গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ২৩
#নাজমুন_নাহার
ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে শেষ চুমুকটুকু বসিয়ে নিলয় চাইলো বর্ষার ক্যাম্পাসের দোতলার করিডরের দিকে। দু,একটা ঘুঘুপাখি বসে আছে করিডরের পাশের জারুল গাছটায়। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সময়টা দেখে নিলো সে আরেকবার। কালো রঙের কাঁটাটা দেড়টার ঘর ছুঁবে ছুঁবে ভাব। কয়েকজনকে গেইট দিয়ে বের হতে দেখে আবারও উঁকিঝুঁকি মারলো মেইন গেইটের আশেপাশে। হল থেকে কাঙ্ক্ষিত একজনকে বের হতে দেখামাত্রই যত্রতত্র চা ওয়ালার বিল মিটিয়ে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়ালো। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে অস্থিরতা আড়াল করার চেষ্টা করলো নিজের। ফায়দা হলো না বিশেষ। মুখ দেখে সাফ ভেতরের কাহিনী ধরে ফেলতে পারবে যে কেউ। পকেট থেকে ফোন বের করে কানের কাছে নিয়ে কার সাথে যেনো কথা বলার ব্যস্থ ভঙ্গিমা দেখালো। তখনই পেছন থেকে কাঙ্ক্ষিত সেই মেয়েলী সুরটা ভেসে আসে।
“আপনি! এখানে?”
নিলয় ঘাড় ঘুরিয়ে চায় ম্যাকি অবাক হওয়ার দৃষ্টিতে। নির্মল চেহারায় মেয়েটির চোখে-মুখে ভেসে উঠছে কোমল সতেজতা। মন গলে যায় মোমের মতো যে মুখ দেখে। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে ফোন কেটে দেওয়ার মতো করে একটু টাচ করলো স্ক্রিনে। স্মিথ হেসে বললো, “যাচ্ছিলাম এদিক দিয়েই।”
ভ্রু কুঁচকায় বর্ষা।আইডি কার্ডটা ব্যাগে ভরতে ভরতে শুধায়, “এদিক দিয়ে? কোথায়?”
মিথ্যা বলার ফলপ্রসূতে কপালে ঘাম জমেছে নিলয়ের। এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে অস্বস্তি লোকানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে আমতাআমতা করে বলে, “আমম…সদরে এসেছিলাম একটা কাজে। মানে মার্কেটে। বিয়ের দাওয়াতে আছি তোমাদের জেলায় ক’দিনের জন্য। আজ হলুদ। হলুদে পরার জন্য আম্মু একটা পাঞ্জাবী কেনার জন্য পাঠালো। দাউদকান্দির দিকে অনেক খুঁজেও একটা ভালো জেন্স পোশাকের শপ পেলাম না। তাই ভাবলাম সদরের দিকে দেখি পাওয়া যায় কি-না।”
“গৌরীপুরের দিকে খোঁজ করে দেখতেন। দাউদকান্দি থেকে বাসে করে দশ মিনিটের পথ।”
“ওখানের কিছুই তো চিনি না।”
“যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই হতো। তা কিনেছেন পাঞ্জাবী?”
নিলয় অপরাধীর মতো করে চায়। বিরক্তও লাগছে কিছুটা। এতো প্রশ্ন করছে কেন মেয়েটা। এতো সমাধান দিতে কে বলেছে একে?
“কেনা হয়নি। যাবো এখনই। তোমাকে নিয়ে যাবো। এখানকার ভালো জেন্স শপ কোথায় জানো? মানে টুকটাক সবই তো চিনবে নিশ্চয়ই? তোমাদের এলাকায় এলাম, বাসায় না নিয়ে যাও, সঙ্গ দিয়ে এতোটুকু উপকার তো করতেই পারো?”
বর্ষা দাঁড়ায় হঠাৎ। তীক্ষ্ণ চোখে চায় সন্দিহান হয়ে। পুরুষ মানুষ হয়েও এতো চিনি না, জানি না জপতে থাকাটা কেমন যেনো শোনালো। সে কৌতুহলী স্বরে শুধায়, “আপনি আমার জন্য এসেছেন এখানে? আই মিন, আমি যেনো চিনিয়ে দিতে পারি তার জন্য?”
“হ্যা।”
“আসলেই?”
“সন্দেহ আছে?”
“না মানে, আপনার বন্ধুও তো শুনলাম কুমিল্লার স্থায়ী বাসিন্দা। উনাকে স্বরন না করে আমাকেই? আপনার বন্ধু কি খুব ব্যস্ত?”
“বন্ধু ব্যস্ত কিনা জানি না। তুমি ব্যস্ত নাকি সেটা বলো।গোয়েন্দাদের মতো জেরা করে ভয় দেখাচ্ছ কেন? ইউ শুড বি হ্যাপি। বন্ধুর অপশন থাকার সত্বেও আমি তোমাকেই তলব করেছি। হাউ লাকি ইউ আর!”
বর্ষা হাসল বিদ্রুপ করে।
“বুঝলাম। কিন্তু মনের মধ্যে সততা থাকলে খামোখা ভয় পেতে যাবেন কেন? তাছাড়া আমি কিন্তু তেমন কিছু মিন করছি না। অসময়ে আপনাকে দেখে একটু, নাহ নাহ, একটু বেশিই অবাক হয়েছি।”
“অবাক না, অসন্তোষ হয়েছো। আপ্যায়ন করার ভয়। যদি কথায় কথায় তোমাদের বাড়িতে যেতে চাই, সেই ভয়ে। তাড়িয়ে দিতে চাও ইনিয়েবিনিয়ে। তোমাদের কুমিল্লার মানুষদের যে আতিথিয়েতার ধরণ ভালো না, আগেই টের পেয়েছিলাম সেটা।”
বর্ষা হেসে কৃত্রিম রাগ দেখানোর স্বরে বললো, “এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। পাঞ্জাবী পরে কেনা হবে, এখন বাইক ঘুরান। এত অপমান আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আজই বাড়ি নিয়ে যাবো আপনাকে।”
বাইকে উঠে চাবি ঘুরিয়ে ঘাড় কাত করে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসল নিলয়। বর্ষা নিঃশব্দে পেছনে চড়ে বসলো। লুকিং গ্লাসে ধবধবে সাদা কামিজ পরিহিত রমণীর ছোট্ট মুখটা দেখে নিয়ে বাইক স্টার্ট করলো নিলয়।
কাকতালীয় দিনের বিপরীতে গড়ে উঠা নাম না জানা একটা সম্পর্কের নরম ভারটুকু মন্দ লাগছে তার। বরং ভালোর চেয়ে কয়েকশো ধাপ বেশির স্নিগ্ধতা টের পায় সে। দু’জনই চুপ। এই নিরবতাটুকুও খারাপ লাগছে না।
“বিয়েটা কেন ভাঙলেন,নিলয়?”
ভাবনার রেশ কাটিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা করে বর্ষা। নিলয় হাসে মৃদু৷ শ্বাস ফেলে জবাব দেয়, ” সৃষ্টিকর্তা যেটা চান না, সেটা ঘটানোর সাধ্য আছে কার মিস, বর্ষা? ওসব বাদ দাও। বলো, বাড়িতে নিয়ে কী খাওয়াবে?”
“সত্যি যাবেন?”
“তো তুমি কি মিছিমিছি দাওয়াত করলে? এসব কেমন ধরনের বাটপারি? এই নিয়ে দু’বারের দাওয়াত জমে আছে আমার। নেহাত আমি জেন্টলম্যান তাই এতো ধোঁকা খাওয়ার পরেও অভদ্রদের মতো অনুমতি ছাড়া এখনও হামলা দিচ্ছি না। অভুক্ত হয়ে আছি কিন্তু। আজ না নিয়ে গেলে সত্যি সত্যি অনশন করবো।”
বর্ষা শব্দ করে হেসে দিলো৷ নিলয় চায় সেই মনোমুগ্ধকর হাসি আড়ালে। বিপরীত দিকের হাওয়া এসে বর্ষার সামনের চুলগুলো উড়িয়ে দিলো। কখনও কখনও সেই মসৃণ চুলগুলো এসে ছুঁয়ে দেয় নিলয়ের ঘাড়, চোখ, মুখ। সে চোখ বুজে ওদের জ্বালাতন গ্রহণ করে স্বাদরে। কথায় কথায় লক্ষ-কোটি কথা হয় ওদের। সেই কথার তরে একটা নির্মল আকাশের নিচে চাপা পড়ে যায় নিলয়ের গোপন অভিলাষ। আত্মীয়স্বজনদের দৃষ্টি এড়িয়ে একটা বহু মাইল দূরের মায়াবী মুখ দেখতে চাওয়ার তীব্র কামনা। কেউ জানলো না তা!
—
বিয়ে বাড়িতে এসেও নিরা ঠিক বিয়ে বিয়ে বাড়ি ফিলটা পাচ্ছে না। বেচারীকে ঘরের এক কোণে বসিয়ে রেখে ডাকাত ধরে বেঁধে রাখার মতোন করে পুরোদমে নজরে নজরে রেখেছে নাবিল। হলুদে সুরেলা কত গান হলো, সুন্দরী কাজিনদের নাচ হলো, স্টেজে এতো মজা করলো সবাই, অথচ তার সেসবে অংশগ্রহণ মানা। কেন? কারণ তার অভদ্র লোকের কঠিন বারণ। তার কড়া আদেশ, এভাবে যেখানে-সেখানে পরীদের মতো সেজে কারো অমূল্য জিনিস প্রকাশ করতে নেই। সে কারো বউ, কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, কারো বাড়ির রত্ন। রত্নদের থাকতে হয় গোপন। তাছাড়া ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা কিংবা নিয়ন্ত্রণাধিকারও থাকে ব্যক্তিগত মানুষদেরই। অন্য কারো সৌভাগ্য হওয়া মানা তা দেখার।
সেজেগুজে এমন রোবটের মতো বসে থাকতে অসহ্য লাগছে নিরার। রাগে-দুঃখে ছলছল করছে চোখ দু’টো। আদতেও এমন উদ্ভট মানুষ হয়? এই লোকের নির্ঘাত কোনো মানসিক রোগ আছে। নয়তো খামোখা এরকম করতে যাবে কেন? একটা সাধারণ মস্তিষ্কে এমন বিরল নিষেধাজ্ঞার সন্ধান কী করে মেলে? সে পারলে শ্বাসটুকুও নেওয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রেখে দিতো নিরার। প্রতিবার শ্বাস ফেলার পূর্বে তাকে অতি সম্মানের সহিত জিজ্ঞেস করতে হতো, “শ্রদ্ধেয় স্বামী মহোদয়, আমি কি পারবো দীর্ঘ দশ সেকেন্ড ধরে আঁটকে রাখা শ্বাসটা একটুখানি ফেলতে? প্রাণ যায় যায় অবস্থা জনাব। প্লিজ, সদয় হোন। কথা দিচ্ছি, এবার শ্বাস ফেলে আগামী বিশ সেকেন্ড আর বায়না ধরবো না। একেবারে শ্বাস আঁটকে এলে সে না-হয় অন্য হিসেব। না থাকবে শ্বাস, না চিন্তা হবে শ্বাস ফেলার। ফেলব?”
উত্তরে সে দীর্ঘসময়ের জন্য ভাবনায় পড়ে যাবে। অতি কঠিন আর দুরূহ এই অনুমতিপত্রটি সই করতে বহু বেগ পোহাতে হবে তাকে। তার ব্যক্তিগত রমণী শ্বাস ফেলবে সামান্য এই মাটির চরাচরে? এ-ও মেনে নেওয়া যায়?এ যে ভারী অনিয়ম। প্রকৃতি কি কাগজে-কলমে তার বউকে বিয়ে করেছে? করেনি। আছে কোনো অধিকার তার বউয়ের কার্বনডাইঅক্সাইড শুষে নেওয়ার? নেই। তা কেবল একজন মহামানবের আয়ত্তে থাকবে। তার নাম, নাবিল এহসান।
ফুলেফেঁপে শ্বাস ফেলে নিজেই নিজেই কিছুক্ষণ বিরবির করলো নিরা। মন টিকছে না ঘরে।
অমাবস্যার মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার আজকের রাতটা৷ পুরো আকাশ নিকেশ কালো মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা যদিও আগামী কয়েক ঘন্টায়ও নেই, তবে আবহাওয়া মৃদুমন্দ ঠান্ডা। ছাঁদের রেলিঙের কার্নিশ ঘেঁষে নির্জন ভঙ্গিতে উঠোনের প্যান্ডেলে চেয়ে আছে নিরা। ফোন বাজছে তখন থেকেই। ভালো লাগছে না তার। ভীষণ মন খারাপ লাগছে। ফোনের পেঁনপেঁনানী থামাতে সুইচ অফ করে রেখে দিলো রেলিঙের উপর। ছাঁদের সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ধাতস্থ হয়ে দাঁড়ায় সে। নিশ্চিত ওই অসভ্য পুরুষই হবে। সারা বাড়ি চষে খোঁজ না পেয়ে ছাঁদে এসেছে। নিস্তার দেবে না এই লোক।
পায়ের শব্দটা একেবারে কাছাকাছি আসতেই ভুল ধারণা কেটে যায়। অপরিচিত পদধ্বনিটা টের পায় নিরা। নাবিল নয়। কে তবে?
“ভূত-প্রেতে ভয় নেই?”
অনাকাঙ্ক্ষিত স্বর কানে আসতেই কৌতুহল নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চায় সে। ওকে দেখামাত্রই হাতের সিগারেটটা ফেলে মৃদু হাসল নিলয়৷ পকেটে হাত ঢুকিয়ে আকাশের পানে দৃষ্টি মেলে হালকা করে শ্বাস ফেলল। নিরাকে চুপ থাকতে দেখে চায় ভ্রু বাঁকিয়ে।
“একা একা দাঁড়িয়ে আছিস যে? মন খারাপ তোর? কেউ কিছু বলেছে?”
নিরা নিঃশব্দে মাথা দোলালো দু’দিকে। এবার সেও চায় আকাশে। জড়তা কাটিয়ে হুট করেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন করে বসে। “আপনার গার্লফ্রেন্ড নেই, নিলয় ভাইয়া?”
প্রশ্নটা করে নিজেও কিছুটা অপ্রস্তুত হয় নিরা। আত্নবিশ্লেষন করার ভঙ্গিতে যত্রতত্র পূনরায় বলে, “না মানে, এমনি জানতে ইচ্ছে হলো।”
নিলয় কিছুক্ষণ চুপ থাকে। অতীত কাটিয়ে মন আঁটকে ফেলা নতুন সেই তরুণীটির ভাবনা হৃদয়ে উড়ে বেরায় তার। ঘাড় বাঁকায়। লুকায় ঠোটের স্মিত হাসি। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, “আছে।”
নিরা খুশিতে আগ্রহ ফিরে পায় কথা বলার। তবে অতো গভীরে জানতে চাওয়ার দুঃসাহস নেই তার। আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি আছে? কী নাম?”
নিলয় মন্ত্রমুগ্ধের মতো আওড়ায়, “আলো!”
নিরা ভারী অবাক হয়। “আলো? বাহ! চমৎকার নাম তো!”
নিলয় বিভ্রম হয়ে মনে করে সেই কাকতালীয় দিনটির কথা। সদ্য হৃদয়ে ভাঙন ধরা সেই রমণীটির কান্নারত বিষন্ন মুখটার কথা। জীবন যেখানে থমকে গিয়েছিল, মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সামান্য একটা বাসযাত্রা।
“নামটার ব্যাখ্যা শুনবি না? তার সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তটায়ও জীবনে চলছিলো তুমুল আঁধার। ধ্বংসস্তুপে পরিনত হওয়া আমার অন্ধকার মনের দুয়ারে প্রেমের জ্যোতি নিয়ে সে সেদিন ধরা দিয়েছিল বলে আদর করে তার নাম দিলাম ‘আলো’। সে আমার হৃদয়ের আলো! মনের আলো! জীবনের আলো!”
নিরা খানিক চুপ থেকে এতো সহজেই বিয়েটা ভেঙে ফেলার কারণ ধরতে পারলো।তবে তাকায় বিভ্রান্ত হয়ে। পরক্ষণেই মনের দরজায় কড়া নাড়ে স্বল্পক্ষণ ধরে ভুলে থাকা অভিমানটুকু। রাগ ফিরে আসে তখনই। ভাইয়ের প্রেমিক নিয়ে আর বেশি আগ্রহ না বাড়িয়ে নালিশ করার স্বরে ডাকে,
“নিলয় ভাইয়া!”
“বল”
“তাকে কি আপনি খুব প্যারা দেন? মানে আপনার প্রেমিকাকে। যেমনটা নাবিল ভাই আমাকে দেয়?”
কথার অর্থ না বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকিয়ে চেয়ে রইলো নিলয়।
“আপনার ভাই আমাকে এতো যন্ত্রনা করে কেন? আর সহ্য হয় না লোকটাকে! জন্ম থেকে জ্বালাচ্ছে।”
ওর বাচ্চাসুলভ কথা শুনে নিলয় হেসে ফেলল শব্দ করেই।
“কী করেছে ও?”
নিরা কন্ঠে গাম্ভীর্যভাব লেপ্টে জবাব দেয়,
“কী করেনি? সবাই নিচে কত কী করছে, আর আমি কিনা সাজগোজ করে ছাঁদে উঠে শোক পালন করছি। আপনার আদরের ভাই সবাইকে বলে দিয়েছে, নিরার মাথা ব্যথা। মাথার সাথে শরীরও দূর্বল। নিরার বিশ্রাম প্রয়োজন। আমার মাথা ব্যথা? না তোর ব্যথা? শুধু শুধু আমাকে যন্ত্রণা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই লোকটার। আমার সুখ এর সহ্যই হয় না।”
নিলস হাসল ঠোঁট টিপে।
“সারাদিন তোর দেখা নেই তবে এই কারণেই?”
নিরা জবাব না দিয়ে চোখের পানি মুছল। ঠোঁট উল্টে বিরবির করলো, “সারাদিন ঘরবন্দী করে রাখলে দেখা পাবেন কী করে?”
নিলয় বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হাসল আড়ালে।
“কারো কারো ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমগুলো একটু অন্যরকম হয়। ও তোকে অসম্ভব ভালোবাসে। ভয় পায় হারাতে, তার জন্যই এমন করছে। একবার ঘরে উঠ, ব্যাপারগুলো আরও নরমাল হবে। তা এতোক্ষণ ধরে এখানে আছিস নাবিল জানে?”
“উহু।”
“সিউর?”
নিরা চায় বিভ্রান্ত নিয়ে। নিলয় উঠোনের দিকে মুখ করে ইশারা করে চোখে।নিরা ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে চায়। কিছুই দেখতে না পেয়ে শুধায়,”কী?”
“তোর যন্ত্রণা তোর দিকেই চেয়ে আছে লাস্ট একঘন্টা ধরে। এখন না, যখন থেকে ছাঁদে আছিস ও তখন থেকেই ওখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে। ওখানেই ছিলাম আমি এতোক্ষণ।”
প্যান্ডেল থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নাবিল। অন্ধকার থাকার দরুণ খেয়াল করে না তাকালে বোঝা যাচ্ছিলো না নাবিলের উপস্থিতি। চেয়ারে পা দু’টো আগেপিছে করার ধরনে বসে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে বুকে হাত ভাজ করে। নিরা তাকাতেই গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো৷ গোপন হুশিয়ারীতে ভীত হয় নিরার মন। ফোনটা অন করে এক দৌড়ে নিচে নামলো। সিঁড়িতেই দেখা হয় নাবিলের সঙ্গে। নিরা না দেখার ভান ধরে পাশ কাটিয়ে চুপচাপ ঘরের দিকে ঢুকলো৷ পিছুপিছু গেলো নাবিল। নিরার সঙ্গে সেও ঢুকে ঘরে। দরজা লক করে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। অভিমানিনী অগ্নিদৃষ্টিতে একপলক চেয়ে ঝরনার মতো খুলে দিলো নিকেশ কালো লম্বা চুলগুলো। আয়নায় চোখাচোখি হয় দু’জনের। কানের দুল খুলতে খুলতে নিরা বলে, “বের হও। বাহিরে না যেতে পারলে এতো সেজেগুজে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আমি চেঞ্জ করবো৷ খুলে ফেলব শাড়ী। দরকার নেই এমন বউ সেজে বসে থাকার।”
নাবিল জবাব না দিয়ে চেয়ে রইলো পলকহীন। নিরা পিঠ থেকে চুল সরিয়ে নিরা ফিতা খুললো ব্লাউজের৷ হাঁক ছাড়ল আবারও, “কী হলো? চেয়ে আছো কেন? বের হও।”
নাবিল চোখ বুজে সংযত করলো দৃষ্টি। মনের খায়েশ লুকিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অচিরেই। কন্ঠে অভিমান ঢেলে বলল, “মামার সাথে কথা বলবো আমি কালই। তুই এখন থেকে আমার বাসায় থাকবি। আর কোনো অযুহাত মানছি না।”
নিরা চট করে চায় পেছন ফিরে। কথার অর্থ বুঝতে লাগলো না খুব বেশি সময়। তখনই ঘর আঁধার করে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়। জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই বাড়িতে। ফ্লাশলাইটের আলো জ্বালানোর জন্য ফোনটা হাতে নিতেই কেউ প্রবল শক্ত হাতে বাঁধা দিলো ওকে। হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে অন্ধকারে সেটা কোথায় ফেলল, কে জানে! শব্দ হয়নি। বোধহয় খাটেই পড়েছে। কোমড় পেঁচিয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি ঠেকায় নাবিল। কন্ঠ ভেঙে হতাশ ভঙ্গিতে বলে, “আমার মন খারাপ,বউ! খুব মন খারাপ আমার!”
নিরা হাত হাতরে ফোনের স্ক্রিনটা অন করলো। মৃদু আলোয় দেখে নিলো একটা অভিমানী নির্মল আলোর মতো সুদর্শন মুখ। বেশ কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে হাসে নিরা। নাবিলের পাঞ্জাবীর বুকের শেষ বোতামটা লাগিয়ে দিতে দিতে শুধায়, “কেন মন খারাপ বাচ্চার?”
নাবিল চায় তীব্র কোমলভাব নিয়ে। ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট ফুলিয়ে মৃদু স্বরে গোঙ্গায়৷
“তোর সাথে থাকতে পারছি না কেন? আমার ভালো লাগে না ভাই।”
ফের ফেলল হতাশ শ্বাস। পকেট থেকে অধৈর্য হয়ে ফোন বের করে কাকে যেনো কল করলো।
“ভাই, মুসিবত মীরাটাকে আজকের জন্য অন্য ঘরে থাকার ব্যবস্থা করিয়ে দাও। দরকার হয় রাতুল ভাইকেও তোমার রুম থেকে ট্রান্সপার করে মীরার সাথে গছিয়ে দাও। কাপলদের বিচ্ছিন্ন হতে নেই। আমিও আমার জোড়ার সাথেই আছি। কেউ খোঁজ নিলে ইনিয়েবিনিয়ে কিছু একটা বলে দিবে। যেনো কেউ আমাদের বিরক্ত যেনো না করে। তোমার কাঁধে দিলাম গুরুভার। কলঙ্কের ভয় আমার নেই, কিন্তু বউয়ের আবার আত্মসম্মান বেশি। বরের সাথে রাত কাটাতেও লোকলজ্জার ভয় তার। মান রেখো আমার বউয়ের।”
নিরা গম্ভীর মুখে চেয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, “কেন করলে এটা? দরকার ছিল না।”
মুখের আঁধারভাব ছাপিয়ে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরটা দেখে নেয় নাবিল। বিছানার বালিশ ঠিক করতে করতে বলে, “ঝগড়া করবি এখন? কাগজে-কলমে অনুমতিপত্র আছে আমার৷ দেখাবো?”
নিরা শাড়ীর আঁচল খুলে আবারও চাইলো তীব্র ক্ষোভ নিয়ে। মুখের উপর বালিশ ছুঁড়ে মারলো ওর। নাবিল হাত দিয়ে ধরে নিলো সেটা। বুকে জড়িয়ে বলল, “বালিশ দিয়ে কী করবো? ওসবে পোষায় না। তুই আয়।”
চুপচাপ নিজের কাজ করে নিরা৷ রাগের তরে খেয়াল নেই কোনোকিছুই। ব্লাউজ-পেটিকোট গায়ে থাকা অবস্থাতেই সে যে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাও মাথায় নেই। একজোড়া বেহেলাজ দৃষ্টি সেই সুযোগটুকুই লুফে নিলো আপন চিত্তে। বিনাবাক্যে চেয়ে রইলো ঘোরলাগানো চোখে। মোহগ্রস্তের মতো বলল, “লাজলজ্জার ভালোই অবনতি হয়েছে দেখছি। ধরলাম না, ছুঁলাম না তবুও এতো তাড়াতাড়ি লজ্জা কেটে গেলো পাখি তোর? মনের ভেতর কী চলে? মুখে মুখে ছুঁবে না ছুঁবে না বলেও আবেদনময়ী রুপে ধরা দিচ্ছিস প্রতিবার। অদ্ভুত ধোঁকা তোর।”
নিরা তাৎক্ষণিক ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে তাতানো দৃষ্টিতে চায়৷ নাবিল ঠোঁট কামড়ে হেসে শিষ বাজায় আপন আনন্দে। মুখ ভেঙিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে, “তাড়াতাড়ি শুতে আসো। রাত অনেক হলো তো। ভালো বউরা স্বামীদের এতো যন্ত্রণা করে না। কাম।”
হাল্কা গোলাপি রঙের একটা থ্রি-পিস পরে নিরা বের হয় বাথরুম থেকে। বিদ্যুৎ ফিরে এলো। নিরা তবুও কৃত্রিম আলো জ্বালায় না। ফোনের ম্লান আলোতেই দেখলো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির শুভ্র মানুষটাকে। এতোক্ষণ ধরে লাগামহীন মুখ চালানো লাজহীন মানুষটা সকল বায়ুন্ডুলেপনা ভুলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল অঘোরে। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে দেখতে লাগে গ্রীক দেবতাদের মতো। কী নিষ্পাপ মুখ, নাক, আর সরল একজোড়া ঠোঁট! নিরা হাসল মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে। মুখোমুখি হয়ে শুয়ে তাকিয়ে রইলো অসম্ভব মায়াবী মুখটার পানে। চুল লেপ্টে আছে কপাল অব্ধি। ফু দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দেয় সে। হাত ছোঁয়ায় গালে,চোখে। ওর নরম পরশে মৃদু নড়েচড়ে উঠে নাবিল। নিরা বুকের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে ডাকে, “শুনো!”
নাবিল ঘুমের ঘোরেই সাড়া দেয় ছোট্ট করে, “হু।”
“আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাও।”
আধোআধো চোখ মেলে চায় নাবিল। হাসে মাতাল হয়ে। চোখ বুজে এক হাত দিয়ে লতানো কোমড়টা পেঁচিয়ে নিজের কাছে টানলো ওকে। দুই হাত দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সঙ্গে আবদ্ধ করে বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে অর্ধাঙ্গিনীর নিকট পরম আদুরে গলায় আবদার করে, “মাথায় হাত বুলিয়ে দে।”
নিরা শ্বাস ফেলে আপন গর্ব আগলে। কোনো এক অলীক দৈব বলের জোরে তার এখন আর ভয় হচ্ছে না কেন যেনো। বরং অসম্ভব এক পবিত্রতা অনুভব করলো নিজের ভেতর। এই আবদারে প্রশান্তি খুঁজে পেলো নিজের। সে চুলে হাত বুলালো পরম আবেশে। প্রেয়সীর এহেম আস্কারায় ছেলেটা নিজেকে ধীরে ধীরে তার বুকের মধ্যে গুটিয়ে নিচ্ছে জন্মলগ্ন শিশুর ন্যায়। নাক ডুবিয়ে দেয় ঘাড়ের কাছে। শ্বাস টেনে সবটুকু মেয়েলী সুভাস শুষে নেয় প্রবল তৃপ্তি নিয়ে। নিরা খেয়াল করলো, একটু আদরেই কেমন মোমের মতো গলে যায় লোকটা। বশীভূত হয় অবুঝের মতো। আরও উপলব্ধি করলো, এই মানুষটাকে নিজের কোমল বুকে আশ্রয় দেওয়ার মতো চমৎকার অনুভূতি বোধহয় পৃথিবীতে আর হয় না। বরং শরীর,মন তাকে ভীষণভাবে আগলে রাখার কামনায় মত্ত। রেশম তুলোর মতো নরম সুখ হয় হৃদয়ের! আর এই পাগল ছেলেটাকেই নাকি খুচরো পয়সার মতো আঁচলে বেঁধে রাখতে হবে আজীবন! রাতের পর রাত তাকে ঘুম পাড়াতে হবে! নিরা আবারও হাসে সেসব ভেবে। কাজটা বোধহয় অতোটাও কঠিন নয়। বরং লোকটা নিজেই প্রতিবার স্বেচ্ছায় ধরা দেয় নিরার নারীসুলভ আঁচলে! এই অনুভূতিটা সত্যিই চমৎকার সুন্দর!
চলবে।