গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১৮
#নাজমুন_নাহার
মুক্ত বিহঙ্গের মতো বাধাহীন বৃষ্টিতে ভিজে রাতে সত্যি সত্যিই জ্বর হলো নাবিলের। যদিও এ জ্বরে সামান্যতমও শারীরিক বেগ পোহাতে হচ্ছে না তাকে। শরীরে কষ্টকেও ছাড়িয়েছে মনের আনন্দ। জ্বরের মধ্যেও যেনো অসীম প্রশান্তি মনে-প্রাণে। যে জ্বরে দূর হয় চিত্তচাঞ্চল্য ও মানসিক অস্থিরতা। বাড়ে মনের খোরাক। অভিলাষ হয় আরও দৃঢ়।
রাতে তেমন মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে না। টুপটাপ পড়ছে ঝিরিঝিরি। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলো। ঘুম আসছে না নাবিলের। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করলো কিছুক্ষণ। আবার এলো ঘরে। বাসায় ফেরার পর থেকে সবকিছুই কেমন সাদামাটা লাগছে। নিরার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সবখানে। গায়ের শার্টটা শুকিয়ে সেটাই গায়ে জড়িয়েছে আবার। নিরার শরীরের মেয়েলী সুভাস পাচ্ছে সেটা থেকে এখনও। চোখের সামনে সে আজ কেবল একটা সুন্দর শান্ত মুখ দেখছে। তাকে এতো ব্যাকুলভাবে এই প্রথম মনে করা। বুঝল, অন্ধের যষ্টির মতো নিজের জীবনে নিরার অশেষ প্রয়োজনীয়তা। উপলব্ধি করলো, মেয়েটা একটু সঙ্গ দিলেই জীবন হয়ে উঠে রেশম তুলোর মতো নরম। টের পায় তার অস্তিত্বের চরম স্বচ্ছতা।
গ্যালারি ঘেটে ফ্যামিলি ফটোতে নিরাকে খোঁজার চেষ্টা চালালো। একটা পায়। মা’য়ের সঙ্গে নিরার হাসোজ্জল একটা ছবি। পরনে নীল জরজেটের থ্রি-পিস। হাসে সে। জুম করে হাত বুলায় ছবিটায়। ভীষণ মায়া ছড়িয়ে হাসে মেয়েটা। বড্ড আদরমাখা হাসি!
মনের ইচ্ছে আর না দমিয়ে ডায়াল করলো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে। রিং হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিসিভ করে নিরা। নাবিল অবাক হয় খানিক। সচরাচর এতো রাত পর্যন্ত নিরা কখনোই জেগে থাকে না। ওপাশ থেকে স্পষ্ট গলায় হ্যালো বলতেই নাবিল নেশাধরানো কন্ঠে শুধায়, “ঘুমাসনি?”
ক্ষীণ হাসল নিরা৷ মনে মনে লোকটার ফোনের অপেক্ষাতেই বসেছিল সে। কেন যেনো বিশ্বাস ছিল, নাবিল ফোন করবে।
“উহু।”
“কেন?”
“জানি না।”
ঠোঁট কামড়ে হাসল নাবিল। একটু চুপ থেকে ডাকে, “শোন!”
“হু।”
“তোকে আজ তুমি করে সম্মোধন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। করবো?”
সাড়া আসল না অপর পাশ থেকে। কেবল শ্বাসপ্রশ্বাস বাড়ার শব্দ ভেসে আসছে। ভেতরের লাজুকতা, অস্থিরতা দমিয়ে নিরা অনেকক্ষণ পর জবাব দেয়, “এতো শিগ্রীই প্রমোশন হয়ে গেলো সম্মোধনের?”
নাবিল কেমন করে যেনো শ্বাস ফেলে গভীর করে। কতো শতকের তৃষ্ণা সে-ই শ্বাসে। নিরার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে সেই মধুর শব্দে। নাবিল শান্ত অথচ গভীর আবেগ ঢেলে বলে, “আমার ধৈর্য্য, সংযম বরাবরই কম। প্রমোশন আরও অনেক ব্যাপারেই ঘটাতে ইচ্ছে করছে। সাধ্য আছে সেসবের, নেই বৈধতা। আমি চাঁদ দেখিয়া তাঁকে স্পর্শ করার খায়েশ মিটাই আপাতত।”
অসম্মতি জানিয়ে হাসে নিরা। বলে, “আমি চাঁদ নই। আর অসংযম মানুষও অপছন্দ আমার।”
হু হা করে বিশ্ব জয় করে হাসল নাবিল। দুষ্টুমি নিয়ে বলল,
“অনেক অপছন্দের লিস্টই পছন্দে কনভার্ট হবে। নাবিল আছে না? আই উইল হেল্প ইউ, পাখি।”
নিরা জানালা খুলে দেয়৷ পাখি! আহা! কী নেশাধরানো গলায় ওকে এমন নামে সম্মোধন করলো নাবিল। হাসে সে। স্নিগ্ধ বাতাস মুখে মাখতে মাখতে হুশিয়ারী করার স্বরে বলে, “আমার অনেক রাগ। রেগে কোনোদিন তোমার মাথা ফাটিয়ে দিতে পারি। নট ওয়াইফ মেটারিয়াল।”
“ইচ্ছে হলে ফাটাবে। তোর হাতে মাথা ফেটে ফাটাকেস্ট হয়ে যাক। সব মঞ্জুর। সব সামলে নেব।”
“আমি কথা কম বলি।”
“আমি বেশি বলে ব্যালেন্স করে নেবো।”
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাসল নিরা। নাবিল ডাকে আবার, “বললি না যে?”
“কি?”
“তুমি করে বলতে পারবো কি-না?”
“পারমিশন নিয়ে কোনো কাজ করার মতো সভ্য লোক তো নও তুমি।”
“অপবাদ দিচ্ছিস? সুযোগে অপমানও করছিস?”
“হু,করছি।”
নাবিল ভাবলেশহীনভাবে দায়সারা ভঙ্গিতে জবাব দেয়, ” তোর প্রেমে পড়ে সভ্য হয়ে গিয়েছি বলে অসভ্য জবাব দেওয়া থেকে বিরত রইলাম। তোর সব অপমান,অপবাদ আমার উপর ফুল হয়ে ঝড়ে পড়ুক।”
“তুমি অসভ্যই। সভ্যতার আড়ালে খাঁটি অসভ্য তুমি।”
“ল্যাহহ্! ছুঁলাম না, ধরলাম না আর অসভ্য হয়ে গেলাম? কী নির্মম নীতি রে তোর? অপবাদ দেওয়ার মাত্রা অতিক্রম হলে কিন্তু সত্যি সত্যিই আর সভ্য থাকছি না। যেচে বিপদ বাড়াস না নিজের। অবুঝ ছেলেটাকে সভ্য থাকতে দে।”
মুখ ভেঙ্গায় নিরা। নাবিল উন্মাদের মতো ডাকে আবার,
“জান!”
খিলখিল করে হেসে উঠল নিরা। পেট ফাটিয়ে হাসি পাচ্ছে তার।
“জান?”
“জান, কলিজা, ফুসফুস, সব। সমস্যা হচ্ছে শুনতে?”
“নাবিল ভাই, কী অদ্ভুত লাগছে তোমার মুখে জান শুনতে। তুমি আমাকে আজীবন জান,বাবু, সোনা ডাকবা? ও মাই গড! ভেবেই হাসি পাচ্ছে। ছিহ ছিহ ছিহ! এতোদিন মনে মনে তোমাকে ভাই ভাবতাম। মানা যাচ্ছে না এসব ন্যাকা ন্যকা ব্যাপার। শেষমেশ তুমিও সে-ই টিপিক্যাল বয়ফ্রেন্ডদের মতো করবা? কী লজ্জার ব্যাপার।”
নাবিল বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে ধমকায়। পরক্ষণেই কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
“শোন, আমার এতো ফেইক ফর্মালিটিস করতে ভালো লাগছে না, নিরা। আই এম মিসিং ইউ বেইবি। ভালোবাসলে লিমিটলেস ন্যাকা হতে হয়। আমার যা ইচ্ছে হবে আমি তা বলেই ডাকব। এতো বিধিনিষেধ মানতে পারবো না। তোকে আমি জড়তা ছাড়া হুটহাট ফোন করে ফেলতে চাই। ছুঁতে চাই। আমি চাই, ঘড়ির কাঁটার মতো চব্বিশটা ঘন্টা তুই আমার আশেপাশে থাক। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। তোকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে খুব! আমি বুঝি না, মানুষ কীভাবে বছরের পর বছর প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করে? আমার তো একদিনও ওয়েইট করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। চল না বিয়ে করে ফেলি? সব ঝামেলা আমি সামলে নিবো,প্রমিস।”
নেশাগ্রস্থের মতো এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল নাবিল। নিরা হাসে। ততক্ষণে ঘুম পুরোপুরি গায়েব। বিছানায় গা এলিয়ে কাঁথা গলা পর্যন্ত টেনে শুলো। পাল্টা জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলো, “ফুপ্পি কিছু বলেনি?”
“কোন ব্যাপরে?”
“কাল যে আমাদের বাসায় তোমাদের দাওয়াত।”
“বলতে পারছিনা। শুনিনি কিছুই। আম্মুর ব্যাপার-স্যাপারও অদ্ভুত ঠেকছে। আজকে সারাদিন তোর শাশুড়িটার মুড অফ। এই মা রমণীটাকে নিয়েও আমার চিন্তার শেষ নেই। কখন কী হয়, কী চলে বুঝি না। বাই দ্য ওয়ে, মামুর বাড়ি ওরফে শশুর বাড়িতে দাওয়াত কোন উপলক্ষে?”
“তেমন বিশেষ কারণ আছে বলে তো শুনলাম না। নিলয় ভাইয়ারাও আসবে। আব্বু মনে হয় তার দুই বোনকে মিস করছে। এই কারণেই বিনা উপলক্ষে জরুরি তলব।”
মাথা ঝাঁকায় নাবিল। বলে,”আরেকবার বরযাত্রী নিয়ে আসলে কেমন হয়? পরব শেরওয়ানি কালকে?”
কপাল চাপরায় নিরা। বিরক্তি নিয়ে শুধায়, “এই তোমার জ্বর হয়েছে?”
নাবিল বিরক্ত হয় খানিক। মেয়েটা বড্ড আনরোমান্টিক।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কেমন করে যেনো ম্যাকি রাগ দেখিয়ে বলে, “এই শোন, বউ না হতে পারলে এমন বউ বউ টাইপ শাসন করবি না। বিরক্ত লাগছে এসব। মুখে এক ফোটাও মধুর অস্তিত্ব নেই, আসছে ন্যাকা ন্যকা জ্বর মাপতে। সতেজ একটা রোমান্সের মধ্যে জ্বর ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই বাল তুই রাজী কি-না বল? নেওয়া যাচ্ছে না এসব আর। কালই বিয়ে করবো আমি।”
ওর বলার ধরনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অকস্মাৎ উচ্চস্বরে হেসে ফেলল আবার নিরা। আবারও ধমকে উঠে নাবিল।
“হাসবি না। আমার মরণ দশা, নিরা। তুই হাসলে তড়তড় করে রাগ বাড়ছে। আমি কিন্তু ছাঁদ থেকে লাফ দিবো। হারপিক খেয়ে ফেলব, আই স্যয়ার। আই এম ফিলিং স্যাড বেইবি। তোর উচিত ছিল ফটাফট এক্ষুণি বাসা থেকে পালিয়ে টপাটপ আমাকে বিয়ে করে ফেলা। তা না করে হাসছিস। কেমন মেয়ে রে তুই? একটুও মায়া হচ্ছে না?”
“মায়া হলেই কী? পরিস্থিতি এখোনও আউট অফ কন্ট্রোল। সব আমরাই নষ্ট করেছি। আব্বুর মন-মেজাজ স্বাভাবিক না হওয়া অব্ধি এখন এসব তুলতে চাচ্ছি না।”
“তাহলে আমার কী হবে?”
বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে কাঁদোকাঁদো স্বরে কথাটা বলে নাবিল। নিরা হাসে। বলে, “কিছুই হবে না তোমার। আমি আছি তো। আর তাছাড়া প্রেমে পড়েছি কি-না সেটাই তো ফিল করতে দিচ্ছো না এখনও৷ বাড়ির সামনে মাঝ রাত্তিরে আদর্শ প্রেমিকের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে, রমনায় কিংবা টিএসসিতে রিকশায় করে ঘুরবো, কেউ প্রেমপ্রস্তাব দিলে পজেসিভ প্রেমিকের মতো কড়া শাসন করবে, এসব না হলে প্রেমটাকে ঠিক প্রেম বলে মনে হচ্ছে না। তুমি আগে প্রেমিক হও, নাবিল ভাই। তারপর বিয়ে।”
“তুই আগে ভাই ডাকা অফ কর,মর্জিনা। থাপ্রাবো আরেকবার ভাই শুনলে।”
“একশোবার ডাকব।”
ব্যর্থ হয়ে হাসে নাবিল।কেমন করে একটা স্বস্তি নিয়ে শ্বাস ফেলে সে। কতো সহজে সবটা নিজের মন মতো হয়ে যাচ্ছে। নিরা ওর প্রেমে পড়েছে। নাকের ডগায় রাগ বয়ে বেড়ানো মেয়েটা নাবিলের প্রেমে কেমন মোমের মতো গলে গিয়েছে। সল কেমন মায়া করে কথা বলে ইদানীং। ময়না পাখির কন্ঠ ওর। শুধু শুনতেই ইচ্ছে হয়।
বেশ কিছুক্ষণ কেউ কথা বলে না। নিভৃতে শুনে একে-অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ। অনেকক্ষণ পর নাবিল অতৃপ্ত স্বরে বলে,
“দোষটা আমারই। কেন যে তোর কথা শুনে ধেইধেই করে বিয়ে ভাঙ্গতে গেলাম! শালার সেদিন বিয়েটা করে ফেললে আজ নবসম্পর্করের এক মাস পূর্ন হতো। ইউ স্পয়েল্ড এভ্রিথিং। যদিও আমারও কিছু ইস্যু ছিল। বিয়েটা আত্মপ্রত্যয় নিয়ে করিনি, কারণ আমিও বিভ্রান্ত ছিলাম আমার অনুভুতি নিয়ে। তখনও জানতাম না, আমি তোকে পাগলের মতো চাই। আবার একেবারেও যে চাই না সেটাও জানতাম না। তাই তো আম্মু নিজের আরজি পেশ করার পর কীভাবে কীভাবে যেনো রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। সন্দেহ ছিল নিজের প্রতি। আবার কোথাও একটা সম্ভাবনা ছিল, আমার সম্ভবত তোর সঙ্গে সংসার করতে সমস্যা হবে না। বরং খুব সরলভাবেই কাটিয়ে দিতে পারবো গোটা একটা জীবন। আমার সরল সংসার সহ্য হলো না তোর। সব বরবাদ করেছিস রে মর্জিনা তুই।”
নিরা ঠোঁট টিপে হাসে। পাগলের মতো উন্মাদনা দেখাচ্ছে ছেলেটা। নিরা কন্ঠে আবেগ ঢেলে আস্বস্ত করে ওকে।
“দুঃশ্চিন্তা করো না প্লিজ। আমি আছি। তাছাড়া তখন বিয়েটা হয়ে গেলে আমারই অনেক বড় আফসোস থেকে যেতো। তখন তোমাকে মেনে নিতে পারতাম না। যেটা এখন হবে না। আমার ভেতরকার অনেক রহস্যের উদঘাটন হয়েছে সেদিন পালাতে পেরে। ওটার দরকার ছিল,নাবিল ভাই।”
নাবিল ক্ষীণ হাসল। মেয়েটা ক’দিনে বড় হয়ে গিয়েছে৷ কেমন বুঝদারের মতো শান্তনাবানী শোনাচ্ছে। নাবিল ভারাক্রান্ত স্বরে বলে,
“তুই আমাকে কখোনও ছেড়ে যাস না,নিরা! আমার ফরএভার ডেস্টিনিতে তোর থাকা চাই। এতোটা কাছে থাকিস, যতোটা থাকলে আর কখনোই দূরে যাওয়া যায় না। জীবনের সাথে এতোটা আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে থাকিস, যতোটা থাকলে বৃত্তের মতো ঘুরে সে-ই আমার কাছেই আসতে হয়। যতোটা কাছে থাকলে শরীরের সাথে শরীর আর আত্নার সাথে নিবিড়ভাবে মিলে যায় আত্না। যতোটা কাছে থাকলে বেলা-অবেলা প্রবল উষ্ণতা নিয়ে দু’ঠোঁটে মিশে যায় দু’ঠোঁট। মিশে অস্তিত্ব, নিশ্বাস, আর অভ্যেস! তুই আমার নেশা হয়ে থাকিস৷ আমি তোর নেশায় মাতাল হতে চাই।”
পৃথিবীর আলো নিভে যাওয়ার অবস্থায় প্রবল উজ্জ্বলতা নিয়ে প্রদীপশিখার আলো ছড়ালো একই শহরে দুই প্রান্তে জেগে থাকা একজোড়া কপোত-কপোতীর মনে। স্বস্তিতে জ্বলজ্বল করে উঠে চোখের তাঁরা। কতো কালের তৃষ্ণা ওদের! তাদের মধ্যে এতোটুকুও অসন্তুষ্টি নেই। আছে আকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন, প্রাণের ঐক্যতা আর সদ্য ফোঁটা প্রেমপুষ্পের সুভাস!
—
“আমাদের সম্পর্কটার কোনো নাম দেওয়া যায় না?”
ছায়াময় মেয়েলী কন্ঠটি দৃঢ় হয়। সে হাসল উচ্চস্বরে। তাকায় ছেলেটির পানে। বলে, “সম্পর্কের নাম চাই? কী নাম রাখবো? মমমমম….ঠিক আছে, আজ থেকে আমাদের সম্পর্কের নাম ‘কল্পনাবিলাস’।
ছেলেটি হাসে। কৌতুহলী হয়ে শুধায়, “কল্পনাবিলাস? ভারী আশ্চর্য নাম!”
“হু। যে সম্পর্কের কোনো স্থায়ীত্বতা নেই, যেটা সুখের হলেও আজীবন ধরে রাখার ক্ষমতা নেই,সেটা কল্পনাতেই সুন্দর। জীননের কান্তিকালে আমরা আবার কল্পনায় ধরা দিবো। আবারও অক্লান্ত হয়ে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যাবো ব্যস্ত শহর। দশ টাকার বাদাম ফুরালেও আমাদের কথা ঝুলি ফুরাবে না আর। এসব আবারও হবে কেবলই কল্পনায়। আগে যা ঘটেছিল, সেসবও কল্পনা ভেবেই বেঁচে থাকবো। আমাদের আবার দেখা হবে কল্পনাবিলাসে!”
বাতাসে আজ মন খারাপের সুভাস৷ এই বিদায়ক্ষণ মন ভার করছে খুব। ছেলেটা ঘাসের পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে চায় মায়াবী মুখটায়৷ চোখে বিষন্নতা এঁকে ধীরকন্ঠে বলে, “আচ্ছা, আমাদের কি সত্যিই আর দেখা হবে না কখনও?”
তাকায় না মেয়েটা। আড়ালে অশ্রুজল আর বুকের দহন লুকিয়ে বলে, “দেখা হওয়াটাই কি প্রকৃত সমাধান? আপনি আমার চোখে চোখ রাখলেই মিটে যাবে অন্ধকার?”
“তুমি চাইলেই মিটবে। তুমি চাইলেই সব সম্ভব। একটু সঁপে দাও আগ্রহ।”
বুক চিরে অচিরেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মেয়েটির। সে উঠে দাঁড়ায়। একপলক পেছন ফিরে চায় আবার। বলে, “আমি থাকতে চাই, কিন্তু আপনি ফেরাতে জানেন না।”
ছেলেটা ছলছল চোখে চেয়ে মেয়েটার নিষ্ঠুর চলে যাওয়া দেখলো। মেয়েটা আর ফিরে চায় না। হাঁটতে হাঁটতে কিছু মুহূর্ত পর ধীরে ধীরে ছায়াটাও বিলীন হয়ে যায়। ছেলেটা মেয়েটার নাম ধরে ডাকে। চিৎকার করে ডাকে। সে তবুও ফিরে আসে না। না একটিবার ফিরে চাইলো! গভীর অরণ্যে একটা টগবগে পুরুষালী দেহ কেমন অসহায়ের মতো বসে আর্তনাদ করছে। তার আত্নচিৎকারে মাটি কেঁপে উঠে। পৃথিবী থমকে যায়। সমুদ্র হয়ে যায় শান্ত। তার একা লাগছে ভীষণ। চারিদিকে কেবলই ধুধু অন্ধকার আর নির্জনতা। মেয়েটাকে তার চাই। তাকে ছাড়া ছেলেটা বাঁচবে না। সে ডাকল,
“শুনো মেয়ে,ফিরে আসো। ফিরে আসো তুমি!”
সে আসে না!
ঘুমের ঘোরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিলয় হাসফাস করতে করতে বিরবির করলো। চোখ মেলে চাইলো আকস্মিক। ঘন অরণ্যের বদলে নিজেকে আবিষ্কার করলো নিজের ঘরের বিছানায়। উপরে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। উঠে বসলো সে। জোরে জোরে শ্বাস নিলো। উত্তেজনায় শরীর ঘেমেছে অনেকখানি। সাইড টেবিলের বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খায়। বারান্দায় বসে একটা সিগারেট ধরায়। এমন অদ্ভুত স্বপ্নের কারণ খুঁজে পায় না সে।
ঘরে ফিরে হাঁটাহাঁটি করে কিছুক্ষণ। ঘুম আসছে না আর আলমারি থেকে কিছু একটা বের করে। ডিভানে শুয়ে হাল্কা কারুকাজের সোনার আংটিটায় হাত বুলায়। কাল যেটা নিরাকে পরাবে নিলয়। ফোনের ফ্লাশলাইটের আলো ছাড়িয়েও আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আংটিটাকে। আপাতদৃষ্টিতে সেটা দেখতে মূল্যবান অলঙ্কার মনে হলেও, নিলয়ের কাছে এই মুহূর্তে এটার নাম বিভ্রান্তি, সিদ্ধান্তহীনতা। ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে, সেটাও অকল্পনীয়, অপ্রস্তুতজনক। মনোযোগ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আংটিটা। খুব সুন্দর দেখতে। নিরাকে মানাবে ভীষণ। নিলয় চোখ বন্ধ করে হতাশ শ্বাস নেয়। ছটফট করছে মনটা। জীবনের স্রোত তাকে কোন দিয়ে বয়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সে জানে না। স্রোনের অনুকূলে বিনাবাক্যে ভেসে চলেছে কেবল। নিজেকে কেমন জড়বস্তু মনে হচ্ছে তার। আবার ফিরিয়ে দেওয়ারও উপায় নেই। কার জন্য ফিরাবে? তার তো কোনো পিছুটান নেই। আচ্ছা, সত্যি কি নেই কোনো পিছুটান? কারো মায়া? ক্ষনিকের সঙ্গ? স্বপ্নের মেয়েটাই-বা কে? কেন সে বলল, “আমি থাকতে চাই,আপনি ফেরাতে জানেন না।”
সত্যিই কি নিলয় কাউকে তাকে জানে না? হয়তো তা-ই হবে। তবে কেন মেয়েটার চলে যাওয়া নিলয়কে স্বপ্নের মধ্যেও পোড়াচ্ছিল? কিসের টান? কে সে? এমন একটা স্বপ্নই-বা এই সময়ে কেন দেখতে হলো?
উচাটন লাগছে খুব। ফোনের নেট অন করে অনলাইন হলো সে। বর্ষাকে এক্টিভ দেখাচ্ছে। টেক্সট পাঠালো তাৎক্ষণিক।
“আমার কি করা উচিত?”
সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি রিপ্লাই আসে।
“নিরাকে নিয়ে?”
না চাইতেও মলিন হাসল নিলয়। মেয়েটা কেমন করে যেনো সবই বুঝে যায় ইদানীং। জবাব দেয়,
“এটাই তো হওয়ার কথা। বলো না বর্ষা, কী করবো?”
“কী করতে চান? মন কী বলে?”
“বুঝতে পারছি না।”
“নিরার সঙ্গে কথা হয়েছে এই বিষয়ে?”
“নাহ। তবে অনেক বড় একটা সিক্রেট জানতে পেরেছি। মিরার সাথে কথা হয়েছিল আজ সন্ধার পর। ওর মাধ্যমেই জানতে পেরেছি ব্যাপারটা।”
“কেমন সিক্রেট?”
“নিরা অলরেডি লাইকস মি।”
বর্ষা অবাক হওয়ার ইমোজি পাঠায়। পরক্ষণেই চোখ টিপার ইমোজি দিয়ে বলে,” তবে আর অপেক্ষা কিসের? পাত্রী রাজি, তো কেয়া কারেগা কাজী?”
“আর ইউ জোকিং? ব্যাপারটা আমার জন্য চিন্তার। নিরা আমাকে পছন্দ করে এটা জানার পর চাইলেও জোর গলায় বলতে পারছি না, আমি বিয়েটা করতে চাই না। নিরাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না, এটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আই এম ডিপ্রেসড। আর নিরা আমার জন্যই নাবিলের সঙ্গে বিয়েটা ভেঙ্গেছিল এটা জানার পর আরও অস্থির লাগছে। অপরাধবোধ কাজ করছে, আবার মনের বিরোধিতাও করতে পারছি না। আমার আসলে দেশে আসাটাই ঠিক হয়নি, বর্ষা। আই এম ফে-আপ উইথ এভ্রিথিং। ভেতরের অস্থিরতা কাউকে বোঝাতে পারছি না।”
বর্ষার মন নরম হয়ে আসে। তাৎক্ষণিক ফোন করে সে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তা-ও রিসিভ করলো নিলয়। বর্ষাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে, “বিয়েটা নিরার সঙ্গে ঠিক না হয়ে যদি তোমার সাথেও হতো, হয়তো এতোটা আপসেট হতাম না। নিরাকে আমি কখনও ছোট বোন ব্যতিত অন্য নজরে দেখিনি। এখনও ব্যাপারটা আমার জন্য কঠিন। ইট’স টাফ টু এক্সেপ্ট হার এজ মাই ওয়াইফ।”
বলেই ফোনটা কেটে দেয় নিলয়। বর্ষাকে আর কিছুই বলতে দিলো না সে। ফোনের দিকে চেয়ে রোবটের মতো ঠায় বসে রইলো বর্ষা। কী বলে গোলো লোকটা? কেন বলল এসব?
চলবে।