গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১৩
#নাজমুন_নাহার
আজকাল খুব ভোরে ঘুম ভাঙে ইফরানের। সকাল সকাল উঠেই চাচ্চুর সাথে প্রতিদিন হাঁটতে বের হয়। চাচ্চুর মতো ট্রাউজার পরে, ঢিলেঢালা গেঞ্জি পরে, পায়ে কেটস পরে এক্সারসাইজ করে সে-ও৷ আজ-ও তা-ই হলো। আসার পর থেকেই সে নিলয়ের সব কাজ খেয়াল করে। তার কথা বলার ধরন, হাঁটার স্টাইল, খাওয়ার মেন্যু, সবই অনুকরণ করে ছেলেটা। নিলয় ব্যাপারগুলোয় বেশ মজা পায়। বিচ্ছুটার সবকিছুতে কৌতুহল আছে। ভাবতে ভাবতে পেছনে ফিরে চাইলো সে। ইফরান দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত। নিলয় ওর দিকে মুখ করে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে হেসে বলে, “কী হলো ইয়াং বয়? থেমে গেলে যে? উই হ্যাভ টু ওয়াক মোর। কাম। চাচ্চুর মতো ইনার্জেটিক থাকতে হবে। আমার ভাতিজাকে ক্লান্ত হলে চলবে না, বি স্ট্রং।”
ইফরান হাঁটুতে ভর করে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার হাঁটা ধরে। হাসে নিলয়। এগিয়ে দেয় পানির বোতল। একটা বেঞ্চিতে বসে ওরা।
“তুমি কী এবরোডেও রেগুলার এভাবে হাঁটতে,চাচ্চু?”
নিলয় কাঁধে হাত রাখে ওর। “আরও অনেক কিছুই করতাম। দেশে আসার পর তোর দাদি পৃথিবীর তামান চর্বি খাইয়ে আমার ডায়াটের বারোটা বাজাচ্ছে।”
বিজ্ঞের ন্যায় উপরনিচ করে ইফরান। শুধায়, “ওখানে কি একা একাই হাঁটতে? আই মিন, আমার মতো সঙ্গ দিতো না কেউ?”
হাসল নিলয়৷ পরমুহূর্তেই ম্লান হয়ে আসে মুখটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্যে চায় সে। “ছিল একজন। সবকিছুতেই সঙ্গ পেতাম তার। যতদিন সাথে ছিল, জীবনটা ফুলের মতো স্বর্গীয় ছিল। সে আর এখন আমার সাথে নেই।”
“নেই কেন?” ইফরানের কন্ঠে কৌতুহল।
“জিজ্ঞেস করা হয়নি কেন নেই। হয়তো আর ভালো লাগে না আমাকে। কিংবা নতুন কারো সাথে হাঁটতে যায়।”
“ফ্রেন্ড?”
বুক চিরে ভারী ভারী শ্বাস বেড়িয়ে আসে নিলয়ের। পিঠে হাল্কা চাপর মারে ইফরানের। তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে, “হয়তো তার দিক থেকে বন্ধুই।”
“ডোন্ট ইউ হ্যাভ এনি গার্লফ্রেন্ড?”
বাঁকা চোখে চেয়ে হেসে ফেললো নিলয়। কেমন গুরুজনদের মতো প্রশ্ন করছে ছেলেটা। ইফরান তীক্ষ্ণ চোখে উত্তরের আশায় চেয়ে আছে তখনও।
“হাসছো কেন? আসলেই নেই?”
নিলয় বোতলের মুখ খুলে পানি খায়। মনে মনে হাসলেও উপরিভাগে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে, “ইউ আর টু ইয়াং টু আস্ক দ্যিস কুয়েশ্চন। তুমি ছোট মানুষ, এসব বোঝার বয়স হয়নি। বড়দেরকে দ্বিধাহীনভাবে যা-তা জিজ্ঞেস করতে হয় না। দ্যিস ইজ ব্যাড মেনার্স।”
ঠোঁট উল্টে নাক দিয়ে শ্বাস ফেলে ইফরান। মাথা ঝাঁকায় দু’দিকে।
“তুমি বুঝতে পারছো না৷ তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে কি-না সেটা না জানলে দাদি তোমার জন্য আরেকটা মেয়ে ঠিক করে ফেলবে। বাবা বলেছে, তোমার গার্লফ্রেন্ড থাকলে তার সাথেই বিয়ে করাবে, না থাকলে অন্য মেয়ে দেখবে। সো আই হ্যাভ টু নৌ।”
বিস্ময় নিয়ে চায় নিলয়। কন্ঠে বিস্ময়ভাব মিশিয়ে শুধায়, “কে বললো এসব তোমায়?”
“তুমি বাড়িতে আসার পর থেকেই তো আম্মু আর দাদি সারাদিন তোমার বিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে। আমি শুনেছি, কয়েক জায়গায় মেয়ে দেখাও শুরু করেছে গোপনে। এখন তোমাকে জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হওয়া বাকি।”
গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে নিলয়৷ মেজাজ বিগড়াচ্ছে তার। শুধুমাত্র এই কারণেই সে বাড়িতে আসতে চায়নি এতোদিন। এর চেয়ে বিদেশে বসেই চার দেয়ালে বন্দীদশায় জীবন কাটানো উত্তম ছিল। ফোঁস করে রাগ ঝারল নিজের উপর। উঠে হাত বাড়ায় ওকে ধরতে। ইফরান হাত ধরল চাচ্চুর। হাঁটতে হাঁটতে নিলয় বলে, “বড়দের কথায় কান দিতে হয় না। বড়রা কথা বললে তুমি ওদের আশেপাশে থেকে আর কখনও এসব শুনবে না। মনে থাকবে?”
ইফরান বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ায়। পূনরায় শুধায়, “তোমার সত্যি গার্লফ্রেন্ড নেই, চাচ্চু?”
নিলয় হাঁটতে হাঁটতে চায়। মনে মনে হাসি পাচ্ছে ব্যাপক। “আপাতত নেই।”
“শিটটট! তাহলে আমি বন্ধু বানাবো কাকে? জানো? আমার একটা ফ্রেন্ড আছে, ওর চাঁচি ওকে খুব আদর করে। চকলেট কিনে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ওর চাঁচি নাকি ওকে বন্ধু বানিয়েছে। আমারও ইচ্ছে তোমার বউয়ের সাথে বন্ধুত্ব করার। আমার কোনো ভালো ফ্রেন্ড নেই,চাচ্চু। তুমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করো প্লিজ!”
নিলয় শব্দ করে হেসে ফেললো ইফরানের অভিমান অভিমান মুখখানা দেখে। এমনভাবে আবদার করছে, যেনো দোকান থেকে একটা খেলনা কিনে দিতে হবে। কাঁধে চড়ায় ভাতিজাকে সে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ দু’জনের নানান রঙের কথায় অতিবাহিত হয়। ওরা খিলখিল করে হাসে, আবার দৌড়ায়।
—-
রাতুল লাজুক স্বভাবের ছেলে। শশুর বাড়িতে বলেকয়ে দু’দিনের বেশি তাকে কিছুতেই রাখা যাচ্ছে না। শশুরের গম্ভীর মুখ এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এই ব্যাপারটাও তাকে কিছুটা জড়তায় ফেলছে। আজ ভোরেই সে রওনা দিয়েছে ফেনির উদ্দেশ্যে। জয়নাল সিকদার বাহ্যিকভাবে নির্লিপ্ত রইলেও আমিনা বেগমের অভিমান-অভিযোগের শেষ নেই৷ কাজের ছুতো, এটা-ওটার বাহানা দেখিয়ে শাশুড়ীকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোনোমতে সে সিকদার বাড়ির চৌকাঠ ডিঙাতে সক্ষম হয়েছে। মিরা থাকছে কিছুদিন।
নিরা সকাল সকাল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে। সামনে তার ইনকোর্স। এই সময়টায় রেগুলার ক্লাস না করতে পারলে এক্সামে পিছিয়ে যাবে সে। আমিনা বেগম রান্নার কাজে ব্যস্ত। মিরা এটা-ওটা এগিয়ে দিয়ে মা’র কাজে কাজে সাহায্য করছে। কখনও কখনও নিজে নিজেই খুন্তি নাড়ছে। আমিনা আরচোখে মেয়েকে খেয়াল করছেন। মেয়েটার আচরণে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করছেন তিনি। শরীর স্বাস্থ্য কিছুটা বেড়েছে মিরার। চেহারা উজ্জ্বল হয়েছে অনেকখানি। চালচলনে গিন্নি গিন্নি ভাব। তিনি হাত ছোঁয়ালেন মেয়ের মাথায়। মাতৃস্নেহের স্পর্শে মিরার মনটা ভরে উঠে আবেগে। শৈশব ফিরে পায় মা’র ছোঁয়ায়। সহসাই মা’কে জড়িয়ে ধরে সে। কতোদিন পর আম্মুকে সে এভাবে ধরলো। আম্মুর শরীর থেকে ভেসে আসা মা মা সুভাসটা কতোদিন পর নাকে নিতে পারলো মিরা। আহ্লাদে আটখানা হয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মেয়েটা। এই তুমুল আবেগময় দৃশ্যটা নিরা দেখলে হিংসেতে আজ সারাদিন ভাতই খেতো না মেয়েটা। গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো ঘরের বারান্দায় অথবা কোনো এক কোনে। কন্ঠে অভিমান মিশিয়ে বলতো, “চুপিচুপি বড় মেয়েকে আদর করো তুমি? আমার সাথে এতো বড় প্রতারণা! আই হেইট ইউ।”
সেসব মনে করে হাসলেন আমিনা। চুলে হাত বুলিয়ে মেয়েকে শুধালেন, “শশুর বাড়ির লোকেরা ভালোবাসে তো তোকে, মা?”
মিরা মা’কে আরও কোমলপ্রাণ জড়িয়ে ধরলো। সুখ সুখ আনন্দ তার ঠোঁটের হাসিতে। “ওরা সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসে, আম্মু। আমার শাশুড়ীটা একদম তোমার মতো। বোকা বোকা। তবে অনেক আদর করে আমাকে। একদম মেয়ের মতো আগলে রাখেন। ইচ্ছে হলেই উনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি আমি। যেমনটা তোমায় ধরতে পারি। কোনো সংকোচ,জড়তা ছাড়াই।”
স্মিত হাসলেন তিনি। “জামাই সোহাগ করে তো তোকে?”
লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে আসে মিরার। মা সম্ভবত জাতিরা এমনই। সরাসরি স্বামীর ভালোবাসার কথা জিজ্ঞেস করবে না। ইনিয়েবিনিয়েই জানতে চাইবে।
মিরা মা’র প্রশ্নের উত্তরের বদলে আদরমাখা সুরে বলে, “তুমি আমাদের জন্য কতো ভাবো, আম্মু। সবসময়, সব বিপদে ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছো ছোট থেকেই। আব্বুর কতো ঝাড়ি খেয়েছো আমাদের অপরাধ ঢাকতে। তুমি হেল্প না করলে আমার জন্য সবকিছু কঠিন হয়ে যেতো। আব্বুকে বুঝানো কঠিন হয়ে যেতো তুমি পাশে না থাকলে। তুমি অনেক ভালো, আম্মু। তুমি আছো বলেই পৃথিবীটা এতো সুখের!”
হাত বুলালেন মাথায়। মিরা মা’র পানে চায়। মুখভঙ্গি পাল্টে হয়ে যায় চিন্তিত। আবদারি সুরে বলে, “একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করার ছিল তোমার সাথে। ব্যাপারটা সিক্রেট।”
তিনি চোখ বড় বড় করে সন্দিহান দৃষ্টিতে মেয়ের পেটের দিকে চাইলেন। মাতৃমন কিছু একটা বলছে। মিরা মা’র মতিগতি বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে ফেলে।
“ওসব না। এতো তাড়াতাড়ি তোমাকে নানু ডাক শোনাচ্ছি না। আমার পড়াশোনা বাকি এখনও।”
“তাহলে?”
আমতাআমতা করে মিরা। “কথাটা আসলে নিরার ব্যাপারে,আম্মু।”
সন্দিহান দৃষ্টিতে চাইলেন আমিনা। চিন্তা হচ্ছে এবার।
“বুঝিয়ে বল।”
“আম্মু, নিরা একজনকে ভালোবাসে।”
কোনোপ্রকার ভনিতা ছাড়াই সরাসরি কথাটা বলে ফেলল মিরা। চোখের মনি আপনাআপনি বেড়িয়ে আসতে চাইলো আমিনার। যেনো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো ব্যাপার। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি। হাত-পা কাঁপছে অস্থিরতায়। মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলেন মেয়ের পানে।
“ও নাবিলকে বিয়ে করতে চায়নি এই কারণেই। তুমি তো কিছুই জানো না, আম্মু। ও পাঁচ বছর ধরে একজনকে ভালোবাসে। কিচ্ছু বুঝতে দেয়নি কাউকে।”
আমিনা দেয়ালে হাত ভর করে দাঁড়ালেন। স্থির দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না আর। মিরা চেয়ার টেনে বসালো মা’কে। মাথায় হাত রেখে শরীরের ভার ছেড়ে দিলেন চেয়ারে আমিনা।
“তুমি কিন্তু বেশিই রিয়েক্ট করছো। এমন কাঁপা-কাঁপি করার মতো কিছুই হয়নি।”
এতোক্ষণের স্নেহময় মুখটা মাটিতে মিশে উৎপত্তি হলো তীব্র ক্ষোভের। সহজ-সরল আমিনা এবার রনমূর্তি রুপ ধারণ করলেন। গর্জে উঠে বললেন, “তোরা আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবি না,তাই না? দিবি না থাকতে? তোদের বাপ হিটলারের যন্ত্রণায় পুরোটা জীবন আতঙ্কে আতঙ্কে কাটলো, এখন হিটলারের মেয়েরাও তারই অনুসারী হয়ে বসে আছে। আমি বেঁচে আছি কেন মাবুদ! ম*রে কেন যাচ্ছি না আমি!”
আহাজারি করতে করতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি। মিরা মা’র অবস্থা দেখে কপাল চাপরায়। “আরেহ বাবা, কাঁদছো কেন তুমি? কাঁদার কী হলো? কথায় কথায় বাপকে টানবে না তো।”
“বাপকে টানবো না? হয়েছিস তো বাপের মতোই। আমার জীবনটাকে নরক না বানালে তো হচ্ছে না তোদের।”
মিরা যথেষ্ট নরম হয়ে সামলাচ্ছে মা’কে। “তুমি চুপটি করে বসো তো। শুনো আগে।”
হাত ঝাড়ি মারলেন তিনি। গর্জে উঠে বললেন, “ছাড় বেয়াদব, কথা নেই তোরা সাথে। আসুক ছোটটা আজকে। ওর চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাম যদি উদ্ধার না করি, তো আমিও আমার বাপের মেয়ে না।”
মিরা ঠোঁট টিপে হাসে।
“তোমাকে বাপের মেয়ে হতে হবে না। তুমি আমার মেয়ে।”
গললো না দুই মিনিটে জমে যাওয়া বরফের পাহাড়। তিনি চোখ দ্বিগুণ লাল করে চেয়ে ধুপধাপ পা ফেলে ঘরের দিকে ছুটলেন। মিরা দাঁত দিয়ে নোখ খুটলো। মারাত্মক খেপেছে মা জননী। দৌড়ে গেলো পিছু পিছু।
“পুরো কথাটা শুনবে তো?”
“কী শুনবো? আমার উপর পৃথিবীর সব বিপদের ভার ফেলতে পারলেই তো তোর বেঁচে যাস। এই কথা তোর বাপের কানে গেলে কী হবে বুঝতে পারছিস, মিরা? বাসায় আগুন লাগবে। এই লোক আমার ঘুম হারাম করবে এবার।”
“উফফ! লাগবে না আগুন৷ তুমি কথাটা শেষ করতে দাও।”
ফোঁসফোঁস করতে করতে চাইলেন মেয়ের পানে। মিরা মা’র পাশে বসে। পিঠে হাত বুলায়।
“মাথা ঠান্ডা করো। এতো প্যানিক খাওয়ার মতো সংবাদ দিচ্ছি না।”
“আর একটাও বাড়তি কথা না বলে পুরো কথা শেষ কর।”
মা’র নিরব হুশিয়ারীতে ভীত হয় মিরা। একটা শুষ্ক ঢোক গিলে চেয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। হুট করেই নির্জনতার বাঁধ ভেঙ্গে বলে ফেলল, “নিলয় ভাইকে কেমন লাগে তোমার?”
তীর্যক দৃষ্টিতে চাইলেন আমিনা। মিরা মনে মনে মিটিমিটি হাসছে। কৌতুহলে চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো আমিনার। অবাক কন্ঠে জপলেন, “নিলয়! নিরা নিলয়কে ভালোবাসে?”
হাসে মিরা। মাথা উপরনিচ করে সে।
“বলিস কী! আমাদের নিলয়? হায় আল্লাহ!”
মিরা চোখ টিপে মা’কে। ” মেয়ের জামাই হিসেবে পাত্র কেমন,আম্মু? তোমার ছোট মেয়ের চয়েজ দেখেছো?”
খুশিতে শব্দ করে হেসে ফেললেন তিনি। হাসল মিরাও। প্রায় একঘন্টা ধরে মা’কে সবকিছুই বুঝিয়ে বললো মিরা। আমিনা এবার চরম খুশি। খুশিতে কেঁদেও ফেললেন বার কয়েক। তার বড় ননদের ছোট ছেলেটা পাত্র হিসেবে লাখে একটা। সে-ই ছেলে কি-না নিরাকে পছন্দ করে? তা-ও পাঁচ বছর ধরে! অথচ কাউকে কিচ্ছুটি বুঝতে দেয়নি বাদরগুলো।
নিলয় যথেষ্ট আদর্শ একটা ছেলে। তার মেয়েটাকে ওর হাতে তুলে দিতে পারলে নিলয়টা ঠিকি সামলে নিবে নিরাকে। এমন একটা সোনার টুকরো ছেলেকে মেয়ের জামাই করতে পারাটা তো পরম সৌভাগ্যের কথা আমিনার জন্য। সিদ্ধান্ত নিলেন, আজই স্বামীর সঙ্গে কথা বললেন এই ব্যাপারে তিনি। নিলয়টা যাওয়ার আগেই চার হাত এক করবেন।
—–
“নাবিল ভাই,
মুঠোফোনে বার্তা প্রেরণের যুগে এসে যারা এখনও চিঠিপত্রের মাধ্যমে মনের ভাবটুকু প্রকাশ করে, বুঝতে হয়– তারা সম্ভবত মারাত্মক কথার জড়তায় ভুগছে। এই ধরনের মানুষরা লিখে যতো সহজে মন খুলতে পারে, মৌখিক উপায়ে তা পারে না। আমার ব্যাপারটাও কিছুটা সেরকমই। যার দরুন, নিজের সাথে বহু তর্ক-বিরোধ করে শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। লিখেই ফেললাম একটা কাঁপা কাঁপা হাতের চিঠি।
আপনি তো জানেন, আমি ছোটবেলা থেকেই ভীষণ লাজুকলতা। এই এক আড়ষ্টতা কারণে আজীবন ঘরকুনো হয়ে থাকলাম। স্কুল-কলেজ ডিঙিয়ে ভার্সিটিতে পা মারালাম, কিন্তু আমার এই জড়তার কারণে ঠিকঠাক বন্ধুর মতো বন্ধু জোটাতে পারিনি। যারা আছে, কেবলই নামের বন্ধু। জানেন? বড়মা ছাড়া আমি পৃথিবীর কারো সঙ্গেই হয়তো নিঃসঙ্কোচে নিজেকে খোলা বইয়ের মতো উপস্থাপন করতে পারিনি। এমনকি আম্মু-আব্বুর সাথেও না। আমি জানতাম, আমি সম্ভবত এমনই। ইন্ট্রোভার্ট আর আনসোশ্যাল। আমার এই ভুলটা ভাঙ্গলো সেদিনই, যেদিন বাড়িতে দাদির মৃত্যুর শোকে অমাবস্যা নেমে এসেছিল৷ ভুলটা ভাঙ্গলো বাড়ির এককোণে বসে থাকা একটা বিষন্ন মুখ দেখে। চোখে-মুখে খুচরো বিষাদ অথচ কী উজ্জ্বল তার চাহুনি। বাড়ির পশ্চিমের জারুল গাছটার নিচে বসেছিল সে। মানুষটার শুভ্র পাঞ্জাবী আর শুভ্র চেহারাখানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কী উজ্জ্বল একটা মুখ! কেঁদেকেটে দু,তিনবার অজ্ঞান হলাম, আবার জ্ঞান ফিরে সেই ভারাক্রান্ত স্থির মুখটাই দেখছি। সেদিনই ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা। তাকে দেখার পর থেকে আমি জানলাম, বর্ষা নামক বোবা মেয়েটার কারো সাথে রাত জেগে কথা বলতে ইচ্ছে হয়, মাইলের পর মাইল কারো হাত ধরে দেশ থেকে দেশান্তরী হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয়, গোটা একটা কৃত্রিম জীবন এক বুক আনন্দ নিয়ে খুব অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে৷ ওড়নার কার্নিশে কারো কপালের ঘাম মুছে দিতে ইচ্ছে হয়। জানেন,আমার ছোট্ট কিশোরী মনটা সেদিনই প্রথম আলোর দেখা পেলো!
সেদিন তার পাশে বসতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব। তার মেঘে ঢাকা চোখ দু’টো দেখে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, “আপনি প্লিজ একটু ঠোঁট উল্টে কাঁদুন,নাবিল ভাই। দাদির সঙ্গে সময় না কাটাতে পারার আক্ষেপটুকু চোখের বৃষ্টিতে প্লিজ ঝেরে ফেলুন৷ আপনার বিষন্ন মুখটা দেখতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। মন খারাপের গল্পগুলো আমাকে নির্দিধায় বলুন। আমি রোমাল এগিয়ে দেবো, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেবো। প্লিজ একটু কাঁদুন!”
আপনি কাঁদলেন না। জড়বস্তুর মতো ঠায় বসে রইলেন। শোকের বাড়িতে শতগুণ শোক নেমে এলো আপনার নিরব দুঃখে। আমার ভীষণ মায়া হয়েছিল আপনার জন্য। কেন হয়েছিল সেটা বোধহয় আজ ভালোই বুঝতে পারছি।
এর পর আর-ও কয়েকবারই এহসান মঞ্জিল আপনার দেখা পায়। আমার লজ্জা, আড়ষ্টতা, আর পালাই পালাই ভাবটা দিন দিন বেড়েই চললো। আপনাকে দেখামাত্রই আমার যে কী হয়–জানি না। শুধু বুঝি, আমি খুব লজ্জা পাই! আবার কাছেও চাই আপনাকে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তা-ই না?
চিঠির পৃষ্ঠা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমার হৃদপিণ্ডের উঠানামাও। ভারী আশ্চর্য কথা! আপনি চিঠিটা পড়ছেন ভেবেও কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠছি। চিঠিতে আপনার হাতের ছোঁয়া লাগছে ভেবেও কতো এলোমেলো শিহরণ আমার! আচ্ছা, চিঠিটা পড়ার সময় আপনি কী করছেন, নাবিল ভাই? শুয়ে আছেন– নাকি বারান্দায় বসে? কিংবা আমার কলমে আঁচড় লাগা শব্দগুলো আপনার চেহারার প্রতিক্রিয়া কেমন পরিবর্তন করেছে? আপনি কি বিস্মিত? নাকি অনেকটা রাগ হচ্ছে? তা হোক। আপনার রাগ না সইতে পারলে এ আবার কেমন ভালোবাসলাম?
হা হা। দেখুন না? বলি না বলি না বলেও কতো অপ্রাসঙ্গিক কথার ঝুলি খুলে বসেছি। এতোকিছুর মধ্যে এটাও ভুলেই গেলাম, আমি যে আপনাকে লিখে কথা পাঠাচ্ছি। কেন যেনো মনে হচ্ছে, আমি ঠোঁট নাড়িয়ে বলছি এসব, আর আপনি গালে হাত ঠেকিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন সামনে বসে। কখনও কখনও কপালের খুচরো চুল সরিয়ে দিচ্ছেন আমার! হয়তো এমনটা কামনা করি বলেই মনে হচ্ছে!
নাবিল ভাই, জানেন? আমি ভীষণ একা! আমার আজ-কাল খুব মন খারাপ হয়। উত্তাল মহাসমুদ্রের ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন দীপের মতো একা আমি! এতোটাই একা যে– মাঝেমধ্যে ভীরের মধ্যেও পৃথিবীটাকে শূন্য লাগে! মনে হয়, কোথাও কেউ নেই…কেউ কখনোই ছিল না! অনেক ভাবলাম, আসলেই অনেকটা ভেবেছি–আমার জীবনের সকল আঁধার মুছে দিতে কেউ একটা বোধহয় সত্যিই চাই। সে-ই কেউ একটা আপনি হলে কি খুব মন্দ হয়? আপনার তলোয়ারের মতো শক্তপোক্ত পুরুষালী হাতটা আমার নরম হাতের উপর লাখলে কি খুব ক্ষতি হবে? দেখুন না একটু চেষ্টা করে! একটু ভালোবাসার চেষ্টা করুন আমায়! ব্যাপারটা অতোটাও কঠিন না।
গত চারটা বছর ধরে আপনাকে নিয়ে কতো সুক্ষ অনুভুতি লালন করলাম। আমি অনেক ভেবে দেখেছি নাবিল ভাই– আপনাকে ছাড়া এই কোলাহলময় পৃথিবীটায় আমার বড্ড একা লাগবে! দুঃখে দুঃখে আমি শান্ত নদী হয়ে যাবো। একটা নির্ঘুম রাত নির্জন রাস্তায় আপনি ছাড়া আর কারো সাথে হাঁটতে পারবো না৷ আমার নিরব পথের পথিক হওয়ার জন্য হলেও একটু চেষ্টা করে দেখুন আমাকে ভালোবাসার! আপনি আমার হয়ে যান, নাবিল ভাই। আমারই থাকুন! আমি আপনাকে বুলবুলির বাচ্চার মতো আগলে বাঁচতে চাই!
ইতি
আপনারই বর্ষণ ”
আলমারি খুলে একটা টি-শার্ট খোঁজার সন্ধান করছিল নাবিল। হঠাৎ চোখ যায় এককোণে পরম অবহেলায় পড়ে থাকা চিঠিটার উপর। গিফ্টটা সে অনেক আগেই খুলে ফেলেছিল। চিঠিটার কথা খেয়াল ছিল না। আজ দেখেই কৌতুহলে মেলে ধরেছিল সেটা। কৌতুহলের চিঠিখানা ভেতরটাকে দুমড়েমুচড়ে শেষ করে ফেলবে জানলে সেটা আলমারির এককোণেই ফেলে রাখতো। জমাতো আরও অবহেলা।
চোখ দু’টো বুঝে লম্বা শ্বাস নিয়ে পূনরায় সাদা কাগজটার পানে চাইলো নাবিল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে কপালে হাত ঠেকাল। ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস বাড়ছে। কাগজটা ভাজ করে বালিশের নিচে রাখলো সেটা। ধীরপায়ে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। বুকের ভেতর তান্ডব শুরু হয়েছে। নানান রকম ভাবনায় মন উৎকণ্ঠিত। আকাশের পানে চেয়ে পূনরায় গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে আকস্মিক নিজের হাত দিয়ে আঘাত করে বসল লোহার গ্রিলে। ক্রোধে নিজের চুল টেনে ধরল। সজোরে আছাড় মারল হাতের ফোনটা। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে তার। ভাঙ্গচুর করতে ইচ্ছে করছে। শিট! শিট! শিট! অনেক বড় ভুল হয়ে গেলো। অনেক বড়! হাত দিয়ে পরপর কয়েকটা ঘুষি মারল দেয়ালে। রক্ত পড়ছে হাত থেকে। সেসব পরোয়া করলো না সে। অস্থির পায়ে ঘরময় পায়চারি করে বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেই ভাঙা ফোনটা মেঝে থেকে হাতে নিলো। পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। উপরের ডিসপ্লেটা ভেঙ্গেছে কিছুটা৷ হাত থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে রক্ত পড়ছে ফোনে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি পায়। ডায়াল করে সে।
“হ্যালো।”
শাহিনা বেগমের কন্ঠ। নাবিল বারকয়েক নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে ধাতস্থ হয়। কন্ঠ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে শুধায়, “বড়মা, বর্ষা ঘুমিয়ে পড়েছে?”
তিনি বিভ্রান্ত হলেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে কৌতুহল নিয়ে বললেন, “ঘুমায়নি মনে হয়। কেন বল তো?”
নাবিল আমতাআমতা করে। “কাজ ছিল। একটা প্রয়োজনীয় পেপার ফেলে এসেছি আমার রুমে। ফোনটা ওকে দাও, আমি বুঝিয়ে বলছি। ও খুঁজে বের করবে।”
মনে মনে কী ভাবলেন তিনি কে জানে। কথা বাড়ালেন না আর। চুপচাপ ফোনটা বর্ষার হাতে এগিয়ে দিলেন। যাওয়ার আগে কেবল হাসলেন মিটিমিটি। কয়েকবার হ্যালো বলার পর অপর পাশ থেকে পুরুষালি স্বরটা শুনতে পায় বর্ষা। নাবিলের কন্ঠ দৃঢ়। চিঠির ব্যাপারে কোনোপ্রকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন না চেয়েই স্পষ্ট স্বরে বলল, “দেখা করো আমার সাথে।”
বর্ষা সহসাই শোয়া থেকে উঠে বসলো৷ উত্তেজনার দরুন গলা দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না। আমতাআমতা করলো মেয়েটা। “ইয়ে মানে, এখন?”
“আগামীকাল।”
“ঠিক আছে। কোথায় দেখা করবো আমরা?”
“কোথায় আসলে সুবিধা হয় তোমার?”
“আমি আসি? মানে আগামীকাল আমি এমনিতেও ঢাকায় যাচ্ছি৷ আপনি শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না, আমিই না-হয় আসবো।”
“হু। বাস টার্মিনালে এসে ফোন করবে আমায়। আমি রিসিভ করবো গিয়ে।”
ফোন রেখেই দুই হাতে বুকে এনে লম্বা শ্বাস নিলো বর্ষা। এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পড়ার মতো ব্যাপার। চোখে-মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। সহসাই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এলোমেলো করলো আলমারিতে ঘুছিয়ে রাখা জামা-কাপড়েরগুলো। কোনটা পরবে কাল? কোনটা পরলে নাবিল ভাই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকবে? পাগলের মতো চেঁচাল কিছুক্ষণ। গ্যালারিতে বসবাস করা নাবিলের ছবিগুলো ঘাটল। একটা ছবি বুকে জড়ালো, টপাটপ সেটায় চুমু খেলো কতোগুলো। বর্ষা স্বপ্ন দেখছে না তো? নাবিল ভাই দেখা করতে চায় তার সাথে? তার মানে, চিঠিটা পড়েছে সে! উফ! উফ! উফ! উত্তেজনায় কেমন এলোমেলো লাগছে বর্ষার। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হলো আবেগের তাড়নায়। সত্যি সত্যি কাঁদলোও। এই বালিশ জড়িয়ে ধরছে, তো এই খিলখিল করে একা একা হাসছে। খুশিতে ঘরটাকে উল্টেপাল্টে লন্ডভন্ড করে ফেলতে ইচ্ছে হলো। করতে পারলে ভালো হতো। দুই হাত ছড়িয়ে লাফালো খাটের উপর। বিছানার চাদর,বালিশ অগোছালো হয়ে ঘরের বিদিগিস্তা অবস্থা। নীল রঙের শাড়ীটা বুকে জড়িয়ে পুরো ঘরে ঘুরে ঘুরে আবেগ ঢেলে গুনগুন করে গাইলো,
“কী দিয়া মন কাড়িলা, ও বন্ধুরে…
অন্তরে পিরিতের আগুন ধরাইলা….”
গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১৪
#নাজমুন_নাহার
বিপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের দোতলার ইংরেজি বিভাগের করিডরে দাঁড়িয়ে আছে নিরা। সাথে ইমু। ইমু আর নিরা স্কুল জীবন থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড। যাত্রাবাড়ী থেকে আসে সে, আর নিরা মালিবাগ থেকে। আজকাল খুব নিয়ম করেই ভার্সিটিতে আসে নিরা। বাসায় মন বসে না। কেমন একটা হাহাকার লাগে। ইমু তখন থেকেই খেয়াল করছে নিরার আচরণ। আসার পর থেকেই মুখটা ভার করে রেখেছে মেয়েটা। ওর মন খারাপ থাকলে সব বিপদ, ঝড়-ঝাপটা ইমুর উপর দিয়েই যায়। নিরার মেজাজ সম্পর্কে স্পষ্ট আইডিয়া থাকার সত্বেও মেয়েটা বান্ধবীর উদ্বিগ্নতার কারণ জানতে কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলো না আর। মনটা খুঁতখুঁত করছে। আকস্মিক পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিরাকে সে। নিরা অপ্রস্তুত হলেও ছাড়ালো না ওকে। ইমু কাঁধে মাথা ঠেকায়। আহ্লাদ করে বলে,
“ডার্লিং, কী হয়েছে রে তোর? আমি যে এতোক্ষণ ধরে একা একাই বকবক করে যাচ্ছি, তুই শুনছিস কিছু? মনোযোগ কোথায় বাবু তোর?”
এক ধ্যানে ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চেয়েছিল নিরা। সম্বিত ফিরে ইমুর ডাকে। রাগলো না সে, বরং জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে কন্ঠ খাদে নামিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “কৃষ্ণচূড়া গাছটায় ফুল হয়েছে অনেক। গাছটার নিচে বসতে ইচ্ছে করছে। যাবি ফিল্ডে?”
প্রায় অনেকক্ষণ ধরে গাছটার নিচে বিনাবাক্যে বসে রইলো ওরা। ইমু ভ্রু, মুখ বাঁকা করে চেয়ে আছে। মনে মনে চরম বিরক্ত সে। এতো নিরবতা হজম যাচ্ছে না আর। শোকসভা বানিয়ে রেখেছে পরিবেশটাকে মেয়েটা। হয়েছে টা কী ওর?
“এই, আমাকে কি তোর জ্যোতিষী মনে হয়?”
নিরা বিভ্রান্ত হয়ে চাইলো।
“খামোখা জ্যোতিষী মনে হতে যাবে কেন?”
“তো মুখটা নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো করে রেখেছিস কেন? বোম মারলেও তো মনে হয় না আজ আর কথা বের হবে। মুখে না বললে মনের দুঃখ বুঝবো কী করে? অলৌকিক ক্ষমতা তো নাই।”
নিরা হতাশ শ্বাস ফেলে কপালে হাত ঠেকিয়ে চাইলো ওর পানে। চেহারায় বিরক্তিভাব ইমুর। নিরা খেয়াল করলো, ইমুটার আচরণ একেবারেই নাবিল ভাইয়ের মতো। একদমই শান্ত থাকতে পারে না মেয়েটা। সারাক্ষণ প্রাণচঞ্চল ভাব। হাসবে, লাফাবে, যা ইচ্ছে করবে। সবচেয়ে বেশি যেটা মিল, দু’জনেরই বলির পাঠা নিরা। নিরাকে জ্বালাতে না পারলে এদের জীবনই চলবে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইমু নিরার ব্যক্তিত্বের একেবারে বিপরীত একটা মানুষ। নিরার কাছে এলে মনে হয় মেয়েটার ছটফটে ভাবটা আরও বাড়ে। এমন একটা উল্টো বৈশিষ্ট্যের মেয়ে কী করে সাত-আট বছর ধরে নিরার মতো চুপচাপ স্বভাবের মেয়ের সাথে অনায়াসেই কাটিয়ে দিচ্ছে, সেটাই ভাবনার বিষয়। এই আট বছরে ইমু আর কোনো নতুন বন্ধু বানায়নি নিজের জন্য। ব্যাপারটা আশ্চর্যের! আরও আশ্চর্যের এই যে, নিরারও চলেনা এই রেডিও মেশিনটাকে ছাড়া। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ভীষণ টান লাগে এই মেয়েটার জন্য।
নিরা চেয়ে থাকার ধরন কেবল ইমু চোখ টিপে হাসে। ভাবের সাথে চুল পেছনে উড়িয়ে বলে, “এম আই লুকিং হট, বেইবি?”
আর দমে থাকা গেলো না। শব্দ করে হেসে ফেললো নিরা। হাসল ইমুও। নিরা বুঝলো, এই এক ইমুর সাথে কখনও স্থির বসে থাকা সম্ভব না। মেয়েটা থাকতেই দেয় না স্থির।
এমন সময় পেছন থেকে ডেকে উঠলো কেউ। দু’জনে একসাথে পেছনে চায়। শাওনকে দেখামাত্রই ইমুর হাসিখুশি মুখটায় আঁধার নেমে আসে। বিরক্ত হয় মেয়েটা। নিরা ওর ভাবসাব বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হেঁসে ফিসফিস করে বলে, “কী হলো? মুখে রা নেই যে এখন? শাওন ভাইকে দেখলেই অটোমেটিক সাইলেন্ট মুড অন হয়ে যায়?”
ইমু তখনও অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে আছে শাওনের পানে। শাওনের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, ইমুর বিরক্তিমাখা মুখটা দেখার জন্যই এসেছে সে এখানে। এবং উপভোগও করছে খুব।
“ক্যাম্পাসে ঢুকে এমন স্বাধীন হয়ে যাও কেন জুনিয়রস? নিরুপমা, তোমার সাথের জন বেহুদাই এতো হাসে কেন? তার কি হাসাহাসি করার রোগ আছে? অকারণে হাসাটা কিন্তু ভালো না,মানসিক রোগের লক্ষন।”
ইমু গর্জে উঠে। “দেখুন, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। আমাকেই নজরে পড়ে? নিরাও তো হাসছিল, ওকে তো কিছু বলছেন না। আমার সাথে কিসের এতো শত্রুতা ,শাওন ভাই?”
শাওন ঘাড় বাঁকায়।
“নিরা তোমার মতো আহাম্মক না, ওর হাসিতে যথেষ্ট ভদ্রতা আছে। তুমি হাসলে মনে হয় অনেকগুলো কাক একসাথে বসে কা কা করছে। এমন খ্যাকঁ খ্যাকঁ করে হাসবা না, শব্দদূষণ হয়।”
“আপনাকে বুঝি ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ শব্দদূষণ প্রতিকারের জন্য বেতনভুক্ত করেছে?”
“ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বেতনভুক্ত করতে যাবে কেন? ক্যাম্পাসে সভ্যতা, ভদ্রতা বজায় রাখার একটা নিয়ম আছে। কেউ অনিয়ম করলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াটা সিনিয়রদের নৈতিক দায়িত্ব। ভদ্রতাজ্ঞান নেই বলে ব্যাপারটা তোমার মগজে তা আঁটছে না।”
ইমু কোমড়ে দুই হাত রেখে এক পা আগায়। ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, “আচ্ছা? কে বানালো এমন গাঁজাখুরি নিয়ম?”
শাওনও এক কদম আগায়। ঝুঁকে চোখে চোখ রাখে ওর। চেহারায় দুষ্টুমি একেঁ বলে, “আমি বানিয়েছি। রুলসটা বাকিরা না মানলেও চলবে, কিন্তু তোমার জন্য মেন্ডাটরি। কারণটা পার্সোনাল। বলতে পারো, তোমার পানিশমেন্ট। সিনিয়রদের মুখে মুখে তর্ক করার পানিশমেন্ট। এইযে কথার আগেই মুখ দিয়ে নাগা মরিচের ঝাঁঝ বের হয়? সেটার জন্য। আমি আশেপাশে থাকলে এখন থেকে তোমার হাসতে মানা। একেবারে মুখে তালা ঝুলবে।”
নিরা ঠোঁট টিপে হাসল। ইমু রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। তেতে উঠে বলে, ” আপনার রুলসের গোষ্ঠী কিলাই মিঞা! আমার মুখ, আমার ক্যাম্পাস। আমি এখানে চিত হয়ে, কাত হয়ে হাসব। যা ইচ্ছে করবো। আপনি আমাকে থামানোর কে? ভদ্রতাজ্ঞান শেখাচ্ছেন? ইমু যদি অভদ্র হয় না? আপনার মাথা আর আস্ত থাকবে না। ক্যাম্পাসটাকে নিজের পৈতৃক নিবাস পেয়েছেন? শাওন ভাই, আর একবার আমাকে রাগাবেন তো সত্যি সত্যি ইট তুলে মাথায় মারবো।”
“হাহ্! কী দুর্দিন আসলো, হাঁটুর বয়সী মেয়ে কি-না মাথা ফাটানোর হুমকি দিচ্ছে। বলি, ডরভয় কি ভেতরে আছে না-কি ওটাকেও ফাটিয়েছো?”
“ডরভয় আছে কি-না সেটার প্রমাণ চাই?”
শাওন ঠোঁট কামড়ে হাসল। গ্যারান্টি নেই, সত্যি সত্যি মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ংকর এই মেয়েটা। শাওন মুখের সামনে ঝুঁকে দাঁড়ায়। কপালে টোকা মারে ইমুর। পূনরায় নিরার দিকে ফিরে হাই তুলতে তুলতে বলে, “নিরুনিধি, আমি কিন্তু তোমার সাথে কথা বলছি। তার কিছু বলার হলে তোমার মাধ্যমে বলতে বলবে। এভাবে সরাসরি সিনিয়রদের সাথে আক্রমনাত্মক হয়ে যাওয়াটা বিপদের। সাবধান করে দিবে।”
রাগে কটমট করতে করতে ধুপধাপ পা ফেলে করিডরের দিকে যেতে যেতে ইমু বলে, “ছাতার সিনিয়র। ছাতার সভ্য মানুষ আমার। উজবুক কোথাকার!”
ওর যাওয়ার পানে চেয়ে হাসে দু’জনই। কতো সহজ এটাকে বাজানো।
“কেমন আছেন, শাওন ভাইয়া?”
“আছি ভালোই। শুনলাম এই মাসেই তোমাদের ইনকোর্স? প্রিপারেশন কেমন?”
স্মিত হাসে নিরা। “আছে টুকটাক।”
মাথা ঝাঁকায় শাওন। পূনরায় চায় করিডরে। হতাশ শ্বাস ফেলে বলে, “আমাকে দেখলেই এমন ছেঁকা লাগে কেন তোমার বান্ধবীর? কিচ্ছু বলা যায় না একে, ছেত করে গায়ে লেগে যায়। ইজ্জতই দেয় না মেয়েটা।”
হেসে ফেলল নিরা। “সেটা আমি কী করে জানবো? কেন ছেঁকা লাগে সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করুন।”
কপাল ঘষে হাসে শাওন। শুধায়, “নাবিল কোথায় আছে বলতে পারো?”
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিরা। কপালে ভাজ ফেলে বলে,”বাসাতেই থাকার কথা।”
“ওকে ফোনে পাই না দুই-তিন ধরে। ক্যাম্পাসেও দেখা নেই। হয়েছে টা কী ওর?”
অবাক হয় নিরা। “রিসিভ করছে না, না-কি ফোন অফ?”
“রিসিভ করছে না।”
ভাবনায় পড়ে যায় নিরা৷ আবার ভার হয় মনটা। কেন জানি না চিন্তা হচ্ছে লোকটার জন্য। হুট করেই এমন অদৃশ্য আর দমে যাওয়ার মতো মানুষ তো নাবিল ভাই না।
—-
নীলক্ষেতের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হুডখোলা রিকশাটি ছুটলো টিএসসির দিকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। প্যাডেলচালিত রিকশার বিপরীত দিকের বাতাস এসে লাগছে বর্ষার মুখে। উড়াচ্ছে তার শাড়ীর ছোপ ছোপ আঁচল, আর রেশমি কালো চুল। আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। স্বপ্নের মতো আশ্চর্য সুন্দর। আজ নীল শাড়ীটাই পরেছে বর্ষা। উজ্জ্বল শরীরে এই রঙটা বেশ মানিয়েছে। শাড়ীর নীল রঙটা যেনো নীল আকাশ ছুঁয়ে এসে সরাসরি লেগেছে তার গায়ে। কপালের ছোট্ট নীল টিপে জলজ্যান্ত এক রোমান্টিক কবিতার পৃষ্ঠা দেখাচ্ছে তাকে। আর পাশে বসে আছে প্রিয় এবং চির আকাঙ্ক্ষিত পুরুষটি! কতো কতো নির্ঘুম রাত আর বিষন্ন বিকেল কেটেছে লোকটার সঙ্গ পাওয়ার কামনায়। আর আজ, পাশাপাশি বসে থেকেও কেমন রুপকথা মনে হচ্ছে। কল্পনা লাগছে সবটা। বুকের মধ্যে আকাশ সমান মুগ্ধতা টেনে আরচোখে চাইলো নাবিলের নির্লিপ্ত, নির্বিকার মুখের পানে। কোথায় যেনো হারাচ্ছে নাবিলের মনোযোগ। উদাসীন ভঙ্গিতে চেয়ে আছে বরাবর। অগোছালো লাগছে অনেকটা। চোখ দু’টোয় কীসের একটা ক্লান্তিভাব। সেভাবে থেকেই হাত দু’টো বেশ সাবধানতার সাথে ভাজ করে রেখেছে সামনের দিকে। এদিক-ওদিক কিংবা পাশে তাকানোরও ফুরসত নেই। চোখ ফিরায় বর্ষা। মানুষটার অপ্রতিরোধ্য চেহারায় খুঁজে নেয় পৃথিবীর সকল অপার্থিব সৌন্দর্য। উত্তেজনায় অস্থির হয় প্রাণ। ঠোঁটে অনন্ত অপেক্ষার তৃপ্ত হাসি। বুকের ভেতর আষাঢ়, শ্রাবণ,হেমন্ত টের পায় সে। কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে ভেতরে ভেরতে ভারী অদ্ভুত লাগছে। অতিরিক্ত খুশিতে শরীর কাঁপছে মেয়েটার। লজ্জায় ঠিকঠাক কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। আসার পর থেকেই দু’জনেই কোনো কথা বললো না। ফুটপাতের পথচারীদের মধ্যে অনেকেই যাওয়া-আসার পথে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। ব্যস্ত নগরীতে এমন নিরব, বেরসিক কপোত-কপোতী খুব কমই দেখেছে এরা।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওরা বিনাবাক্যে একই জায়গায় কয়েকটা চক্কর কাটলো রিকশায়। শেষে শাহবাগ মোড় নেমে সোজা হাঁটা ধরলো রমনার দিকে। বসে লেকের পাশের সবুজ ঘাসের উপর। গলায় বাষ্প জমে আছে নাবিলের। বুকের মধ্যে পাহাড় টের পায় সে। চোখ দু’টোয় শুধুই যন্ত্রণা। পাশে পরে থাকা ইঁটের টুকরোটা তুলে শূন্যে চেয়ে ঢিল মারে লেকের দিকে। ভারী কিছু শরীরে লাগতেই লাফিয়ে উঠে লেকের সে-ই অংশের পানি। সেভাবে চেয়েই শুধায় সে, “শাড়ী আমার জন্য পরেছো?”
মাথা উপরনিচ করে বর্ষা। নাবিল না চেয়েও উত্তরটুকু দেখে নেয়। গলা ঝেরে ম্লান হেসে বলে, “সুন্দর লাগছে।”
অতি নগন্য অথচ ভারী আনন্দের প্রসংশা। লাজুক দৃষ্টিতে চায় বর্ষা। নাবিলের শুভ্র শান্ত মুখটায় অমাবস্যা দেখতে পায় কিঞ্চিৎ। কেঁপে উঠে বর্ষার মন। “আপনি কি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত?”
আরচোখে চায় নাবিল। হাসে উদাসীন হয়ে । “চেহারা দেখে মনে হচ্ছে নাকি?”
“কেমন একটা লাগছে। রাতে ঘুম হয়নি?”
জবাব না দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে চোখ মুছে সে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “চলো হাঁটি।”
গাছের ছায়ায় ছায়ায় উদ্দেশ্যহীন হাটছে ওরা। মুখে রা নেই, অথচ কতো কথা জমে পিরামিড হয়ে আছে বুকটা। পাশাপাশি দাঁড়ায় ওরা। নাবিল এদিকওদিক চেয়ে প্রবল অস্বস্তি নিয়ে বলে, “আজ সারাদিন আমার সাথে কাটাতে পারো,বর্ষা? সন্ধায়ও থাকবো কিছুক্ষণ এখানে। ঘুরেফিরে আজকের রাতটা আমাদের বাসায় থাকো, সকালে দিয়ে আসবো চান্দিনায়।”
প্রতুত্তর করে না বর্ষা, কেবল এদিকওদিক চেয়ে লুকিয়ে তৃপ্তি নিয়ে হাসে। মনে মনে বলে, “আমি তো আজীবনের জন্য থেকে যেতে চাই, নাবিল ভাই!”
‘কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে,জ্যাম ছিল বলে যেতে পারোনি। আমি আম্মুকে দিয়ে ফোন করিয়ে বাড়িতে জানিয়ে দিচ্ছি।”
মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানায় বর্ষা।
বিকেল ঘনিয়ে কমলা রঙা সন্ধা নেমেছে ধরণীতলে। বিহঙ্গরা ফিরছে আপন ঘরে। তবে এখনও রমনায় ওরা।ল্যামপোস্টের হলদেটে আলোয় জ্বলজ্বল করছে চারজোড়া গভীর চোখ। ওরা পাশাপাশি বসে। মুখে কথা নেই কারো। তবুও ভালো লাগছে নীলাঞ্জনা বর্ষার। পুরো মনটাই আজ বিমোহিত। পৃথিবীর সমস্ত লজ্জাভাব বিধাতা বোধহয় আজ বর্ষার অন্তরে প্রাণভরে ঢেলে দিয়েছেন। আকাশ সমান সংকোচভাব নিয়েও সে কথা বলতে চায়। পাখির মতো কিচিরমিচির করতে চায় সারা সন্ধা। অক্লান্ত হয়ে সারাটা জীবন লোকটার পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে কাটিয়ে দিতে চায় এই জাদুর শহরে। এই সন্ধাটুকুও হিরন্ময় হয়ে আজীবন জ্বলে উঠুক স্মৃতির পাতায়।
নাবিল ম্লান শ্বাস ফেলে চায় ওর দিকে। মেয়েটার হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখে কন্ঠ নরম হয়ে আসে তার। কোথায় একটা খারাপ লাগা কাজ করছে ওর জন্য। সে এক হাত বাড়িয়ে বর্ষাকে বলে, “তোমার হাতটা ধরতে দিবে আমায়?”
বর্ষা লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়। অতঃপর বিনাবাক্যে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়ায়। আরেকটু দূরত্ব কমিয়ে বসে নাবিল। মাথা ঝুকিয়ে বলে, “আমার ঘাড়ে মাথা রাখো।”
বিভ্রান্ত হয় মেয়েটা। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে আসে তার। নাবিল আবার বলে, “ঘাড়ে মাথা রাখো।”
“হাহ্?”
এবার নাবিল আর অনুরোধ করলো না। পেছন দিক দিয়ে ওর মাথাটা টেনে নিজেই রাখলো নিজের কাঁধে। বর্ষার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ছে। হতভাগ হয় সর্বাঙ্গ। চোখ দু’টো বুজে লম্বা শ্বাস টানে। সে কী স্বপ্ন দেখছে? স্বয়ং নাবিল ভাইয়ের কাঁধে তার মাথা ঠাই পেয়েছে! চৈতন্য হারানোর পথে। সম্বিত ফিরে নাবিলের পুরুষালী কন্ঠের ভারী স্বরে।
“আমার যখন খুব মন খারাপ হয়? আমি প্রায় এখানে এসে ঘাসের উপর শুয়ে থাকি। বেশিরভাগই রাতে আসি। জায়গাটা আমার খুব আপন। এখানে শুলে আকাশটাকে একান্তই নিজের মনে হয়। মন খারাপ ব্যাপারটাকে আর মন খারাপ বলে মনে হয় না।”
মৃদু হাসে বর্ষা। নাবিল হাতটা শক্ত করে ধরে ক্লান্ত কন্ঠে বলে, “একটা গল্প বলবো আজ তোমায়। আজকের এই আয়োজন সে-ই গল্পটার জন্যই। শুনবে?”
মাথা উপরনিচ করে বর্ষা। কেন শুনবে না? এই একটা মানুষের সঙ্গ পাওয়া পাশাপাশি বসে কন্ঠ শুনতে পাওয়া তো তার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। একটা কেন? একশোটা গল্প বলুক সে। এই গল্পের রাত, এই সময় না ফুরাক। চির অম্লান হয়ে থাক মুহুর্তটা!
নাবিল কিছুক্ষণ চুপ থাকে। চোখ রাখে আকাশের দিকে। অতঃপর ম্লান হাসে সে।
“একবার একটা বোকা মেয়ে থাকে, মেয়েটার নাম মনে করো ‘চিত্রা’। তো একদিন সে-ই চিত্রা নামের মেয়েটি একটা চিঠি লিখেছিল। তার খুব প্রিয় একজন মানুষকে নিয়ে। চিঠির কাগজটা ছিল নীল, অনেকটা আজকের দিনের আকাশের মতো। বহু আবেগ আর স্বপ্ন ঢেলে মেয়েটা লিখেছিল চিঠিটা। চির আশায়, যে চিঠিটা একদিন পৌঁছাবে প্রিয়জনের ঠিকানায়। মানুষটা যত্ন নিয়ে পড়বে চিঠি, আদর ঢেলে দিবে সাড়া। প্রিয় মানুষের সাড়া পাওয়ার উদ্দেশ্যে সে একদিন চিঠিটা একটা পুরনো ডাকবাক্সে ফেলে এসেছিল। তারপর বহুদিন হয়ে যায়, সে-ই চিঠির কোনো ফিরতি জবাব আসে না। হতাশ হয় সে। মন খারাপে মন খারাপে কেটে যায় আরও অনেকগুলো দিন। হঠাৎ অনেকদিন পর এসে সে জানতে পারে, সেই ডাকবাক্সটা আসলে অনেক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানে, চিঠিটা তখনও পৌঁছায়ইনি প্রিয় মানুষের দোরগোড়ায়। তারপর আরও কয়েকবার মেয়েটা একই চিঠি নিয়ে যায় সেখানে, বিশেষ ফায়দা হয় না। তার চিঠির জন্য খোলা হয়নি ডাকবাক্স।”
থামে নাবিল৷ মাথায় হাত বুলায় বর্ষার। “এমন একটা অবান্তর গল্প কেন বলছি জানতে চাইবে না?”
চোখ বুজে ছোট্ট করে জবাব দেয় বর্ষা, “হু।”
সে তখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। নাবিল চোখ নামিয়ে তাকায় ওর দিকে। ছেলেটার চোখ দু’টো ঝিলের মতো টলমল করছে আজ। বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে পূনরায় বলতে থাকে,
“আমাকে নিয়ে তোমার অনুভূতিগুলো ওই চিঠিটার মতোই খাঁটি আর স্পেশাল,বর্ষা। কিন্তু আমি সেই ডাকবাক্স নই, যেটা তোমার সুক্ষ অনুভুতির অনুরুপ সাড়া দিতে পারবে। আমার মন তার ব্যক্তিগত এক চিঠি বহু আগেই অন্য কারো ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। চিঠির মালিকানা এখন অন্যকারো। ডাকবাক্সটাও তারই। সেখানে সে ব্যতিত অন্যকারো চিঠি পাঠানোর নিয়ম নেই।”
শেষের কথাটা বলে চোখ দু’টো বন্ধ করে নাবিল। দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে বর্ষার হাতে। অকস্মাৎ হাত আলগা হয়ে আসে বর্ষার। নাবিল তাৎক্ষণিক পূনরায় শক্ত করে ধরে ওর হাতটা। আরেক হাত দিয়ে শক্ত করে মাথাটা বুকের মধ্যে ঠেকায়। নাবিলের প্রশস্ত বুকের ধুকপুক শব্দ শুনতে পায় বর্ষা। বুকের উঠানামা বাড়ে মেয়েটার। শরীর হয়ে আসে ঝড়ে আহত হওয়া মলিন চোখের নিঃসঙ্গ পাখির মতো। নাবিল স্পষ্ট অনুভব করে বর্ষার শরীরের কাঁপুনি। সে তবুও দয়া দেখায় না। চোখ ভিজে আসে তবু আরও নিষ্ঠুর হয় কন্ঠ।
“আমি একজনকে ভালোবাসি। পাগলের মতো ভালোবাসি।”
যেনো ধনুকের মতো বর্ষার কানে বিঁধল বাক্য দু’টো। কান দু’টো ঝাঁঝরা হয়ে যেতে চায় অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দগুচ্ছের আওয়াজে। শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো হাঁপায় বর্ষা। হৃৎস্পন্দন থেমে যেতে চায় তার। নাবিলের ঠোঁট ভেঙ্গে আসে মেয়েটার অবস্থা দেখে। মাথায় হাত রাখে বর্ষার।
“তাকে ভালো না বাসাটা এই এক জীবনে আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব,বর্ষা। বরং, আমি তাকে ভালোবাসার জন্যই বেঁচে আছি। আমার মনের কোটরে ইতোমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে এক টানা টানা চোখের ছোট্ট প্রাণ। তাকে যে ভালোবাসি, সেটা বুঝতে আমার দেরি হলেও উপলব্ধি করলাম, এর মধ্যেও আমি তাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে কখনও তেমন প্রায়োরিটি দেইনি। আম্মু আমার প্রথম প্রায়োরিটি, দ্বিতীয়টা ছিল সে। এখন সেটা আবার যোগবিয়োগ করে হয়েছে সমান সমান। ভালোটা তাকে হয়তো আগেই থেকেই বাসতাম, শুধু বুঝতে একটু সময় লেগেছে। তাকে ভালো না বাসার কোনো কারণ নেই, বরং ভালোবাসার জন্য লক্ষ-কোটি কারণ দেখি। প্রখর উত্তাপ রোদে সে আমায় ছাতার মতো ছায়া দেয়, আবার একই সে পৌষের উষ্ণ কাঁথা হয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আলিঙ্গন করে। সে আমার ঘর। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, তাকে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গ আমায় এমন করে আরাম দিবে না। সে আশেপাশে থাকলে আমি যতোটা প্রানবন্ত থাকি, আর কোথাও গেলে তেমন থাকি না। সে আমার কপালে হাত ছোঁয়ায় কেমন মায়া করে! তার ছোট্ট ছোট্ট নারীসুলভ যত্নগুলো আমাকে নেশা ধরায়, বিশ্বাস করো। আমরন তার নরম ছোঁয়া পাওয়ার নেশা। এই একই কাজ অন্য কেউ করলে তাকে আমি একইরকম করে ভালোবাসতে পারতাম না। সে আমায় পদে পদে উপলব্ধি করায়, তাকে ছাড়া আমার চলবে না। একেবারেই চলবে না!”
কথা বলে না বর্ষা। ঠোঁটের কোনে এক টুকরো ক্লান্ত হাসি।
“তোমার উচিৎ এমন কাউকে নিজের জন্য নির্বাচন করা, যে তোমাকে তোমার প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু দেবে। যেটা দেওয়ার জন্য আপাতত আমি নিঃশেষ। এমন কাউকে তোমার ভালোবাসা উচিত,যে তোমার নরম হৃদয়টাকে যত্ন করতে পারবে শিমুল তুলোর মতো করে। নাবিল নামক মানুষটা তোমার নির্ভেজাল ভালোবাসার দাম চুকাতে পারবে না, বর্ষা৷ তোমার জন্য সে অযোগ্য। তার বুকের সবটুকু ভালোবাসা ওই একজন জন্যই বরাদ্দ।”
নাক টানে বর্ষা। পৃথিবীর সবটুকু সুখ শেষবারের মতো খুঁজে নেয় মানুষটার প্রশস্ত বুকে।
“আজ আমি তোমাকে ডেকে এনে আমার বুকের মধ্যে মাথা ঠেকানোর জায়গা দিয়েছি কেন জানো? কারণ তুমি আমার পরিবার। আমার রক্ত তুমি। চোখের সামনে নিজের রক্তের ভেঙ্গে যাওয়ার দৃশ্য দেখা আমার জন্য অসম্ভব যন্ত্রণার,বর্ষা। আমি জানি, এখান থেকে গিয়ে এই কথাগুলো তুমি আর কাউকে শেয়ার করবে না। চেয়েও করতে পারবে না। এমনকি বড় মা’কেও বলবে না। তোমার এ-ই করুন দিনে তোমার মাথায় স্নেহ করে হাত বুলানোর মতো একটা মানুষ থাকবে না। নিজের মন না ভাঙ্গলেও তোমার মন ভাঙ্গার ঝনঝন শব্দ আমার চেয়ে স্পষ্ট কেউ শুনতে পাচ্ছে না,বর্ষা। তা-ই তোমাকে স্বল্প সময়ের জন্য বুকে জায়গা করে দিলাম। মনের শেষ অভিমানটুকু মুছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কাঁদো। আজ আমি তোমায় শুধুই স্নেহ করবো। আজকের পর থেকে তুমি আমায় সবসময় তোমার পাশে পাবে,বন্ধু আর পরিবার হিসেবে।”
জড়বস্তুর মতো অনড় রইলো বর্ষা। বুকের মধ্যে তোলপাড় চললেও বাইরে থেকে শীতল। শরীরের শিরা-উপশিরার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে চায় তার। সর্বাঙ্গ ভার ছেড়ে দেয়। খামচে ধরে নাবিলের শার্টের বুক। মাথা ঠেকায় আর-ও কাছে এসে। চোখ বুঝে আহত মনে। ধীরে ধীরে শ্বাস টানে। বাঁধ ভাঙা কান্নারা গলায় আটকে আছে মাছের কাঁটার মতো, অথচ চোখ ভেজার নাম নেই। আশ্চর্য কথা! প্রবল ঝড়ের আঘাতের পরে যেমন শান্ত হয়ে যায় পৃথিবী, তেমনই স্থির সে।
“বিশ্বাস করো, আমার জীবনের অনেকটা দখল করা সে-ই মানুষটা না থাকলে হয়তো আমি চেষ্টা করতাম তোমাকে ভালোবাসার। ভালো না বাসতে পারলেও ফিরিয়ে দিতাম না। কিন্তু এখন আমার সত্যিই কিছু করার নেই। তাকে ছাড়া আমি পাগল হয়ে যাবো। আমি আর আমি থাকবো না যদি না জীবনে সে থাকে। আমাকে স্বার্থপর হতে হবে নিজেকে বাঁচাতে। তুমি ক্ষমা করো আমায়, বর্ষা!”
কেমন করে যেনো হাসে বর্ষা। একটাবারের জন্যও সে-ই ভাগ্যবতীর নামটা পর্যন্ত জানতে চাইলো না মেয়েটা। কেবল ভাঙ্গা গলায় শেষ বারের মতো আবদার করে,”আমি শুয়ে থাকি আপনার বুকের মধ্যে আর কিছুক্ষণ? থাকবো? না করবেন না প্লিজ!”
মেয়েটার চোখের পানিতে নাবিলের বাদামী রঙের শার্টটা ভিজে একাকার। কী অতৃপ্ত অবুঝ বায়না তার! নিঃশব্দে, নির্লিপ্তে অশ্রু ঝরাচ্ছে সে। এই প্রথমবার বুকটা বড্ড ভারী লাগছে নাবিলের। একদিনের অনুশোচনা জমে বুকের মধ্যে সুউচ্চ হিমালয় আর কালবৈশাখী ঝড় টের পায় সে!
চলবে