#রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ৩
#নাজমুন_নাহার
জয়নাল সিকদারের বাড়িটা কয়েক’টা বড় বড় অট্টালিকার মাঝখানে ঠাই পেয়েছে। শহরের দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু দালানগুলো নিরাদের একতলা বাড়িটার ছাঁদ থেকে দেখতে দানবের মতো লাগে। যেনো সুবিশালদেহী কোনো রাক্ষসের দল ঘিরে ধরেছে ছোট্ট একটা শরীরকে। তবে গেইটের ভেতরের চিত্র ভিন্ন। শৌখিনতা ফুটে উঠে নগরের অবহেলিত এই বাড়িটায়। নিরাদের বাড়ির গেইট পেরোলেই নজরে আসে আটপৌরে শৌখিনতা। কৃত্রিম শহরে এক টুকরো নব্বইদশক যাকে বলে। বিভিন্ন রকম ফুল-ফল গাছে ভরপুর বাড়ির সামনের দিকটা। নিরার দাদার আমলের বাড়ি এটা। বাড়ির উত্তর দিকে গেইট। গেইট পেরিয়েই বাড়ির বড় কাঠের দরজা। পশ্চিমে খালি জায়গা আর পূর্বদিকে ছাউবনের মতো বেড়ে উঠা গাছগাছালি। বারোমাস যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা আশ্রয় নেয়। মাঝেমধ্যে সেখান থেকে আবার অল্পবিস্তর চাঁদের দেখা মেলে। উঁকি মারে অসংখ্য ঝলমলে তাঁরা’রা ৷ পূর্বে আবার একটা টিনের চালার ঘরও আছে। শখ করে করেছেন জয়নাল সিকদার ঘরটা। বৃষ্টি হলেই যেখানে নিরা-মিরা, দুই বোন রাতে ঘুমানোর পায়তারা করে। টিনের চালে রিমঝিম বৃষ্টির আওয়াজে ওদের বড্ড নেশা হয়৷ রাতভোর গল্প করতে করতেই কেটে যায়। বৃষ্টি ঝরে মুক্তর দানার মতো। সেখানে শেষ রাতে মায়ের নকশা করা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ওরা।
তবে আজ সেই শৌখিন মেয়ে দু’টি বাড়িতে নেই। সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ানো নিরা-মিরা আজ ভীষণ বড় হয়ে গিয়েছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নেওয়ার মতো বড়৷ এতোটাও বড় বোধহয় হতে দিতে চাননি জয়নাল সিকদার ওদের!
চিরকুটটা নিঃশব্দে পড়ে শেষ করলেন জয়নাল সিকদার। মুখভঙ্গি স্বভাবসুলভ স্বাভাবিক এবং গম্ভীর। পড়া শেষ হলে চিরকুটটা খুব ঠান্ডা মাথায় কুটিকুটি করে ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলেন। বুক চিরে তীব্র ক্ষোভ উগলে আসতে চাইলেও মুখে তা প্রকাশ করলেন না। বোনের দিকে একপলক শান্ত অথচ শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে পরক্ষণেই চোখের চশমা টা খুলে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। আমিনা অসহায় চোখে চাইলেন। বুঝতে পারছেন না স্বামীর প্রতিক্রিয়া। স্বামীর আগে চিঠিটা তার ননদই পড়েছে৷ তা-ই উত্তরের আশায় আরেকবার ননদের পানে চাইলেন। রাহেলা চোখের ইশারায় আস্বস্ত করলো ভাবীকে।
“একটা ফোন করুন-না আপা। এই রাত-বিরেতে কোথায় গেলো দুটোতে!”
“চিন্তা করবেন না, ভাবী। নাবিল আছে তো সাথে, কিচ্ছু হবে না। ঠিকি কোনো একটা ব্যবস্থা করে নিবে। আর এমনিতেই বাদরটা এখন ফোন ধরবো না। ভয়ে আছে ভাইজানকে নিয়ে।”
আমিনা হতাশ মুখে চাইলেন। শূন্য চেয়ে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“আমাকেই বলতে পারতো মেয়েটা। আমি কি চেষ্টা করতাম না ওর বাবাকে বোঝানোর? নাবিলটাও কিচ্ছুটি বললো না। বাড়ি ভর্তি কেবল নিজের লোক ছিল বলে বাঁচা গিয়েছে। লোক জানিয়ে বিয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে কী হতো বলুন তো? বাচ্চাগুলো যদি এমন করে তাহলে ওদের চিন্তায় তো বোধহয় আমরা এই বয়সেই মরে যাবো আপা।”
রাহেলা স্বভাবসুলভ সহজ ভঙ্গিতে হাসলো। চেহারায় বরাবরের মতোই এতোটুকুও গাম্ভীর্যতা কিংবা চিন্তার ছাপ নেই। বরাবরই রাহেলা ভীষণ বিনয়ী আর ঠান্ডা মেজাজের। মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়া ব্যাপারগুলো যেনো তারই বৈশিষ্ট্য। ছেলের মা হিসেবে উদ্বিগ্ন হওয়ার বদলে উল্টো বেশ দায়িত্ব নিয়ে ভাই-ভাবীকে একাই সামলাচ্ছে।
“এতো চিন্তা কেন করছেন, ভাবী? এসব আজকাল স্বাভাবিক ব্যাপার। ভুলটা বোধহয় আমাদেরই হয়েছে। ওদের উপর একটু বেশিই চাপ দিয়ে ফেলেছি সম্ভবত। চিন্তা করবেন না। ভাইজানকে আমি বুঝিয়ে বলবো। এমন কিছুই ঘটেনি যার জন্য নিরার আর বিয়েই হবে না। আমার ছেলের সঙ্গে না হলে অন্য কারো সাথে হবে। ও পড়তে চাইছে,পড়ুক। ওকে বাঁধা দিবেন না, ভাবী। নিরাকে আমি চিনি। ও শুধু বাইরে থেকে দেখতেই বদমেজাজি। ভেতর থেকে আমাদের নিরুটা একদম তুলোর মতো নরম। ঠিকি কথা শুনবে,দেখবেন। তাছাড়া এই মাসেই তো নিলয় দেশে ফিরছে। ঠিকি দু’টোকে ধরে সোজা করে ফেলবে। আমার ঘাড়ত্যাড়া, বদমেজাজি নাবিলটাও যে এই এক নিলয়ের কথাই শুনে,মানে। নিলয়টা এলেই সব ঠিক করে ফেলবে দেখবেন। খাদিজা আপার ছোট ছেলেটা নাবিলের কাছে গুরু সমতুল্য। ”
হেসে ফেললো রাহেলা। হাসলো আমিনাও।ননদের কথায় বোধহয় মৃদু আস্বস্ত হলো আমিনা। হবে না-ই বা কেন? দোষটা তো তার নিজের মেয়ের। নাবিলটাকে দিয়ে এই অকাজ নিরুই করিয়েছে। রাহেলা আপার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেতো। তার ননদটা সহজ-সরল বলে এখোনও মুখে কুলুপ এঁটে ভাই-ভাবীকেই মানিয়ে যাচ্ছে। আপা অবশ্য মন্দ বলেনি। খাদিজা আপার ছেলেটাকে নিয়ে ভালো কিছুই আশা করা যায়। নিলয়কে নিয়ে তার স্বামীরও বিশ্বাস আছে।
“আপনাদের আস্কারাতেই মেয়েটা দিন দিন আরও অবাধ্য হচ্ছে, আপা। এতো লায় দেবেন না ওকে।”
শব্দ করে হাসলো রাহেলা। বুঝলো ভাবীর মাথা থেকে চিন্তার ভুত নেমেছে।
“নিরা যে আমারও মেয়ে, ভাবী৷ তিন বছর আমার বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছে। আমার মেয়ে না থাকার শূন্যতা পূর্ণ করেছে। একটু মায়া তো লাগবেই।”
নিরার বাপেরা তিন ভাই-বোন। নিরার বাবা, জয়নাল সিকদার পরিবারের বড় সন্তান। তারপর বড় ফুপ্পি খাদিজা। নাবিলের মা, রাহেলা, নিরার ছোট ফুপু। বড় ফুপু খাদিজার দুই ছেলে, নিলয়-নেহাল আর বড় মেয়ে আয়শা৷ নাবিল ওর বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। নাবিলের জন্মের পরপরই জসিম এহসান জীবিকার তাগিদে ফ্রান্সে পারি জমান। যার কারণে মেয়ের জন্য এতো আকাঙ্ক্ষা থাকার সত্ত্বেও আর কোনো বাচ্চা নিতে পারেনি রাহেলা। দ্বিতীয় কোনো সন্তান না থাকার কারণে নাবিলকে বাবা-মায়ের অতি আদরের পুত্রও বলা চলে। নানার গোষ্ঠী- দাদার গোষ্ঠী, সব খানেই তার কদর ভালো। কাজিন সমাজের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চলতা ওর মধ্যেই। সম্পর্কে খালাতো দু’ভাই হলেও নাবিল-নিলয়ের চেহারায় ভীষণ মিল। এদের খাতিরও ভালো ছোট থেকে।দেখতে অনেকটা পাকিস্তানি নাটক-সিনেমার তারকাদের মতো। ওদের ফর্সা সুপুরুষ চেহারায় চাপ দাঁড়িতে কেমন অদ্ভুত মানানসই লাগে। পাশাপাশি দু’জন হাঁটলে টাশকি খেয়ে চেয়ে থাকে লোকজন। তবে চলন-বলনে দু’জনকে আলাদা করা বেশ সহজ। নাবিলের আচরণে সবসময়ই পাখির চঞ্চলতা। রয়ে সয়ে চলার মানুষ নয় সে। অন্যদিকে নিলয় তার একেবারেই বিপরীত। ছোট থেকেই অসম্ভব শান্ত মেজাজের সে। এ ধরণের লোকদের সিদ্ধান্তের কদর ভালো। সবখানে সুবুদ্ধিতার সাথে চলার ক্ষমতা থাকার দরুন পারিবারিক যেকোনো বিষয়ে আলাপচারিতার আগে সকলে নেহালের আগে নিলয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
এদিকে জয়নাল সিকদারের সর্বদা শান্ত, লাজুক ধরনের আদরের বড় মেয়ে মিরা। বিশ্বস্ত কন্যাই যখন হুট করেই কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলো, জয়নাল সিকদারের জন্য এর চেয়ে বড় ধাক্কা অন্যটি ছিল না। প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পূর্ন মানুষটা বড় মেয়ের রেশ ধরে এলাকাবাসীর থেকে কতো কটুক্তির সম্মুখীন হলো। মানুষের বাঁকা চোখ তাকে ক্ষণে ক্ষণে লজ্জিত করে। বড়টার এমন অধঃপতন জয়নাল সিকদারকে আরও সতর্ক করে তুললো। আদর্শ উপাধি পাওয়া মিরাটাই যদি এমন করে বসে তো নিরুটাকে নিয়ে আর কী-ই বা আশা করা যায়? ছোটটাকে নিয়ে আর ঝুঁকি নেওয়া চলবে না। যার কারণেই এমন তাড়াহুড়ো করে ছোটটাকে বিদায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ছোট বোন রাহেলা জয়নালের অতি আদরের বোন। মায়ের মৃত্যু আর খাদিজার বিয়ের পর এই এক রাহেলাই ছোট বোন হওয়ার সত্বেও বড় ভাইকে মা’য়ের মতো যত্ন করেছে। ছোট্ট ছোট্ট হাতদুটোই আগলে নিয়েছে অসহায় বাপ-ভাইকে। জয়নাল তখন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র। রাহেলা কেবলই ক্লাস সিক্সে পড়তো। বড় বোনের বিয়ের পর কেমন করে যেনো ছোট্ট কিশোরী মেয়েটার কাঁধে দায়িত্ব বেড়ে গেলে। ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে বাবা আর একমাত্র বড় ভাইয়ের কাপড় ধোঁয়া থেকে শুরু করে সবই করতো মেয়েটা। সেসব দেখতে দেখতে আদরের ছোট বোনটার প্রতি কবে যে এতো মায়া বেড়ে গেলো, জয়নাল জানে না। কেবল জানে, ওর দিকে তাকালে মা’য়ের কথা খুব মনে পড়ে। ওর মুখে মা’য়ের চেহারার খুব মিল। মা’র মতো করেই শাসন করতো তার ছোট্ট বোনটা। রাতে দেরিতে ফিরলে না খেয়ে মুখ ফুলিয়ে খাবার টেবিলে বসে থাকতো। ভাইজান না এলে সে কিছুতেই খাবে না। ভাইজান কেন রাতে বাইরে থাকবে? সে কী জানেনা, ঘরে তার ছোট্ট বোনটা তার জন্য চিন্তা করে? রাহেলা যে সে না এলে খায়ই না তা-ও কি জানে না ভাইজান?
একবার রাস্তা পাড়াপাড় করতে গিয়ে প্রাইভেট কারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারাত্মক আহত হয় জয়নাল। দু’দিন হসপিটালাইজড থাকতে হয়েছে। রাহেলা সেবা’র খুব কেঁদেছিল ভাইয়ের জন্য। অসুস্থ ভাইয়ের সেবা করেছে দিন-রাত। বাবাকে ঠোঁট উল্টে বার-বার জিজ্ঞেস করেছে, “ভাইজান কবে বাড়ি ফিরবে, বাবা? ভাইজানের খুব কষ্ট হচ্ছে না? এবার সুস্থ হলে তুমি ভাইজানকে খুব বকবে। আর বাহিরে যেতে দিবে না। আমার একটুও ভালো লাগছেনা,বাবা।”
সুস্থ হয়ে সেসব শুনে খুব হেসেছিল জয়নাল। রাহেলার বিয়ের পর গর্ভে যখন নাবিল এলো, সে কী খুশি জয়নালের। হাসপাতালে গিয়ে ভাগ্নের মুখটা দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গিয়েছিল। নাবিলটা দেখতে অবিকল রাহেলার মতো হয়েছে। চোখ-নাক-মুখ একদম মা’য়ের মতো আকর্ষণীয়। এইটুকুনি বাচ্চার চেহারায় কী যে মায়া দেখেছিল সেদিন। ওকে কোলে নিয়েই জয়নাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, তার একটা কন্যা সন্তান হলে তার সঙ্গে রাহেলার এই ছেলেটার সাথে বিয়ে দিয়ে বোনটার রিন আজন্মের জন্য চুকিয়ে দেবে। মিরাটাকে সে-ই আদর্শেই বড় করে তুলেছিল। তার বোনের সকল দুঃখ চুকাবার জন্য একটা মেয়ে যে চাই। জসিম সারাজীবন বিদেশের মাটিতে জীবন কাটিয়ে গেলো, ফলে সংসার, সন্তান সবকিছু রাহেলাকে একাই সামলাতে হয়েছে। মিরাকে রাহেলার ঢাল হয়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু মিরাটা সে-ই আশায় জল ঢেলে কোথাকার কোন প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে। জয়নাল সিকদারের এতো বছরের করা পরিকল্পনাকে এভাবে বুড়ু আঙুল দেখাতে পারলো মেয়েটা?
ছোট মেয়েটাও যেনো একই ভুল করে না বসে সেই আশাতেই এই মনে মনে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া। তাছাড়া নিরুর মতো করে রাহেলাকে কেউ বুঝবে না। রাহেলাও নিরুটাকে কতো ভালোবাসে। ব্যাস, আগে-পরে কোনোকিছু না ভেবে বোনজামাইকে ফোন করে প্রস্তাবটা দিয়ে দিলো। জসিম আগে থেকেই বন্ধুর দুই মেয়ে, নিরা-মিরাকে খুব স্নেহ করতেন। তাছাড়া তার স্ত্রীকে যে মানুষটা এতো ভালোবাসে সে-ই ভাইয়ের কথা কী করে ফেলতে পারে জসিম?
বড়রা মিলে সিদ্ধান্ত নিলো, পারিবারিকভাবে অন্তত কাবিনটা হয়ে থাকুক। পরে নাহয় বড় করে অনুষ্ঠান করে তুলে নিবে। কিন্তু কী হলো শেষমেশ?
—–
পূর্নিমার রাত। ঝলমলে চাঁদের শুভ্র আলো ছুঁয়েছে পৃথিবীর বুক। আকাশেও অসংখ্য তাঁরাদেরও মেলা বসেছে আজ। কোথাউ আবার দলবদ্ধ জোনাক পোকাদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। যেনো আশ্চর্য কাব্যিক ঢঙ্গে ওরা উৎসব করছে তামান আকাশ জুড়ে। কী বিরল দৃশ্য!
বাইক চলছে কুমিল্লা চান্দিনার পথে। নাবিল বাইকের গতি ধীর করলো। ফ্রন্ট মিররে নিরার গম্ভীর মুখখানায় একপলক চেয়ে নিঃশব্দে হাসলো। মালিবাগ থেকে মেঘনা ব্রিজ অব্দি এতোটুকু পথও জমলো না দু’জনের। কঠিন ঝগড়া বাঁধিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে রইলো নিরা। শুরুটা অবশ্য প্রতিবারের মতো নাবিলই করে। নিরাটাকে রাগাতে ওর বড্ড ভালো লাগে। সার্কাস দেখার মতো করে উপভোগ করে নিরার চিরতার মতো তেতো কথাগুলো। রাগলে যা লাগে না ওকে!
নিরা সিদ্ধান্ত নিলো, এ-ই স্টুপিড নাবিল ভাইটার সাথে সে বোম মারলেও আর কথা বলবে না। না মানে না-ই। বাবা কী মনে করে এমন একটা অভদ্র, অসভ্য, অসহ্যকর পাত্র নিজের মেয়ের জন্য বেছে নিয়েছিল, কে জানে! এটাকে তো নিরা এক মিনিটের জন্যেও সহ্য করতে পারে না, স্বামী তো দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না।
নাবিল গুনগুন করলো। বোরিং লাগছে তার। কিছু একটা দরকার। পরক্ষণেই পূনরায় বাইকের গতি বাড়িয়ে গলা ছেড়ে গান ধরলো,
“ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শুনে না
যার তার লগে ডেটিং মারে আমায় চেনে না…..”
ফ্রন্ট মিররে দু’জনে দু’জনের দিকে চাইলো। নিরার ভাব বুঝতেই নাবিল সংশোধন করার ভঙ্গিতে বললো,
“পছন্দ হচ্ছে না? ওকে ওকে, লেটস চেঞ্জ ইট।”
পরক্ষণেই গাইলো,
“আকাশে তে লক্ষ তাঁরা
চাঁদ কিন্তু একটা রেইইই ইয়ায়ায়ায়া..
এই জগতে পরান বন্ধু প্রিয় তোমার মুখটা
রে ইয়ায়ায়া…”
নিরা দুম করে কিল বসিয়ে দিল পিঠে। আকস্মিক ব্রেক কষলো নাবিল।
“জন্ম থেইক্ক্যা জ্বালাইতেসোস, ভাই। সমস্যাটা কী তোর? মুখ আমার, এবলা-ভ্যাবলা যা ইচ্ছা তা গাইবো। তোর বাপের কী?”
নিরা জবাবে কেবল ফোঁসফোঁস করতে করতে চাইলো৷ আঙুলের তর্জনি মুখে রেখে চুপচাপ বাইক চালাতে ইশারা করলো। নাবিল ভ্রু বাঁকিয়ে চেয়ে রইলো। পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি মেয়েটা!
“হাত দিয়ে কী ইশারা করছিস রে, প্রতিবন্ধী? মুখ না-ই?”
নিরা তেতে উঠলো।
“মুখ আছে। তবে আমার অতি মূল্যবান মুখের একটা শব্দও তোমার জন্য খরচ করা বেকার মনে করছি। গান গাইতে কে বারণ করলো? দরকার হয় এখানেই স্টেজ বানিয়ে মাইক ধরো,হু কেয়ারস? কিন্তু আমার মাথা খেয়ো না দয়া করে। বেশি চাপলে বাইক থেকে নেমে পাবলিক টয়লেটে গিয়ে গান সেরে আসো।”
নাবিল অবাক চোখে চাইলো। হেলমেট খুলে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“টয়লেটে গান সারতে যাবো? প্রাকৃতিক কাজের বদলে গান সারার অপশন-টপশন এড হয়েছে নাকি?”
নিরা ম্যাকি হাসলো।
“অনলি ফর বাথরুম সিঙ্গার্স। লাইক ইউ।”
নাবিল রাগলো না। বরং যথেষ্ট নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাসল। “উহহহু! ভালো উদ্যোগ তো।”
কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো মেয়েটার মুখটা। “নাবিল ভাই, আই এম সিরিয়াসলি ফেড-আপ উইথ ইউ।”
“তো আমি করবো? তুই ফেড-আপ, সেবেনআপ যা মনচায় হয়ে থাক। আচ্ছা, একটা কাজের কথা শোন।”
নিরা প্রতুত্তর না করে কপালে হাত ঠেকিয়ে চেয়ে রইলো।
“ধর, আমরা ক’দিন পর বাড়িতে গেলাম৷ আমি, এজ আ আম্মুর সোনার টুকরো ছেলে, আমাকে তো কেউ কিছু বলার সাহস পাবে না। কিন্তু তোর কী হবে? তুই কই পালাবি? মামার যা রাগ! তোর বাপ যদি রেগেমেগে তোকে আরেক পিস মদন ধরে বিয়ে দিয়ে দেয় তখন? আবার কার হাত ধরে ভাগবি?এগেইন আমার?”
“আব্বু যদি আমার সাথে রাস্তার পাগল ধরে এনেও বিয়ে দিতে চায়, আমি চোখ বন্ধ করে কবুল করে নেবো। একটা আস্ত জনম হাসতে হাসতে পাগলের বউ হিসেবে পাড় করে দিবো নির্দ্বিধায়। আমাদের বাচ্চা-কাচ্চারাও আমার মতো আউলা-ঝাউলা কিসিমের বৈশিষ্ট্য পাবে। স্বামী,সংসার নিয়ে পাবনায় সুখেই বসবাস শুরু করবো দরকার হয়। পৃথিবীতে পাগলকে বিয়ে করে ভালোবাসার একটা দৃষ্টান্ত ইতিহাস রেখে যাব। হয়েছে শান্তি?”
নাবিল চোখ বড় বড় করে চাইলো।
” আমার উপর রাগ দেখিয়ে এভাবে নিজেকে কুরবান করে দিবি,নিরু? ভেরি আনফেয়ার!”
নিরা জবাব দেয় না। নাবিল আরচোখে ওর বেলুনের মতো ফুলে থাকা মুখের দিকে চেয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলল,
“অবশ্য কুরবানটা তোর না, হবে তোর জামাই বেচারার। এরকম ব্রিটিশ মরিচ সহ্য করা কি আর চারটিখানি কথা? নেহাত বেচারা আগে থেকেই পাগল, তাই নিজের ভালো-মন্দ না বুঝেই ভেটকিমাছের মতো ভেটকি মেরে মেনে নিবে সব।”
“পৃথিবীর তামান পুরুষজাতির সর্বনাশ কেবল আমি নিরার জন্য হবে? আমাকে কেউ সহ্য করতে পারবে না? আমার সম্মুখে থাকলে বেচারা আর আমি একা খলনায়িকা?”
“তো নয়তো কী? তোর মুখের এক একটা কথার যা ঝাঁঝ ভাই! সরিষা ভর্তার ঝাঁঝও ফেইল। আমারই তো ভয়ে আত্মা কাঁপা-কাঁপি অবস্থা।”
“তো চুপ থাকো না। কেন যেচে কথা বাড়াও? জোর করেছি? নাকি তোমার শ্রুতিমধুর কন্ঠনালির শব্দগুচ্ছ না শুনতে পেলে মরে যাচ্ছি?”
“অফকোর্স। মরেই তো যাচ্ছিস। না মরলে খপ করে আমার কথার যুক্তি কেন ভাঙাতে আসিস? তোর রগে রগে আমাকে নিয়ে আগ্রহ।”
নিরা হতাশ শ্বাস ফেলে,” রক্ষা করো মাবুদ!”
“রক্ষা করবে মানে? তুই বোঝাতে চাচ্ছিস আমার সঙ্গে থেকে তোর বিপদ বাড়ছে? চরম আতঙ্কে আছিস? ভয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারানোর মতো সিচুয়েশন? মার্ডার করবো?”
নিরা হতাশ শ্বাস ফেললো।
“নাবিল ভাই,আল্লাহ’র দোহায় লাগে মুখটা বন্ধ করো! আমার সহ্যক্ষমতা ছাড়িয়ে গেলো আস্ত রাখবো না তোমায়। নিজেকে চার্লি চ্যাপলিন মনে হয়? রসে টইটম্বুর হয়ে রসমালাই হয়ে গিয়েছো? আমার যদি আর একবার তোমার জন্য মেজাজ খারাপ করতে হয়, আমি সত্যি চলন্ত বাইক থেকে লাফ দিবো, আই স্যয়ার।”
নাবিল ঠোঁট কামড়ে গা দুলিয়ে হাসলো৷ আজকের জন্য এইটুকুই থাক। বেচারি আর কতোই-বা চোপা করবে? শব্দভান্ডার ফুরিয়ে যায় না? সবাই কী আর নাবিলের মতো বিশ্ব অভিধানে টইটম্বুর আর মহাজ্ঞানী বিতর্ক দল?
রাতের শেষ সময়
চলতি বাইকের নরম হাওয়ায় নিরার ফর্সা চোখের পাপড়িগুলো আপনাআপনি বুঝে আসছে৷ আশপাশটা পুরোপুরি অন্ধকার। মুখের নেকাপটা খুলে পৃথিবীর সবটুকু শীতলতা এই এক ছোট্ট মুখে শুষে নিলো নিরা। হেলমেটের ফাঁক দিয়ে ফ্রন্ট মিররে সেদিকে চেয়ে ভেতরে ভেতরে অল্পস্বল্প হাসলো নাবিল। রাতের আকাশ, চাঁদ, বাতাস, বৃষ্টি, এসব পেলে নিরা এমনই করে। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে ওড়না উড়িয়ে দৌড়ে বেড়ানো, ওয়েস্টার্নের বদলে সুতির থ্রি-পিস, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজির চেয়ে পরিবারের লোকজনদের সাথে সময় কাটানো আর একটা দীর্ঘ মেঘলা দিনে নির্বিঘ্নে জানালার ধারে কাটিয়ে দেওয়া, এই সবকিছুতেই নিরা বেঁচে থাকা, আরামে থাকা খুঁজে নেয়। নিরাটা বড্ড সেকেলে। বয়সে আঠারোর কোটা ছাড়ালেও মনটা যেনো ওর সবে ষোলোয় পদার্পণ করা দূরন্ত কিশোরী৷ বড্ড কাল্পনিক ওর কামনা-বাসনাগুলো!
“নাবিল ভাই!”
“হু।”
“আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।”
আর কোনো রসিকতা নয়। ওর ক্লান্ত মুখটায় চেয়ে ভীষণ মায়া হলো। দৃষ্টি সরিয়ে কোমল কন্ঠে নাবিল বলল,
“আমার কাঁধে মাথা রাখতে পারিস চাইলে।”
পুরুষালী শরীরে পাছে অযাচিত স্পর্শ না লেগে যায় সে-ই ভেবে হাতের ছোট্ট ব্যাগটা নাবিলের কাঁধে রেখে খানিক দূরত্ব মেপে মাথাটা রাখলো। ওর সচেতনতা খেয়াল করে একরাশ ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো নাবিলের মনটা! বাইকের গতি আরো ধীর করলো নাবিল। জ্যোৎস্নার ঝলমলে আলো গায়ে মেখে ছুটলো অজানা, অনাকাঙ্ক্ষিত অন্তিমের পথে!
চলবে।