লেবু পর্ব-০৪

0
2

#লেবু

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

গাড়ি থামলো রহমান ভিলার সামনে। আজ দিনব্যাপী প্রচুর কাজ সাবার। কাজ শেষে ফেরার পথে এখানে এলেও হতো, তবে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্যশক্তি ফুরিয়ে গেছে সাবার ভেতর থেকে।

গাড়ি থামিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে এলো সাবা। এই বাড়িতেই তার বেড়ে ওঠা। তার জীবনের হাজারো আনন্দের স্মৃতি নিজের মাঝে আঁকড়ে ধরে আছে এই বাড়ি। এ বাড়ির প্রত্যেকটা কোণাই একান্ত আপন তার কাছে। তবুও বাড়ির ভেতরে সে পা রাখে না। সেই সাহস অবশিষ্ট নেই তার মাঝে।

ফাহমিদা বেগম বাগানের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলেন। হঠাৎ বাড়ির সামনে মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। পানির পাইপ হাত থেকে নামিয়ে রেখে হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন সাবার দিকে। মায়ের ঠোঁটের হাসি বিগলিত করতে ব্যর্থ হলো সাবাকে। তার মুখভঙ্গি একরাশ গাম্ভীর্যে ভরা।

ফাহমিদা বেগম হাসি হাসি মুখে বললেন, “সাবা? তুই?”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন আসতে মানা আছে?”

ফাহমিদা বেগম অবাক গলায় বললেন, “ওমা! সে কথা কখন বললাম? আয় ভেতরে আয়।”

সাবা থমথমে গলায় বলল, “ভেতরে যেতে পারবো না। বাগানে বসছি, তোমরা এসো। আর চা বানিয়ে আনো মা। বেশি করে তেজপাতা আর এলাচ দিয়ে।”

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বাড়ির ভেতরে পা রাখলেন ফাহমিদা বেগম। বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা এ বাড়ির ভেতরে পা রাখে না। এ জীবনে আদৌ কী কোনোদিন নিজের বাড়িতে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে সাবা? পরম করুনাময় সেই শক্তি দেবেন তার মাঝে?

এ বাড়ির বাগানে অসম্ভব সুন্দর একটা বসার জায়গা আছে। মুখোমুখি দুটো বেতের সোফা, মাঝখানে কাঁচের টেবিল। সোফার আশেপাশে টবে টবে অসংখ্য রঙিন ফুলের গাছ।

সোফায় গা এলিয়ে দিলো ক্লান্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো সাবা। হাজারো বাঁকে মোড় নিতে নিতে জীবনটাই যেন হাঁপিয়ে উঠেছে তার। আজ থেকে ছয় মাস আগে যে বাঁকে মোড় নিলো জীবন, সেটা ছিল বড়ই অনাকাঙ্ক্ষিত।

চিরকালই ঝলমলে একটা মেয়ে সাবা। হাস্যোজ্বল, স্নিগ্ধ তার সবটা। চারপাশের সকলকে মুগ্ধ করে তোলার ক্ষমতা আছে এই মেয়ের। স্কুলে-কলেজে তাই হয়ে উঠেছিল সকলের প্রিয়। স্কুলে কোনো একটা অনুষ্ঠান হলেই সেখানে থাকবে সাবার অংশগ্রহণ। স্টেজ সাজানো থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করা, সবকিছুতেই শিক্ষকরা ছিল তার ওপরে নির্ভরশীল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে তো কথাই নেই। সেই ছোট্টবেলা থেকে স্কুলের প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়ে সাবা উঠে যাবে গান গাইতে।

এসএসসি পরীক্ষা পরবর্তী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যখন গাইলো, ‘আমার যাওয়ার সময় হলো, দাও বিদায়’ তার মোহনীয় কণ্ঠে নিয়মিত গান না শুনতে পাবার আক্ষেপে তখন ভিজে উঠলো শিক্ষকদের চোখ।

অয়ামিক ব্যবহার আর মিশতে পাবার দক্ষতায় সাবা যেখানেই যায়, সেখানেই বন্ধু জুটিয়ে নেয়। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি সবখানেই তাই ছিল তার বিশাল বন্ধুদের দল। দলভুক্ত বন্ধুদের সাথে থাকার একটা অসুবিধা হলো, সকলের মাঝে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায় না। সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া যায় না।
তবে সাবা চিরকালই খেয়াল রেখেছে যেন, তার দলের প্রত্যেকটি বন্ধু সমান গুরুত্ব পায়। সকলেই যেন নিজের মনের কথাটা বলার সুযোগ পায়। তবেই না হবে প্রকৃত বন্ধুত্ব!

আজকের কঠোর-শুষ্ক সাবাকে দেখে বোঝার উপায় নেই এই মেয়েটার মাঝে এক সময়ে প্রাণচাঞ্চল্য খেলে বেড়াতো। জীবনটা নির্মমতম বাঁকে মোড় নেওয়ার পর থেকেই বদলে গেল সবটা। বদলে গেল সাবা নিজেও। গুটিয়ে নিলো নিজেকে সবকিছু থেকে। বন্ধু-আড্ডা-গান কোনোকিছুতেই আজকাল ধৈর্য নেই তার। বুকের মাঝে অপূরণীয় এক শূন্যতা তার। এই শূন্যতা ভরাট হবে না কোনোদিন। সাবাও কোনোদিন হতে পারবে না আগের মতো।

মাস ছয়েক আগে, একরাশ ক্লান্তি নিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে সাবা। মানসিক যন্ত্রনায় এমনিতেই সে বিধ্বস্ত। তার ওপরে এই বাড়িটায় পা রাখলেই দমবন্ধ লাগে তার। মনে হয় যেন বাড়ির সবগুলো ইট বেরিয়ে এসে গলা টিপে ধরেছে তার।

হঠাৎ সাবার বাবা আমির রহমান এসে বললেন, “আমাদের একটু বের হতে হবে মা।”

সাবা ক্লান্ত গলায় বলল, “কোথাও যেতে পারবো না। অলরেডি অনেক টায়ার্ড আমি।”

আমির সাহেব সতর্ক কণ্ঠে বললেন, “বিষয়টা জরুরি মা। এমনি এমনিই তো আর বলছি না।”

আমির সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রবেশ করলেন ফাহমিদা বেগম। তার হাতে একটা শাড়ির বক্স।

বক্স থেকে একটা লাল জামদানি বের করতে করতে বললেন, “ফ্রেশ হয়ে আয় সাবা। পারলে শাওয়ার নিয়ে নে। আমি শাড়িটা পড়িয়ে দিচ্ছি।”

সাবা হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল, “কী আশ্চর্য!শাড়ি পড়তে হবে কেন?”

ফাহমিদা বেগম তড়িঘড়ি করে বললেন, “এত কথা বলার সময় নেই। চট করে শাওয়ার নিয়ে আয়!”

সাবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফাহমিদা বেগম ঠেলেঠুলে তাকে বাথরুমে পাঠিয়ে দিলেন। হঠাৎ বাবার বাইরে যেতে বলা, মায়ের শাড়ি পড়তে বলার অর্থ উদ্ধার করার আগেই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো সে। মা সুন্দর করে শাড়িটা পড়িয়ে দিলেন। চুলগুলো শুকিয়ে আঁচড়ে দিলেন, হালকা সাজিয়েও দিলেন।

সাবার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মস্তিষ্ক হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল।

সাবা ভীত গলায় মাকে বলল, “মা? আমাকে কি ছেলে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছো? যদি সেই চিন্তা থাকে, তাহলে আগেই বলে রাখি আমি বিয়ে করবো না।”

তার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে আমির সাহেব এবং ফাহমিদা বেগম তাকে নিয়ে উঠলেন গাড়িতে। সাবার বিস্ময় সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল, যখন যে দেখলো গাড়ি এসে থেমেছে একটা হসপিটালের সামনে। সাধারণ কোনো হসপিটাল নয়, ক্যান্সার হসপিটাল।

আরেকদফা বিস্ময়ে খাবি খেল যখন জানতে পারলো এই হসপিটালে বসে মৃত্যুর দিন গুনছেন তার বাবার বন্ধু শাহজাহান আলম। মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা, ছেলের বিয়ে দেওয়া। তার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতেই এখানে আনা হয়েছে সাবাকে!

কোনো মানে হয়? বাবার যে বন্ধুটিকে সাবা জীবনে কোনদিন দেখেনি, দীর্ঘদিন যে বন্ধুর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই তার বাবার – তার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্যে এতটা ব্যস্ত হতে হবে কেন?

সেই হসপিটালে প্রথম দেখেছিল সাবা শাফকাতকে। ছয় ফুট লম্বা, কালো শার্ট পরিহিত সুদর্শন এক পুরুষ। তাকে একবার দেখলে যেকোনো মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার দেখবে। তার কন্ঠ একবার শুনলে নানান অজুহাতে আরেকবার শুনতে চাইবে।

সাবা স্বাভাবিক থাকলে প্রথম দেখাতেই তার ভালো লেগে যেত শাফকাতকে। আগে থেকেই বয়ে বেড়ানো মানসিক ঝড়, আর এই আকস্মিক বিয়ের ধাক্কায় একেবারেই অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল সাবা।

বিয়ের জন্যে শাফকাতও প্রস্তুত ছিল না বোধ হয়। হসপিটালে তার চোখেমুখে স্থায়ী হয়ে লেগে ছিল বিরক্তি। শাফকাতের বিরক্তি কিংবা সাবার অস্বাভাবিকতা, কোনো কিছুর পরোয়া করলো না দুটো পরিবার। ওই হসপিটালেই হয়ে গেল তাদের বিয়ে।

চিন্তিত মুখে সাবার মুখোমুখি বসে আছে তার বাবা-মা। চিন্তার সঙ্গে খানিক অসহায়ত্ব ধরা দিচ্ছে তাদের চোখে। কে বলবে মেয়েটাকে এক সময়ে একা একা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ভয় পেত? রিকশায় উঠলে ভয় পেত। অন্ধকারে ভয় পেত। অথচ এই মেয়েটাকে আজ তার বাবা-মা ভয় পেয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। সাবা এমন ছিল না। বদলে যাওয়ার পর থেকেই গাম্ভীর্য আর কঠোরতা যেন তার নিত্য দিনের বন্ধু।

আমির সাহেব পরিবেশ হালকা করার জন্যে বললেন, “আজ অফিসে যাসনি?”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “অফিসে না গিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ আমার নেই বাবা। একটু পরেই যাবো।”

ফাহমিদা বেগম আহত গলায় বললেন, “একটু কম ঝাঁঝ নিয়ে কথা বলা যায় না?”

সাবা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “না যায় না।”

চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে সাবা। তার মায়ের মতো চা এই পৃথিবীতে সম্ভবত কেউই বানাতে পারে না। শুধুমাত্র এই চায়ের লোভেই প্রতিদিন ছুটে আসতে ইচ্ছে হয় এ বাড়িতে। কিন্তু সে যে সম্ভব নয়। এ বাড়ির মুখোমুখি হওয়াও অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক তার পক্ষে। যে যন্ত্রণা এ মুহূর্তে অনুভূত হচ্ছে।

লম্বা শ্বাস নিয়ে মনে মনে কথা গোছালো সাবা।আজ একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে তার বাবা-মাকে।

সাবা গম্ভীর গলায় বলল, “বাবা শোনো। অনেক হয়েছে। আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।”

আমির সাহেব চমকে উঠে বললেন, “মানে?”

সাবা কঠিন গলায় বলল, “আমার ডিভোর্সের ব্যবস্থা কবে করছো তুমি?”

আঁতকে উঠে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন আমির সাহেব এবং ফাহমিদা বেগম। মেয়ের সংসার জীবন যে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, এটা তাদের অজানা নয়। তবুও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন সাবাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শান্ত রাখতে। পরম করুনাময়ের ইচ্ছা ছাড়া বিয়ে হয় না। একবার বিয়ে হয়ে গেলে হাজার কষ্ট সহ্য করে হলেও মানিয়ে নেওয়া শিখতে হয়। কথায় কথায় বিয়ে ভেঙে ফেলার চিন্তা করতে হবে কেন?

ফাহমিদা বেগম অবাক গলায় বললেন, “ডিভোর্স? এসব কী ধরনের কথা সাবা?”

সাবা বিরক্ত গলায় বলল, “খুবই বাস্তবভিত্তিক কথা। তোমরা কি আশা করেছো ওই লোকের সাথে আমি আজীবন থাকবো? অসম্ভব!”

আরেকবার চায়ে চুমুক দিয়ে নিজেকে শান্ত করলো সাবা। শাফকাতের মুখটা কল্পনায় ভেসে এলেও গা জ্বলে ওঠে তার। এই অসহ্যকর মানুষটার সাথেই তার বিয়ে হতে হলো!

সাবা কঠিন ভঙ্গিতে বলল, “তোমার বন্ধু মারা যাচ্ছিল, মরার আগে তার ছেলের বিয়ে দেখার শখ হয়েছে। এজন্যেই তো জোর করে বিয়েটা দিয়েছিলে আমাকে। লোকটা তো বিয়ে দেখে মরেই গেল। এখন আমাকে এই বিয়ে থেকে মুক্তি দাও।”

আমির সাহেব যথাসম্ভব নরম গলায় বললেন, “বিয়ে কোনো ছেলেখেলা না মা। এই ইচ্ছা হলো, একটা মানুষকে বিয়ে করলাম। এই ইচ্ছা হলো বিয়েটা ভেঙে ফেললাম।”

সাবার রাগটা আর বাঁধ মানলো না। রাগে জ্বলে উঠে সে বলল, “আমার তো বিয়ে করার ইচ্ছা কোনো কালেই হয়নি বাবা। জোর করে বিয়ে দিয়েছো তোমরা আমাকে। বিয়ের আগে আমার কথা শোনারও প্রয়োজন মনে করোনি!”

ফাহমিদা বেগম বেশ টের পেলেন অবহাওয়া সুবিধাজনক নয়। মেয়ের রাগ সমন্ধে বেশ ধারণা আছে তার।

তাই তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বললেন, “আচ্ছা থাম বাবা! শাফকাত করেছেটা কী?”

সাবা আক্ষেপের সুরে বলল, “জিজ্ঞেস করো কী করেনি! তেজপাতা বানিয়ে ছেড়েছে আমার জীবনটাকে! তাকে কে অধিকার দিয়েছে প্রতিনিয়ত আমাকে কন্ট্রোল করার? আমাকে টিভি দেখায়, এটা না-কি তার পছন্দ না। আমি রাত-বিরেতে রিপোর্ট করতে গেলে একগাদা বডিগার্ডকে সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়।”

ফামিদা বেগম সরল গলায় বললেন, “এটা তো ভালোই। রাতে একা একা বাইরে যাওয়ার থেকে বডিগার্ড নিয়ে যাওয়াটাই তো নিরাপদ।”

“সেদিন পার্টিতে গিয়েছি শাড়ি পড়ে। আমার শাড়ি পড়াও তার পছন্দ নয়। এজন্যে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এসেছে।”

“শাফকাতের পছন্দ না হলে শাড়ি পড়বি না। এতে সমস্যার কী হলো?”

সাবা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “প্রথমত, কারও পছন্দ-অপছন্দে আমি নিজের ড্রেসিং স্টাইল বদলাবো না। আর দ্বিতীয়ত সমস্যা এর থেকেও গুরুতর।”

“মানে?”

সাবা ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলল, “আজ সকালে জানতে পেরেছি আমার ফোন না-কি ট্র্যাক করা। কখন আর সঙ্গে কথা বলছি, সব সে শুনতে পারে।”

শাফকাতকে নিয়ে মেয়ের একের পর এক অভিযোগে তেমন একটা উদ্বিগ্ন না হলেও এবার চমকে উঠলেন আমির সাহেব। ফোন ট্র্যাক করা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি নয় কী? শাফকাত যখন ছোট, তখন তার বাবার সঙ্গে বন্ধুত্বটা ছিল তুঙ্গে।

এই ছেলেটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আমির সাহেব। তখন তার বয়স কত হবে? বড়জোর ছয়-সাত। ওইটুকু বয়সেই ছেলের যেমন রাগ তেমনই জেদ। একবার জেদ ধরলে তা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি।

একবার আমির সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে দাওয়াতে গেছেন শাহজাহান সাহেবের বাড়িতে। শাহজাহান সাহেব তখনও বাড়ি ফেরেননি। তার স্ত্রী আতিয়া আলম তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। কলিংবেল বেজে উঠতেই একজন স্টাফ দরজা খুলে দিলো।

ছোট্ট শাফকাত দরজার কাছে গিয়ে দেখলো বাবার হাতে অফিসের ব্যাগ ছাড়া কিছুই নেই। অথচ সে সকাল বেলা বলে দিয়েছিল, তার জন্যে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে আসতে। ব্যাট না পেয়ে রাগের বশে হাতের কাছে শাফকাত যা পায়, তাই ছুঁড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। বসার ঘরের দামী শোপিস থেকে শুরু করে ডাইনিং টেবিলের কাঁচের গ্লাস-প্লেট, কোনো কিছুই রেহাই পায়নি তার রাগের তীব্রতা থেকে।

ভাগ্যিস এর কিছুদিন পরেই আমির সাহেবের বদলি হয়ে যায় চিটাগংয়ে। সাবার জন্মও হয় সেখানে। দূরত্বে কারণে ফাটল ধরে দুই বন্ধুর সম্পর্কে। নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষাও হয় না, দেখা হওয়া তো দুঃসাধ্য ব্যাপার। সে কারণেই সাবা কখনো দেখেনি শাফকাত। আগে থেকেই তার অনিয়ন্ত্রণযোগ্য আচরণের কথা জানলে, জোর করেও বিয়েটা দেওয়া যেত না।

অবসর নিয়ে আমির সাহেব আবার ঢাকাতেই ফিরে এসেছেন। তবুও যোগাযোগটা আবার আগের মতো হয়নি শাহজাহান সাহেবের সঙ্গে। পুরনো বন্ধুকে তার মনে পড়লো মৃত্যুশয্যায়।

মৃত্যু পথযাত্রী বন্ধুর শেষ ইচ্ছা পূরণ ছাড়াও এমন তড়িঘড়ি করে সাবাকে বিয়ে দেওয়ার পেছনে আরও একটা কারণ আছে। কারণটা তার মানসিক বিধ্বস্তটা। গত এক বছরে ভয়ানকভাবে বদলে গেছে মেয়েটা। মুখের হাসি উড়ে গেছে, অন্তরের শান্তি মিটে গেছে। এই বাড়িতে থেকে প্রতিনিয়ত বিচিত্র যন্ত্রণায় ভুগতো সে।

আমির সাহেব এবং ফাহমিদা বেগম ভেবেছিলেন, বিয়েটা হয়ে গেল মেয়ে তাদের সব যন্ত্রণা ভুলে থাকবে। সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং আরও অস্থির হয়ে পড়েছে সাবা।

সাবা আক্ষেপের সুরে বলল, “আমার প্রাইভেসি বলে কিছু নেই বাবা? যতই স্বামী হোক, তুমি মানতে পড়তে যদি মা তোমার ট্রাক করার চেষ্টা করতো?”

আমির সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “না, না। এটা একদমই ঠিক করেনি শাফকাত।”

সাবা অধৈর্য কণ্ঠে বলল, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না বাবা। অনেক তো চেষ্টা করলাম। আমার কোনো কাজে কখনো বাঁধা দাওনি তোমরা আমাকে। এই লোকটার একেকটা বাঁধা তার আরও বেশি অসহ্য লাগে। সবথেকে অসহ্য লাগে তার ব্যবহার। সে এমন একটা ভাব করে যেন আমাকে বিয়ে করে দয়া করেছে। অথচ দয়া তো করেছি আমি!”

ফাহমিদা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আহ্! এসব কী কথা সাবা?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আমির সাহেব নরম স্বরে বললেন, “মা রে, সবই তো বুঝলাম। বিয়েটা যদি ভেঙেও দিই, কোথায় থাকবি তুই? এ বাড়িটা তো বিষ হয়ে গেছে তোর কাছে। এতদিন পর আমাদের সাথে দেখা করতে এসেও বাড়ির ভেতরে ঢুকছিস না। কোথায় যাবি তাহলে?”

সাবা সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো, “একা থাকবো। সেই সামর্থ্য আমার আছে।”

“এই শহরে একা একটা মেয়ের সঙ্গে কতটা বিপজ্জনক তোকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিতে হবে না?”

সাবা চুপ করে রইলো। উফ! এই পৃথিবীতে কেন যে নারী-পুরুষকে আলাদা চোখে দেখা হয়? মেয়েরা তো মানুষই, ভিন্ন কোনো প্রজাতি নয়। তবুও কেন প্রতিটা পদক্ষেপে তাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে একের পর এক বাঁধা?

ফাহমিদা বেগম হালকা গলায় বললেন, “তাছাড়া শাফকাতের ব্যাপারগুলো গায়ে না মাখলেই তো নয়। তুই তোর মতো চলবি, শাফকাত তার মতো চলবে। ছোট ছোট বিষয়ে এত বিচলিত হওয়ার প্রয়োজন তো দেখি না।”

সাবা শুকনো গলায় বলল, “তার মানে তোমরা ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবে না?”

বাবা বা মা কারও কাছ থেকেই কোনো উত্তর না পেয়ে উঠে দাঁড়ালো সাবা। লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল বাড়ির বাইরে। প্রচন্ড অসহায় লাগছে তার। বুকটা ভারী হয়ে উঠেছে। আগের সাবা কষ্ট পেলেই বালিশে মুখ গুজে কিংবা বাথরুমে লুকিয়ে লুকিয়ে অশ্রু ঝরাতো। এখন তো সে উপায়ও নেই। সে যে কাঁদতেও ভুলে গেছে।

(চলবে)