#লাল_রং
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ৫]
-‘আজকের আকাশটা সুন্দর। তারা গুনতে গুনতে আপনার কথা মনে পড়লো। কেমন আছেন?
—তন্ময়।’
মধ্যরাতে অত্যন্ত পছন্দের পুরুষের থেকে টেক্সট পেয়ে অদ্রি হতবাক। মেসেজটা দেখে অদ্রি স্তব্ধ হয়ে গেল। এসব কী? তন্ময় কেন হঠাৎ তাকে মেসেজ করবে? অদ্রি কিছু সময় বোকার মতোন বসে রইল। ভাবতে লাগল কি রিপ্লাই করবে। কিছুটা ভেবে-টেবে উত্তর দিতে যাবে, তখনই রিমির ফোন আসে। অদ্রি এই সময়ে কলে বিরক্ত হলো। তবুও তার কলটাই আগে রিসিভ করল। সে কল রিসিভ করতেই রিমি বলল,
-‘এই শোন, তোর কনফিউশন কি এখন একটু হলেও শেষ হয়েছে? ওই তন্ময়ের ব্যাপারে কিছু কি ভেবেছিস?”
অদ্রি তপ্ত শ্বাস ফেললো। ম্যাসেজটা রিমিকে পড়ে শোনাল। রিমি হেসে ফেললো,
-‘বাহ! তোর তন্ময় তো বেশ এগিয়ে। ছেলেও মনে হয় তোকে পছন্দ-টছন্দ করে বুঝলি! তো, কি করবি এখন? রিপ্লাই দিবি?”
অদ্রি ভাবল। বলল,
-‘কি দেওয়ার আছে? কী বলব আমি?’
-‘সত্যিটা বল, আর কি বলবি? যেমনটা তোর মনে হচ্ছে সেটাই বলবি।’
-‘আ—আচ্ছা। তুই রাখ, আমি কথা বলে দেখি।’
অদ্রি ফোন কেটে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সময় নিয়ে তন্ময়ের ম্যাসেজের রিপ্লাইয়ে লিখল,
-‘তারা গোনার সময় আমার কথা কেন মনে পড়বে?’
টেক্সট সেন্ড করে অদ্রি বসে রইল। বুকের অসহ্যকর ধুক-পুক আওয়াজটুকু পর্যন্ত শুনতে পেল। ফোন ধরে রাখা হাত হালকা কাঁপলো। ম্যাসেজটা পড়ে কে জানে কি ভাবে ছেলেটা!
তন্ময় টেক্সটটা দেখে মুচকি হাসল। হাসি মুখে টাইপ করল,
-‘আপনাকে তারার মতো সুন্দর দেখতে, হয়তো তাই।’
অদ্রি রিপ্লাই পড়ে নিজের চোখ বড়বড় করে ফেললো। এরপর ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। লিখল,
-‘ফ্লার্ট-টার্ট করছেন নাকি মশাই?’
-‘কেন? করা বারণ আছে?’
-‘তা নেই। চালিয়ে যান।’
-‘আপনি পটবেন?’
-‘দেখি ভেবে। পছন্দ হলে পটতেও পারি।’
-‘আচ্ছা!’
তন্ময় হেসে ফেললো।
****
ক্যাম্পাসে ঢুকেই রিমিকে দেখে অদ্রি দৌড়ে গেল। রিমি তাকে এভাবে আসতে দেখে তার হাত ধরে থামালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘কি হলো?’
অদ্রি হাঁপাচ্ছে তখন। রিমি তাকে বসিয়ে পানি খাওয়াল। স্বাভাবিক হতেই রিমির গলা জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল। রিমি অবাক হলো তার কাজ-কর্মে। বলল,
-‘আরে, আজব। হলো কি বলবি?’
অদ্রি গলা ছেড়ে সরে বসল। তার হাত ধরে হেসে বলল,
-‘আমি না, কনফার্ম হয়ে গিয়েছি। এখন আর একদম কনফিউজড নেই।’
-‘কি ব্যাপারে।’
-‘তন্ময়ের ব্যাপারে।’
-‘আচ্ছা, কি কনফার্ম হয়েছিস?’
-‘আমি তন্ময়কে সত্যিই পছন্দ করি।’
এতটুকু হাসিমুখে বলে সে থামলো। মুহুর্তেই মুখে আঁধার জমলো। উদাস গলায় বলল,
-‘কিন্তু ও আমাকে পছন্দ করে কি-না আমি বুঝতে পারছি না। এটা কীভাবে বুঝব?’
রিমি মাথা নিচু করে হেসে ফেলল। বলল,
-‘তন্ময় যদি তোকে সত্যি পছন্দ করে, সত্যি-ই পছন্দ করে; তাহলে ও তোকে সেটা অনুভব করাবে ওর কাজ-কর্মে। ইউ নো, এক্ট অফ সার্ভিস। তো, তুই সময় নিয়ে দেখ। আর যদি তোর ওকে ভালো লাগে, ওর সাথে সময় কাটা। তন্ময়ের কথা-বার্তা আচার আচরণে বোঝার ট্রাই কর, ওর একচুয়াল ফিলিংসটা কেমন।’
-‘তবে আমি কি করে ওর সাথে সময় কাটাবো, ভাই? আমি কি এখন ওই লোকের আগে পিছে ঘুরঘুর করতে থাকবো নাকি? ছ্যাঁচড়া ভাববে তো!’
রিমি তার মাথায় চাটি মেরে বলল,
-‘তোকে সেঁধে কথা বলতে বা কিছু করতে বলেছি আমি? ওর সাথে দেখা হলে তুই এমন এমন কিছু করবি, যেটাতে ও ইন্টারেস্ট ফিল করবে। তখন নিজে থেকে সেঁধে কথা বলতে আসবে। দেখা গেল প্রেম-ট্রেমের প্রস্তাবও দিয়ে বসতে পারে। কে জানে!’
অদ্রি শুনলো। কিছুক্ষণ চুপও থাকল। রিমি তার হাবভাব বোঝার চেষ্টায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আচমকা অদ্রি খুব বোঝার মতোন মাথা ঝাঁকাল। সায় দিলো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। রিমি তাকিয়ে বলল,
-‘কি হলো?’
-‘চল, ক্লাসের দিকে যাই। ওঠ!’
রিমি উঠতে চাইল না। খুব শখ ছিল আজকের ক্লাস বাঙ্ক করে চটপটি খেতে যাবে। সে উঠলো না। অদ্রি শেষমেশ না পেরে হাত টেনে তাকে উঠালো। এরপর তার হাত জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-‘আচ্ছা, রিমি?’
-‘হু?’
-‘তুই প্রেমের ব্যাপারে এতকিছু কিভাবে জানিস?’
বলে একটু থেমে রিমির মুখের দিকে তাকালো। চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে বলল,
-‘প্রেম করছিস?’
থতমত খেলো রিমি। বলল,
-‘হ্যাঁ? না! প্রেম করলে জানতিস না তুই?’
কাঁধ ঝাঁকালো নিজের অদ্রি। বলল,
-‘হতেও পারে, চুপিচুপি প্রেম করছিস। আমাকে না জানিয়ে। পারে না?’
রিমি প্রচন্ড ঢং করে বলল,
-‘মোটেও না। আমি আজীবন সিঙ্গেল ছিলাম আর এখনও সিঙ্গেল আছি। এসব প্রেম ভালোবাসায় জড়িয়ে আমার জীবন এতো তাড়াতাড়ি আমি শেষ করবো না।’
-‘ফুল সেন্টেস শেষ করিসনি তো। যে, ভবিষ্যতেও তুই সিঙ্গেলই থাকবি, সিঙ্গেলই মরবি।’
রিমি চোখ পাকিয়ে তাকালো,
-‘বেয়াদব মেয়ে! তুই আমার ভবিষ্যৎ বরকে সন্ন্যাসি বানাতে চাচ্ছিস? এত খারাপ আমি না। বেচারা এলে আমি ফটাফট তিন কবুল বলে বিয়ে করে নেব।’
-‘জ্বি। তারপর সোজা বাসরে ঢুকে যাবি। তাই না?’
অদ্রি দৌড় দিলো বলেই। পরের স্টেপ জানা আছে তার। যেকোন সময় পিঠে ধরাম করে কিল-ঘুষি পড়বে। রিমি তার কথা বুঝতে সময় নিল। বুঝতেই ক্ষেপে গেল। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে বলল,
-‘অশ্লীল মহিলা!’
****
কয়েকদিন কাটলো। অদ্রি অনুভূতি গভীর হচ্ছে দিনকে দিন। সে এবার পুরোপুরি ভাবে শিওর যে—‘শি ইজ ইন লাভ’। তন্ময়ের প্রতি অনুভূতি নিছক ইনফ্যাচুয়েশন মনে হচ্ছে না। এর থেকেও তীব্র কিছু। অর্থাৎ, হয়তো ভালোবাসা।
তন্ময়ের মনে অদ্রিকে নিয়ে কৌতুহল হয়। একটা মেয়ে এতটা অ্যাক্টাটিভ কি করে হয়? অদ্রির চাল-চলন , বেশ-ভূষায় এতটা আকৃষ্ট হয় তন্ময়, বলার মতো নয়! তবে এগুলো স্রেফ তার মোহ নাকি অন্যকিছু বলে ধরবে সে? তার মনে অদ্রিকে নিয়ে ভাবনা এলে সে আচমকাই নিজে থেকে হাসে। এরপর খেয়ালে এলে হাসি থামিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায়। যখন দেখে কেউ দেখেনি তাকে, তখন তন্ময় আবারও হাসে। যদি তাকে এভাবে কেউ দেখে, ‘পাগল’ বলে আখ্যায়িত করতে দু’বারও ভাববে না।
****
অদ্রি ভার্সিটি থেকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরলো। টিউশনি নেই আজ। যাকে পড়ায়, সে টু তে পড়া একটা বাচ্চা। দাদু বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে বলে বাচ্চার মা তাকে আসতে বারণ করেছে ক’দিন৷
দুপুরে যখন অদ্রি বাড়িতে এল, বাড়ির দরজার সামনে কয়েকটা জুতো দেখলো। জুতোগুলো তাদের নয়। মানে বাড়িতে কেউ এসেছে। ভ্রু কুঁচকে আসে তার। নিজের পায়ে জুতো খুলে ভিতরে ঢুকলো। ড্রইংরুমের দিকে এগোনোর আগে, কারো গলার স্বরে থেমে গেলো ও। পা থমকে গেলো। কুঁচকে থাকা ভ্রু-দ্বয়ের ভাজ শিথিল হলো, সমান হলো। তখনই নাহারা ডাকলেন ওকে,
-‘অদ্রি! মা এদিকে এসো।’
অদ্রি চোখ খিঁচে নিল। তারপর স্বাভাবিক মুখ করে ড্রয়িংরুমের দিকে তাকালো। তন্ময় বসা। পাশে তার মা-বাবা। অদ্রি জোরপূর্বক হেসে এগিয়ে গেলো। সালাম দিলো। তন্ময়ের মা, নাইমুনা জিজ্ঞেস করলেন,
-‘কেমন আছো, সোনা?’
অদ্রি এবার হাসলো সামান্য,
-‘আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি কেমন আছেন আন্টি?’
-‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো আমার পাশে।’
অদ্রি একবার নিজের মা-বাবার দিকে তাকালো। এরপর ধীরগতিতে হেঁটে গিয়ে নাইমুনার পাশে বসলো। নাইমুনা আবারও বললেন,
-‘তোমাকে এতো দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না! তাই চলে এলাম। কতদিন দেখি না তোমাকে।’
-‘ভালো করেছেন আন্টি। আমারও আপনার সাথে দেখা করতে মন চাইছিলো। মাঝেমধ্যে তো আসতে পারেন।’
নাইমুনা হাসলেন তার কথায়। মেয়েটাকে তার বড্ড পছন্দ৷ সুন্দর নম্র-ভদ্র একটা মেয়ে। কার পছন্দ হবে না?
অদ্রি সরাসরি না চেয়ে আড় চোখে তন্ময়ের দিকে তাকালো। তন্ময়ও অদ্রির দিকে তাকিয়ে। চোখে চোখ পড়লে অদ্রি চমকাল। চোখ সরিয়ে নিলো ত্বরিতে। নাহারা এবার বললেন,
-‘তাহলে বিয়ের দিন-ক্ষণ কবে ঠিক করবি?’
নাইমুনা বললেন,
-‘তার আগে ছেলে-মেয়েদের কথা বলতে হবে তো এই নিয়ে। তাদেরও তো একটা মতামত আছে, তাই না?’
নাহারা আর অদ্রির বাবা মাথা নাড়ালেন,
-‘তা তো অবশ্যই আছে। তাহলে ওরা আগে কথা বলুক।’
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘কার বিয়ের কথা বলছো তোমরা?’
নাইমুনা হাসলেন। অদ্রির মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে বললেন,
-‘তোমার আর তন্ময়ের বিয়ের কথা, মা।’
~সমাপ্ত~