#গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১
#নাজমুন_নাহার
ক্যালেন্ডারের পাতায় এখন বৈশাখের মাঝামাঝি সময়। দিনে কাঠফাটা রোদ আর রাতে মাঝে মাঝেই তুমুল ঝড়-বৃষ্টি ধরণের আবহাওয়া। চারদিন ধরে ভ্যাপসা গরম পড়েছে। প্রকৃতিকে কেবলই গুমোটভাব। আজ অবশ্য সারাদিন তেমন রোদের প্রকোপ দেখা যায়নি। রাতের আকাশও পরিস্কার। শুভ্র সুদূর আকাশে কেবল উজ্জ্বল চাঁদ আর ঝিলমিলে তাঁরাদের বিচরণ।
পরনে লাল টুকটুকে ছোপ ছোপ ডিজাইনের বেনারসী। মাথার আটপৌরে সিথিখোঁপার উপর লাল দোপাট্টা। হাতে-গলায় হাল্কা কারুকাজের সোনার গহনা। ধরে বেঁধে কোনোমতে সাজালেও বলা বাহুল্য, এই সারল্য রূপেই চমৎকার মানিয়েছে নিরাকে। ফর্সা গোলগাল মুখের সরু, চিকন নাকটাতে এক নজর চোখ বুলালে অকপটে তাকে ইর্ষা করবে পৃথিবীর তাবত সৌন্দর্যেরাও। ঝিল চোখদুটোয় যেনো একবুক সমুদ্র আছড়ে পড়ছে। বিরক্তিমাখা অপ্রতিরোধ্য চেহারাটা তুলে একপলক চাইলো দরজার পানে সে। রাগান্বিত রক্তিম নাকের স্বর্নের নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছে তখনও। চোখের কোটরে কাজল লেপ্টানো। মায়াবী মুখশ্রীটায় আজ শুধুই অসন্তুষ্টি। বেলীফুলের কৈশোর থেকে তপ্ত যৌবনের প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে রমণীরা মনে মনে যে বিশেষ দিনের আকাঙ্ক্ষা করে থাকে? শিউলিফুলের মালার মতো করে স্বপ্ন বুনে? আজ নিরার জীবনের সেই শিহরণ জাগানো একটা দিন। কিন্তু এই হিরন্ময় সাজ, এই লাজুক আয়োজন, কিছুই মেয়েটাকে স্পর্শ করতে পারছে না। মনটা কেবল পালাই পালাই করছে।
আজ নিরার বিয়ে। কিন্তু এই শুভলগনে মেয়েটা এমন ফাঁসির আসামীদের মতো করে মুখ করে রেখেছে কেন? ওকে দেখে মনে হচ্ছে, মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছেটা জানতে চাওয়া হচ্ছে। নিরা সে-ই ইচ্ছাটা নিয়েই বিভ্রান্ত। তার ইচ্ছেকে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট কতটুকু প্রাধান্য দেবে? কেননা আসামী মৃত্যুসজ্জায় দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁচাতে চায়। বেকসুর খালাস চায়। বিনা অপরাধের শাস্তি থেকে পাখির মতো মুক্ত হতে চায় সে। অথচ এরা আসামীকে এক আনার পাত্তাও দিচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার!
বিরক্তিতে দাঁত কিড়মিড় করছে নিরা। পাখির মতো চঞ্চলা চোখ তুলে এদিক-ওদিক ঘাড় বাঁকিয়ে কাকে যেনো খুঁজছে । সময় বোধহয় ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোথায় সেই গুনধর লোক? লোকটা কি জানে না, আর কিছু মুহূর্ত পেরোলেই দু’জনের বলি হয়ে হবে? জবাই করা হবে দু’টোকে। অসহ্য লাগছে নিরার। এতোটা ইরেসপন্সিবল কী করে হতে পারে, নাবিল ভাই? যে যাই বলুক, যা-ই করুক, নিরা কিছুতেই নাবিল ভাইকে বিয়ে করবে না। না মানে না-ই। তার জীবনটাকে সকলে মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি এরা? বললেই হলো? একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের গলায় কী করে ঝুলে পড়বে নিরা? সে-ই কিশোরী বয়স থেকে যে মানুষটাকে পাগলের মতো চেয়ে এসেছে, যাকে নিয়ে আজও দিবালোকে, নিশির প্রহরে সংসার সাজায় অবুঝ মনটা, সে-ই নিলয় ভাইকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারছে না নিরা। আচ্ছা, নিলয় ভাই কি জানে না আজ নিরার বিয়ে? মানুষটা কি কখোনও নিরার তৃষ্ণার্থ মনটা পড়ে দেখেনি? সে কি জানে না, বাংলাদেশে বসে থাকা একটা ছোট্ট প্রাণ চাতক পাখির মতো তার জন্য দিবারাত্রি অপেক্ষা করছে? নিলয় ভাই কি কখনোই সেসব একপাক্ষিক ভালোবাসা টের পায়নি? কেন পায়নি! একটা বার কি বাবাকে ফোন করে বলা যেতো না, ‘মামা, নিরুকে আমার জন্য রেখে দিন। ওকে আমি বিয়ে করবো৷ নিলয় ছাড়া নিরা অন্য কারো কাছে নিজেকে মানিয়ে পারবে না,মামা। নিরা শুধু নিলয়কে চায়।’
মহিলাদের ভীর ঠেলে নিরার ঘরে ঢুকলো সাত বছর বয়সী ইফরান। নাবিল চাচ্চুর আদেশ মেনেই বেচারাকে এই আতঙ্কপুরীতে প্রবেশ করতে হলো। ইফরান বরাবরই লাজুক স্বভাবের ছেলে। তার উপর এতোগুলো মেয়েকে একসঙ্গে দেখে সে বেশ বিব্রতবোধ করছে। পাছে কেউ তাকে একা পেয়ে মশকরা না করে বসে। কিন্তু কী আর করা?চাচ্চু যা হোমওয়ার্ক দিয়েছে সেটা করতে না পারলে কপালে দুঃখ আছে।
ভীর ডিঙিয়ে পিঁপড়ার মতো পা ফেলে কোনোমতে নিরার পাশে দাঁড়াতে দাঁড়ালো। তবে প্রাইভেসি কম। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝল, কাঙ্ক্ষিত বার্তা নিরা পর্যন্ত পৌঁছানো দুরূহ ব্যাপার এই মুহূর্তে। বার্তা পাঠানোর জন্য জন্য একটু চুপিচুপি টাইপ পরিস্থিতি দরকার। যেটা এখন নেই। মানে এখন ফুপ্পির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। এমনকি নিরাও ওকে খেয়াল করলো না। বোকা বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো ইফরান। নিরা ফুপ্পিকে আজ তার বড়োই ভালো লাগছে। কণে সাজে কী যে সুন্দর লাগছে ফুপ্পিকে। ইফরান চোখ ফেরাতে পারছেনা। নাবিল চাচ্চুর সাথে খুব মানাবে। আচ্ছা, বাবা তো বলেছিল নিরা ফুপ্পি আর নাবিল চাচ্চু কাজিন ব্রাদার এন্ড সিস্টার হয়। তাহলে সকলে যে বলছে আজ ওদের বিয়ে? কাজিনকে আবার বিয়ে করা যায়? অদ্ভুত তো! তাহলে তো তারও অনেক কাজিন সিস্টারস আছে। সে বড় হলে বাবা-মা-ও কি তাকে কোনো এক কাজিনের সঙ্গে বিয়ে করাবে? হ্যা, যুক্তি তো তা-ই বলে। ইফরান চিন্তায় পড়ল।
“এই জুয়ান বর, তোমার এখানে কী গো?”
সকলে হো হা করে হেসে ফেললো। ইফরান ভ্রু বাঁকিয়ে চাইলো ওদের দিকে। এই শাহানা নানুটা তাকে নিয়ে সবসময় মশকরা করে। মা বলেছে সে নাকি নিরা ফুপ্পির ছোট খালা। কিন্তু উনি কেন সবসময় ইফরানকে দেখলেই এমন পঁচা কথা বলে? ধ্যাত! একদম লজ্জায় ফেলে দেয়। এতো লোকের ভীরে এভাবে বর ডেকে দিলো? ছিহহ! ইফরানের বুঝি লজ্জা করেনা?
“ফুপ্পিকে দেখতে এলাম।”
“দেখা হলো?”
ইফরান একপলক নিরার দিকে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
“কেমন লাগছে তোর নিরা ফুপ্পিকে?”
কানের কাছে এসে পাশ থেকে প্রশ্নটা করলো রিমি। ইফরান পূনরায় নিরাকে দেখে নিলো।
“সবার থেকে বেশি সুন্দর লাগছে।”
হেসে ফেললো সকলে।
“তা-ই? তাহলে এক কাজ কর, তোর নাবিল চাচ্চুকে গিয়ে বল, ফুপ্পিকে আজ সবার থেকে বেশি সুন্দর লাগছে। ব্যাটা কী রিয়াকশন দেয় এসে জানাবি। যদি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে চায় সেটাও এসে বলবি। কেমন?”
ইফরান বিভ্রান্ত মুখে চেয়ে রইলো। আজব তো! নিরা ফুপ্পিকে সুন্দর লাগছে সেটা চাচ্চুকে জানানোর কী আছে? চাচ্চু তো কতোই দেখেছে ফুপ্পিকে। আলাদা করে বলার কী হলো?
ঘরময় পায়চারি করছে নাবিল। বিচ্ছুটাকে সে-ই কখন পাঠালো, এখোনও কোনো আপডেট নিয়ে এলো না। ও কি নিরাকে প্ল্যানটা জানাতে পারেনি? কিন্তু সময় যে নেই হাতে আর! নিরাটা আস্ত চিবিয়ে খাবে।
কোথা থেকে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে হাঁটুতে হাত ভর করে দাঁড়িয়ে হাপাতে লাগলো ইফরান৷ নাবিল দুই হাত বুকে ভাজ করে দাঁড়াল। অগ্নিচোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বিচ্ছুটাকে মাথায় তুলে আছার মারতে ইচ্ছে করলেও এই মুহূর্তে উত্তরের আশায় চেয়ে রইলো।
‘চাচ্চু, ফুপ্পিকে রিচ করতে পারিনি। আই মিন, পেরেছি তবে দ্যেয়ার আর সো ম্যানি লেডিস এরাউন্ড নিরা ফুপ্পি। ওরা ফুপ্পির সাথেই বসে আছে। ওদের ওভারকাম করে ফুপ্পি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। এন্ড দ্যিস ওল্ড লেডি, ‘শাহানা’, শি ইজ টু মাচ। আমাকে বলে আমি নাকি তার জুয়ান বর। আজব কথা! আমি কেন তার বর হতে যাবো! শি ইজ নিরা ফুপ্পি’স আন্টি। তাছাড়া শি হ্যাভ এন ওল্ড হাজবেন্ট এন্ড থ্রি কিডস। তাকে জানিয়ে দেবে, আমি কোনো ম্যারিড ওল্ড লেডিকে বিয়ে করবো না, হু।’
নাবিল চোখ বড় বড় চাইলো। মেজাজ খারাপ হলো তার।
“তোকে ওল্ড লেডিদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করতে পাঠিয়েছি? এমন চর লাগাবো ব্যাটা ইংরেজের বাচ্চা! গর্ধব, নিরা কী করছিল?”
“মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। ম্যাবি শি ইজ এংগ্রি উইথ সামওয়ান।”
মেজাজ অত্যাধিক চটলো বোধহয় নাবিলের। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে চাইলো।রেগেমেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিরার কর্কশ কন্ঠ ভেসে এলো। কঠিন স্বরে ঝাঁঝিয়ে উঠলো মেয়েটা।
“নাবালকের বাচ্চা! তোকে সামনে পাই একবার,তোর চান্দি ভেজে যদি ইঁদুরকে না খাইয়েছি? তো আমার নামও নিরা না! বিয়ে করার শখ হয়েছে? যা বললাম সেটা না করে টোপর পরে রোস্টে কামড় মেরে বসে আছো কেন? আমার মাথা গরম করাবা না, নাবিল ভাই। ঘর-বাড়ী ভেঙে একাকার করে ফেলবো বললাম। কিছু একটা করোওওওওওও! এরা আমায় চিতায় তুলবে। প্লিজ ডু সামথিং, নাবিল ভাইইই!”
“তোর কি মনে হয় তোকে বিয়ে করার খুশিতে আমি লুঙ্গি ডান্স করতেসি? বেহুদাই কেঙ্গারুর মতো লাফায় উঠোস ক্যান?”
“গলা উচাবা না। একে-তো একটা কাজ ঠিকঠাক করতে পারলা না। আবার ভাব নিচ্ছো?”
“ফর্টি ফাইভ ডিগ্রি এঙ্গেলে ধরে বন চটকানা মারবো, ছেমরি। একদম বউয়ের মতো ঝাড়িঝুড়ি মারবি না। তোর বাপ, আই মিন আমার শ্রদ্ধেয় মামু পালে আমারে? যৌতুকে একটা ওডি দিলে নাহয় তোর গরম গরম ঝাড়ি নরম ভাত ভেবে গিলে নিতাম। আমার চেহারায় কী জোকার টাইপ কিছু লেখা আছে? এতো ত্যাজ দেখাস ক্যান? পৃথিবীতে আমার ইম্পরট্যান্স কতো জানিস তুই? তোদের বস্তাপঁচা চিপ নাটক দেখার মুড নেই আপাতত। ঘুমাবো। বাসায় যাইতে দে বাল।”
নিরা মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও পারছে না। নাবিল ভাইকে তার আগাগোড়া বরাবরই বিরক্তিকর লাগে। এখন তো আরও লাগছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই করার নেই! হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকি, টিকটিকি, এমনকি সাপও ঠ্যাং দেখায়। এখন সে শুধু কাঁদায় পড়েনি, গলা সমান চোরাবালিতে ডুবতে যাচ্ছে। না চাইতেও বিটকেলটার সাহায্য দরকার। যার জন্য তার গাঁজাখুরি মার্কা কাজগুলোও হজম করে নিতে হবে এই মুহূর্তে।
“দেখো নাবিল ভাই,
নাবিল মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে অবাক হওয়ার ভানে বলে,
“দেখছি।”
নিরা দাঁত কটমট করলো।
“গন্ডারের বাচ্চা! আমি ওয়াশরুমে ঢুকে ফোন করেছি তোকে। দয়া করে কিছু একটা কর, নাবিল্লায়ায়া। কাজি আসবে একটু পরেই। বিয়েটা যদি হয়ে যায়, তোকে জিন্দা চাবাই খাবো, আই স্যয়ার।”
“গুনে গুনে তোর থেকে বয়সে চার-পাঁচ বছরের বড়, একটু তো রেসপেক্ট কর ব্রো।”
“ওসব দুই-চার বছর কোনো কেলকুলেশন হলো? তোমার সঙ্গে এতো রেসপেক্টের সম্পর্ক কোনো বেলাতেই ছিল না। জংলীর মতো সারাক্ষণ পেছনে লেগে থাকলে সম্মান আমদানি হবে কোথা থেকে?”
“নিরা রে, তুই কিন্তু সত্যিই একটা ফালতু মহিলা। চাপা ধরে না? এতো কথা প্যাচাস ক্যান? কতোটা লাইফলেস আর ইউজলেস হলে মানুষ সারাদিন আকামের কথা বাড়াতে পারে। ভালো হয়ে যা,আমি দিবো ফ্রি ট্রেইনিং।”
“আমি ফালতু? লাইফলেস আমি? তুমি, দ্য ফাজিল বয় নাবালক ছাড়া আর কারো সাথে এতো কথা বলেছি কখনোও? বলেছি কেন বললাম? বলতে তো বাধ্য করো৷ আমার পেট উগলানো তেতো কথা না শুনলে তো তোমার পেটের ভাত হজম হয়না। এমন কেন করো আমার সাথে? কোন কালে তোমার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি?”
নাবিল আঙুল দিয়ে কপাল ঘষে নিঃশব্দে হাসলো। বুঝলো, বেজায় খেপেছে মেয়েটা।
“ছল্লিবাজি সাইডে রেখে ডিলে আয়। বল, তোকে হেল্প করার বিনিময়ে কী পাবো? জলজ্যান্ত একটা বিয়ে ভেঙে ফেলা তো আর চারটিখানি কথা না, মামাতো সিস্টার। খাটনি আছে বহুত।”
“কী চাই তোমার?”
“উমমমমমমমমম… মাল কতো আছে তোর পকেটে?”
নিরা বিরক্তিতে দাঁত কটমটালো।
“হাজার পাঁচেক হবে।”
“ব্লাডি গরীবসস। মামীর গহনা-টহনা নাই কিছু?”
নিরা প্রকট রাগ দেখিয়ে দুম করে ফোন কেটে দিলো। আর সহ্য করা যাচ্ছেনা অসহ্য লোকটাকে। মাথাটা ধরেছে খুব। এতো অত্যাচার কি মেনে নেওয়া যায়? বুঝতে বাকি নেই, নাবিল ভাই ইচ্ছে করে ওকে রাগাচ্ছে।
পরমুহূর্তেই ফোন করলো নাবিল।
“রেগে যাচ্ছিস কেন ব্রো? ব্লাড প্রেশার বাড়বে তো। ওপপস, তুই তো আবার লো আয়রন, লো প্রেশারের রুগি। ব্লাড প্রেশার বাড়ে না। কিছু হলেই পৃথিবী গোলগোল করে ঘুরে। রিলাক্স, শান্ত হ। রাগ কমা, নয়তো গালের মাংস ফুলে ব্লাস্ট হবে যেকোনো সময়। মাথা ঠান্ডা করে বোস, ভাবতে দে।”
“আমি কিন্তু গলায় ফাঁস দিবো, নাবিল ভাই। তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে ফাঁসাবো জেনে রেখো।”
“হু হা হা। তোর মদন মার্কা আরজি শুনে হাল্কা করে মরে গেলাম। এমন চিপ মুখস্থ ট্রাজেডি লাইন কে শেখায়? আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে তোর গোষ্ঠীই তো অর্ধেক রে বলদের বলদ। এমন আবুল কিসিমে’র যুক্তি নিয়ে নাবিলের সঙ্গে তর্কে জড়াস? মূর্খ রমণী।”
নিরা ফুঁসে উঠলো। নাবিলের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে অপর প্রান্ত থেকে। গগন কাঁপিয়ে হাসছে ছেলেটা৷ জলজ্যান্ত আগ্নেয়গিরির লাভাটাকে আরেকটু উস্কে দিতে মন্দ লাগে না তার। নিরুটার রাগটা বরাবরের মতোই একটু বেশিই। ওকে রাগানো মানে নাবিলের সারাটাদিন বিন্দাস।
ইফরান বিভ্রান্ত মুখে চেয়ে আছে চাচ্চুর পানে। হুট করেই হাসছে কেন চাচ্চু!
“হাসছো কেন,তুমি? নিরা ফুপ্পি কী বললো?”
“ফুপ্পি না রে পাগলা, চাঁচি বল। একটু পরেই পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে তোর নিরা ফুপ্পি তোর চাচাকে কবুল করবে। তোর ফুপ্পির অবস্থা বেগতিক। যেকোনো সময় ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যাবে। চাঁচি বলার অভ্যাসটা এখন থেকেই কর বাপ। আমার বিয়ে করা বউকে ভবিষ্যতে এমন এবড়োখেবড়ো ডাকে সম্মোধন করলে মাথায় তুলে আছার মারবো। চাঁচি বলবি,বুঝলি? সাথে আম্মা এড করলেও প্রব্লেম নেই। আমাদের নাদুসনুদুস ছাওয়াল-পাওয়াল হওয়ার আগে তোকেই নাহয় পালিত সন্তান বানিয়ে নিলাম। কী বলো, প্রি-অর্ডারি বউ?”
নিরা ভারী একটা শ্বাস ফেললো।
“নাবিল ভাই, প্লিজ তাড়াতাড়ি বলো কী করতে হবে? তোমার সঙ্গে আজাইরা প্যাচার করার জন্য পুরা জীবন পড়ে আছে। এখন বাঁচাও। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ম্যারি নাউ,আর তোমাকে বিয়ে করার তো প্রশ্নই আসে না। প্ল্যান আছে কিছু? নাকি ওটাও মেয়ে হয়ে আমাকে দিয়েই করাবা?”
“তুই কি রে? সাহায্য চাইছিস আবার অকৃতজ্ঞের মতো এটিটিউড দেখাচ্ছিস? কংক্রিটের শরীর নাকি? মায়া-দয়া, ম্যানার্স,সফ্টনেস,কুলনেস বলতে কিছু আছে, নাকি সেটাও সিমেন্ট ভেবে গিলে নিয়েছিস? কই হাতে-পায়ে ধরে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ভ্যাঁ করে একটু কাঁদবি, তা না, উল্টো এমনভাবে বলছিস মনে হয় তোর মতো ব্রিটিশ মরিচকে বিয়ে করার জন্য আমি খুব আনন্দবোধ করছি। আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে টাইপ ব্যাপার? আয়নায় নিজেকে দেখেছিস কোনোদিন? ইউউউউ ব্লাডি ব্রিটিশ মরিচ!”
নিরা নিজেকে সামলালো একটা লম্বা শ্বাস টেনে। মেয়েটা বরাবরই এই এক রাগের কাছে কাবু হয়ে যায়।
“শ্রদ্ধেয় নাবালক এহসান, প্লিজ আমার প্রতি একটু এহসান করুন। এই মাইনকার চিপা থেকে উদ্ধার করুন প্লিজ। আপনার প্রানপ্রিয় মামা আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বলি দেবেন। সেখানে আপনি প্লিজ জল্লাদের রোলটা প্লে করবেন না। একটু সদয় হোন এই দুঃখী মানবীর প্রতি।”
বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথাগুলো বললো নিরা। নাবিল বিরক্ত হলো। মুখে চ সূচক শব্দ করে বললো,
“তুই নাবালক, তোর নানার সাত গোষ্ঠী নাবালক! বাপের সঙ্গে না পেরে আমার মধুর মতো মিষ্টি নাম বিকৃত করতে আসছে। এতো কাহিনী না মারিয়ে নিজে গিয়ে বললেই তো পারো, হাঙ্গা তুমি করবে না। আমাকে কেন ফাঁসালি? তোকে আসলে থাপ্রানো উচিত, ফাজিল। মুখে বেহুদা পটরপটর সারাদিন, কাজের বেলায় খালি কলসি।”
নিরার কন্ঠ নরম হয়ে এলো। রয়ে সয়ে বলল,
“অসময়ের সুযোগ নিও না তো, নাবিল ভাই। মেলা পেরায় আছি। আপুর বিপদ আমার ঘাড়ে এভাবে চেপে বসবে জানলে জীবনেও ওকে হেল্প করতাম না। না থাকতো বাঁশ,না বাজতো বাঁশরি। হারামিটা প্রেমিক নিয়ে ভেগে আমায় ফাঁসিয়ে গিয়েছে। আব্বুকে কী করে বোঝাই বলো তো? মিরাপু ভেগেছে বলে কি আমিও মানইজ্জত ডুবাবো? এই চিনলো আমায়?”
নাবিল হাই তুলতে তুলতে বললো,
“তোদের বিশ্বাস নেই। করতেই তো পারিস। তলে তলে টেম্পু চালালে আমার সহজ-সরল মামার গতি কী? কন্সপিরেসি তো কম জানিস না। বাপের বংশ বাদ দিয়ে নানার বংশের রীতি ধরলে এমনই হওয়ার কথা। তোদের নানার বংশে আমাদের মতো খাঁটি লোক দেখা তো একটা? এমন শুদ্ধ বংশ আর পাবি কোথাউ? তোদের আসলে রুচির সিস্টেম ভালো না। তোর বোন ধরেছে গরু বেপারী আর তুই ধরবি ছাগল বেপারী। দুই বোন মিলে হাম্বা হাম্বা, ভ্যা ভ্যা ছাড়া উপায় নাই। আমাদের মতো ক্লাসিদেরকে তো আর ভাল্লাগবে না। অবশ্য, দেশের প্রোডাক্টিভিটিতে তোদের অবদান কিছুটা বাড়বে।”
নিরার এবার সত্যি ইচ্ছে করছে গড়াগড়ি করে কাঁদতে। লোকটা ওকে এক রত্তিও স্বস্তি দিচ্ছেনা। জন্ম থেকে জ্বালিয়ে মারছে শয়তানটা!
“আমি গরু বেপারী না, দরকার হয় গরু চোরকে বিয়ে করবো, তা-ও তোমাকে না। ”
“হাহ্, যার টেস্ট যেমন।”
দরজার ধুপধাপ আওয়াজ হচ্ছে। মা ডাকছে নিরাকে,
“নিরা, তাড়াতাড়ি বের হ মা। কাজী সাহেব এসে পড়েছে, বাবু। তোর আব্বু রেগে যাচ্ছে। বের হ জলদি।”
নিরা দাঁত দিয়ে নোখ খুঁটতে খুঁটতে ঠোঁট উল্টে মৃদু শব্দ করে গোঙ্গালো।
“নাবিল ভাইইইই!”
নাবিলের হাসি ঠেকায় কে। উদভ্রান্তের মতো গা দুলিয়ে পৈশাচিক হাসলো ছেলেটা। সে কী বিশ্ব জয় করা হাসি!
“এহহে রেএএএএএ! নিরুপমার ডাক পড়েছে। যা নিরু, যা, জি লে আপনি সাসুরাল। তোর ফুপ্পি ওরফে আমার একমাত্র আম্মা তোকে বরন করার জন্য প্রস্তুত। যাও বউ। বলবো কথা বাসর ঘরে।”
—–
সিকদার বাড়িতে ইতিমধ্যে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেছে। বর-বউ উভয়ই নাকি একইসঙ্গে উধাও। অবাক কান্ড! পালাতে হয় একজন পালাবে, দু’জন কেন? বিরল ঘটনা। রিমির মতে এসব ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। মানবজাতি বিয়ে থেকে পালানো ইতিহাসের ভিন্নরকম দৃষ্টান্ত দেখতে পাবে।
রাহেলা বেগম ভাইয়ের শিউরে বসে আছেন। ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত না হওয়া অব্দি কোনোকিছুই বলা যাচ্ছে না। ছেলেটা তার এমন কান্ড করে বসবে কে জানতো? বিয়ে করবি না তা আগে জানালে কী হতো? খামোখা লোক হাসানো তামাশা।
আমিনা বেগম চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন খাটের এক কোনে৷ মেয়ে দু’টোকে এতো দেখেশুনে, কঠোর পরিবেশে বড় করার এই ফল দিলো? কীসের অভাব ছিল এদের? একটা বার বাপটার দিকে চাইলো না?
রিমি কোথা থেকে উড়ে এলো কে জানে। হাতে একটা সাদা কাগজের চিঠি৷ রাহেলা বেগমের সম্মুখে ধরে বললো,
“নিরাপুর রুম থেকে পেয়েছি।”
শোকসভায় পরিনত হওয়া নিস্তব্ধ বাড়িটা জেগে উঠার মতো একটা কারণ পেলো এবার। যারা বসেছিল ওরা উঠে দাঁড়ালো। আর দাঁড়ানো লোকগুলো আরও কাছে এলো। চোখে-মুখে তীব্র কৌতুহল। মুহূর্তটাকে বাংলা সিনেমার ক্লাইমেক্সও বলা যায়। শুধু অভাব একটা ধুম তা-না-না ধরণের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের। সেই কাজটা অবশ্য নিরার মামি-খালারা করে দিবেন। কুটনামিতে এদের ভালো সুনাম আছে। মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি টাইপ হা-হুতাশে এরা পিএইচডি প্রাপ্ত।
চিঠির খবর পেয়ে বড়ঘরে ছুটে এলো সকলে। চেয়ে রইলো অধির আগ্রহ নিয়ে। ডাকপিয়ন রিমি মেলে ধরলো চিঠি। সকলের অপেক্ষার অবসান এই বুঝি ঘটল। কখন পড়বে চিঠি? কী আছে এতে? চিঠিটা কি সকলের উদ্বিগ্নতা কমাতে সক্ষম হবে, নাকি নতুন করে মাথায় হাত দিয়ে চক্কর খাওয়ার মতো কোনো বিষয়? রহস্য রহস্য রহস্য!
চলবে।