লাবণ্যর সংসার পর্ব-১৩

0
614

#লাবণ্যর_সংসার
#পর্ব_13
#কৃ_ষ্ণ_ক_লি

জনা ছয়েক পুরুষের মধ্য থেকে গিটার হাতে থাকা এক পুরুষকে দেখে থমকে যায়। সেই চোখ, সেই মুখ, গালে টোল পড়া হাসি, সেই এক চেহারা। আজ প্রায় দুই বছর পর মানুষটাকে দেখছে সত্যিই অবিশ্বাস্য!
না যতোটা নিজের ভাগ্যকে খারাপ ভেবেছিলো তা নয়। এতবছর পর প্রিয় মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে তাও নিজের চোখের সামনে এই ভাগ্য কি কখনো খারাপ হতে পারে!
কিন্তু লাবণ্য দোটানায় পড়ে যায়। আসলেই কি পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। না কি এক সেকেন্ডের জন্য হলেও ‘কেমন আছো? ’ কথাটা জিজ্ঞাসা করবে!
আচ্ছা মানুষটা কথা বলবে ওর সাথে! না কি মুখ ফিরিয়ে নেবে!
লাবণ্যর নিজের মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যাওয়াটা ঠিক হবে! গিটারে তখনও টুং টাং শব্দে , প্রিয় মানুষটা সুরেলা কন্ঠস্বরে গানের শেষ লাইন গাইছে।

লাবণ্য ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় টেবিলটার কাছে। ও কে দেখে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। লাবণ্যর ধ্যান শুধু ওর প্রিয় মানুষটার দিকে।

—“ কেমন আছো অভ্র? ”

লাবণ্যর ডাকে অভ্র অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ও কি ভুল দেখছে! লাবণ্য পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। যাক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অন্তত প্রিয় মানুষটাকে তো সে দেখতে পাচ্ছে। এরপর ওর যদি কিছু হয়ে যায় , জীবনটাই যদি শেষ হয়ে যায় তবুও শান্তি। আর কি আছে ওর জীবনে! তবুও এই মানুষটাকে একপলক দেখে চোখ বন্ধ করতে পারলেই শান্তি।

অভ্র গিটার টা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায়। লাবণ্যকে কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পায়না তখন ওর চোখের সামনে তুড়ি মারে। লাবণ্য চমকে চোখের পাতা ফেলে। হাসিমুখে অভ্র ঝটপট বলে উঠে,,

—“ আমি বিন্দাস আছি। আর কতোটা ভালো থাকলে মানুষ গান গায়, হাসি খুশি থাকে তা নিশ্চয়ই আমাকে দেখেই বুঝতে পারছো!”

—“ হুম , তুমি ভালো থাকো সর্বদা তাই দোয়া করি।”

লাবণ্য মিনমিনে গলায় বলে উঠলো।

—“ বাই দ্যা ওয়ে তুমি এখানে? বুঝেছি নতুন বিয়ে হয়েছে নিশ্চয়ই হাজবেন্ডের সাথে টাইম্সপেন্ড করতে এসেছো! কেমন আছেন তোমার হাজবেন্ড?”

লাবণ্য চোখ বড়ো করে তাকায় অভ্রের দিকে। তার মানে অভ্র জানে ওর বিয়ে হয়েছে!

—“ হাজবেন্ড.. তুমি জানো, ”

—“ হুম , অ্যাম সরি বিয়ে করেছো অথচ আমি অভিনন্দন জানাতে পারিনি তোমাকে। তোমার হাজবেন্ডকে ডাকো দুজনকে না হয় একসাথেই উইশ করবো ভালো হবে। ”

অভ্রর মুখে হাসি রেখা ফুটেই আছে। লাবণ্য ধরা গলাতেই বলে উঠে,,

—“ আমার হাজবেন্ড আসেননি অভ্র। আর আমি এখানে উনার সাথেও আসিনি। আমি তো তোমাকে একপলক দেখার জন্য তোমার কন্ঠস্বর হঠাৎ শুনে তোমায় চোখের দেখা দেখতে এসেছিলাম অভ্র। ”

লাবণ্যর কথায় মুখের হাসিবিলীন হয়ে যায় অভ্রের। এতোক্ষণ ওর বন্ধুরাও ওদের কথা শুনছিলো। অভ্র লাবণ্যকে কিছু বলতে যাওয়ার আগে নিজের বন্ধুদের দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। ওর বন্ধুরা ওর চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে ও কে একা করে বের হয়ে যায়।

অভ্র এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাবণ্যকে দেখতে থাকে। অতিরিক্ত কাঁদার ফলে লাবণ্যর চোখদুটো ফুলে গেছে। ঠোঁটটা শুকনো লাগছে। দেখেই মনে হচ্ছে ওর কিছু একটা হয়েছে। অভ্র প্রশ্নাতীত চোখে লাবণ্যর চোখে চোখ রাখে।

—“ তোমাকে এমন ক্লান্ত লাগছে কেনো লাবণ্য? ”

লাবণ্য অভ্রের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।

—“ আমি আসছি অভ্র। তোমার খোঁজ খবর নিতেই তোমার সামনে এসেছিলাম। ”

লাবণ্য চলে যেতে নিলেই অভ্র ওর হাতটা ধরে নেয়।
লাবণ্যকে একটা চেয়ার টেনে বসিয়ে দেয় অভ্র।

—“ আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে যাও? ”

—“ কি? ”

—“ তোমার চোখ মুখের এমন অবস্থা কেনো? তোমার তো এই কিছুদিন হল বিয়ে হয়েছে? নতুন বউদের তো এমন অবস্থা হয়না! আমাকে এক পলক দেখার মানে কি? বিয়ের পরেও স্বামীকে ছাড়া অন্য পুরুষকে দেখতে এতোটা আগ্রহী! এটা কিন্তু ঠিক নয়। ”

—“ হুম। ”

—“ শুধুই হুম! অবশ্য তুমি আর কি বলবে। তুমি তো কিছুই বলতে পারো না। আচ্ছা বললে না তো আমায় এখানে যে এসেছো তোমার স্বামী আসেনি কেনো? ”

—“ আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছি। ”

অভ্র কিছুক্ষণের জন্য একদম চুপ হয়ে যায়। লাবণ্য কি বলছে!

—“ বুঝলাম না তোমার কথা! ”

—“ নাই বা বুঝলে। তোমার বুঝে আর কাজ কি। ”

অভ্র সশব্দে হেসে উঠে। লাবণ্য অভ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা হাসছে!

—“ হ্যা তা ঠিক বলেছো। কিন্তু তোমার বাবা একজন সুপাত্রের সাথে তোমার বিয়ে দিলো কিন্তু তুমি ছেড়ে চলে এলে সেটাই আমার ভাবার বিষয়। ন মানে তুমি তো আবার তোমার জীবনে তোমার বাবার কথাই বেশি মানো। অবশ্য সব সন্তানরাই তাই মানে। তোমার বাবার কথা রাখার জন্যই তো আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। তোমার বাবার পছন্দের পাত্রকেই বিয়ে করবে! তাই তো করলে। কিন্তু ছেড়ে চলে এলে কেনো? তোমার স্বামীকে কি তুমি ডিভোর্স দিবে? ”

—“ সেটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার । আমি তোমার সাথে কিছু শেয়ার করতে চাই না। আমি আসছি। ”

লাবণ্য দ্রুত ওখান থেকে বের হয়ে যায়। কি হবে নিজের দুঃখের কথা নিজের প্রাক্তন কে শুনিয়ে। সেই বা কি করবে! ওর কষ্ট গুলো একান্তই ওর নিজের। আসলেই জীবনে কেউ কারুর নয়। ওর মতো মেয়ের জন্য তো আরই নয়।

উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটেই চলেছে লাবণ্য। ফুটপাত দিয়ে যেতে যেতে কয়েকটা বাচ্চা ও কে ঘিরে ধরে। তাদের খেতে না পাবার যন্ত্রণা লাবণ্যকে আরও বেশী কষ্ট দেয়। একসময় এই বাচ্চাগুলোদের মতোই কিছু ফুটপাতের বাচ্চাদের ও পেট ভরে খাওয়াতো। আর আজ! ওর নিজের খাবার কেমন করে জুটবে তাই চিন্তাই করতে হবে।

কিছু মানুষদের ভালো রাখার জন্য সব কিছু ছেড়ে দিতে হয়। শুধু শুধু তাদের পথের কাঁটা হয়ে তাদের অভিশাপ নিজের জীবনে বয়ে বেড়ানোর থেকে একা পথে চলা অনেক ভালো। জীবনে তো সবাই ভালো থাকতে চায়। ওর জীবনে তো কিছুই নেই। বাবা – মাও তো ওকে আর ঠাঁই দিবে না। একটা মাত্র বড়ো ভাই সেও তো ও কে পছন্দও করে না। ও তো প্রত্যেকের জীবনেই কাঁটা। এই তো প্রিয় মানুষটাও কথায় কথায় কিভাবে আঘাত করলো।

ফুটপাতের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে লাবণ্য। এটাই ওর ঠিকানা হবে আজকের পর থেকে। বাচ্চাগুলোকে ধরে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে লাবণ্য।

—“ এসো বাচ্চারা এই নাও খাবার।”

খাবার দেখে বাচ্চা গুলো ছুটে চলে যায়। লাবণ্য দেখে প্রত্যেকটা বাচ্চা হাতে খাবারের প্যাকেট পেয়ে খুব খুশি। অভ্রর হাত থেকে বাচ্চা গুলোর খাবারের প্যাকেট নিতে দেখে মৃদু হাসে লাবণ্য।

তবে এবার আর অভ্রর সাথে কথা বলেনা। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে থাকে। অভ্র হাসি মুখে বাচ্চাগুলোর হাতে খাবার দিচ্ছে। লাবণ্য চলে আসতে গেলে ওর সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। একজন ড্রাইভার লোক গাড়ির দরজা খুলে ও কে গাড়িতে উঠতে বলে। ও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। অভ্র খাবার দেওয়া শেষ করে লাবণ্যর হাত ধরে একপ্রকার জোর করে গাড়ির ভিতর বসিয়ে দেয়।

—“ আমাকে গাড়িতে তুলছো কেনো? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমায়? ”

—“ আপাতত আমার বাড়িতে চলো। তারপর তোমার ঠিকানায় চলে যাবে। ”

—“ মানে টা কি অভ্র? কি পাগলামো করছো তুমি? আমি তোমার বাড়িই বা কেনো যাবো? আর তুমি আমাকে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দেবে মানে? ”

—“ তোমার স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছো? এখন তুমি কোথায় যাবে? ”

—“ সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি গাড়ি থামাও, আমি যাবো না। ”

লাবণ্য চিৎকার করতে থাকে , গাড়ি থামানো কথা বলে, গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করে কিন্তু কোনও লাভ হয় না।

গাড়ি এসে দাঁড়ায় অভ্রের বাড়ির সামনে। লাবণ্য গাড়ি থেকে নামলেই অভ্র হাতটা চেপে ধরে।

—“ আমাকে প্লিজ যেতে দাও। দেখো আমি আমার জীবনে আর কাউকে রাখতে চাই না। আমি একা নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। আমাকে যেতে দাও।”

—“ শাট আপ লাবণ্য। আমরা মানুষ , মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আমরা চাইলেই একা থাকতে পারি না। স্বার্থপর হতে পারিনা। আমাদের অনেক রীতিনীতি নিয়মের মধ্যে চলতে হয়। ”

লাবণ্য একটু শান্ত হয়। অভ্রকে বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ এমন কথা বলছে কেনো অভ্র! আর স্বার্থপর কেনো বলছে ও! অভ্র লাবণ্যর হাত ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে যায়। একটা রুমের মধ্যে নিয়ে যায় লাবণ্যকে। লাবণ্যর হাতে একটা শাড়ী ধরিয়ে দেয়।

—“ দেখো লাবণ্য তুমি অনেক ক্লান্ত , তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি তোমার খাবার দিতে বলছি। খাবার খেয়ে একটু রেস্ট নাও। তারপর আমরা কথা বলছি। ”

রুমানিয়া বেগম মেয়েকে হাজার বুঝিয়েও পারছেন না। আতীক সাহেবও বেশ কয়েকবার ধমক দিয়ে মেঘলার সাথে কথা বলছেন। কিন্তু মেঘলার সেই এক কথা।

—“ তোমরা কেনো বুঝতে চাইছো না। লাবণ্য তো আমার সাথে নিবিড় ভাইয়াকে বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে। তাহলে কেনো তোমরা বুঝছো না। আমাকে বিয়ে দাও না নিবিড় ভাইয়ার সাথে। ”

—“ পাগল হয়ে গেছিস তুই । বিয়ে দাও, বিয়ে দাও! লাবণ্য নিবিড়ের স্ত্রী। আজ না হয় রাগ করে , আবেগে চলে গেছে। কিন্তু কাল ও কে ফিরে আসতে হবেই এই সংসারে। ”

শিউলি বেগম কড়া গলায় কথাগুলো বলে উঠলেন। উনি মনে প্রাণে দৃঢ় বিশ্বাস করেন লাবণ্য ফিরে আসবেই।

লাবণ্য এতোটাই ক্লান্ত ছিলো যে ফ্রেশ হয়ে খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দেয়। চোখ খুলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা নেমে গেছে।কিছু না ভেবে তড়িঘড়ি করে উঠতে গেলেই লাবণ্যর চোখ আটকে যায় ওর পাশে বসে থাকা মানুষটির দিকে…!

চলবে… ..

(লেখায় ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন 🙏)