গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ৯
#নাজমুন_নাহার
‘ এয়ারপোর্ট’ একটি এমন প্রস্থানদ্বার, যেখানে আবেগ ছড়িয়ে থাকে প্রতিটি পদক্ষেপে। কেউ সেখানে প্রিয়জনকে বিদায় দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু লুকায়, আবার কেউ বা বহুকালের প্রতীক্ষার পর প্রিয় মুখ ফিরে পেয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসে যায়।ভালোবাসা আর বিদায়ের এক অদ্ভুত সংযোগস্থল এই জায়গা।
“হি ইজ সো হ্যান্ডসাম। দেখ, কালো ড্যানিম জ্যাকেটে একেবারে মাখন লাগছে! দাঁড়ানোর স্টাইল। শিটটট! হাউ ম্যানলি রে! আমি ডিসটার্ব দোস্ত।”
পাশেরজন অসন্তোষ নিয়ে চাইলো। মনে মনে খানিক বিরক্ত।উটকো ঝামেলা সব।
“দোলা, স্কিপ ইট৷ সুন্দর ছেলেদের ভাব বেশি থাকে। পাত্তা দিবে না। আর যদি কমিটেড হয়? তখন?”
দোলার ঠোঁটে নাছোড় হাসি।
“সো হুয়াট? ট্রাই মেরে দেখতে তো সমস্যা নেই। যদি পটে যায়, সোজা বিয়ে।”
“তোর বয়ফ্রেন্ড আছে, রোহানকে ধোঁকা দিস না বেইব।”
“জাস্ট কিডিং, বাট আমার একটু লাইন মারতে ইচ্ছে করছে।”
“ভেরি ফানি। দোস্ত, আমরা আমাদের ফ্রেন্ডকে রিসিভ করতে এখানে এসেছি, দ্যিস ইজ নট রাইট টাইম। রেন্ডমলি এমন উইয়ার্ড প্লেসে তুই অচেনা একটা ছেলেকে লাইন মারবি, ইটস সিমস সো লেইম। ছেলেটা ছেছড়া মনে করবে। এন্ড, আর ইউ গন্না প্রপোজ হিম?”
দোলার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।
“ঠিক প্রপোজ না, একটু বাজিয়ে দেখি? কী বলিস?”
পাশের জন হতাশ শ্বাস ফেলে। ভেতরে ভেরতে গোপন বিরোধিতায় যুদ্ধ-বিগ্রহ চলল তার। মনে মনে হিংসেও হচ্ছে। তবে মুখে প্রকাশনা না চালিয়ে কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে চেয়ে হুট করেই প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করে সহমতসূচক চোখ মারলো। বান্ধবীর আস্কারা পেয়ে পূনরায় দোলা দৃষ্টি ফেলে কয়েক কদম দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষটির দিকে। পাখির মতো চঞ্চলতা ভাবভঙ্গিতে অথচ এক দেখায় ঘায়েল হয়ে যাওয়ার মতো সুদর্শন৷ চলন-বলন আকর্ষণ করছে ভীষণ।
এয়ারপোর্টের এরাইভাল টার্মিনালে হাতে সাদা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাবিল। খানিক পরপর ঘাড় বাঁকিয়ে কাকে যেনো খুঁজছে। সাথে সাগর। হাতের কাগজে লাল রঙের মার্কার প্যানের কালিতে বড় বড় ইংরেজি অক্ষরে লেখা, “NILOY BABY, NABIL IS HERE”
হাতঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে পূনরায় গেইটের দিকে চাইলো। অপরিচিত এতো লোকমুখের ভীরে নিলয় ভাইয়ের দেখা নেই৷ অথচ এতোক্ষণে তার এসে পড়ার কথা। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো। আশেপাশে চেয়ে কতো রকমারি গল্পই না দেখছে। কেউ প্রিয়জনকে বিদায় দেওয়ার শোকে নাক টেনে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তো কেউ আবার কাছের মানুষকে কাছে পাবার আনন্দে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। কিন্তু ভাই কোথায়? নাবিলের বেইবিটা কোথায়?
“এক্সকিউজ মি!।”
অপরিচিত নারীকন্ঠে চেতনার বেঘাত ঘটে। নাবিল কৌতুহলবসত পাশ ফিরে চায়৷ অল্পবয়সী একজন তরুণী ভীষণ বিনয়ী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর পানে। ঠোঁটে অজানা হাসি। ভেসভুসায় অতিরিক্ত মডার্ন ধাঁচের। কপালে ভাজ ফেলে নাবিল। পাশে এতো খালি জায়গা পড়ে থাকতেও মেয়েটার এমন ঘেঁষে দাঁড়ানোর অর্থ বোধগম্য হলো না।
“জ্বি বলুন।”
“আপনি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন? মানে, আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ আসবে?”
“আমার ভাই আসবে।” নাবিলের সহজ কন্ঠ।
“কিছু মনে না করলে আমি কি আপনার পাশে, আই মিন এইখানটায় দাঁড়াতে পারি? আমারও ফ্রেন্ড আসবে ইউএসএ থেকে। একা একা দাঁড়িয়ে বোরড হচ্ছিলাম। মনটাও ভালো নেই। আমরা চাইলে কথা বলতে পারি যতক্ষণ না আমাদের কাঙ্ক্ষিত লোকেরা আসছে। আই হোপ, আপনি মাইন্ড করছেন না।”
নাবিল মনে মনে বিরক্ত হয়। উপরে উপরে তাচ্ছিল্য করে হাসে। এসবে সে অভ্যস্ত। এদের সাইকোলজি বোঝা খুব কঠিন নয়। এটেনশন সিক করতে চাইছে মেয়েটা। চোখ দু’টোই বলে দিচ্ছে তা। মনে মনে প্রবল রাগ জমলেও চেপে গেলো সেসব। মেয়েটা যে আকার-ইঙ্গিতে ওকেই লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখছিল তখন থেকে তা এখন ঠিকি স্পষ্ট হলো। এমন কতো কতো ব্যক্তিত্বহীন রমণীরা যে তাদের একাকিত্বের গল্প বলে সহানুভূতি নিতে আসল সেসব ভোলার অবকাশ নেই। অতি কুৎসিত পদ্ধতি তাদের।
তবে অসহ্য লাগে তার। নারীজাতের এমন নোংরা অধঃপতন বড়োই দৃষ্টিকটু। তার ঘরেও তো মা নামক একজন নারী আছে।আছে খালা, মামি,চাঁচি, কাজিন বোনেরা। এদেরকে তো কখনোই এমন করতে দেখেনি নাবিল। আধুনিকতার নামে এই সমাজের বেহায়াপনা মোটেও প্রসংশনীয় নয়। এতে তাদের সম্মানের জায়গাটুকু ক্ষীণ হয়। নষ্ট হয় কোমলতা।
মেয়েটা উত্তরের আশায় চেয়ে দাঁত বের করে কেমন লাজুক ভঙ্গিতে হাসছে। নাবিল বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়। অসহ্য লাগলো সে-ই হাসি। মনে মনে বলে, ” ছেছড়া ছেছড়া! শ্বশুর আব্বা লাগি তোর? নাতি-নাতনীদের মুখ দেখার আবদার করেছি? এমন ভ্যাবলির মতো আকামের শরম পাওয়ার কী আছে?”
নাবিল ভ্রু জরায়। খানিক দূরত্ব টেনে ম্যাকি হেসে দৃঢ় গলায় বলে,
“দাঁড়িয়েই যখন পড়েছেন তখন আর সভ্যতা দেখিয়ে পারমিশন চাওয়ার প্রয়োজন দেখছিনা। আমার বাপের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলে নাহয় নাকচ করার উপায় থাকত। যেহেতু সাইনেজে বড় করে ” হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর” লেখা, তা-ই আর চাইলেও আপনাকে কিছু নগ্ন তেতো কথা শুনাতে পারবো না। তবে অনুরোধ করতে পারি। আম্মাজান আর বউজান ব্যতিত বাদবাকি সকল নারীসঙ্গে এলার্জি আছে। সরে যেতে বলছি না, তবে নিরাপদ দূরত্ব মেপে দাঁড়াতে পারেন।”
মেয়েটা চরম অসন্তুষ্ট হয়, সাথে অবাকও।” আপনি ম্যারিড!”
নাবিল মাথা উপরনিচ করে, “জ্বি। নির্ভেজাল বিয়ে।”
রাজ্যের অসন্তুষ্টি চোখে-মুখে তার, সাথে ব্যথিত হয় হৃদয়। “ম্যারিড তো কী হয়েছে? আমি তো আর আপনার কোলে চড়ে বসছি না। পাশেই দাঁড়িয়েছি। এইটুকুতে মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার কথা না।”
নাবিল চোরের মতো ফিসফিস করে বলে,”এইযে সাথে একটা গোয়েন্দা দেখছেন? সম্পর্কে সে আমার শালা। কাজকারবারও এক্কেবারে শালার মতোই। পরনারীর সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়েছি শুনলে বোনের কানে লাগাবে। এসব শুনলে তার শ্রদ্ধেয় বোন ওরফে আমার সুইট সিক্সটিন বউ আমাকে মারবে। রাতে ঘরে ঢুকতে দিবে না। আপনার কারণে একজন অবলা নববিবাহিত পুরুষ ঘরের বাইরে রাত কাটাবে ব্যাপারটা কেমন মানবতাবিরোধী কাজ হয়ে যায় না?
“সুইট সিক্সটিন মানে! আপনার ওয়াইফের বয়স ষোলো?”
“জ্বি।”
“মশকরা করছেন?”
“জ্বি না। বউ নিয়ে কখনোই মশকরা করি না। কেবল এই এক জায়গাতে আমি সক্রেটিস কিংবা আইন্সটাইন লেভেলের সিরিয়াস।”
“একটা ষোলো বছরের মেয়ে বিয়ের বোঝে কী?
“সে তো যখন বিয়ে করেছিলাম তখন ষোলো ছিল। এখন নাইন্টিন, আদর করে বলি সিক্সটিন। তবে ঠিকি ধরেছেন। প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতো না। বড্ড জ্বালাতন করতো। আদর্শলিপির মতো করে ধরে ধরে শেখাতে হয়েছে। বলা যায়, বউকে কোলেপিঠে করে বড় করেছি। এখন সে মাশাল্লাহ সবই বুঝে, এমনকি আমাকেও বোঝায়। ছাত্রী থেকে শিক্ষিকা আর নাবালিকা থেকে সাবালিকা হয়ে উঠার হিরন্ময় প্রমোশন। সবই অভিজ্ঞতা ব্যাপার, বুঝলেন?”
মেয়েটা নাক-মুখ বাঁকিয়ে আগাগোড়া চাইলো৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে অপ্রত্যাশিত উত্তরে দারুণ বিরক্ত সে। সমানতালে দুঃখী। এতো সুদর্শন ছেলে কি-না এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলল? পৃথিবীটা এতো নিষ্ঠুর কেন!
সাগর এতোক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো। মনে মনে গগন কাঁপিয়ে হাসলেও ভাইয়ের অভিয়নয়কে রিয়ালেস্টিক করার জন্য নির্লিপ্ত রইল। মেয়েটা যেতেই দমিয়ে রাখা হাসি প্রকাশ্যে এনে বলে,
“আমাকে সত্যি সত্যি শালা বানাই ফেললে আপত্তি করবো না। দুলাভাই হিসেবে খাসা আছো।”
নাবিল বাঁকা চোখে চেয়ে বিশ্ব জয় করা হাসল।
তোকে আমার ভবিষ্যৎ বউয়ের পাতানো ভাই বানিয়ে ফেলবো যা। শালা হিসেবে তুইও খাসা।”
সাগর মুখ বাঁকায়। মুখে বিরক্তি নিয়ে মিনমিন করে বলে,”আমার কি বোনের ঠাডা পড়সে? পাতানো ভাই হতে যাবো কোন দুঃখে? পরীর মতো বোনটারে চোখে লাগে না তোমার?”
কিন্তু মুখে বলল,
“আছে নাকি কেউ?”
নাবিল মাথায় চাট্টি মারল।”থাকলেও কেন তোকে বলতে যাবো? লাভগুরু সাজিস?
সাগর মাথা ডলতে ডলতে বলে,
“শুনো ভাই,আমাদের মতো অল ইন ওয়ান ভাই-ব্রাদার থাকলে প্রেম-প্রনয়ে সুবিধা ভালো। প্রেমিকার ভাই বানিয়ে শালার সার্ভিস নেওয়া যায়। ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট।”
“প্রেম-প্রনয় শুরু করলে কোনো শালার সার্ভিসের অপেক্ষায় থাকবো মনে হয়? সোজা কাজী অফিস থেকে বাশর ঘরে।”
“কোন প্রেমিকার চর্চা হচ্ছে, প্রেমিক পুরুষ?”
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ বুঝতেই নাবিল ফট করে ফিরে চাইল। আগন্তুক ঠোঁট কামড়ে হাসছে মিটিমিটি। পরনে কালো প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট ইন করে পরা। চুলগুলো পরিপাটি করে পিছন দিকে গুছিয়ে রাখা। চোখে কালো সানক্লাস। মুখে স্বভাবসুলভ সহজ হাসি। শ্যামবর্ন মুখেও বিপুল সতেজতা। আভিজাত্যভাব লেপ্টে আছে সারা মুখে। খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়িগুলো অল্পস্বল্প ছাঁটাই করা। হাতে কালো সিলভার কালারের ঘড়ি। নাবিল চোখ বড় বড় করলো। নাবিলের মতিগতি বুঝতে পেরে নিলয় তড়িঘড়ি করে সরে দাঁড়ায়। নাবিল তবুও ছাড় দিলো না। এক ঝটকায় জড়িয়ে ধরল ওকে। ছোট্ট শিশুর মতো শক্ত করে ধরল।
“ব্রোওওওওওওও! বেইবিইইইই! তুমি কোথায় ছিলে এতকাল? আমার জন্য পরান পুড়ল না ভাই তোমার?”
নিলয় ওর ধরার ধরনে পেছনে পরে যেতে নিয়েও সামলে নিলো নিজেকে।
“ছাড় হারামি! মানুষ উল্টাপাল্টা মনে করবে৷ আমি তোর প্রেমিকা না।”
নাবিল ফট করে ছেড়ে সরু চোখে চাইল।
“তুমিই তো আমার প্রথম প্রেম, প্রথম প্রেমিকা।”
কিছু মনে করার ভঙ্গিতে পূনরায় বলে,”এতোক্ষণ যা যা বলেছিলাম শুনে ফেলেছ সব?”
“এ টু জেট।”
নাবিল সাগরের পানে অসহায় মুখ করে চাইল।
“তোকে শালা বানাতে গিয়ে আমার পুরোনো প্রেমিকা হারাতে বসবো মনে হচ্ছে।”
নিলয় ফিক করে হেসে ফেলল। কাঁধে হাত রাখল ওর। কন্ঠে উৎকন্ঠা নিয়ে বলে, “কেমন আছিস ভাই তুই?”
নাবিল ভেতরের অস্থিরতা লুকানোর পায়তারা করছে। মুখে কৃত্রিম দুষ্টুমি টেনে বলে, “খারাপ থাকার দোয়া করো নাকি? তুমি নাই বলে দেবদাস হয়ে যাবো ভাবলা ক্যামনে? নাবিল অলওয়েজ বিন্দাস থাকে।”
নাবিল গাড়ির জানালার দিকে মাথা করে নিলয়ের হাটুতে পা দু’টো রেখে বাচ্চাসুলভ ভঙ্গিতে ফোনে গেমস খেলছে। নিলয় সেদিকে একপলক চায়৷ তার ছোট্ট কিশোর নাবিলটা আজ প্রাপ্তবয়স্ক যুবক। ‘ভাই ভাই’ বলে ডাকা দস্যি ছেলেটার বাহ্যিক অস্থিরতা একইরকম দেখালেও, কোথাও বোধহয় একটা ফাঁকা ব্যাপার রয়েই গিয়েছে। কোথাও কিছু একটা নেই নেই লাগছে। কী নেই? পরিবর্তনটা কিসের? দূরন্ত শৈশব? রমনার গাছতলার বাদামের আড্ডা, একই স্কুলে পড়ার সুবাদে স্কুল পালানোর দিনগুলো, আর নাকি জুম্মার দিনের নামাজের পর রকিব ভাইয়ের দোকানের তেহারি? নাকি একটা হারিয়ে যাওয়া প্রানবন্ত বয়স? কোনটা নেই?
বয়সে তিন বছরের বড় নিলয়। তবে একত্রে দাঁড়ালে বয়সের ফারাক বোঝার উপায় নেই৷ দু’জনকে দেখতে প্রায় একইরকম লাগে৷ চেহারায় খুব মিল। একসাথে কোথাও গেলে কেউ কেউ এক মায়ের পেটের দুই ভাই ভেবে বসে থাকে। নিলয়ের গায়ের রঙটা একটু শ্যামবর্ন। যদিও এই রঙটাই ওকে মানায়। তুলনামূলকভাবে নাবিলের গায়ের রং অনেকটা উজ্জ্বল। তবে লম্বায় দু’জনই ছয় ফিট, দুই ইঞ্চি।
“বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে কিনা তোদের?”
নাবিল ফোন থেকে মুখ তুলে তীক্ষ্ণ চোখে চাইল। কথার অর্থ বুঝতে পেরে হতাশ শ্বাস ফেলে হাত দিয়ে গলায় ছুড়ির মতো ইশারা করে বুঝালো, বাড়ি গেলে মামা গলা কাটবে।
“আমি আসলাম কোন চুল ছিঁড়তে? ভরসা নেই আমার উপর?”
নাবিল মাথা উপরনিচ করে।
“কালকেই নিরাকে নিয়ে ঢাকায় রওনা হবি। এতোদিন বাইরে থাকাটা মানুষ ভালো চোখে দেখবে না। মামার ক্ষোভ বাড়ার আগেই কনভিন্স করতে হবে। তোদেরকে বাড়িতে নিয়ে তারপর মিরার ব্যবস্থা করতে হবে। প্ল্যান আছে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মিরার শশুর বাড়িতে একটা চক্কর দিয়ে আসার।”
নাবিল তীক্ষ্ণ চোখে চায়।
“মিরাকে নিয়ে পেরা খেও না। যা খেল দেখালো, বাপরে। তবে জামাই একটা পাইসে গ্রিন ফ্লাগ। একদিন না একদিন ঠিকি মানবে হিটলার মামা।”
নিলয় হেসে মাথা ঝাঁকায়।
“সেদিন বিয়েটা করে ফেললে মন্দ হতো না, কী বলো? সন্ন্যাসীর মতো দৌড়ঝাঁপ আর ভাল্লাগে না।”
“তোর মতো গরুর সাথে নিরার বিয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে। নিরাকে আমরা দেখেশুনে ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দেবো এবার।”
নাবিল হু হা করে হাসে।
“আমাকে অবজ্ঞা করলে তোমাদের আদরের ভেলকির কপালে গরুই জুটবে, মিলিয়ে নিও।”
নিলয় রাগে না। রং উত্তরে ওর কাঁধে হাত রেখে হাসে। হাসিতে শব্দ নেই, আছে চমৎকার আকর্ষণশক্তি।
“ভাই, তুমি এমনে হাসবা না-তো। ছেলেদের হাসি সুন্দর হওয়া ঘোর অন্যায়। মেয়ে না হইতে পারায় আফসোস লাগে। পরান যায় জ্বলিয়া টাইপ দাউদাউ হিংসাও হয়।”
নিলয় গরম চোখে চাইলো। নাবিল ঠোঁট টিপে হাসি সংবরণ করার চেষ্টা করে বলে,
“বিয়ে করো, ভাই।”
নিলয় শুনেও শুনলো না। নাবিল ক্যাঙ্গারুর মতো লাফিয়ে উঠে অনুনয়ের স্বরে পূনরায় বলে,
“একটা করো।”
নিলয় কপালে ভাজ ফেলে চাইলো। নাবিলের মুখভঙ্গি অত্যন্ত সিরিয়াস ধাঁচের। যেনো বিরাট সুপরামর্শ দিয়ে ভাইয়ের জীবন ধন্য করতে যাচ্ছে।
“তুই কয়টা করবি?”
“এভাবে লুক দিবা না বিগ ব্রো। চরিত্রহীন মনে হয়? চারটার বেশি একটাও করবো না, তোমার বউয়ের কসম।”
“শুধুই চারটা? আই ওয়াজ এক্সপেক্টিং মোর।”
নাবিল চিন্তায় পড়ল। কৃত্রিম উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“এতো সতিন দেখলে তুমি সইতে পারবে? দুঃখ হবে না?”
নিলয় গরম চোখে চায়। দুম করে লাত্থি কষল ওর কোমড়ে। নাবিল হাসতে হাসতে সিটে হেলান দেয়। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। হঠাৎ শান্ত হয়ে তাকায় নাবিল।
“বলে ফেল কিছু বলতে ইচ্ছে হলে।”
“আমার চোখের ভাষা দেখছি এখনও ভালোই বুঝো।”
নিলয় না চেয়ে হাসে। নাবিল সময় নিয়ে শ্বাস ফেলে।
“কাউকে আজকাল বেহুদাই খুব বেশি মিস করি ভাই৷ মিস বলতে, এক মুহূর্তের দূরত্বও সহ্য হয় না, যেমন এখন হচ্ছে না। একটা ছোট্ট সর্বনাশী মুখ ইদানীং আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। একদিন…এমনকি কয়েক ঘন্টাও তাকে না দেখলে পাগল পাগল লাগে। প্রাণটা যুদ্ধ-বিগ্রহ করে বেড়িয়ে আসতে চায়। আমার মনে হয়, ও আমাকে বশ করেছে ভাই, তাবিজ করেছে। কী যেন লাগে, কেমন কেমন একটা লাগে। ইটস হার্ড টু এক্সপ্লেইন। ম্যা বি,.. ম্যা বি,আম লস্টিং মাইসেল্ফ ইন হার আইস! ধীরে ধীরে একজোড়া মলিন চোখে স্বেচ্ছায় নিজেকে হারাচ্ছি।”
নিলয়ের দৃষ্টি শান্ত। ঠোঁটে উচ্ছাস করা হাসি, “হুম…চিন্তার বিষয়। নাম কী?”
নাবিল মাথা ঝুঁকায়। দৃষ্টি এলোমেলো রেখে শূন্যে চায়। “বলবো, শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। তার দিক থেকে অনুভুতিটা একইরকম মনে হলে, সে-ও আমায় একই উন্মাদনা নিয়ে চায় বুঝলেই বলে দেবো। তাকেও, তোমাদেরকেও।”
নিলয় চোখ ঘুরিয়ে চায়। “ওয়ান সাইডেড?”
নাবিল কেমন করে একটা হাসে, ” হু। বাট শি ইনফ্লুয়েন্সড মি টু লাভ হার ফার্স্ট। শি ফোর্সড মি ভাই। আই নিড হার ভেরি বেডলি।”
নিলয় রহস্য করে হাসে। “পাখি হাতছাড়া হওয়ার আগে বিয়ে করে ফেল। আমি আছি তোর সাথে। আদায় করে নিতে না জানলে প্রতিযোগি বাড়বে। ছিনিয়ে নেওয়ার লোক বাড়বে। প্রিয় কিছু হারানো ভীষণ ব্যথার। হারাতে দিস না।”
শেষের বাক্যটা জপার সময় নিলয়ের কন্ঠে কী যেনো একটা ছিল। বোধহয় প্রিয়মানুষ হারানোর তীব্র যন্ত্রণা!
—
ভার্সিটির করিডরে দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। প্রানবন্ত ভাবটা আর নেই তার মধ্যে। চারিদিকটা আজকাল কেমন জনমানবহীন শূন্য লাগে৷ কোথাও একটু স্বস্তি মিলবার অবকাশ নেই। পৃথিবীটায় বহুদিন ধরে বহু দোটানায় জরাজীর্ণ। ঝাপসা লাগে সব। মনের মধ্যে হাজারও উচাটনতা, হাজারও প্রশ্ন। কাকে শুধাবে সেসব?
বিনা অনুমতিতে চোখের কোটর পাড় করা পানিটুকু মুছে ফোনের স্ক্রিনটা অন করলো। ওয়ালপেপারে চোখ বুলিয়ে ম্লান হাসল। কেমন নেশাধরানো মায়ার চাহুনি নিয়ে চেয়ে আছে লোকটা। দৃষ্টিতে কেবলই অপ্রতিরোধ্যতা। ছবিটা বর্ষা তুলেছিল দাদির চল্লিশার দিন। সেদিনও নাবিল ভাইয়ের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। রঙটা তাকে খুব মানায়। ছাঁদের প্যান্ডেলে গেস্টদের খাবার বাড়ার মুহূর্তে চুপিসারে ছবিটা তুলেছিল বর্ষা। ওকে ছাঁদের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডেকে নাবিল বলেছিল,
“এদিক-ওদিক না ঘুরে বসে পড়লেই তো পারো।”
“আমি এতো লোকের ভীরে খেতে পারবো না, ভাইয়া।”
“ঘরে পাঠিয়ে দেবো?”
“পরে খাবো।”
“পরে আবার কী? বেলা কতো হলো খেয়াল আছে?বাড়ি ভর্তি কতো লোক। ঘুরাঘুরি করো না। ঘরে যাও, কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আরাম করে খাও।”
একবার ঈদের দিন বিকালে আসলেন নাবিল ভাই। যদিও তারপর থেকে প্রতিবারই ঈদের দিন বিকালে তিনি আসেন দাদুকে দেখতে। তবে সেদিন ছিল প্রথম। বর্ষা কেবলই রেডি হয়েছিল বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে বের হবে বলে। নিচে নেমেই ঈদের চাঁদটাকে সেদিন বিকালে দেখা। সবুজ রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়েছিলেন তিনি। নিচে নামতেই অজানা কৌতুহলে পা থমকে যায়। নাবিল ভাই উল্টো পিঠ হয়ে বসেছিলেন। পুরুষালী চওড়া পিঠের মালিককে চিনতে অসুবিধা হলো না বর্ষার। বর্ষার জীবনে তুমুল প্রেমের বর্ষণ নামানো সেই মানুষটা সেদিন ফিরে তাকানো মাত্রই বর্ষার পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যায়। ওর বুকে তান্ডব মাতিয়ে লোকটা সেদিন কতো সহজ স্বরে বলেছিল,
“আরেহ বর্ষণ যে, কোথায় যাচ্ছো?”
মানুষটার সাথে কখনোই দু,এক মিনিটের আলাপন হয়না বর্ষার। টুকরো টুকরো সংলাপ। এতেও প্রাণ খুঁজে পায় মেয়েটা। শরীর বেয়ে শিহরণ বয়ে যায় লোকটার একটা ডাকে। ভীষণ লাজুকলতায় মিয়িয়ে যায় মেয়েটা।
বর্ষার ধ্যানমগ্নতা কাটে। তবুও প্রশ্নটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। ওর জড়তার কারণ বোধহয় সেদিন আচ করতে পেরেছিল শাহিনা। ওর হয়ে তিনিই উত্তর করেন,
“বান্ধবীদের সাথে টাউনহলের দিকে ঘুরতে যাবে মনে হয়। কী রে সেখানেই যাবি তো?”
বর্ষা বড়মার দিকে চাইল। পরিবর্তে দেখলো জ্বলজ্বল করতে থাকা এক টুকরো আশার আলো। বড়মা যদি সেদিন জানতেন, পৃথিবীর সব নিয়ম বাড়ির বড়রা পাল্টাতে জানে না, সব স্বপ্ন চাইলেই পূরন হয়না, তবে বোধহয় সেদিন ওমন কোমল দৃষ্টিতে আশা দেখাতেন না। বড়মাটা বড্ড বোকা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ষা। অস্থির লাগছে খুব। কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে কী মনে করে ডায়েল করলো বাড়িতে। নিরার ফোনে।
“হ্যালো নিরা, কী করছো?”
নিরা একা একা বোর হচ্ছিল। বর্ষার ফোন পেয়ে চমকায়।
“তোমার বাগানে সময় কাটিয়ে আসলাম। এতরকমের ফুলগাছ কোথায় পেলে?”
বর্ষা হাসে।
“আরও ছিল, অযত্নে মরে গিয়েছে। আচ্ছা শোনো না, একটা কথা বলার ছিল।”
“বলো।”
“কিছু খাবে তুমি? আমি কিছুক্ষণ পরই ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরবো, কিছু খেতে ইচ্ছে হলে বলো।”
“কিচ্ছু খাবো না আমি। তুমি সোজা বাসায় আসো, আমার একা একা বোর লাগছে।”
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। বর্ষার ভয় হচ্ছে। সত্যিটা বললে যদি ভুল বোঝে নিরা?
“ইয়ে নিরা, আমি বোধহয় নাবিল ভাইয়ের মতো কাউকে একটা দেখলাম ধর্মসাগরপারের দিকে। সাথে একটা মেয়ে ছিল। আমি নিশ্চিত না ওটা উনিই কি-না, তবে পেছন থেকে দেখে এমনটাই মনে হলো। উনার কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে? তুমি জানো এ বিষয়ে?”
নিরা বিভ্রান্ত হয়। এমন লুকোচুরি টাইপ প্রেম করার মতো মানুষ তো নাবিল ভাই না।
“তুমি সিউর উনাকেই দেখেছো? আমি তাকে যতোদূর জানি, আজ অব্দি একটাও প্রেম করেনি। করলেও লুকিয়ে রাখার মতো ছেলে নাবিল ভাই না।”
“এমনটাই তো মনে হলো।”
নিরা চিন্তায় পড়ে, তবুও আত্নবিশ্বাসী স্বরে বলে, “ফুপ্পি তার ছেলেকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছে। কোনো সম্পর্ক থাকলেও সেটা লুকানোর মতো স্ট্রিক্ট পরিবেশ নাবিল ভাইয়ের নেই। আমার মনে হয় তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
বর্ষা আমতাআমতা করে, “ওহহ, তাহলে বোধহয় ভুল দেখেছি। একইরকম দেখতে পৃথিবীতে তো অনেক মানুষই থাকতে পারে। আমি বোধহয় তাদেরই একজনকে দেখেছি। ঠিক আছে, আমি চলে আসবো তাড়াতাড়ি। রাখছি।”
বর্ষার ঠোঁটে বিমোহিত হাসি। নাবিল ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড সম্পর্কে নিরার সহজ প্রতিক্রিয়াই বর্ষাকে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। আর কোনো বেড়িকেট রইলো না তবে।
—
“তোমাকে ভালোবাসতে বাসতে এই আকাশ
আমার কাছে আসে,
আল্পস পর্বতমালা উঠে আসে ঘরে
ভূমধ্যসাগরের তলদেশে বসতি বানাই।
এই তোমাকে ভালোবাসতে বাসতে আমি
পৃথিবীকে সুস্থ করে তুলি ”
আবেগি ধরণীতলের এক নির্লিপ্ত মানবী হয়ে বেঁচে থাকাটা বড়োই আফসোসের৷ প্রনয়ের শহরে কাউকে বুক ভাঙা কান্না নিয়ে না চাওয়াটাও আফসোসের। গানের সুরে তাকে ভালোবাসছি। চিঠির পাতায়, মনের গহীনে বছরের পর বছর লিখে যাচ্ছি, আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু এই ভালোবাসাটা ঠিক ভালোবাসার মতো উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। এই ভালোবাসাটা যে হৃদয়মাঝারে সমুদ্র আছড়ে পড়ার মতো ভালোবাসা হওয়া চাই। হওয়া চাই ধ্বংসাত্মক প্রেমের মতো সুতীব্র৷ দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলার মতো হওয়া চাই। দিবারাত্রি মনের গহীনে প্রেমানন্দলন হওয়া চাই। নিঃশ্বাস পৃথিবী থেকে মুছে গেলেও যেনো লোকমুখে প্রচলন থাকে সে প্রেমের। না হোক রোমিও-জুলিয়েট কিংবা মমতাজ-শাহজাহান। পৃথিবীর এককোণে অবহেলায় পড়ে থাকা তুচ্ছ প্রেম হোক, তবুও হোক। একটা প্রেমের মতো প্রেম, একটা ভালোবাসার মতো ভালোবাসা। আঁচলে শক্ত করে বেঁধে রাখার মতো অধিকার হওয়া চাই সে প্রেমে। কিন্তু আফসোস, নিরা সেসব তুমুল উষ্ণ অনুভুতির দেখা পায়নি আজও। তবে প্রত্যাশা, এমন একটা প্রেম নিরারও হবে। নিলয় ভাইকে নিরা একদিন পৃথিবীর সকল নারীসুলভ আবেগ ঢেলে ভালোবাসবে। লোকটার উপস্থিতি, তার তীক্ষ্ণ শান্ত চাওয়া একদিন ঘুম হারাম করবে নিরার নারীমনের। সেদিন শূন্য আকাশে চাঁদ আর তাঁরারা খেলা করবে। মনের বেরঙীন ফুলটার গায়ে লাল-নীল রঙ আসবে। পৃথিবীর সমস্ত কুয়াশা ভেদ করে উন্মুক্ত হবে এক অষ্টাদশীর কিশোর জীবনের প্রেম। ছন্দোবদ্ধভাবে এসব প্রাণচঞ্চল অনুভুতি প্রকাশ করারও দিন আসবে।প্রবল আনন্দ নিয়ে খেলা করবে ভ্রমর। সেদিন মহাদেব সাহার সুরে গর্ব করে নিরাও আবৃত্তি করবে,
“তোমাকে ভালোবাসতে বাসতে এই আকাশ
আমার কাছে আসে,”
বই পড়ছিল নিরা। চমৎকার উপন্যাসের বই। ঘটনা প্রায় শেষের পথে। গল্পের ক্লাইমেক্স এসেছে। ম্যাসেজের আওয়াজে ফোনটা ভাইব্রেট হয়। নিরা বিরক্ত হয়। সুন্দর একটা মুহূর্তে বেঘাত।
“কী করছেন,মিস মর্জিনা?”
নিরা ম্যাসেজ দেখে ভ্রু বাঁকায়। নাবিলের নাম্বার থেকে আসা ম্যাসেজ। অবাক কান্ড! সকাল সকাল কাউকে কিছু না বলে দুম করে বেড়িয়ে গেলো, দিন না পেরোতেই আবার ম্যাসেজ করে খোঁজ করছে, বাহ! অদ্ভুত পরিবর্তন তো গন্ডারটার। ইন্টারেস্টিং।
নিরা প্রতুত্তরের বদলে পাল্টা প্রশ্ন করে, “আছো কোথায়? কাউকে না জানিয়ে ভূতগ্রস্তের মতো দুম করে না-ই হয়ে যাওয়ার কাহিনী কী? প্রেমিকার সঙ্গে ডেটে গেলে বুঝি?”
অপর প্রান্ত থেকে তাৎক্ষণিক জবাব আসে,”আমাকে নিয়ে তো উদ্বিগ্নতা ভালোই দেখছি। কৌতুহল থাকলে বল, নেক্সট থেকে না-হয় বলে বলে সবকিছু করবো। গিন্নি সাজার খুব সখ?”
“গিন্নি সাজার সখ মানে! কোনো প্রয়োজন নেই আমাকে বলে বলে সন করার। এক আনাও কৌতুহল নেই তোমাকে নিয়ে।” সাথে মুখ বাঁকানো ইমোজি।
“এক আনা নাকি ষোলোআনা সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আচ্ছা কাজের কথা শোন, একটা সেলফি তুলে পাঠা তো। কাটছাট লাগবে না। এখন যেভাবে আছিস ওভাবেই।”
নিরা বিভ্রান্তি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ম্যাসেজটার দিকে। অনাকাঙ্ক্ষিত আবদার। ইদানীং এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ একটু বেশিই করছে। হলো কী লোকটার!
“কী হলো? এখনোও বসে আছিস কেন? ভাব দেখাচ্ছিস? একটা ছবি চেয়েছি বলে খুব দাম বেড়ে গেলো?”
নিরা গর্জে উঠে,
“তোমাকে ছবি দিতে যাবো কোন দুঃখে?”
“তোকে আকামের দুঃখ পেতে বলেছে কে? ভেটকিমাছের মতো ভেটকি মেরেই দে।”
“আমার ছবি দিয়ে কী কাজ?”
“কিডন্যাপারদের দিবো। একটা ভালো মেয়ে পাচারকারী চক্রের সন্ধান পেয়েছি। অতি অকেজো বস্তু হয়ে পৃথিবীতে পড়ে আছিস খামোখা। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, বেঁচে দেই।”
নিরা জবাব দেয় না। রাগে ফুঁসছে সে। নাবিলই আবার পাঠায় ম্যাসেজ।
“হ্যালো ম্যাডাম, মোটেও ভাববেন না আপনার বেদানা ফলের মতো মুখটা দেখার জন্য নাবিল এহসান মরে যাচ্ছে। এমন আজাইরা ভাবনা ভুলেও মাথায় আনবেন না। সাগরকে বলছিলাম, আম্মুর মতো তোর ঠোঁটের নিচেও একটা কালো তিল আছে। ব্যাটা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। ওকে বিশ্বাস করাতেই নিজের উপর জুলুম করে তোর ছবি দেখতে চাচ্ছি। এটিটিউড পকেটে রাখ আপাতত।”
সাথে হাত জোর করা ইমোজি। নিরা আর কথা বাড়ায় না। বিনাবাক্যে ছবি দিয়ে নেট অফ করে দেয়। মেজাজ চটল অত্যাধিক।
কত মিথ্যে বলতে হয় তোমার একটু দর্শন পেতে, প্রিয়া। কতো জেদ তোমার, পাখি। কতো যন্ত্রণা দিচ্ছ এই অবলাকে! এই দেখো এখনই কী হাল করেছো? কী হবে বাকি দিনগুলোতে আমার?
নাবিল প্রায় দশ মিনিট ধরে পলকহীন চেয়ে রইলো ছবিটায়। বিশেষ কিছু নেই ছবিতে। একটা রাগান্বিত পাখির গোমড়া মুখশ্রী, চেরি ব্লসম ফুলের মতো শুভ্রতা, একজোড়া আদুরে ঠোঁট, আর হিমালয়সম মায়া! এই ছোট্ট মুখটা খুব টানে ইদানীং। ভীষণ ভীষণ রকম টানে। সন্ধা হয়ে এসেছে প্রায়। নাবিল ফোনটা বুকের মধ্যে ছুয়িয়ে চোখ বুঁজে। চলতি গাড়ির হাওয়ায় চুলগুলো কপালের দিকে উড়ছে। ঠোঁটে স্মিত হাসি। সর্বাঙ্গে নবজন্ম নেওয়া উষ্ণ অনুভুতি। প্রেয়সীর সঙ্গে কল্পনায় মিছিমিছি একটা রোমাঞ্চকর মুহূর্ত তৈরি করা যাক তবে।
[চলবে]