রোদ পোহাবার ছুতোয় পর্ব-২৪+২৫

0
9

গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ২৪
#নাজমুন_নাহার

“আম্মু, তোমাদের এসব অদ্ভুত ফর্মালিটিস একেবারে অসহ্য ঠেকছে এবার। এখান থেকে সোজা বাসায় যাবো। তুমি আব্বুকে বলে দাও, আমি যাচ্ছি না চান্দিনায়। আমার ভাল্লাগে না। আই লাভ টু স্টে এট মাই হোম৷”

“তো ওটাও তো তোরই বাড়ি৷ যা বাপ, তোর চাচার মতো এমন গুরুগম্ভীর মানুষ এতো করে অনুরোধ করে বলেছে, না যাওয়াটা সমিতির হচ্ছে না। সবসময় নিজের জেদ ধরে বসে থাকতে নেই, মানুষ কষ্ট পায়। একটা রাতেরই তো ব্যাপার। তাছাড়া তোকে একা যেতে বলছি না, ভাইজান সবাইকে নিয়ে একসাথে যেতে বলেছেন। অহনা আর নেহাল যাবে না। বাকিদের নিয়ে ঘুরে আয়। মা’র কথা শোন লক্ষী আমার৷”

নাবিল কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে, “তুমি সবসময় এমন করো আমার সাথে৷ আই হেইট ইউ।”

ছেলের কথায় হেসে ফেলল মা। শার্ট গোছগাছ করতে করতে বলল, “মানহাকে বিদায় দিয়ে আমরা এদিক দিয়ে ভাই-বোনেরা ঢাকায় ফিরে যাবো, আর তোরা ঘুরে আয় চান্দিনায়।”

নিলয় এখানেই বসেছিল এতোক্ষণ। হ্যা,না কিছুই বলেনি। সচরাচর ধরে-বেধেও ওকে কখনও কোথাও বেরাতে নিয়ে যাওয়া যায় না। রাহেলা চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ওর শার্টও গোছাতে গোছাতে বলেন, “তুই যেনো আবার কোনো অযুহাত না দেখাস, বাপ। ঘুরে আয় সবাই মিলে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আয়। ভাইজানকে ডেকে বল, তোদের জন্য একটা টেবিল খালি করতে।”

নিলয় মনের উত্তেজনা লুকিয়ে হাসল সম্মতিসূচক। হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে ম্যাসেজ করলো কাউকে একটা, “ধরো, তোমার দাওয়াত এক্সেপ্ট করে নিলাম আজই। হুয়াট উইল বি ইউর রিয়াকশন?ইউ ইউল বি হ্যাপি অর নট?”

দু,এক মিনিট পর আসে ফিরতি উত্তর।

“মুখে মুখে আসবো আসবো না করে একদিন সত্যি সত্যি এসে চমকে দিলেও তো পারেন। আপনার আগমনে অখুশি হওয়ার ভীষণ ইচ্ছে আমার।”

না চাইতেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে নিলয়ের। নাবিল আরচোখে খেয়াল করে দুম করে পাশে বসে হাত রাখে ভাইয়ের কাঁধে। ভ্রু নাচিয়ে শুধায়, “প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে। আছে নাকি প্রেডিকশন সত্য হওয়ার সম্ভাবনা?”

নিলয় রাগলো না। সেও হাত রাখে নাবিলের কাঁধে । জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হেসে বলে, “সত্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে করবি হেল্প?”

নাবিল চোখে-মুখে উচ্ছাস নিয়ে লাফিয়ে উঠে বলে, “দুইশো বার করবো। কে সে?”

——

খয়েরী রঙের পাঞ্জাবীর সাথে ধবধবে সাদা জিন্সপ্যান্ট। পাঞ্জাবীর হাতা কনুই অব্ধি গোটানো। ভাবসাব একেবারেই অপ্রতিরোধ্য ধরনের। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো অভিজাত হাসি আর পৃথিবী থমকে দেওয়ার মতো ম্যানলি হাটার ধরন। ঘোরলাগানো চোখজোড়ায় সারাক্ষণ খেলতে থাকে চমৎকার নেশা। শরীর থেকে ভেসে বেড়ায় মাতাল করা পুরুষালী সুভাস। ঠোঁটের কোনো সর্বদা স্মিথ হাসি বিদ্যমান। আশেপাশের অল্পবয়সী যুবতীরা ক্ষণে ক্ষণে নজর বোলাচ্ছে ছেলেটার পায়ের নোখ থেকে মাথার চুল অব্ধি। ওরা উঁকিঝুঁকি মেরে পর্যবেক্ষণ করছে ছেলেটাকে। কানাকানি করছে ওরা। কে সে? কে তুমি হে সুপুরুষ? বুকের মধ্যে সমুদ্র আছড়ে পড়ার মতো তোমার উপস্থিতি। যেনো কল্পনা জগৎ থেকে উঠে আসা কোনো স্বপ্নের মহাপুরুষ। নির্জন জ্যাৎস্না রাতে বহু রমণী যেমন পুরুষের ছবি আঁকে বুকে। অপেক্ষা করে বছরের পর বছর। ছেলেটা তেমনই কাল্পনিকচরিত্রের মতো সুদর্শন।

বিয়ে বাড়ির লোকসমাগমের মধ্যে কোথাও নিরাকে দেখতে না পেয়ে মহা বিরক্ত হয় নাবিল। জয়নাল সিকদার তখন থেকেই ভাগ্নেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। ডাকবেন ডাকবেন ভাব। সেদিনের পর থেকে তিনি নাবিলের সাথে কথা বলা কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। মনের স্নেহটা দমাতে না পারলেও মুখের গাম্ভীর্যভাব অটুট থাকে সর্বদা। ডাকলেন তবুও, “সবাইকে নিয়ে এই টেবিলে বসে পর। তোরা আগে খা, তারপর তোর মামি আর মা-খালাদের বসাবো। বাকিরা কোথায়?”

মামার ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে চায় নাবিল। জয়নাল সিকদার অন্যদিকে মুখ করেই কথাটা বলেছেন। ভেতরে ভেতরে হাসল নাবিল। মনের মধ্যে আকাশ সমান মায়া তুলে রেখেও তার মামুটার এটিটিউড এক ইঞ্চিও কমার নাম নেই। বউটা নির্ঘাত বাপের মতোই হয়েছে। শরীরজুড়ে ভয়ংকর জেদ তারও।

“সবাইকেই ডেকে দিয়েছি,মামা। আসছে ওরা।”

মাথা ঝাঁকায় জয়নাল। ফিরে যেতে নেয় ধীরপায়ে। নাবিল ডাকে আবার, “মামা!”

তিনি হঠাৎ করেই কেমন নরম হয়ে তাকান। আদরের ভাগ্নের মুখে এই সম্মোধন শুনলো বহুদিন পর। মুহূর্তেই যেনো বুকের উপর থাকা ক্ষোভের পাহাড়টা ভেঙে চুরমার হয় কিছু মুহূর্তের জন্য। বাবা-র আদর থেকে চিরকাল দূরে থাকা এই ছেলেটার জন্য বরাবরই ভীষণ মায়া হয় জয়নাল সিকদারের। মায়া হওয়ার মতো অসহায় নাবিল না। যথেষ্ট অভিজাত পরিবেশেই বড় হয়েছে সে। তার পরে-ও এই নিষ্পাপ, নির্মল চাহুনির ছেলেটার দিকে তাকালে আপনাআপনিই বুকে আগলে ধরতে ইচ্ছে করে ওকে। নিজের সন্তানের মতো কান টেনে দিয়ে ভীষণ শাসন করতে ইচ্ছে করে কখনও কখনও। নাবিল মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো মামাকে। শক্ত প্রাচীরের আড়ালের তুলোর মানুষটা মাঝে মাঝেই ধরা দেয় আড়ালে-আবডালে। কেমন কোমল করে তাকায়। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নাবিল। যা জিজ্ঞেস করবে বলে ডেকেছিল তার বিপরীতে শুধায়,” আপনি খেয়েছেন?”

ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে জয়নাল সিকদারের। সেটাও খুব সামান্য। মুখের নির্লিপ্ত স্বর বজায় রেখে তিনি জবাব দেন, “তোদের না খাইয়ে খাচ্ছি না। সবার খাওয়া শেষ হোক। ওদেরকে ডেকে বসে পড় একসাথে। পরে খাবো আমি।”

মাথা ঝাঁকিয়ে ফিরে যেতে নিয়েও আবারও ডাকে নাবিল৷ “মামা, আমি আপনার সাথে খাবো।”

এবার আর পুরোপুরি ঘাড় ফেরালেন না তিনি। গোপনেই হাসলেন স্মিত। মাথা নুয়িয়ে রেখেই হাত রাখেন ভাগ্নের পিঠে। বললেন, “তুই না থাকলে ওরা এক টেবিলে বসে খেতে মজা পাবে না। তোরা ভাই-বোনরা একসাথে বসে হাসি-ঠাট্টা করে খাবি, এটাই অন্যরকম ভালো লাগা। বোস ওদের সাথেই। মামা খেতে বসলে তখন না-হয় আবার বসাবো তোকে।”

মানুষটা কেমন ছোট্ট শিশুর ন্যায় বুঝ দিয়ে দিলো নাবিলকে। ভেতরে ভেতরে কপাল চাপড়ালেও মুখে অতি ভোলাভালা সেজে মাথা নাড়ায় নাবিল। তাকায় বাধ্য ছেলের মতো। শশুরটা বোধহয় অতোটাও হিটলার না। আছে জুৎসই।

চঞ্চল চড়ুইয়ের মতো হাত-পা সারাক্ষণ নড়ছে নাবিলের। দুই চেয়ার একত্রে দখল করে বসেছে সে। এক চেয়ারে নাকি তার হয় না। পা দু’টোর জন্যও তো আরেকটা চেয়ার লাগে না-কি? ওদেরও তো আরামের প্রয়োজন।
শিষ বাজাতে বাজাতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে। স্থির হয়ে বসতে পারে না ছেলেটা। সকলেই আপন ধ্যানে ব্যস্ত। নেহাল-অহনার মধ্যে মান-অভিমান চলে সম্ভবত। প্যান্ডেলে ঢুকার পর থেকেই ভাবীজানের মুখ গোমড়া। অমাবস্যা হয়ে আছে চেহারাটা৷ নবদম্পতি মীরা-রাতুলও সেলফি তোলায় ব্যস্ত। নিলয় ফোন টিপছে। ইফরান টেবিলের উপর হাত রেখে ধ্যানমগ্ন হয়ে কী যেনো ভাবছে। হতাশ শ্বাস ফেলে নাবিল। সকলেই আছে, নেই শুধু তার জোড়ার জন। নাবিল মাথায় হালকা চাট্টি মারে মীরার। পা দোলাতে দোলাতে শুধায়, “নিরা কই রে?”

মীরা অগ্নীরুপ ধারণ করে চাইলো৷ স্বামীর সামনে নিজের চেয়ে মাত্র এক বছরের বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া এহেম অপমানে মাথাটা দবদব করে জ্বলছে। দুম করে কিল বসালো পিঠে৷ খেকে উঠে বলল, “এই জানোয়ার, তুই কি শুধরাবি না কোনোদিন? নিলয় ভাইয়া,কিছু বলবা ওকে?”

নিলয় শাসনের চোখে চায়৷ “আঃ কী হচ্ছে। বিয়ে হয়েছে না ওর? ও কি বাচ্চা? সবসময় জ্বালাস কেন মেয়েটাকে?”

নাবিল গা-ছাড়া ভাব নিয়ে চেয়ারে হেলান দেয়। হাই তুলতে তুলতে বলে, “চিল করো৷ রাতুল ভাই মাইন্ড করবে না। ভাই খুব কুল। কী ভাই? আপনার বউয়ের সাথে একটু মশকরা করলে করবেন মাইন্ড?”

রাতুল অস্বস্তিতে পড়ে যায়। অপ্রস্তুত হয়ে হাসে কিছুটা। নাবিল মীরার তেতো চাহুনিকে পাত্তা না দিয়ে পূনরায় বলে, “তোর বোন ব্রিটিশ মরিচটাকে ডেকে আন। সে কি পাতিল খালি হলে পরে খেতে আসবে?”

মীরা ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে । “তোর এতো কী কাজ ওকে দিয়ে?”

ধপ করে পা নামিয়ে বসে নাবিল। চুলের বেনি টেনে দিয়ে বলে,

“শোন, তুই ভাবিস না জামাই নিয়ে বসে আছিস বলে আমি অতি ভোলাভালা উত্তর করবো। এতো তেলানোর সুযোগ নাই। মুখ,হাত, পা এখনও লাগামহীন চলে। আমাকে রাগাস না। মামা তোদেরকে গাইড করার গুরুভার আমার কাঁধেই দিয়েছে। সবাই আসছে কি-না, খাচ্ছে কি-না দেখতে হবে না? নয়তো খামোখা সেধে সেধে লুতুপুতু কেয়ার দেখানোর ইচ্ছে নেই আমার। ঠেকা পড়ছে, হাহ্।”

মীরা মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে, “গুরুভার দেওয়ার আর মানুষ পায়নি? পরমুহূর্তেই চায় চোখ যায় গেইটের পানে। বোনকে দেখে হাতের ইশারায় দেখায়,” ওইযে,আসছে তোর ব্রিটিশ মরিচ। পা মচকেছে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে। আম্মু মলম লাগিয়ে দিচ্ছিলো এতোক্ষণ।”

কথাটা শোনামাত্রই নাবিলের মুখভঙ্গি হুট করেই পাল্টে গেলো। ‘পা মচকেছে’ কথাটা যেনো চট করেই বুকের ভেতর আঁধার নামিয়ে আনলো। মুখ তুলে চায় বাড়ির গেইটের পানে৷ আস্তেধীরে হেঁটে এদিকেই আসছে নিরা। পরনে খয়েরী রঙের ভারী কাজের থ্রি-পিস। ফর্সা, গোলগাল সরু নাকের মুখে প্রসাধনীর আস্তরণ তেমন নেই বললেই চলে। চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তিভাব মেয়েটার। তবুও যেনো পৃথিবীর তাবত মুগ্ধতা চেহারায় লেপ্টে প্যান্ডেলে এসে পৌঁছালো নিরা নামক রমণীটি। সকলে একসঙ্গে চাইলো ওর পানে। টেবিলের পাশাপাশি এসে দাঁড়াতেই ইফরান হাহুতাশ করে বলে, “কোথায় বসবে তুমি? জায়গা নেই তো।”

নিরা চোখ বুলিয়ে চায় টেবিলজুড়ে। আসলেই কোনো খালি চেয়ার নেই। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রাতুল বলল, “আমি না-হয় আব্বুদের সাথে খাবো৷ তুমি তোমার বোনের সাথে বসো, নিরা।”

নিলয় বাঁধা দিয়ে বলে, “তুমি বসো রাতুল৷ বাড়ির জামাই তুমি। নিরা, তুই আমার চেয়ারে বোস৷ এমনিতেও আমার খিদে নেই।”

নেহাল স্নেহময় কন্ঠে বাঁধা দেয় ওদের। “বইন তুই এখানে বোস৷ ইফরানকে আমি কোলে নিয়ে নিচ্ছি। তোকে ছাড়া আমরা আরাম করে খাবো, তা হয় না।”

রীতিমতো কে নিজের চেয়ার ছেড়ে দেবে তা নিয়ে ভাগাভাগি, টানাটানি দরনের বাকবিতন্ডা শুরু হয়ে গিয়েছে। এদের অবস্থা দেখে নিরা হাসল নিঃশব্দে। পরক্ষণেই চোখ যায় অপলক চেয়ে থাকা মানুষটার দিকে৷ নাবিল নির্লিপ্ত অথচ কেমন বিষন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখ দিয়েই বলে দিচ্ছে কত-কী। এই ছেলেটা মুখে যতটুকু না বলে, তার চেয়ে বেশি বলে চোখে চোখে। তার চোখের ভাষা গভীর, গাঢ়, অপ্রতিরোধ্য। সেসব প্রেয়সী কতটুকু বুঝল, কে জানে। নিরা খুড়িয়ে খুড়িয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে নাবিলের সম্মুখে দাঁড়ানোর আগেই নাবিল চেয়ার থেকে পা ছেড়ে দেয় নিজের। নিরা হেসে গোপন ইশারায় বসে পড়ে স্বামীর পাশে।

ইফরানসহ সকলে ভূত দেখার মতো চমকে চাইলো। নির্লিপ্ত কেবল নিলয়। হাসল মনে মনে। ইফরান ঠোঁট উল্টে অভিযোগের স্বরে বলে,

“চাচ্চু, তুমি আমাকে কেন বসতে দিলে না তখন? নিরা ফুপ্পি তো ঠিকি বসে পড়ল। এই বেলায় তোমার আরাম নষ্ট হয় না?”

নাবিল ভেতরের প্রগাঢ় বিরক্তিভাব আড়াল করে চাইলো শান্ত চোখে। ইচ্ছে তো করছে ভাতিজাকে মাথায় তুলে সজোরে তিন-চারটা আছাড় মারতে। তা না করতে পারার আক্ষেপ নিয়ে মনে মনে ওর মায়ের গোষ্ঠী উদ্ধার করে অভদ্র কিছু গালি ছুড়ল। বেটা নির্ঘাত হিটলার, ব্রিটিশ সমাজের বংশধর! সবখানে খাই খাই স্বভাব। বউকে না বসতে দিয়ে তোকে দিবো? মদন পেয়েছিস?
কিন্তু মুখে অতি কোমলভাবে বলল,

“তোর ফুপ্পি এই মুহূর্তে ইমারজেন্সি ক্যাটাগরির রোগী। সিঁড়ি থেকে পড়ে পা মচকেছে বেচারীর । বসতে না দিলে যখন-তখন ফিট খেয়ে পড়বে। ভরা মজলিসে ব্যাপারটা খুবই বিব্রতকর। তোরও পা ভেঙেছে? তুইও কি রোগী? ওয়া ওয়া ফিডার মুখে তুলে কোলে নিতে হবে? আয় বাপ, কোলে উঠ তাইলে। টসটসা গালে একটু আদর দেই। সব রোগ সেরে যাবে।”

সকলে হেসে ফেলল একত্রে৷ নেহাল হুট করেই চোখ ছোট ছোট করে চায় অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে। গোয়েন্দার মতো রসিয়ে রসিয়ে শুধায়, “এইরে, তোরা কি প্ল্যান করে ম্যাচিং ম্যাচিং পরেছিস? ড্রেসাপ তো পুরাই মিলে গেলো। বসেছিসও পাশাপাশি। কাপল গোলস এর বদলে সিবলিংস গোলস টাইপ ব্যাপার হয়ে গেলো না?”

বলেই হু হা করে হেসে উঠল নিজেই৷ এতোক্ষণে সকলে খেয়াল করে চাইলো ওদের পানে। সত্যি দু’জনের পোশাকের রঙ প্রায় একই। পাশাপাশি বসায় দেখতে লাগছে সদ্য বিয়ে হওয়া কোনো নবদম্পতির মতো। নাবিল ভাইয়ের পানে চাইলো গরম চোখে। মনে মনে পৃথিবীর নিকৃষ্ট গালিটা শুনিয়ে দেওয়ার অভিলাষ করলেও বাইরে থেকে রইলো নির্লিপ্ত। নিলয় ওর চাহুনির অর্থ বুঝে ঠোঁট টিপে হাসল।

নিরা তখন থেকে মুখ গোমড়া করে নিজের প্লেটের দিকে চেয়ে পোলাউয়ে আঙ্গুল ঘাঁটাচ্ছে। খাচ্ছে না কিছুই। নাবিল ইশারায় শুধায়, “কী হয়েছে?”

“আমি চিংড়ি মাছ দিয়ে খাবো৷ আমাকে চিংড়ি দেয়নি। রোস্ট আর কাবাব খাবো না।”

কেমন মন খারাপের স্বরে কথাটা বলল নিরা। নাবিল খেয়াল করে দেখলো, সকলের পাতে চিংড়ি পড়লেও নেই শুধু নিরার পাতে। বেচারি চিংড়ি মাছ খেতে এত পছন্দ করে আর অভাগারা ওরটাতেই দিতে ভুলে গেলো। আশেপাশে ডাকার মতো কাউকেও পেলো না তেমন। নিজের প্লেটেরটা দিয়েও স্বস্তি মিললো না। বউ একটা খেলে কি আর তার পোষাবে? পছন্দ করে মানে পুরো বিয়ে বাড়ির সব চিংড়ি তার বউয়ের প্লেটে হওয়া চাই। যেখান থেকে হোক হামলে আরও একটা ম্যানেজ করা চাই। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো, কেউই এখনও চিংড়িতে হাত লাগায়নি। তবে সবারগুলো লুট করা যাবে না। এদের মস্তিষ্ক বিচক্ষণ। চোরা চোখে চাইলো মিরার পানে। বেচারী আপন ভঙ্গিতে খাচ্ছে। শয়তানি বুদ্ধি ফলাতে ওকেই বলির পাঠা বানাতে হবে। আহারে আহারে ধরনের অসহায় মুখ করে নাবিল ডাকল মীরাকে, “মিরু রে!”

মিরা চায় বিরক্তি নিয়ে। “কী সমস্যা?”

নাবিল দীর্ঘ একখান শ্বাস ফেলল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল,

“শরীরটা মারাত্মক খারাপ লাগতেসে বইন৷ সারা দেহে কেমন চিনচিনে ব্যথা। মাথার উপর পৃথিবী ঘুরতেসে। চোখ দুইটায় আন্ধাইর দেখতেসি সব। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করে। শ্বাসকষ্টও হইতেসে একটু একটু। খাইতে পারতেসি না।”

মীরা চোখ-মুখ কুঁচকে চাইলো। পর্যবেক্ষণ করে বিরক্ত নিয়ে। গড়গড় করে বাড়ির প্রবীণ সমাজের সকল রোগ বলে দিলো নাবিলটা। নানী-দাদীদের রোগ সব। এতো ধরনের সমস্যা দেখা দেওয়ার মতো নিষ্পাপ তো দেখাচ্ছে না ওকে। তবুও দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি করে রাখা ভুক্তভোগীর মতো অসহায় ধরনের করে রেখেছে ছেলেটা মুখটা। মায়া হলো সহজ-সরল মীরার।

“এই কয়েক মিনিটের মধ্যে কী হলো তোর আবার?”

“জ্বর জ্বর লাগছে। রুচি হচ্ছে না খেতে৷ মানে এসব রোস্ট, কাবাব দিয়ে খেতে রুচি হচ্ছে না।”

মীরা বিভ্রান্ত হয়ে চাইলো। সামান্য জ্বরের এতো সিমটমস থাকে?

“উঠে পড়বি?”

নাবিল কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে থেকে হতাশ শ্বাস ফেলল। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চর লাগাতে। কী-সব আলু মার্কা মগজ। এসব দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না মানে বিকল্প কিছু চাইছে এটাও মাথায় আঁটে না? এই লাউয়ের ব্রেইন নিয়ে সংসার করবে কীভাবে ছেমরি।
নিজেকে সংযত করলো তবুও। অবলা অবলা ভাব ধরে বলল,

“না খেয়েই উঠে পড়ব? কেমন দেখায় না?”

“মরেই তো যাচ্ছিস রীতিমতো। কেমন দেখাদেখিতে কী আসে- যায়? আর খেতে পারলে খা আস্তেধীরে।”

“বললামই তো, এসব রুচিতে যাচ্ছে না। চিংড়ি মাছটা হলে খেতে পারতাম দু’টো।”

কথাটা মীরার প্লেটের লাল টুকটুকে চিংড়িটার দিকে চেয়ে বলেছে নাবিল। মীরা ওর প্লেটে চোখ বুলিয়ে দেখে, বেচারাকে চিংড়ি আসলেই দেওয়া হয়নি। মায়ার চোখে চায় মীরা। আবার নিজেরটা বিলাতে মন মানছে না। চিংড়ি যে ওরও ভীষণ প্রিয়। মানবতার খাতিরে তবুও মুখ গোমড়া করে বলল, “তুই চাইলে আমারটা নিয়ে নিতে পারিস। অল্প করে খেয়ে রেস্ট নে ঘরে গিয়ে।”

বলতে দেরি নাবিলের ছো মেরে চিংড়িটা মীরার পাত থেকে সরাতে দেরি হলো না। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে মীরার। বলেছে বলেই নিবে নেবে? লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েটা আর বলতেও পারলো না কিছু। চাইলো অসন্তোষ চোখে৷ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চিংড়ির খোসাটা ছাড়িয়ে আড়ালে রেখে দিলো নিরার পাতে। কী মনে করে মীরার চোখ গেলো ওর উপর, কে জানে। দেখলো, কোনোপ্রকার রোগী রোগী ভাব ছাড়াই মনের আনন্দে নাবিল রোস্ট আর কাবাব দিয়ে মজা করে খাচ্ছে। চিংড়ির সন্ধান নেই সেখানে। খাসির রেজালাও নিলো একটু পর। আরামছে বসে দুই প্লেট সাবার করলো এক বসায়। হা হয়ে এলো মীরার মুখ। একে দেখে কেউ মোটেও বলবে না এর কোনো অসুখ হয়েছে। মীরা দাঁতে দাঁত পিষে রসিয়ে রসিয়ে বলল, “কি রে হারামি? তোর না মুখে রুচি নাই? রাক্ষসের মতো দুই প্লেট হজম করলি ক্যামনে?”

নাবিল ওর দিকে না চেয়েই হাত ধুয়ে ড্রিংসয়ের বোতলের মুখ খুলতে খুলতে জবাব দেয়,

“তুই আর তোর জামাই একাই যে ছয় প্লেট মারছিস, আমি কিছু বলছি? এখনও তো ঠুসা অফ যায় না। কুত্তার মতো মুখ চলতেসে। যেই হারে খাইলি, এক বসায় ব্লাস্ট হবি সিউর।”

খাবার পরিবেশক মাত্রই টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন ডেজার্ট নিয়ে। নাবিল নালিশ করার ভঙ্গিতে জোরে জোরে বলে, “মামা, খাবারদাবার একটু বেশি বেশি দিয়ে যাবেন না? বায় এনি চান্স হাতি,গন্ডাররা গেস্ট হিসেবে আসলে কিন্তু সমস্যা। ওদের জন্য খাবার কম হয়। গেস্টদের ডেকে এনে এভাবে অপমান করা ঠিক না। হোক না হাতি, মহিষ।”

পরিবেশক ওদের ভাই-বোনদের রসিকতা ধরতে পেরে হাসল দাঁত বের করে।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মানহাকে বিদায় দেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই মানহার মা-খালাদের তুমুল কান্নার রোল পড়ে গিয়েছে। জাঁকজমক বিয়ে বাড়িতে কিছু মুহূর্তের মধ্যেই নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রক্ষণশীল সমাজের গ্রামের বিয়েতে সচরাচর এমনই হয়। বাড়ির প্রায় সকলেই ওকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য পিছু পিছু যাচ্ছে। নিরার ভালো লাগছে না ওখানে। আবার ফিরে যেতেও পারছে না। মীরা শক্ত করে ধরে রেখেছে বোনের হাত। কারো বিদায় দেখায়ও যে একটা মজার দৃশ্য, সেটা মীরার কৌতুহল না দেখলে বোঝার উপায় নেই। মুখে বিরক্তি ভাব নিয়ে রোবটের মতো হাঁটল বোনের ধরে। ভীরের মধ্যে হঠাৎ কেউ একজন শক্ত করে টেনে নিলো ওকে। ধাক্কাধাক্কির মাঝেও প্রবল নিরাপত্তা দিয়ে সমাগম থেকে বের করে আনলো কেউ একজন। খেয়াল করলো না নিরা তাকে।

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নাবিল ওকে। ছাড়াছাড়ির কোনো নাম নেই। নিরা হতাশ শ্বাস ফেলল। এক নিশ্বাসে টপাটপ বিশ-ত্রিশটা চুমু খেয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে ছেলেটা। নিরা মৃদু নড়েচড়ে বলল, “হয়েছে তো।”

নাবিলের হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় হয়। তপ্ত শ্বাস ফেলে কেমন করে যেনো। পারলে বুকের মধ্যেই ঢুকিয়ে ফেলতো ওকে। ফিসফিস করে বলে, “হয়নি তো।”

“আঃ ছাড়ো না।”

“আরেকটু থাক। এখন আসবে না কেউ। আগামী দশ মিনিট ধরে চলবে ওদের শোককান্না। কতক্ষণ ধরে এই সুযোগটা খুঁজছিলাম, জানিস?”

নিরা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের ছেড়ে রাখা হাত দু’টো রাখে ওর পিঠে৷ প্রশ্রয় পেয়ে আরও নৈকট্যে আসে নাবিল। চুমু খায় ঘাড়ে৷ শরীরে শিহরণ হতেই রেগেমেগে ঘাড় সরায় নিরা। নাবিল যেতে দেয় না ওকে। অবাধ্যের মতো প্রতিশোধমূলক চুমু খায় আরও কয়েকটা৷ গালে হালকা কামড় বসিয়ে বলে, “একেবারে সফ্টি কেক তুই৷ ইশ! কী নরম গাল রে ভাই। দেখলেই কামড় বসাতে ইচ্ছে করছে।”

নিরা এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারতে মারতে বলে, “একদম গালের সামনে মুখ নেবে না আর। দাগ পড়ে যাবে।”

“আমার দেওয়া আরও কত দাগই পড়বে তোর শরীরে।”

নিরা হাল্কা করে থাপ্পড় মারলো ওর গালে। নাবিল মুখ সরিয়ে হাসল নির্লজ্জের মতো। নিরার হাত দু’টো নিজের ঘাড়ে রেখে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে দুই হাত দিয়ে। দৃষ্টি বিনিময় করে আবেদনময় চোখে। চোখ বুজে উন্মাদের মতো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে, “আই লাভ ইউ!”

নিরা তোতাপাখির মতো হেসে অনাকাঙ্খিত জবাব দেয়, “আই হেইট ইউ।”

এবারও হাসে নাবিল। ফু দিয়ে সামনের চুলগুলো উড়িয়ে দিতে দিতে বলে, “এমন মধুর করে ঘৃণা করতে জানলে, করার অনুমতি আছে। আজন্ম তোর ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকার সৌভাগ্য হোক আমার। স্টিল আই উইল লাভ ইউ।”

কথাটা কেমন করে যেনো বেহালার মধুর সুরের মতো ঠেকলো নিরার কানে। সদা স্বল্পভাষী মেয়েটাও এই প্রাণখোলা ধরনের মানুষটার সামনে এলে কেমন মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে যায়৷ দূরন্ত এক কিশোরী হয় তার নিরব রমণী মন৷ চারিপাশ থেকে তখন ভেসে বেরায় অদ্ভুত এক অল্পবয়সী প্রেমের মতো নরম সুর, কোমল সুভাস। নিরা মোহগ্রস্ত হয়, ধ্যান হারায়। আবার ফিরে আসে ওই নেশাধরানো অপলক চোখে। এই চোখজোড়া ভীষণ মায়া করে তাকায় নিরার পানে। ভীষণ আদর করে কথা বলে ঠোঁটজোড়াও। কত মোহতা! কত আনন্দ মানুষটার নৈকট্যে! তাবত পৃথিবীর সকল মুগ্ধতা দেখতে পায় নিরা এই গভীর চোখের সুপুরুষের আশ্রয়ে!

গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ২৫
#নাজমুন_নাহার

সবুজ ঘাসের মতো ছাঁদের এককোণে বিস্তররুপে বিছিয়ে পড়ে আছে বর্ষার বাগানের বাহারি ফুলের থোকা থোকা পাপড়িগুলো। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে গাছের ডালে বসা ছোট্ট শহুরে চড়ুই পাখিটার।রাস্তার ধারে দূরে কোথাও নিয়নের টিমটিমে আলো ভাসমান। কেবলই অন্ধকার নামলো ধরণীতলে। আকাশে চাঁদ উঠেছে মস্ত বড়ো। মেঘহীন আকাশ হতে থেকে থেকেই গলে পড়ছে চাঁদের নৈসর্গিক আলো। বর্ষাকালে সচরাচর মেঘহীন রাতের আকাশের দেখা মেলে না। ব্যাপারটা বিরল। জানালার ফাঁক হয়ে জ্বলজ্বল করছে অদ্ভুত সুন্দর আলোক রশ্মি।

কোনো এক অজানা কারণবসত নাবিল বাড়িতে ঢোকার কিছু মূহুর্ত পরই কিছুদিন আগের ঘটে যাওয়া সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটির কথা দাদুকে, বড়মাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করলো। উদ্দেশ্যটা অবশ্য বর্ষাই৷ মেয়েটাকে সবকিছু পরিস্কারভাবে জানানো দরকার। নিজের অবস্থানের স্বচ্ছতা রাখা দরকার। এই এক পিছুটানের জন্য নয়তো সে বিভ্রান্ত হবে বারবার। দোটানায় আর আগাতে পারবে না সামনে। এসব এতো তাড়াতাড়ি জানানোর ইচ্ছে ছিলোনা নাবিলের। তবে ভাইয়ের কাছ থেকে তার পছন্দের মানুষের কথাটা জানবার পর থেকে নিজের ভেতর আর উত্তেজনা দমিয়ে রাখতে পারেনি সে। নিলয় তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর মধ্যে একজন। বর্ষার সঙ্গে শৈশব, যৌবন দেখা না হলেও মেয়েটার জন্য আলাদা একটা টান অনুভব করে নাবিল। ভীষণ মায়া হয় ওর জন্য। এই দু’টো মানুষ নিজেদের জীবনের একটা পূর্ণতা পাবে এটা ভেবেই তো বুকটা অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে উঠে। সবটা জানাতে পেরে বর্ষার জন্য ভেতরে পুড়তে থাকা একটা দিকের আগুন এই বুঝি নিভলো বলে৷ বর্ষার প্রতিক্রিয়া অতো জটিল ছিল না। নাবিল ওর চোখ পড়েছে। মেয়েটা স্বাভাবিক আছে। মুখে প্রকাশ না করলেও কেবল একজন মানুষই ওদের বিয়ের খবরটা শুনে অসন্তুষ্ট। বড়মা। হয়তো মনে মনে তিনি নাবিলকে বর্ষার সঙ্গেই কল্পনা করেছিলেন, ওর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আশা বেঁধেছিলেন নিজের মেয়েরুপী বর্ষাকে নিয়ে।

বন্ধুত্বের দায়বদ্ধতা থেকে রাতবিরেতে নিলয়ের ডাককে প্রত্যাখান করতে পারেনি বর্ষা। অবশ্য নিজেও আসতে চেয়েছে। নিলয়ের তাকে আর জ্যোৎস্নাকে নিয়ে আড্ডা দেওয়ার খায়েশ মেটাতে।

বর্ষা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আড়ালে চাইলো পাশে থাকা প্রশস্ত পুরুষ অব্যয়টির দিকে। লম্বা শ্যামবর্নের সুঠাম দেহের অধিকারী এই নির্বিক মানুষটার জন্য ইদানীং একটু বেশি অস্বস্তি, আরক্ত ধরনের অনুভুতি উঁকিঝুঁকি মারে মনের এককোণে। আজকের ব্যাপরাটা তাই নেহাতই বিস্ময়কর লেগেছে। লোকটা যে সত্যি সত্যি বাড়ি পর্যন্ত আসতে সক্ষম হবে, ভাবেনি সে। রীতিমতো জলজ্যান্ত নিলয়কে সামনে দেখে লজ্জায় কেঁপেছে মেয়েটা।

নিলয় কাতায় ওর পানে। চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে বলে,

“অস্বস্তি কাটিয়ে আজকে আদতেও কথা বলতে পারবো তো আমরা? তোমার অবস্থা দেখে আমার কিন্তু অসম্ভব হাসি পাচ্ছে। নিজেকে অপরাধীও লাগছে।”

বর্ষা ধ্যান ভাঙ্গিয়ে চায় আরক্তভাব লুকিয়ে। হাসে স্মিত। মেয়েটা আবারও খানিক বিভ্রম হয়। অনেকটা লম্বা শ্বাস টেনে চলে যায় আরেক ভাবনায়। আচ্ছা, এতো বড় সত্যটা জানার পরও এতোটা স্বাভাবিক কী করে লাগতে পারে বর্ষার? নাবিল ভাই বিবাহিত। সে ভালোবেসে বিয়ে করেছে নিরাকে। ওরা এখন থেকে দম্পতি। এই তেতো সত্যটা জানার পরও বর্ষার উচাটন লাগছে না। ধ্বংস হচ্ছে না সে। ওদের দু’জনের চোখে দু’জনের জন্য অসম্ভব প্রেম দেখা যায়। বর্ষার চোখে কি দেখা যায় না তা? তার ভালোবাসাটা তবে কেমন ছিল? নিষ্ঠুর, নির্লিপ্ত? হবে হয়তো। এইযে, বর্ষা জানতো সে নাবিলকে ভালোবাসে? তবে তার পাশে অন্য নারীকে বৈধ রুপে দেখার পরও কেন বুকের ভেতরটায় তোলপাড় হচ্ছে না? কেন রক্তশূণ্য হলো না আজ? স্নায়ুদের মরন হওয়ার কথা ছিল তো। হওয়াও উচিত। এমন হিংস্র সত্য জানার পর তার তো বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কথা ছিল। কথা ছিল বুকের মধ্যে সুউচ্চ কয়েকশো ইমারত ধ্বসে পড়ার। বুকের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। কই, কিছুই তো হলো না? কেন হলো না? কাউকে ভালোবাসলে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যেতে হয়। তবে সে কেন স্থির রইলো এখনও? কীসের বলে? তবে কি সে আবেগহীন? তার ভালোবাসায় কোনো স্বচ্ছতা ছিল না? যেমনটা আছে নিরার ভালোবাসায়? যে টানে নাবিল ভাই সেদিন ওকে প্রত্যাখ্যান করেছিল!

নিলয়ের দৃষ্টি আকর্ষণসূচক কাশিতে সম্বিত ফিরল বর্ষার। একধ্যানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অপ্রস্তুত হয়ে মেয়েটা বলে,

“আপনি আসলেই মাঝে মধ্যে ভীষণ অদ্ভুতভাবে চমকে দেন আমাকে। পরিচয়ের শুরু থেকেই এই অবস্থা। এই বাসে হুট করে চলে আসছেন, তো এই ভার্সিটির সামনে। আজ যে আসবেন, আগে কেন জানালেন না?”

নিলয় হাসল মাথা নুয়িয়ে। মেয়েটা আসলেই অবাক হয়েছে বেশ।

“জানালাম তো।”

“এরকম জানানো তো রোজই জানান। আপনি খুব খারাপ একটা লোক। সত্যি সত্যি আসবেন জানলে বড়মা একটু প্রিপারেশন নিতে পারতো।”

“বড়মা প্রিপারেশন নিতে পারতো না-কি তুমি? বিপদে ফেললাম না তো?”

“ধুর! সব সময় ফাজলামো নয়। আপনি কাজটা আসলেই খারাপ করেছেন।”

“ডোন্ট ওয়ারি, খোঁটা দিবো না। ওতো পোলাও, কোরমা খাওয়াতে হবে না। ডিম ভাজিতেই রাজী।”

ওর রসিকতা ধরতে পেরে হাসল বর্ষা। কী ভেবে হঠাৎ শুধায়, “নাবিল ভাইয়ার বিয়েটা আমার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগছে। ওরা তো বিয়ে করবে না বলেই বিয়ে থেকে পালিয়েছিল সেদিন। তাহলে?”

গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে কৌতুক করে হাসে নিলয়। বলে, “এদের কথা আর বলো না। এরা দু’টো হচ্ছে জলজ্যান্ত সার্কাস। যখন যেটা যেভাবে করতে মন চাইবে, সেভাবেই করে।”

“মানে?”

“মানেটা আপাতত বাদ দাও। এইটুকু জেনে রাখো, এদের লাইলি-মজনু ধরনের পীরিত থেকেই ঘটনা বিয়ে পর্যন্ত গরিয়েছে। কয়েকদিনের প্রেম, তবে একেবারে খাঁটি।”

এ পর্যায়ে দু’জনেই হেসে দেয়। ভেতরে ভেতরে কিছু হিংসে অবশ্য হচ্ছিলো বর্ষার। তবে সেটাও অতি সামান্য। বুকে জ্বলে যাওয়ার মতো না।
মাঘের শুপ্ত বিকেলের মতো বেশ কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। এই নীরবতা ভেঙ্গে হুট করেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন করে বসে নিলয়। রীতিমতো ঘাবড়ে দেওয়ার মতো প্রশ্ন।

“বিয়ে নিয়ে কী প্ল্যান তোমার?”

বর্ষা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে তাকায়। নিলয়ের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক।

“প্ল্যান বলতে?”

হাসে নিলয়। “এইযে, কবে বিয়ে করবে, কার সাথে করবে? বাসা থেকে এই বিষয়ে কোনো প্রেশার পাও কি-না?”

নীরবে শ্বাস ফেলল বর্ষা। দৃষ্টি দুরে রেখে বলে, “বাবা-র এক বন্ধুর ছেলেকে নিয়ে বাসায় বেশ কিছুদিন ধরে কথা বলতে শুনছি৷ যদিও আমার এসবে কান দেওয়ার দরকার নেই। ওরা আমার অমতে আগাবে বলে মনে হয় না।”

“তো তোমার মতটা কী?”

হুট করেই একটা মৃদু হাওয়া এসে লাগলো মুখে। কী বিষন্ন এক হাওয়া। সেই হাওয়ার সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বর্ষা জবাব দেয়, “আপাতত একাই থাকতে চাই। সময় দরকার আমার। ওই লোক না-কি বিয়ে করে কানাডায় নিয়ে যাবে আমাকে। চেনা নেই, জানা নেই একটা মানুষকে হুট করে বিয়ে করেই দেশ ছেড়ে দেবো? ব্যাপারটা অদ্ভুত না?”

মাথা ঝাঁকায় নিলয়। শুধায়, “তোমার বাবা-র কি কানাডিয়ান ছেলে খুব পছন্দ? আই মিন, মেয়ের জামাই হিসেবে?”

বর্ষা শান্ত চোখে চায় একপলক। কী যেনো একটা খুঁজে পায় নিলয়ের কথার গোপনে। লোকটার আবেদনময়ী শব্দগুলো কিছু একটার ইঙ্গিত দিচ্ছে। খুব সুক্ষ কিছু একটার। মেয়েটা চোখ নামায়। কোনো এক অজানা অনুভুতির জোরেই কিছুটা ভীত হয়, আরক্ত হয় সে। সর্বাঙ্গে অদ্ভুত ভয় ভয় অস্বস্তি জন্মায়।

——

দাদাভাইয়ের ঘরের আটপৌরে কাঠের বড় দোলনাটায় হাত-পা ছড়িয়ে দায়সারা ভঙ্গিতে আধশোয়া হয়ে বসে আছে নাবিল। শুয়ে থেকেও শরীর স্থির থাকছে না তার। মুখ চলছে একটা স্ট্রবেরি ফ্লেভারের চুইংগামের সাথে। সাগরের ক্রিকেট বলটা হাতে। আপাতত এটাই তার বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। দাদাজানের জ্ঞানসভায় বিশেষ কান দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না। মনোযোগ দেওয়ার মতো ভদ্দরলোকও সে নয়। তবুও একপলক চাইলো মহা অলস ভঙ্গিতে ওদের পানে। নিরার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন শ্রদ্ধেয় দাদামশাই। নাতবউয়ের সাথে রাজ্যের আলাপ জুড়েছেন তিনি। হেসে কতো কতো অতীতের গল্প শোনাচ্ছেন। দাদীর গল্প, ষাট বছরের সংসারের গল্প, নবীন থেকে প্রবীণ হওয়ার প্রমোশনের গল্প, আরও কতো কী। নাবিল হতাশ শ্বাস ফেলে আপন কাজে মত্ত হয় ফের সে। বলটাকে চোখের সম্মুখে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর প্রস্তুত হলো সেটা দেয়ালে মারতে। শক্ত দেয়ালে আঘাত লেগে বার-বার সেটা তারই কাছে ফিরে আসছে আবার। এমনই চলছে শেষ একঘন্টা ধরে। দাদাজানের সামনে ওর এহেম বালকসুলভ খাপছাড়া আচরণে বিরক্ত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে চোখ রাঙিয়ে তাকাচ্ছে নিরা। কিন্তু এই ছেলে সেসবে পরোয়া করলে তো? ইশতিয়াক এহসান হাসলেন ঠোঁট টিপে নাতি আর নাতবউয়ের গোপন খুনসুটি ধরনের যুদ্ধ দেখে। নীতিটা তার ছোটবেলা থেকেই ভয়ংকর দস্যি ধরনের। নীরবতা তার চোখের দুশমন। আজন্ম চঞ্চলতাকেই আগলে ধরেছে ছেলেটা৷ ভয়ংকর অস্থির প্রকৃতির হলেও কোনো এক অলীক কারণে, এই ছেলেকে সকলেই ছোট থেকে অসম্ভব স্নেহ করে। অগোছালো, স্বাধীন চলাফেরার এই পাজি নাবিলকে খুব অদৃশ্য কারণবসত কেউই এড়িয়ে যেতে পারে না। ইশতিয়াক এহসানও সেদিন পারেনি৷ ভেতরের শক্ত ক্ষোভের প্রাচীরটা সেদিনই ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। জন্মের দিন নাতিটার মুখ দেখে গম্ভীর মানুষটাও হার মেনেছিলেন ছেলের কাছে। ততদিনে ছেলে তার নিজের জীবন,সংসার নিজেই গুছিয়ে নিয়েছে। আর ফেরার প্রয়োজনবোধ করলো না।

আলাপচারিতায়র এক পর্যায়ে আলমারি থেকে একটা ছোট্ট কাঠের অলঙ্কারের বাক্স বের করলেন তিনি। পরের দৃশ্য প্রত্যাশিত। বাক্সের রহস্য উন্মোচন হওয়ার আগেই নাবিল তীক্ষ্ণ চোখে একপলক পেলব মুখের মেয়েটির পানে চেয়ে শান্ত স্বরে দাদার উদ্দেশ্যে বলে, “দাদীর জন্য তোমার মায়া-দয়া কম তা-ই তার অতি মূল্যবান শেষ স্মৃতিগুলো তুমি আরেকজনকে দিয়ে দিতে দু’বার ভাবছো না, তা আমি জানি। তোমার ভালোবাসা একেবারেই নেই তোমার বউয়ের প্রতি। আমি কিন্তু আবার এতো দিলদরিয়া লোক না। ভেবেচিন্তে দিবে। কারণ এইসব জিনিস প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে বেরানোর মতো মহামানব হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। এই প্রাচীন ন্যাকামির ধারেকাছেও আমি নেই। আমার বউয়ের জিনিস আমি আর কাউকে দিচ্ছি না। এসবের মালিকানা শুধু তারই। দেখা গেলো, বৃদ্ধ বয়সে টাকাপয়সা কমে আসলে তখন ছেলে-মেয়েদের উপর নির্ভর হয়ে থাকতে হচ্ছে। সব তাদের দিয়ে নিঃস্ব হয়ে আমার বউকে আমি পরনির্ভরশীল করে রাখতে চাই না। তারচেয়ে বরং এসব বিক্রি করে শেষ বয়সে দু’জন মিলে মালদ্বীপ একটু ঘুরে আসবো। বৃদ্ধ বয়সে হানিমুন। সেটাই কাজের কাজ হবে। অন্তত জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা রইলো না। যেমনটা তোমার আর দাদীর ছিল। আজন্ম সন্তান আর সংসার নিয়ে পড়ে থাকলে হয় না। নিজেরও একটা অস্থির কোয়ালিটি লাইফ থাকা চাই, দাদু।”

নিরা ফের চাইলো চোখ রাঙিয়ে৷ ছেলেটার লাগামহীন কথাবার্তার মাত্রা ছাড়াচ্ছে দিন দিন। ইশতিয়াক এহসান হাসলেন মিটিমিটি। নাতবউয়ের হাতে স্বর্নের বালা দু’টো পরিয়ে দিতে দিতে বলেন, “তোর শাশুড়ীর পরার কথা ছিল এই অবশিষ্ট বালা জোড়া। নাবিলের দাদী তার জন্যই রেখেছিল। তার সৌভাগ্য হয়নি, তাই তোকে বঞ্চিত করলাম না।”

পরক্ষণেই আবারও হাত বুলালেন মাথায় কেমন মায়া করে। এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন করে বললেন, “তোর বাপকে নিয়ে ভয় পাইস না বোইন। জয়নাল মানুষটা অতো খারাপ না।আর দাদু বাঁইচা থাকতে এমনিতেও তোদের কেউ আলাদা করতে পারবে না৷ আর বেশিদিন পরের বাইত থাকনের কাম নাই৷ দেখি আমি, কী করন যায়।”

নাবিল শান্ত চোখে চাইলো৷ হাই তুললো মৃদুমন্দ হেসে। আরচোখে নিরাও চায় একপলক। দু’জনের চারজোড়া গভীর চোখে অল্পস্বল্প লাজুকতা আর পূর্নতার আনন্দ।

নিরা নিজের কোমল হাতে উনার চোখ মুছিয়ে দিলো। হেসে বলল, “আপনি এখন থেকে আমাদের সাথে ঢাকায় থাকবেন, দাদু? এখানে আর থাকতে হবে না। অনেক থেকেছেন বড় দুই ছেলের ছায়ায়। আমরা আর থাকতে দিচ্ছি না আপনাকে। আপনার শাসন, স্নেহ থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন না আর। বাকিটা জীবন ছোট ছেলের বাড়িতে কাটাতে হবে। শেষ বয়সে আপনার সেবাযত্ন না করতে পারলে আমরা বেঁচে থেকেও স্বস্তি পাবো না। না করবেন না দয়া করে।”

হাসলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“তোর শশুর দেশে ফিরে নিজে থেকে যতদিন না নিয়ে যেতে চায়, আমি কোথাও যাচ্ছি না।”

দাদুর অভিমান ধরতে পারে নাবিল। বলল না কিছুই। বাবা-ছেলের এই গোপন মান-অভিমান নতুন নয়। দু’জন দু’জনকে অসম্ভব ভালোবাসে, মনে করে। তবে প্রতিবার বাবা-র জেদের কাছে হেরে যায় তার সহজ- সরল দাদুটা।

উঠে দাঁড়ায় সে। নিরার দিকে আড়ালে একপলক চেয়ে নাবিল হাই তুলে অলস ভঙ্গিতে। দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে হাওয়ায় বলে, “ঘুম পেয়েছে আমার। গেলাম।”

পাজি ছেলের ইশারা ধরতে পেরে নিরার অসম্ভব রাগ হলো। বেহেলাজ লোক! এমন একটা ভাব ধরছে যেনো সবসময় বউকে নিয়ে একই রুমে থেকে অভ্যস্ত সে। আজ নতুন করে অনিয়ম হচ্ছে। স্বাভাবিক সম্পর্কের মতো অধিকার খুব। মেয়েটা কন্ঠে আগুন ঝেরে বলল, “ঘুম পেলে ঘুমাও। আমি বর্ষার সাথে ঘুমাচ্ছি।”

নাবিল থম মেরে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চায় হতাশা নিয়ে। একপলক দাদুর দিকে চেয়ে আবার নিরার দিকে কঠিন দৃষ্টি ফেলে থমথমে গলায় বলে, “আমার ব্লাক শার্টটা আয়রন করে দিয়ে যা। এক্ষুণি।”

হুকুম দেখো ছেলের। নিরা না চেয়েই নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দেয়, “এই মুহূর্ত ওটা আয়রন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। যখন লাগবে, করে দিবো। পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। এখন না করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে না।”

দৃঢ় বালকসুলভ রাগ-অভিমান মুখে তার। নিরা সেদিকে চাওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না। প্রেয়সীর এহেম নিষ্ঠুর অবহেলায় ভেতরটা দবদব করে জ্বলছে নাবিলের। ক্ষোভের পাহাড় জমেছে মস্তিষ্কে। বাঁকা চোখে শেষ বারের মতো চেয়ে গম্ভীর মুখে প্রস্থান নিলো দাদুর ঘর থেকে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তুমুল বৃষ্টি। পরিস্কার জ্যোৎস্নার আকাশ ভেঙ্গে হুট করেই মাঝ রাত্তিরে নামলো বর্ষণ। অঝোর প্রকৃতি ভারী করা বৃষ্টির সাথে গগন কাঁপানো বাজ পড়ার শব্দ। ধুপধাপ আওয়াজে ঘুমের ঘোরেই খানিক নড়েচড়ে উঠল নাবিল। গায়ের উপর কাঁথার উষ্ণতা অনুভব হতেই চোখ মেলে পিটপিট করে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার দরুণ ঘরের টিমটিমে ড্রিমলাইটটারও আলো নেই৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারেও কাঁচের জানালা ভেদ করে খানিক পরপর আকাশের যে ঝলকানো আলো পড়ছে, তা দিয়েই আবিষ্কার করা গেলো একটা পেলব মুখের রমণীর উপস্থিতি। বারান্দার দরজা মেলে তাতে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অলস ভঙ্গিতে মেয়েটা। শোঁশোঁ করে বইছে এলোমেলো দিকের হাড়কাঁপানো বাতাস। নাবিল অবাক হলো না, উঠে বসলোও না৷ ওভাবেই চেয়ে রইলো সেদিকে। অদ্ভুত এক বিষন্ন ভঙ্গি মেয়েটার দাঁড়ানোর। অকস্মাৎ ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু হয়। বৃষ্টির পানির ঝটকা এসে ঢুকছে ঘরে। নিরা যত্রতত্র দরজা লাগিয়ে দেয়। ফিরে আসে রুমে। নাবিল ওর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে ফের৷ নিরা খাটের কার্নিশে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে ওর পাশে। চুলে হাত বুলিয়ে আলতো করে হুট করেই চুমু খায় অভিমানী নাবিলের কপালে। ভেতরে ভেতরে হাসল ছেলেটা। বাপের মতো শুধু বাইরে থেকেই যত জেদ মেয়েটার। তবে একটা ছোট্ট চুমুতে তার সর্বাঙ্গ এলোমেলো, ভেতরটা তোলপাড় করে দিলেও চোখ বুঁজে অনড় রয় পূর্বের ন্যায়। অটুট রাখে আপন অভিমান। নিরা গুটিশুটি হয়ে ওর পাশে শুলো। নাবিলের হাতটা টেনে নিজের কোমরে রাখলো নিজেই। অসংযমবসত হাত দু’টো শক্ত হয়ে এলো নাবিলের। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি চোখ মেলে জোরেশোরে একটা চুমু খেয়ে মেয়েটার সব ক্রোধে পানি ঢেলে দিতে। এতো ভদ্রতা, নিয়মানুবর্তিতা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না৷ নয়তো ঠাটিয়ে দু’টো মেরে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ” একলা ঘুমিয়ে বিরহ করার জন্য তোকে বিয়ে করেছি, বেয়াদব?” কিন্তু বলল না। দমিয়ে রাখলো নিজেকে,নিজের অভিমানকে।

“তুমি কি বাচ্চা, নাবিল ভাই?”

কী ধূর্ত! ফাজিলটা ঠিকি ধরে ফেলেছে ঘুমিয়ে থাকার চোরা অভিনয়টা। নাবিল তবুও জবাব দিলো না। নিরা ফের বলে, “জেগে আছো সেটা জানি। খামোখা ঘুমিয়ে থাকার ভান ধরবে না আমার সামনে। আমাকে পাশে দেখতে না পেলে বর্ষা খোঁজ করতে চলে আসবে। বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। উঠো।”

নাবিল দৃষ্টি মেলে চাইলো গাল ফুলিয়ে। চোখে-মুখে সে কী ক্ষোভ তার। চোখ খুলেই আচমকা কিছু না বলেই হামলে পড়ল নিরার বুকে। সজোড়ে প্রচন্ড ক্রোধের সাথে কামড় বসিয়ে দিলো নিরার ঘাড়ে। মেয়েটা ওর কোমল অভিমান ধরতে পেরে হাসে আর বাঁধা দেয় না। ব্যথা পেলেও তা দমিয়ে রাখলো। দীর্ঘসময় ধরে সেই অভিমানী দাঁত বসিয়ে রেখে মেয়েটার নরম শরীরে দাগ করে তবেই ছাড়ল নাবিল। নিরা হতাশ শ্বাস ফেলে ব্যথাতুর জায়গাটায় হাত রেখে স্বাভাবিক স্বরে শুধায়, “কমেছে জেদ?”

শান্ত চোখে চায় নাবিল। সেই ছলছল দৃষ্টিতে কতো চাওয়া, কতো আকাঙ্ক্ষা, কতোই না কাতরতা! সে নীরবে মাথা দোলায় দু’দিকে। নিরা হাসে মৃদু। শান্তনাবানীর মতো করে বলে, “বিয়েটা সকলের অমতে করলে-ও সংসারটা শুরু করার আগে পুরো ঝামেলাটা মিটমাট করা দরকার। আমি জানি আমরা বৈধ, তা-ও প্লিজ আরেকটু অপেক্ষা করো। এখনও ব্যাপারগুলো ভীষণ ঘোলাটে। এই মুহূর্ত বাবাকে বিষয়টা জানানো মানে বড়ো ধরনের বোকামি। আমরা তো আছি একসাথে, তাই না? বিয়েটা তো হয়েছে আমাদের। এখন চাইলেই জোড়াকে ভাঙা যাবে না। দূরে সরানো যাবে না আমাদের। ব্যাপারটা ওদের জন্য জটিল। শুনছো তুমি? এদিকে তাকাও।”

নাবিল চাইলো বিষন্ন চোখে। লালিত্য ঠোঁটে তখনও ভীষণ অভিমান লেপ্টানো। নিরা ওর শক্তপোক্ত হাতটা টেনে নিজের বুকের কাছে আনে। নরম হয়ে বলে,

” চিন্তা করো না,সব ঠিক হয়ে যাবে খুব শীগ্রই।”

“আর কতো শীগ্রই? তুই বুঝতে পারছিস না। আমি মরে যাচ্ছি তোকে ছাড়া,নিরা!”

মৃদু আওয়াজ করে হেসে ফেলল নিরা। একটু চেয়ে চোখ বুঁজে আবারও হাসে। ওর গালে হাত বুলিয়ে বলে, “তুমি আর কতো অত্যাচার করবে আমাকে,নাবিল ভাই? কী-ই বা বয়স আমার? এই অল্প বয়সেই তোমার বালকসুলভ দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে জীবনটা প্রবীণ করে ফেলছি। কোথায় যাবো আমি এই ছেলেকে নিয়ে! এই বাচ্চা ছেলেটাকে কী করে বিয়ে করে ফেললাম সেটাও ভেবে পাই না আমি। কী হবে আমার মাবুদ! অসম্ভব জ্বালায় এই ছেলে আমাকে।”

ধীরে ধীরে অভিমান মুছে হাসির রেখা ফুটে উঠে নাবিলের লালিত্য ঠোঁটে। অবুঝ কন্ঠে ম্যাকি রাগ ঝেরে বলে, “তুই একটা নিকৃষ্ট বউ।”

“ঠিক আছে। আমি একটা নিকৃষ্ট বউ। নাবিল এহসানের নিকৃষ্ট বউ আমি।”

নাবিল কোমরে হাত বুলিয়ে বলে,

“অভিশাপ দিলাম, তোর একসাথে ছয়টা বাচ্চা হবে। এদের যন্ত্রনায় তুই অতিষ্ঠ হয়ে যাবি। পোকার মতো কিলবিল করবে তোর জীবনে ওরা। আমাকে শাস্তি দেওয়ার শোধবোধ মোটেও ভালো হতে যাচ্ছে না।”

বিদ্যুৎ ফিরে এসেছে। ড্রিম লাইটের আলো পড়েছে ঘরে। আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শব্দ করে হেসে ফেলল নিরা। বলল, “মাত্র ছয়টা? ব্যাপারটা তবে আসলেই খুব হতাশাজনক! ছয়টা বাচ্চা দিয়ে কী হবে? আমি তো চাই বারোটা হোক।”

নাবিল বোয়াল মাছের মতো লাফিয়ে উঠলো। দৃষ্টিতে বিস্ময়ভাব। “বারোটা সামলাতে পারবি বেডি তুই?”

নিরা ওর পুরুষালী বুকে নিজের মাথাকে ঠাই দেয়। তৃপ্তির শ্বাস ফেলে বলে,

“তুমি একাই তো বারোটার সমান। তোমাকে সামলাতে পারলে ওদেরকেও পারবো। আফ্টার অল, তোমারই রক্ত। এক্সপিরিয়েন্স আছে।”

নাবিল মাথা ঝাঁকায় অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে। চায় ছোট ছোট সন্দিহান চোখে। নিরা ওর চাওয়ার ধরন দেখে হাসে আবারও। কী নিষ্পাপ সেই চাহুনি! ছেলেটার পানে চাইলেই কেন যেনো নিরার বুক ভেঙ্গে আসে। ইচ্ছে করে খুব যত্ন করে বুকের মধ্যে জায়গা করে দিতে ওকে। সারাক্ষণ যত্ন চাই যত্ন চাই ভাব এই ছেলের। বেড়ালের স্বভাব।সর্বক্ষণ শুধু উষ্ণ আদরের অভিলাষ! নিরা মায়া করে হেসে চোখে-মুখে হাত রাখে ওর। প্রেয়সীর নরম স্পর্শের প্রশ্রয়ে চোখ বুঁজে নাবিল। নিরা বার-বার তাকায়। লোকটার ঝিলের মতো গভীর চোখজোড়ায় কী বিস্ময়কর মায়া ঢেলে দিয়েছেন বিধাতা নিজ হাতে। শরতের কাশফুলের মতো শুভ্র, স্বচ্ছ একটা মুখ। আহা! কতো পবিত্রতা ও মুখে, কতো আহ্লাদ, কতো নিষ্পাপভাব! এই একটা চেহারায় তাকালে পৃথিবীর সকল ক্লান্তিভাব এক নিমিষেই গুচে যাওয়া সম্ভব। সম্ভব শরীরের প্রতিটা নিউরনের সচল হওয়া। সে একটা জাদু! তার উপস্থিতি জাদু, তার কথা জাদু, তার সংস্পর্শ জাদু। বুকে নিযুত মোহতা ভরে রাখা জাদুর পুরুষ নিরার এই নাবালক মনের পুরুষটা! যে হাসলে হাসে পাহাড়, সমুদ্র, ঝর্না। অভিমান করলে ভেঙ্গে আসে সুবিশালদেহী আকাশও। তার লালিত্য আবেদনময় ঠোঁটে যেনো সবই মানায়। সব!

[রিচেক করা হয়নি। সময় পাইনি।]
চলবে