লাল নীল সংসার পর্ব-২৫+২৬

0
257

#_লাল_নীল_সংসার_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_২৫_

চারিদিকে ফুল,, বাল্ব দিয়ে সাজানো। আদনান একটা চেয়ারে বসে সামনে স্টেজে বসে থাকা ফুলের রানিকে দেখে যাচ্ছে। সামনে স্নেহা গায়ে হলুদের সাজে সজ্জিত হয়ে আছে। হলুদ শাড়ির সাথে কাঁচা ফুলের গহনায় সজ্জিত সে।

আদনানের এখন শুধু স্নেহাকে দেখা আর তাকে হারানোর প্রতিটাহ মুহুর্ত গননা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। সবাই স্নেহাকে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। স্নেহা যেন পুতুলের মতো বসে আছে। পুতুল? হ্যা! স্নেহার নিজেকে পুতুলের মতোই লাগছে। সবার কথা মতো কাজ করেই যাচ্ছে।

রিয়াদ আদনানে পাশে এসে বসে। ওরা সবাই স্নেহাকে হলুদ ছুয়ে দিয়ে এসেছে। শুধু আদনানেরই বাকি। রিয়াদ এই কয়েকদিন আদনানকে খেয়াল করে যাচ্ছে। কেমন যেন হয়ে আছে আদনান। স্নেহার বিয়েতে তারা যতোটাহ আনন্দ করছে,, আদনান ততোটাহ করছে নাহ। ডাকলেও আসে নাহ আদনান। একা একা বসে থাকে আদনান। রিয়াদ আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আদনান!”

রিয়াদের ডাকে ধ্যান ভাঙে আদনানের। আদনান রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” হুম! বল!”

–” আমরা সবাই তো হলুদ লাগিয়ে আসলাম। যাহ তুইও লাগিয়ে দিয়ে আই।”

আদনান একপলক স্নেহার দিকে তাকায়। আসলেই তো সে তো একটুও হলুদ লাগিয়ে দিলো নাহ স্নেহাকে। স্নেহাকে শেষবারের মতো ছুয়ে দেওয়ার এই একটা সুযোগ। নাহ! আর দেরি কেন করবে সে? রিয়াদের দিকে একবার তাকিয়ে স্টেজের দিকে হাঁটা দেয় আদনান।

স্নেহা সামনে তাকাতেই দেখে আদনান এগিয়ে আসছে। আদনান কি তাকে হলুদ লাগাবে? স্নেহার চোখ ছলছল করে উঠে। আদনান স্নেহার দিকে এগিয়ে এসে হালকা ঝুঁকে দাড়ায়। স্নেহা একভাবে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে।

আদনান হলুদের বাটি থেকে একটু হলুদ তুলে নিয়ে স্নেহার গালে ছুইয়ে দিতেই স্নেহা চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর আটকাতে পারলো নাহ স্নেহা। চোখ দিয়ে গড়িয়ে এক ফোঁটা পানি পড়েই গেলো। স্নেহা চোখ খুলে আদনানের দিকে তাকায়। আদনান স্নেহার চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। মিষ্টির প্লেট থেকে একটু মিষ্টি স্নেহার মুখে তুলে দেয় আদনান। স্নেহার দিকে আর একটু ঝুঁকে হালকা হেসে বলে ওঠে,
–” হলুদ পরিকে একটু হলুদ নাহ ছোয়ালে হয়? আজকে বেশি করে হলুদ লাগা,, যেন আগামীকাল তোকে খুব সুন্দর দেখায়। যদিও তোর সৌন্দর্যের কমতি নেই,, মাশআল্লাহ! কিন্তু,, বিয়ে বলে কথা একটু বেশি সুন্দর লাগা উচিত। বুঝলি?”

স্নেহা হালকা হাসে। স্নেহার হাসি মুখ দেখে আদনানও একটু হাসে। স্নেহা হলুদের বাটি থেকে একটু হলুদ উঠিয়ে আদনানের মুখে লাগিয়ে দেয়। আদনান অবাক হলেও হাসে। স্নেহা একটু মিষ্টিও নিয়ে আদনানকে খাইয়ে দেয়। আদনানের চোখ ছলছল করে উঠলেও মুখে হাসি বজায় থাকে।

আদনান স্টেজ থেকে নেমে আসে। একটা ফোন করার জন্য একটু সাইডে যাওয়ার জন্য এগোতেই সামনে মিসেস. আখি এসে দাড়ায়। আদনান মিসেস. আখিকে দেখে একটু হতভম্ব হয়ে যায়। তাও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে ওঠে,
–” আসসালামু আলাইকুম! আন্টি!”

মিসেস. আখি তাচ্ছিল্য ভাবে হেসে বলে ওঠে,
–” ওয়ালাইকুম আসসালাম! তা,, কেমন আছো আদনান?”

–” জি আন্টি আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?”

–” আছি,, ভালোই! তা,, বড়লোক বাড়ির বিয়েতে কেমন মজা করছো? এরকম বিয়ে তো আর কখনো তোমার দেখা হয় নি,, তাই নাহ? কেমন লাগছে?”

আদনান চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলিয়ে নেয়। সে কখনোই মিসেস. আখির সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চায় নাহ। আর নাহ কখনো করতে পারবে। আদনান একটু হেসে বলে ওঠে,
–” ঠিকই বলেছেন আন্টি! আমার কখনো এরকম বিয়ে দেখা হয় নি৷ দেখবো কি করে বলুন,, সেই সামর্থ তো আমার বা আমার কোনো আত্মীয়ের নেই।”

মিসেস. আখি ক্রুর হেসে বলে ওঠে,
–” সে তো আমি তোমাকে প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলাম। স্নেহা কিভাবে তোমার সাথে বন্ধুত্ব করেছে আমার ধারনার বাইরে। আসলে….”

মিসেস. আখি কথা শেষ করতে পারেন নাহ। তার আগেই আদনান চাপা কন্ঠে বলে ওঠে,
–” মাফ করবেন আন্টি,, আপনার কথার মাঝে কথা বলছি,, আসলে আন্টি আমি কখনো আমার বন্ধু বান্ধবের মাঝে নিজের আর্থিক অবস্থা কে লুকায় নি। সব সময় সত্যিই বলে এসেছি। স্নেহা আমার সব সত্যি জেনেই আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছে। কেন করেছে,, এইটা স্নেহা জানে। হয়তো স্নেহা টাকা পয়সা দিয়ে মানুষকেজাজ করে নাহ তাই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আন্টি আসি। আল্লাহ হাফিজ!”

কথাটাহ বলে আদনান চলে যায়। মিসেস. আখি কিছুটাহ অপমানিত বোধ করেন। তাও আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নেন।


রহমান পরিবারের সবাই সকালের খাবার একসাথে খেতে বসেছে। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন সবার। ডাইনিং টেবিল টাহ বদলে অনেক আগেই ছয় চেয়ারের টেবিল কিনেছে শিশির। আদনান,, শিশির,, আজিজ রহমান,, ছোয়া,, সাঝ,, আহিয়া রহমান সবাই একসাথে বসেছে।

সবাই খাচ্ছে কিন্তু আদনান যেন খেতে পারছে নাহ। আজ স্নেহার বিয়ে। সারাজীবনের মতো চলে যাবে তার বার্বিডল। খাবে কি করে সে? বুকের ভেতর এক অতি কষ্ট চেপে রয়েছে। সারা রাত ঘুম হয়নি তার। কান্না করেছে সে। নিজেকে হালকা করার এক ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আদনান।

শিশির খেয়াল করে আদনান সেরকম কিছু খাচ্ছে নাহ। ছেলেটাহ আজকাল তেমন কিছুই খায় নাহ। কি হয়েছে তার ভাইয়ের? সেইদিন ছোয়াও বলছিলো। তারপর থেকেই আদনানকে আরও বেশি খেয়াল করছে শিশির। ছেলেটাহ কে স্বাভাবিক লাগে নাহ আজকাল।

কিন্তু,, আদনান বড় হয়েছে। তার নিজের একটা জগৎ হয়েছে। প্রশ্ন করলেই উত্তর পাওয়া যাবে এমন টাহও নাহ। কিন্তু,,, ভাই টাকে এরকম দেখতেও তো ভালো লাগে নাহ তার। দেখা যাক আর দুইটা দিন। যদি কোনো পরিবর্তন নাহ দেখে,,তাহলে সে সরাসরি কথা বলবে আদনানের সাথে।


চারিদিকে আলোয় আলোয় আলোকিত। কোটিপতি বাবার একমাত্র মেয়ে,, কোটিপতি ভাইয়ের আদরের বোনের বিয়ে বলে কথা,, সেকি আর চাট্টিখানি কথা? একদমই নাহ,, কতো আয়োজন হচ্ছে পুরো বাড়ি জুড়ে।

আলোর ঝলকানিতে বাড়ির রুপটাই বদলে গেছে। গার্ডেনের সাঝে আধুনিকতা মিশে আছে। আছে অবিরাম সৌন্দর্য। দুইপাশে দুইটা স্টেজ করা হয়েছে। সেখানে একপাশের একটা স্টেজে বসে আছে ইয়াশ সেরোয়ানি পরনে,, আজ ইয়াশকে ঠিক রাজপুত্রের মতো লাগছে। রাজপুত্র? হ্যা! রাজপুত্রই তো। ইয়াশ তো রাজপুত্র,, যে কিনা আদনানের বার্বিডল এই রাজ্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করে সম্মানের সাথে নিয়ে যেতে এসেছে।

আজকের পর থেকে স্নেহা ইয়াশের। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আদনানের। কত বড় অভাগা সে,, নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলছে সে। সেইদিন স্নেহাকে বলেছিলো,, ফ্যামিলির মতে নাকি সে বিয়ে করবে। কিন্তু,, পারবে তো অন্য একজনকে জীবনে জড়াতে? ভাবতে পারে নাহ আদনান।

আদনানের মন চাচ্ছে দৌড়ে গিয়ে স্নেহাকে সব টাহ বলে দিতে। নাহ পাক,, তাতে কি? ভালোবাসার মানুষকে কি আর সবাই পায়? পায় নাহ তো। দুনিয়াতে এমন অনেক ভালোবাসা আছে যারা তাদের পূর্নতা পায় নি। কিন্তু,, তারা তো প্রকাশ করে একটা বোঝা থেকে মুক্তি পায়। আদনান তো এখনো প্রকাশ করে নি। অন্তত প্রকাশ করুক যে,, সে তার বার্বিডল কে কতোটাহ ভালোবাসে।

নাহ! কি ভাবছে সে এইসব? পাগল হয়ে গেছে নাকি সে? এমন একটা দিনে স্নেহাকে তার অনুভুতির কথা বলা যে অন্যায়। হয়তো কষ্ট পাবে তার বার্বিডল,, অসম্মান করা হবে বন্ধুত্বকে। পারবে নাহ আদনান! কখনোই নাহ।

আদনান একপলক হাতে থাকা গোলাপ ফুলের দিকে তাকায়। ইচ্ছে করেই দামি উপহার সে কিনে নায়। তার কারনও আছে। দামি উপহার কেনার জন্য গিয়েছিলো,, হয়তো সেইটা স্নেহার কাছে কিছুই নাহ। তিন হাজার টাকা নিয়ে একটা উপহার কেনার জন্য গেলেও,, কি মনে করে বিশ টাকা দিয়ে এই ফুটন্ত গোলাপ টাহ কিনে আনে আদনান।

…………….একটা রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে আদনান। এই রুমেই আছে স্নেহা! তার বার্বিডল! যে আজ থেকে অন্য কারোর হয়ে যাবে। যার উপর প্রতিষ্ঠিত হবে অন্য কারোর অধিকার।

ভেতর থেকে একটু হাসির আওয়াজ পাচ্ছে আদনান। স্নেহার হাসির আওয়াজ নাহ,, অন্য মেয়েদের। দরজা হালকা নক করতেই হাসির রেশ থেমে যায়। কেউ একজন ভেতরে আসার অনুমতি দিলে আদনান ভেতরে আসে।

আদনান কে দেখে দাড়িয়ে পড়ে স্নেহা। আয়না দিয়ে দেখতে থাকে আদনানকে। আদনান আয়নার দিকে তাকালে দেখতে পায় এক অনন্য রুপবতী কন্যাকে। এই কি তার বার্বিডল? মেয়েদের নাকি বউ সাজে অধিক সুন্দর লাগে? আজ তার প্রমান পেলো আদনান।

স্নেহা কাজ করা গাঢ় লাল রঙের লেহেঙ্গা পরা যার দোপাট্টা গোল্ডেন কালারের। ব্রাইডাল সাজ,, সোনার গহনা,, খোপায় ফুলের গজরা,, অসম্ভব সুন্দর লাগছে স্নেহাকে। স্নেহা আদনানের দিকে ঘুরে দাড়ায়। আদনান এখন আরও ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে স্নেহাকে। এইটাই হয়তো তার শেষ দেখা স্নেহাকে। স্নেহা পাশের মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” তোরা যা! আমার কিছু কথা আছে আদনানের সাথে। তোরা পরে আই।”

সবাই চলে যায়। এখন রুমে আদনান আর স্নেহা ছাড়া কেউ নেই। স্নেহাও কিছু নাহ বলে আদনানকে দেখতে থাকে। আদনান কেমন যেন শুকিয়ে আছে। কি হয়েছে তার? আদনান হালকা হাসে স্নেহার দিকে তাকিয়ে। স্নেহার যেন হাসি পাচ্ছে নাহ,, বরং কান্না পাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রনা ঘিরে ধরছে তাকে।

আদনান এগিয়ে এসে গোলাপ ফুল টাহ স্নেহার দিকে বাড়িয়ে দেয়। স্নেহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে। আদনান হালকা হেসে স্নেহাকে ইশারা করে ফুল টাহ নিতে। স্নেহা হাত বাড়িয়ে ফুল টাহ নিয়ে নেয়। তারপর আদনান স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আজ তোর বিয়ে,, এক নতুন জীবনে যাবি,, এক নতুন মানুষের সাথে তোর জীবন জড়িয়ে যাবে। অনেক অনেক শুভ কামনা তোর জন্য!”

স্নেহা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে। আদনান আবার বলে ওঠে,
–” দুইদিন পর কানাডায় চলে যাবি। আর দেখা হবে কি নাহ তাও জানি নাহ। ভুলে যাস নাহ প্লিজ! জানি,, নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবি,, কিন্তু তাও বলছি,, প্রতিদিন নাহ হোক,, সপ্তাহে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও আমাকে মনে করিস। আমি তোকে খুব মিস করবো,, ককটেল সুন্দরী! অনেক মিস করবো।”

আদনানের গলা ভেঙে আসছে। তাও বলে ওঠে,
–” স্নেহা! আমি তোর জন্য ভালো কিছু কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু,, আমি কিনি নি। তার বদলে একটা সস্তা পাতি গোলাপ নিয়ে এসেছি। আমি জানি নাহ এই ফুলের মূল্য তোর কাছে কি,, কিন্তু,, আমার কাছে এই ফুলের মূল্য অনেক। মনে পড়ে তোর,, এরকম একটা গোলাপ নিয়ে তোর সাথে আমার প্রথম দিন কেমন ঝগড়া হয়েছিলো? আমার কিন্তু মনে পড়ে। তাই আমি এই প্রথম দিন টাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”

স্নেহা তন্ময় হয়ে আদনানের কথা শুনছে। মনে হচ্ছে এই কথা বলা যেন শেষ নাহ হয়। আদনান একটা ঢুক গিলে আবার বলে ওঠে,
–” এই ফুল টাহ একদিন পর ঝরে যাবে। তার সাথে ঝরে যাবে তোর আর আমার বন্ধুত্বের একটা ধাপ। বিয়ে হলে বন্ধুর জন্য সময় কম হয়ে থাকে,, এই ফুলে ঝরে যাওয়া টাহ তার প্রকাশ মাত্র। আর এই ফুলের যতটাহ সৌন্দর্য এই মুহুর্তে বিদ্যমান আছে। ততটাই সৌন্দর্য,, তোর দাম্পত্য জীবনে ফুটে উঠুক!”

স্নেহার চোখ ছলছল করছে। পলক ফেললেই গড়িয়ে পরবে অশ্রুকণা। কিন্তু,, স্নেহা ফেলতে দিচ্ছে নাহ। আদনান একটা জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,
–” তুই বলেছিলি,, আমি যেন তোর বিয়ের প্রতিটা ফাংশনে থাকি। আমি তােকে কথা দিয়েছিলাম থাকবো,, আর আমি থেকেছি। কিন্তু,, এখন আর আমাকে আটকাবি নাহ প্লিজ! আমি চলে যাচ্ছি! সুখি হ,, সব সময় এই দোয়া করি তোর জন্য। আল্লাহ তোকে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখী কন্যা বানিয়ে দিক। ভালো থাকিস! নিজের দিকে খেয়াল রাখিস। নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো। আল্লাহ তোদের সুখী করুক। তোদের দাম্পত্য জীবনে আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হোক। আল্লাহ হাফিজ!”

আদনান আর দাড়ায় নাহ। ঘুরে যায় স্নেহার দিক থেকে। হাঁটতে শুরু করে বেরিয়ে আসার উদ্দেশ্যে। হাত দিয়ে মুছে নেয় চোখের পানি। চলে যায় আদনান। স্নেহা আদনানের যাওয়ার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। একটা কথাও বলে নি সে। কারন,, স্নেহা জানে এখন যদি সে একটা শব্দ উচ্চারণ করতো,, তাহলে নিজের কান্না আর সামলাতে পারতো নাহ।

স্নেহা হাতে থাকা গোলাপ ফুলের দিকে তাকায়। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে আদনানের সাথে কাটানো সেই সোনালি দিন গুলো। আদনান তাকে বিয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলো। চোখ থেকে অজস্র জল গড়িয়ে পড়তে থাকে স্নেহার!!!!!

#_চলবে………..🌹

#_লাল_নীল_সংসার_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_২৬_

–” আদনান!”

কারোর চিৎকার করে ডাকার আওয়াজে পা থেমে যায় আদনানের। এমন নির্জন রাস্তায় কে ডাকছে তাকে? তাও আবার সব থেকে চেনা কন্ঠে। তার মানে,, তাড়াতাড়ি পেছন ঘুরে দাড়ায় আদনান। আর সামনে তাকাতেই আদনানের চোখ সেইদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

স্নেহা দৌড়ে আসছে। স্নেহা? হ্যা! সত্যিই স্নেহা দৌড়ে আসছে। স্নেহার পরনে শুধু বিয়ের লেহেঙ্গা টাহ,, কোনো গহনা নেই,, চুল গুলো খোঁপায় জড়িয়ে গজরা লাগানো থাকলেও কিছুটাহ এলোমেলো হয়ে আছে,, মুখের সেই ভারি সাজ এখনো রয়েছে,, শুধু কাজল হালকা লেপ্টে গেছে।

কিন্তু,, স্নেহা এখানে কেন? স্নেহা দৌড়ে এসেই আদনানকে জড়িয়ে ধরে। আদনান হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে নাহ তার। স্নেহা আদনানকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,
–” আমি তোকে ভালোবাসি আদনান! আমি পারবো নাহ তোকে ছাড়া থাকতে। একটুও পারবো নাহ। ওরা বুঝার চেষ্টা করছে নাহ আদনান! অনেক চেষ্টা করলাম,, ওরা ভাবছে নাহ আমার কথা। আমি তোকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো নাহ। পারবো নাহ আদনান!”

আদনান যেন বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেছে। তার বার্বিডল তাকে ভালোবাসে? সত্যি? স্নেহা আদনানের থেকে একটু সরে এসে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” I love you, Adnan. প্লিজ ফিরিয়ে দিস নাহ আমাকে। আমি……”

স্নেহা আর কিছু বলার আগেই আদনান স্নেহার ঠোঁটে এক আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
–” হুশশশশ!”

স্নেহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে। আদনান স্নেহাকে আবার টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,
–” আমিও তোকে ভালোবাসি স্নেহা! কিন্তু,, বলতে পারি নি কখনো। আর আমি তোকে কিভাবে ফিরিয়ে দেবো বল? I love you, Sneha! I love you very much. অনেক অনেক ভালোবাসি তোকে।”

স্নেহাও আদনানকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই আদনান পালিয়ে যাবে। ভাগ্যিস আজ রাস্তাটাহ নির্জন। এলাকার প্রায় সবাই স্নেহার বিয়ের দাওয়াতে। রাস্তা একদম নিঝুম,, আর রাস্তার মাঝে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে দুই নর-নারী।

কিন্তু,, স্নেহা এখানে কিভাবে এলো? ওর তো বিয়ের আসরে থাকার কথা ছিলো। এতো টুকু সময়ে এমন কি হয়ে গেলো? আদনান স্নেহাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
–” কিন্তু,, তুই এখানে কিভাবে এলি? আমি কিছুই বুঝছি নাহ। তোর ফ্যামিলির কি হবে এখন?”

–” ওরা আমার কথা ভাবছে নাহ। ওরা শুধু নিজেদের কথা ভাবছে। আমার সুখ টাহ কেউ দেখছে নাহ।”

–” মানে কি হয়েছে? একটু ক্লিয়ার করে বল প্লিজ!”

স্নেহা আদনানের দিকে কান্না চোখে তাকিয়ে সব বলতে শুরু করে।

#_Flashback_…………
আদনান বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই স্নেহার মনে হচ্ছে কেউ তার গলা চেপে ধরে আছে। তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সহ্য করতে পারছে নাহ। স্নেহা তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিয়ে ওর মা,, বাবা,, আর ভাইকে বলে নিজের রুমে আসতে।

……………..স্নেহার সামনে মি. আশাউল,, সাইফ,, মিসেস. আখি দাড়িয়ে আছে। স্নেহা এখনও বলতে পারছে নাহ। কিভাবে বলবে বুঝতেও পারছে নাহ। সাইফ স্নেহার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
–” স্নেহা! বোন আমার,, যাহ বলবি তাড়াতাড়ি বল,, অনেক কাজ আছে এখনও। সব গেস্টরা আছে,, তাদের সময় দিতে হবে তো নাকি?”

স্নেহা চোখ বন্ধ করে মন শক্ত করে বলে ওঠে,
–” ভাইয়ু! বাপি! আমি এই বিয়ে করতে পারবো নাহ!”

স্নেহার কথা শুনে সাইফ,, মি. আশাউল,, মিসেস. আখি চমকে উঠে। কি বলছে স্নেহা এইসব? সাইফ স্তম্ভিত কন্ঠে বলে ওঠে,
–” কিক কি বলছিস তুই এইসব?”

স্নেহা সাইফের দিকে তাকিয়ে হালকা কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
–” আমি ঠিকই বলছি ভাইয়ু,, এই বিয়ে আমি করতে পারবো নাহ। আমাকে মাফ করে দাও!”

মিসেস. আখি থতমত কন্ঠে বলে ওঠে,
–” কেন? কি হয়েছে? এই বিয়েতে কি সমস্যা?”

স্নেহা মাথা নিচু করে বলে ওঠে,
–” এই বিয়ে করতে পারবো নাহ কারন,, আমি একজনকে ভালোবাসি!”

স্নেহার কথা শুনে যেন তিনজনই চরমের শেষ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। স্নেহার কথা যেন তাদের বিশ্বাস হচ্ছে নাহ। স্নেহা কাউকে ভালোবাসে? এইটা তাদের মন মতো হচ্ছে নাহ। সাইফ গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–” সে কে?”

স্নেহা একপলক সাইফের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বলে ওঠে,
–” আদনান!”

আদনান নামটাহ শুনে তিনজনেই চমকে উঠে। মিসেস. আখি স্নেহার দিকে এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” কি বলছিস এইসব তুই? আদনান কে ভালোবাসিস মানে? তুই জানিস নাহ,, ওর স্টাটাস আর তোর স্টাটাস কোথায়? তুই জানিস নাহ,, ওর ফ্যামিলি লেভেল কতটুকু? তুই এই বাড়ির মেয়ে হয়ে কি করে আদনানকে ভালোবাসতে পারিস?”

স্নেহা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” মামনি! এইসব কি বলছো তুমি? দয়া করে আদনানকে নিয়ে এইসব বলো নাহ প্লিজ! ও অনেক ভালো একটা ছেলে মামনি! ওর পরিবারের প্রতিটা মানুষই খুব ভালো। হয়তো আমাদের মতো টাকা,, পয়সা ওদের নেই,, কিন্তু ওদের মানসিকতার মতো মানুষ খুব কমই দেখেছি। মামনি! আমরা সব সময় টাকা দিয়ে কেন মানুষকে জাজ করি? কেন আমরা এর বাইরে গিয়ে একটা মানুষকে ভাবতে পারি নাহ? কেন আমরা টাকা দিয়ে মানুষের লেভেল বিচার করি?”

স্নেহা সাইফের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে,
–” ভাইয়ু! আমি আদনানকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো নাহ বিশ্বাস করো। আমি আর কারো কাছে ভালো থাকতে পারবো নাহ। আমি জানি,, আমার আরও আগে জানানো উচিত ছিলো,, কিন্তু আমি তোমাদের কষ্ট দিতে চাই নি। কিন্তু,, আমি এখন আর সহ্য করতে পারছি নাহ৷ দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার। আর এতে ইয়াশকেও ঠকানো হবে,, কারন,, ইয়াশকে আমি কখনোই ভালোবাসতে পারবো নাহ ভাইয়ু! বাপি! আমি সত্যি বলছি আমি আদনানকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো নাহ।”

সাইফ,, মি. আশাউল,, মিসেস. আখি গম্ভীর হয়ে দাড়িয়ে আছে। সাইফ স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” তুই কি ভেবেছিস বলতো? তুই যদি আমাদের আগেই বলতি যে,, তুই আদনানকে ভালোবাসিস,, তাহলে আমরা তোর সাথে আদনানের বিয়ে দিতাম?”

স্নেহা অবাক হয়ে সাইফের দিকে তাকায়। সাইফ গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–” কখনোই নাহ! ভুল ভেবেছিস তুই। কখনো আদনানের সাথে তোকে বিয়ে দিতাম নাহ। আরে,, আদনানের সাথে তোর বিয়ে হলে আমাদের বাড়ির মানসম্মান কোথায় গিয়ে দাড়াবে ভাবতে পারিস? কি যোগ্যতা আছে আদনানের,, এই বাড়ির জামাই হওয়ার? একটা লো ক্লাস ফ্যামিলির ছেলে,, তার উপর বেকার! আর হ্যা! এই দুনিয়ায় টাকাই সব। যার টাকা থাকে,, তার সব থাকে। যার টাকা নেই,, তার কিছুই নেই। মামনি আমাকে বলেছিলো আদনানের মতো একটা ছেলো তোর ফ্রেন্ড কিভাবে হয়? আদনানের সাথে তোর বন্ধুত্ব আমার ভালো নাহ লাগলেও আমি কিছু বলি নি,, সেখানে তোর সাথে বিয়ে দিবো তার,, ভাবলি কি করে?”

স্নেহার যেন কান বন্ধ হয়ে আসছে। আদনানের নামে এতো কথা যে তার শুনতে ইচ্ছে করছে নাহ। সে তো ভেবেছিলো,, আগে বললে হয়তো তার ফ্যামিলি মেনে নিতো,, কিন্তু তারা তো কখনোই আদনানকে মানতো নাহ। মি. আশাউল স্নেহার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–” তোমার বিয়ে ইয়াশের সাথেই হবে। তুমি কাকে ভালোবাসো কি বাসো নাহ,, সেইটা আমার কাছে ম্যাটার করে নাহ। তোমার এই সো কল্ড ভালোবাসার জন্য আমি আমার সম্মান হারাতে পারবো নাহ। যদি কাউকে পছন্দ করো,, তাহলে তাকে আমাদের ফ্যামিলি লেভেলে আসতে হবে। আদনানের মতো রাস্তার ছেলে কে এই বাড়ির জামাই আমি কখনোই বানাবো নাহ।”

স্নেহা কানে দুই হাত চেপে ধরে কান্না করে বলে ওঠে,
–” স্টপ বাপি! আমি আর নিতে পারছি নাহ। আদনান কোনো রাস্তার ছেলে নাহ। এইভাবে বলো নাহ প্লিজ!”

স্নেহা কান্না করতে করতে নিচে বসে পড়ে। সাইফ মিসেস. আখির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলে ওঠে,
–” রুমের দরজা বন্ধ করে রাখো মামনি! বিয়ে নাহ হওয়া পর্যন্ত ও যেন এই রুম থেকে বের হতে নাহ পারে।”

কথা গুলো বলল সাইফ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মি. আশাউলও বেরিয়ে গেলে,, মিসেস. আখি বেরিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। স্নেহা উঠে দরজায় হাত দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে বলে ওঠে,
–” মামনি! ভাইয়ু! বাপি! প্লিজ দরজা টাহ খুলো,, আমি আদনানকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো নাহ। প্লিজ! ওপেন দি ডোর!”

স্নেহার রুম সাউন্ড প্রুফ হওয়ায় কোনো আওয়াজ বাহিরে যায় নাহ স্নেহার। আর গেলেও বোধ-হয় খোলার মতো কেউ নেই। স্নেহার আরও কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে ব্যার্থ হয়ে এগিয়ে এসে বিছানার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরের উপর বসে কান্না করতে থাকে।

…………….মিনিট পাঁচেক পরে দরজা খোলার আওয়াজে দরজার দিকে তাকায় স্নেহা। দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠে,, কারন দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে ইয়াশ।

স্নেহা মেঝেতে হাটু ভাজ করে কান্না করছিলো,, খোপা থেকে কিছু চুল বেরিয়ে এসেছে,, চোখের কাজলও কিছুটাহ লেপ্টে আছে,, কান্নার জন্য মুখ টাহ লাল হয়ে গেছে,, অতিরিক্ত কান্নার ফলে এখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে স্নেহা। এই কষ্টকর দৃশ্যেও ইয়াশের কাছে সব থেকে সুন্দরতম একটা দৃশ্য মনে হচ্ছে। কারন,, স্নেহাকে এক অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে,, কিন্তু,, ইয়াশ তাও এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে চায় নাহ,, কারন,, তাহলে যে এই মিষ্টি মেয়ে টাহ কে কান্না করতে হবে,, কষ্ট পেতে হবে তাকে।

স্নেহা আস্তে আস্তে উঠে দাড়ায়। ইয়াশ দরজা টাহ আটকে দেয়। স্নেহা কিছুটাহ অবাক হয়ে আছে। হালকা ভিতুও হচ্ছে সে। ইয়াশ এগিয়ে এসে স্নেহার দিকে তাকায়। তারপর শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
–” আদনানকে কতটা ভালোবাসো,, স্নেহা?”

স্নেহা চমকে উঠে ইয়াশের কথা শুনে। ইয়াশ এইগুলো জানলো কিভাবে? তার পরিবারের মানুষজন গুলো নিশ্চয় বলবে নাহ। স্নেহাকে চুপ করে থাকতে দেখে ইয়াশ বলে ওঠে,
–” চুপ করে কেন আছো স্নেহা? কতটাহ ভালোবাসো জানো নাহ? নাকি এতোটাই ভালোবাসো,, যে গুনেও শেষ করা যাবে নাহ।”

স্নেহা ছলছল চোখ নিয়ে ইয়াশের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াশ একটু হেসে বলে ওঠে,
–” তুমি কি ভেবেছো,, আমি তোমার ভালোবাসার কথা জানার পরও,, তোমাকে বিয়ে করবো? স্নেহা! তাহলে তুমি ভুল ভেবেছো। আমি যদি তোমাকে এই মুহুর্তে বিয়ে করি,, তাহলে আমি তোমার শরীর পাবো,, কিন্তু তোমার মন পাবো নাহ। আমি তো তোমার শরীর চাই নাহ,, আমি তো তোমার মন টাহ কে চেয়েছিলাম। শরীর তো ধর্ষন করলেও ছোয়া যায়। মন কি আর সবাই ছুঁতে পারে?”

স্নেহা কান্না ভেজা গলায় বলে ওঠে,
–” এতো ভালো কেন তুমি?”

–” আমি একটুও ভালো নাহ স্নেহা! আজ যদি আমি ভালো হতাম,, তাহলে বিয়ের আগে নিজেই তোমার মতামত নিতে আসতাম। কিন্তু,, আমি নেই নি। জানার চেষ্টাও করি নি,, তোমার এতোদিনে কষ্ট টাহও অনুভব করতে পারি নি। স্নেহা! তোমাকে একটা কথা বলি,, তোমার বাপি,, ভাইয়ু,, মামনি কেউ তোমাকে আর আদনানকে মেনে নিবে নাহ। আমার বোঝা হয়ে গেছে।”

–” তুমি এতো কিছু কিভাবে জানলে?”

ইয়াশ একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,
–” তুমি যখন ওনাদের সাথে কথা বলছিলে,, তখন আমি দরজার ওপাশ থেকে সব শুনে ফেলেছি। ওনাদের কাছে ওনাদের মানসম্মান অনেক বড় হয়ে গেছে। তোমার সুখী হওয়া টাহ চোখে বাঁধছে নাহ। তাই,, তোমাকে আমি বলছি,, পালিয়ে যাও।”

স্নেহা চমকে ইয়াশের দিকে তাকায়। ইয়াশ হালকা গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–” স্নেহা! আমি জানি নাহ,, আমি তোমাকে ভালো উপদেশ দিচ্ছি কি নাহ। কিন্তু,, আমার সাথে যদি তোমার বিয়ে হয় তুমি শুধু আরামে থাকবে,, কিন্তু সুখী হতে পারবে নাহ। আর নাহ আমি হতে পারবো। যেখানে মন টাই আমি পাবো নাহ,, সেখানে তার শরীরও আমার চাই নাহ। স্নেহা! তুমি তো আমাকে সব থেকে কাছের বন্ধু ভাবো তাই নাহ? আমি তোমার বন্ধু হয়েই থাকতে চাই।”

–” কিন্তু,, ইয়াশ আমি পালিয়ে গেলে তোমার কি হবে?”

–” স্নেহা! আমাদের এইটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এখানে,, বিয়ের দিন মেয়েদের বিয়ে নাহ হলে তাদের বদনাম হয়,, ছেলেদের হয় নাহ। আর আমি তো কানাডায় চলে যাবো। হয়তো,, তোমার প্রতি মায়া আছে,, অজানা ভালোবাসা থাকলেও থাকতে পারে,, কিন্তু এই ভালোবাসা এখন আমার নিজের কাছেই ফিকে হয়ে গেছে। তুমি একদম গিল্টি ফিল করো নাহ,, আমি একদম তোমার উপর অভিযোগ,, রাগ কিচ্ছু নেই। আমি আগেও তোমার পাশে ছিলাম,, এখনো আছি,, ভবিষ্যতেও থাকবো ইনশাআল্লাহ!”

স্নেহার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইয়াশ এগিয়ে এসে স্নেহার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
–” স্নেহা! আর দেরি করা ঠিক হবে নাহ। আদনান তোমার সাথে উপরে কথা বলতে এসেছিলো হয়তো। আমি যখন উপরে আসি,, তখন মাত্র বের হচ্ছে আদনান। মানে,, বেশি দুরে যেতে পারে নি। তাড়াতাড়ি চলো।”

–” কিন্তু,, এখানে?”

–” এখানে আমি সব ম্যানেজ করে নিবো। তুমি চিন্তা করো নাহ।”

–” কিন্তু,, ওরা যে অনেক কষ্ট পাবে।”

–” আমিও জানি স্নেহা! কিন্তু,, ওনারা ভুল করছে,, সব সত্যিটাহ জানার পরেও,, ওনারা নিজেদের সম্মান সম্মান করছে। ব্যাপার টাহ অন্যভাবেও সেটেল করতে পারতাম। আর তাতে কোনো মানসম্মানও যেতো নাহ। ওনাদের মেইন সমস্যা টাহ হলো,, আদনানের টাকা পয়সা।”

স্নেহা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলে। ইয়াশ অস্থির হয়ে বলে ওঠে,
–” স্নেহা! আর দেরি করা ঠিক হবে নাহ। যে কেউ চলে আসতে পারে। চলো!”

–” এক মিনিট!”

–” আবার কি হলো?”

স্নেহা কোনো কথা নাহ বলে আয়নার সামনে দাড়িয়ে মাথার ঘোমটা ফেলে দেয়। আস্তে আস্তে সব গহনা খুলে ফেলে। ইয়াশ অবাক হয়ে বলে ওঠে,
–” এইসব কি করছো?”

স্নেহা গহনা খুলতে খুলতে বলে ওঠে,
–” এইসব আমি নিয়ে যেতে পারবো নাহ ইয়াশ! তাহলে ওরা,, আমার আদনানের দিকে আঙুল তুলবে। যাহ আমি সহ্য করতে পারবো নাহ।”

ইয়াশ মুচকি হাসি দিয়ে স্নেহাকে দেখতে থাকে। স্নেহার সব গহনা খোলা শেষ। হাতের আংটি খুলতে গিয়ে এইংগেজমেন্টের রিং চোখে পড়ে স্নেহার। আহত চোখে ইয়াশের দিকে তাকায় স্নেহা। ইয়াশ একটা মুচকি হাসি দিয়ে স্নেহার হাত টাহ নিজের হাতের মাঝে নিয়ে আংটির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” এইটা আমি নিয়ে নিচ্ছি স্নেহা! আদনানকে বলো,, ওর সাধ্যের মাঝে একটা আংটি যেন তোমাকে পরিয়ে দেয়। হোক সেইটা পঞ্চাশ টাকার,, কিন্তু সেইটা অবশ্যই ভালোবাসাপূর্ন হতে হবে। এইটা আমি সাথে রাখবো,, এইটা দিয়ে আমার কাজ আছে।”

কথাটাহ বলে ইয়াশ নিজেই রিং টাহ খুলে নিয়ে পকেটে রেখে দেয়। স্নেহা কান্না ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,
–” I am sorry,, ইয়াশ! আজ আমি স্বার্থপর হয়ে গেলাম।”

–” আর ধুর পাগলি,, বললাম তো সব কিছু,, তাহলে সরি কেন বলছো? চলো,, সময় নেই হাতে।”

ইয়াশ স্নেহাকে নিয়ে বাইরে আসে। স্নেহা বুঝতে পারছে নাহ ইয়াশ কি করতে চাচ্ছে। ইয়াশ স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” স্নেহা এখানে আমি মই সেট করে দিয়েছি। তুমি,, মই বেয়ে নিচে নেমে ব্যাক ডোর দিয়ে বাইরে যাবে। আদনান বেশি দুরে এখনও যেতে পারে নি। ওকে?”

স্নেহা সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে মই বেয়ে নিচে নেমে যায়। ইয়াশকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে দৌড়ে চলে যায় স্নেহা। স্নেহাকে যতোসময় দেখা যাচ্ছিলো,, ইয়াশ দাঁড়িয়ে দেখছিলো। স্নেহা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে ইয়াশ তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি গুলো মুছে নেয়। তারপর ভেতরে চলে যায়।

#_Present_………
স্নেহা আদনানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আদনান স্নেহার এই কান্না আর সহ্য করতে পারছে নাহ। স্নেহার মুখ টাহ তুলে নেয় আদনান। মুছিয়ে দেয় স্নেহার চোখের পানি। স্নেহা আদনানের দিকে আহ্লাদী চোখে তাকিয়ে আছে। আদনান স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” কিন্তু স্নেহা! আমি যে এখনও বেকার। স্টাডিও শেষ হয় নি।”

–” তাতে কি হয়েছে? তুই তো টিউশনি করিস,, আমিও করবো। দুইটা বছর,, তারপর তো আমাদের স্টাডি শেষ হয়ে যাবে। তারপর আমরা চাকরি করবো,, কোনো সমস্যা থাকবে নাহ। এই দুইটা বছর কি আমরা একটু কষ্ট করতে পারবো নাহ?”

আদনান সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে,, স্নেহার চেখ মুছে দেয়। তারপর স্নেহার মুখ ধরে বলে ওঠে,
–” অনেক হয়েছে কান্না আর কাঁদতে দিবো নাহ তোকে। আমি হয়তো তোকে ইয়াশের মতো আরামে রাখতে পারবো নাহ,, কিন্তু,, কথা দিতে পারি,, অনেক ভালোবাসতে পারবো,, তোর গরম লাগলে রাস্তায় গিয়ে প্রকৃতির বাতাস খাওয়াতে পারবো,, তোর অন্ধকারে ভয় লাগলে মোমবাতি দিয়ে তোর চারিদিকে আলোকিত করতে পারবো,, সারা রাত আমার বুকে তোর মাথার রাখার জায়গা বানিয়ে দিতে পারবো,, তোকে খাইয়ে দিতে পারবো,, এই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই আমি মুছে দিতে পারবো,, হবে নাহ?”

স্নেহা কান্না ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,
–” এগুলোই তো আমার জন্য অনেক। আর কি চাই আমার? আমার শুধু তোকে হলেই চলবে। দেখিস তুই,, আমি তোর ঘরে সুখের #_লাল_নীল_সংসার_ সাজাবো। সবাইকে আনন্দে রাখবো। সত্যি বলছি। তুই শুধু আমার পাশে থাকলেই হবে। আমি সব সামলিয়ে নিবো।”

আদনান স্নেহাকে জড়িয়ে ধরে। স্নেহাও আদনানকে জড়িয়ে ধরে। কিছু সময় পর স্নেহা সরে এসে বলে ওঠে,
–” আদনান! আমাদের আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে নাহ। চল আমরা আগে কাজি অফিসে যায়।”

–” কাজি অফিস?”

–” তোর পরিবার অনেক রাগ করবে তাই নাহ এমন করে বিয়ে করলে? আমি সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো তার জন্য। কিন্তু,, আমি তোর বউ হয়ে ঐ বাড়িতে যেতে চাই। প্লিজ, আদনান!”

–” হুম!”

আদনান স্নেহাকে নিয়ে মেইন রোডে এসে একটা রিক্সা ঠিক করে। রিকশা কাজি অফিসের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করে। আদনান স্নেহার কপালে কপাল ঠেকায়। একটা তৃপ্তি + শান্তির হাসি ফুটে উঠে আদনান আর স্নেহার ঠোঁটে। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার আনন্দ ভরে আছে দুইজনকে। রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে,, আর সেই সাথে রিকশায় করে এগিয়ে যাচ্ছে #_লাল_নীল_সংসার_ বাঁধার জন্য দুই নর-নারী!!!

#_চলবে……………🌹