গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১৭
#নাজমুন_নাহার
“মাথা ঠিক আছে তোমাদের?”
কথাটা বলেই তুমুল শব্দ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নিলয়৷ ক্ষোভে আগুন জ্বলছে গায়ে৷ আলমগীর আহমেদ অত্যন্ত স্নেহের সাথে ছেলের পানে চাইলেন। পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, “তোর যদি ব্যক্তিগত পছন্দ থাকে, তাহলে আমরা ওদের না করে দিবো। আছে কেউ?”
“বাবা, কেউ থাকা আর না থাকাটা ফ্যাক্ট না। না থাকলেই নিজেদের সিদ্ধান্তে আমার উপর একটা বিয়ে চাপিয়ে দিবে? আই এম শকড যে তোমরা আংটিবদলের দিনতারিখ পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছো! আমাকে আর জিজ্ঞেস করার কী দরকার তাহলে?”
“নিরাকে তোর পছন্দ না?”
নিলয় হতাশ শ্বাস ফেলল। কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,” পছন্দ না হওয়ার ব্যাপার না, বাবা। ইভেন ওকে পছন্দ না করে থাকাই যায় না। বাট স্টিল, তোমরা ওকে কিংবা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতে।”
খাদিজা থমথমে মুখ করে বসেছিলেন এতোক্ষণ। এ পর্যায়ে উঠে দাঁড়ালেন।
“তোদেরকে কি জিজ্ঞেস করবো? তোদের ভালো-মন্দটা তোদের চেয়ে ভালো আমরা জানি। তোর বাবা-র সঙ্গেও তো আমার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। আমরা কি ভালো নেই? তিরিশ বছরেট সম্পর্কে আমাদের মধ্যে কি কখনও অশান্তি দেখেছিস? ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে কখনও?”
নেহাল করুন করে চাইলো ভাইয়ের পানে। ক্ষীণ স্বরে বলল, “কাউকে পছন্দ হলে বল, আমি ব্যক্তিগতভাবে তোর পক্ষই নেবো।”
নিলয় ক্ষোভ, বিরক্তি আর অসহায়ভাব করে চায় ভাইয়ের পানে। বলে, “নেই ভাইয়া। বাট আমি বিয়েটা এখন করতে চাচ্ছি না।”
“সমস্যা কোথায়? এখন আংটিবদল করে রাখ, বিয়েটা তোদের মর্জি মতোই পরে হবে।”
নিলয় ব্যর্থ নয়নে চায় একে একে সকলের পানে। ভাইয়ের পানে বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে নিঃশব্দে প্রস্থান নিলো। উপলব্ধি করলো, এদেরকে বুঝিয়ে লাভ নেই।
খাদিজা ছেলের যাওয়ার পানে চেয়ে মিটিমিটি হাসলেন। স্বামীর পানে চেয়ে ফিসফিস করে বললেন, ” এখন তো না না করছে। বিয়েটা একবার হয়ে গেলে তখন দেখবে, বউ ছাড়া কিছুই বুঝবে না।”
বারান্দায় এসে বসল নিলয়। মেজাজ খারাপ লাগছে ভীষণ। ঘরে গিয়ে একটা সিগারেট নিয়ে আবার ফিরলো বারান্দায়। সিগারেটে সুখটান মেরে ফোনটা হাতে নিলো৷ টুংটাং শব্দ ভেসে আসে ম্যাসেজের। অসময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটির ম্যাসেজ দেখে অবাক হয় নিলয়। বর্ষা লিখেছে,
“পরে ম্যাসেজ করবো বলেও যে করলাম না, আপনি কি রাগ করেছেন সে কারণে?”
ফিরতি উত্তর না পাঠিয়ে সোজা ফোন করলো নিলয়। দু’বার রিং হওয়ার রিসিভ করলো বর্ষা। রিসিভ করতেই নিলয় থমথমে স্বরে বলে, “বৃষ্টি পড়ছে কুমিল্লায়।”
বর্ষা বিভ্রান্ত হয় কিছুটা। “নেই।”
“কোথায় আছো তুমি?”
একের পর এক অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে অবাক হয় বর্ষা।
“ভার্সিটিতে।”
“আজ একটু দেরি করে বাসায় গেলে আপত্তি আছে?”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে জবাবে বর্ষা। বলে, “না নেই৷ কেন?”
“আমার মন খারাপ। তুমি আমার মন ভালো করাবে আজ।”
কী আশ্চর্যজনক আবদার। কৌতুহলবসত অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। সেসব দমিয়ে আপাতত বর্ষা জবাব দেয়, “কোথায় বসবো?”
“আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি৷ তুমি একটা রেস্টুরেন্টে বসে সময়টা কাটাও। দেড় ঘন্টার মধ্যে এসে পড়ব।”
প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করিয়ে নিলয় এলো দুপুর তিনটায়৷ ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশের একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে ওরা। নিলয়ের মন খারাপের প্রকৃত কারণ জানার পর থেকে পেট ফাটিয়ে হাসছে বর্ষা। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো বিস্মিত সে৷ ওর হাসি দেখে নিলয়ের রাগ তড়তড় করে বাড়ছে। থমথমে মুখে চেয়ে আছে সে।
“তোমাকে আমি কি হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখাচ্ছি? কমেডি হচ্ছে এখানে? হুয়াই ইউ লাফিং?”
বর্ষা মুখ চেপে ধরে নিজের। তাকায় আবার। চোখে চোখ রেখে আবার হেসে দেয়। নিলয় গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসে। মেয়েটা বড্ড ফাজিল।
“আমি তোমার কাছে নিজের দুঃখ শেয়ার করতে আসলাম আর তুমি মশকরা করছো? পাষাণ একটা!”
বর্ষা এবার সত্যি সত্যি হাসি বন্ধ করলো। বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।
“স্যরি। আসলে বিয়ে করা ব্যাপারটাও যে এতোটা দুঃখের হতে পারে আমি সত্যি উপলব্ধি করিনি। আজ করলাম। একইসাথে আপনার মন খারাপের মাত্রাটা আচ করতে পারছি।”
নিলয় রাগী রাগী মুখ করে চায়। “আবার মশকরা?”
কপাল চাপরায় বর্ষা। “এইবার সত্যি মজা নয়, আই এম সিরিয়াস। বাট আই উইল সাজেস্ট ইউ, বিয়েটা করে নিন। নিরা ভালো মেয়ে। দেখতেও জলজ্যান্ত পরী।”
নিলয় উঠে দাঁড়ায়৷ হাঁটা ধরে নির্বিকার ভঙ্গিতে। বর্ষাও উঠে দৌড় লাগায় ওর পিছু পিছু। হাঁক ছাড়ে, “মজা করে বলিনি, সত্যি। আপনি বিয়েটা করে নিন, নিলয়। শি ইজ গুড ফর ইউ।”
নিলয় ঘাড় না ঘুরিয়েই জবাব দেয়,”আমি জানি নিরা ভালো মেয়ে, যোগ্য মেয়ে। কিন্তু বর্ষা, একটা তরতাজা মন ভাঙ্গার মতো মুহূর্তে আমি আরেকজনের তরে নিজের জীবনটা কীভাবে সঁপে দেই? ম্যারিজ লাইফ নিয়ে ওর এক্সপেকটেশানস হাই থাকবে। সব মেয়েদেরই থাকে। সেসব কীভাবে ফুলফিল করবো আমি? মেন্টালি আই এম নট এভেইল টু ম্যারি। আর এই ব্যাপারটাই কাউকে বোঝাতে পারছি না।”
বর্ষা হাঁপাতে হাঁপাতে ওর পায়ে পা চালায়। তাল মেলাতে পারছে না নিলয়ের হাঁটার সঙ্গে। এতো লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটে লোকটা।
“আংটি পরিয়ে রাখেন। এই অপশন তো আছে আপনাদের। টেক টাইম। এতো তাড়াহুড়ায়র প্রয়োজন কি?”
দাঁড়ায় নিলয়। হতাশ শ্বাস ফেলে চায় ওর পানে। কতটা নির্লিপ্ত, নির্বিকার মুখে কথাগুলো বলছে মেয়েটা। মাথা ঝাঁকায় হতাশ ভঙ্গিতে নিলয়।
“শুধু আমার ফ্যামিলি না, তুমিও একটা পাগল। তোমরা সবাই পাগল।”
হাসে বর্ষা। “সে যাই বলুন না কেন,নিরার মতো বেস্ট অপশন আপনার জন্য আর হয় না। আপনার তাকে হারানো উচিত না। শি ইজ ডায়মন্ড ফর ইউ। আমি ছেলে হলে তো, লাফাতে লাফাতে বিয়ে করে নিতাম।”
নিলয় তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে সহসাই শব্দ করে হেসে ফেলল এবার। চোখ নামিয়ে আবার চায়। দুই হাত বুকে ভাজ করে লম্বা শ্বাস টেনে আবার হাসে। শুধায়, “কি খাবে?”
বর্ষা আশেপাশে চোখ বোলায়৷ হাত ইশারায় দূরে কিছু একটা দেখিয়ে বলে, “ফুচকা। আপনি ফুচকা খান?”
নিলয় হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়, “খাই না। তবে ট্রাই করা যায় আজ। আজ সব নিয়ম-নীতির ছুটি।”
ফুচকা খাওয়ার পর আরও এক ঘন্টা ওরা বসে ধর্মসাগরপাড়ে। আড্ডা দেয়, অপ্রাসঙ্গিক আলাপে শব্দ করে হাসে। নিলয় ভুলে যায় তার আপন দুঃখ, আপন মন খারাপ। দু’টো সহজ-সরল মন কখন যেনো ভুলে যায়, ওদেরও মন ভেঙ্গেছে সদ্যই। কাঁচা প্রাণ ওরাও। একই অপারগ পথের সহযাত্রী। কেবলই ভয়ংকর কিছু দুর্যোগ শেষ হলো ওদের জীবনের। সেসব ধূসর রঙা বিষন্ন দিনগুলো মনে রাখল না ওরা৷ কেবল বুঝল, আজকের দিনটা সাদামাটা হলেও বিষন্নতার মতো রঙচটা নয়। প্রহরগুলো বড্ড সুখের। আকাশে-বাতাসে প্রশান্তির সুভাস। আরাম লাগছে শ্বাস নিতে। অপরুপ লাগছে ক্ষুদ্র শহরটাকে!
—–
প্রকৃতিতে আষাঢ় ছুঁই ছুঁই ভাব। বর্ষার আগমনীর শুরুর দিকেই নিকষ কালো আধারে ছেয়ে গেছে চরাচর। আজ ক’দিন যাবত আবার কদাচিৎ মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সময়ে-অসময়ে হুটহাট শুরু হয় বর্ষণ। ব্যস্ত শহরের ফাঁকফোকড়ে পানি জমে জমে জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। মাটিতে, বাতাসে আদ্র সেঁতসেঁতে সুভাস। কোথাও কোনো শুষ্কতা নেই৷ আছে কেবলই প্রকৃতির নির্মলতা।
আজই ইনকোর্সের শেষ পরিক্ষা নিরার। পরিক্ষা শেষ হলো বেশ কিছুক্ষণ হয়। হল থেকে বেরিয়েই করিডর দাঁড়াল। তাকাল আকাশের পানে। ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবকিছু ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। আকাশে মেঘ করেছে ভীষণ। সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় আসবে গগন কাঁপিয়ে। হতাশ শ্বাস ফেলল সে। বৃষ্টি তার প্রিয়, তবে এই পরিস্থিতিতে বৃষ্টি এলে বাসায় যাবে কি করে? বাসা থেকে আবার ছাতাটাও নিতে ভুলে গিয়েছে। সময়মত বাসায় পৌছাঁতে না পারলে বাবা-র শখানেক ফোন এসে পড়বে। মা চিন্তা করবে। নিরা মন খারাপের ভঙ্গিতে চাইলো ইমুর পানে। বেচারীর অবস্থাও একই। কাকতালীয়ভাবে ইমুও আজ ছাতা নেয়নি। উপায়ন্তর না পেয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে কিছুক্ষণ বসার সিদ্ধান্ত নিলো ওরা৷ পরিক্ষা শেষ, আজ বাসায় দেরি করে গেলেও আহামরি সমস্যা হবে না। দু’জনই ফোন করে জানিয়ে দিলো বাসায়।
ক্যাফেটেরিয়ার কাঁচের দরজা পেরুতেই গানের আওয়াজ ভেসে আসলো কানে। ক্যাম্পাসের সিনিয়ররা গানের আসর জমিয়েছে সেখানে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ক্যাপেটেরিয়াতে কোনোরকম হৈ-হুল্লোড় করার নিয়ম নেই। তবে আজ যেনো কেউ কিছু বলছে না৷ ক্যান্টিনটাকে মুক্ত লাগছে৷ বাইরের ঝড়ের হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এরাও জুড়েছে ঐকতান। এমনকি ক্যান্টিনের মামারাও সুরে সুর মেলাচ্ছেন কখনও কখনও। ইমু খুশিতে গদগদ হয়ে যেতে চাইলে নিরা হাত টেনে ধরে ওর। ধমকের স্বরে বলে, “এই, তোর ওখানে কি কাজ? সবখানে মেয়েটার নাচন বেশি। ওরা কি আমাদের ব্যাচমেট? সিনিয়ররা নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে সেখানে আমাদের কি কাজ? বস এখানে।”
ইমু মন ভার করে চায় বান্ধবীর পানে।
“সিনিয়র তো কি হয়েছে? ওরা সবাই তো আমাদের পরিচিত। নাবিল ভাইও তো আছে ওখানে। আয় তো, কিচ্ছু হবে না।”
নাবিলের নাম শোনামাত্রই তীক্ষ্ণ চোখে চাইলো একপলক। উল্টো পিঠ হয়ে বসেছে লোকটা৷ পরনে হাল্কা আকাশী রঙের শার্ট আর কালো জিন্সপ্যান্ট। শার্টের হাতা দু’টো কনুই অব্ধি ভাজ করানো। চুলগুলো এলোমেলো, উসকোখুসকো। হাতে একটা কালো রঙের গিটার। বসার ধরন অদ্ভুত আবেদনময়। ক্লাসিকসের এলিট ক্লাসের নায়কদের মতো দেখতে লাগছে উল্টো পিঠ থেকে। কন্ঠ মধুর।
প্রথম গান শেষ হলে সকলে সজোরে তালি আর শিষ বাজাল। বন্ধুদের অনুরোধে দ্বিতীয় গানের জন্য পূনরায় সুর তুললো গিটারে। অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট থেকে শুরু করে জুনিয়ররাও ভীর করে বেশ প্রতিক্ষা নিয়ে বসেছে। এবারের গানটা নাবিলের কন্ঠে এর আগেও শুনেছে ওরা। সকলের তুমুল জোরাজোরিতে আবার সেটা গাইতে রাজি হয় সে। ক্ষুদ্র সংখ্যক দর্শকের মনোরঞ্জন করার উদ্দেশ্যে এই পর্যায়ে গায়ক গলা ছেড়ে ধরে গান। গায়কের উৎসাহ বাড়াতে নিস্তব্ধ হয়ে যায় সকলে।
“তুমি আমায় ডেকেছিলে এক মেঘে ঢাকা দিনে
কেন আমি সাড়া
আমার চোখে আকাশ দেখে তুমি বলেছিল কিছু
বুঝিনি কেন সে ইশারা
এখন আমি অন্য আমি হয়ে
ছুটে চলি তোমার শহরে
হারিয়ে চোখের যত ঘুম….
ঝুম….ঘুরে ঘুরে দূরে দূরে ঝুম….
মেঘে মেঘে ডানা মেলে ঝুম..
ঘুরে ঘুরে তারেই খুঁজি…
থামল নাবিল। শাওন গান শেষ হতেই বন্ধুকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরল দুই বাহুতে। আবেগপ্রবণ ভঙ্গিতে বলল,” ম্যান, ইউ জাস্ট মেল্ট মাই হার্ট। ভাই তুই সেরা।”
না চাইতেও ঠোঁটের কোনে এক ফালি হাসির রেখা ফুটে উঠে নিরার। কী চমৎকার গানের গলা মানুষটার। এই প্রথম তার এই বিশেষ গুনটা নজরে পড়ল নিরার। ইমু আরচোখে একপলক চায় ওর পানে। বলে, ” নাবিল ভাই একটা চিজ রে মাইরি। এমনিতেই ক্যাম্পাসের জুনিয়র রা উনার উপর টাস্কি খেয়ে পড়ে থাকে, তার উপর এই সুর শুনলে ওরা তো মরেই যাবে বন্ধু।”
নিরা থমথমে আঁধার মুখে চাইলো। মনে মনে ইর্ষা নিয়ে শুধালো, “কারা তার উপর টাস্কি খেয়ে পড়ে থাকে?”
ইমু ইশারায় নিপাকে দেখিয়ে বলে, “এদের বন্ধুমহলেই তো আছে একজন। নিপা, দ্য ক্যাট্রিনা কেফ।”
বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে মুখ ভেঙ্গিয়ে শেষে নামটা জপে ইমু। নিরা বিরক্তিকর চোখে চাইলো নিপার পানে। শাওনের কাছ থেকে নিরা এই চিপকিগার্লের ব্যাপারে আগেই শুনেছিল নিরা। আশ্চর্যের ব্যাপার! পছন্দ করে জানার পরও কেন নাবিলের এর সঙ্গেই বসতে হবে? ব্যাচমেট বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে না-কি? আসুক এই লোক আর সামনে। আস্ত ইট দিয়ে তার মাথা ভাঙ্গবে নিরা। আর একে দেখো? একটা মেয়ে কতো নির্লজ্জ হতে পারে সেটা নিপাকেই উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায়। এতোগুলা ছেলের মাঝে কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে আছে বেহায়া টা। বিশ্রী চোখজোড়াও নাবিলের দিকেই নিবদ্ধ। এতো রসকষ নিয়ে দেখে মিটিমিটি হাসছে, যেনো চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে নাবিলকে।
নিরা তাৎক্ষণিক টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাসটা তুলে শব্দ করে আবার রাখল সেটা। এ পর্যায়ে সঙ্গে সঙ্গে সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। পুরো ক্যাফেটেরিয়ার নজর এখন ওর পানে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই নিরার। সে কেবল চোখ দিয়ে ভস্ম করে ফেলার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নাবিলের পানে। শাওন ইশারায় নাবিলকে পেছনে ফিরতে বলে। নাবিল ফিরে চায়। নিরার রাগী রাগী মুখটা দেখে ভ্রু বাঁকায়। কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধুপধাপ পায়ে ক্যান্টিন থেকে প্রস্থান নেয় নিরা। নাবিল প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চায় শাওনের পানে। শুধায়, “কাহিনী কি?”
শাওন মিটিমিটি হাসে। ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ” মনে হয় জেলাস।”
নাবিল সন্দিহান চোখে চাইলো ওর দিকে। “খামোখা জেলাস হতে যাবে কেন?”
শাওন ইশারায় নিপাকে দেখালো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আগুন চোখ নিক্ষেপ করলো ওর উপর নাবিল। জানতে চাইলো, “ওর কথা নিরাকে কে বলেছে?”
শাওন তাৎক্ষণিক উঠে দূরত্ব নিয়ে দাঁড়াল নিজেকে বাঁচানোর ভঙ্গিতে। দুই হাত গালে রাখল ভয়ে ভয়ে। বলে, “আকামটা আমার দ্বারাই হয়েছে বন্ধু। আই এম ভেরি ভেরি স্যরি দোস্ত! কথায় কথায় একদিন কুটনামিটা করে ফেলেছি। তখন তো আর জানতাম না, এটাকেই যে তুই আমাদের ভবিষ্যত ভাবী হিসেবে পয়েন্ট করবি। এইবারের মতো মাফ কর ভাই।”
নাবিল তেড়েমেড়ে কলার চেপে ধরলো ওর। পুরো ক্যাফেটেরিয়া উড়াধুরা ধস্তাধস্তি চললো দু’জনের। ইমু এদিকেই চেয়েছিল এতোক্ষণ। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে হুট করেই শাওনের চোখ যায় ওর দিকে। মিটিমিটি হাসছে মেয়েটা। শাওন অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে নাবিলকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল, “ভাই, পরে চিপায় নিয়ে শোধবোধ করে নিস৷ এখন থাম। সামনে ক্রাশ। এদিকেই তাকায়ে আছে। ওর সামনে কিল-ঘুষি মেরে ইজ্জতের ফালুদা বানাইস না। এমনিতেই সহ্য করতে পারে না, এখন মাইর খাইতেসি দেখলে পাত্তাই দিবে না।”
নাবিল ঠোঁট টিপে হেসে ছাড়ল ওকে। ইমুর দিকে চেয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে ডাকল ওকে, “ইমুপাখি, কি দেখছো?”
ইমু হাসি সংবরণ করে। “কিছু না, ভাইয়া।”
“কিছু তো একটা দেখছোই৷ শুনো, একটা হেল্প করতে পারবে ভাইয়ার?”
“জ্বি, বলুন।”
“আমার বন্ধু শাওনের আজকে খুব মন খারাপ। বৃষ্টির দিনে ওর কারণেই এমন মন খারাপ হয়। পারিবারিক রোগ। এসব দিনে সে আবার একা থাকতে পারে না। নিঃসঙ্গ থাকলেই রেগে নিজের মাথা নিজে ফাটিয়ে দেয়। তাই ওর মন খারাপ হলে আমি ওকে কখনও একা ছাড়ি না। প্রেমিকার মতো পেম্পার করি। একটু যত্নআত্তি করা যাকে বলে।”
ইমু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। “তো আমি কি করতে পারি? ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। এমনিতেও আপনার বন্ধু একটা আধপাগল। তার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন।”
অপমানে, অপবাদে হৃদয়টা ব্যথিত হয়ে আসে শাওনের। নাবিল আড়ালে ওর পিঠে হাত রেখে ঠোঁট টিপে হাসে। পূনরায় সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
“সেটা তো পরে দেখাব। বাট এখন তো সামলাতে হবে ক্ষণকালের জন্য। ভাইয়ার একটু বাইরে যেতে হচ্ছে। ওকে একা রেখে যাই কি করে? মুড সুইং হলে পরে কেঁদেকেটে কখন দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে, ঠিক নেই। ব্যাপারটা রিস্কি। একজন স্বহৃদয়বান বন্ধু হিসেবে এটা তো হতে দেওয়া যায় না তাই না? থাকো না বোনু একটু। যাই আমি হু? একজন চরম রেগে আছে আমার উপর। তার রাগ না ভাঙ্গালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কেয়ামত হবে, কেয়ামত।”
করিডর, লাইব্রেরী, ডিপার্টমেন্টের ক্লাস, কমন রুম, কোথাও দেখা নেই নিরা। চারতলার পুরোটাই খোঁজা শেষ। এদিকে শুরু হয়েছে মুশলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে রেগেমেগে কোথায় গেলো মেয়েটা?
পূনরায় হাঁটা ধরলো গ্রাউন্ড ফ্লরের উদ্দেশ্যে। করিডর দিয়ে আনমনে বাইরে চোখ যেতেই নজর আঁটকে এলো ক্যাম্পাসের ফিল্ডে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে লাফাতে থাকা মেয়েটার উপর। নাবিল তাকাতেই নিরা ইশারায় হেসে ডাকল ওকে। পা থেকে মাথা অব্ধি ভিজে চুবচুবে অবস্থা। নাবিল তাৎক্ষণিক পা চালিয়ে ফিল্ডে যায়৷ নিচতলার করিডর থেকে হাঁক ছাড়ে, “এখানে কি তোর?”
নিরা জবাবে হাসল। কিছুক্ষণ আগের মন খারাপের গল্প ভুলে আকাশের পানে মুখ মেলে দিয়ে সবটুকু জল শরীরে শুষে নিতে নিতে আবার চেয়ে হাসল। হাত মেলে দিয়ে বৃষ্টি ছুঁতে ছুঁতে জবাবে শুধায়, “বৃষ্টিতে তোমার জ্বর হয়,নাবিল ভাই?”
নাবিল শরীরের অসুখ লুকিয়ে মনের খোরাক মেটাতে পা ফেলল কাদামাটিতে৷ ভেজাল দেহ-প্রাণ। বৃষ্টিবিলাসীর সম্মুখে আসতে আসতে নেশাগ্রস্থের মতো বলল, “মনে সুখ নিয়ে ভিজলে বৃষ্টি কাউকে অসুখ দেয় না। বিশ্বাস রাখতে হয় ।”
নিরা ঘাসের উপর আচমকা বসে পড়ল। ইশারা করলো ওকেও বসতে। নিরা দুই পা সামনে মেলে বসল। হেসে নাবিলও ‘দ’ আকৃতিতে বসে পেছনে দুই হাত ঠেকিয়ে আকাশের পানে চায়। এ পর্যায়ে সে-ও পুরোপুরি ভিজে একাকার। নিরা ওর পানে চেয়ে হাসল নিভৃতে। শুধাল, “পৃথিবীতে কেটস এন্ড ডগস বৃষ্টিতে ভেজার চেয়ে সুন্দর রোমান্টিসিজম আর অন্যটি হতে পারে,নাবিল ভাই?”
নাবিল ঠোঁটের কোনে বিমোহিত হাসি টানল৷ আবেদনময় কন্ঠে সম্মতি জানাল, “উহু।”
“নাথিং ক্যান বি মোর বিউটিফুল দ্যন দ্য রেইন।”
নাবিলের কন্ঠে অসম্মতি এ পর্যায়ে। মাথা নাড়িয়ে বলে,! “ক্যান বি।”
আড়চোখে চায় নিরা। নাবিল পাশে অবহেলায় পড়ে থাকা নিরার হাতের উপর হাত ছোঁয়ায় নিজের। পূনরায় আকাশে চোখ মেলে বলে, “ইউ আর মোর বিউটিফুল দ্যন এনিথিং, বেইবিগার্ল।”
আপনাআপনিই ঠোঁটে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি নিরার। নির্জন হয় মনের পরিবেশ। নিরা জবাব দিলো না, হাত সরাল না। কেবল চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির সুরেলা গান শুনলো। উপভোগ করলো চরাচরের সবচেয়ে সুন্দর দিনটিকে। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে ওর ঠোঁটে, চোখের পাপড়িতে, গালে। কী আশ্চর্য উপন্যাসির ঢঙ্গের দৃশ্য! নাবিল মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো অপলক। মুখ থেকে চোখ সড়িয়ে চাইলো পায়ের দিকে। তার মায়াবতীর ফর্সা পা দু’টো লাগছে দুধে-আলতার সৌন্দর্যের অনুরুপ। নুপুরজোড়া পরম আবেশে শুয়ে আছে পায়ে৷ চিকন চিকন আঙ্গুলগুলোকেও লাগছে নজরুল কবিতার ছন্দের মতো। সে মায়াময় কন্ঠে ডাকে ওকে, “নীর!”
নিরা চোখ বন্ধ রেখেই সাড়া দেয়। “হু।”
“রাত জাগার অভ্যেস আছে তোর?”
নিরা চোখ তুলে চায়। অসময়ে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে বিভ্রান্ত হয় কিছুটা। নাবিক আবার শুধায়, “আছে?”
“নাহ। তোমার জানার কথা, এগারোটার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।”
” আজ থেকে রুটিনটা পরিবর্তন করতে হবে।”
“কেন?”
তুইও রাত জাগবি। বেশি না, বারোটা অব্ধি হলেও চলবে।”
“কি করবো জেগে?”
“কথা বলবি আমার সাথে। আমার বন্ধুরা রাত জেগে প্রেমিকাদের সঙ্গে কথা বলে। হোস্টেলে থাকতেও দেখতাম, ভোর অব্ধি পৃথিবীর সকল ফালতু বিষয় নিয়ে প্রেমিকার সাথে ফুসুরফুসুর করতো। যদিও তখন ব্যাপারটায় বিরক্ত হতাম। ভাবতাম, ঘুমের রফাদফা করে যারা এমন হুতুমপেঁচার মতো রাত জাগে, এরা মূলত উজবুক, আহাম্মক। আমি হলে কখনোই এমন ন্যাকা ন্যাকা কাজ করতাম না।”
বলে হাসল নাবিল। নিরা বাঁধ সেধে শুধায়,
“তো?”
“সম্ভবত আমারও ইদানীং এই ন্যাকা ন্যাকা কাজগুলো করার স্বাদ জাগতে শুরু করেছে। আজকাল ভোর অব্ধি নির্ঘুম রাত কাটাতে ইচ্ছে হয়। পৃথিবীর সব ফালতু বিষয় নিয়ে আমারও একটা তোতাপাখির সঙ্গে ফুসুরফুসুর করতে ইচ্ছে হয়। এসব এক্সিকিউট করতে হলে তোর জেগে থাকাটা জরুরী।”
নিরা না চেয়ে স্মিত হাসে। সুরে আদর মিশিয়ে শুধায়, “আর কি কি করতে ইচ্ছে হয় তোমার?”
নাবিল চোখ ছোট ছোট করে ভেবে বলল, “আর ইচ্ছে হয় সারা শহর হুডখোলা রিকশায় করে প্রনয়িণীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে।”
নিরা তাৎক্ষণিক উঠে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হেসে হাত বাড়াল। বলল, “চলো, তোমার ইচ্ছে পূরণ করি। হুডখোলা রিকশায়, স্বর্গীয় আষাঢ়ে।”
নাবিল ভ্রু কুঁচকে চাইলো। পরক্ষণেই হাসল আবার। হাত ধরে উঠতে উঠতে শুধায়,
“আর ইউ সিউর?”
মাথা ঝাঁকায় নিরা। “হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”
বিকেলের নরম আলো আর রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজে শহরটা যেন আজ একটু বেশিই ছন্দময় হয়ে উঠেছে।
রিকশার ছাউনির নিচে দুইজোড়া চোখে জমে থাকা গল্পেরা মুখোমুখি বসে। শরীর শরীরকে পুরোপুরি ছোঁয় না, কিন্তু মন ছোঁয় একে-অপরের মন, অস্তিত্ব। চারিদিকে কেবল ঝমঝম বৃষ্টির গান আর পাশাপাশি ওরা। মনে হচ্ছে, এই শহরে আজ কোনো কৃত্রিমতা নেই, নেই কোলাহল। কেবল আছে দু’টো মায়াময় প্রাণ। একটা নিবিড় অনুভুতি আর ওদের গোপন প্রেমের মৌসুম।
নিরা হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়। তখনই বাজ পড়ে আচমকাই। সে খামচে ধরলো নাবিলের শার্ট। হাসে নাবিল। প্রেয়সীর সকল ভয় গুচাতে বাহুতে আগলে ধরে তাকে। এবার শরীর শরীরকে ছুঁলো। খুব গভীরভাবে না ছুলেও, ছুঁলো। এ ছোয়ায় শরীরের উন্মদনা না থাকলেও, মন হয় ব্যাকুল। কামনা-বাসনা হয় দৃঢ়। নাবিল অন্যদিকে মুখ করে বসে আত্নসসংযম করলো। ঘাড় বেয়ে টুপটাপ পানি বেয়ে পড়ছে ওর। শরীর থেকে ভেসে পারফিউমের মাতাল করা সুভাস। নিরা চেয়ে থাকে অপলক। একটা অপ্রতিরোধ্য মানুষের সঙ্গে খুঁজে পায় নিজের জীবন। একটা রিকশা, একটু ভিজে যাওয়া গাল, আর বাহুডরে আগলে রাখা একটা ভরসার হাত। পক্ষীরাজের ঘোড়ায় না চড়লেও আজ নিজেকে কুইন অফ অল মনে হচ্ছে নিরার।রিকশার চাকায় ঘূর্ণায়মান পানির ছিটা, আর হৃদয়ে জমে থাকা ভালোবাসার শব্দেরা একসাথে ছুটে চলে শহরের অলিগলি পেরিয়ে, এক অদূর ভবিষ্যতের দিকে। ওদের ঠোঁট কথা বলে না। তবে নিভৃতে কথা হয় হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের!
[চলবে]