#রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ৭
#নাজমুন_নাহার
সকালে জ্বর সারতেই নাবিলের ভেতরকার আমিত্ব পূনরায় জেগে উঠল। নাশতা শেষ করেই গিটার নিয়ে ছাদঘরে ছুটলো সে। রাতের এতো কাহিনির পর সকালে ওর অস্থিরতা দেখে সকলেই হতভম্ব। সকলকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে এখন ভাবখানা এমন, যেনো তার কোনোকালেই কিছুই হয় না। চির দূরন্তর পাখি সে। ঘুম থেকে উঠেই বাউণ্ডুলেপনা শুরু। এখন আবার বাড়িতে ঢুকেই গানের আশর। তার গানের একমাত্র শ্রোতা এই মুহূর্তে সাগর৷
“ভাই, তুমি কি আর বিয়া করবা না?”
“আর মানে! কয়টা করসি?”
“না-মানে, বিয়েসাদী করার প্ল্যান আছে কি-না?”
নাবিল সরু চোখে চাইলো। গিটারে আঙ্গুল বুলিয়ে বিশ্ব জয় করা হেসে বললো,
“ধুর,বিয়ে কি কোনো সুস্থ মানুষ করে রে, ছোটু? পাগল, উন্মাদ, বেকুবদের ছাড়া কেউ বিয়ে করে না। সকল বিবাহিত পুরুষই পাবনা সার্টিফাইড। শোন, বিবাহ হচ্ছে একটা ক্রাইম। নাবিল জেনেশুনে কোনো ক্রাইমে জড়ায় না।”
সাগর অবাক হয়,”ক্রাইম?”
“হু। যেনোতেনো না, একবারে সিরিয়াস পর্যায়ের ক্রাইম।এই বিয়েসাদীর হাত ধরেই ঘরে ঘরে বউ নামক স্বৈরাচারীর উপক্রম। এরা পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে তিন কবুল বলে পরিপূর্ণ স্বৈরাচার হওয়ার বৈধতা পায়। মানে, বৈধ সরকারের দেশের সম্পদ লুট করার মতো ব্যাপার। এখানে চাইলেও তুই কিছু বলতে পারবি না। তারপর আর কী! মাসুম, নাদান, অবলা, নাদুসনুদুস, ফুলের মতো নরম হৃদয়ের পুরুষের জীবন ফুল্লি কব্জায়। জাস্ট মেনিফেস্ট কর, হাগতে গেলেও তোর নিজের বউয়ের পারমিশন নিতে হবে! ভাবতে পারছিস, কতোটা অপমানজনক ব্যাপার? বিয়ে বিষয়টাকে আমরা যতোটা প্রাধান্য দেই, ব্যাপারটা আসলে এতোটাও মাইনে রাখে না। মানে ধর, রাঘববোয়াল ধরতে গিয়ে হয়ে গেলি পালতু কুত্তা। ব্যাটালোক হচ্ছে সিংহ। গর্ব করে হাঁটার মতো চওড়া বুক থাকবে। এদেরকে যদি তুচ্ছ রমণীরা নিয়ন্ত্রণ করতে আরম্ভ করে, পৃথিবী গোল্লায় যাবে না? একজন সুবুদ্ধিসম্পন্ন জেন্টলম্যান হিসেবে এসব অবিচার আমি আদতেও মেনে নিতে পারি বল? ইজেন্ট ইট আ ক্রাইম?”
সাগর মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনলো সবই। অতি তেতো সত্য,”তবে যে বাবা-কাকা রা বিয়ে করলো? সবাই তো বিয়ে করে ভাই৷ আমিও তো করবো।”
নাবিল ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠে বিস্ময় নিয়ে চাইলো। “আরিশ্শালা, তুই তো হেব্বি স্বার্থপর। এমন মানবতাবিরোধী চিন্তা আসে কী করে মাথায়? এমন নিষ্ঠাবান, নীতিবান, সৎ, বিদ্রোহী ভাই থাকার সত্ত্বেও তোর বিবেকবুদ্ধির এই দশা? ওরা করেছে বলে তুইও করবি? ওদের জেনারেশনটা ছিল ভাদাইম্মা জেনারেশন। আজাইরা খাইয়া কাম-কাজ নাই তো টাইমপাসের জন্য করে একটা বিয়ে। তোর-আমার কি এতো টাইম আছে? আমরা ইন্টেলেকচুয়াল বয়েজ না? অবশ্য, সমস্যা নেই। করুক এরা। এদের হয়ে তুই-আমিই না-হয় একটু ত্যাগ করলাম। আমাদেরকে এতো কেয়ারলেস হলে চলবে? আদিপুরুষরা অসচেতনতাবসত ভুল করে বসেছে বলেই তো পস্তাচ্ছে।”
সাগর তার ভাইয়ের অন্ধভক্ত। তবুও সে এমন গোপন আর জটিল ষড়যন্ত্র কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বরং অনড় রইলো নিজের সিদ্ধান্তে। বিয়ে তো সে করবেই।
“তুমি দেশের কথা চিন্তা করে বিয়ে থেকে ভাগছো?”
নাবিল গর্বিত নয়নে চাইলো। “হ্যা রে বেটা।”
সাগর আবেগাপ্লুত হলো। তার ভাইটা কী মহৎ! মানুষের কথা চিন্তা করে কিনা আস্ত একটা বিয়ে ভেঙ্গে দিলো? আহারে! সাগর হলে তো এমন সাহসী সিদ্ধান্ত কিছুতেই নিতে পারতো না। নাবিল ভাইয়ের দয়ার হৃদয় বলেই পেরেছে।
“কী গাইবো বল তো?”
নাবিল উল্লাস নিয়ে হয়ে বসে, “তুমি যা গাও তা-ই জোস ভাই। যা ইচ্ছা গাও।”
“একটা ছ্যাকা খাওয়া লাইন মনে করা। আজকে একটু ব্যর্থ প্রেমিক হইতে মনে চাইতাসে।”
“ব্যর্থ প্রেমিক হলে বাপ্পারাজের গান ধরো। ব্যর্থতার জগতে তার অবদান অনস্বীকার্য। হি ইজ দ্য লিডার অফ ব্যর্থতা।”
সাগরের সরল মুখে চেয়ে গিটারে আওয়াজ তুললো নাবিল। ব্যর্থতার গলা খাঁকারি দিয়ে গাইতে আরম্ভ করলো তার ভীষণ প্রিয় একটা সফ্ট গান। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী, জাস্টিন টিম্বারলেকের গাওয়া একটা ইংরেজি গান।
If you missed the train I’m on
You will know that I am gone
You can hear the whistle blow a hundred miles
A hundred miles, a hundred miles,
A hundred miles, a hundred miles
You can hear the whistle blow a hundred miles
Lord, I’m one, Lord, I’m two,
Lord, I’m three, Lord, I’m four
Lord, I’m five hundred miles away from home
Away from home, away from home,
Away from home, away from home
Lord, I’m five hundred miles away from home
সাগর জোরে জোরে হাত তালি দিয়ে শিষ বাজালো। নাবিল ভাইয়ের গানের গলা তার বরাবরই চমৎকার লাগে। যদিও জ্বরের তাড়নায় গলা কিছুটা ভেঙে এসেছে, তবুও শুনতে বেশ লাগলো।
“সেই হইছে ভাই! সেই!”
নাবিল দ্বিতীয় গানের জন্য পূনরায় গিটারে আঙ্গুল বুলায়। কী মনে করে জানালা দিয়ে বাইরে চাইলো কে জানে! তার অবাক বিস্ময় কৌতুহলী চোখজোড়া আটকে গেলো মোহনীয় কিছুর উপর।
সূর্য যখন তার সোনালি আঁচল মেলে ধরেছে, তখন কারো শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে খেলা করছে মৃদু বাতাস। গোলাপি সাদা ছোপ ছোপ শাড়ীর আঁচল দখল নিয়েছে বাতাসের। কমলস্নান শেষ হয়েছে সবেই। পিঠ লেপ্টে থাকা কোমড় ছুঁই ছুঁই চুল থেকে পানি পড়ছে টুপটাপ। ছাঁদঘরের জানালার একেবারে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সে। কাপড় ছড়িয়ে চুলের তোয়ালেটা খুলে উন্মুক্ত করে দিলো দীঘল কালো ঝর্নার মতো লম্বা চুলগুলো! চুল থেকে ভেসে আসছে তীব্র নারীত্বের সুভাস। শরীরের ভাজে ভাজে মমতাময়ীর কবিত্বময়তা ফুটন্ত। বিখ্যাত সাহিত্যিকরা তাদের নোভেলে নারীর ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের যেমন বর্ননা করে থাকেন? তেমন। চেহারা অস্পষ্ট। কেবল পিঠের দিকটাই প্রকাশ্য সর্বনাশিনীর। ছাঁদের দড়িতে কাপড় ছড়িয়ে শুভ্র তোয়ালেটা দিয়ে আপন ভঙ্গিতে চুল ঝারছে সে। চুলের ঝটকার সঙ্গে বিন্দু বিন্দু শীতল পানির ছিটেফোঁটা লাগলো নাবিলের বেহেলাজ মুখে। এই কাঠফাটা রোদে সে-ই চুলের অবহেলিত পানিটুকুও যেনো তৃষ্ণার্থ মরুভূমির বৃষ্টির মতো ঠেকলো। নাবিল নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ! ফর্সা পা দু’টোতে রুপোর নুপুরজোড়া তীব্র বিদ্রোহ করলো নাবিলের সঙ্গে। ছেলেটা কেন এমন উন্মাদ হয়ে চেয়ে আছে তার মালকিনের পানে? এমন রুপকথার অপ্সরার দেহে ওমন সস্তা নজর কি মানানসই? নাবিল অভিমান করে। সস্তা! হ্যা, সস্তাই তো। সোনার অঙ্গে নজর বোলাবে কেবল গ্রিক দেবতারুপী প্রেমিক! অন্য কারো সাধ্য কী তাতে ধ্বংসাত্মক চাহুনি নিক্ষেপ করার!
নাবিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্থির চেয়ে রইলো তার সারল্য চলন-বলনে। মেয়েটা এখনো উল্টো দিক করে দাঁড়িয়ে। সেভাবেই কিছুক্ষণ উপন্যাসের ঢঙ্গে বিচরণ করলো ছাঁদে। নাবিল অবচেতন। প্রবল ঝড়ের কবলে পড়েছে তার সুপ্ত, স্থির বক্ষপিঞ্জরটা। একটাবারও নিজেকে প্রশ্ন করার ফুরসত পেলো না ছেলেটা, এই অবেলায় তার বাড়ির ছাঁদে কে এই অপরিচিতা? একজোড়া শুদ্ধ দৃষ্টির ধ্বংস কে ডেকে আনলো এভাবে? কে সে? কে তুমি চন্দ্রমল্লিকা!
চৈতন্য ফিরলো কারো আওয়াজে। একটা ডাক ভেসে আসলো সিঁড়ির দিক থেকে। আরেকটা মেয়েলি কন্ঠ। নাবিলের সর্বনাশিনী এবার চোখ ফিরিয়ে চাইলো। তবে এবার যা দেখলো, তা দেখার পর নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নির্বোধ মনে হচ্ছে। এই মুখ চিরপরিচিত। তাকে দেখামাত্রই বৈদ্যুতিক গতিতে একটা হাওয়া ধাক্কার বেগে এসে লাগলো নাবিলের মুখে। নাটক-সিনেমাতে নায়ক নাইকাকে প্রথম দেখার সিনটা যেমন হয়? তেমন। অভিনয় জগতের ডিরেক্টরদের টাকা খরচ করে যে হাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়? সে-ই হাওয়াটাই নাবিলকে প্রকৃতি দিলো বিনা বিনিময়ে। একটা ঠান্ডা শীতল হাওয়া। ব্যাপারটা আকস্মিক এবং কাকতালীয়। কী দেখলো ছেলেটা! নিজের চোখকে বিশ্বাস করানো দুঃসাধ্য। নাবিলের হাত আপনাআপনি বুকের মধ্যে চলে যায়। হাল্কা ব্যথা হচ্ছে বক্ষপিঞ্জরে। সমান তালে বুকটায় কেউ তীব্র উল্লাস নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দামাদামা বাজিয়ে চলেছে। কেউ জানান দিয়ে যাচ্ছে, কাঠফাটা রোদে নাবিলের এক মায়াবতীর প্রেমে পড়ার গল্প। কেশবতীর নারীসুলভ দেহের পোশাকেরা রোদ পোহাচ্ছে। নাবিল প্রেমে পড়ল কাঠফাটা রোদে। প্রেমে পড়ল… ওদের রোদ পোহাবার ছুতোয়! আচ্ছা… প্রেমে পড়ার এমন অদ্ভুত দৃষ্টান্তও বুঝি হয়? এভাবেও প্রেমে পড়া যায়? যায় বোধহয়। এইযে, নাবিল পড়ল, ভয়ংকর প্রেমে পড়ল!
কেমন একটা লাগছে, কিন্তু কেমন লাগছে? নাবিল জানে না। শুধু জানে, চোখের সম্মুখে নিজের বিধ্বস্ত পরিনতি দেখলো সে। এই ভয়ংকর দিনটি আসা কি খুব জরুরী ছিল? এমন একটা রুক্ষ বৈশাখে তার আগমন হওয়াটাই বা জরুরী ছিল কিনা? দিলে তো মনের গহীনে চুপটি করে বসে থাকা প্রেমের সুরটাকে মুক্ত করে! এবার ওদের ঠেকায় কে? প্রজাতির ন্যায় অবাধ্য হয়ে ডানা জাপ্টাচ্ছে। এইযে, হৃদয়টা বুঝি চাতক পাখির মতো হাসফাঁস করতে করতে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কী হবে ছেলেটার এখন? প্রাণটা যে গলা পর্যন্ত এসে বাঁচার আকুতি নিয়ে বড্ড দাপাচ্ছে! এ কী নিষ্ঠুরতম রুপ তোমার, মেয়ে!
সাগর বুঝলো না নাবিল ভাইয়ের হুট করেই মূর্তির স্টাচু হয়ে যাওয়ার কারণ। সে বসেছে জানালার উল্টো পিঠ হয়ে। ভাই এমন ধ্যানমগ্ন হয়ে কী দেখছে তখন থেকে?
নাবিল হুট করেই উঠে পড়ল। ছাঁদঘর ছেড়ে ডাইনিংরুমে গিয়ে ঢকঢক করে দুই ক্লাস পানি খেলো। শার্টের হাতার উল্টো পিঠ দিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে কপালের ঘাম মুছলো। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে পূনরায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই রান্নাঘর থেকে বড় চাঁচি উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধায়,
“কিরে বাপ, এমন হাঁপাচ্ছিস কেন? খারাপ লাগছে? এদিকে আয় তো, দেখি জ্বরটা এলো কিনা আবার।”
নাবিল বাঁধ সাধলো।
“জ্বর নেই৷ ঠিক আছি, বড়মা।”
বলেই চোরের মতো হন্তদন্ত পায়ে ছুটলো দোতলায়। নিজেকে লুকিয়ে রাখা জরুরী আজ। এই করুন রুপ কাউকে দেখানো যাবে না। কাউকে না। শাহিনা বেগম বিভ্রান্ত মুখে চেয়ে রইলেন ওর যাওয়ার পানে। বিমর্ষ দেখাচ্ছে নাবিলকে। কী হলো ছেলেটার হঠাৎ?
সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় নিরার সঙ্গে দেখা। শাড়ী পরেছে মেয়েটা। চোখেমুখে একরাশ আনন্দ। কোথাও যাচ্ছে বোধহয়। ওকে দেখামাত্র নিরা পথ আটকে এক গাল হেসে আবদারী ভঙ্গিতে বলে,
“তোমাকেই খুঁজছিলাম,নাবিল ভই। ভালোই হলো দেখা হয়ে।”
নাবিল জবাব দেয় না। ভেতরটা কেমন পালাই পালাই করছে। এই প্রথম এতো অস্বস্তি আঁকড়ে ধরল তাকে।
“একটু বাহিরে যেতে পারবে? আমার আর বর্ষার জন্য দু’টো রজনীগন্ধার গাজরা এনে দাও। খোঁপাটা বড্ড বেমানান লাগছে ওটা ছাড়া।”
নাবিল ঘোরলাগানো নজরে ওর মুখের দিকে চায়। কী ভেবে তড়িঘড়ি করে চোখ সরিয়ে সিঁড়িতে দৃষ্টি ফেলে রুষ্ট কন্ঠে বলে,
“পারবো না, সর সামনে থেকে। আর শোন, খবরদার আমার আগে-পিছে এমন সং সেজে ঘুরঘুর করবি না। এমন মাঞ্জা মারার কী হলো? তোকে দেখেই মেজাজ বিগড়াচ্ছে।”
“সং সাজলাম কোথায়? আমি তো সাজিইনি। এই দেখো, কেবল কপালে একটা টিপ পরেছি। আর হাতে কাঁচের চুরিগুলো। মুখে নো ম্যাকআপ।”
নাবিল তীর্যক চায়। সত্যি, কেবল একটা সবুজ রঙের ছোট্ট টিপ কপালে। ফর্সা কপালটার সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় যে রঙটা। নাবিল একটা শুষ্ক ঢোক গিলে চোখ ফিরিয়ে বলে, “না সেজেই এমন মারাত্মক দেখালে, সাজার কী প্রয়োজন!”
মোহগ্রস্তের মতো মিনমিন করে কথাটা বলে নাবিল। নিরা চোখ বাঁকায়, “হাহ্?”
“কিছু না।”
“এনে দিবে তো?”
“কী?”
“গাজরা।”
“সময় নেই।”
“কী করো সারাদিন? সময় থাকবে না কেন? এমন করো কেন? যাও না, নাবিল ভাই! এবার বাড়িতে ফিরে তোমাকে পুডিং বানিয়ে খাওয়াবো, প্রমিস।”
অন্য সময় হলে এই অফারের বিপরীতে লম্বা সংলাপ হতো। তবে আজ যে নাবিলের কথার অভিধানটা নিখোঁজ। চাইলেও বেশিক্ষণ ওর সঙ্গে বিতর্ক করতে পারছে না। নাবিল হতাশ শ্বাস ফেলে। সামান্য পুডিংয়ের লোভ দেখিয়ে মেয়েটা ওকে দিয়ে কাজ করাতে চাইছে ভেবেই হাসি পেলো। অথচ নাবিল যে পুরো দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করার চিন্তা করছে এই তুচ্ছ রমণীর জন্য, তা কী সে জানে? জানে না।
নাবিল জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। নিরা মন খারাপ করে মনে মনে কয়েক সেকেন্ডে কয়েক হাজার খানেক গালি দিয়ে ফেললো। সবসময় বাড়াবাড়ি লোকটার!
দোতলায় চড়ে কী মনে করে সিঁড়িতে ফিরে পূনরায় নাবিল শুধায়,
“শাড়ী পরে এমন রঙ্গ করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”
নিরা ভাবলো নাবিলের মন গলেছে, “বর্ষার ভার্সিটিতে যাবো। কী একটা প্রোগ্রাম আছে। বাসায় থেকে বোর হচ্ছিলাম, তা-ই আন্টিও বললো ওর সঙ্গে যেতে।”
“চালচলন সুবিধার না। পা দু’টো স্বাভাবিকের চেয়ে এক-দেড় ইঞ্চি বেড়েছে বোধহয়। কেটে আগের ফর্মে আনা দরকার।”
নিরা বুঝলো না।
“পাখা গজিয়েছে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে?”
নিরার চোখ ভিজে এলো।
“এভাবে কেন বলছো,নাবিল ভাই? আমি কি কখনও কোথাও গিয়েছি?”
নাবিল রয়ে সয়ে চাইলো। গলার স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে কথার বিপরীতে প্রশ্ন করে,
“কতক্ষণ লাগবে ফিরতে?”
নিরা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। নাবিল গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,
“এক্সট্রা কিছু সেইফটিপিন ব্যাগে রেখে নিলে খারাপ হয় না। পাছে অযাচিত সৌন্দর্য উন্মুক্ত না হয়ে যায়। এবং বিশেষ দ্রষ্টব্য, ঘুরাঘুরি শেষ হলে আমাকে ফোন করতেও যেনো ভুল না হয়। এসব শর্ত মানতে খুব অসুবিধা হলে যাওয়ার প্রয়োজন দেখছি না।”
নিরা অদৃশ্য আস্কারা পেয়ে স্মিত হাসে, “তাহলে এনে দাও গাজরা।”
নাবিল দোতালার বারান্দা পেরোতে পেরোতে বলে,
“সাগরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
রাত প্রায় এগারোটা। বাড়ির সকলেই খেয়েদেয়ে যার যার ঘরে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি আজকেও। ছাঁদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো নাবিল। মনের অভিলাষগুলো বর্ষণের ঠান্ডা স্পর্শে কিছুটা হলেও যদি শীতল হয়। যদি ভেতরের উচাটনতা কিছুটাও কমে। শরীরের সবটুকু অস্থিরতা মুছে ফেলতে হবে যে। শার্ট-প্যান্ট ইতোমধ্যে ভিজে একাকার। চুল কপাল পর্যন্ত চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। নাবিল চোখজোড়া বন্ধ করে আকাশের পানে মুখ করে একটা লম্বা শ্বাস নিলো। মন- মস্তিষ্কের এমন উন্মদনা আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। বুকটা বড্ড এলোমেলো লাগছে। মনে জমেছে হাজারও প্রণয়াকাঙ্ক্ষা। কাউকে কাছে টানার তীব্র তৃষ্ণা। চোখের সম্মুখে অগত্যাই দুপুরের অনাকাঙ্ক্ষিত মুখটা ভাসছে। একটা মসৃণ আলোর মতো মুখ, ঢলঢলে দীঘির মতো কোমড়, কাঁজল টানা ধূসর একজোড়া চোখ, আর তার দীঘল কালো চুল! আহা! সেই প্রহরের পর থেকে কী বিধ্বস্ততা মনের! সে-ই চিরপরিচিত মুখ, অথচ নতুন করে তার প্রতি জন্ম নেওয়া ধ্বংসপ্রেম!
টানা দুই ঘন্টা ধরে ভিজে রাতে পূনরায় গা কাঁপিয়ে জ্বর হয় নাবিলের। এবার আর কাউকে ডাকার প্রয়োজনবোধটুকু করলো না। একটু একা থাকা জরুরী আজ। অশান্ত মনটা একটু নিরবতা চাইছে। কোনোরকমে উঠে ঔষধ খেয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঠিক ঘুম না, চোখ বুঝে বিভ্রম চিন্তাভাবনা নিয়ে শুয়ে থাকা। মাঝ রাত্তিরে শরীর পূনরায় গরম হয়ে এলো। শীত করছে ভীষণ। একটা কম্ফোটারে কিছুতেই ঠান্ডা কমছে না। উঠে বড়মা’কে এতো রাতে ডাকা ঠিক হবে কিনা। নাহ থাক, বেহুদা চিন্তা করবে। চুপচাপ গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকে নাবিল। নির্জন অন্ধকার ঘরটায় হুট করেই আলো জ্বলে উঠল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হতেই নাবিল তাৎক্ষণিক উঠে দরজার পানে চাইলো। নিরা!
“ডাকলে না কেন আমায়? নিজে নিজে কিছু করার মুরদ যে নেই তা জানো না? বদ ছেলেকে আদরে আরও বদ বানিয়েছে আমার ফুপ্পি। প্রয়োজনেও এখন সে মাটিতে পা মারায় না। আর কবে বড় হবে নাবিল ভাই তুমি?”
নাবিল মনের উচাটনতা ঢেকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কেবল। নিরা তীক্ষ্ণ চোখে চায় ওর ধ্যানগ্ন মুখে।
“ভাবছো, কী করে জানলাম আবার জ্বর এলো? ভুলে যাচ্ছো যে, আমি আমার ফুপ্পিরই ভাতিজী। বৃষ্টিতে ভিজে রাতে ঘরে ঢুকেছে সেসব চোখ এরিয়েছে ভেবো না। তোমার শিরা-উপশিরা আমার জানা। ভাগ্যিস পানি খাওয়ার ছুতোয় বের হয়েছিলাম, নয়তো আমার বাপের নাবালক ভাগ্নেটা সারারাত মা’কে পাশে না পেয়ে অসহায়ের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতো।”
বলেই খিলখিল করে হাসে মেয়েটা।
“অবশ্য না ভিজলেও এসে কপাল চেক করে যেতাম। ফুপ্পির অনুপস্থিতিতে একটু তো মায়া লাগেই। আমার ফুপ্পির বেইবি বয় বলে কথা।”
নিরা কপালে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে শক লাগার মতো করে আঁতকে উঠলো ছেলেটা। যেনো কেউ ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠান্ডা বরফপানি ঢেলে দিয়েছে ওর শরীরে। বিদ্যুৎতের গতিতে চোখ দু’টো বুঝলো নাবিল। সারা গা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। নিরা আঁতকে উঠে হাত সরিয়ে নেয়। ভয় পায় মেয়েটা।
“কী হয়েছে তোমার? নাবিল ভাই! কী হলো?”
নাবিল একটা শুষ্ক ঢোক গিললো। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বললো,
“নিরা, প্লিজ চলে যা। তোর যত্নের প্রয়োজন নেই আমার। প্লিজ, যা দয়া করে।”
“এভাবে কেন বলছো?”
“বুঝতে পারছিস না তুই! কথা শোন লক্ষীটি, কিচ্ছু হয়নি আমার। ঘুমা রুমে গিয়ে। এতো রাতে এভাবে এসেছিস কেউ দেখলে ব্যাপারটা ঠিক দেখাবে না।”
নিরা হতভাগ হয়ে চেয়ে রইলো। এমন নরম আর ব্যথিত আচরণ নাবিল ভাই কখনই করেনা। কী হলো হঠাৎ?
“কেউ দেখলেই কী? মনে হয় আজ নতুন এসেছি তোমার কাছে? ফুপ্পি তোমাকে দেখে রাখতে বললো গতকাল জ্বরের খবর শুনে। আমি কিন্তু ফুপ্পিকে নালিশ করবো এমন ছেলেমানুষী করলে। তুমি এমন কেন করছো? জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। একটু শান্ত হয়ে বসো, নাবিল ভাই।”
নাবিল ক্লান্ত চোখে চাইলো ওর মুখে। মেয়েটা কেন বুঝছে না ওর সান্নিধ্য নাবিলকে অসম্ভব পোড়াচ্ছে। মায়াবী মুখটা যে আজকের পর থেকে মনোযোগ দিয়ে দেখা মানে নির্ঘাত খুন! কেন বুঝতে পারছিস না, নিরা! কেন যেচে বিপদ বাড়াচ্ছিস! তুই কি জানিস না নাবিলের যা পছন্দ তা সে যেকোনো মূল্যে আদায় করে ছাড়ে? তবে কেন বার-বার কাছে টানছিস! কেন!
“ভাগ তো ভাই। মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”
“যাবো না। কী করবে, শুনি?”
নাবিল মুখ গম্ভীর করে কপালে হাত ঠেকিয়ে বসলো। নিরা হাতে থাকা লেবুর সরবতটা ওর সম্মুখে ধরে।
“মা’কে মিস করছো তো? জ্বর অসুখটা এমনই। কেবল মা’কে মনে করার ছুতো। ফুপ্পি জ্বর হলে তোমার লেবুর সরবত বানিয়ে দিতো, আজ না-হয় আমিই দিলাম। মনের অসুখটা অন্তত কমুক!”
নাবিল তীর্যক দৃষ্টিতে একপলক চেয়ে গ্লাসটা হাতে নিয়ে বিনা বাক্যে সবটুকু সরবত শেষ করলো।
মনে মনে হতাশ শ্বাস ফেলে। মনের অসুখ সারানোর কৃত্রিম প্রচেষ্টা করছে মেয়েটা। সাপ হয়ে দংশন করে আবার নিজেই ঝাড়পোঁছ করার মতো ঘটনা!
“হয়েছে? উদ্ধার কর আমায় এবার। যা ফুট।”
নিরা ভেঙচি কেটে শেষ বারের মতো কপালে হাত ছোঁয়াল।
“ঔষধ খেয়েছিলে?”
“হুম।”
“জ্বর হলে তোমায় কেমন ইনোসেন্ট লাগে, নাবিল ভাই। আহারে, মুখটা একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে।”
বলেই পূনরায় ঠোঁট টিপে হাসলো নিরা। নাবিল চাইলো একপলক। হিংসে হচ্ছে খুব। রাগও হচ্ছে। কারো দূর্দশা দেখে একটা মানুষ এতো সুন্দর করে কেন হাসবে? ইচ্ছে করলো ওর ঠোঁটজোড়ায় তালা ঝুঁলিয়ে দিতে। সুহাসিনীর স্নিগ্ধ হাসির ইস্তাফা টানতে।
নিরা ঘরটা একটু সময় নিয়ে গোছালো যাওয়ার আগে। দেখতে লাগছে সদ্য বিয়ে হওয়া সাংসারিক কাজে ব্যস্ত নববধূর মতো। নাবিলের ইচ্ছে করলো ঘরটা পূনরায় এলোমেলো করে দিতে। এতোটা এলোমেলো, যতোটা করলে নিরার কাজ এই জনমেও ফুরোবে না। ইচ্ছে করলো,হাত দু’টো শক্ত করে ধরে আবদারি স্বরে বলতে, ‘আজ সারারাত আমার পাশে বসে হাসতে পারবি ,নিরু? তোর হাসির শব্দে বড্ড আরাম পাচ্ছি বিশ্বাস কর! আমার মনের অসুখ কেবল এই হাসিতেই সারতে চাইছে।”
কিন্তু বললো না। মনের কথা মনে রেখেই চাপা পড়ে রইল।
“জ্বর হয়েছে বলেই কী চিরতার মুখে আজ এতো মিঠা কথা?”
নিরা ওর খোঁচাটা ধরতে পারলো।
“বলা যায়।”
“বাহ! তুচ্ছ অসুখের দেখছি ক্ষমতা ভালোই। তবে আজন্ম এই অসুখ-বসুখ নাহয় না-ই সারুক। কিংবা দেখা দিক ছয় রুপে, ছয় ঋতুতেই।”
নিরা ভ্রু কুঁচকে চাইলো। কথাবার্তা আজ একটু বেশিই অদ্ভুত বলছে লোকটা। নিরা ঝুঁকে এসে বলে,
“মিস্টার নাবালক, ঘুমিয়ে পড়ুন। মাথার তার কয়েকটা ছিঁড়েছে বোধহয়। রেস্ট নিন,ঠিক হয়ে যাবে। আর প্রয়োজন হলে অবশ্যই ডাকবেন।”
নাবিলের দৃষ্টি মোহাবিষ্টের ন্যায় স্থির। নিরার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। গ্লাসটা পাশে রেখে কম্ফোটারটা ঠিকঠাক গায়ে জড়িয়ে দিলো। নাবিল কী ভেবে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলো আবার। হচ্ছে টা কী আজ তার সাথে! পরিচিত আমিত্ব আজ এক তুচ্ছ রমণীর সম্মুখে এতো সহজে হার মানবে! কোন দৈব বলে? কী তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা?
“নীর!”
নিরা থমকায়৷ এই সম্বোধন নিরার পরিচিত না। এ কী নামে ডাকছে নাবিল ভাই ওকে? কন্ঠে কী যেনো একটা আছে। কিছু একটা তো আছে। স্পষ্ট টের পেলো তা। নিরা ছোট্ট করে জবাব দেয়, “হু।”
“তুই শাড়ী পরে আর কখনোই বাইরে বের হবি না।”
নিরা ঘাড় ঘুরিয়ে চায়,” কেন?”
“এমনি।”
নিরার সহজ স্বীকারোক্তি,” আচ্ছা, বের হবো না।”
এক চিলতে গর্বিত হাসলো নাবিল। তা কেবল সে-ই দেখলো। নিরা প্রস্থান নিলো। সাথে রেখে গেলো একটা দীর্ঘ অতৃপ্ত রাত আর কপালে ওর উষ্ণ কোমল ছোঁয়া। সে-ই রাতে নাবিলের আর ঘুম হলো না। হবেই বা কী করে? জলজ্যান্ত একটা মানুষের ধ্বংস ডেকে এনে তাকে আবার সেবা-শুশ্রূষা করা হচ্ছে? এতো নাটক কী করে করিস, নিরু! কী করে পারলি এই অবলার এমন নগ্ন ক্ষতিটা করতে? তুই বড্ড পাষাণ! ক্ষতিই যখন করেছিস তো আরেকটুখানি না-হয় পাশে বসতিস! ক্ষয়ক্ষতির হিসেব শুনতিস! আরেকটু ছোঁয়াতিস কপালে তোর নরম হাতটা। খুব কী ক্ষতি হতো,বল?
নাবিল কম্ফোটারটা ভালোভাবে জড়িয়ে বিমোহিত হাসলো। কানের কাছে কেউ এসে ওর দশাকে বেঙ্গ করে বেশ রসিয়ে রসিয়ে গাইছে,
“আর এভাবেই নরম বালিশে
তোমার ওই চোখের নালিশে
বেঁচে থাক রাতপরীদের স্নান
ঠোঁটে নিয়ে বেঁচে থাকার গান….”
চলবে।