফ্লাই, তুমি ছোটো থেকেই ফ্যামিলি-ফ্রেন্ডসের মাঝে বড় হয়েছো, আর আমি এতিমখানায়।’

ইনান হতবাক। জেহফিল এতিমখানায় বড় হয়েছে? সে তো জানতো না? উৎসুক গলায় বলল,

‘আপনি এতিমখানায় বড় হয়েছেন?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেহফিল। খাটে আধশোয়া হয়ে ইনানকে নিজের বুকে এনে ফেলল। ইনান আপাতত কিছু বলল না, জেহফিলের কাহিনী শোনার জন্য সে জেহফিলের দিকে চেয়ে আছে। ইনানের সিল্কি চুল নিয়ে খেলা করতে করতে জেহফিল বলল,

‘আমি জানি না আমার বাবা মা কে বা কোথায়! বুঝ হবার পর থেকেই জেনেছি আমাকে কুড়িয়ে পাওয়া হয়েছে। পরিবার আসলে কী জিনিস, আমি কখনোই বুঝিনি! এতিমখানায় একঝাঁক ছোট বড় ছেলেমেয়ের মাঝে আমিও বড় হয়েছি।’

‘তারপর?’

জেহফিল হাসে। হলদেটে আলো লেগে থাকা ইনানের মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে বলে, ‘তারপর তোমাকে পেয়েছি।’

‘এতিমখানায় থেকেও আপনার ফ্রেন্ডস ছিলো না?’

‘না, জানি না কেন আমি অন্যদের থেকে আলাদা হলাম! চুপচাপ থাকতাম, আর ছবি আঁকতাম। কেউ আমার সাথে মিশতো না, শুনেছি আমাকে নাকি তারা ভয় পায়, আমাকে দেখতে নাকি আজব লাগে, গোমড়ামুখো থাকি বলে সবাই দূরে দূরে থাকতো। এতে আমিও খুশি ছিলাম। কারো সাথে কথা বলা, খেলাধুলা এসব বিরক্তিকর লাগতো আমার কাছে। বই আর আর্ট এই দুইয়ের মাঝেই আমার আমার জীবনটা সীমাবদ্ধ ছিল।‌ তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তবে আমার এত বছরের জীবনটায় ঊর্ধ্বে দশ-পনেরোজন মানুষের সাথেই ভালোমতো আলাপ হয়েছিল। তার মধ্যে অধিকাংশই ছিল আশ্রমের আঙ্কেলরা যারা আমার আর্ট বিক্রি করতে সাহায্য করেছিল।’

ইনানের মুখ হা হয়ে গেল। মানুষের জীবন আদৌ এমন হয়?

‘যখন তারা দেখল আমি আর্ট করেই নিজেকে চালাতে পারব তখন আশ্রমের হেড আমাকে এই বাড়িটা কিনে দেয় আমার টাকাতেই। মূলত আমার পছন্দেই, একা থাকা, লোকালয় থেকে দূরে নির্জনে থাকাটাই আমার পছন্দ। তারপর আর কী, আর্ট, বই পড়া, আর কলেজেই জীবন চলছে।’

‘আপনি কিন্তু আমার কথার জবাব দিলেন না এখনো?’

‘দিতেই হবে?’

‘অবশ্যই।’

‘আগে একটা কিস দাও।’

‘উফ! বলা লাগবে না।’ ইনান বিরক্ত নিয়ে উঠে যেতে নিলো। জেহফিল হাত টেনে আগের জায়গায় নিয়ে আসলো,

‘বলছি বলছি।’

ইনানকে বুকের মধ্যে নিয়ে আবার বলা আরম্ভ করল,

‘দিন ভালোই চলছিল, আর্ট ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে পৌঁছাল। টাকা পয়সা সবই হলো। কিন্তু ভেতর থেকে আমি মরে যাচ্ছিলাম একাকিত্বের কারণে। কলেজে ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব, রাস্তায় পরিবারের বন্ধন, এসব দেখলে খুব হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। ঘরে কেউ নেই যে আমার জন্য অপেক্ষা করবে, আমার অসুস্থতায় পাশে বসবে, কেয়ার করবে, আমার সব দুঃখ কষ্টের ভাগ নিবে…একাকীত্ব আমাকে কুড়ে কুড়ে খেত। জ্বরে পড়লে নিজেই নিজের সেবা করা, ক্লান্ত হয়েও রান্না করা.. বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম জীবনের প্রতি।’

জেহফিলের কণ্ঠ বিষাদময়, ‘যারা আমাকে জন্ম দিয়েছে তাদের দোষারোপ করতাম, কেন এমন জঘন্য দুনিয়াতে এনে ফেলেছে! আমাকে মে’রে ফেললেই তো এত কষ্টে থাকতে হতো না। সুই’সাইড করতে চেয়েছিলাম। সুই’সাইড করতে যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য হাত কেটে ট্রায়াল দিয়েছিলাম। দেখলাম আসলে আমার কষ্ট হয় কিনা। তবে মনে কষ্টের কাছে শরীরের কষ্টটা তুচ্ছ ঠেকল।’

ইনানের দিকে তাকালো একবার, ইনানের হাত নিজের গালে চেপে ধরে চুমু খেয়ে বলল,

‘মনে আছে বাটারফ্লাই, আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা? ঐদিন আমি ডিসাইড করেছিলাম সুই’সাইড করব। কিন্তু কী মনে করে আমি সেদিন তোমার ক্লাসে ঢুকে পড়েছিলাম, আর তোমাকে দেখলাম। বোধহয় উপরওয়ালা আমাকে বাঁচানোর জন্যই তোমাকে পাঠিয়েছেন। কারো প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া আমি প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম। তোমার হাসি মুখ আর চঞ্চলতার প্রেমে। সেই মুহুর্তেই ম’রার চিন্তা নিমিষেই দূর হয়ে গেল। মনে হতে লাগল, কেউ আছে আমার, সে আমার হলে আমার একাকীত্ব দূর হবে, আমি বাঁচতে পারব। তোমাকে স্টক করতে লাগলাম প্রতিটি সেকেন্ড। তোমাকে নিজের করে পাওয়াটার তীব্র বাসনা ক্রমে ক্রমেই আমাকে তাড়া দিতে লাগল। তারপর আর কী…আমাকে বাঁচানোর জন্য তুমি আমার হলে…একান্তই আমার।’

.
.
চলবে…