লীলাবালি পর্ব-৮৮+৮৯

0
490

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮৮
আফনান লারা
.
রুম খালি হতে প্রায় আরও দশ বারো মিনিটের মতন সময় লেগে গেলো।তাও তারা বের হতে পেরে বিরাট খুশি।
বাথরুমের ঠাণ্ডা পানি আর বৃষ্টির পানি এক হয়ে অর্ণবের জ্বর বেড়ে যাওয়ার বদলে একেবারে উধাও হয়ে গেছে।
তাতে সে খুশি বরং এমন ভাব করলো যেন আগে থেকেই জানতো।ওদিকে কুসুম হাঁচি দু একটা দেবার পর সেও ভারী সুস্থ।মাথা যন্ত্রনা আলাদা অসুখ।জ্বর হয়নি এই ভেবে সে খুশি।
সাগর ভাইয়া জানতে চাইলেন এতটা সময় অর্ণব কোথায় ছিল,কারণ কুসুম তো বাথরুমে গেছে এটা তারা আন্দাজ করেছে। অর্ণব কোথায় গেলো তবে?
অর্ণব বললো সে বাগানে ছিল।এই ডাহা মিথ্যেটা ভাইয়া কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলেন না।অর্ণব তার কথার নড়চড় করেনি তাই তিনি মেনে নিলেন শেষে।
আজকের দিনটা ভালমন্দ নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছে।
সাগর ভাইয়া বললো এখানে পাশেই নাকি একটা রেস্টুরেন্টে শর্মা পওয়া যায়,একেবারে নামকরা।সবাইকে ট্রিট দিতে নিয়ে যাবেন এটাও বলেছে।বৃষ্টি থেমে হঠাৎ সূর্যর মুখ ও দেখা যাচ্ছিলো।ওর এই প্রস্তাবে সকলে রাজি হয়েছে সে জন্য।কুসুম তো তৈরিও হওয়া ধরেছে।
এরই মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো অর্ণব।সে সবাইকে বুঝাতে চাইলো কুসুমের শরীর খারাপ,সে যেতে পারবেনা।আর সে তো একা।তাকে একা রেখে ও কি করে যাবে।তাই তারা দুজন বরং থেকে যাবে।বাকিরা যেতে চাইলে যাক।
কুসুম ওর কানে ফিসফিস করে বললো ‘এটা কখন বললাম?আমার তো যেতে ইচ্ছে করে’

‘চুপ থাকো।এত যেতে হবেনা।আমি তোমায় বাসায় ট্রিট দিব।’

কুসুমের অসুখের নতুন করে ব্যাখ্যা কাউকেই দিতে হবেনা।সবাই অর্ণবের কথা সুরসুরিয়ে মেনে নিয়েছেন।বাসা ফাঁকা করে বিকেল চার টার দিকে সকলে চলে গেছে ঐ রেস্টুরেন্টের দিকে।
এর কারণে কুসুম তখন থেকে গাল ফুলিয়ে বসে আছে বারান্দার শেষ সীমানায়।
অর্ণব বাহিরে গিয়ে অনেক খুঁজেও হাওয়াই মিঠাই পেলোনা।কোনো রকমে দশ টাকার বাদাম ভাজা হাতে ফিরেছে।দরজা লাগাতে না লাগাতেই মেঘে ডাক দিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।
আজ সারাদিন বৃষ্টি হবে নাকি?
কুসুমের পাশে হাতের তালুতে বাদাম ধরে সে মুখে হাসি ফোটালো।কুসুম ভেংচি কেটে অন্য দিকে ফিরে গেছে।

‘খাবেনা তুমি?’

‘উহু’

অর্ণব গোল হয়ে বসে নিজেই খাচ্ছে এবার।ওর খাওয়ার শব্দ কানে আসতেই কুসুম মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললো ‘বললেন না, কেন আমাকে যেতে দিলেন না?আমি তো বেশ সুস্থ আছি,তবে কেন আমায় যেতে দিলেন না?আমার কি ইচ্ছা করেনা সবার সাথে ঘুরতে যেতে?শুধু যে খেতে যাব সেটা তো নয়।সাগর ভাইয়া আরও একটা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেতো।তাহলে কেন আমায় আটকে রাখলেন?’

‘কারণ সেসবের চেয়ে সুন্দর কিছু মূহুর্ত আমি তোমায় উপহার দেবো’

কুসুম কৌতুহল নিয়ে একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইলো।অর্ণব ঠোঁট এগিয়ে ওর কপালে চুমু এঁকে বললো,’সুন্দর লাগে?’

‘ভীষণ’

‘বয়স কত তোমার?’

‘জানিনা’

‘জানতে হবেনা।চলো যাই’

‘কোথায়?’

‘ছাদে’

‘শেয়াল?’

‘আসতে আধ ঘন্টা দেরি।ততক্ষণ ছাদে ভিজবো।আবারও ভিজবো।আজ আমরা শুধুই ভিজবো।একদিনে জীবনের সব প্রেম উজাড় করে বিলাবো আমি,সঙ্গী হবে তুমি।স্বাক্ষী হিসেবে থেকে যাবে ইতিহাসে।বলো যাবেনা?’

‘যাব।’

অর্ণবের হাতের কব্জি ধরে কুসুম ছাদে এসেছে।
ছাদ ফাঁকা।সেই শেয়ালগুলো নেই কারণ ওদের আসার সময় না এটা,তবে খুব বেশি দেরি নেই।খুব শীঘ্রই তাদের দেখতে পাওয়া যাবে।
কুসুম রেলিংয়ে হাত রেখে আবার হাতটা সরিয়ে নিলো,বৃষ্টির পানি পড়ে কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে।

‘দেখুন ছাদ থেকে জবা গাছটা কি সুন্দর দেখায়’

অর্ণবের সাড়া আসছেনা দেখে কুসুম পেছনে তাকালো।
ওমা সে সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।কুসুম একটু পিছিয়ে গিয়ে বললো,’কি হলো?’

‘ডিস্টার্ব করো না তো।আমার অনেক আগ থেকে ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর কোনো এক বৃষ্টির দিনে ছাদে বউকে এনে ওর পায়ে পায়েল পরিয়ে দেবো। পা বাড়াও সুন্দর করে।’

কুসুম পা বাড়িয়ে ওর দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে।সে যে সঠিক একটা মানুষকে প্রাণপণে ভালবেসেছে আজ সেটা মনে করে গর্ব বোধ হলো।অর্ণব পায়েল পরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুষ্টু করে খানিক হেসে কুসুমের হাত টান দিয়ে ওকে একটু কাছে নিয়ে এসে বললো,’ভালবাসা উড়ন্ত মেঘের মতন বুঝলে?
কেউ জানেনানা ঐ মেঘটা কোন জায়গায় গিয়ে থামবে আর গায়ের সব ভালবাসা ঝরাবে সেই জায়গার মাটিতে।
আমি কবে জানতাম তোমার মতন একটা মেয়েকে এত ভালবেসে ফেলবো?একেবারে দম বন্ধ হবার মতন অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে প্রতিবার?’

কুসুমকে আরেকটু টেনে এনে গায়ের সাথে লাগিয়ে ধরে হাসিটাকে ঘাড়ো করে সে আবার বললো,’ভাবো তোমার কিছু হলে আমার দমটা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।তারপর মৃত্যু’

কুসুম অর্ণবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পিছিয়ে বললো,’একজন মরলে আরেকজনকে মরতে হবে?আপনার জীবন সুন্দর,আমার মতো অসুস্থতার বালাই নেই।খুব সুন্দর হবে আপনার জীবন সামনের দিকে।দেখে নিয়েন,মিলিয়ে নিয়েন।কোনো একটা সময়ে হয়ত আমার কথা মনে পড়বে আপনার,তখন কষ্ট পাবেন।কিন্তু সবসময় কষ্ট পাবেন না।কিংবা মনে পড়বেনা, কারণ আপনি আপনার মতন একজন জীবনসঙ্গী পেয়ে যাবেন। আমার অনেক অনেক দোয়া আছে।আমি চাই আপনার মুখে সর্বদা এই সুন্দর হাসিটা লেগে থাকুক’

অর্ণব বৃষ্টির মধ্যেও হাত দিয়ে চোখ মুছলো।কাঁদো স্বরে বললো,’আমার এই হাসিটা আসার কারখানার নাম কুসুম।কুসুম না থাকলে এই কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।সিল মেরে।
এটা মানুষের মনের কারখানা,যে কেউ কিনে নিয়ে মালিকানা দখল করতে পারবেনা।সেই জ্ঞান তোমার হয়নি কুসুম’

কুসুম তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,’শিক্ষার জ্ঞান হয়ত হয়নি,কিন্তু আমি ওতোটাও ছোট না যে ভালোবাসা কি সেটা জানিনা।আমি আপনাকে ভালবেসেছি তবে আমি জানবোনা এ ব্যাপারে?’

‘নিশ্চয় জানো তবে এটাও জেনে নেওয়া উচিত প্রথম ভালবাসা যারে বাসা হয় এই ভালবাসা ২য় জন কোনোদিন পায় না।আর আমার জীবনে আগে জুথি আসলেও ভালোবেসেছিলাম কেবল তোমায়,জুথিকে না।
হয়ত জুথি আমায় ভালবেসেছিল কিন্তু আমি বাসিনি।আমি বাসলে সেটা তোমায়,এখন!!শুরুতেও না।’

‘আপনি কাঁদছেন কেন?আমি কান্নার মতন কি বললাম?’

‘তুমি কেন বলবে আমি তোমার পরে অন্য কাউকে মেনে নিতাম?এটা বলার অধিকার তোমার নেই!আমার জীবন,আমার ইচ্ছে আমি কি করবো না করবো!তোমার সাথের বিয়েটাি কেউ জোর করে দেয়নি।আমি নিজের ইচ্ছেতে করেছিলাম এবং আমার নিজের ইচ্ছেতেই আমার এই জীবনটা চলবে।তোমার কোনো অধিকার নেই ভবিষ্যত বাণী দেওয়ার।সেই অধিকার আমি তোমায় দেইনি’

‘কোন অধিকার দিলেন তবে?’

অর্ণব কিছু বলতে পারলোনা।চলো গেলো চিলেকোঠার দিকে।কুসুম ওর পিছু পিছু এসে দেখলে নিচে সিঁড়িতে বসে আছে ও
তাই কুসুম ও ওর পাশে এসে বসলো।তারপর পরিস্থিতি ঘুরাতে বললো ‘আচ্ছা আমার নাম কি যেন?’

‘লীলাবালি’

‘আমি দেখতে কিরকম,মানে ধরুন বেশ?’

‘লাল শাড়ী,লাল চুড়ি,খোলা চুল আর একটা জবা কানে গুজা।কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করতেছো?’

‘লীলাবালি আপনার কে হয়?’

‘আমার সব হয়’

‘তার দাপট কিরকম একটু বলবেন?’

‘তার দাপট সে আমার সবটা জুড়ে আছে।আমি পুরোটাই তার।এটাই তার একমাত্র দাপট’

কুসুম মুচকি হেসে নেমে গেলো সিঁড়ি বেয়ে।অর্ণব কিছুই বুঝলোনা।কিছু সময় সিঁড়িতেই বসে থাকলো।হঠাৎ ছাদ থেকে শেয়ালের ডাক শুনে তড়িগড়ি করে বাসার দিকে ছুটে গেছে।এখানে আর থাকা যাবেনা।

দরজা খোলাই ছিল।ভেতরে ঢুকে দরজাটা আটকে কুসুমের নাম ধরে ডেকে টেবিলের উপর থেকে পানি নিয়ে খেলো সে।কুসুম রুম থেকে বললো,’আসছি!!”

তাই অর্ণব ড্রয়িং রুমের বারান্দা থেকে একবার ঘুরে আসলো।এরপরেও ও আসছেনা দেখে সে নিজেই গেলো দেখতে।
চুল ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল কুসুম।রুমের চলো জ্বালাতেই নজরে আসলে লাল থান কাপড় পরা সেই মেয়েটি যে অর্ণবের লীলাবালি হবার যোগ্যতা বহন করে।
ঠিক সেরকম সেজেছে যেমনটা অর্ণব তাকে জানিয়েছিল।
কুসুম ওর দিকে ফিরে আয়নার সাথে হেলান দিয়ে বললো,’আমার দাপট দেখাবো?’

‘দেখাও।দেখতে চাই’

অর্ণবের কথা শুনে কুসুম মিটমিট করে হাসছে।বলে তো দিলো।কিন্তু এটা পূরণ করবে কে?
ওর কদম ফেলার আগেই অর্ণব এগিয়ে এসে ওর কোঁকড়া চুলগুলোতে হাত লাগিয়ে বললো,’তোমায় কে বলে নিজে নিজে সাজতে?তোমার নিজের করা সাজ আমার সারা শরীরে নেশা জাগিয়ে দেয়।ভাবীর কাছে সাজতে পারলেনা?’

‘আমি সেই নেশা ধরাতেই নিজে সেজেছি জানেন?’

‘ঠিক করোনি’

কথাটা বলে অর্ণব ও ওর সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’উমমমমমম্ বয়স কম তোমার’

‘তো?’

‘তো এত পাকনামো ঠিকনা তোমার’

‘তবে কি সাজ খুলে ফেলবো?’

‘এমন ভাবে বলছে যেন হীরা যহরত পরে দাঁড়িয়ে আছে।সামান্য বালাটাও পরোনি।’

‘তারপরেও তো আমার সাজ আপনার নেশা জাগিয়ে দিলো।ওরকম সাজলে এই নেশা তো কি ছাড়িয়ে যেতো সেটাই ভাবছি আমি’

‘শোনো সাজ খুলে ফেলো।ভাইয়া ভাবী দেখলে ভীষণ লজ্জা পাবো।আমি অনেক লাজুক জানোই তো’

কুসুম রেগে গিয়ে জবা ফুলটা কানের থেকে নিয়ে অর্ণবের মুখের দিকে ছুঁড়ে মেরে বললো,’ফোন এসেছিল সাগর ভাইয়ার,বাসার নাম্বারে।ওনারা নাকি বৃষ্টির কারণে আটকে আছেন।বৃষ্টি থামা পর্যন্ত আসতে পারবেন না’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ’

অর্ণব ফুলটা আবারও ওর কানে লাগিয়ে দিয়ে বললো,’থাক সাজ নষ্ট করতে হবেনা,এমনই থাকো।আমি তোমায় দেখি আর নেশাখোর হয়ে যাই।’

কুসুম ওর কথায় হেসে ফেললো,মূহুর্তেই তার কাড়ি কাড়ি রাগ গায়েব।মুখে হাত দিয়ে হাসি থামিয়ে বিছানায় গিয়ে গোল হয়ে বসে পড়েছে সে।অর্ণব চাইছে ওকে নিজের সবটা দিয়ে ভালবাসতে কিন্তু নানারকম দ্বিধা এসে বাধা দিচ্ছে।হাজারটা প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেয়ে যায়।
এই মন বলে ওর হাতটা ধরে ওর ঠোঁটে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে তো এই মন বলে এসবের সময় এখন না।

কুসুম কান থেকে ফুলটা খুলে নিয়ে দেখছে মনযোগ দিয়ে।অর্ণব হাত মুঠো করছে তো আবার খুলছে।
হঠাৎ গায়ে ফুঁ দিয়ে রুম থেকেই বেরিয়ে গেলো।প্রচুর সাহস প্রয়োজন।
‘বুকের ধুকবুক করাটা থামলে ওর কাছে যাব,তার আগেনা’
চলবে♥

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮৯
আফনান লারা
.
ভাইয়ারা আসতে সেদিন অনেক দেরি করেছিল,বলতে গেলে রাত দশটা বাজিয়ে ফেলেছে।
কত সুন্দর ছিল সেই রাত।দশটা অবধি আমার প্রেম রাত।আমার লীলাবালিকে আমি সেদিন সাহস এনে ছুঁয়েছিলাম।সে জানতো না তাকে আমি আজই ছুঁবো।সে শুধু জানতো আমি তারে সুন্দর কিছু মূহুর্ত উপহার দেবো।সেই মূহুর্ত গুলো কিরুপ হবে সেটা সে জানতোনা।
আমার লীলাবালি ছিল স্বচ্ছ কাঁচের মতন, তার ভেতরটা সামনে থেকে বোঝা যেতো।আফসোস!এই স্বচ্ছ শব্দটাকে উপলব্ধি করতে আমার বড্ড দেরি হয়ে গেলো!
তাকে একবার ছুঁয়ে আমি আরও কতবার যে ছুঁয়েছি!কারণে!অকারণে।
সে লজ্জা পেতো,ভীষণ লজ্জা পেতো।যার হাত ধরলে গাল দুটো তার লাল হয়ে আসতো তাকে সম্পূর্ণটা ছুঁলে তার কি অবস্থা হতে পারে আমি কল্পনাও করিনি।যেটা কল্পনা করেছি তার চেয়ে বেশিই দেখেছিলাম।সে অনেক বেশি লাজুক।আমার লাজুক হওয়ার কাছে তার ঐ লাজুকতা বিশাল।
তাকে আপন করে নেবার সেই দিনটি ছিল ১৪তারিখ।এরপর আমি তারে বহুবার ভালবেসেছি।নানা কারণ দেখিয়ে তাকে ভালবেসেছি।
১৪ তিনগুনে কত হয়?৪২ হয়।প্রায় ৪২ টা দিনের মতন তাকে আমি নানারকম ভাবে ভালবেসেছি।যেন বৃদ্ধ বয়স হবা অবধি মানুষ যতটা ভালবাসে তার সঙ্গীকে আমি ঐ ৪২দিনে তাকে প্রাণ উজাড় করে বেসে গেছি।যেন আমি জানতাম সে আমার থাকবেনা।এই রুমের দোলনায় আর সে দুলবেনা!তার ঠোঁটের স্বাদ আমার আর কোনোদিন নেওয়া হবেনা।আমার না এত বেশি কষ্ট হতো না!!একটু কম কষ্ট হতো যদি না জানতাম তার পেটে আমার অনাগত সন্তান ছিল।তার বয়স কত হবে?জানিনা!১৪তারিখের প্রেমের ফল হিসেবে সে কবে এসেছিল কে জানে!কুসুম কবে জেনেছিল হয়ত সেটাও জানিনা।মিশু ভাবী ওর প্রেগন্যান্ট হবার খবর আমায় আজই দিলো।আশ্চর্য কর হলেও সত্যি যে আমি খুশি হইনি, একটুও হইনি।
কুসুম জানেনা প্রেগনেন্সি কিটে ঐ দুটো লাল দাগের মানে কি!
বমি হওয়া তো শুরু থেকেই ছিল,কিন্তু তার শরীর তাকে অন্য কিছু বলতো সারাক্ষণ। এর উত্তর সে জানতে চাইলো মিশু ভাবীর থেকে।ভাবী মুচকি হেসে তাকে প্রেগনেন্সি কিট ধরিয়ে দিয়েছিলেন।নিয়ম মত সে টেস্ট ও করিয়েছিল।আমার পাগলামো আর বাসার কাজের ব্যস্ততা তাকে ঐ কিট আলমারিতে তুলে রাখতে বাধ্য করেছিল।সে জানেও না ঐ কিটের অর্থ কি।যদি একবার আমায় বলতো!!
হাহ!!বললেও কি!আমি কারে ধরে রাখতে পারতাম?এত কষ্ট একদিনে কেনোই বা পেলাম?কি দোষ করেছিলাম আমি?তারে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আছে সে কি তা জানেনা?তাহলে কেন সে চলে গেলো?তার নিথর দেহটা কেন সবাই বারবার ঢেকে দিচ্ছে।আমি তাকে কেন ছোঁয়ার সাহস আজ পাচ্ছিনা।অথচ সেদিন সাহস করে ছুঁয়েছিলাম,,তাহলে আজ আমার ঐ সাহস আসছেনা কেন?
পাসপোর্ট তো এসে যাবে কাল পরশু শুনলাম।তাহলে আর কটাদিন সে বেঁচে থাকলে কি হতো?
কেন সে আমার বুকটা জ্বালিয়ে চলে গেলো!!তাও এভাবে!আমার তাকে চাই।সে যেন নাটক বন্ধ করে আমার সামনে এসে মাথায় হাত বুলায়।আমি তার চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিনা।আমার সন্তানের এভাবে চলে যাওয়া আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা!
—-
মিশু ভাবী কাঁদতে কাঁদতে বাবা মায়ের সামনে পানির গ্লাসের ট্রে রেখে বললো,’মা!জানাজা তো কিছু সময় পর।
অর্ণব ভাই কি মুখে কিছুই দেবেননা?উনার তো কিছু খাওয়া হয়নি ভোর থেকে।’

মা মলিন মুখে একবার রুমের দিকে তাকালো।অর্ণব কুসুমের দেহটাকে কাউকে ছুঁতে দিচ্ছেনা।তার সামনে বসে আছে মূর্তির মতন।
সেসব দেখে মা আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বললেন,’ও কিছু খাবেনা।তুমি কুসুমের মাকে কিছু খাওয়াতে পারো কিনা দেখো।উনি তো প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন’

‘আমি জানি তুমি ঘুমাচ্ছো।এখনই উঠবে আর হাসবে।জবা ফুল ছিঁড়ে কানে দেবে।কি হলো দেবে না?জানো আমি কাল গাছে একটা বড় জবার সন্ধান পেয়েছি।ডখনও ভালমতন ফোটেনি বলে আমি ছিঁড়ে আনিনি।এখন হয়ত ফুটেছে।তুমি উঠে বসো,আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি’

অর্ণব চট করে উঠে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ছুটে গেলো বাগানের দিকে।গাছের ফুলটা ছিঁড়ে দ্রুত আসতে গিয়ে পড়ে গেলো সিঁড়িতে
মৃদুল ওর বুক চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে বললো,’ভাই শান্ত হ।এভাবে করলে তুই নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বি’

অর্ণব মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’তাই হোক।আমি চাই আমার অসুখ হোক।মরণব্যাধি হোক।আমি চলে গিয়ে তারে আরও একটিবার দেখবো।তার চোখের পলক ফেলা দেখবো।আমার যে এখনও তাকে দেখার সাধ পূর্ণ হয়নি।তার আগেই সে চলে গেছে।এটা ঠিক হয়নি।আমি আরও ভাল করে তাকে দেখবো,তার জন্য আমায় মরতে হবে মৃদুল’

অর্ণব হাতটাকে মৃদুলের থেকে ছাড়িয়ে চলে গেলো।জুথি সেসময়ে এসেছে।মৃদুল ওকে দেখে কিছু বললো না।অর্ণবের অবস্থা সে দূর থেকে দেখছিল এতক্ষণ।
মৃদুলের কাছে এসে বললো,’আমার কি যাওয়া ঠিক হবে এখন?’

‘কয়েক মিনিট পরে যেও।জানিনা ও কখন নিজেকে সামলে নিতে পারবে।কুসুম প্রেগন্যান্ট ছিল এ কথা জানার পর থেকে পাগলামো করছে।আমরা কেউ ওকে সামলে নিতে পারছিনা।’

‘বাহিরে জবা গাছটার নিচে দেখলাম কবরের জায়গা তৈরি করা হচ্ছে।ওখানে কবর দেবে?’

‘হুম।কুসুমের ইচ্ছে ছিল সেটা।মেয়েটা খুব মায়া দিয়ে গেলো তাই না?আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।আফসোস আমি কাঁদতে জানিনা।মনে হয় আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ মারা গেলো।ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে’

জুথি মৃদুলের মুখে দিকে চেয়ে বললো,’আমিও ঠিক আপনার মতন।কাঁদতে চেয়েও পারছিনা।তবে ভেতরটা পুড়ছে।কুসুমকে কখনও খারাপ ভাবিনি,ওর সাথে কোনো শত্রুতাও ছিলনা।মেয়েটা ভীষণ ভাল ছিল।ভালোদের সাথে এমন কেন হয়?।বিদেশে গেলে রোগটা ভাল হয়ে যেতো নিশ্চিত।’

‘আমি ভাবছি অর্ণবের কথা।তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওর এভাবে ভেঙ্গে পড়া আমি মেনে নিতে পারছিনা।ও আমাদের কাউকে নিজের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছেনা।’
—-
‘কাল রাতেও তো মেয়েটা আমার হাতে ভাত খেয়েছে আপা!তাহলে সকালের রুটিটা খাওয়া পর্যন্ত কেন থাকলোনা আপা!!আমার মেয়েটার কপালে এটা কেন ছিল!!আমার মেয়ের এই রোগ কেন হতে গেলো আপা একবার বলবেন?আমি যে আর সইতে পারতেছিনা’

অর্ণবের মা কুসুমের মায়ের মাথায় হাত রেখে চুপ করে আছেন।সকাল থেকে হাজারটা সান্ত্বনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।সবার এক কথা।কুসুমের এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হলোনা।একদম ঠিক হলোনা।

কলি অর্ণবের রুমের দরজার কিণারায় দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ যাবত।ভেতরে ফ্লোরে অর্ণব বসে কুসুমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে কিসব বলছে।বুবুকে শেষবারের মতন জড়িয়ে ধরতে অনেক ইচ্ছে হচ্ছিল কলির।কিন্তু অর্ণবের কারণো রুমে পা রাখতে পারছেনা।ওকে সবসময় সে ভয় করে।
কিন্তু কুসুমের ফ্যাকাসে মুখ তাকে আর বাহিরে থাকতে দেয়নি।ছুটে এসে মেঝেতে বসে পড়লো সে।ওর বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। অর্ণব কলির কান্না দেখে বললো,’কাঁদো,বেশি করে কাঁদো।তোমায় কুসুম অনেক ভালবাসে।সে নিশ্চয় নাটক করা বন্ধ করে হাসিমুখে তোমায় জড়িয়ে ধরবে এখন।জোরে কাঁদো কলি।দেখো আমি জবাটা ওর কানে গুজে দিচ্ছি কিন্তু থাকছেনা।বারবার পড়ে যাচ্ছে।তুমি চেষ্টা করে দেখো তো কুসুমের মান ভাঙতে পারো কিনা?সে মনে হয় জবাটা নিতে চাইছেনা’

কলির আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে অর্ণবের পাগলামো দেখে।অর্ণব যেন তার বোধজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।কিরকম উদ্ভট কথা বলছে।ওর এই হাল দেখে কলির আরও বেশি খারাপ লাগলো।
কুসুমের মৃত্যু আরও বেশি করে আঘাত হেনেছে অর্ণবের বাবার উপর।এই সহজ,সরল অবুঝ মেয়েটাকে নিজের ঘরের আলো করে আনতে সবচাইতে বেশি যদি কেউ লড়ে থাকে তবে সেটা তিনি।ওর মৃত্যু তাকে এমন চমকে দিয়েছে যে শুরুতে যে জায়গায় তিনি ছিলেন ঐ জায়গাতেই বসে আছেন এখনও।তার বিশ্বাস হচ্ছেনা কিছু।কাল বিকেলে এই মেয়েটা তাকে চা করে খাইয়েছিল।চিনি অনেক কম দিয়েছিল তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন এ বয়সে চিনি কম খাওয়াই ভালো।সে যেন চিনি কন দিছে বলে নিজেকে দোষারোপ না করে।

দরজার ওপারে জুথিকে দেখে কলি চিনতে পারেনি।তাও আত্নীয় ভেবে সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিলো ওকে।জুথি অর্ণবের পাশে মেঝেতে বসে কুসুমের মুখ থেকে চাদরটা সরাতে যাওয়া ধরতেই অর্ণব ওর হাত আটকে ফেললো।তারপর জুথির মুখ দেখে হাত ছেড়ে দিয়ে একটু সরে বসলো।জুথি জানলোনা ও কেন প্রথমে আটকেছিল।সে কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কান্না ধরে রাখতে পারেনি।নিঃশব্দে কেঁদে ফেলেছে।কেঁদে কেঁদে বললো,’কেমন করে হলো এসব?’

অর্ণব যেন ওর কথা শোনেনি।সে কুসুমের আলতা রাঙা পা জোড়া দেখছিল মনযোগে।মৃদুল তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল, সে বললো,’ভোরে অর্ণবের চিৎকার শুনে সবাই একজোট হবার পর জানতে পারলাম কুসুম চোখ খুলছেনা,সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে।হার্টবিট অফ।ডাক্তার ডেকে জানতে পারলাম…..
কালকেও বেশ ভাল ছিল।।মৃত্যুর আগে মানুষ হঠাৎ সুস্থ হয়ে যায়।তারপর মারা যায় হঠাৎ করে।এই সত্যটা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম।ভেবেছি রোগ সেরে যাবে অনায়াসেই।
এভাবে কুসুম চলে যাবে আমরা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।ভেবেছি বিদেশী চিকিৎসায় সব ঠিক হয়ে যাবে।এভাবে জীবন থেকে একজনের চলে যাওয়া মেনে নিতে গিয়ে মনে হয় সব কল্পনা’

অর্ণব ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,’একজন না তো!দুজন।
তারা দুজন চলে গেছে একসাথে।আর আমায় রেখে গেছে স্মৃতি নিয়ে যুদ্ধ করতে ‘

চলবে♥