গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ৬
#নাজমুন_নাহার
“ম্যা আই কাম ইন?”
নিরা চুল বাঁধছিল আনমনে। কারো ডাকে দরজার দিকে ফিরে তাকালো। আগন্তুককে এই প্রথম সামনাসামনি দেখলেও চিনতে এতোটুকুও কষ্ট হলো না নিরার। বর্ষা!
বর্ষা এক গাল হেসে প্রতুত্তরের আশায় চেয়ে রইলো। কী সুন্দর মেয়েটা! নিরা বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো। ফুপ্পির ফোনে তার তার ছবি দেখেছে নিরা। কিন্তু ছবির চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে এখন। এক দেখায় চোখ আঁটকে পড়ার মতো মায়াবী! ঠোঁটের স্মিত হাসি উজ্জ্বল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে। জ্বলজ্বল করছে চোখের কোটর।
নিরা ফটাফট বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ভদ্রতাসূচক হেসে বলল,
“তোমারই তো বাড়ি,আসো।”
বর্ষা ঘরে ঢুকে মুখের হাসি বহমান রেখে হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালো।
“হ্যালো, আমি বর্ষা।”
নিরাও হেসে হাত বাড়ায়।
“আমি নিরা। তোমাকে বোধহয় আমি আগে থেকেই চিনি। ফুপ্পির ফোনে দেখেছি তোমার ছবি। ভীষণ মিষ্টি তুমি। ছবির চেয়েও বেশি সুন্দর।”
বর্ষা কিছুটা লজ্জা পেলো। অস্বস্তিতেও পড়ল। তাৎক্ষণিক কথা ঘুরানোর ভঙ্গিতে বলে,
“তুমি গতকাল গেস্টরুমে ঘুমিয়েছিলে?”
নিরা মাথা উপরনিচ করে।
“হ্যা। তবে আমার কোনো সমস্যা হয়নি।”
“সে কী! আমাকে ডাকলেই তো পারতো বড়মা। অচেনা জায়গায় এসে একা ঘুমাতে নিশ্চয়ই ভয় লেগেছে তোমার?”
“ভয় না ঠিক,কিছুটা অস্বস্তি তো লেগেছে। তবে ভয় বলা যায় না।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে দু’জন। কথা বাড়াতে বর্ষাই বলে,
“আমরা কিন্তু চাইলে আরও ফ্রাংক হতে পারি। আই মিন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি লজ্জা পাচ্ছো। উই আর রিলেটিভস। তুমি তোমার ফুপ্পির বাড়িতেই আছো বলা যায়। সো ডোন্ট বি হেজিটেট।”
নিরা মাথা উপরনিচ করে, সাথে বর্ষার মনখোলা স্বভাব দেখে মুগ্ধ হয়।
“বাড়িতে কে কে থাকে?”
“দাদাভাই, বড়আম্মু-বড়আব্বু, সাগর, আমি, আর দু’জন কাজের বুয়া।”
নিরা অবাক হয়।
“এতো বড় বাড়িতে কেবল এই ক’জন থাকো?”
বর্ষা হাসে।
“কম কোথায়? বাড়িতে থাকে না বলে বোঝা যায় না। নাবিল ভাইয়ারা আর আব্বু-আম্মু থাকলে পরিবারের ষোলকলা পূর্ণ হতো। অবশ্য দাদি থাকতে বাড়িটা আরও গরম ছিল। দাদি বেঁচে থাকলে হয়তো আজকের দিনটায় বাড়িটা এতো ফাঁকা মনে হতো না।”
বর্ষা আবেগাপ্লুত হয়। নিরা তা বুঝে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
“আচ্ছা, বাড়ির ছাঁদটা কোন দিকে? আসলে বাসায় বসে থাকতে সারাক্ষণ একটু বেশি একঘেয়ে লাগছে। আমি আবার একটু আধটু আকাশ না দেখতে পেলে ঠিকমতো শ্বাসটাও নিতে পারি না।”
বলেই হাসে নিরা, বর্ষাও হাসলো শব্দ করে। কী ভেবে বর্ষা সহসাই উঠে দাঁড়িয়ে নিরার হাত ধরে টানতে টানতে বলে,
“এসো, আমার ঘরে থাকবে যতদিন আছো। ছাঁদে আমি নিয়ে যাবো তোমায়। যতদিন আছো, আমার সঙ্গে ঘুরবে। আমার ভার্সিটিতে আগামীকাল একটা প্রোগ্রাম আছে, তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো। আপাতত চলো প্ল্যান করি
।কোনো কিন্তু, না, ইয়ে-মানে চলবে না। আমার ভাইব ভালো। একটু মিশেই দেখো, আর যেতে ইচ্ছে করবে না। রাতে একটা ফাটাফাটি মুভি দেখবো, জমপেশ গল্প হবে সারারাত। আমার সঙ্গে থাকলে একটুও বোরিং লাগবে না, প্রমিস।”
বর্ষার সহজ আবদার। নিরা চেয়ে রইলো মেয়েটার পানে। অসম্ভব মায়াবী মুখটা! বর্ষাকে এক দেখার পর কেউ কোনো ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবে না। এড়িয়ে যাওয়ার ফুরসতই নেই। জলজ্যান্ত পুতুল মেয়েটা। সৃষ্টিকর্তার নিপুণ হাতের নিখুঁত সৃষ্টি যাকে বলে। নিরা খেয়াল করলো, বর্ষা কথা বলার সময় ওর বাম গালে টোল পড়ে। হাসলে সেটা অদ্ভুত সুন্দর দেখায়!
আকাশে মেঘ করেছে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রাতে সম্ভবত গগন কাঁপিয়ে বর্ষণ শুরু হবে। বর্ষার বেলকনীটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বড়। দু’টো সিঙ্গেল কাঠের দোলনা দুলছে সেখানে। ওরা দুটোতে বসলো। হাতে সদ্য বানানো ধোঁয়া উঠা চা। দৃষ্টি অন্ধকার আকাশের পানে দু’জনের।
“বৃষ্টি পছন্দ?”
নিরা দৃষ্টি অনড় রেখে জবাব দিলো। ঠোঁটে অদ্ভুত সুন্দর হাসি। প্রিয় কিছু নিয়ে তীব্র ভালোলাগা কিংবা অনুভুতি প্রকাশের সময় যেমনটা হয়।
“অনেক পছন্দ! আমি বর্ষাকালকে তা-ই সকল ঋতুর শ্রেষ্ঠ ঋতু মানি।”
“আমারও ভীষণ পছন্দ। তবে একটা ব্যাপার কী জানো নিরা,..”
নিরা উত্তরের আশায় চেয়ে রয়।
“মানুষ বোধহয় তার জীবনের ভালো কোনো মুহূর্তে, ভালো দিনে, ভালো আবহাওয়া কাছের মানুষদের আরও কাছে চায়। যারা পায়, তাদের জন্য সেটার আনন্দ দ্বিগুণ। না পেলে দুঃখ বাড়ে। ভালো দিনে প্রিয় মানুষদের কাছে না থাকা মানে সুখটা দুঃখে পরিনত হওয়া। আমারও তা-ই হয়। মাঝেমধ্যে ম্যাজিক করে এসব দিনে কাছের মানুষদের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে হয়। একটা গোটা বর্ষার রাত কেটে যাবে প্রিয় কারো সাথে বৃষ্টিবিলাস করতে করতে। অথচ, আমার এসব ইচ্ছের কথা কেউ জানে না।”
নিরার মনটা অজানা কারণেই মেয়েটার জন্য নরম হয়ে এলো।
“মন খারাপ করো না। শুনলাম, তুমিও তো ফ্রান্সে আঙ্কেল-আন্টির কাছে চলে যাচ্ছো কয়েক বছরের মধ্যে।”
বর্ষা ওর কথা শুনে হাসল।
“ব্যাপারটা ফ্রান্সে যাওয়া কিংবা আব্বু-আম্মুর জন্য না। আমি বড় হয়েছি, পারিবারিক দূরত্বের ব্যাপারগুলো নিজে থেকেই বুঝি। তাছাড়া, বড়মা আর বড়আব্বুও আমাকে কখনোই তাদের অনুপস্থিতি কিংবা শূন্যতা উপলব্ধি করতে দেয়নি। আম্মু-আব্বুও সারাক্ষণ খোঁজ-খবর নেয়। আর আমার ছোট্ট ভাইটাও তো আমার সাথেই আছে।”
নিরা বোধহয় কথাগুলোর গভীরতা বুঝলো। যেচে বর্ষা সবটা না বললেও বুঝলো। যদিও একটু দেরি করেই বুঝলো যে, তার বয়সের মেয়েরা প্রিয় মানুষ বলতে কেবল প্রিয় পুরুষকেই বোঝায়।
নিরাকে ধ্যানমগ্ন হতে দেখে বর্ষা বলে,
“তুমি না থাকলে খুব বোর হতাম। কী করতাম জানো?”
“কী করতে?”
“কাঁদতাম!”
নিরা চাইলো বর্ষার ব্যথিত মুখখানায়। কী বিষন্ন কন্ঠে জপল শব্দটা। এতো কিসের দুঃখ মেয়েটার?
“কেন কাঁদতে?”
“সে ভালোবাসে না ভেবে কাঁদতাম। তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসাটুকু পাই না বলে আমার মন খারাপ হতো। লোকটা আদতেও সেসব অনুভুতি একরত্তিও বোঝে কি-না সেটাই সন্দেহের বিষয়। আছে এমনই দুঃখ দেওয়ার মতো একজন, যাকে পৃথিবীর সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হয়। যে জানে না সে নিজের মনের অজান্তেই আমায় কতো কাঁদাচ্ছে। কিশোরী বর্ষার বুকে ঝড় বয়িয়ে দিব্বি জলে গা ভাসিয়ে বেড়াচ্ছে লোকটা। এতোটুকুও অনুশোচনা হয় না। আমার না খুব ইচ্ছে হয়, শীতলপাটি বিছিয়ে তাকে ঘুম পাড়াতে। তার অগোছালো কথার তরে ডুব দিতে ইচ্ছে হয় শুনতে ইচ্ছে হয় তার সকল অপ্রাসঙ্গিক গল্প। নিজের জীবনের নগ্ন সত্যগুলোও সে নির্বিঘ্নে আমাকে বলে ফেলুক, এমন রুপে পেতে ইচ্ছে হয়। আমি তার ঘর হতে চাইলাম, অথচ…সে ঘর বোঝেনা! ঘুরে বেড়ায় গভীর বনে। আচ্ছা, কেন তার বুকে আমার ছোট্ট মাথাটা ঠাই পাচ্ছেনা বলতে পারো? কেন সে এতো দূরে! কেন চাইলেই তাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়া যায়না! কেন সে আমার হয় না, কেন হয় না!”
মোহগ্রস্তের মতো কথাগুলো বলে গেলো মেয়েটা। আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। মেয়েটার বুকের জ্বালাপোড়া বোধহয় আকাশও বুঝলো। নিরা কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়। কী বলা উচিৎ বুঝলো না। একদিনের পরিচয়ে একটা মেয়ে তার একান্ত ব্যক্তিগত কথাগুলো কতো সহজেই না খোলাসা করে দিচ্ছে। মেয়েটা নেহাতই খুব সহজ-সরল। বর্ষা কাঁদছে। নিরা তীর্যক চোখে দেখলো একপলক। কেন জানি না খুব খারাপ লাগছে বর্ষার জন্য। বর্ষা খেয়াল করার আগেই চোখ সরিয়ে নিলো। নিরার ইচ্ছে করলো না সে-ই একজন বিশেষ লোকটা কে তা জিজ্ঞেস করতে। ব্যাপারটা নিরার ব্যক্তিত্বের বিপরীত। মানুষের গোপনীয়তায় নিরা কখনোই হস্তক্ষেপ করে না। স্বেচ্ছায় যদি বলে তো সেটা রক্ষা করতেও জানে। তবে কিছু কিছু ব্যাপার না বললেও মানুষকে নিজে নিজে বুঝে নিতে হয়। এইযে নিরা বুঝে নিলো, বর্ষার জীবনের প্রিয়পুরুষটির কথা। তার ইচ্ছে করলো মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে একটুখানি শান্তনা দিতে। কিন্তু, এক মুহুর্তের পরিচয়ে মানুষের সঙ্গে এতো সহজ হওয়া যায় কি? বোধহয় যায়, কিন্তু নিরা পারে না। নিরা আরও খেয়াল করলো, বর্ষার তার নিজের প্রিয় মানুষকে নিয়ে বৃষ্টি পড়ার মুহুর্তে যে অনুভুতির সৃষ্টি হয়, নিরার ক্ষেত্রে তা সম্ভবত হয়না। নিরারও তো একটা প্রিয়পুরুষ আছে। কই? তার বেলায় তো এমন হয়নি? নিলয় ভাইকে ভেবে নিরা কখনোই মন খারাপ করেনি। বৃষ্টি পড়ার মুহূর্তে তো না-ই। তাকে মিস করে এতো গভীর চাওয়া কখনোই উপলব্ধি হয়নি মেয়েটার। তবে যে নিরা ভেবে এসেছে লোকটাকে সে অসম্ভবরকম ভালোবাসে? ভালোবাসে আকাশসম মুগ্ধতা নিয়ে।
নিরাকে চুপ থাকতে দেখে বর্ষার চেতনা ফিরলো। ধাতস্থ হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে হেসে শুধায়,
“তোমার ক্ষেত্রে বৃষ্টির আবেগ কেমন? তোমারও কি আমার মতো একলা আর বিষন্ন লাগে?”
নিরা চোখ বুঝে শ্বাস নেয়। বৃষ্টির পানি আর মাটি মিশে একাকার হয়ে এক অনন্য সুভাস সৃষ্টি করেছে। তীব্রভাবে সতেজ ঘ্রাণটা নাকে লাগছে। ভীষণ প্রানবন্ত লাগছে ব্যাপারটায়। নিরা ভাবে কিছুক্ষণ। চোখ মেলে বলতে লাগে,
“বোধহয় লাগে না৷ বৃষ্টি ব্যাপারটা আমার কাছে ভীষণ আনন্দময় আর উপভোগ্য! বৃষ্টির দিনে আম্মুর হাতের খিচুড়ি-ইলিশ, বাবা-র গলির মোর থেকে কিনে আনা বাদাম ভাজা, ছাঁদের নেতিয়ে যাওয়া বেলীফুল গাছটার প্রাণ ফিরে পাওয়া, কিংবা হলদেটে মোমের আলোয় একটা পরিত্যক্ত উপন্যাস মেলে ধরা, সবই চমৎকার! আমাদের বাড়ির সামনে একটা টিনের চালের ঘর আছে, বাবা শখ করে বানিয়েছেন সেটা। আমি আর মিরা আপু বর্ষাকালের বেশিরভাগ সময়টাই সে-ই ঘরে কাটাই। রাতের বর্ষণে সোনালি রোদের মতো স্ট্রিটলাইটের আলো পড়ে ভেজা রাস্তায়, প্রতিফলিত হয় হাজারো স্বর্গ-সম অনুভূতি। আমরা দু’বোন জানালা দিয়ে আগ্রহ নিয়ে দেখি তা। তোমাকে বলে বোঝানো সম্ভব না আমার দাদাভাইয়ের বানিয়ে যাওয়া নব্বই দশকীয় বাড়িটায় এই আটপৌরে ব্যাপারগুলোয় কতো আরাম! কালো মেঘ দেখে মাঝে মাঝে আবার পাহাড়ে ছুটে যেতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। সুউচ্চ পাহাড়ের নিঃসঙ্গ বেড়ার ঘর থেকে বৃষ্টি দেখতে ইচ্ছে হয়। ছুঁতে ইচ্ছে করে শুভ্র মেঘ। আকাশের পানে দৃষ্টি মেলে সবটুকু জল শুষে নিতে ইচ্ছে হয়। তবে এটা সত্য, বৃষ্টি সবার কাছে একরকম হয়না বোধহয়। কারো কাছে এই বৃষ্টি প্রেমের দূত, কারো কাছে তা বিষাদের ছোঁয়া। আমার সাথে প্রথমটারই মিল পাই। বৃষ্টি মানে আমার কাছে প্রেম। আকাশের প্রতি, নরম বাতাসের প্রতি, আর রিমিঝিম শব্দের প্রতি নিবিড় প্রেম! এই প্রেম অফুরন্ত, অতৃপ্ত, আর দীর্ঘস্থায়ী! মানে, নেভার এন্ডিং এন্ড আনস্টপেবল অবসেশন। একমাত্র বর্ষাতেই প্রকৃতি আমায় এতো টানে! ইংরেজি সাহিত্যিকরা যাকে ‘রোমান্টিসিজম উইথ নেচার’ বলে জানে, আমি তার নাম বর্ষণপ্রেম!”
শেষের কথাটা বলে নিরা চমৎকার ভঙ্গিতে চাইলো। ওকে দেখতে লাগছে সেকেলের সুচিত্রা সেনের মতো। মেয়েটার চেহারায় একটা উপন্যাস উপন্যাস ব্যাপার আছে। কথা বলেও কন্ঠে মধু ঢেলে। গলার স্বর বেশ মোহনীয়। বর্ষা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। অদ্ভুতভাবে মনটাও ভালো হয়ে গিয়েছে চট করেই। কথাগুলো ভীষণ টানছে ওকে।
“বাহহ! চমৎকার তো! বৃষ্টি যে এতো সুন্দর সেটা তোমার মুখ থেকে না শুনলে বুঝতামই না। এখন থেকে তোমার চোখ দিয়ে বৃষ্টিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। টিনের চালের ঘরে বর্ষণপ্রেমে ডুবতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
নিরা গালে হাত ঠেকিয়ে হাসল।
“আমার চোখ দিয়েই দেখতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তোমার জায়গা থেকে বৃষ্টি তোমায় যেমন অনুভুতি দেয়? ওটাও সঠিক। ওটা তোমার মনের প্রতিফলন। মানে এইযে, তোমার মনে তোমার প্রিয় মানুষের প্রতি এতো আকুলতা? কাছে পাওয়ার তৃষ্ণা থাকার সত্ত্বেও তাদেরকে তুমি কাছে পাচ্ছো না বলেই বৃষ্টিও তোমার মনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তোমায় নিঃসঙ্গ অনুভব করায়। তুলনামূলকভাবে আমার তেমন দুঃখ, তৃষ্ণা নেই। তা-ই হয়তো বৃষ্টি ব্যাপারটা আমায় এতো ব্যথিত করতে পারে না। বরং এটাকে আমি খুব উপভোগ করি। শুধু যে বর্ষার ক্ষেত্রেই এমন হবে, তা-ও না। যেকোনো ঋতুই মানব মনের ভাবমূর্তি অনুযায়ী নিজেদেরকে উপস্থাপন করে। প্রকৃতি তোমাকে কেমন অনুভব করাবে তা নির্ভর করে সে-ই মুহুর্তে তুমি দুঃখে আছো নাকি আনন্দে। বৃষ্টিতে সুখী হতে হলে দুঃখ কমাও, বর্ষা। যে তোমায় স্বেচ্ছায় বোঝে না, তাকে মুখে বলেও কখনোই বোঝানো যাবে না। নিজেকে গুটিয়ে নিও না। আগাছায় পানি না ঢেলে সঠিক মানুষের অপেক্ষা করো। যে তোমায় সত্যিকার অর্থে ভালোবাসবে? তাকে মনে করে তোমার কখনোই দুঃখ হবে না। জীবনটা স্বর্গ হবে একটা উপযুক্ত মানুষের জন্য। অনুভুতি সঞ্চয় করো, অপাত্রে ঢেলো না।”
বর্ষা একদৃষ্টে চেয়ে শুনলো। নিরা যে এসব তার উদ্দেশ্যেই বলছে সেটাও বুঝলো। চেতনা ফিরতেই বাইরে তাকায়। নাবিল ভাইকে ভালো না বেসেও বর্ষা থাকতে পারবে কখনও? হয়তো না! কিন্তু মুখে সেসব লুকিয়ে কথা কাটাতে বলে,
“আচ্ছা, তোমার জীবনে কোনো দুঃখ নেই? কিংবা প্রিয় মানুষ?”
প্রকৃতিও বোধহয় চাইলো না নিরার উত্তর শুনতে। শব্দ করে বাজ পড়ল। আঁতকে উঠল দু’জন। বর্ষা আকস্মিক শক্ত করে নিরার হাতটা ধরলো। নিরা বুঝলো, মেয়েটা বড্ড ভিতু। হাসলো সে। বিদ্যুৎ চলে গেলো। বর্ষা জেনারেটরের লাইট অন করতে যেতে নিতেই নিরা বাঁধ সাধলো।
“উহু, উপভোগ করো। হাতে চা, আর বাইরে জাদু। চোখ দু’টো বন্ধ করে এই শব্দ আর আধভেজা অন্ধকার শহরটা ফিল করো। প্রকৃতি যখন স্বেচ্ছায় অন্ধকার দেয়? সেটা কৃত্রিম আলোয় মুছে দিতে যেও না। ওরা অভিমান করে। প্রয়োজন হলে একটা মোম জ্বালাতে পারো, আপাতত এতোটুকু কৃত্রিমতাই যথেষ্ট।”
বর্ষা তা-ই করলো। উঠে বারান্দার রেলিঙে গাল ঘেঁষে চোখদুটো বন্ধ করে দাঁড়াল। এলোমেলো শীতল বাতাস চুলগুলো উড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। বৃষ্টির ছিটেফোঁটা লাগছে মুখে। শিহরণে গা কাটা দিয়ে উঠল। নিজেকে আবিষ্কার করলো মহাসমুদ্রের তীরে। বিশাল সমুদ্রের একটা নির্জন দীপে বর্ষা একা। একাই হাঁটছে মেয়েটা। শোঁশোঁ করে বাতাস বইছে সমুদ্র থেকে। তার ছোট্ট দেহটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে-ই বাতাস। পৃথিবীটাকে আজ শুধুই নিজের মনে হচ্ছে। কোথাও কেউ নেই, কেউ না!
দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
“বর্ষাপু!”
“দরজা খোলাই তো, সাগর। আয় ভেতরে।”
সাগর ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালায়। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
“নাবিল ভাইয়ার জ্বর হয়েছে। নিরাপুকে ডাকছে। বড়মা যেতে বললো।”
“আম্মু, তুমি আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। আমার খুব ঠান্ডা লাগছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। একটা গল্প বলো। খবরদার আমার কাছ থেকে উঠবে না।”
“শুনো আম্মু, আজকে ভুনাখিচুড়ি রান্না করবে, সাথে ঝাল ঝাল গরুর মাংস। বেগুন আছে বাসায়? থাকলে ওটাও ভাজবে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে এসব।”
অবচেতন শরীরে মৃদু গোঙ্গানোর সুরে মাতৃক্রোড়ে থাকা শিশুর মতো বিরবির করছে নাবিল। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে কপালে হাত রেখেছিল নিরা। সে-ই থেকে হাত নাবিলের দখলে। শক্ত করে হাতটা বুকের মধ্যে আগলে ধরে আবোলতাবোল বলেই চলেছে। নাতিটাকে নিয়ে এবার চিন্তাই হচ্ছে ইশতিয়াক এহসানের৷ হুট করেই এমন গা কাঁপিয়ে জ্বর আসার কথা তো না। এই বৃষ্টির রাতে ডাক্তার পাবে কোথায়?
শিউরে বসে আছে সকলে।
“দাদুভাই! উঠে ঔষধটা খেয়ে নে। একটা লম্বা ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে। উঠো ভাই, উঠো।”
নাবিল রক্তিম চোখ দু’টো ধীরেসুস্থে মেলার চেষ্টা করলো। সবকিছু কেমন ঝাপসা দেখছে। কেবল একটা ছোট্ট মুখই তার নিকট স্পষ্ট হলো। খেয়াল করার চেষ্টা করলো তাকে। মেয়েটার হাত নিজের হাতের বাঁধনে অবরুদ্ধ আছে সেটা বোধগম্য হতেই ধীরেসুস্থে হাতটা ছেড়ে দিলো। চোখদুটো জ্বলছে ভীষণ। দূর্বলতা আর শারীরিক টানাপোড়নে নাবিল পূনরায় ক্লান্তিতে চোখ বোঝে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিরা পানিতে ছোট্ট একটা তোয়ালে চুবিয়ে পূনরায় সেটা ওর কপালে ধরে। এই লোকের জ্বর হলে সে অবুঝ শিশুর মতোই আচরণ করে সেটা নিরার অজানা না। কপালে ভাজ ফেলে চেয়ে রইলো নাবিলের মুখে। থামাথামির নাম নেই। কী যে বলছে, নিজেও জানে? কই, নিরার তো এমন হয় না। দিব্বি জ্বর হলে নিজে নিজে ঔষধ খেয়ে জ্বর সারিয়ে ফেলে। আর ইনাকে দেখো, ভাবখানা এমন যেনো জ্বর হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর রোগ। লেগে পড় চৌদ্দ গোষ্ঠী তার সেবায়। সবকিছু নিয়ে এই লোকের অতিরিক্ত ঢং। ফুপ্পিটা অতি আদরে এমন ড্রামাবাজ বানিয়েছে এটাকে। পিঁপড়ার কামড়েও ইনার চরম আতঙ্ক। সোনার যৌবন ঝলসে যাবে। তাকে মাঝেমাঝে বাচ্চা বাচ্চা মনে হয় নিরার।যেনো অবুঝ বালকটি! এই লোক বিয়ে করবে কোন অভাগীকে? একজন প্রাপ্তবয়স্কা রমণীর এমন বালক স্বামী হলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়? ভীষণ অদ্ভুত! হাসলো নিরা। না জানি কোন মেয়ের কপাল পুড়াবে এই লোক। মেয়েটার ভবিষ্যৎ শঙ্কায় নিরার বেশ দুঃখই হচ্ছে এবার। অথচ সুস্থ হলে সে কী চঞ্চলতা আর দায়সারাপনা তার!
কেবল নিরা, বর্ষা আর সাগরই আছে ঘরে। জ্বর কিছুটা কমতেই বাকিরা ফিরে যায় যার যার ঘরে। নাবিল খেলো না কিছুই। মুখে হাজার বলেও ফায়দা না করতে পেরে হতাশ হয়ে কোনোরকমে ঔষধটা খাওয়ালো নিরা। ওরা চলে গেলে কেবল বর্ষাই রইল ঘরে। শাহিনা বেগম থাকতে বললেন ওকে। রাতে ঘুম ভাঙলে নাবিল শিউরে বর্ষাকে আবিষ্কার করে। এতোক্ষণ মোহগ্রস্তের মতো নাবিলের ঘুমন্ত মুখখানায় চেয়েছিল বর্ষা। ঠোঁটে তৃপ্তি,চোখে অধীর কৌতুহল। মাঝ রাতে আবারও ঘুম ভাঙে নাবিলের। ওকে চোখ মেলতে দেখে ব্যস্ত হয়ে বর্ষা শুধায়,
“কিছু লাগবে আপনার? খারাপ লাগছে?”
নাবিল কিছুটা অপ্রস্তুত হয় ওকে দেখে।
“ঘুমাওনি তুমি?”
“বড়মা থাকতে বললো। রাতে যদি কিছুর প্রয়োজন হয় আপনার।”
নাবিল ধীরেসুস্থে উঠে বসল। বর্ষা ধরতে চাইলে হাতের ইশারায় বারণ করে বলে,
“সামান্য জ্বর হয়েছে, এতো ব্যস্ত হইয়ো না। টাইফয়েড হয়েছিল কয়েকবার, সেটার কারণেই মাঝেমধ্যে এমন গা কাঁপিয়ে জ্বর হয়। আহামরি কিছুই না,সেরে যাবে। তুমি শুয়ে পড়ো ঘরে গিয়ে।”
বর্ষা নিশ্চুপ মন খারাপ করে বসে আছে খেয়াল করে নাবিল বলে,
“আচ্ছা,এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?”
বর্ষা বোধহয় এরকম একটা হুকুমের আশায়ই বসেছিল। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে দৌড় লাগালো ডাইনিংয়ের দিকে। পানি সমেত ফিরে এসে গ্লাসটা নাবিলের সম্মুখে ধরল। নাবিল ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে আছে। বর্ষা সাথে ওর কোনো কালেই অতো ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক ছিল না। দু’জনের মধ্যে সবসময় একটা দূরত্ব থেকেই যেতো। অবশ্য সেটাও নাবিলের কারণেই। প্রাপ্তবয়ষ্ক চাচাতো বোনের সাথে কেবল কয়েকবারের দেখাতেই তো আর এতো খোলামেলা হওয়া যায় না। মেয়েটাও এমন না। একটু লাজুক ধাঁচের।
মাথাটা ধরে আছে নাবিলের।
“অনেক রাত হয়েছে। ঘরে ফিরে যাও। আই এম অলরাইট।”
বর্ষা মাথা নিচু করে সম্মতি জানায়। ঠোঁটের কোনে অজানা লাজুক হাসি। দরজার প্রান্তে পৌঁছাতেই নাবিল পেছন থেকে ডেকে উঠে,
“শুনো!”
পা দু’টো থমকে যায় মেয়েটার। হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় তড়িৎ গতিতে। বুকের উঠানামায় শরীর কাঁপছে। মানুষটার মুখে ‘শুনো’ শব্দটায় কী যেনো ছিল। কেমন নেশাধরানো ডাক।
“নিরা কি জেগে আছে?”
বর্ষা অসন্তুষ্ট হয়। চুপসে যায় প্রানবন্ত মনটা। বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে তবুও জবাব দেয়,
“বলতে পারছি না। আমি তো আপনার সাথেই ছিলাম এতক্ষণ। কেন? কিছুর প্রয়োজন?”
নাবিল হতাশ শ্বাস ফেলে। কিন্তু মুখে বলে,
“নাহ, এমনি। আচ্ছা ঘুমাও তুমি।”
খাটে হেলান দিয়ে বসেছিল নাবিল। হাত কপালে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চোখ তুলে চাইলো,
“আসবো?”
কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পেয়ে নাবিল স্মিত হাসল।
“আয়।”
নাবিলের কপালে হাত রেখে পাশে বসতে বসতে নিরা শুধায়,
“কী এমন বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে তলব করা হলো?”
নাবিল তীক্ষ্ণ চোখে চায়। নিরার চোখে রসিকতা। নাবিল তা খেয়াল করেও সহজ ভঙ্গিতে চেয়ে কথার জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“ঘুমাসনি?”
“নাহ।”
“কেন?”
“ঘুমালে তোমার মাথা কে টিপে দিবে? এই এক কাজের জন্য ফুপ্পির পর আমিই তো ঠিকাদার আছি। জ্বর হলে তোমার কতোকিছু হয়। মাথা ধরবে, রাতে ঘুম ভাঙবে, মুড সুইং হবে, মেজাজ বিগড়াবে, এসব কি আর এই বাড়ির লোকেরা সামলাতে পারবে?”
নাবিল হাসে। নিরা খাটের উপর ওর সামনাসামনি পা তুলে বসল। মাথাটা সোজা করে দুই হাত কপালে রাখল। নাবিলও ঝুঁকে বসল ওকে সুবিধা করো দিতে। কপালে মলম লাগিয়ে হাতের সিংহ আঙ্গুল দিয়ে কপালের দুই কোনে চেপে ধরল নিরা। মলমের ঝাঁঝ নাক আর চোখে লাগতেই চোখ বুঝল নাবিল। নিরা হাসে। মাথা টিপে দিতে দিতে বলে,
“ডাক্তার বাইরের খাবার খেতে নিষেধ করেছে। শরীরের প্রতি অবহেলা যা করার তুমিই করছো। টাইফয়েড ব্যাপারটাকে তুমিই নিজেই উস্কে দিয়েছো। উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছিলে?”
“উহু। তোর সঙ্গে গতকাল বার্গার খেয়েছিলাম, ওটাই তো।”
“উচিত হয়নি খাওয়া।”
“উপায় কী ছিল? জামাই আপ্যায়ন নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিস? দিলে না-হয় ভালো কিছু খেতে পারতাম।”
চোখদুটো বন্ধ রাখা অবস্থাতেই কথাগুলো বলে নাবিল। নিরা নিঃশব্দে হেসে বলে,
“এমন লক্ষী ছেলের মতো জবাব দিবে না তো,নাবিল ভাই। আমি কিন্তু অবাক হই। এসব তোমাকে মানায় না।”
নাবিল বাঁকা চোখে চাইলো।
“আমি জন্মলগ্নগতভাবেই লক্ষী। আজন্ম নিষ্পাপ, অবলা, সুইট সুইট, দেখলেই গাল টিপে দেওয়া ম্যাটারিয়াল। তোরা ভন্ডরাই আমাকে চিনতে ভুল করিস।”
নিরা রাগল না, বরং শব্দ করে হাসে। জ্বরের মধ্যেও কথাগুলো বলার সময় লোকটাকে সত্যি ভীষণ আদুরে লাগছিল। মুখখানা একেবারে নিষ্পাপ। অসুস্থতার দরুন চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সেটাও সুন্দর লাগছে। পরনের কালো রঙের টি-শার্টটা কী দারুণ মানিয়েছে তার প্রসস্থ দেহে। ফর্সা মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো অবহেলার দরুন কিছুটা বেড়েছে। তাতে লাগছে জলজ্যান্ত দেবীমূর্তির ন্যায়। চোখে-মুখে সম্ভ্রান্তবংশীয় ছাপ। নিষ্পলক অধীর সময় নিয়ে চেয়ে থাকলে সত্যি ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয় গালদুটো। নিরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। মৃদু হাসে। ভাবে, কে বলবে? সুস্থ হলেই এই লোক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দায়সারাপনায় খেতাবপ্রাপ্ত এক দস্যি ছেলে?
ঘুম পাড়ানি ঔষধ পেয়ে নাবিল বিনাবাক্যে ঘুমিয়ে পড়ে। নিরা শেষবারের মতো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মনে পড়ে যায় স্কুল জীবনের কথা। যখন ফুপ্পির বাসায় থেকে তিন বছর পড়াশোনা করেছে নিরা। স্কুল থেকে ফিরে প্রায় লোকটাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখেছে। ফুপ্পি ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকলে নিরাকে দিয়েই নিজের সেবা করাতো নাবিল। “নিরা মাথা টিপে দে, পানি দে, আম্মুকে বল একটু লেবুর সরবত করে দিতে, মাথায় পানি ঢাল, আমার টি-শার্টটা এনে দে ছাঁদ থেকে”আরও কতো কী। নিরা বিরক্ত হতো তখন। এতো বড় দামড়া লোক কিনা এইটুকু মেয়েকে দিয়ে খাটাচ্ছে!
এখন সেসব ভেবে হাসি পায়। সময় বহমান স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নাবিল ভাই আছে একইরকম। শান্ত চাহুনির প্রানবন্ত হাসি। মানুষটা একটুও বদলায়নি। যুবক নাবিলের মধ্যেও সে-ই একইরকম পাগলামি, একইরকম দায়সারাপনা!
দরজায় এক কোনে দাঁড়িয়ে সবটা খেয়াল করলো বর্ষা। অজানা দহনে ভেতরটা পুড়ছে। আর দাঁড়াল না মেয়েটা। অসার হয়ে আসা দেহটা বয়ে কোনোমতে ঘরে ফিরে এলো। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি শেষ করলো। এতো ছটফট লাগছে কেন? বর্ষা জানে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক। তবুও কেন জানিনা দাবানলের জ্বলন্ত আগুনের শিখার মতো দবদব করে ভেতরটা জ্বলছে। মনটা অজানা আশঙ্কায় ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। মনে মনে মেয়েটা চাইছে, যা মন বলছে, সেসব বিভ্রম হোক, ভুল প্রমানিত হোক সবটা।
চলবে।