গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১০
#নাজমুন_নাহার
আজই এহসান মঞ্জিল থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ছিল নাবিলদের। তবে ইশতিয়াক এহসানের জন্য হয়ে উঠলো না তা। প্রতিবারের মতোই উনার মান-অভিমানের কাছে হার মানতে হলো নাবিলকে। তাই যাওয়ার দিনক্ষণ আগালো আগামীকাল অব্ধি। বাড়িতে আবারও বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে ওদের বিদায় নেওয়ার বার্তার শোকে। ইশতিয়াক এহসান সকালের দিকে রাগারাগি করে বিদিগিস্তা অবস্থা। লোকটা বরাবরই এমন।কোনোরকমে আবারও বুঝিয়ে শুনিয়ে আগামীকাল ঢাকায় ফেরা নিয়ে রাজি করানো গিয়েছে তাকে। তবে মুখের কথায় প্রকাশ না করলেও নাবিলের বড় চাচাও অসন্তোষ কিছুটা। এরা অবশ্য প্রতিবারই যাওয়ার বেলায় বাংলা সিনেমার মতো আবেগি হয়ে পড়ে। বড় চাঁচির কান্নাকাটি, সাগর-বর্ষার বিষন্ন মুখ আর দাদাজানের কঠিন ভার মুখ, এসব নতুন কিছু না, নাবিল অভ্যস্থ।
আজ সকাল থেকে দেখা নেই বর্ষার। বাড়িতে ফিরলো সন্ধার দিকে। চোখ-মুখ ফুলেফেঁপে একাকার অবস্থা। বাড়িতে ঢুকেই সোজা দোতলায় পশ্চিমের ঘরটার দিকে ছুটলো সে। নাবিলের ঘরে। শাহিনা বেগম অবশ্য খেয়াল করলেন তা। হাতে কিছু একটা দেখে সন্দেহ স্পষ্ট হলো। নাবিলের জন্য উপহার কিনতেই বেড়িয়েছিল মেয়েটা। কোথাও বসে কেঁদেকেটে এসেছে বোধহয়।
নিরা দরজা খোলা পেয়ে মৃদু আওয়াজে টোকা দিলো নাবিলের ঘরের দরজায়। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। ভেতর থেকে তাৎক্ষণিক পুরুষালী ভারী কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে।
“দরজা খোলাই।”
বর্ষা ধীরপায়ে ঢুকলো। উঁকিঝুঁকি মারল কিছুক্ষণ। ঘরের ভেতরে, বারান্দায়, কোথাও নেই লোকটা।সে ভয়ে ভয়ে ডাকে,”আপনি কোথায়,নাবিল ভাই?”
নাবিল চমকানোর স্বরে সারা দেয়, “ওহহ তুমি? আমি ভেবেছিলাম নিরা।”
বর্ষা মৃদু উদাস হয়। বিষন্ন কন্ঠে শুধায়, “কোথায় আপনি?”
“শেভিং করছি। ওয়েট আ মিনিট,আসছি।”
বসে বসে পুরো ঘরটায় চোখ বোলিয়ে প্রসন্ন হাসে সে। অদ্ভুত সুন্দর একটা পারফিউমের ঘ্রাণ ভাসছে,সাথে নাবিল ভাইয়ের শরীরের পুরুষালী সুভাস। বিছানা, বালিশ, শার্টগুলো, সব এলোমেলো। অবশ্য, এসবই মানায় তাকে। বর্ষার এলোমেলো পুরুষ। বাথরুমের দরজাটা হাল্কা খোলা। না চাইতেও তার চোখ চলে যায় সেদিকে। ধোঁয়াটে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে দাঁড়ি শেভ করছিল নাবিল। পরনে শুধু একটা ট্রাউজার, শরীরটা ভেজা, জল টপটপ করে নগ্ন পিঠ বেয়ে পড়ছে। সে-ই লজ্জাহীন পানিটুকুও কেমন একটা নাটকীয় ভঙ্গিতে একটু একটু করে ঘাড় ছাড়িয়ে নিচের দিকে নামছে। মনে হচ্ছে, পাহাড়ের গা ছুঁয়ে হিমালয় থেকে আসা ঝরনার পানি নামছে অধঃস্থানে। পরম আদরে ছুঁয়ে দিচ্ছে কারো আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় পুরুষকে। পুরুষালি চওড়া পৃষ্ঠদেহের পেশীগুলো স্পষ্ট। দাঁড়ানোর ঢঙ আশ্চর্য আবেদনময়। যেন অনেকখানি যত্ন ঢেলে কেউ তার ক্যানভাসে এঁকে রেখেছে একটা নিখুঁত দেবমূর্তি। প্রিয় পুরুষের অজানা সৌন্দর্যের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ছে একটা শান্ত প্রকৃতির মেয়ের সর্বাঙ্গে। বর্ষা একটা শুষ্ক ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নেয়। কী লজ্জা! কী লজ্জা! বেহায়া শিহরণ! এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে এলো। তুমুল অস্থিরতায় ধুকপুক করছে ভেতরটা। ভেজা আলো আর সেই সুদর্শন অবয়ব মিলে এক ধরনের চুম্বকীয় মোহ তৈরি করল তার চোখে। নিরলস চোখজোড়া কিছু একটার তীব্র কামনা করছে। কাউকে ছুঁয়ে দেখার অসম্ভব বাসনা। শক্তপোক্ত বাহুতে গাল ছোঁয়াবার অভিলাষ! আছড়ে পড়ার স্বাদ জেগেছে তার চওড়া পিঠে। ছিহহ্! কী অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার জেঁকে বসছে মাথায়! নাবিল ভাইকে নিয়ে এতো কুরুচিপূর্ণ চিন্তা কী করে খেলল মস্তিষ্কে! লজ্জা আর অস্বস্তিতে শরীর কাঁপছে মেয়েটার৷ বসে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে আর এক মুহূর্তও। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বর্ষা। ঘোর বিপদজনক আচরণ করে বসবে আর কিছুক্ষণ থাকলে। তার বাড়ন্ত নারীত্ব এমন কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। নিজেই নিজের সঙ্গে বিদ্রোহ করে উঠলো। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শাসায় সে। কোনোমতে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি বিছানায় রেখে যত্রতত্র প্রস্থান নেয়। এখানে বসে থাকাটা যে ঝুঁকির। ভীষণ ভীষণ রকম ঝুঁকির!
বাথরুম থেকে বেড়িয়ে কাউকে দেখতে পায় না নাবিল। খাটে রেপিং পেপারে মোড়ানো কিছু একটা রাখা। উপরে ছোট্ট চিরকুট। হাতে নিলো চিরকুটটা নাবিল।
“দাদাভাইয়ের প্রাণভোমরার জন্য একটা ছোট্ট উপহার। উপহার ঠুনকো হলেও প্রেরকের অভিপ্রায় আর টুকরো টুকরো অনুভুতি বহিঃপ্রকাশের চেষ্টাটুকু ঠুনকো নয়। তবে রেপিং পেপারের ভেতরে স্থান পাওয়া ছোট্ট চিঠিটা বিশেষ। বিশেষ চিঠি নিয়ে বিশেষ অনুরোধ, প্রাপক যেনো সেটা এখন না পড়ে।”
রাতের দিকে চায়ের আসর জমেছে ছাঁদে। নাবিল-সাগর বসেছে অভারহেড ছাঁদের সিঁড়িতে। নিরা হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে রেলিঙের পাশ ঘেঁষে। বর্ষা আর শাহিনা বেগমও ছিলেন এগারোটা অব্ধি। প্রায় আধাঘন্টা সময় কাটিয়ে বর্ষা চলে যায় রুমে। তার নাকি এক, দু’দিন পর থেকেই ইনকোর্স পরিক্ষা শুরু হবে। শাহিনাও চলে যান ওর পিছুপিছু। নাবিল সকলের সামনে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি চিরকুট নিয়ে।
চোখ-মুখ শান্ত রেখে নির্জনে নিরিবিলি দাঁড়িয়ে আছে নিরা। পরিবেশটা অসম্ভব ভালো লাগছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে খানিক পরপর। বৈশাখের শেষের দিকে সারাদিনের ভ্যাপসা গরমের পর রাতের স্মিথ বাতাসটা প্রশান্তি এনে দেয় ধরণীতে। আকাশটাও ফকফকা পরিস্কার আজকে। বাতাসের সাথে ছাঁদের ফুলের গন্ধে নেশা ধরছে কেমন। আকাশে অজস্র তাঁরা। একটা দু’টো খসে পড়ছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আকাশজুরে বিচরণ করছে কোনোটা আবার। নাবিল চুপচাপ বসে গোয়েন্দা দৃষ্টিতে সবই দেখছিল এতোক্ষণ। তীর্যক চোখে নজরে নজরে রাখছে নিরাকে। নাহ, হজম হচ্ছে না। এমন শান্ত নদীর মতো ঠান্ডা পরিবেশ কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। এতো সুখ-শান্তি মেনে নেওয়ার মতো না। মুখে তালা লাগিয়ে কী এমন দিলদরিয়া ভাবনায় ডুম মেরেছে ফাজিলটা?
“নিরা!”
নিরা জবাব না দিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চায়। নাবিল ছাঁদের আমগাছটাকে দেখিয়ে বলে,”আম খাবি? কাঁচা আম?”
নিরা দু’দিকে মাথা দোলায়। লোকটা যে মনোযোগ পাওয়ার উদ্দেশ্যে কাঁচা আমের প্রসঙ্গ তুলছে তা-ও বুঝল।
বিরক্ত হয় নাবিল। মনে মনে ঠাটিয়ে দু’টো থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করলেও আপাতত সেসব ইচ্ছে দমিয়ে ঘোড়ার মতো লাফ দিয়ে নামলো ওভারহেড ছাঁদের সিঁড়ি থেকে। পাশে দাঁড়াল নিরার। নিরা পাশ ফিরে চাইলো না। নিরার দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের পানে চেয়ে নাবিল শুধায়,
“মন খারাপ?”
“উহু।”
“নেতিয়ে আছিস কেন তবে?”
নিরা জবাব দেয় না। বেশ কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। নাবিল দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
“আমার এখানে ভীষণ ভালো লাগছে, নাবিল ভাই। বাড়ির ছাঁদটা এতো সুন্দর! এইযে দেখো, এখান থেকে কী অদ্ভুত সুন্দর দেখায় আকাশটাকে। কতো বিশাল! চাঁদ, তাঁরা, সবই সুন্দর। ফুলগুলোকে দেখো না, বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে একটু আধটু দুলছে, ভালো লাগছে না?”
নাবিল নিরবে মাথা উপরনিচ করে চায় নিরার উচ্ছ্বসিত মুখে। অথচ চাওয়ার কথা ছিল নিরার দেখানো চাঁদ, তাঁরা আর ছাঁদের দুলতে থাকা ফুলগুলোর দিকে। মনে মনে হাসে নাবিল। এতোক্ষণ কি-না এদের সঙ্গে ভাব জমাচ্ছিল বেয়াদবটা! আরেকটু পাশাপাশি দাঁড়ায় সে। চায় নিরার ঝিলচোখে। একরাশ আনন্দ খেলা করছে প্রকৃতিপ্রেমী রমণীর চোখে-মুখে।
“সমস্যা নেই, ভবিষ্যতে থাকতে এখানে পারবি চাইলেই। সব তোর মর্জি মোতাবেক হবে।”
নিরা চোখ বাঁকায়, “হাহ্?”
নাবিল ফটাফট প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে, “আমার একটা শখ কী জানিস?”
নিরা হতাশ শ্বাস ফেলে। বুঝল, এই লোক ওকে একটু নিরবতা পালন করতে দিবে না। তার অভিধানেই নেই সভ্যতা নামের শব্দটা। “কী?”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে কেমন নাটকীয় ভঙ্গিতে নাবিল বলে,”বলবো? নাহ থাক। শখের কথা যে কাউকে শেয়ার করতে হয় না, নজর লাগে। অন্য কাউকে করলে যেমনতেমন, তোকে শেয়ার করলে কুদৃষ্টি লাগার চান্স শতভাগ।”
“আমার নজর খারাপ?”
“শুধু খারাপ না, খারাপ ট্রিপল স্কয়ার। তুই তো মানুষ ভালো না। দৃষ্টি ধ্বংসাত্মক কারো ভালো দেখলেই তো বুকে দাউদাউ হিংসে হয়। চোখে বিষ জমে, আপনাআপনি মুখ ভেঙ্গানি আসে, ঠিক না? তোর চোখে আমি আমার জন্য শুধুই আগুন আগুন হিংসা দেখি। তন্ত্রমন্ত্র জানিস না-কি? পীরবাবা টাইপ প্রফেশনে আছিস?”
নিরা বিরক্তি নিয়ে চাইলো।
“এইযে মনে মনে গালাগালি শুরু করেছিস ইতোমধ্যেই। তোর লিভার, ফুসফুস, শিরা-উপশিরা সব আমার জানা।”
নিরা মুখে চ সূচক শব্দ করে আবার দৃষ্টি ফেরায় অন্য কোথাও। সাগর এসে দাঁড়ায় ওদের কাছাকাছি। মনে মনে অসন্তোষ হয় নাবিল। যদিও মনোযোগ পরিপূর্ণ ফোনের গেইমে সাগরের। নাবিল ওর কাঁধে হাত রাখে এদিকওদিক ঘাড় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিরার উদ্দেশ্য বলে,”তোর নামের শেষের পদবীতে এহসান যুক্ত করলে মন্দ লাগবে না বুঝলি? নিরাআআআআ এহসাননন! হুমমমম, খাপে খাপ মানানসই। শুনতেই কেমন মধুর লাগে।”
“তো?”
নাবিল দুই হাত বেয়াম করার ভঙ্গিতে ছড়িয়ে এদিকওদিক চেয়ে বলে, “তো আমার কী? ভাল্লাগবে এটাই জানালাম। শুনতে এলিট ক্লাসের মনে হয়। তবে এই পদবী পেতে হলো তোকে এমন কাউকে বিয়ে করতে হবে, যে ব্যাটার সারনেইমেও এহসান আছে। রেয়ার ব্যাপার। পাবি কই এমন মামুর ব্যাটা?”
সাগর হো হা করে হাসে। যেনো বিরাট বোকার মতো কথা বললো নাবিল ভাই। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার ভঙ্গিতে পেট চেপে বলে, “ভাই,তোমার নামের সারনেইমেও তো এহসান আছে। মামুর ব্যাটা না হোক, ফুপুর ব্যাটা তো এক্সিস্ট করে?”
নাবিল হুট করেই বিস্মিত ভঙ্গিতে চাইলো ওর দিকে। মনে মনে সাগরটাকে ধরে একখান গরম গরম দু’টো চুমু খেতে ইচ্ছে করলেও মুখের নাটকীয়তা বজায় রাখলো। যেনো নতুন কোনো রহস্যের খোলাসা হলো। কিংবা ওর যুক্তি শুনে অসন্তুষ্ট নাবিল। কথাটা সে একদমই জানতো না, কিংবা আজই মনে পড়লো।
“বলিস কী! শিটটট! তাহলে তো হচ্ছে না। এহসান ক্যান্সেল।”
নিরা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়। লোকটার মুখে সবসময় যত অবান্তর আজগুবি কথাবার্তা। এক রাতে এই রেলগাড়ী কতক্ষণ চলবে, কে জানে।একটা মানুষ সারাটাক্ষন এতোটা জটলা পাকানো আলাপন কী করে করতে পারে! এর মাথায় কি এসবই চলে?
ওর গম্ভীর চাহুনি আর নিরবতাটুকু খেয়াল করলো নাবিল। নাহ, কেউ স্বেচ্ছায় তার প্রসঙ্গ তুলছে না। পাত্তাই দিচ্ছে না এরা। অপমানে হৃদয়টা কুঁকড়ে এলো। কী ভেবে নিজেই গলা ঝেরে আকর্ষণ দৃষ্টি করার ভঙ্গিতে বললো,
“আমাদের বংশে আর কোনো এহসান নাই রে, সাগর?”
সাগর মনে পড়ার ভঙ্গিতে কপালের কার্নিশে আঙ্গুল ঘষে। “আছে তো। একজন আছে।”
নাবিল শার্টের কলার ঠিক করে আত্নবিশ্বাসী ঢঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে বেশ আগ্রহ নিয়ে নির্দেশ দেয়, “অতি সম্মানের সহিত নামটা পেশ করে ফেল।”
সাগরও কম না। গলা খাঁকারি দিয়ে বেশ ভাবসাব নিয়ে বলতে আরম্ভ করল, “শ্রদ্ধেয় ইশতিয়াক এহসানের সুযোগ্য নাতি, এহসান বংশের একমাত্র গর্ব-প্রাণ-কলিজা-ফুসফুস-লিভার, নাবিল এহসানের সুযোগ্য চাচাতো ভাই, সাগর এহসান।”
নাবিল চট করেই সটান হয়ে চাইলো। মুখটা রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ইতোমধ্যেই। বিচ্ছুটা যে এমন কিছু বলে বসবে তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি সে। তার বিরুদ্ধে কুটিল ষড়যন্ত্র করছে এরা। একপলক অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে আকস্মিক লাত্থি কষল বেচারার কোমড়ে। সাগর তাল সামলাতে না পেরে পড়তে পড়তেও ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিপদ আশঙ্কা বুঝে পকেট থেকে গেইটের চাবি বের করে ছাঁদের দোলনার উপর রেখে কোনোমতে দৌড় লাগালো। শেষ রেহাই হলো না তবুও। নাবিল ছাঁদ থেকে ছোট্ট ইঁটের টুকরো কয়েকটা তুলে একটার পর একটা মারলো ওর দিকে। লেগেও যায় একটা। তবুও থামলো না ছেলেটা। বেচারা জানে, এই মুহূর্তে নাবিল ভাইয়ের নাগালে পড়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু।
চেহারাখানা কঠিন গম্ভীর করে পূর্বের স্থানে দাঁড়ায়। কারো হাসির শব্দে হুশ ফিরে নাবিলের। নিরা হাসছে। নাবিল সেদিকে মুখ আধার করে চায়। নিরার হাসি থামার নাম নেই তখনও। বিরক্ত হলো নাবিল। এভাবে হাসার হলো কী! পাগল-টাগল হলো নাকি মেয়েটা?
নাবিল ধমক মারার উদ্দেশ্য ওর দিকে চাইতেই পরম আবেশিত কিছুর দর্শন পেয়ে পরমুহূর্তেই থমকে যায় পৃথিবী। একজোড়া ঠোঁট হাসছে মাঘের কনকনে শীতের প্রথম প্রসন্ন হাওয়ার মতো। যে হাওয়ায় থাকে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো ঠান্ডা শিহরণ। বুকের মধ্যে ঝড় বইলো। হাই বোল্টেজের ঝটকা খাওয়ার ভঙ্গিতে দুলে উঠলো সর্বাঙ্গ। মনে হচ্ছে, হৃদমাঝারে একটা ছোট্ট পাখি ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ভীষণ অভিলাষে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবচেতন মস্তিষ্কে। চোখ দু’টোও আজ বাঁধ মানছে না। মানছেই না একেবারে। ওরা অক্লান্ত হয়ে পলকহীন জাগিয়ে রেখেছে নিজেদের। নিরা হাসছে। চোখের কোটরে উষ্ণ পানি জমেছে ওর। হাসছে জলরাশীর মতো চোখজোড়াও। কী দারুণ দৃশ্য সেটাও! তার ইচ্ছে করলো নিরার চোখের সবটুকু জল খুব যত্ন করে শুষে নিতে। নাবিল উপলব্ধি করলো, নিরাকে ও কখনো এভাবে হাসতে দেখেনি, কিংবা এটাই তার প্রথম বিচিত্র স্বর্গীয় সৌন্দর্যের দর্শন! সে খেয়াল করলো, হাসিতে বড্ড মানায় নিরাকে! অথচ, এই গোপন সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও জানা ছিল না নাবিলের। কী যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিল এতোগুলো বছর নিষ্ঠুর মেয়েটা। হায়ে আফসোস! সে কেবল নিরার ভ্রু জড়ানো একরাশ বিরক্তিমাখা চেহারাই দেখে এসেছে আজন্ম। কিন্তু আজ,… নাহ, এই হাসি তার দেখা উচিত হয়নি। আজ যে বড্ড লালসা জন্মাচ্ছে ওর হাসির উপর, গোলাপি ঠোঁটজোড়ার উপর। আজন্ম এই মুখটা দেখার কামনা-বাসনা করছে অবাধ্য মনটা। কিংবা ওকে পরম যত্নে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুকের মধ্যে। এই হাসি দেখার অধিকার কারো নেই, কারো না। মারাত্মক হিংসে হচ্ছে ওর নরম ওষ্ঠদ্বয়ের প্রতিও। কী নিবিড় আলিঙ্গন দু’টো গোলাপি ঠোঁটের। নাবিল খুন হলো দ্বিতীয়বারের মতো। এই মাঝরাত্তিরেও চাঁদের উজ্জ্বল হয়ে আছে ওর মসৃণ মুখটা। ছেলেটা আজ প্রথমবারের মতো খেয়াল করলো, নিরাটা অসম্ভব রূপবতী। হাসি, কন্ঠ, চোখ, ঠোঁট, থুঁতনির ছোট্ট তিল, সবই নিখুঁত। নিখুঁত সৌন্দর্য। নাক-চোখ-ঠোঁটের অবস্থানেরা একেবারেই যোগ্য স্থান পেয়েছে। ঠিক যেনো কোনো জাদুঘরে স্থান পাওয়া জাদুকরের যত্নে বানানো মানবমূর্তি। কোথাও এক টুকরো হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিলো নাবিলকে। কেউ জানান দিচ্ছে, তার জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝি শীগ্রই শুরু হতে যাচ্ছে। মনের মধ্যে বাজছে একটা সুমধুর গান,
“তোমার ভোলাভালা হাসি
আমার বুকের ভেতর ঝড়
তুমি চলতি ট্রেনের হাওয়া
আমি কাঁপি থরথর…”
চৈতন্য ফিরে নিরার আঙ্গুলের তুরিতে। চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে নিরা বলে, “হ্যালো মিস্টার নাবালক, কোথায় হারালেন? রাত-বিরেতে ধ্যান করছেন?”
নাবিল ঘোরলাগানো চোখে চায়। একবুক আকাঙ্ক্ষা বাসা বেঁধেছে মনে। একটা শ্বাস টেনে চোখ বুঝে হাসে সে। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে নিরার কপালে টোকা মেরে ফু দিয়ে সামনের চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে মোহময় কন্ঠে বলে, ” দ্যেয়ার আর সামথিং বিউটিফুল এবাউট ইউর স্মাইল- হোয়েন ইউ স্মাইল, ইভেন দ্য মুন গ্লৌস ব্রাইটার!”
নিরার পা দু’টো অগত্যাই থমকায়। বশীভূত হওয়ার ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সম্মুখে থাকা অপ্রতিরোধ্য চোখজোড়ায় কী যেনো একটা আছে। কন্ঠে মধু ঢেলে বাক্যদুটো জপল লোকটা! ভীষণ আবেদনম গলার স্বর! চোখজোড়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিরলস চেয়ে থাকে শুধু। অপলক দৃষ্টি বিনিময় হয় দু’জনের। ওর নাজেহাল অবস্থা দেখে নাবিল ঠোঁট কামড়ে হাসে। চোখের সামনে তুরি বাজিয়ে একই ভঙ্গিতে বলে, “হ্যালো মিস মর্জিনা, কোথায় হারালেন? ধ্যান করছেন রাতবিরেত?”
আঁতকে উঠার ভঙ্গিতে মৃদু কেঁপে উঠে নিরা। গায়ের ওড়নাটা আরেকটু ঠিক করে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই কেউ শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে আঁটকে ফেলে ওকে। নিরা জোরে জোরে শ্বাস ফেলে৷ ফিরে চাইলো আরেকপলক। নাবিলের ঠোঁটে অবাধ্য দুষ্টু হাসি। এলোমেলো চুলগুলো কপাল অব্ধি খেলা করছে বাতাসে। কন্ঠে নেশা মাখিয়ে পুরুষালি অব্যয়টি বলে, “আমার শখের ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে হয় না, মিস মর্জিনা?”
জবাব দেয় না সে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“আজ তোকে একটা ভালোবাসার গল্প বলবো। ঠিক গল্প না। একজনকে নিয়ে কিছু স্বপ্নের কথা শেয়ার করবো।”
“আমাকেই কেন বলতে হবে? নজর লাগবে না?”
নাবিল ঠোঁট টিপে হাসে। ওর চাওয়া, না চাওয়ার ধার না ধেরে নিজেই বলতে শুরু করলো পরম কোমলতা মিশ্রিত কন্ঠে। ব্যাপারটা তার কাছে বিশেষ সেটা বলার ধরনেই বোঝার উপায় থাকে। নাবিলের দৃষ্টি সুদুর বিশাল আকাশে।
“ভালোবাসার বহু দৃষ্টান্ত তো শুনেছিস, তাই না? ভালোবেসে রুমিও-জুলিয়েট জীবন দিলো, শাহজাহান দিলো প্রেয়সীকে তাজমহল, লাইলির প্রেমে সন্ন্যাসী হয়ে মজনুর মরনও হলো, শিরির জন্য ফরহাদের পাহাড় কাটতে চাওয়া, দেবদাস-পার্বতীসহ আরও কতো কতো হিরন্ময় ইতিহাস….! আমি সেসব কিছুই করতে পারবো না ভালোবেসে। না পারবো শাহজাহানের মতো তাকে তাজমহল করে দিতে, না পারবো ফরহাদের মতো পাহাড় কাটার বেকুবি করতে। বোধহয় জীবনও দিতে পারবো না রোমিওর মতো। আমি শুধু পারবো প্রাণঢালা ভালোবাসতে! পারবো নিজেকে সম্পূর্ণ উজার করে তার নামে সঁপে দিতে। আজ না-হয় পৃথিবীর এককোণে পড়ে থাকা সেই তুচ্ছ প্রেমিকের অভিলাষটুকুই শোন। অধমের ঠুনকো অথচ স্বর্গীয় কামনাটুকু শোন।”
কিছুক্ষণ থেমে হাসে নাবিল।
“নির্জন কোনো গ্রামে একটা বাড়ি করার ইচ্ছে আছে আমার। ঠিক বাড়ি নয়, খড়কুটোর কুঁড়েঘর। ইচ্ছেটা একেবারেই নতুন জন্ম নিয়েছে। বলার জন্য বলছি না, কাজটা আমি সত্যি করবো। একটা ভিটেমাটির বাড়ি। বাড়ির পেছনের দিকটায় ঘন জঙ্গল থাকবে, সামনের দিকটায় কারো নরম স্পর্শে রোপন করা ফুল গাছের বাগান। বাগান পেরিয়ে একটু সামনেই থাকবে একটা নব্বই দশকীয় পুকুর। আমার শখের বাড়িতে একটা শখের নারী বেলা-অবেলা গা ভেজাবে সেখানটায়। পরনে তার লাল-সাদার ছোপ ছোপ শাড়ী, পায়ে একজোড়া রূপার নুপুর। নগ্ন পায়ে যখন পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে সে উঠে আসবে? আমি ঘরের জানালা ভেদ করে পরম আবেশে দেখবো আবেদনময়ীর কমলস্নান শেষ করার দৃশ্যটুকু। ভেজা ভেজা শরীরে তাকে দেখতে লাগবে স্বর্গীয় কোনো অপ্সরা। আমি খুন হবো তার রুপে। নিজেকে হারাবো, উন্মাদ হবো, ছটফট করবো। আমার সেই ঘরে বেলা-অবেলা বৃষ্টি ঝড়বে ঘরের ছাঁদ ভেদ করে। একটা গোটা বৃষ্টির রাত আমরা নির্ঘুম কাটিয়ে দেবো। মুগ্ধতা ছড়াবে তার কথার তরে,চোখের মনিতে। মায়াবিনীর নারীসুলভ কোলে মাথা রেখে কেটে যাবে গোটা একটা দীর্ঘ আষাঢ়ের রাত। পৃথিবীর সকল কৃত্রিমতা ভুলে মাসে অন্তত দু,একদিন হলেও আমি তাকে উৎসর্গ করবো একটা অকৃত্রিম জীবন! আমাদের মাসিক দু,একদিনের ছোট্ট সংসার, ছোট্ট ছোট্ট সুখ! বিনিময়ে আমার অবাধ্য মাথাটা যেনো আজীবনের জন্য ঠাই পায় তার জ্বালাময় বুকে! আমি তার সকল ইচ্ছেগুলোকে আপন করে নেবো, আর সে করবে আমায়!”
নিরা অবাক হয়ে চায়। আশ্চর্য ব্যাপার! এসব তো তারই চীরকালের চাওয়া। মোহগ্রস্তের মতো সন্দিহান স্বরে শুধায় নিরা, “এসব ব্যাপারে তোমার আগ্রহ কবে থেকে? তুমি তো এমন তুচ্ছ কিছুতে মন দেওয়ার মতো মানুষ না, নাবিল ভাই? বৃষ্টি, কুঁড়েঘর, ভিটেমাটির বাড়ি, নব্বই দশকীয় পুকুর, এসবে ভালো লাগা খুঁজতে শুরু করলে কবে থেকে?”
নাবিল প্রসন্ন হাসে। খানিক ঝুঁকে ধীরকন্ঠে বলে, “যেদিন থেকে কারো প্রতি তুমুল প্রেম অনুভব করছি,সেদিন থেকেই! আমার প্রেয়সীরও এসব প্রিয়।”
হা হয়ে চোখের পলক ফেলে নিরা। ভ্রু বাঁকিয়ে অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তুমি প্রেম করছো?”
নাবিল জবাব না দিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। হাসিই উজাড় করে বলে দিতে সক্ষম সব।
“ফুপ্পি জানে?”
“উহু। যার সাথে করছি সে-ও জানে না।”
“খবর করাচ্ছি তোমার। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করা হচ্ছে? আর দুনিয়ায় সামনে সাজছো নিষ্পাপ,নাবালক? ”
নাবিল পকেটে হাত ঢুকিয়ে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে চায়। “করা খবর। দেশের শীর্ষ সংবাদপত্রে কিন্তু ছাপানো চাই তা। নাবিল এহসানের প্রেমকাহিনী বলে কথা! ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জেলায় জেলায় বিলিয়ে বেড়া। পারলে নিজের বাপকেও জানাস, আমারই সুবিধা তাতে। সাপও মরলো, আবার লাঠিও ভাঙ্গলো না।”
নিরা তীক্ষ্ণ চোখে চায়। ঘাঁটিয়ে দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা। দৌড়ে ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে শুধায়, “নাম কী? বলো না নাবিল ভাই! সত্যি বলছি, কাউকে জানাবো না, প্রমিস।”
নাবিল চোখের ইশারায় কাছে আসতে বলে। বেশ আগ্রহ নিয়ে কান পাতে নিরা। নাবিল ফিসফিস করে বলে, “সরাসরি না বলে হিন্টস দেই? দেখি, কতোটুকু সুবুদ্ধিতার পরিচয় দিতে পারিস। এতোক্ষণ যেসব শখের কথা বললাম? সেসব মূলত আমার নয়, তারই শখ। আমি কেবল তাকে তার শখগুলো উপহার দেবো।”
“এটা আবার কেমন হিন্টস? এভাবে বললে কী করে জানবো?”
“ওইযে, বুদ্ধির পরিক্ষা? তুই তাকে জানিস বলেই এসব হিন্টস দিলাম। আকাশ-পাতাল এক করে তল্লাশি শুরু কর এবার। খুঁজে বের করতে পারলে বড়সড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
নিরা মাথা চুল্কাতে চুল্কাতে কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে চায়। নাবিল হাঁটতে হাঁটতে শিষ বাজিয়ে মধুর সুরে গায়,
“শুধু তোমাকেই ভালোবেসে
তোমাকেই ভালোবাসব ভেবেছি শত যুদ্ধের শেষে!”
চলবে।