গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ২০
#নাজমুন_নাহার
কবিগুরু বলেছিলেন,
“তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে
আরও কিছু নাহি চাই গো।”
সত্যি কি কবি প্রেয়সীকে সুখী দেখার প্রত্যাশা থেকেই তাকে সুখের সন্ধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন? নাকি এর অনলেও আছে অপ্রকাশিত বেদনা, অনাহুত ভালোবাসা, অভিমান আর বক্ষপিঞ্জরের কালবৈশাখী ঝড়? মানুষ যারে হৃদয়ে পায় তারে কি সত্যি মুক্তি দিতে পারে? চায় মুক্তি দিতে? চায় না। কবিও চায়নি। সে প্রিয়জনকে মুক্ত করেছেন কারণ জোর করে রেখে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। দোকানের খেলনা কিনতে মা’কে জোর করা যায়, আবেগ দেখিয়ে বাবা-র মন ভোলানো যায়, কিন্তু এসব করে মানুষের হৃদয় জয় করা যায় কি? যায় না বোধহয়। যেখানে অধিকার চর্চার সুযোগ থাকে, মানুষ সেখানে জোর দেখাতে পারে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো বায়না ধরতে পারে। পৃথিবী ভস্ম করতে পারে কঠিন অধিকারের জোরেই। তবে যদি চোখে আঙ্গুল দিয়ে কেউ দেখিয়ে দেয়, ইউ আর জাস্ট আ নাম্বার ইন দ্যেয়ার লাইফ, সেখানে গলার জোর আর জীবন ভাগাভাগি করতে চাওয়ার অভিলাষ দেখানো নিত্যান্তই বেমানান, অপমানজনক নয় কি? তাহলে কারো জীবনে নিজেকে জাস্ট আ নাম্বার হিসেবে জানার পরও নাবিল কি সেই অপমানজনক অনধিকার চর্চা করতে যাবে? করা উচিত? উচিত না। করা যায়ও না। ব্যাপারটা নিছকই হাস্যকর বৈকি অন্যকিছু না।
সে হাসল নিজের উপর বিদ্রুপ করে। চাইলো আরেকপলক সম্মুখে বসা পুতুলবউ সেজে থাকা মেয়েটির পানে। বুক চিরে প্রাণ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলেও নাবিল পন করেছে, বুকে পাহাড় চড়ে বসলেও সে আজ কিছুতেই এ মেয়ের মুখ থেকে নিজের চোখ সরাবে না। হৃদয়ের সমস্ত রক্তক্ষরণ দমিয়ে সে কেবলই এই হিরন্ময় অভিনেত্রীর অভিনয়ের শেষটুকু দেখে ছাড়বে আজ। তার স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, নরম অনুভুতিগুলোকে পরম যত্নে আস্কারা দিয়ে কতো সহজে সে মোর ঘোরাতে পারে, সেটাও মুগ্ধ হয়ে দেখবে। আজ যেনো কিছুতেই মুগ্ধতা না কমে নাবিলের। কমতে দিবে না সে।
হাতের বাহুতে কারো হাতের ছোঁয়া লাগতেই পাশ ফিরে চায় নাবিল। রাহেলা মাথা নুয়িয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে ধীরকন্ঠে অবাধ্যতা দেখিয়ে বলেন, “আমি কথা বলবো ভাইজানের সাথে। তোর কোনো কথাই শুনছি না আর।”
নাবিল চোখ বুজে হাসল মলিন করে। স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, “তুমি কেন কাঁদছ অকারণেই? মরে তো যাইনি আমি। মরবো না। আমি জানি, আমি মরে গেলে পৃথিবীতে কেবল তুমি ছাড়া আর কারো যায় আসবে না। আমি না থাকলে আমার মা ভালো থাকবে না। তোমার জন্য হলে-ও আমাকে বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। চিন্তা করো না। তোমার রক্ত না? ঠিকই সামলে নিবো নিজেকে।”
রাহেলা বেগম মুখে হাত দিয়ে আবারও অগাধ কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। বললেন, “তুই একবার নিরার সঙ্গে কথা বলে দেখ আলাদা করে।”
নাবিল তাচ্ছিল্য করে শ্বাস ফেলল।
“কথা বলবো? সে-ই সুযোগটা আছে আমার? দিয়েছে কেউ? আম্মু, ওর জীবনে এই মুহূর্তে আমি শুধুমাত্র একজন তৃতীয় পক্ষ। যার উপস্থিতি ওর মনে এতোটুকুও প্রভাব ফেলছে না।”
” অভিমান থেকে বলছিস এসব।”
নাবিল হাসে আবার। বলে, “এখানে আসার আগ পর্যন্ত সবটুকু অভিমানই ছিল। তবে এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ মস্তিষ্কেই বলছি। তুমি জানো? সবকিছু জানার পরেও ভেবেছিলাম, এসব ব্যাপারে নিরা হয়তো অবগত নয়। ওর সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। কোথাও একটা ঘাবলা রয়েছে। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমি ওর সামনে দাঁড়ালে হয়তো-বা ও আমায় সবটা বলার সুযোগ পাবে। ইভেন বলবেও। ও যদি মুখে একবার বলতো, ‘আমি এসবের কিছুই জানি না, নাবিল ভাই। আমাকে দিয়ে জোর করে করানো হয়েছে এসব।’ বিশ্বাস করো আম্মু, পুরো দুনিয়া এক করে দিতাম আমি। ওকে আমার থেকে আলাদা করার সুযোগটুকু তোমার প্রাণের ভাইও পেতো না। যদি একবার বলতো…..! কিন্তু কই? ও বললো না, আম্মু! কেন বললো না! কেন ডাকল না আমায়? আমি ওকে কম ভালোবাসতাম? কম যত্ন করতাম? তোমার আদরের ভাতিজি আমায় নিঃস্ব করে দিয়ে কেমন আনন্দ নিয়ে বউ সেজে হাসতে হাসতে সবকিছুই উপভোগ করছে। না ফোন, না টেক্সট, কোনোভাবেই আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধটুকু করলো না। সবটা কেন তোমার মুখ থেকেই শুনতে হলো আমাকে,আম্মু? এসব জানার পরও বলবে আমি অভিমান করেছি? অভিমান হলে মানুষ ক্ষমা করতে পারে, তবে আমার কেন ওকে ক্ষমা করতে ইচ্ছে করছে না? একটুও দয়া আসছে না ওর জন্য।”
রাহেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নাবিল আবার বিদ্রুপে দৃষ্টিতে চায় মায়াবতীর পানে। সেভাবে চেয়েই হাসল মুগ্ধ হয়ে। অশ্রু সংবরণ করে বলল,
“জানো? গতকাল সারাটাদিন ও আমার সঙ্গে কাটিয়েছে। আমরা একসাথে ক্যাম্পাসে বৃষ্টিতে ভিজেছি, রিকশায় ঘুরেছি। রাতেও লম্বা সময় ধরে অনেক কথা হয়েছে। একটা আস্ত রাত না ঘুমিয়ে আমরা জীবন-সংসারের স্বপ্ন দেখেছি। এই দু’দিনে একটা সুখের জীবনের লোভ দেখিয়ে মনে মনে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার ছক আঁকছিল মেয়েটা! অথচ দেখো, কিচ্ছু টের পেলাম না আমি! আজ আফসোসের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম গর্ধভাত্বের নাম ‘নাবিল এহসান’। ভাবতে পারছো? তোমার ছেলেটা কতো নির্বোধ। সে নাকি আমারই চোখের সামনে আমারই ভাইকে বিয়ে করে ফেলবে! কিচ্ছু আটকানোর ক্ষমতা নাবিলের নেই। এসব কীভাবে মেনে নিবো, ও একবারও ভাবলো, আম্মু! আমি কী নিয়ে থাকবো? ও তো আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। প্রথম প্রেম ও আমার। শেষ অব্ধিও আর কেউ আসবে না। আর কেউ দখল করতে পারবে না তোমার ছেলেকে। ও কি টের পায়নি এসব? ওর প্রতি আকাশ-পাতাল এক করা গভীর ভালোবাসা আমার চোখে দেখেনি ও? ওর চেহারায় কোনো দুঃখ নেই। একটুও দুঃখ নেই। কী মিষ্টি করে হাসছে দেখো? একফোঁটা অনুশোচনা, লজ্জাবোধ, কিচ্ছু নেই ওর চোখে। এখানে আমার এক্সিটেন্স দেখতে পাও? আছে ওর লাইফে আমার কোনো অস্তিত্ব? নেই। অথচ আমাকে সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে ওকে একপাক্ষিক ভালোবাসার ভার কাঁধে নিয়ে। ওর ভালোবাসা আমার বুকের মধ্যে খুব ভারী ঠেকছে! খুব ভারী! নিরা আমায় ভালোবাসেনি…! এই ধারালো সত্যটা জানার পরও বাকিটা জীবন আমাকে কৃত্রিমভাবে বেঁচে থাকতে হবে,আম্মু! ওকে অর্জন করতে না পারার এই হিমালয়সম আক্ষেপটুকু বহন করতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার!”
ছেলের কান্নাভেজা কন্ঠে মায়ের দুনিয়ায় উলোটপালোট হয়। মা’র ইচ্ছে করছে পুরো পৃথিবী এক করে ছেলের চোখের পানি চিরতরে মুছিয়ে দিতে। ইচ্ছে করছে ধরণীতলের সবচেয়ে দামী সুখটা ছেলের নামে করে দিতে। আর সহ্য হচ্ছে না। যাচ্ছে না আর সহ্য করা। একটা নির্মল প্রাণ আর প্রাণবন্ত সন্তানের ঠোঁটের হাসি এভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া তার মা’কে ভীষণ পোড়াচ্ছে। কলিজা দু ভাগ হয়ে আসছে ছেলেটার চোখের দিকে তাকালে। রাহেলার নাবিল তো এমন ছিল না। এ ছেলেকে এতো শান্ত হয়ে কথা বলা মানায় না। এতো আক্ষেপ নিয়ে চোখ ভেজানোও তাকে একেবারেই মানায় না। নাবিলরা কখনও স্থির হয় না। ওরা হয় চঞ্চল পাখি, নয়তো স্বাধীন বন্য ঘোড়া। ওরা হয় আকাশ, সমুদ্র, হিমালয়ের সুউচ্চ পাহাড়চূড়া। ওদের অস্তিত্ব হয় সুখতাঁরাদের মতো উজ্জ্বল, ভাসমান। যারা সবাইকে হাসায়, বাঁচায়, সতেজ করে। ওরা এমন তুচ্ছ প্রতারণায় হেরে যেতে পারে না। কিছুতেই না!
আজকের দিনটার জন্য নির্জনে বসে প্রহর গুনার সুযোগ পায়নি নিরা। না প্রবল প্রতিক্ষা নিয়ে উল্টিয়েছে ক্যালেন্ডারের পাতা। তবুও এই বিশেষ দিনটা বিনা অনুমতিপত্রেই এলো। তবুও জাদুর মতো করে দিনটি ধরা দিয়ে চমকে দিলো আকাশ, সমুদ্র আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে। যেমন করে পৃথিবীতে প্রবল সুঘ্রাণ নিয়ে বসন্ত আসে, বাগানে ফোটে প্রিয় বেলী ফুলটা, হৃদয়ে বসে ভ্রমর, তেমন করেই এলো দিনটা। নিরার জীবনের প্রবেশদ্বারে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলো, কোনোকিছু চাওয়ার অভিলাষকে কেন্দ্র করে সর্বদাই মানুষকে কাঠখড় পোড়াতে হয় না। সৃষ্টিকর্তা, প্রকৃতি কখনও কখনও খুব সরলভাবেই সব অনুকূলে রাখেন কারো কারো জন্য। তবে ঘটনাটা আশ্চর্যের। বলা চলে, ভয়ংকর আশ্চর্যের। বিস্ময়কর ব্যাপার এটাও যে, নবপ্রেমের সূচনা মনে কড়া নাড়ার আগেই নিরার দরজায় প্রবেশ করছে পূর্ণতা।
আড়ষ্টতায় মুড়িয়ে এলো শরীর। সর্বাঙ্গ বেয়ে নেমে যাচ্ছে স্নিগ্ধ শিহরণ। খয়েরী জামদানী শাড়ীর আঁচলে ঘোমটা টানা কপাল অব্ধি। অস্বস্তিতে চোখ তুলে তাকাবার সুযোগ নেই। খানিক পরপর জিভ দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় ভেজাতে ভেজাতে অর্ধেক লিপস্টিক প্রায় উধাও করে দিয়েছে। শ্বাস বাড়ছে ঘনঘন। বুকের দামামা দমানোর চৈতন্য নেই। এতোদিন ধরে যাদের সম্মুখে নির্দিধায় ধেইধেই করে ঘুরে বেরিছে জড়তাহীন, আজ তাদেরই সামনে তার ঠোঁট কেঁপে আসছে লজ্জায়। এরাই নাকি আয়োজন করে আজ নিরাকে নবরূপে দেখতে এসেছে। বুকের মধ্যে প্রবল হাওয়ায় দুলে যাওয়ার ভাব থাকলে-ও এই মুহূর্তে অস্ফুটতায় গাল হয়ে আছে গোলাপীর পাপড়ির মতো রাঙা। চোখের খবর কে রাখে? ওরা লাজ ডিঙিয়ে নিজেদের মেলে ধরলে তো?
চোখ নুয়িয়ে রাখার সত্বেও নিরা একটা অস্থির মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করে নিলো নিবিড়ভাবে। সে যে পলকহীন নিরাকেই দেখে চলেছে, তা-ও চোখ এড়ালো না মেয়েটার।
ড্রইংরুমের বিপরীতমুখী দুইটা সোফার একটার মধ্যে বসেছে নেহাল আর তার বাবা। আরেকটায় নিরার বাবা আর মামা। বাড়ির মহিলা সমাজেরা একজোট হয়ে দাঁড়িয়েছে দরজার পাশেই। মিরা দাঁড়াল নিরার পাশে। নিলয় এতোক্ষণ বাইরে থেকে সবেমাত্র এসে বসলো বাবা-র পাশে। নাবিল ছিল এখানেই। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে, হাত বুকের উপর ভাজ করে। আসার পর থেকে সবার সাথেই স্বাভাবিক আচরণ করছে সে। রাহেলা একটু পরপর ছেলের পানে তাকান গভীর উদ্বিগ্নতা নিয়ে। তার চঞ্চল ছেলেটা আজ কেমন শান্ত, স্থির হয়ে গেছে। মা টের পায় ছেলের ভেতরকার অদৃশ্য কান্না। ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পৃথিবীর সমস্ত অমাবস্যা ঘীরে ধরেছে রাহেলার আদরের ছেলের জীবনকে।
নাবিল শুরু থেকেই দৃষ্টি রেখেছে নিরার পানে। গভীর নয়নে দেখে মেয়েটাকে। কী নির্লিপ্ত, নির্বিকার একটা প্রাণ! কী সুন্দর দেখাচ্ছে নিরাকে! কী মায়াবতী নাবিলের নিরাটা! আজ যেনো আবার রুপ ছড়িয়ে ছড়িয়ে দেবীতে পরিনত হয়েছে তার সোনার অঙ্গ। সে পলক ফেলে হাসল কেমন করে যেনো। যে-ই ম্লান হাসিতে হৃদয়ের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা ঢাকা পড়ে পরম যত্নে। সে দেখে প্রেয়সীকে মন ভরে,প্রাণ ভরে। হৃদয়ের নিরব শ্রাবণধারা লুকিয়ে নরকে মুগ্ধ হতে এসেছে সে আজ। দেখছে সব, দেখলো নিজেকে, তার চোখ আর তাকে…..!
দুঃখটা বোধহয় অনেকখানি বেশি হতো যদি জানতো,নিরাকে জোর করে রাজি করানো হয়েছে। ভেবেছিলোও এমনটাই হবে। কিন্তু এখানে আসার পরের চিত্র ভিন্ন। লাজুকলতার মসৃণ ঠোঁটজোড়া বলে দেয়, সে আজ ভীষণ খুশি। খুব আনন্দ তার! যার নিজেরই উড়ে যাওয়ার তাড়া থাকে, তাকে কীভাবে আঁটকে রাখবে নাবিল? জোর করে আদতেও কারো সঙ্গ পাওয়া সম্ভব? সম্ভব না! সে আজ মন দিয়ে তার সাধের পাখির পিঞ্জর ছাইড়া মুক্ত হওয়ার আয়োজন দেখবে। প্রেয়সীর টানা টানা হরিণ চোখে অনুশোচনাও যে দেখতে মানা। ও চোখে কেবল নির্লিপ্ততা মানায়। মানায় নিষ্ঠুরতা! প্রতারণা!
ইফরান তখন থেকে এঘর-ওঘর ঘুরছে। মাত্রই এলো ড্রইংরুমে। নিরাকে দেখামাত্রই পাশে এসে দাঁড়ায় ওর। কানের কাছে মুখ নিয়ে আদর আদর কন্ঠে বলে, “একটা সিক্রেট বলবো?”
নিরা হাসে। অনুরুপভাবে ফিসফিস করো শুধায়, “কী সিক্রেট?”
ইফরান রহস্য উদঘাটনের ভঙ্গিতে বলে,”চাচ্চুর কিন্তু কোনো প্রেজেন্ট গার্লফ্রেন্ড নেই। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ডিনাই করেছে। ইউ আর সো লাকি।”
নিরা ঠোঁট টিপে হাসল। বলল, “তোমার চাচ্চু একটা ফ্রড। মিথ্যে বলেছে সে। তার একটা বিউটিফুল গার্লফ্রেন্ড আছে। দেখবে?”
ইফরান অবিশ্বাস্য চোখে চায়। ঠোঁট উল্টে বলে, “দেখাও।”
নিরা ফোনের গ্যালারিতে ঢুকে নিজের একটা ছবি বের করে ওর সামনে ধরলো। ইফরান ভ্রু উচিয়ে একবার ছবির দিকে চায় তো আরেকবার তার ফুপ্পির দিকে। বিভ্রান্ত কন্ঠে বলে, “ও তো তোমার মতো দেখতে। সেইম সেইম।”
নিরা অবাক হওয়ার ভান ধরে। বলে, “বলো কী! সত্যি আমার মতো দেখতে? একেবারে সেইম সেইম? আহা! দেখেছো? তোমার চাচ্চুর চয়েজসেন্স তো সাংঘাতিক খারাপ। প্রেম করেছে যেমন চেহারার মেয়ের সঙ্গে, বিয়েও হওয়া চাই এমন চেহারার কারো সাথেই। এমন জমজ মিল রেখে কেউ বিয়ে করে?”
ইফরান মাথা চুল্কাতে চুল্কাতে বলে, “আর ইউ সিউর চাচ্চুর গার্লফ্রেন্ড আছে? এই মেয়েটা চাচ্চুর গার্লফ্রেন্ড?”
নিরা চোখ টিপে।
“টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর।”
“তোমার রাগ হচ্ছে না? জেলাস হচ্ছে না একটুও?”
কেমন মায়া মায়া চোখে চেয়ে প্রশ্নটা করেছে ইফরান। নিরা মাথা উপরনিচ করে দোলায়। “হু৷ খুব হচ্ছে।”
“চাচ্চুর মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে?”
“হু।”
মুখটা গম্ভীর করে ফেলল ইফরান। বলল,”থাক। রাগ করো না। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। চাচ্চু বুঝতে পারেনি।”
নিরা হাসল। গাল টানলো আলতো করে ওর। “ঠিক আছে, তুমি বললে বলে ক্ষমা করলাম। নয়তো এতো সহজে কিন্তু আমি ছাড়ার পাত্রী নই। অল ক্রেডিট গোজ টু লিটল বেইবি, ইফরান।”
“দাদুভাই, চাঁচির সাথে কী এতো আলাপ করছো? আর ক’দিন বাদে তো চাঁচিকে আমরা আমাদের বাড়িতেই একেবারে নিয়ে যাচ্ছি, তখন থেকে চাঁচি সারাদিন তোমার সাথে খেলবে। এখন এদিকে আসো তো৷ চাচ্চু চাঁচির সাথে বসবে।”
ইফরান ঠোঁট উল্টায়। বলে, “ক’দিন পর কেন? আজই নিয়ে যাবো। চলো না দাদু, আজই ফুপ্পিকে চাঁচি বানিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই।”
নিরা চোখ তুলে চায় বিভ্রান্ত হয়ে। বুকের ভেরতটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। পরক্ষণেই চাইলো ফুপ্পির পানে। রাহেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান হাসলেন ও তাকাতেই। কিছু বোঝার, বলার আগেই জয়নাল সিকদার তাগাদা দিলেন বোনকে, “খাদিজা, নিলয়কে বল নিরার পাশে বসতে। আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না।”
তড়াক করে নিরার দুই কান ঝাঁঝিয়ে তুললো বাক্যদু’টো। মস্তিষ্ক হচ্ছে মহাপ্রলয়ের মতো এলোমেলো। উপস্থিত সকলের পানে চাইলো হতভম্ব দৃষ্টিতে। এদের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। অসহায়, বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রক্তলাল চোখের মানুষটির পানেও। চোখে ঘূর্ণিঝড় চলমান লোকটার। দৃষ্টি স্থির, নদীর মতো শান্ত। অভিমানমিশ্রিত ব্যথাতুর চাহুনি। বিপদের সাইরেন বাজে মনের গহীনে। বাকিদের প্রতিক্রিয়া তখনও দিনের মতো পরিস্কার। যেনো যেটা হওয়ার ছিল, সেটাই হচ্ছে। অবিশ্বাস্য কিছুই ঘটছে না। সে চোখ কপালে তুলে চায় বাবা-র পানে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে শুধায়, “আব্বু, নিলয় ভাই কেন পাশে বসবে? তুমি উনাকে কেন তাড়া দিচ্ছ?”
জয়নাল সিকদার অস্বস্তিতে পড়ে যায় মেয়ের এহেম অদ্ভুত প্রশ্নে। সকলের পানে চেয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললেন, “এসব কেমন প্রশ্ন, মামুনি? যার সাথে তোমার বিয়ে হবে, সে-ই তো পাশে বসবে?”
নিরার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তাৎক্ষণিক সোফার হাত রেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে উত্তেজিত স্বরে বলল, “যার সাথে বিয়ে হবে মানে! নিলয় ভাই আংটি পরাবেন কেন আমাকে? বিয়েটা উনার সাথে হবে?”
উপস্থিত সকলে এই পর্যায়ে হকচকিয়ে গেলো নিরার এহেম আচরণে। নিরা প্রবল রাগ দেখিয়ে দাঁড়াতে উদত্য হতেই মিরা বোনের কাছে গিয়ে দুই বাহু ধরে বলে, ” মেহমানদের সামনে এসব কী ধরণের আচরণ,নিরা? সবকিছুই তোর ইচ্ছে মতো হচ্ছে, তাহলে এমন করছিস কেন? অবাক হওয়ার মতো তো কিছুই ঘটেনি। তোর খুশির জন্য করা হচ্ছে সব। যাকে ভালোবাসিস, তার সাথেই বিয়ে হচ্ছে।”
নিরা গর্জে উঠে, “যাকে ভালোবাসি মানে! কাকে ভালোবাসি?”
মিরা হতবিহ্বলের মতো একপলক বাবা-র অগ্নিমূর্তি মুখে চেয়ে বলে, “নিলয় ভাইকে ভালোবাসিস না তুই? চিঠি লিখিসনি ডায়েরিতে উনাকে নিয়ে?”
নিরার পৃথিবী উল্টে যায় বোনের কথায়। কী বলবে, কী করবে গতি বুঝল না। কয়েক মুহূর্তেই জীবনটা যেনো ঝড়ের মতো উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে এসব? কী হচ্ছে তার সাথে! মেয়েটা লম্বা শ্বাস টেনে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। আরেক বার চাইলো নাবিলের পানে। ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না আর। পুরুষালী শক্তিশালী দেহটা আজ বড্ড দূর্বল লাগছে যে। ধারালো চোখ’দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রবল শ্রাবণধারা।
নিরা বোনের পানে চাইলো প্রবল রাগ দেখিয়ে। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে হাত সরালো সজোরে ঝারি দিয়ে। তার ঝিলের মতো চোখ দু’টো ইতোমধ্যেই টলমল করছে অশ্রুতে। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “ছুঁবি না আমায়, মিরাপু। দূরে সর। তুই সব শেষ করে দিয়েছিস। আমার গোছানো জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছিস কয়েক ঘন্টায়।”
বলেই অঝোরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা। এহেম এলোমেলো পরিস্থিতি দেখে জয়নাল সিকদার বোধহয় আন্দাজ করলেন আসন্ন বিপদটা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো কিছু একটার। তিনি তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য হাঁক ছেড়ে বললেন, “নিলয়, আংটিটা পরিয়ে দে ওকে। তাড়াতাড়ি।”
মামার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে নিলয়ের। মা’য়ের পানে একপলক চেয়ে আবার মামার দিকে চেয়ে বলল, “মামা, ওর সাথে আগে একটু আলাপ করে নিন। নিরা সম্ভবত অন্য,…..
আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না ছেলেটা। জয়নাল তড়িঘড়ি করে ওর হাতে আংটিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আমার বাড়ির সম্মানটুকু বাঁচা, বাপ। মামা হয়ে তোকে হাত জোর করে অনুরোধ করছি। আর একটাও কথা বলিস না। আমার সম্মান এই মুহূর্তে তোর হাতে।”
নিলয় মাথা নিচু করে আংটিটা নিঃশব্দে হাতে নেয়। তখনই নাবিল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো বিনাবাক্যে। আড়ালে তা কেবল খেয়াল করলেন রাহেলা। নিলয় হাত বাড়ায়। মিরা নিরার নিস্তেজ পড়ে থাকা হাতটা ধরে উপরে তুলে। জড়বস্তুর মতো অনুভূতিহীন বসে রইলো মেয়েটা। নিজেকে কাঠপুতুল মনে হচ্ছে আজ। চোখ দু’টো অমাবস্যার মতো অন্ধকার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ঠোঁটে ম্লান, নিষ্প্রাণ হাসি। চোখের কার্নিশ বেয়ে তখনও পড়ছে বৃষ্টি। সে ধীরে চোখ বুজে একটা নির্মল চেহারাকে স্বরণ করে নিলো শেষবারের মতো। নাবিল ভাইয়ের মায়াভরা কন্ঠে বলা শেষ রাতের বাক্যগুলো, “তুই আমাকে কখোনই ছেড়ে যাস না,নিরা! আমার ফরএভার ডেস্টিনিতে তোর থাকা চাই। এতোটা কাছে থাকিস, যতোটা থাকলে আর কখনোই দূরে যাওয়া যায় না। জীবনের সাথে এতোটা আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে থাকিস, যতোটা থাকলে বৃত্তের মতো ঘুরে সে-ই আমার কাছেই আসতে হয়। যতোটা কাছে থাকলে শরীরের সাথে শরীর আর আত্নার সাথে নিবিড়ভাবে মিলে যায় আত্না। যতোটা কাছে থাকলে বেলা-অবেলা প্রবল উষ্ণতা নিয়ে দু’ঠোঁটে মিশে যায় দু’ঠোঁট। মিশে অস্তিত্ব, নিশ্বাস, আর অভ্যেস! তুই আমার নেশা হয়ে থাকিস৷ আমি তোর নেশায় মাতাল হতে চাই।”
নিরা আবারও হাসে মলিন ঠোঁটে। নিঃশব্দে বিরবিরায়, “আমার আর তোমার ফরএভার ডেস্টিনিতে থাকা হলো না, নাবিল ভাই। তোমার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে থাকাও হলো না আর। আমাদের আত্নার সাথে আত্মা মিললেও, শরীর কখনোই ছুঁবে না শরীরকে। না মিশবে তোমার ঠোঁটে আমার মসৃণ দু’ঠোঁট। আমি তোমার অস্তিত্ব, নিঃশ্বাস কিংবা অভ্যেস… কোনোটাই হতে পারলাম না, উন্মাদ ছেলে! আমায় অভিশপ্ত করে তুমি না-হয় মাতাল হইয়ো অন্য ফুলের নেশায়!”
নিলয় আংটিটা ডান হাতে নিয়ে সেটা পরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিরার বাম হাতটা ছুঁতেই অকস্মাৎ পৃথিবীর সমস্ত অভিমান বুকে নিয়ে মেয়েটা লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। ধরাস করে শব্দ হলো একটা। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে হতবিহ্বল, হতভম্ব। আমিনা বেগম তাৎক্ষণিক চিৎকার দিয়ে উঠলেন। ঝড়ের গতিতে সকলে দৌড়ে এসে ধরলো ওকে। ততক্ষণে জ্ঞানহীন, নিস্তেজ দেহটা আর কথা বলে না। উত্তপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে অভিমান ঝারে না সে আর! কেবল টিকিয়ে রাখলো ঠোঁটের সেই মলিন, মুগ্ধ হাসিটা!
চলবে।