গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১৬
#নাজমুন_নাহার
পৃথিবীর পুরোটা নিয়মের নামই যেনো অনিয়ম। এখানে আবহাওয়া পূর্বাভাসে চার নম্বর সতর্কসংকেত দেখিয়ে লুকানো হয় দশ নম্বরের প্রবল জলোচ্ছ্বাস। বিপদ, দুর্ভোগ বুঝে উঠার আগেই প্রাণসংকট দেখা দেয়। আবার কখনও বড় বড় সমস্যাগুলো এসে জীবনের গতিপথ সহজ করে দেয়৷ ঝাপসা চোখ দু’টো থেকে ময়লা সরিয়ে দেয়। শক্ত হয় মেরুদণ্ড। কোন কাজের ফলাফল কি আসবে তার সবকিছুই অনাকাঙ্ক্ষিত, অনিয়ন্ত্রিত, কাকতালীয়। ভেঙ্গে পড়া সুউচ্চ গাছও জীবন পায় আষাঢ় মাসের বৃষ্টিতে, আবার একই মাসের ঝড়ে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে পড়ে আত্নবিশ্বাসী বটগাছ। তবুও বহমান জীবন চলে কোনো ধোঁয়াশা ভবিষ্যতের আশায়। অমাবস্যার শেষের সূর্যোদয়ের কামনায়। যাই হয়ে যাক, মনুষ্য প্রাণ বিশ্বাস করে, জীবন কাউকে আসলে পুরোপুরি ঠকায় না। দুঃখের পর সুখ দিয়ে দেনদেনগুলো সমান সমান করে দেয়।
এক দীর্ঘ যন্ত্রনার অর্ধরাত পেরিয়ে বর্ষার ঘুম হলো শেষরাতে। ঝাপসা ঘুম হলো একটা নতুন ভোরের আশায়। ক্লান্তিহীন দিনের আশায়। চির বিশ্বাস, আবার হবে সূর্যোদয়, গুচবে অন্ধকার। তার জীবনের হিসেবটুকুও যোগ-বিয়োগের কাটাকাটি শেষে হবে হয়তো সমান সমান। মুছবে বুকের ভেরতের খা খা শব্দগুচ্ছ। চুকবে না পাওয়ার দুঃখ। হবে দিনবদল।
প্রতিদিনকার মতো আজ-ও বেলা করে ঘুমোচ্ছে বর্ষা। সারারাত এপাশ-ওপাশ করেও চোখের পাতা দু’টো এক করতে পারেনি। সকালে ক্লান্তিতে একটু চোখ লেগে এসেছে। জানালা ছাপিয়ে অসহ্যকর রোদের ঝলকানি আর ফোনের রিংটোনে সেটাও আর অক্ষুণ্ণ থাকলো না। মাথাটা ধরেছে অনেক। চোখ না মেলেই বালিশের নিচ হাতরে ফোন রিসিভ করলো। হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসলো একটা অপরিচিত পুরুষালী স্বর।
“গুড মর্নিং।”
বর্ষা ভ্রমের মধ্যে থেকেও অবাক হয়। কন্ঠটা নতুন। ঘুমের তাড়নায় ঠিকঠাক মস্তিষ্কও কাজ করছে না।
“এখনও ঘুমাচ্ছ?”
“কে?”
“বন্ধু।”
“বন্ধু কে?”
“আমি।”
“আপনি কে?”
” আমি আমি।”
“নাম কি?”
“বন্ধু।”
বর্ষা বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলো নাম্বারটা। নাহ, পরিচিত কারো বলে তো মনে হচ্ছে না।
অতিষ্ঠ হয় বর্ষা। “স্যরি রং নাম্বার।”
বলেই কেটে দেয় ফোন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার রিং হয়। বর্ষা বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলো। আচ্ছা বিপদ তো! সকাল সকাল কোন পাগলের পাল্লায় পড়ল কে জানে!
“কি সমস্যা?”
লোকটার দায়সারা জবাব,”আমার? নাহ,কোনো সমস্যা নেই তো। তোমার আছে নাকি?”
“আচ্ছা বেহায়া লোক তো। আপনি আমাকে তুমি বলে সম্মোধন কেন করছেন?”
“তো কি বলবো? তুই?”
“আজব! চেনা নেই, জানা নেই তুই কেন বলতে যাবেন?”
“চিনি তো।”
“চিনেন?”
“হ্যা।”
“তাহলে পরিচয় না দিয়ে ভনিতা কেন করছেন?”
“এমনি।”
“এমনি? এই আপনি কি পাগল?”
“নাহ। পাগলরা এতো সুন্দর করে কথা বলে? শুনেছো কখনও?”
“অনেক শুনেছি।”
“বাহহ! তাহলে তো দেশে আমার মতো স্মার্ট পাগলদের সংখ্যা ভালোই আছে দেখছি।”
“কে বলেছে আপনি স্মার্ট?”
“বলতে হয় না। আমি জানি আমি স্মার্ট।”
“পাগলের সুখ মনে মনে। এই,ফোন রাখুন তো মশাই।”
” আগে বলো,ঘুম ঠিকঠাক হয়েছে তো?”
“তা জেনে আপনার কি কাজ?”
“অনেক কাজ।”
“উফ! আপনি কে বলুন তো?”
অপর পাশ থেকে অনবরত শ্বাস নেওয়ার শব্দ ভেসে আসছে এ পর্যায়ে। হাঁপাচ্ছে লোকটা। বর্ষা সন্দেহ নিয়ে শুধায়, “এই আপনি হাঁপাচ্ছেন কেন?”
“এক্সারসাইজ করতে বের হয়েছিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে একটু ক্লান্ত লাগছে।”
“এতো সকালে?”
“এক্সারসাইজ তো সকালেই করতে হয়,ম্যাডাম।”
“যাকগে ওসব। বলুন এবার, কেন ফোন করেছেন? কী কাজ? কে আপনি? নাম্বার পেলেন কোথায়?”
হু হা করে হাসল লোকটা।”তুমি তো কনফিউজড করে দিলে। ব্রেইন ইজ নট ব্রেইনিং। কোনটার উত্তর আগে দেবো?”
“একসাথেই দিন।”
লম্বা শ্বাস টানে আগন্তুক।
“গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় তোমার সহযাত্রী হয়ে যে সঙ্গ দিয়েছিল? আমি সে-ই পাপী বান্দা।”
বেশ কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। বর্ষা শোয়া থেকে অকস্মাৎ উঠে বসে। “হুয়াট! নিলয় ভাইয়া? কীভাবে, কখন, মানে…. আর ইউ সিরিয়াস?”
নিলয় হাসল। “যাক, চিনতে পারলে তবে। ভেবেছিলাম এক কলেই সোজা ব্লক খাবো। নাহ, তুমি মানুষটা অতোটাও খারাপ না।”
হাসে বর্ষাও। “কিন্তু আপনি নাম্বার পেলেন কোথায়?”
“ফুটপাতে।”
এ পর্যায়ে বর্ষার ঘুম পুরোপুরি মামার বাড়ি দৌড় লাগালো। কোলের উপর বালিশ রেখে আয়েশ করে বসলো সে। আগ্রহ বাড়ছে কথা বলতে।
“ধুর! রসিকতা ছাড়ুন তো। বলুন না, কোথায় পেলেন?”
নিলয় জুতার ফিতা ঠিক করতে করতে জবাব দেয়, “ব্যাপারটা একেবারেই কাকতালীয়। সেদিন তোমাকে বললাম না, কুমিল্লায় বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি? সেখানেই কীভাবে কীভাবে তোমার বান্ধবীর সাথে পরিচয় হলো। মানে তোমার বান্ধবী ‘লিতি’ আমার বন্ধুর ছোট বোন। কথায় কথায় তোমার প্রসঙ্গ তুললাম। মানে অতো গভীরের ব্যাপার বলিনি। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ে, আবার একই ব্যাচ, একই ডিপার্টমেন্ট। শুনে কথায় কথায় তোমার নাম বললাম। ও চিনতে পারলো। বললো তোমার সাথে না-কি বেশ ভালো সম্পর্ক ওর। তারপর আর কি, কায়দা করে নাম্বারটা নিয়ে নিলাম।”
“ও মাই গড! হুয়াট আ কুয়েন্সিডেন্ট। স্যরি স্যরি স্যরি, আমি আসলে আপনার ফোনের ভোকাল ঠিক ধরতে পারিনি, তাই চিনতে অসুবিধা হয়েছে।”
“চিল, ব্যাপার না। তারপর বলো, কি হালচাল তোমার? মন-প্রাণ ভালো আছে তো? নাকি এখনও নাক টেনে কাঁদো?”
লজ্জা, অস্বস্তিতে খানিক বিব্রত হয় বর্ষা। “এসব বলে লজ্জা দিচ্ছেন তো?”
“একদমই না। সত্যি সত্যি তোমার হালচাল জানার জন্য ফোন করেছি। সেদিনের পর থেকে তোমার চিন্তায় চিন্তায় শুকিয়ে গিয়েছি বিশ্বাস করো। অবশ্য ফোনটা এক সপ্তাহ আগেই করতাম। বাট তোমার ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ে এতোদিন পেছালো।”
“এইযে দেখুন, আবার লজ্জা দিচ্ছেন। আসলে মন-মেজাজ ঠিক ছিল না সেদিন।”
“এখন ঠিক আছে?”
প্রতুত্তর না করে প্রসঙ্গ পাল্টায় সে, ” কুমিল্লায় তো প্রায়ই আসা হয় বলেছিলেন। একদিন বাসায় আসার জন্য দাওয়াত রইলো। সুযোগ বুঝে ফট করে এসে পড়বেন। কিংবা চান্দিনা নেমে একটা ফোন করলেই হবে।”
নিলয় ম্যাকি অসন্তোষ হয়। “কুমিল্লার মানুষরা দেখছি দাওয়াতও দিতে জানে না। তোমাদের আদিপুরুষদের কি কিপ্টেমির রেকর্ড আছে? এসব কেমন দাওয়াত? সুযোগ বুঝে আসবো মানে? আমাকে কি যা-তা পেয়েছো? বললেই সুযোগ বুঝে যে কারো বাড়িতে হামলে পড়ব? আমার দেহ-মন ভর্তি আত্মসম্মানে ঠাসা। এতো সস্তা দাওয়াতে মন ভোলে না। তোমার উচিত আমার হাত-পায়ে ধরে টানা তিন-চারদিন অনুরোধ করা। তারপর যদি রাজি হই, তবেই না হলো দাওয়াতের মতো দাওয়াত।”
“ফোনে কীভাবে হাত-পায়ে ধরবো?”
“সেটা আমি কী জানি?”
শব্দ করে হেসে ফেলল বর্ষা। নিলয় অবাক কন্ঠে আওড়াল, “এই এই, তুমি হাসতেও জানো? বাব্বাহ! এক্সট্রা কুয়ালিটি দেখছি। আমি তো জানতাম টিস্যু ভিজিয়ে সারাদিন কাঁদোই শুধু।”
এবার আর হাসি থামাথামির নাম নেই। খিলখিলিয়ে বাড়িসুদ্ধ সজাগ করার মতো গগন কাঁপানো হাসি। শাহিনা নিচতলা থেকে উঠে আসলেন ওর হাসির আওয়াজে। সিঁড়িতে থাকতে থাকতে হাঁক ছাড়েন, “কিরে বর্ষা, এতো শব্দ হয় কোথা থেকে? বাড়িতে চোর ঢুকলো না-কি? ”
বর্ষা ফটাফট ফোন কেটে ম্যাসেজ পাঠায় , “শুনুন, বড়মা আমার ঘরে আসছে। আমি আপনাকে পরে ফোন করবো,কেমন? এখন মিছিমিছি ঘুমিয়ে পড়ার ভান ধরতে হবে। বায়।”
ম্যাসেজ দেখে স্মিত হাসল নিলয়। হাঁটুতে ভর করে একটু জিরিয়ে আবার হাঁটা ধরলো। মেয়েটা খুব মিষ্টি।
কুমিল্লায় একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে সেদিন সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়েছিল নিলয়। সায়দাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে বাসের টিকিট কাটল সবার শেষে। ততক্ষণে বাস ভর্তি যাত্রীতে ঠাসা। উপায়ন্তর না পেয়ে একটা মেয়ের পাশেই বসতে হয়েছে ওকে। সিটে বসে কানে এয়ারপড লাগিয়ে গান শুনছিল একঘেয়েমি দূর করতে। পাশের সহযাত্রী তখনও জানালার বাইরে বিষন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। নিলয় আরচোখে একপলক চাইলো। এরিয়ে গেলো কয়েকবার। শব্দ না হলেও তার কান্নার দৌরাত্ম নিলয়ের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছালো। পাশে একজন বিশ্বের সকল দুঃখ এক করে কেঁদেকেটে বিদিগিস্তা অবস্থা, আর নিলয় নির্বিঘ্নে,নির্লিপ্তে মনের সুখে গান শুনে যাবে? ব্যাপারটা মারাত্মক নিষ্ঠুর দেখায়।
“এক্সকিউজ মি!”
জবাব না দিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে চায় বর্ষা।
“আপনার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে? পার্সোনাল প্রবলেম, নাকি পাশে আমি বসেছি বলে? মেয়েলী কোনো ব্যাপার হলে অন্য কোনো মেয়ে যাত্রী আপনার সাথে বসবে, আমি না-হয় আরেক সিটে ম্যানেজ করে নেবো।”
বর্ষা এতোক্ষণে স্বজ্ঞানে ফিরলো। চোখ,মুখ ফুলে আছে অতিরিক্ত কান্নার দরুন। একটা অপরিচিত মানুষের সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করে ফেলছে ভাবতেই লজ্জা হলো। ধাতস্থ হয়ে চোখের পানিটুকু মুছলো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল, ” কোনো সমস্যা হচ্ছে না আমার। নিশ্চিন্তে বসুন আপনি।”
নিলয় নিশ্চিন্তে বসতে পারলো না। খুব পরিচিত লাগছে মেয়েটার চেহারাটা। কোথায় যেনো দেখেছি টাইপ। সন্দেহ দূর করতে চাইলো আরেক ঝলক। মেয়েটা তখনও একবুক দুঃখ আগলে কেঁদেই চলেছে। তবে এবার কাঁদছে লুকিয়ে। চোখে চশমা পরে। নিলয় বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো আরচোখে। আগ্রহ পেলো কথা বলার। আচ্ছা, একবার জিজ্ঞেস করবে কি? যদি কাঙ্ক্ষিত সে-ই মানুষটাই হয়?
জিজ্ঞেস করবে কি-না বলতে বলতে বহু দ্বিধাদ্বন্দ্ব পুহিয়ে শেষমেশ আমতাআমতা জিজ্ঞেস করেই ফেললো, “আপনাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে। খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। থাকেন কোথায়?”
অতিষ্ঠ হয়ে চায় বর্ষা। বিরক্তি নিয়ে শ্বাস ফেলল সে। এই ছেলেদের সমস্যা আসলে কোথায়? মেয়ে দেখলেই এদের এতো চিপকাচিপকি স্বভাব উদয় হয় কোথা থেকে? সে-ই একই মেয়ে পটানোর লাইন। কণ্ঠে অসন্তোষ আর ক্রোধ নিয়ে বর্ষা বলে, “আমারও আপনাকে পরিচিত লাগছে। ইনফ্যাক্ট আপনাকে তো পুরো বিশ্ববাসীর চেনার কথা। আপনি ডোনাল ট্রাম্পের ভাতিজা না?”
কী কায়দা করে মেয়েটা ধুয়ে দিলো একটা সভ্য,শান্ত,ভদ্র ছেলেকে। অপমানে, অবজ্ঞায় মুখটা চুপসে আসে নিলয়ের। ফুরফুরে হাসিটা বিলীন হয়ে থমথমে হয় মুখ। নিজেকে কেমন ব্যক্তিত্বহীন মনে হচ্ছে। আচ্ছা, মেয়েটা কি যেতে কথা বলায় ছেছড়া মনে করছে ওকে? হ্যা করছেই তো। কেমন যাচ্ছেতাই কথা শুনিয়ে দিলো। বেয়াদব মেয়ে, বেয়াদব মেয়ে! তোর উপর ঠাডা পড়বে।
নিলয় প্রবল রাগ নিয়ে পূনরায় কানে এয়ারপোড লাগায়। পন করে, দুনিয়ায় কেয়ামত এসে পড়লেও এই মেয়ের সঙ্গে নো মোর টকিং। নো মোর মানে, নো মোর। কিন্তু কৌতুহল তো কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না। আসলেই খুব চেনা চেনা লাগছে। অবিকল একই চেহারা। আচ্ছা,কথা না বলে অন্য পদ্ধতিতে ট্রাই করলে কেমন হয়? সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙ্গলো না।
নিলয় এদিক-সেদিক চেয়ে আপন মনে জপলো, ” বর্ষাআআআ! ছিহহ্ কী বিশ্রী নাম। এসব পঁচা নাম যে কারা রাখে আল্লাহ মালুম।”
তড়াক করে চাইলো বর্ষা। বিস্ময়ে হা হয়ে এলো মুখ। চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “এই ,আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?”
হুয়াট আ ভাগ্যের লীলাখেলা! মিলে গেলো তো।
নিলয় ভাব নিয়ে চোখ ছোট ছোট করে চাইলো, “দ্যট মিনস, আমার ধারণাই সঠিক? তুমি বর্ষা! নাবিলের সে-ই পিচ্চি কাজিনটা?”
বর্ষা সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
“আমি নিলয়৷ মনে নেই, তোমার দাদি যেদিন মারা গেলো সেদিন নাবিল আর রাহেলা খালার সাথে আমিও গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে? আমি নাবিলের বড় খালার ছেলে। তুমি যে একটু পরপর অজ্ঞান হচ্ছিলা? মনে নেই? আমি তো কোলে করে তোমাকে ঘরেও নিয়ে গিয়েছিলাম। এইটুকুনি ছিলে তখন। ওইযে নীল শার্ট পড়া ছেলেটা? যাকে দু’বার পানিও খাওয়ালে? পড়েছে মনে?”
বর্ষার আসলেই ওর কথা মনে পড়ছে না। সে কবেকার কথা। বাড়ি ভর্তী কতো নাম না জানা আত্নীয়ই তো এসেছিল। খেয়াল করে তাকানোর সুযোগ আছে শোকের পরিবেশে? তাকালেও এতোদিন পর্যন্ত মনে থাকে? তবে নাবিল ভাইয়ের খালাতো ভাই শুনে আস্বস্ত হলো কিছুটা।
“আপনার বড় ভাইকে চিনি, নেহাল নাম। আপনি তার ছোটজন? কানাডায় থাকে যেইজন?”
“যার নাম জানো সে বড়জন হলে আমি তো ছোটজনই হওয়ার কথা।”
ওর বলার ধরন শুনে হেসে ফেলল বর্ষা। লজ্জাও পায় কিছুটা।
“ইয়ে,এতোক্ষণের বাজে ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। আপনি মাইন্ড করেন নি তো?”
“নাহ নাহ, ইটস ওকে। অপরিচিত মানুষদের সাথে রেন্ডমলি এতো ফ্রাংক হওয়াও উচিত না। দেশে যে হারে মলম পার্টির সংখ্যা বাড়ছে, সন্দেহ করে দু-চারটা চড় থাপ্পড় মেরে দিলেও জায়েজ।”
সেদিনের তিন ঘন্টার জার্নিতে পুরোটা সময় দু’জন মনে ফাটল ধরা অপরিচিত, স্বল্প জানা যাত্রী কখন যে নিজেদের খুব পরিচিত হয়ে উঠল, ওরা কেউ বুঝলো না। কেবল জানলো, এদের দু’জনেরই দু’জনের সঙ্গ জাদুর মতো ভালো লাগছে। নবপরিচিত কন্ঠ উপভোগ্য লাগছে দু’জনেরই। নিলয় কথায় কথায় নিজের ব্যক্তিগত জীবনের এমন অনেক ঘটনাই সেদিন ওর সঙ্গে শেয়ার করে ফেলেছিল, যেসব ঘটনা আজ অব্ধি কাউকেই জানানো হয়নি। বর্ষাও কোনো এক অজানা দৈব বলে তার জীবনের ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় মন ভাঙ্গার গল্পটা সেদিন না চাইতেও কীভাবে যেনো শেয়ার করে ফেলেছিল। নামটা অবশ্য ইচ্ছে করেই বলেনি। তবে সারাটাপথ অনেক অপ্রাসঙ্গিক, অবান্তর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব জয় করে হেসেছে ওরা। এমন করে মন খুলে বর্ষা শেষ কবে হেসেছিল, মনে পড়ে না। শুধু জানলো, খুব হাল্কা লাগছে বুকটা। বুকের উপর দখল করা হিমালয়টা নেমেছে মানুষটার শব্দগুচ্ছে। লম্বা সময়ের যাত্রাপথটাকেও খুব সংকীর্ণ মনে হচ্ছিল। বিদায়ক্ষনে চান্দিনা নামার পথে বারবার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল বর্ষা। বাস পূনরায় পথ ধরার আগ পর্যন্ত নিলয়ও মন খারাপের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ওর যাওয়ার পানে। কোথাও একটা পিছুটান কাজ করছে মনে। নিভে যাওয়া মনের অনুভুতিদের নাড়া দিয়ে কেবল একটা গানই কানের কাছে বেজে উঠলো দু’জনের।
“কিছুক্ষণ আরও না-হয় রহিতে কাছে
আরও কিছু কথা না-হয় বলিতে মোরে…”
—
নিরা খেয়াল করলো, মিরাপু আজ ক’দিন ধরে অদ্ভুত আচরণ করছে। বেহুদাই ওকে দেখে মিটিমিটি হাসছে, গুনগুন করে কী সব আজগুবি গান গাইছে। হুটহাট এসে কাঁধে ঝুলে পড়ছে। ব্যাপার-স্যাপার বোঝা দায়। বিয়েসাদী করে মাথাটা পুরোপুরি গেছে মেয়েটার।
“কোথায় যাচ্ছিস রে?”
নিরা আয়নায় চুল বাঁধতে বাঁধতে ফিরে চাইলো। মিরা যে তখন থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকেই খেয়াল করে যাচ্ছে, সেটাও দৃষ্টি এড়াল না।
“ভার্সিটিতে।”
মিরা ফট করে উঠা দাঁড়ালো। ধপাস করে কাঁধে হাত রাখল ওর। তাল সামলাতে না পেরে নিরা বেসামাল হয়ে পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলায়। উঠে চোখ রাঙ্গায় বোনকে।
“আপু, কী সমস্যা তোর? সবসময় বাচ্চাদের মতো ধপাস ধপাস গায়ের উপর ঢলে পড়িস কেন? এতো জ্বালাস কেন তুই আমায়? তোর আচরণ দেখলে মানুষ আমাকে ছোট না বলে তোকে বলবে।”
মিরা গলায় জড়িয়ে ধলো।”জ্বালাতে দে না আর ক’টা দিন।” মিরার কন্ঠে কেমন একটা মন খারাপের সুভাস।
“কেন? ক’টাদিন পর বুঝি আর জ্বালাতে পারবি না? তুই না এলে না-হয় আমিই তোর শশুর বাড়িতে হামলে পড়ব তোর জ্বালানি নিতে।”
হেসে ফেলল মিরা। “নাহ, ওইটা না। মানে ধর তোর বিয়েটিয়ে হয়ে গেলো, তখন তো চাইলেই দু বোন হুটহাট দেখা করতে পারবো না।”
ভ্রু বাঁকিয়ে চায়। দায়সারাভাবে বলে, “আপু, বেহুদা আলাপ মেরে দেরি করাচ্ছিস আমার। রেডি হতে দে। কাজ না থাকলে স্বামীর সঙ্গে প্রেম কর গিয়ে।”
কে শুনে কার কথা? কাঁধে থুতনি ঠেকায় মিরা। চেহারায় দুষ্টুমি নিয়ে বলল, “ধুর! সারাক্ষণ প্রেম করতে ভাল্লাগে না।”
“আমাকে জ্বালাতে তো ঠিকি ভাল্লাগে।”
হাসে মিরা। গাল টানে বোনের। পূনরায় কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরে ঢুলতে ঢুলতে বলে,” নিরা শোন, তোকে না এমন বর চেয়ে বিয়ে দেবো, যে তোর মতো শান্ত, চুপচাপ, গম্ভীর, আর বেরসিক ধরনের। একেবারে খাপেখাপ মিলবে। আমাদের নিলয় ভাইয়ের মতো এমন একটা পাত্র খুঁজবো তোর জন্য। গম্ভীর প্রফেসর টাইপ। ভালো হবে না?”
মিরা আরচোখে কথার পরিপ্রেক্ষিতে নিরার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলো। বিশেষ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না পিচ্চিটার চেহারায়। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চুল বাঁধছে সে।
“নিলয় ভাই মোটেও গম্ভীর আর বেরসিক না আপু। উনি চুপচাপ থাকে, তবে নাবিল ভাইয়ের কাছ থেকে খোঁজ নিস, উনার চেয়ে বেশি রসিকতা আমাদের বংশে আর কেউ জানে না। শুধু ভান ধরে থাকে গম্ভীর গম্ভীর।”
মিরা কেমন করে যেনো সন্দেহ নিয়ে চায়।” তাই? বাহ! ভালোই তো পর্যবেক্ষণ করিস নিলয় ভাইকে।”
“না জানার কি হলো? সবাই জানে।”
মিরা ঠোঁট টিপে হেসে আবার মনে পড়ার ভঙ্গিতে চায়। বলে, “ওহহ ভালো কথা, রাহেলা ফুপ্পি বলছিল নাবিল নাকি কোথায় মারামারি করে হাত ভেঙ্গে এসেছে? হাতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নাকি বিছানায় পড়ে আছে ফাজিলটা? জানিস কিছু? মুখে তুলে খায়িয়ে দেওয়ার মতো নাকি অবস্থা ওর হাতের। ভাবতে পারছিস, কতো বখাটে হয়েছে।”
নিরা না জানার ভান করে চায়। কাঁধব্যাগটা নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বলে, “আমি কি করে জানবো? আমি এসবের খোঁজ রাখি না। সামনে পরিক্ষা, এতো সময় কোথায় নাবিল ভাই জনিত ঘটনা ঘাটার? আর বখাটে হওয়ার কী আপু? হয়তো পরিস্থিতিটাই মারামারি করার মতো ছিল। হতে পারে না?”
বোনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুখটায় আঁধার নামিয়ে চলে গেলো মেয়েটা। মিরা বুঝলো না হুট করেই এভাবে রেগে কেন গেলো মেয়েটা।
চৌধুরীপাড়া থেকে রিকশায় করে প্রধান সড়কে আসতে সময় লেগেছে তিন থেকে চার মিনিট৷ রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাসের জন্য দাঁড়াল। সড়কের একটা বিলবোর্ডে চেয়ে রইলো একদৃষ্টে। ভালো লাগছে না কিছুই। মনটা কেমন উচাটন লাগছে। কিছু একটার পিছুটান আজ ভার্সিটিতে যেতে দিচ্ছে না নিরাকে। কোথায় একটা নিস্তব্ধতা হৃদয়ে। কারো জন্য ভীষণ হাহাকার করছে বুকটা। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ইমুকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজ আর ভার্সিটিতে যাবে না সে। ফিরতি এসে একই রিকশায় চড়ল। গন্তব্য গুলিবাগের দিকে। চৌধুরীপাড়া থেকে গুলিবাগের দূরত্ব কেবলই পাঁচ মিনিটের। হেঁটে গেলে দশ মিনিট৷ রিকশা থেকে নেমে হাঁটা ধরলো কাঙ্ক্ষিত গলির দিকে৷ রমজান চাচার দোকান পেরিয়েই ডুপ্লেক্স বাড়িটার সম্মুখে দাঁড়াল। পুরোনো একতলাটাকে ঘষামাজার করে গত বছরই ডুপ্লেক্স বাড়িটা শখ করে করেছে জসিম এহসান। নিরা দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে। গেইট ভেতর থেকে বন্ধ। পেছন থেকে রমজান চাচা হাঁক ছাড়লেন, “নিরা আম্মা, বহুত দিন পর আইলা দেহি৷”
হাসে নিরা। “বহুদিন কোথায় চাচা, দু’মাস আগেও তো এসে গেলাম।”
রমজান রাহেলার খুব বিশ্বস্ত আর কাছের একজন। ছোট বোনের মতো স্নেহ করে রাহেলাকে সে। থাকেও এই গলিতেই।
তিনি মিষ্টি করে হাসলেন একগাল। বাড়ির গেইটের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “গেইট বন্ধ নাকি?”
“হ্যা, ভেতর থেকে তালা।”
“খারাও ফোন করতাসি রাহেলারে।”
দুই মিনিটের মাথায় চাবি নিয়ে নিচে এলেন রাহেলা। অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে নিরাকে দেখে অবাকই হলেন অনককখানি। চৌধুরীপাড়া থেকে গুলিবাগের দূরত্ব খুব বেশি না হলেও কলেজে উঠার পর থেকে খুব প্রয়োজন ছাড়া এদিকটায় আসে না নিরা। ওকে দেখে খুশি যেনো উপচে পড়ছে রাহেলার চোখে। তড়িঘড়ি করে গেইট খুললেন তিনি।
ফ্রিজ থেকে যত ধরণের নাস্তা আছে নামিয়ে সামনে রাখলেন নিরার৷ এই পাস্তা বানাচ্ছেন, তো এই কফি করে আনছেন। একটু পর আবার খাসির মাংসও ভেজালেন কাচ্চি করার জন্য। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ভাতিজিকে আপ্যায়ান করতে। নিরা কপাল চাপরায় ফুপ্পির এহেম অবস্থা দেখে।
“দেখেছো, এই কারণেই তোমার বাসায় আসতে ইচ্ছে হয় না। এতো চাপ নিচ্ছো কেন বাবা? চিল, আমি তোমার ভাতিজী, মেহমান না।”
“মেহমানের মতোই তো করিস। বছরে এক-দুই বার পা মারালে মেহমান নয় তো কি?”
নিরা রান্নাঘরে ঢুকল। সত্যিই অনেকদিন পর এলো সে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সবকিছুই। আগের চেয়ে এখন আরও গোছানো রান্নাঘরটা। থাকারই কথা, ঘরের মালকিন যে তার ছোটফুপ্পি। যেখানে যাবে, সেখানেই কীভাবে কীভাবে যেনো সব গুছিয়ে ফেলে। সম্পর্ক, জীবন, সব।
নিরা ফুপ্পির সাথে হাতে হাত চালায় কাজে। চোরা চোখে কাকে যেনো খুঁজে। আমতাআমতা করে শুধায়, “নাবিল ভাইকে দেখছিনা যে?”
কড়াইয়ে পেঁয়াজ ছাড়তে ছাড়তে জবাব দেয় রাহেলদ,”দেখ গিয়ে ঘরে, ঘুমাচ্ছে বোধহয়। ডাক্তার কি এক পাওয়ারের ঔষধ দিলো, ছেলে আমার দিনের অর্ধেক বেলাই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। একবার ডেকে এলাম নাশতার জন্য। ঝাড়ি মেরে পাঠিয়ে দিলো ফাজিলটা। একটু পর আবার দেখিস, নিজেই এসে জড়িয়ে ধরে স্যরি বলবে। কী এক পাগল যে পেটে ধরেছি আমি।”
নিরা মিটিমিটি হাসল। মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল, “খামোখা আবার ডাক্তার দেখাতে গেলে কেন? সকালের ঔষধ দুপুরেই যদি খাবে, তো নিজেই ডাক্তার হয়ে গেলে পারতো।”
রাহেলা হেসে ওর হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিলো। বলল, “রেখে আয় ঘরে। এক্ষুনি উঠবে। উঠে বিছানার কাছে কফি না দেখলে বাড়িসুদ্ধ সজাগ করে ফেলবে চেঁচিয়ে।”
“তুমি এটাকে কীভাবে সহ্য করো বলো তো? তোমার ছেলে যে আগাগোড়া একটা আধপাগল, জানো সেটা?”
খিলখিল করে হেসে উঠলেন ভাতিজীর পানে চেয়ে। রসিকতার স্বরে বললেন, “তুই সবসময় আমার লক্ষী ছেলেটাকে ধমকাস। এভাবে বলবি না তো। আমার ছেলের বদনাম কিন্তু আমার সহ্য হয় না। আমার ছেলেটা পাগল হলেও মানুষ ভালো।”
দু’জনই হাসল একসঙ্গে।
নিরা নিঃশব্দে কফির মগ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। দিনের বেলাতেও ঘরটাকে অমাবস্যার মতো অন্ধকার করে রেখেছে লোকটা। তবে ঘরের সুভাস ভালো। তার ম্যানলি দেহের মনমাতানো সুঘ্রাণের সঙ্গে ভেসে আসছে হৃদয় জুড়ানো মিষ্টি পারফিউমের সুভাস। আলো-বাতাস না থাকার দরুন এসিতেও কেমন ভ্যাবসাভাব মনে হচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখার উপায় নেই। নিরা আলো, উজ্জ্বলতাহীন ঘরে অন্ধের মতো পা ফেলে হাত হাতরে জানালা পর্যন্ত পৌঁছালো। পর্দাটা টেনে দিতেই এক টুকরো আলোকরশ্মি এসে ছুঁলো ঘরের মেঝে। টাটকা রোদের আলোর ঝলকানি জানালা ডিঙিয়ে লাগতেই মৃদু নড়েচড়ে মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করলো নাবিল। রোদ্দুর জ্বালাময় হাসি নিয়ে ছুলো তার চোখ,গাল,কপাল। মুখটা চকচক করছে নাবিলের। যেনো কোনো সাদা মুক্তাপাথরকে সূর্যের সম্মুখে অচীরেই মেলে ধরা হয়েছে। মনে হচ্ছে, সূয্যিমামার উত্তপ্ত পরশে দ্বিগুণ মুগ্ধতা নিয়ে জ্বলজ্বল করছে একটা মুক্তাপাথর। নাবিল চোখ বন্ধ রেখেই ভ্রু, ঠোঁট বাঁকায়। গভীর আক্রোশ মিশিয়ে বিরবির করে, “এই বাড়িতে আমার দু আনারও দাম নেই৷ সুখের একটা ঘুম লম্বা সময়ের জন্য টিকবে,তা-ও সম্ভব না। আম্মু, আমি ঠিক করেছি এ মাসে আবার হোস্টেলে গিয়ে উঠব। আমার শান্তি তোমার সহ্যই হয় না। সকাল সকাল পর্দা মেলে আমার চিরসঙ্গী ঘুমের রফাদফা করে দিলে। এতো কুটিল ষড়যন্ত্র আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আই এম ফেড-আপ উইদ্ ইউ, এন্ড ভেরি সুন আই এম গোয়িং টু লিভ দ্যিস হাউজ। কাছে থাকতে মর্ম বুঝলে না তো। যাই দূরে, তখন ফোন করে নাকের পানি, চোখের পানি এক করে ফেললেও আসবো না।”
নিরা গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে চাইলো ওর পানে। নিভৃতে চাইলো পরম অবজ্ঞা নিয়ে। তবে সে-ই অবজ্ঞাটুকু অক্ষুণ্ণ হয়ে রুপ নিলো অন্তহীনরুপের কোনো কাম্যে। ফর্সা উন্মুক্ত পীঠদেশ মেলে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে লোকটা। পরনে কেবল একটা খয়েরী রঙের ট্রাউজার। ব্যান্ডেজ করা হাতটা বালিশের উপর অবহেলায় ফেলে রাখা। মুখের একদিকে সূর্যের আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে শুভ্র চেহারাটা। ফুলের মতো আবেদনময় ঠোঁটজোড়ায় কী নিবিড় নিষ্পাপভাব। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো খেলছে চিবুকের সঙ্গে। নিরা সেদিকে একপলক চেয়ে ক্ষীণ হাসল। অবুঝ মুখটায় হাত ছোঁয়াবার খায়েশ দমিয়ে কফির মগটা সাইড টেবিলে রাখল। বসল খাটের এক কোনে। মানুষটার হাতের দিকে চোখ যেতেই মনটা কেমন মলিন হয়ে এলো। চেয়ে রইলো সেভাবেই বেশ কিছুক্ষণ। কী পরম যত্নে লোকটা নিজের অবহেলা করতে পারে তা-ও দেখলো। নিভৃতে সফেদ ব্যান্ডেজের উপর আনমনে হাত ছোঁয়াল। নরম,শীতল ছোঁয়া ইন্দ্রিয় সজাগ করতেই নাবিল তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে চাইলো। ভূতের মতো হুট করে চোখ মেলায় আঁতকে উঠল নিরা। কেঁপে তাৎক্ষণিক দূরে সরে বসে।
“তুই!”
চোখ ছোট ছোট করে চায় নাবিল। আজব সকাল! রাতে কি নেশা করে ঘুমিয়েছিল ভুলে? এমন ভুলভাল কেন দেখছে? চোখকে বিশ্বাস করাতে আরেকবার পুরো ঘরটায় চোখ বুলায়৷ দিবাস্বপ্ন নয় তো? নাহ, ভ্রম কিংবা কল্পনাও তো নয়। বাস্তবেই স্বয়ং নিরা ওর ঘরে। নাবিল চোখ-মুখ কুঁচকে ওকে ইশারায় কাছে আসতে বলে বলল, “একটা চিমটি কাট তো,মর্জিনা।”
নিরা মুখে উত্তাপ নিয়ে চেয়ে আছে। এইযে, শুরু হয়েছে লোকটার যত বাজে বকা। হতাশ শ্বাস ফেলল সে। নাবিল ক্ষীণস্বরে ধমকে উঠে, “দে না একটা চিমটি।”
নিরা বিরক্তি নিয়ে আওড়াল, ” অসহ্য লোক। সমস্যা কি তোমার, নাবিল ভাই? এভাবে ভূতের মতো তাকায় কেউ? ভয় পেয়েছি না? রাক্ষস একটা।”
নাবিল বুঝল, ভূত-প্রেত নয়, মর্জিনাই এসেছে ওর ঘরে। পিটপিট করে সন্দিহান চোখে চেয়ে তড়াক করে ঝড়ের গতিতে উঠে বসলো। ফটাফট ওয়ারড্রপ থেকে গেঞ্জি নিয়ে পরতে পরতে প্রশ্ন ছুড়ল, “কাহিনী কি? মর্নিং বার্ড হয়ে গিয়েছিস নাকি? এমন ভোর সকালে আমার বাড়িতে সূর্যের মতো উদয় হওয়ার রহস্য বল? মাকসাত কি তোর,মর্জিনা?”
নিরা ঝাঁঝাল কন্ঠে জবাব দেয়, “কচু মাকসাত। ছাতার মাথা। আমার এ ঘরে আসাটাই ভুল হয়েছে।”
বলেই বিরবির করে ঝাঁঝ দেখিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই নাবিল তাৎক্ষণিক হাত টেনে ধরলো ওর। হেঁচকা টান মেরে আচমকা সামনে দাঁড় করালো। মুখোমুখি হলো দুই জোড়া অতৃপ্ত চোখ। নিরা অস্বস্তিতে চোখ নামালো। বাম হাত দিয়েও কেমন দৃঢ়তা নিয়ে আবদ্ধ করে রেখেছে লোকটা। বহু ধস্তাধস্তি করলো নিজেকে ছাড়াতে। সফল হলো না । অতিরিক্ত নড়াচড়ার দরুন গা থেকে জরজেটের ওড়নাটা পরে যেতে নিলো আচমকা। লজ্জায় চোখ বুজে নেয় নিরা। তবে ওড়নার নির্লজ্জ খায়েশকে ব্যর্থ করে তাৎক্ষণিক সেটা সামলে নিলো একটা টগবগে পুরুষালী হাত। ওড়নাটা পূনরায় নিরার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে রোবটের মতো দাঁড় করিয়ে পূনরায় মোহগ্রস্ত মনোযোগ নিয়ে চেয়ে রইলো ওর হাসফাস করতে থাকা মুখটায়। নিরা বিরক্তি বিরক্তি মুখ করে অন্যদিকে চেয়ে আছে। এভাবে একাধারে কারো চেয়ে থাকাটা বিব্রতকর লাগছে। কিন্তু কে বুঝে মনের অভিযোগ? লাজহীন লোকটা দৃষ্টি সংযত রাখলে তো? নিরা গরম দৃষ্টিতে চায় গাল ফুলিয়ে। হাতে কিল-ঘুষি মারল কয়েকটা। ফায়দা হলো না বিশেষ। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল নাবিল।
“মোচড়ামুচড়ি বন্ধ। শক্তিতে কুলাবার অবকাশ নেই আমার সঙ্গে। কেন এসেছিস? আমার জন্য? মন আনচান করছিল তাই না? তোর চোখ দেখেই বোঝা যায়, আমার জন্য দাউদাউ করে বুক পুড়ছে।”
জবাব দেয় না মেয়েটা। নাবিলের চোখে-ঠোঁটে দুষ্টুমি। দৃষ্টি শান্ত, ধারালো। আওয়াজ ক্ষীণ রেখে শুধায় পূনরায়,
“পুড়ছে বুক?”
মাথা উপরনিচ করে নিরা। “হু।”
“কেন পুড়ছে?”
নিরা হাতের দিকে করুন করে চাইলো। নাবিল বুঝলো মেয়েটার চোখের ভাষা। হাসে ঠোঁট কামড়ে। ওর ব্যান্ডেজ করা ডান হাতটার পানে চেয়ে মনটা নরম হয়ে আসে নিরার। চোখে চোখ রেখে শুধায়, “ব্যথা কমেনি?”
নাবিল মনে মনে খুশি হয়। অজানা ভালো লাগায় জ্বলজ্বল করছে চোখের তাঁরা। চোখে প্রেম প্রেম কৌতুহল মেয়েটার। সে নিজের বাহু থেকে ওর হাতটা আলগা করে। ঠোঁট উল্টে বলে, “কমলো আর কোথায়? প্রতিদিনিই বাড়ছে। ছুঁয়েই দেখ।”
নিরা চোখ মুছে আলতো করে ছোঁয় হাতটায়। স্পর্শ লাগতেই বৈদ্যুতিক ঝটকা খাওয়ার মতো হাত সরিয়ে আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো নাবিল।
নিরা বিচলিত হয়ে গেলো কিছুটা। “কী হলো? আমি তো হাল্কাভাবে ধরেছি। ব্যথা লেগেছে?”
নাবিল বাচ্চাটির মতো মাথা উপরনিচ করে।
“কোথায় লেগেছে?”
বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টায় সে। আঙ্গুল দিয়ে বুকে হাত ঠেকায়। চায় করুন দৃষ্টিতে। নিরা ওর রসিকতা ধরতে পারলো। গরম চোখে চেয়ে এবার সত্যি সত্যি থাপ্পড় মারল ব্যান্ডেজে। গর্জে উঠে বলল,
“ফাজলামো হচ্ছে? হাত রাখলাম হাতে, আর ব্যথা হচ্ছে বুকে?”
নাবিল ঠোঁট টিপে দুষ্টুমি নিয়ে বলে, “হচ্ছে তো। বহুদিন ধরে হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে এই রোগের একমাত্র ঔষধ ‘বউ’। বিয়ে করে চিকিৎসা না নিলে আমি শীগ্রই অক্কালাভ করবো। মানে বুঝতে পারছিস, বউহীনতায় নির্দয় মৃত্যু। কী জুলুম! কী অবিচার! কী নিষ্ঠুরতা! এখন তুইই বল মর্জিনা, এই মন্দার দেশে এতো তাড়াতাড়ি আমি বউ পাবো কোথায়? বউয়ের অভাবে বুকের খোরাক বুকেই রয়ে যাচ্ছে যে। শ্বাসরোধ হয়ে যে কোনো সময় ইন্না-লিল্লাহ।”
চোখ রাঙায় নিরা। বিছানা ভাজ করতে করতে আবার নরম স্বরে বলে, “তুমি আর কখনও মারামারি করবে না, নাবিল ভাই।”
অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল নাবিল।
“তোর চিন্তা হয় আমাকে নিয়ে?”
“হু।”
“তাহলে আরও করবো। আই লাভ ইউর চিন্তা চিন্তা কেয়ার।”
নিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নাবিল আয়নার সম্মুখে মুখ রেখে চায় ওর দিকে। শান্ত স্বরে বলে, “তুই আমার জন্য ভাবছিস ব্যাপারটা মাথায় আসলে আমার কেমন লাগে জানিস? মরুভূমিতে বৃষ্টি পড়ার মতো সুখের। এই প্রথম অনুভব করলাম, তুই আমার জন্য চিন্তা করিস। কাঁদিস। উদ্বিগ্ন হওয়াও শুরু করেছিস। ব্যাপারটা দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সমস্ত প্রাপ্তি বোধহয় শীগ্রই আমার একার হতে যাচ্ছে।”
এই প্রথম এতো মোহ, মুগ্ধতা নিয়ে মানুষটার কন্ঠে আগ্রহ ঢেলেছে নিরা। অকারণেই ভালো লাগছে শুনতে। সাথে লজ্জাও। দৃষ্টি এলোমেলো রেখে আড়ালে লজ্জা ঢাকে নিরা। জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে বাইরে। নাবিল কফিতে চুমুক বসিয়ে অপলক, অক্লান্ত উপভোগ করলো নিরার চাওয়া। কী মিষ্টি একটা ছোট্ট মুখ মেয়েটার! দেখলেই গাল নয়তো নাক টিপে দিতে ইচ্ছে করে। আদর আদর চাহুনি।
নিরা সেভাবে জানালাতে চেয়েই হেসে আনমনে ডেকে উঠে ওকে,
“নাবিল ভাই!”
“হু।”
“তোমার সারপ্রাইজটা রেডি তো?”
ভ্রু কুঁচকায় নাবিল। বিভ্রান্ত নিয়ে শুধায়, “কিসের?”
ওর চোখে চোখ রেখে তাকায় নিরা। রহস্য উদঘাটিত হাসি হেসে বলে,
“ওইযে? প্রেমিকা খুঁজে বের করার বিনিময়ে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলেছিলে, ওটা।”
মগটা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে চায় নাবিল। কৌতুহল নিয়ে আরেকটু দূরত্ব নিভিয়ে বসে। শুধায়, “পেয়েছিস খুঁজে?”
“হু।”
নাবিল নিভৃতে ঠোঁট কামড়ে হাসে। ধীরে আরও সামনে এসে বসে ওর। সরু,চিকন নাকটা টেনে হেসে ফিসফিস করে বলে, “এতোদিন লাগলো বের করতে? আমি হলে কিন্তু এক মিনিটেই বের করে ফেলতাম। বোকা নিরা।”
নিরা নিরুত্তর রয়। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে দৃষ্টি এলোমেলো রেখে এদিক-ওদিক চায়। নাবিল একেবারে মুখের সামনে ঝুঁকে আসে ওর। মেয়েটার অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে ভীষণ। সে মুখের সামনে মুখ নিয়ে ফু দিয়ে সামনের চুলগুলো উড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“কি মনে হয় বল তো? সে আমাকে নিজের প্রেমিক মানতে রাজি হবে? একতরফা থেকে দূতর্ফার প্রমোশন হয়েছে প্রেমটার? প্রেমিক প্রেমিক অধিকার রটাতে পারবো এখন থেকে? নবপ্রেমের সূচনা হিসেবে একটু বেহায়া আচরণ করতে পারবো? অনুমতি আছে? দেবে অনুমতিপত্র আমার লাজুক প্রণয়িনী? জিজ্ঞেস কর একটু।”
শেষের কথাটা নিরার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল নাবিল। লজ্জায় আর দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। অজানা শিহরণে শরীর কাঁপছে নিরার। হৃৎস্পন্দন বেড়েছে। বুকের ধুকপুকানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠোঁট,গলা কাঁপছে। উঠে দাঁড়াল সে৷ নাবিল ওড়না টেনে ধরলো ওর। থমকে যায় নিরার পৃথিবী।
“কী হলো? জিজ্ঞেস করবি না?অন্তত একটা চুমু তো খেতেই পারি। এইটুকুর অনুমতি তো প্রাপ্য আমার?”
ভেতরে ভেতরে দুষ্টুমি খেলিয়ে ওকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইচ্ছে করেই শেষের বাক্যটা জপলো নাবিল। কাজও হলো। লাজে থরথর করে কাঁপছে নিরা। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকল আড়ষ্টতায়। নাবিল আরও কিছু বেফাঁস কথা শোনানোর পূর্বেই নিরা আকস্মিক ওর বুকে ধাক্কা মারলো। উঠে আরেকবার ফিরে চাইলো একজোড়া বেহায়া, বেহেলাজ চোখে। নেশাগ্রস্তের মতো চেয়ে আছে নাবিল। ওড়না ছাড়িয়ে পা চালাতেই নিরার ওড়নার মসৃণ কোণ ছুঁয়ে গেলো নাবিলের কপাল, চোখ, নাক, ঠোঁট। সে চোখ বুজে শুষে নেয় সবটুকু মেয়েলী সুভাস। বোকা রমণীর ওড়না ছুঁয়ে গেলো নাবিলের শরীর, আর লাজুকতা ছুঁলো একটা অতৃপ্ত, তৃষ্ণার্ত বুক!
চলবে।