#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫২
আফনান লারা
.
প্রতিটা রুমে ড্রিম লাইট জ্বলা।ফরহাদের রুমে সবুজ বাতি,জুথির বাবার রুমে লাল বাতি,ওর দাদা দাদির রুমে হলুদ বাতি।
সবগুলো রুমের বাতি চেক করে মৃদুল দেয়ালের সাথে লেগে লেগে রান্নাঘরে ঢুকেছে।জুথি ও ওর পিছু পিছু এসে রান্নাঘরের আলো জ্বালিয়ে বললো,’এরকম নাটকের কি আছে বুঝতে পারছিনা।আপনি কেন এমন ব্যবহার করেন?কি চাইছেন টা কি আপনি?’
মৃদুল একটা পাতিল হাতে নিয়ে বললো,’নুডুলস চাইছি।কোন শেল্ফে রাখলে?’
জুথি বিরক্ত হয়ে প্যাকেট খুঁজে দিয়েছে।মৃদুল দাঁত দিয়ে কামড় প্যাকেট খুলে ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিয়ে তাকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’আজকে তোমায় এমন নুডুলস খাওয়াবো সারাজীবন আমার তারিফ করে যাবে উন্মাদের মতো’
‘আমি উন্মাদ হতে চাইনা’
‘হতে হবে।মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক লাইফ থেকে রক্ষা পেতে উন্মাদ হতে হয়।পেঁয়াজ,মরিচ আর ডিম এনে দাও এখন।ফটাফট দি গ্রেট মৃদুল শেফ নুডুলস রাঁধবে।ইউ আর এডভান্স ওয়েলকাম ‘
‘আপনি একটা পাগল!’
কথাটা বলে জুথি পেঁয়াজ,মরিচ আর ডিম এনে রেখে চলে গেলো।মৃদুল তার মতন করে রান্না শুরু করেছে।
জুথি বাবার রুমের উপর নজর রাখছিল।বাবা যদি একবার জেগে যায় তাহলে সর্বনাশ।ওদিকে মৃদুল হঠাৎ মা বলে চিৎকার করে বসেছে।
জুথি মুখে হাত দিয়ে আগে বাবার আর ফরহাদের রুম চেক করলো।মৃদুলের চিৎকারে তারা কেউই জেগে যায়নি।সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়েছে।
এবার সে রান্নাঘরে আসলো মৃদুলকে বকবে বলে, এসে দেখলো মৃদুল হাত নাড়ছে আর ফু দিচ্ছে।চোখে পানি ঝলঝল করছিল তার।জুথি তা দেখে ছুটে এসে বললো,’হাতে ছ্যাঁকা লেগেছে?’
‘হ্যাঁ।নুডুলস সেদ্ধর গরম পানিকে ঠাণ্ডা পানি মনে করে হাত চুবিয়েছিলাম’
জুথি গাল ফুলিয়ে ওর হাত ধরে ভেসিনের কাছে নিয়ে পানির নিচে হাত ধরে রাখলো।মৃদুল নাক টেনে বললো,’তোমার পথ চেয়ে থাকতে গিয়ে আজ আমার এই হাল হলো।আর কত কষ্ট দেবে?’
‘যার কাছে কষ্টের অভাব নেই।সে আবার আগ বাড়িয়ে কিসের কষ্ট দেবে?’
মৃদুল গায়ের নীল টি শার্টটাতে হাত মুছে আবারও ফু দিতে দিতে বললো,’উহঃ কি জ্বালা।মরে যাব’
জুথি তার রুম থেকে ওয়েন্টমেন্ট খুঁজে এনে ওকে ধরে সোফায় বসিয়ে অন্ধকারে মলমটা লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,’আপনি সব কিছু অতিরিক্ত করেন।যেটা আমার পছন্দ না’
‘আমার কোন দিকটা তোমার ভাল লাগে?সবটাই তো অপছন্দের তালিকায় লিখে যাচ্ছো, ওয়ান বাই ওয়ান।’
জুথি মলম লাগিয়ে উঠে রান্নাঘরে এসে নুডুলসের বাকি কাজটা করায় মন দিয়েছে।মৃদুল অন্ধকারে দেয়াল ধরে ওর পিছু পিছু চলে আসলো রান্নাঘরে।জুথি তার চুলে খোঁপা করে একটা বড় ক্লিপ দিয়ে চুলগুলোকে দমিয়ে রেখেছে।মৃদুল এক দৃষ্টিতে সেই খোঁপাটাই দেখছিল।ইচ্ছে করে গিয়ে ক্লিপটা খুলে দিতে।সেটা করলে জুথি খুব মারবে।সে ভয়ে এগোলো না।
নুডুলস বাটিতে নিয়ে জুথি ওকে রুমে আসতে বলে চলে গেছে
।মৃদুল বললো,’কফি?’
জুথি জবাব দেয়নি।বাটি এনে নিজের বিছানায় রেখে ওকে বসতে বলে আবারও রান্নাঘরে চলে গেছে।নুডুলসে দুবার ফু দিয়ে মৃদুল জুথির পুরো রুমটা দেখছিল চোখ বড় বড় করে।
স্বাভাবিকভাবে বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ের রুম যেমন হবার কথা তেমনই।সাজসজ্জায় পরিপাটি। নামি দামি আসবাব।
গোলাপি রঙের রুম,গোলাপি রঙের বিছানার চাদর,একশোটা টেডি বিয়ারের ছড়াছড়ি,কিছু কিছু পিচ্চি,কিছু কিছু দানব টাইপের।বিছানায় ছোট বালিশের অভাব নেই।পুরোটা দেখে নুডুলস এক চামচ মুখে দিয়ে মৃদুল ভাবলো জুথিকে ডাকতে যাবে।সেসময়ে ও নিজের বাটি নিয়ে এসে মৃদুলের সামনে চেয়ার টেনে বসে বললো,’কফির গরম পানি বসিয়ে এসেছি।খাচ্ছেন না কেন?যেটার জন্য এত কিছু এখন সেটাকে ঠাণ্ডা হতে ফেলে রেখেছেন?’
‘অনেক গরম।ভাগ্যিস বাম হাতে পুড়েছে নাহলে এখন তোমায় আমাকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা নিতে হতো’
‘আপনি আমায় পছন্দ করেন?’
মৃদুল হেসে নুডুলস মুখে দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসেছে।জুথি প্রশ্নটা আরও একবার করলো।মৃদুল এবার ওর দিকে ফিরে বললো,’বললে সিঙ্গাপুর যাবেনা?’
‘আমি না গেলে আপনার অনেক লাভ হবে?আমার থেকে এত ইগনোরেন্স পাবার পরেও আপনার এত ভালো লাগা কই থেকে আসে?আমার মাঝে আপনি কি পেলেন যেটা অর্ণব পায়নি??’
‘সে কি করে পাবে?সে খোঁজার সময়ে তো রেডি করা একজনকে পেয়ে গেছে যার নাম তার নামের সাথে জুড়ে ছিল আগে থেকেই।খুঁজতে বেরিয়েছি তো আমি নিজেই’
‘আমি এসব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।সিঙ্গাপুর যাওয়া ক্যানসেল করতে পারবোনা কোনো মতেই।আমাকে যেতেই হবে।আপনি প্লিজ আমায় মায়ায় জড়াবেননা।এমনিতেও জীবনে আমার ভাঙ্গা টুকরো ছাড়া আর কিছু বাকি নেই।আমি আর ভেঙ্গে যেতে চাইনা।’
‘আমার ব্যবহারে তুমি ভেঙ্গে যাবে?’
জুথি কিছু বললোনা আর।আবারও চুপ হয়ে আছে।নুডুলসটা কয়েক চামচ খেয়ে মৃদুল চলে যাওয়া ধরতেই জুথি ছুটে এসে বললো,’কফি হতে আর কয়েক মিনিট লাগবে।’
ওর কথা শুনে মৃদুল বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো,গেলোনা।কিন্তু রুমের ভেতর যাবেনা বলে ঠিক করেছে।
—–
বাসায় ফেরার পর কুসুম একবারের জন্য একটু বিছানায় শুয়ে ছিল।ভেবেছে অর্ণব মুখ ধুয়ে বেরুলেই ওর সাথে বসে রাতের খাবারটা খেয়ে নেবে।কিন্তু পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে তার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসলো।অর্ণব ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে আর জাগালোনা।রুমের আলো নিভিয়ে বাহিরে গিয়ে খাবারের ঢাকনা সরিয়ে তাকিয়ে রইলো।কুসুম খায়নি বলে ওর নিজেরও খেতে ইচ্ছে আসলোনা।পুনরায় খাবারটা ঢেকে রুমে এসে দেখলো কুসুম বিছানার মাঝখানে এসে ঘুমায়।আস্তে করে বালিশটা নিয়ে অর্ণব অন্য রুমে চলে গেছে।এখন থেকে আলাদা শোবে।বাবার বাড়িতে বাধ্য হয়ে কুসুমের সাথে ঘুমাতো।এখন আর টানাপোড়ন নেই।শান্তিতে চোখ বুজে শুয়ে পড়লো সে।
—
কুসুম গভীর রাতে দুইটা বিশ মিনিটের সময় হঠাৎ জেগে গিয়েছিল ঐ শিয়াল গুলোর কেমন একটা গা হিম করা আওয়াজে।ভয়ে সারা শরীর কাঁপছিল তার।
পাশে হাতিয়ে অর্ণবকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ভয়টা আরও বেশি করে লাগলো।ব্যস্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে ছুটে গেলো রুমের বাহিরে।দরজা ভেতর থেকে লাগানো দেখে স্বস্তি পেলো কিছুটা।তারপর পাশের রুমটাতে গিয়ে দেখলো অর্ণব ওখানে ঘুমাচ্ছে।
কুসুম বুঝলো সে একসাথে ঘুমাতে চায়না।আজ হঠাৎ অর্ণবকে আলাদা ঘরে এসে শুতে দেখে চোখ জুড়ে অশ্রুতে টলমল হয়ে গেছে কুসুমের।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে পিছিয়ে গেলো সে।
অর্ণব কেন তাকে এত অপছন্দ করে ভেবে অনেক কান্না আসলো।অন্ধকারে পিছোতে গিয়ে ওখানে থাকা একটা ছোট টেবিলরে সঙ্গে ধাক্কা লেগে আওয়াজ হলো সামান্য ।সেই আওয়াজে অর্ণব জেগে গেছে।কুসুম ওকে জেগে যেতে দেখে চলে গেলো তার রুমে।অর্ণব উঠে বসে বললো,’কুসুম?’
কুসুমের কোনো সাড়া নেই দেখে রুমের আলো জ্বালিয়ে অর্ণব বের হয়ে দেখলো কুসুম তার রুমের বিছানায় অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে।ও যে এখানে এসেছিল তা অর্ণব ড্রিম লাইটের আলোয় দেখেছিল।তবে ছুটে চলে যাবার কারণ কি।
সন্দেহ হওয়ায় অর্ণব ওর কাছে এসে বললো,’আমার রুমে এসেছিলে কেন?’
কুসুম জবাব দিচ্ছেনা।নিরবে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতেছে ধীরে ধীরে।অর্ণব ওর নড়াচড়া দেখছিল।
তাই এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে এক টান দিয়ে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো সে।দেখতে পেলো তার সারা মুখে পানি।চোখ লাল হয়ে আছে।বারবার করে মুখ মুছে যাচ্ছিল সে।
‘আজব তো।এত রাতে কাঁদতেছো কেন?’
‘কই!আমি কাঁদতে যাব কেন?’
কথাটা বলেই কুসুম কেঁদে ফেলেছে।অর্ণব ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,”আমাকে ঐ রুমে দেখে এসে কাঁদছো।ওহ আচ্ছা! এবার বুঝতে পারলাম।আমি আলাদা রুমে শোয়ায় তোমার খারাপ লেগেছে?তুমি কি জানো তুমি বিছানার মাঝখানে এসে শুয়ে ছিলে?আমার জন্য কোনো জায়গা ছিলনা।আর এখন এত রুম থাকতে আমি কেন তোমার সাথে শুতে যাব?’
কুসুম কেঁদে কেঁদে বললো,’চলে যান।আমি কি বলেছি শুতে?আমার কষ্ট আমি গিলে খাব।কারোর স্বাদ নিতে হবেনা’
‘আবার বড় বড় কথা!যাও কোণায়।আমি বালিশ নিয়ে আসতেছি।রোগীরে কাঁদালে পাপ হবে আমার।এমনিতেও বহুত মানুষরে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।পাপ পাকা করতে চাইনা’
কথাটা বলে অর্ণব গিয়ে বালিশ নিয়ে আসলো ঐ রুমটা থেকে।কুসুম কিণারায় গিয়ে বসে দেখছিল সব।আলো নিভিয়ে অর্ণব ওর পাশেই শুয়ে পড়েছে।এবার কুসুমের কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো।মুখে হাসি ফুটলো তার।
অর্ণবের গায়ের এক অদ্ভুত গন্ধ তার চোখের পানি শুকিয়ে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে দিলো হঠাৎ করে।
ইচ্ছে করলো ঐ গন্ধটা পেতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু এত সাহস নেই।
একটু কাছে এগিয়ে এসে কুসুম অর্ণবের একদম কাছে শুয়ে পড়েছে।কত কি ইচ্ছা করছিল।কিছুতেই কোনো কিছু করার সাহস জোগাতে পারছিলনা সে।
শেষে অর্ণবের পাঞ্জাবিটা একটুখানি খাঁমছে ধরে চোখ বন্ধ করলো সে।অর্ণব টের পেয়েছে কুসুম যে তার পাঞ্জাবি ধরেছে কিন্তু তাও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালোনা।কয়েকটা দিন ধরে ওকে কষ্ট দিতে পারা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘খুব মায়া হয়।এই মায়ার বলে আগেকার অর্ণব সম্পূর্ন বদলে গেছে।যেন সে কুসুমের সব কথা মানতে প্রস্তুত। অথচ এটা আমি কখনও চাইনি।আমি তো ওকে অপছন্দ করি,তাহলে কেন এত টান কাজ করে।কেন এত মায়া লাগে?’
—-
কফির মগ হাতে মৃদুল অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়েছিল।জুথি ওর পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কফি খাচ্ছে।কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছেনা।শেষে কফির শূন্য মগটা নিচে রেখে মৃদুল চলে যাবার জন্য উদ্ধত হতেই জুথি এগিয়ে এসে বললো,’যদি কষ্ট দিয়ে থাকি তবে মাফ করে দেবেন?’
মৃদুল সেসময়ে বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলছিল।জুথির কথা শুনে এক হাত এগিয়ে ওর কানের কাছে নিয়ে গলা স্পর্শ করে চুলের ক্লিপটা খুলে দিয়ে হাতটা আবারও নিয়ে আনলো।জুথি চোখ বন্ধ করে ছিল।মৃদুল রোডে নেমে মুচকি হেসে বললো,’বলছিলাম না!দারুণ অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো?’
চলে গেলো সে।জুথি তার কানের কাছে হাত রেখে ওর চলে যাওয়া দেখছে।কানের ঐ জায়গা কেমন শীর শীর করছে।যেন হাতটা এখনও লেগে আছে।বাতাসে ওর চুল উড়ছিল আপন স্থিতিতে।সেই স্পর্শ যেন নড়ছেনা।জুথি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
‘মৃদুল কেন এমন একটা শাস্তি দিয়ে গেছে রাতের এই অসময়ে?কিসের শত্রুতা ছিল?আমাকে দূর্বল করাই কি তার লক্ষ্য?’
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫৩
আফনান লারা
.
গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েরা সবসময় ভোরবেলায় উঠে পড়ে।কুসুম ও পারতো।কিন্তু রাতে মাথা যন্ত্রনার সঙ্গে যুদ্ধ করে তার ঘুম আসতে ভোর হয়ে যায়।তাই আটটা অবধি ঘুমিয়ে থাকে অনেক সময়।তো এই ভোরে অর্ণব ওঠার পর ওকে দুবার ডেকে সে নামাজ পড়তে চলে গেছিল।নামাজ পড়ে এসে দেখলো এখনও আগের মতন শুয়ে আছে।নড়ছেনা।
অর্ণব একটু কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,’তোমার কি পড়াতে মনযোগ নেই?তবে আমাকে দিয়ে বই আনালে কেন?’
কুসুম যেন অনেক কষ্টে তার চোখ খুলেছে।বিছানায় হাত রেখে আস্তে করে উঠে বসে বললো,”আমার শরীর খারাপ লাগে।আচ্ছা আমি বই নিচ্ছি ‘
এই কথা বলে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে কুসুম মুখ ধুতে চলে গেছে।অর্ণব বইগুলো আগের জায়গায় রেখে দিয়ে ভাবছিল হয়ত ওকে ওঠানো ঠিক হয়নি।
কুসুম মুখ ধুয়ে এসে বললো,’নিন শুরু করুন’
‘নাহ।ঘুমাও।শরীর খারাপের ভেতর পড়ায় মন বসবেনা তোমার’
কুসুম ওর কথা যেন শুনেইনি।বই নিয়ে বসে পড়েছে বিছানার মাঝ বরাবর।অর্ণব সামনে বসে ওকে প্রথমে এক থেকে দশ পর্যন্ত শেখানো শুরু করেছে।
কয়েকটা পড়ে কুসুম বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছিলো।অর্ণবের সঙ্গে পড়াতে তাল মেলাতে পারছিলনা।অর্ণব সেটা বুঝতে পেরে বই বন্ধ করে ওকে শুয়ে পড়তে বলে।
সাথে সাথে কুসুম শুয়েও পড়ে।তার নিজেরই সহ্য হচ্ছিলনা এত অস্বস্তি।
কালকের সেই ডাক্তারের নাম্বারে অর্ণব কয়েকবার কল করলো।কিন্তু তিনি রিসিভ করলেন না।এদিকে কুসুম কেমন কেমন করছে।
অর্ণবের ভীষণ ভয় লাগছে।ওর পাশে বসে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করেছে কি কষ্ট হয় তার।
কুসুম শুধু বললো মাথা ব্যাথা।
অর্ণব ওর চুলে হাত দিয়ে টানতে গিয়ে ওর মনে পড়ে গেলো চুল সব উঠে চলে আসবে।তাই আস্তে আস্তে ওর কপাল টিপছে সে।কুসুম এক হাতে ওর পাঞ্জাবিটা ধরে ছিল আর চোখ বন্ধ রেখে জিকির করছিল অনবরত।
হঠাৎ করে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়বে তা অর্ণব ভাবতেও পারেনি।
কুসুমের কষ্ট দেখে তার নিজের মনের শান্তিই গায়েব হয়ে গেছে।
বেশ কিছুক্ষন মাথা টিপে দেবার পর অর্ণব যখন বুঝেছে কুসুম ঘুমে তখন সে আলতো করে নিজের পাঞ্জাবি থেকে ওর হাত সরিয়ে নামলো বিছানা থেকে।খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
কাল রাতের খাবার এতক্ষণে নষ্ট হয়ে গেছে মনে হয়।সেটা আর মুখে দেওয়া যাবেনা।এদিকে তরকারি সব কালকের আনা।
রান্না না করলে ওগুলোও নষ্ট হবে।ঘরে তো ফ্রিজ নেই।বাধ্য হয়ে সে নিজেই রান্নাঘরে প্রবেশ করেছে।উদ্দেশ্য পরোটা আর ডিম ভাজবে।কাল আটার বদলে ময়দা নিয়ে এসেছিল সে যার কারণে এখন পরোটা বানাবে।বুদ্ধি করে হাঁড়ি পাতিলের সাথে তাওয়াও এনেছিল তা নাহলে এখন রুটি পরোটা কিছুই খাওয়া হতোনা।ময়দা পানি সব একসাথ করে তুলকালাম বাঁধিয়ে কোনোরকমে তিনটা পরোটা বানাতে সে সফল।এখন বাকি রইলো ডিম ভাজি।হোটেলে খেতে গেলে রাঁধুনীকে ডিম ভাজতে সে অনেকবার দেখেছে।সেরকম করে কাঁচা মরিচ কুচি কুচি করে ডিমটাকে চামচ দিয়ে নড়াচড়া করে দিয়ে দিলো কড়াইয়ে।
হাত পুড়ে -টুড়ে সব সম্পন্ন করেছে সে।
দম ফেলে এবার সব এক এক করে টেবিলে এনে রাখছে।কিরকম বিশ্ব জয়ের মতন ফিল ফিল হচ্ছে মনের ভেতরে।এবার দেখতে হবে কুসুমের কাছে খাবারটা কেমন লাগে।
‘এ্যাই কুসুম উঠো।সকাল আটটা বাজে’
কুসুম আচমকা ভয় পেয়ে উঠে পড়েছে।অর্ণবের মনে ছিলনা ওর অসুস্থতার কথা।দেরিতে মনে আসায় জিভে কামড় দিয়ে চেয়ে আছে সে।
কুসুম প্রথমে ঝাপসা দেখছিল পরে চোখ ডলে বললো,’বেশি সকাল হয়ে গেলো বুঝি?’
অর্ণব মাথা নাড়িয়ে বললো,’হালকা কিছু খাবার রেডি করেছি।খেতে এসো।মাথা ব্যাথা কমছে?’
কুসুম মাথায় হাত দিয়ে মুখটা কালো করে বললো কিছুটা।এরপর ওর সাথে রুমের বাহিরে টেবিলের কাছে এসে পরোটা আর ডিম ভাজির হাল দেখে জিজ্ঞেস করলো এগুলো কি সে নিজে বানিয়েছে।অর্ণব পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে উত্তরে বললো,’আর কে করবে?’
কুসুম হাসি মুখে চেয়ারে বসে পরোটা দিয়ে ডিমের টুকরো মুখে দিয়ে চিবাতে গিয়ে চোখ কপালে তুলে ফেলেছে।অর্ণব ওর পাশে বসে বললো,’কি হলো?স্বাদ কেমন?লবণ বেশি হলো বুঝি?’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে জানালো সব ঠিক আছে।অর্ণবের ওর এমন ব্যবহারে সন্দেহ হওয়ায় সে নিজেও এক টুকরো মুখে দিলো।দিয়ে বুঝতে পারে ডিমের খোসা সমেত ভাজি করেছে সে।কিরকম একটা বিদঘুটে স্বাদ।লবণ কি বেশি দেবে!!লবণের ছিঁটেফোটাও দেয়নি।
থুথু করতে করতে সে ছুটলো রান্নাঘরের দিকে।কিন্তু কুসুম বসে বসে ডিমের ভেতর থেকে খোসার টুকরো গুলো বের করে এক পাশে রেখে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শুরু করেছে।
ওর খাওয়া দেখে অর্ণব অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।তার নিজের কাছে খারাপ লাগলো অসুখের মাঝে এমন বিচ্ছিরি একটা খাবার কুসুমকে খেতে দিয়ে।তাই পকেটে হাত দিয়ে বাহিরে যাচ্ছিল কিছু খাবার কিনে আনতে।কুসুম ওকে থামতে বলে জানালো তার পেট ভরে গেছে।সে যেন শুধু নিজের জন্য খবার আনে।
অর্ণব চলে যাবার পর কুসুম বারান্দায় গিয়ে দেখছিল ও কি করে।বারান্দাটা দিয়ে সামনের বাজারটা সম্পূর্ণ দেখা যায়।অর্ণব অর্ডার দিকে যেইনা পেছনে তাকালো,কুসুমকে ওখানে দেখতে পেয়ে একটা চিপসের প্যাকেটে হাত রেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো খাবে কিনা।কুসুম আনতে মানা করেছে।
খাবার কিনে বাসায় এনে নাস্তা করে অর্ণব মৃদুলকে ফোন দিয়ে জানালো সে আজ ভার্সিটিতে আসবেনা।কুসুমের শরীর ভালোনা।ওকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা।
মৃদুল রাজি হলো।সে রেসাল্ট ফোনে জানিয়ে দেবে বলেছে।আর নয়ত অর্ণব নিজেই নেট থেকে বের করতে পারবে।
এদিকে বাবা মা কুসুমের শরীর খারাপের কথা শুনে তারা নাকি ঢাকার জন্য রওনা হয়েছেন।এমনিতেও তারা আসবেন বলে ঠিক করেছিলেন আগেই।
উনারা আসতেছেন শুনে কুসুম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কি রান্না করবে, কি করে সব সামলাবে সেটা ভেবে।অর্ণব আরামসে শুয়ে ছিল।কুসুম ওর কাছে এই নিয়ে পাঁচবার ছুটে এসে একই কথা বলেছে,’একটা মুরগী কিনে আনেন’
শেষে অর্ণব মাথা তুলে বললো,’তোমার অসুখ।আমার মুড নেই রান্না করার,পারিওনা।আমার হাতের ঐ অখাদ্য আমি বাবা মাকে খাওয়াতে পারবোনা।টাকা আছে পকেটে।বাহিরে থেকে কিনে আনবো’
কুসুমের খারাপ লাগলো।নিজের হাতে রাঁধতে পারলে হয়ত মনে মনে অনেক ভাল লাগতো।বাহিরের খাবার উনাদের খাওয়ানো ঠিক না।
এদিকে শরীর খারাপ হওয়ায় ঠিকমত দাঁড়াতেও পারছেনা সে।
এক রাশ মন খারাপের ঝুড়ি নিয়ে জবা ফুল গাছটার কাছে এসে বসে রইলো।অর্ণব ওকে নিরবে চলে যেতে দেখে পিছু নিয়েছিল।ওকে ওমন করে বসে থাকতে দেখে বললো,’আচ্ছা আমি বাজার করে আনবো,তারপর রাঁধবো।তুমি শুধু দেখিয়ে দেবে।হাত লাগাতে পারবেনা।রাজি?’
কুসুম যেন বিরাট আশার আলো খুঁজে পেয়েছে।চট করে বসা থেকে উঠে গিয়ে বললো আমি রাজি।অর্ণব আর কি করবে উপায়ান্তর না পেয়ে বাজার করতে চলে গেছে।
—–
আজ ভার্সিটিতে মৃদুল আসার পর থেকে জুথিকে খোঁজার চিন্তা মাথায় আনেনি।অনেক অনেক ব্যস্ত সে।রেসাল্ট নিয়ে এক প্রকার দৌড়াদৌড়িতে আছে।
কিন্তু আজ ঘটলো উল্টো ঘটনা।জুথি নিজে মৃদুলকে খুঁজছে।তার কারণ হলো,কাল রাতে ওর হাত পুড়ে যাওয়ায় হাতের ঘড়িটা খুলে রেখে গিয়েছিল জুথির বিছানায়।জুথি সেটা ফেরত দিতে এখন ব্যস্ত হয়ে ওকে খুঁজে যাচ্ছে।
আজ অনেক ভীড়।সব স্টুডেন্ট একজোট হয়েছে রেসাল্ট নিয়ে গবেষণা করতে।মৃদুলকে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।হঠাৎ এই ভীড়ের মাঝে আদিলের সাথে দেখা হয়ে গেলো তার।
স্বাভাবিক ভাবে আদিলের কাছে মৃদুল,অর্ণব আর তমালের সব খবর থাকে।জুথি তাই ওর কাছেই জিজ্ঞেস করলো।আদিল জুথিকে ভাল করে একবার দেখে নিয়ে বললো,’এতদিন না আপনি অর্ণব ভাইয়ার খবর নিতেন?এখন মৃদুল ভাইয়া কেন?’
জুথি বিরক্ত হয়ে বললো,’তোমার কি তাতে?’
‘বলছিনা।সুন্দর করে বললে তারপর বলবো মৃদুল ভাইয়া কই’
জুথি বিনয়ের সহিত বললো,’আদিল ভাই আমার।প্লিজ বলবে মৃদুল ভাইয়া কোথায়?’
‘কোথায় আবার!ডিপার্টমেন্টেই আছে’
‘আমি চার তলা উঠতে পারবোনা।পায়ে ব্যাথা।
একটু গিয়ে ডেকে আনো না প্লিজ।আচ্ছা এক কাজ করো, ধরো এই ঘড়ি।ওনাকে দিয়ে দিও’
‘আপনার যেমন চার তলা উঠতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা হয় আমার ও ব্যাথা হয়।তবে সেটা বুকে।তাই আমিও উঠছিনা।আপনি গিয়ে দিয়ে আসুন।বাই’
আদিল চলে গেলো।জুথি কোমড়ে হাত দিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছিল সেসময়ে উপরে চার তলায় হঠাৎ করিডোরে মৃদুলকে দেখলো গ্রিলে হাত রেখে ফেনে কার সাথে যেন কথা বলছিল।জুথি হাত নাড়িয়ে কয়েকবার ইশারা করতেই মৃদুল ওকে দেখতে পেয়েছে।তাই সেও ইশারা করে বললো সে আসছে এদিকে।
—-
অর্ণব মুরগী কাটছে আর কুসুম পাশে থেকে দেখিয়ে দিচ্ছে।
কিছু সময় পর অর্ণব মুরগীর কলিজা হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে কুসুমের দিকে চেয়ে বললো,’আমরা কত নিষ্ঠুর।এত কিউট কলিজা কিনা ছিঁড়ে ফেললাম’
কুসুম হাসতে হাসতে শেষ।অর্ণব ওর হাসি দেখে বললো,’আমি সিরিয়াস।তোমার লজ্জা করেনা এমন দৃশ্য দেখে হাসতে?’
‘ভেবে দেখুন এই কলিজা রান্না করার পর আপনি সাগর ভাইয়ার সাথে প্রতিযোগিতা ধরে খেয়েছিলেন’
কথাটা শুনে অর্ণব ঢোক গিলে বললো,’ওহ আচ্ছা ওই কলিজা আর এই কলিজা একই।খাওয়ার জিনিস খেতেই পারি।আমিওনা!কেন যে কাঁদছি’
কুসুম মুখে হাত দিয়ে শুধু হাসছে।অর্ণব নাক টেনে আবারও মাংস কাটায় মন দিলো।
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫৪
আফনান লারা
.
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা,সূর্যটা কি আজ তার দিক ভুলে অন্যদিক থেকে উঠেছে?যে মেয়েটা আমায় সহ্য করতে পারেনা আজ সে আমায় খুঁজে যাচ্ছে?হাত দিয়ে ইশারাও করছে?ওয়াও!গ্রেট’
জুথি হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়েছিল।মৃদুলের কথা শেষহতেই ওর হাতে ঘড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,’আমি বিনাকারণে খুঁজিনি।এটা হলো সেই কারণ।’
‘ঘড়িটা আমি তোমার জন্য রেখে এসেছিলাম ইচ্ছে করেই।আমার স্মৃতি হিসেবে রেখে দাও বরং’
জুথি জবাব দিলোনা।চলে গেলো।মৃদুল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ক্লাসে ফিরে গেছে।
—–
অর্ণব মাথায় গামছা বেঁধে রান্নায় নেমেছে।কুসুমকে ধরতে দিচ্ছেনা।সে পাশে থেকে সব বলে বলে দিচ্ছিলো।বাবা মা আসলেন দুপুরের দিকে।কুসুমের মুখ দেখে মা তো আতংকে পড়ে গেছেন।ওর শরীর ঠিক কতটা খারাপ সেটা ওর চোখ মুখে যেন ভেসে আছে।অর্ণব তাদের ডাক্তারের কথা বলে আপাতত দমিয়ে রেখেছে।বলেছে রিপোর্ট আসলেই ডাক্তার ঔষুধ দেবে তারপর ঠিক হয়ে যাবে।
আজকের খাবারে লবণ নিয়ে সমস্যা হলো।একটু কম হয়ে গেছে।তবে সব ঠিক ছিল।বাবা মা কুসুমের অনেক প্রশংসা করলেন।তারা জানেন না রান্না সব অর্ণব করেছে।শেষে কুসুম নিজ থেকেই বলে দিলো আসল কথা।
বাবা তো অবাক।তার ছেলে কিনা এত সব রাঁধলো।ভাবা যায়!যে ছেলে মেসে জীবনেও নিজে রাঁধতোনা।দরকার পড়লে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতো রান্না করার ভয়ে। আজ সেই ছেলে কিনা এত পদ রেঁধে ফেলেছে।
বাবা বুঝতে পারলেন সমস্তটা।তার ছেলে দায়িত্ব নিতে জানতো,তবে আজ সে কুসুমের দায়িত্ব নেওয়াও শিখে গেছে।অতীতে যখন ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়তেন তখন তিনিও এমনটাই করতেন।বাপের মতন হয়েছে ছেলেটা।
আজ অনেক গর্ব লাগলো।কুসুম মেয়েটার যে মায়ায় আমরা পড়ে ওকে বিয়ে করাতে চেয়েছিলাম মনে হয় আমার ছেলেটাও সেই মায়ায় পড়ে গেছে।
বেশ ভাল লক্ষণ। মেয়েটা যে আমার ছেলের জন্য ষোলআনা সৌভাগ্য সেটা আমি আগেও জানতাম।আমি এটাও জানি ভবিষ্যতে সে অর্ণবকে এতটা মানিয়ে নেবে যে অর্ণব ওকে চোখে হারাবে।সেই দিন খুব কাছে।দোয়া করি দুজনে যেন সুখী থাকে।’
দুপুরের খাবার শেষে তারা দুজনে ঘুমোতে চলে গিয়েছিল।অর্ণব গিয়ে ঘুমাচ্ছে তার রুমে।কুসুমের চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।মাথার যন্ত্রনা বেড়েছে।অর্ণবকে জ্বালাতে চায়না বলে ওর পাশে শোয়ার চেষ্টা করলো একবার।কিন্তু শুলেই মনে হয় যন্ত্রনা আরও বেড়ে গেছে।তাই মাথা ধরে বসে রইলো সে অনেকক্ষণ যাবত।অর্ণব এত কাজ করেছে যে এখন ক্লান্তি দূরীকরণের ঘুম ঘুমাচ্ছে সে।
কুসুম ভুলেও ওকে জাগাতে চায়না।কিন্তু এই অসহ্য যন্ত্রনা তাকে এক জায়গায় স্থির থাকতে দিচ্ছেনা।সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেলেছে ।তবে কোনো শব্দ করলোনা।
আজ বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।তাকে ধরলে সব অসুস্থতা চলে যায় কিন্তু এখন তিনি নেই বলে অসুস্থতা যাওয়ার নাম নিচ্ছেনা।
চোখ মুছে নিজের ফোন বের করে বসে থাকলো।মায়ের নাম্বার তো তার চেনা নয়।তাছাড়া নাম সেভ থাকলেও সে তো পড়তে জানেনা।অর্ণবের নাম্বারে স্টিকার থাকে বলে চিনতে পারে।
ফোন রেখে ধীরে সুস্থে বিছানা থেকে নেমে পুরো বাসায় ঘোরাঘুরি করলো সে অনেকক্ষণ।সময় যায়না।কখন বিকেল হবে আর কখন সবাই ঘুম থেকে উঠে বসবে।ছাদে যেতে খুব ইচ্ছে হলো কিন্তু ঐ শেয়ালের ভয়ে যাবার ইচ্ছা পানিতে ডুবে মরে গেছে।
জবা ফুল গাছটাকে অনেকক্ষণ যাবত দেখে একটা ফুল নিয়ে কানে গুজে ফ্লোরের উপর বসে আছে সে।সকালে অর্ণব শিখিয়েছে এক, দুই, তিন, চার আর পাঁচ।বাকিগুলো মনে নেই।আঙ্গুলে এক দুই তিন চার পাঁচ গুনে সেকি আনন্দ হলো তার।কিছুক্ষণের জন্য মাথা ব্যাথার কথাটাই ভুলে গেছে সে আনন্দে।
বারান্দায় বসে যখন সে গুনছিল তখন রাস্তা দিয়ে এক ফেরিওয়ালাকে যেতে দেখে থামতে বললো।তার কাছে ঝিনুকের মালা ছিল কতগুলো।আশ্চর্যের কথা হলো মালাগুলো সাদা নয়।নীল,লাল আর কালো রঙের।কুসুম দাম জানতে চেয়েছে।লোকটা বললো পঞ্চাশ টাকা।
কুসুম ভাবছে টাকা কই পাবে।অনেক ভেবে অর্ণবের কাছে গিয়ে ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিল।ওর ঘুমের বাহার দেখে জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছেই করেনা।এদিকে রঙিন মালা হাত ছাড়া করলে আফসোসে জীবন শেষ হবে।সে মাকে প্রায় সময় দেখতো বাবার পকেট থেকে টাকার নোট নিয়ে কোমড়ে গুজতে।এই বুদ্ধিটা আসায় ভাবলো অর্ণব যদি রাগ করে বসে?পরে ভাবলো জানিয়ে দেবে একদিন তাহলে রাগ হবেনা।দেরি না করে অর্ণবের ঝুলিয়ে রাখা পাঞ্জাবি হাতিয়ে দশ টাকার, বিশ টাকার,একশো টাকার নোট পেলো সে।কিন্তু সে তো জানেনা পঞ্চাশ টাকা কত তে হয়।
তাই টাকার নেট কয়েকটা নিয়ে ছুটে নিচে চলে গেলো ফেরিওয়ালার কাছে।তাকে একটা নোট দিয়ে চুপ করে রইলো।
যদি তিনি বলেন কম হয়েছে তাহলে আবার আরেকটা নোট দেবে।
কিন্তু লোকটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে ওর হাতে দিলো উল্টে ।
ও বললো টাকা কেন দিয়েছে।লোকটা জানালো সে তো একশো টাকার নোট দিয়েছে।বাকি পঞ্চাশ তো ওর পাওনা,যেহেতু সে একটা মালা নিয়েছে।কুসুম আগাগোড়া কিছুই বোঝেনি তাও টাকাটা নিয়ে মুঠোবন্দি করে রাখলো।
সে লাল রঙের মালাটা নিয়েছিল।তড়িগড়ি করে বাসায় ফিরে টাকা সব আবার আগের জায়গায় রাখছে সে এখন।
সেসময়ে অর্ণব উঠে পড়েছে ঘুম থেকে।কুসুমকে ওর পাঞ্জাবিতে কি যেন করতে দেখে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো কাছে।
কুসুম টাকাগুলো রেখে পেছনে তাকিয়ে আচমকা অর্ণবকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো।ভয়ের চোটে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।
অর্ণব ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়োছিল।ও কিছু বলছেনা দেখে এগিয়ে এসে ওর কোমড় থেকে দশ টাকার নোটটা টেনে বের করে বললো,’টাকা তোমার কোমড়ে কি করে?’
কুসুম লজ্জায় লাল হয়ে আছে।অর্ণব ওর নিরবতা দেখে আবারও প্রশ্ন করেছে।কিন্তু এবারও কুসুম কিছু বললোনা দেখে সে বললো,’আমার পকেট থেকে টাকা নিয়ে নিজেকে চোর ভাববেনা।আমি কি তোমায় মারতাম?ওমন ভয় পাচ্ছো কেন?’
‘না কিছুনা’
‘টাকা কোমড়ে রাখে মানুষ?তাও এমন করে যে সবার আগে আমার চোখ টাকার উপরই গেলো?’
কুসুম লজ্জার সাথে যুদ্ধে হেরে অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এখনও।
সে চলে যাবার পর দম ফেলে মালাটাকে সামনে ধরে মুচকি হাসলো।
—–
জুথির বাবা পরীক্ষার খাতা দেখা শেষে সব গুছিয়ে রাখছিলেন।সামনেই ফোন রাখা।তাতে ভিডিও কল চলছিল।জুথির মা গালে হাত দিয়ে বসে দেখছিলেন তাকে।আর মিটমিট করে হাসছিলেন।
কারণটা হলো জুথি চলে যাবার পর জনাব করিম এতদিন নিজেকে যতটা একা মনে করতেন এরপর আরও বেশি একা হয়ে যাবেন।এদিকে জুথি চলে আসছে শুনে মা ভীষণ খুশি।কারণ তিনি তো কত বছর একা কাটাচ্ছেন। এমতাবস্থায় জুথির বাবার হাল দেখে তার মশকরা ছাড়া মাথায় আর কিছু আসছেনা।তার হাসি দেখে বিরক্তি নিয়ে জনাব করিম বললেন,’জুথি আমাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকবেনা।আবারও চলে আসবে সে।হতে পারে আসার সময় তোমায় ও নিয়ে আসলো।সুতরাং দাঁত কেলানো বন্ধ করো’
‘জ্বলছে তোমার?অথচ দুই যুগ আগে যখন আমাদের বিয়ে হয়েছিল তখন তুমি আমায় বলেছিলে আমার হাসিতে তুমি মত্ত।আর এখন তার উল্টো কথা বলছো?’
‘ওসব ছাড়ো।এই তো সুন্দর বাংলা পারছো।চলে আসলে কি হয়?শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই?আমি আর কতকাল একা থাকবো?’
জুথির মা রাগ করে কলটাই কেটে দিয়েছেন।জুথি তখন মৃদুলের কথা ভাবছিল।কাউকে মনে আঘাত করলে কতটা কষ্ট সে পায় তা জুথি বরাবর জানে।সে বুঝতে পারছে মৃদুলের মনের অবস্থা কেমন।কিন্তু সে তো চায়নি মৃদুল তাতে আসক্ত হয়ে যাক।শুরু থেকে ওকে ইগনর করে এসেছে ঠিক এই জন্যই।সে নিজ থেকে এতদূর এসে এখন মানা করাটা কেন নিতে পারছেনা?এই ভেবে জুথির খারাপ লাগে।তার নিজের মনটাই খারাপ ওর কথা ভাবতে গিয়ে।একটা সাক্ষাৎ হয়ত ওর মনের অবস্থা ভাল করে দেবে কিন্তু তাতে করে মৃদুল সম্পর্কে আরেক ধাপ এগিয়ে আসবে।
‘কি করলে এই অশান্তি দূর হবে!!মন চাইছে আজই সিঙ্গাপুর চলে যাই।তাহলে আজকেই সব কিছু থেকে মুক্তি পাওয়া যেতো।’
—-
অর্ণব কি মনে করে আবারও কুসুমের কাছে ফিরে এসেছে।কুসুম ওকে আসতে দেখে যেই জায়গায় ছিল ঐ জায়হায় দাঁড়িয়ে পড়লো।ও সোজা কুসুমের কান থেকে জবা ফুলটা হাতে নিয়ে বললো,’তোমাকে না বললাম এই ফুল কানে দিবানা!’
‘মনে ছিলনা।দিন ফেলে দিই’
‘ফুল ফেলবার জিনিস না।ছিঁড়ছো যখন তখন নিজের কাছেই রাখো।’
এটা বলে অর্ণব বিড়বিড় করে আরও কয়েকটা লাইন বললো।সেগুলো হলো’একটা কথা শোনেনা আমার।ঘাঁড়ত্যাড়া মেয়ে কোথাকার!’
কুসুম শোনেনি তবে বুঝতে পেরেছে অর্ণব কিছু একটা বলেছিল।সবসময় ওর কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসলেও জবা ফুলের ব্যাপারে সেটা করতে পারেনা।কিসের একটা আকর্ষণ টান দেয় ওর দিকে।জবা দেখলে অর্ণবের নিষেধের কথা মাথায় আসেনা।ফুলটাকে অনেকক্ষণ দেখে মনে মনে ঠিক করলো আর কোনোদিন এই কথা অমান্য করবেনা সে।
অর্ণব ভাবছে কুসুম হঠাৎ টাকা নিচ্ছিলো কেন।
‘কিসের দরকার পড়লো যে চুপিচুপি নিলো?জিজ্ঞেস করা তো ঠিক হবেনা।হাতেনাতে ধরেছি বলে লজ্জায় যে লাল হয়েছে সে লাল এখনও ওর মুখ থেকে নড়েনি।তবে কি নিলো?আর ও তো হিসেব জানেনা।কি করেই বা নিলো!
ভাবতে ভাবতে কুসুমকে সামনে দিয়ে যেতে দেখে একবার ওর দিকে গভীর মনযোগ দিয়ে তাকালো সে।সব ঠিক আছে কিন্তু গলার মালাটা নতুন লাগে।এটা তো এর আগে সে পরেনি।তাহলে কি এটাই কিনেছে?
ঝিনুকের মালা ওর এত পছন্দের?একদিন যদি সময় এবং সুযোগ দুটোই পাই হবে এই ঝিনুকের পাগলা ভক্তটাকে সমুদ্র সৈকত দেখিয়ে আনবো।
হায়! তখন তো তাকে হয়ত ওখান থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসতে হবে।চোখের সামনে জ্যান্ত হাজার হাজার ঝিনুক দেখলে তাকে তো আমি জোর করেও নিয়ে আসতে পারবোনা। কি সুন্দর হবে দৃশ্যটা।’
চলবে♥