রোদ পোহাবার ছুতোয় পর্ব-২৬

0
10

গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ২৬
#নাজমুন_নাহার

কেবলই ভোরের প্রহর নামলো চরাচরে। কাক ডাকা নবদিগন্তে স্বচ্ছ আকাশের মোলায়েম আলো ছুঁলো এহসান মঞ্জিলের চৌকাঠ। কোমল উজ্জ্বলতা পড়ল নাবিলের জন্য বরাদ্দ ঘরের সফেদ চাদরে। দক্ষিণা বাতাসে জানালার ধবধবে সাদা পর্দাটাও মৃদুমন্দ নড়ছে। বাইরের আলোটা চোখ ঝাঁঝানো রোদের মতো তপ্ত, কিংবা খুব বিরক্তিকর টিমটিমে না। ঝলসানো অহমিকাবিহীন ছায়াময় একটা মিষ্টি মিষ্টি সকাল। মায়ের আঁচলের মতো স্নিগ্ধ উমের প্রলেপ সে ছায়ায়। কিছুটা শীতল আর নরম ছোঁয়া তাতে। সেই নরম আলোর ডাকাডাকি উপেক্ষা করে দাদীর স্নেহের হাতের নকশা করা কাঁথাটা গলা পর্যন্ত উঠায় নাবিল। ফের মৃদু আহ্লাদ করে নড়েচড়ে আবারও ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। কিছুক্ষণ পর এপাশ ফেরে আবার। সঙ্গিনীর মতো করে বুকে জড়িয়ে ধরে পলিয়েস্টার ফাইবারে তৈরি নরম তুলতুলে সাদা কোলবালিশটাকে। উসকোখুসকো চুলগুলো কপাল অব্ধি লেপ্টে আছে পরম অবলিলায়। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় আজকের ঘুমটা ভীষণ উষ্ণ উষ্ণ হয়েছে তার। কিন্তু এই প্রলম্বিত ঘুমকে বাগরা দিতে কিছু একটা শেষ পাঁচ মিনিট ধরে বিরক্ত করছে তাকে। কানে ফোনের ঘেনঘেনানি রিংটোনের শব্দ আসছে তখন থেকে। অসহ্য আওয়াজ। নাবিল সেটা স্বপ্ন আর ভ্রম ভেবে উপেক্ষা করলো পুরোপুরি। এই মধুর ঘুম কিছুতেই ভাঙানো যাবে না। নো। মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ তুলে অবেহলার শ্বাস ফেলে এড়িয়ে গেলো তা। যেমনটা আমরা উপেক্ষা করে থাকি প্রাইমারি স্কুলে সকাল আটটায় মা নামক এলার্মটাকে। তারপরের দৃশ্য অপ্রত্যাশিত। এলোপাতাড়ি ধাক্কাধাক্কি আর ডাকাডাকির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধুপধাপ আওয়াজ। কড়া নিরাপত্তায় থাকা বাড়িটায় ডাকাত পড়ল, না-কি চোর? ভাংচুর ধরনের বিদঘুটে শব্দ থামাথামির নামই নিচ্ছে না। রীতিমতো ভূমিকম্পের মতো হৃদয় কাঁপানো ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো তার ঘুমন্ত শরীরটা। উত্তেজনায় এক লাফে উঠে বসলো। হতবিহ্বল হওয়ার মতো ঘটনা। পরিস্থিতি বুঝতে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো দরজার পানে। ধ্যান ভাঙেনি তখনও। তবে বাহিরের অবস্থা বেগতিক। আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে দরজা ভেঙে চৌচির হতে বেশিক্ষণ লাগবে না।

উঠে দরজা মেলতেই চার জোড়া থমথমে, আঁধার করা চোখের মালিকদের দেখে নিজের চোখ ছোট ছোট করে চাইলো নাবিল। নিরার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই আবিষ্কার করলো, মেয়েটার চোখ ছলছল করছে। আবেগঘন পানিতে টইটুম্বুর হয়ে আসা টানা টানা চোখ ভেঙে যেনো এক্ষুণি সমুদ্রের ঢেউ নেমে আসবে। স্বপ্ন বলে তা পুরোদমে উপেক্ষা করলো। অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে বলল, “খাইচ্চতের গাট্টি কোথাকার! স্বপ্নেও স্বস্তি দিবি না একরত্তি? বেহুদাই বেমলাচ্ছিস কেন? কী করেছি আমি?”

রাগে-চিন্তায় দবদব করছে নিরার চোখ। নাবিলের কথাগুলো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো। নাবিল সেসব পরোয়া না করে দুই হাত ছড়িয়ে বেয়াম করার ভঙ্গি করে পাশে তাকাতেই তাৎক্ষণিক দাবাং মার্কা একটা চর বসে গেলো বেচারার অপ্রস্তুত গালে। তখনও বিভ্রমে ছেলেটা৷ বিস্ময়ে চোখ চড়কগাছ। থতমত খেয়ে গেলো রীতিমতো। হচ্ছে টা কী? স্বপ্নের মধ্যে সামনে দাঁড়ানো এই দু’টোকে জ্বীনে ধরলো না তো? অবাস্তব জগতেও চরটা এতো শক্তপোক্তভাবে লাগলো কীভাবে? আশ্চর্য!

নাবিল মুখে বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে গাল ডলতে ডলতে বলে, “হুয়াটস রং উইদ ইউ, ব্রো? স্বপ্নে কেউ এতো জোরে চর মারে? ধুর বাল! ব্যথায় জান যাইতেসে উইড়া। বড় ভাই হয়ে কী কিডনি কিনে নিয়েছো? এই চরটা বাস্তবে আমার বউয়ের সামনে ভুলেও মাইরো না। সব বউদের কাছে স্বামীরা হয় শারুখ খান। তুমি এক সেকেন্ডে বানিয়ে দিলা আমাকে জায়েদ খান। হইলো কিছু?”

নিলয় ওর কথার প্রতুত্তর না করে ঘরে ঢুকে বিছানা হাতরে ফোনটা টেনে আনলো। মিসড কল লিস্ট বের করে ওর চোখ বরাবর ধরে শুধালো, “কয়টা ফোন দিলাম তোকে? নেশা করে ঘুমিয়েছিস নাকি হারামি? খালামনির ফোনটা পর্যন্ত তুলছিস না। আর এক মিনিট দেরি করলে তোকে জীবিত কবর দিতাম দরজা ভেঙে,কসম।”

নাবিল কোনোপ্রকার গুরুতর প্রতিক্রিয়া ছাড়া কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইলো দু’জনের পানে। বিভ্রান্তের মতো চোখ-কপাল কুঁচকে আবারও পুরোটা ঘরে চোখ বোলাতে বোলাতে বলে, “ইজ দ্যট রিয়াল? মানে আমি সত্যি সত্যি থাপ্পড়টা বাস্তবে খেলাম? হুয়াট দ্য…… এই ব্রিটিশ বউ, একটা চিমটি কাট আস্তে করে। সবকিছু কেমন চান্দির উপর দিয়ে যাচ্ছে। পিন্চ মি, ফাস্ট।”

নিলয় ফোঁসফোঁস করতে করতে চাইলো। চোখে রক্ত জমেছে রাগে৷ হতাশ শ্বাস ফেলে বলল, “রেডি হ, ঢাকায় ফিরছি এক্ষুণি।”

না, এতো যুক্তিসঙ্গত কথাবার্তা তো স্বপ্নে হয় না। স্বপ্নে হয় মাথাপাগল টাইপ আলাপ। স্বপ্নতে সচরাচর ঘটনার কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। উগান্ডা থেকে মঙ্গোলিয়া চলে যাওয়ার মতো অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনাই ঘটে।

ডিভানের উপর পড়ে থাকা অগোছালো শার্টটা গায়ে দিতে দিতে নাবিল পূনরায় ফিরে চায়। চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান হয়ে শুধায়, “কনটেক্সট কী?”

“কট খেয়েছিস।”

“সে তো রোজই খাই কোনো না কোনোভাবে। আজ এতো বিশেষ খাতির কেন?”

“আজকেরটা ভিন্ন। বিয়ের কাবিননামাসহ সাংঘাতিকভাবে কট।”

শেষের কথাটা বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল নিলয়। কথাটা শোনামাত্রই বৈদ্যুতিক ঝটকা খাওয়ার মতো করে চোখ বড় বড় করে নিরার পানে চাইলো নাবিল। বেচারী দীর্ঘ একখান চিন্তিত শ্বাস ফেলে মাথায় হাত দিয়ে খাটের এক কোণায় বসে পড়ল। মাথা কাজ করছে না। প্রেশারটা কমেছে টেনশনে।

“আর একটাও গাঁজাখুরি কথা না বলে জলদি রেডি হ। বাড়িতে ভূমিকম্প হচ্ছে। নিরার দোষ নেই। ওকে ধমকাবিনা। বেচারি সেইফজোনেই রেখেছিল কাগজটা। মামি ঘর গুছাতে গিয়ে কীভাবে কীভাবে হাতে পেয়েছে, কে জানে। এই মা জাতীদের নিয়ে বিপদের শেষ নেই। এদের সামনে-পেছনে মিলিয়ে সদা চারচোখ সচল থাকে।”

নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ পরিবেশে আগ বাড়িয়ে একটা কথা বলারও সাহস হলো না কারো। চিন্তায় রাহেলার প্রেশারটা বোধহয় বাড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছেন তিনি। আমিনা বেগম নির্বাক বসে রইলেন নিষ্প্রাণ একটা দেহের মতো। বোঝাই যাচ্ছে, মেয়ের এহেম অদ্ভুত কাজ তাকে বেশ চিন্তায় ফেলেছে।

“মামা, আসলে….

জয়নাল সিকদার হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন নিলয়কে। চোখেমুখে অসম্ভব শান্ত ক্রোধ। কাবিননামার সাক্ষীর সাক্ষরে নিলয়ের নাম দেখে এই ছেলেটার উপর আজ সবচেয়ে বেশি রাগ তার। তিনি অত্যন্ত গম্ভীর অথচ ক্ষীণ স্বরে বোনের পানে চেয়ে বললেন, “তোর ছেলের বউকে নিয়ে যা, রাহেলা। ওকে আমার চোখের সামনে থেকে সরা। অচেনা লাগছে এই মেয়েকে আমার।”

বাবা-র দুই পা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিরা তখনও কেঁদে চলেছে নিঃস্বর মতো। মেয়েটার চোখের পানি আজ একরত্তিও টনক নড়াতে পারছে না জয়নাল সিকদারের পাথুরে মনের। যে ব্যথা তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন, এই ব্যথার নিকট মেয়েটার সামান্য কান্না কিছুই না। পৃথিবীর মাটি থেকে সকল বিশ্বাস, আস্থা উঠে গেছে আজ। ছেলে না থাকা সত্বেও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি কখনোই অসন্তুষ্ট ছিলেন না। আদরের দুই মেয়েকে তিনি ছেলে না থাকার সেই অসন্তোষের জায়গাটাও দেখাননি কখোনও। নিজেদের বৃদ্ধ বয়স এড়িয়ে সর্বদা মেয়েদেরকে ভালো রাখার উদ্দেশ্যে দিবারাত্রি এক করেছেন, লোকের কথা শুনেছেন। তবুও দমে যাননি। অথচ আজ, এই কালদিনে এসে জানলেন, তার মেয়েদের তো এই অভাগা বাবা-র প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ওরা এখন বুঝদার।

নিরা আহত দেহটা নিয়ে পড়ে রইলো বাবা-র পায়ের কাছে। চোখের বর্ষা মুছে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা! তুমি তো চেয়েছিলে নাবিল ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হোক। তখন না হয়ে এখন হলো। প্লিজ মেনে নাও আমাদের, বাবা। মেরে ফেলো না-হয় আমাকে।”

মৃদু তাচ্ছিল্য করে হাসলেন জয়নাল সিকদার। রুষ্ট স্বরে বললেন, “জীবনটাকে কি কোনোভাবে সিনেমা ভেবে বসে আছিস রে, মা? তোরা যা করেছিস, সেসব শুনতেও হাস্যকর লাগছে৷ যার সাথে আমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিতে চেয়েছি তার সঙ্গেই বাড়ি ছাড়লি বিয়ে করবিনা বলে। ফিরে এসে তবে সেখানেই কেন যেতে চাইছিস? যদি এমন-ই করবি, তবে সেদিন কেন চলে গেলি? মাস না পেরোতে একই পাড়ে হোটচ খেলি তো কেন এতো নাটকীয়তা? তুই তো একবারও ভাবিসনি তোর বাপের কথা। আমার তো তোদের ছাড়া কেউ নেই। কেউ একজন তোদেরকে ছায়া দিয়ে আজন্ম আগলে রেখেছে, তার কথা তো তুই একটুও ভাবলি না। কীসের হেতুতে?”

নাবিলের আত্মবিশ্বাসে কোনো হেলদোল নেই। সে আজন্ম বেয়াড়া, বেপরোয়া। বিন্দুমাত্র ভয়ভয়, সংকোচ দেখা গেলো না তার প্রতিক্রিয়ায়। আশেপাশের সকল সংকটাপন্ন পরিস্থিতি উপেক্ষা করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে কেবল চেয়ে রয় ছলছল চোখের প্রেয়সীর পানে। নিরা দিগবিদিক ভুলে অঝোরে কেঁদেই চলেছে। চোখদুটো থেকে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার। ওকে এমন নিঃস্বর মতো কাঁদতে দেখে মোটেও ভালো লাগছে না নাবিলের। তড়তড় করে রাগ বাড়ছে তার। ইচ্ছে করছে ঠাস ঠাস করে দু’টো থাপ্পড় লাগাতে এমন কান্নার বদৌলতে। এভাবে মেঘনা,যমুনা এক করে কাঁদার কী হলো এই মেয়ের? কী সমস্যা ওর?

“মামা, যা হয়েছে তাতে আমাদের কারোরই হাত ছিল না। সবকিছুতে এতো জটিলতা যে আমি বোঝাতে চাইলেও আপনি হয়তো বুঝবেন না। বুঝলেও মেনে নিতে সমস্যা হবে। আমি নিরাকে ভালোবাসি। এই মুহূর্তে এর চেয়ে সহজ সত্য, ব্যাখ্যা আর হয় না। আমাদেরকে নিজেদের সংশোধন করার সুযোগ দিন। জানি পদ্ধতিটা ভুল ছিল, তবে কিছু করার ছিল না বিশ্বাস করুন। শাস্তিস্বরূপ আপনি যা বলবেন, তাই করবো।”

প্রতুত্তরে কেমন ক্লান্ত মুখে হাসলেন তিনি। চেহারায় লেপ্টে আছে অসম্ভব রকমের গাম্ভীর্যতা। তিনি মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন আলগা করে। মলিন স্বরে বললেন, “তোর উপর আমার অধিকার ফুরিয়েছে, মা। বাবা হওয়ার খাতিরে লালন-পালন করে বড় করেছি, ব্যস এতোটুকুই। এখন থেকে তুই মুক্ত। দায়মুক্ত হলাম আমি। বড়ো হয়েছিস তোরা দু বোন। নিজেদের ভালো-মন্দের হিসেব নিজেরাই করতে জানিস। বাবা-মায়ের প্রয়োজন থাকার কথা না এখন আর। যাও। তোরা যেখানে ইচ্ছে, যার সাথে ইচ্ছে চলে যা। তোর ছেলের বউকে নিয়ে যা রাহেলা।”

কারো হেলদোল দেখা গেলো না প্রতুত্তরে। পুরোপুরি গুমোট একটা পরিস্থিতি। জয়নাল সিকদার নিজের পা থেকে মেয়ের হাত সরিয়ে নিঃশব্দে প্রস্থান নিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “খুব বুঝদার হয়ে গিয়েছিস। আশা করছি ভবিষ্যতেও বাপ নামক মানুষটার প্রয়োজন আর পড়বে না।”

আহত বৃক্ষের মতো চেয়ে রইলো নিরা বাবা-র যাওয়ার পানে। কী নিষ্ঠুর পদচারণ বাবা-র! ঠেলে ঠেলে ক্ষণে ক্ষণেই ডুকরে কেঁদে উঠছে মেয়েটা। অনিচ্ছায় চোখ ভরে উঠছে শ্রাবণ মাসের দিঘির মতো। বাবা-র ভারী ভারী কথাগুলো নিরার ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে। অসম্ভব অনুশোচনায় শেষ হয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরন। রাহেলা বেগম স্নেহময় হাত রাখলেন ভাতিজীর মাথায়। নিরা সঙ্গে সঙ্গে বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ল ফুপ্পির। প্রবল মাতৃমায়া থাকা এই মানুষটার স্নেহে ভেতরের সকল দুঃখ বেয়ে বেয়ে পড়তে চাইলো। নাবিল কখন এসে পাশে দাঁড়ালো খেয়াল করলো না ওরা। সে নিরার হাতটা ছাড়িয়ে নিজের কাছে টানতে নিতেই রাহেলা বেগম বাঁধা দিলেন। মায়ের এহেম ব্যবহারে নাবিল হতবিহ্বল হয়ে চায়। রাহেলা ছেলের পানে চাইলেন করুন করে। দৃষ্টিতে ভীষণ অসহায়ভাব মায়ের। তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিক চোখে পূনরায় চাইলেন নিরার চোখে। কন্ঠে মলিনতা টেনে বললেন, “আমি জানি আমার ছেলেটাকে তুই অসম্ভব ভালোবাসিস। আমার ছেলেটাও তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আমি তো মা, চিনি আমার ছেলেকে। আমার পরে দুনিয়া তোলপাড় করা ভালোবাসা ও কেবল তোকেই বেসেছে। আমার ভাইয়ের ছোট্ট কন্যাটা তার প্রাণভ্রমরা যে। আমি আমার ছেলেকে কষ্ট পেতে যেমন দেখতে পারবো না, তেমন আমার ভাইয়ের মন ভেঙেও তোকে আমার ঘরে নিয়ে যেতে পারবো না। আমি মা হিসেবে কী চাই সেটা তোরা দু’জনই জানিস। তা-ই বলছি, যদি ভাইজানের ভুল ভাঙাতে সক্ষম হতে পারিস,তবেই তোকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আমার ছেলের জন্য তোকে নিয়ে যেতে আসবো। তার আগ পর্যন্ত এই গোপন বিচ্ছেদ সয়ে নে। সেটা যদি হয় আজীবনের জন্য, তাহলে সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা কর। কেবল একসাথে থাকতে পারাটাকেই থাকা বলে না। তোদেরকে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে।”

নাবিল বিরক্তিসূচক শব্দ করলো মুখে।

“আবোলতাবোল না বকে ওর জামাকাপড় রেডি করে দিতে বলো মামানিকে। বউ আমার, সিদ্ধান্ত আমার। তোমার ভাইয়ের কথায় হবে?”

এই প্রথম ছেলেটাকে বড্ড অচেনা লাগছে। স্বার্থপর লাগছে। ছেলের কথার প্রতুত্তর না করে নিরাকে শুধায়, “এর পরেও যদি তুই যেতে চাস, আমি আপত্তি করবো না। বল, কী চাস?”

নিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছল। শান্ত চোখের মানুষটার দৃষ্টি তখনও ওর পানে। সে দৃঢ় বিশ্বাসী,প্রেয়সী মহা দূর্যোগের দিনেও অতি আনন্দের সহিত তারই সঙ্গে থাকার অভিলাষ জানাবে। তবে প্রকৃতির বোধহয় তার এমন কাল্পনিক অহমিকা ভালো লাগলো না। মহাবিশ্বের এহেম তাচ্ছিল্য এড়িয়ে নাবিল চায় নিরার পানে। হাত বাড়ায় পরম আত্মপ্রত্যয় নিয়ে। নিরার চোখে চোখ রাখে। ফোলা ফোলা গভীর চোখে আজ কেবলই তীব্র অনুশোচনা দেখতে পায় নাবিল। নাবিল হাত ওভাবে রেখেই বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে। চল।”

“কিচ্ছু ঠিক হবে না, নাবিল ভাই। আব্বুকে আমি চিনি। সব দোষ আমার। আমার কারণে এসব হচ্ছে। আব্বুকে আমরা কখনোই খুশি করতে পারিনি। এই মানুষটা আমাদের জন্য কী না করেছে? আমাদের আরও ভাবা উচিত ছিল। অনেক বড় বোকামি করে ফেললাম, নাবিল ভাই।”

বলেই ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো আবারও। নাবিল চোখ বুঁজে বিষন্ন শ্বাস ফেলে। মেয়েটার চোখের পানি সহ্য হচ্ছে না তার।

“আমরা পরিস্থিতির স্বীকার। আর কোনো দোষ নেই তোর। আমি সামলে নেবো পরে সব। প্লিজ আমাকে হতাশ করিস না। এভাবে কাঁদবি না, নিরা। চল।”

নিরা মাথা নুয়িয়ে বলে, “আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। ভালোবাসো তো? পরিক্ষা দাও।”

“কীসের অপেক্ষা? কোনো অপেক্ষা লাগবে না আমার। তুই চুপচাপ চল আমার সাথে। স্বেচ্ছায় না গেলে কোলে উঠাতেও দু’বার ভাববো না।”

“যাবো না আমি। আব্বুকে এভাবে কাঁদিয়ে আমি ভালো থাকবো না ও বাড়িতে। প্লিজ!”

বলেই বিধ্বস্ত হয়ে বসে পড়ল খাটে। নাবিল অগ্নিচোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই মা’কে ইশারা করে ওদেরকে একটু সময় দিতে। ছেলের ইশারা ধরতে পেরে আপত্তি থাকার সত্বেও তিনি বাইরে যান। যায় নিলয়,আমিনাও।

নাবিল ধীরপায়ে পাশে বসে ওর। নিজের পুরুষালী হাতে চোখ মুছায় নিরার। মাথাটা বুকে ঠেকিয়ে বলে, “খারাপ সময়, মানুষের মন সবসময় এক থাকে না, পাখি। মামার এমন প্রতিক্রিয়া দেখানোটা অস্বাভাবিক না। তাই বলে আমরা দূরে সরে যাবো? আমরা নিজেদের কষ্ট দিবো? এদিকে তাকা, আমি আছি না? কীসের এতো ভয় তোর? সব একসাথে ঠিক করবো আমরা। আমাদের তো একসাথে থেকে বেঁচে থাকার কথা ছিল। বাবা-মা’রা কখনো সন্তানদের উপর রেগে বেশিদিন থাকতে পারে না। চল।”

নিরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়। যার অর্থ, সে যাবে না। নাবিল গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে হাত দিয়ে কপাল ঘষল।

“আমার রাগ বাড়ছে৷ আমাকে রাগাতে খুব ভালো লাগছে তোর?”

নিরা চায় আহত দৃষ্টিতে। হিচকি তুলে বলে, “আমি অপেক্ষা করবো।”

“কিন্তু আমি পারবো না।”

“দূরে থেকেও তো ভালোবাসা যায়।”

“দূরে থেকে যেভাবে ভালোবাসতে হয়, আমি সেই ভালোবাসার সিলেবাস শেষ করিনি। অপরিপক্ক প্রেম শিখেছি। ও ভালোবাসায় আমার পোষাবে না।”

নিরা কথা বাড়ায় না। শেষ বারের মতো অদ্ভুত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “প্রতিদিন যতবার নিশ্বাস ফেলবে, ততবারই যেনো শ্বাস-প্রশ্বাসের ওই হিসহিসে আওয়াজের সঙ্গে নিরা নামক রমণীর নামটা বেলীফুলের সুগন্ধির মতো ভেসে আসে৷ এভাবে মনে করো, ভালোবেসো। আমি তোমার এই গভীর মনে করাটুকু কিশোরী বয়সের নরম প্রেমের মতো করে হৃদয়ে পুষে রাখবো। অনুভব করে নেবো, কাছে আসার সময়ে কেউ দূরে থেকেও আমাকে ভালোবাসছে, ছায়া দিচ্ছে। কেউ তুমুল মন খারাপের রাতে উষ্ণ হাতের ছোঁয়া লাগিয়ে বলছে, এভাবেও ভালোবাসা যায়! এভাবেও ভালোবাসা যায়!”

[রিচেক করতে ভাল্লাগে না।]
চলবে।