#লাস্ট_হোপ
#পর্ব৩
#কলমে_সুমনা
রুমের আলোটা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়ে এলো।
কণা জানালার পর্দাটা সরিয়ে বাইরে একবার তাকাল, তারপর বলল,
“আচ্ছা, চল সবাই নিচে যাই। আজকে তোমাদের একটু থিয়েটারের স্পেস দেখিয়ে দিই।”
সবাই আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।
তটিনী এখনও চুপ করে বসে, গালে হাত দিয়ে যেন কিছু ভাবছে।
ফারিয়া তার কানে মুখ লাগিয়ে আস্তে বলল,
“তটিনী ঠিক আছিস?”
তটিনী কিছু বলল না, শুধু মাথা ঝাঁকাল।
তবে ইরাদের মনে হলো, তার চোখে যেন জল চিকচিক করছে।
তারা নিচে নামতে নামতে কণা হালকা গলায় বলল,
“ইরাদ, তুমি কিন্তু মঞ্চে ভালো করবে। তোমার চোখে যে দ্বিধা আছে, সেটাই সবচেয়ে বড় শক্তি।”
ইরাদ একটু হেসে বলল,
“আপু, চোখের ভাষা বুঝে ফেললেন?”
কণা বলল,
“মানুষ চোখে অনেক কথা বলে। কিন্তু সব কথা বুঝতে গেলে কষ্টের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।”
হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“তুমি কি কখনও মঞ্চে অভিনয় করেছো?”
সবাই ঘুরে দেখল—এতক্ষণ যিনি চুপ করে ছিলেন, সেই আভা কথা বলেছে।
কণা একটু অবাক হয়ে বলল,
“আভা, তুমি আজকে অনেক কথা বলছো।”
আভা ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি রেখে বলল,
“তটিনীর জন্যই তো নাট্যচক্রে আসা। এখন তো উনার ছায়াতেই হাঁটতে হবে আমাদের।”
এই কথায় একটা অদ্ভুত ঠান্ডা নেমে এলো চারপাশে।
ইরাদ ঠিক বুঝতে পারল না, আভার কথায় প্রশংসা বেশি, না উপহাস।
————————
টিএসসির ছাদ থেকে দূরের সপ্তছায়া মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে ইরাদ। বড় একটা গাছের নিচে টাইলস করে বসার জায়গা বানানো।এক রত্তি রোদও নেই,এজন্যই জায়গাটার নাম সপ্তছায়া মঞ্চ। গাছতলায় বসে আছে রিদওয়ান চৌধুরী আর তার দলের ছেলেরা। সানভি একটু কেশে বললো,
“ভাই ক্যাম্পাসে তো এখন সবার সামনেই কিছু মশা আপনার ব্যাপারে যা তা বলে বেড়াচ্ছে।”
নীরব হুংকার দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“কোন মাদার*চোদ কি বলছে? তুই খালি নামটা বল সানভি।”
রিদওয়ান চৌধুরী নীরবের হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,
“ডু ইউ নো নীরু,অ্যা ফেমাস প্রোভার্ব ইন আওয়ার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ?”
সানভি কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই রিদওয়ান মুচকি হেসে বলে উঠল,
“পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। বলতে দে তোরা। সংবিধানেই তো বলা আছে বাকস্বাধীনতা সবার অধিকার। বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হয়ে যদি সংবিধান না মানি তোর নানারা কি মানবে? জবান থাকলে স্বর তো বেরোবেই।”
সানভি বলে উঠল,
“তাহলে জবানটাই শেষ করে দিই?”
রিদওয়ান হো হো করে হেসে উঠলো। পরক্ষণেই বলল,
“মাত্র তো আওয়াজ তুলেছে আরেকটু বাড়তে দে। সাহসী রমণীর সাহস আগুনের হল্কার মতো দাউ দাউ করা লাল ধ্বংসময়ী হয়ে উঠুক। সব জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়ার জন্য আগে নিজেকে তৈরি করুক,তারপরেই তো রাক্ষসের আগমনী সুর বাজবে।”
ঠোঁট দুটো কিঞ্চিত সংকুচিত করে চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
“রাক্ষসের দেখা পাওয়ার জন্যও কঠোর তপস্যার আর পরিশ্রমের প্রয়োজন। কালকে থেকে তোরা কুমড়ার বীজ খাবি তোদের মাথায় ঘিলুর বদলে গু জমে আছে।”
রিদওয়ানের কথা শুনেই দলের ছেলেরা সমস্বরে হেসে উঠলো।
——————-
টিএসসি থেকে বের হয়ে উত্তর দিকে হাঁটছে তটিনী। টারজানের ফুচকার দোকানগুলোতে ভিড়, দুপাশে সাড়ি সাড়ি গাছ। একটু সামনেই মেয়েদের আবাসিক হল। দূর থেকে একটা অবয়ব এগিয়ে আসছে, অবয়বটি আবছা থেকে স্পষ্ট হতেই তটিনীর কুন্চিত ভ্রুযুগল আপনা আপনি সোজা হয়ে গেল। তটিনীর পায়ের গতি হঠাৎ থেমে গেল। সময় যেন জমে গেল। মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো দুটি শব্দ — “প্রফেসর রায়ান..”
চলবে…?
#লাস্ট_হোপ
#পর্ব৪
#কলমে_সুমনা
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ভার্সিটির দোতলার করিডোরে ছায়া লম্বা হয়ে পড়ছে। নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু ছেলেমেয়ে, কেউ গল্পে মশগুল, কেউ একা একা হাঁটছে।
রায়ান আহমেদ তার অগোছালো কেবিনে বসে। জানালার পর্দা অর্ধেকটা সরে গেছে। বাঁ হাতের তালুতে ভর দিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে সে, চোখ জুড়ে ক্লান্তি, কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। হঠাৎ করে করিডোরের এক কোণ ঘুরে হেঁটে আসে ইরাদ। ফর্সা গায়ের রং, সাদা-কটন টপস, হালকা নীল জিনস, কাঁধে ব্যাগ—চোখে একটা প্রশ্নবোধক অভিব্যক্তি। যেন চারপাশের কিছু খুঁজছ। তার হাঁটার মধ্যে অস্থিরতা নেই,পাশাপাশি হাঁটছে ফারিয়া।
রায়ান উঠে বসে। চোখদুটো কপালের ওপর টিকিয়ে দেয়। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো অভিব্যক্তি—হয়তো বিস্ময়, হয়তো চিন্তা। এক সেকেন্ডের জন্য সে জানালার কাচে আঙুল রাখে। তারপর চুপচাপ বলে ওঠে—
“চোখে দ্বিধা থাকলে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না। ওরা সত্য খুঁজে পায়।”
ঘরে তখন হালকা পারফিউমের গন্ধ, আর দেয়ালের ঘড়িটা ঠিক দুপুর ১২টা ০৩ মিনিটে থেমে আছে—অচল।
ওদিকে নিচে, ইরাদ ছায়ার ভেতর হাঁটছে। হয়তো জানে না, এই মুহূর্তে তাকে গভীরভাবে দেখছে একজন, যে দেখতে জানে… ভয়ঙ্কর ভালোভাবে।
—————————–
সবুজে মোড়া ক্যাম্পাসের মাঝখানে যেন একান্ত নির্ভরতার মতো দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনারটি। ৭১ ফুট উঁচু স্তম্ভগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ছায়াঘেরা গাছ, বাতাসে কোকিলের ডাকে যেন সময়ও থমকে যায়। বেলা দুপুরের দিকে মিনারের পিচঢালা সিঁড়িগুলো রোদের আলোয় ঝিকমিক করে ওঠে। আর সন্ধ্যাবেলায় চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে হলুদ-কমলা আলো, মৃদু বাতাসে পতপত করে ওড়ে কিছু অদেখা প্রতিজ্ঞার পতাকা। শহীদ মিনারটি শুধু পাথরের স্থাপনা নয়, এটি জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রদের এক গভীর আত্মপরিচয়ের প্রতীক। শহিদ মিনারের সিঁড়িতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে রিদওয়ান চৌধুরী। সাথে সানভি,নীবর আর দলের বাকি ছেলেরা। সানভি নরম গলায় ডাকল,
“ভাই।”
রিদওয়ানের কোনো হুঁশ নেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। প্রায় পাঁচবার ডাকার পর এক হাতে একটু হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাকছে সানভি।
“কি ভাবছেন ভাই?”
রিদওয়ান সেদিকে তাকিয়েই ভরাট কন্ঠে বলল,
“চল একটু কাউকে জয় বাংলা ডোজ দিয়ে আসি।” বলেই সামনে মুরাদ চত্বরের চা কুঞ্জে বসে থাকা সাদাবাহারীর দিকে এগিয়ে গেল রিদওয়ান। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে ইরাদ। হালকা করে ফুঁ দিচ্ছে যেন একটু জোরে দিলেই চা গড়িয়ে পড়বে, পরক্ষণেই নিজের গোলাপী অধরে চায়ের ভাঁড় ঠেকিয়ে চুমুক দিচ্ছে। ইরাদ চা খাওয়া শেষে চায়ের ভাঁড় ফেলে দিতেই রিদওয়ান চায়ের ভাঁড়টি কুড়িয়ে নিয়ে নীরবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“চুপচাপ ধরে থাক সান্ডার নাতি। নয়তো এমন থেরাপি দেব আন্ডা পাড়তে বসে পড়বি।”
রিদওয়ান এক পা সামনে এগিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে দলের বাকি ছেলেদের বলে উঠল,
“সবগুলো চোখ বন্ধ কর। তোদের গরুর মতো চোখ দিয়ে আমার অপ্সরাকে দেখলে ও অপবিত্র হয়ে যাবে।”
রিদওয়ানের কথায় বিষম খেল ইরাদ। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,
“এই ছেলে এইসব কি বলছেন আপনি? মেয়ে দেখলেই ইভটিজিং করতে ইচ্ছে করে তাই না? আরেকবার যদি কিছু বলেছেন তাহলে কিন্তু থানায় গিয়ে দিয়ে আসব। ২ বছর বসে বসে জেলের ভাত খাবেন।”
ফারিয়া এতক্ষণে ধাতস্থ হয়ে ইরাদের হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। সানভি একটু প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বলল,
“কিন্তু ভাবি সাহেবা, জেলে তো রুটি দেয়।”
রিদওয়ান কঠিন স্বরে বলল,
“চুপ কর বেয়াদব। আমার জন্য আমার অপ্সরা নিজে হাতে ভাত রেঁধে দিবে।”
ইরাদ ধৈর্য্য এবার তার সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলল। চিৎকার করে বললো,
“জেলে যাবেন..বিয়ে বাড়িতে না যে মেন্যু ঠিক করছেন। অসভ্য কোথাকার।”
ফারিয়া এবার ইরাদের হাত টানতে টানতে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ইরাদ, চল। তুই কিছু বুঝিস না।”
ইরাদ যেতে যেতেই আরেকবার রাগী চোখে রিদওয়ানেরা দলবল সহ হো হো করে হেসে উঠলো।
চলবে…?