লেবু পর্ব-১০

0
2

#লেবু
১০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

দেশের সবথেকে বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেল ‘The Paradise’। ঢাকায় যাদের স্থায়ী বসবাস, হোটেলে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তাদের খুব একটা দেখা যায় না। তবুও সাবা বেশ কয়েকবার এসেছে এখানে। কখনো বান্ধবীদের সাথে সুইমিং পুলের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে, কখনো অফিসের কোনো মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে, আবার কখনো বাবা-মায়ের সঙ্গে ডিনার করতে। তবে ভুলক্রমেও কখনো টের পায়নি এই হোটেলের মালিকই একদিন হবে তার স্বামী।

স্বামী শব্দটার সঙ্গে এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি সাবা। মন সায় দিতে চায় না শাফকাত তার স্বামী। তার সঙ্গে জোর করে বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ব্যস এতটুকুই! এতকাল মন শাফকাতকে মেনে নিতে না পারলেও আজকাল আবার অস্বীকারও করতে পারছে না। এই দারুণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝেই কাটছে দিনকাল।

বিয়ের পরপর শাফকাতের সঙ্গে খুব একটা কথা হতো না সাবার। মনের অন্তঃস্থল থেকে তার প্রতি এক ধরনের অনীহা, এক ধরনের বিরক্তি জন্মে গিয়েছিল। একটা ছেলে বিয়ের আগে কী করে তার হবু স্ত্রীর মতামত না নিয়ে বিয়ে করতে পারে? শাফকাত বিয়ের আগে তার সঙ্গে কথা বলারও প্রয়োজন বোধ করেনি বলে তার প্রতি রাগটা যারপরনাই বেশি ছিল।

রাগ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। সাবা নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হয়, এভাবে জীবন চলে না। শাফকাতের মৃত্যু পথযাত্রী বাবার শেষ ইচ্ছা পুরণার্থে বিয়েটা করেছিল তারা মনের বিরুদ্ধে। লোকটা বিয়ের পরপরই মৃত্যুবরণ করে চলে যায় অজানা এক দেশে। বাঁধনে আটকা পড়ে যায় এই দুটো মানুষ।

কোনো এক অজানা কারণে সাবার সহ্যই হয় না শাফকাতকে। ছেলেটার গাম্ভীর্য, সোজাসাপ্টা কথা বলা, কাউকে তোয়াক্কা না করা, নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া – এসব নিয়ে সাবার বিরক্তির শেষ নেই। শাফকাতও যে এই বিয়েটা নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বসিত নয়, বেশ বুঝতে পারছিল সাবা।

ভেবেছিল ঠান্ডা মাথায় কথা বলে দুজনে আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এই ছেলের মাথা শেষ কবে ঠান্ডা হয়েছিল, সম্ভবত সে নিজেও জানে না। ডির্ভোসের কথা তুলতেই তাই দিলো জানে মেরে ফেলার হুমকি।

সাবা এই ছেলেটাকে বুঝতে পারে না। একবিন্দুও না। বাইরে বাইরে সে এমন একটা ভাব দেখায়, সাবার উপস্থিতিতে যেন তার মাঝে বিরক্তির ছড়াছড়ি। অথচ ভেতরে ভেতরে ঠিকই সাবার জন্যে উদ্বিগ্ন সে। না হলে সেদিন জোর করে সাবাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে বের হতো না। তাহলে কি শাফকাত ভালোবেসে ফেলেছে সাবাকে?

প্রশ্নটা জেগে মনে উঠতেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সাবা। ভালোবাসবে, তাও আবার শাফকাত আলমের মতো যন্ত্রমানব? এ যেন অসম্ভবেরও উর্ধ্বে?

গাড়ি প্যারাডাইসের সামনে থামতেই হইচই পড়ে গেল। হোটেলের ভেতর থেকে ম্যানেজার নিজে ছুটে এলো। সঙ্গে হোটেলের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা। মিষ্টি গলায় “স্যার, স্যার” করছে অনবরত। তাদের মিষ্ট ভাষাকে উপেক্ষা করে শাফকাত পা রাখলো হোটেলের ভেতরে। সাবাও প্রবেশ করলো তার পিছু পিছু।

হোটেলের কর্মকর্তারা একবার তাকে বসতে বলছে, একবার জিজ্ঞেস করছে কী খাবে, একবার বলছে পুরোটা হোটেলটা ঘুরে দেখাবে কিনা! এসব আকস্মিক আপ্যায়ন পেয়ে সাবাও নেহায়েত কম বিরক্ত নয়। একটা সময়ে পাত্তা পেতে ভালোবাসতো সে। তবে আজকাল কারও এক বিন্দু পাত্তা পেলেও যেন গা জ্বলে যায় বিরক্তিতে।

শাফকাত রিসিপশনে গিয়ে কী যেন করছে।
সাবা হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে দেখছে চারপাশ। মাথার ওপরে বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি। একপাশের দেয়ালজুড়ে দামী দামী পেইন্টিং, শো পিস। ধবধবে সাদা রঙের সোফা সুসজ্জিত করে রাখা চারপাশে। লবি থেকে কিছুটা দূরে চোখ গেল সাবার। একটা দরজার বাইরে চমৎকার আলোকসজ্জা। এই দরজার অপরপ্রান্তে হোটেলের পার্টি হল। ওখানেই নিশ্চয়ই শাফকাত নিয়ে যাবে সাবাকে।

রিশিপশন থেকে ফিরে এলো শাফকাত। তবে সেই পার্টি হলের দিকে এগিয়ে গেল না। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে পা বাড়ালো লিফটের দিকে। সাবা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে পিছু নিলো শাফকাতের। কাঁচে ঘেরা গোলাকার লিফট। ভেতর থেকে পুরো হোটেলের প্রতিটি তলায় কী হচ্ছে না হচ্ছে দেখা যায়।

সাবা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “আমরা ওপরে যাচ্ছি কেন? পার্টি না নিচে হওয়ার কথা?”

শাফকাত তার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বরং রহস্যের ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “বাহ্! এতটুকু বুদ্ধি আছে তাহলে তোমার?”

মেয়েরা অনেককিছুই আগেভাগে আঁচ করতে পারে। তেমনই কিছু একটা আঁচ করে সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

শাফকাত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমার প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে।”

এই হোটেলের সবথেকে জাকজমোক প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটটা গেস্টদের ভাড়া দেওয়া হয় না। সেটা শাফকাতের একান্ত নিজস্ব। মাঝেমধ্যে ক্লান্ত হয়ে পৃথিবীর সবকিছুর ওপর বিরক্তি ধরে গেলে শাফকাত এখানে এসে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকে দিনভর।

সাবা খানিক ভীত স্বরে বলল, “কেন?”

শাফকাত কৃত্রিম আক্ষেপ নিয়ে বলল, “নাহ্! ভুল ভেবেছিলাম। এক ফোঁটাও বুদ্ধি নেই তোমার মাথায়।”

“কী বলতে চাচ্ছেন? হেঁয়ালি না করে বলুন তো!”

শাফকাত সরাসরি সাবার চোখের দিকে তাকিয়ে অন্যরকম গলায় বলল, “একটা ছেলে একটা মেয়েকে হোটেল রুমে কেন নিয়ে যায় সাবা?”

শীতল স্রোত বয়ে গেল সাবার গা বেয়ে। যে ভয়টা মনে মনে বেড়ে উঠছিল, সেটাই সত্যি হলো। শফাকাতের পাশে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে ছিল সে। এক নিমিষে ছিটকে গিয়ে সেই নিরাপদ দূরত্বটাকে আরেকটু নিরাপদ করে দিলো সাবা। লিফটের বাটনগুলো কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের অজান্তেই তার কম্পিত আঙ্গুলগুলো গিয়ে পড়লো ডোর ওপেন বাটনের ওপরে। তবে চলন্ত লিফট তৎক্ষণাৎ থেমে পড়লো না।

সাবা ভয়মিশ্রিত গলায় বলল, “আমি বের হবো!”

শাফকাত তার কাছে এগিয়ে আসতে আসতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “Don’t you dare to.”

মুহূর্তেই শাফকাত চেপে ধরলো সাবার বাহু। এতটাই জোরে চেপে ধরেছে সে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠার উপক্রম সাবার। তবুও বিনা প্রতিবাদে সাবা সহ্য করলো সেই ব্যথা। ব্যথার থেকে মনে বাড়তে থাকা ভয়ের তীব্রতা প্রবল।

সাবা শাফকাতের পোক্ত বাঁধন থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “ছাড়ুন আমাকে! আমি বের হবো।”

এতক্ষণে লিফটের দরজা খুলে গেছে। তারা পৌঁছে গেছে তাদের গন্তব্য তেরো তলায়। শাফকাত সাবার বাহু আঁকড়ে ধরেই তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল লিফটের বাইরে।

রহস্যমাখা গলায় বলল, “সেই সুযোগ আর তোমার কাছে নেই সাবা। অনেক দেরি হয়ে গেছে।”

ভয়ের মাঝেও শাফকাতের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটের চাকচিক্যে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না সাবা। হোটেলের মধ্যে এ যেন আলাদা একটা বাড়ি। দরজা খুলে যেতেই চমৎকার একটা লিভিং রুম। গোলাকার সোফার মাঝখানে সেন্টার টেবিল। সোফার সামনেই দেয়ালে ঝুলন্ত প্রকান্ড টিভি। দেয়ালের একপাশে বিশাল পিয়ানো। আসলেই এই পিয়ানো কাজ করে না-কি সৌন্দর্যের জন্যে রাখা হয়েছে কে জানে।

সোফার পাশ দিয়েই চলে গেছে সিঁড়ি। সিঁড়িগুলো স্বচ্ছ কাঁচের। সিঁড়ির রেলিংও কাঁচের। শাফকাত সাবাকে নিয়ে উঠে যাচ্ছে একেকটা সিঁড়ি বেয়ে। প্রতিক্রিয়া জানাতেও ভুলে গেছে সাবা। ঘুর্ণাক্ষরেও যদি টের পেতো, শাফকাতের মনে এই উদ্দেশ্য রয়েছে – কখনোই আসতো না তার সঙ্গে। নিজেকে শাফকাতের হাতে তুলে দেবে না সাবা। কিছুতেই না। তবে কি করে তাকে বাঁধা দেওয়া যায় তাও বোধগম্য হচ্ছে না এই মুহূর্তে। মেয়েরা কি এতটাই অসহায়?

ওপরে এসে সাবার হাত ছেড়ে দিলো শাফকাত। তার চোখেমুখে কোনো ভিন্নতা নেই। চিরচেনা গাম্ভীর্য লেগে আছে শাফকাতের চোখদুটোতে। তবে এই গাম্ভীর্যের মাঝেও যেন খানিক ভিন্নতা রয়েছে। খালি চোখে দেখা না গেলেও বুঝতে পারছে সাবা।

এক পা এক পা করে পেছাচ্ছে সে। একটু একটু করে তার দিকেই এগোচ্ছে শাফকাত। সাবার মাঝে এই মুহুর্তে ভয়ের থেকেও যে জিনিসটা সবথেকে বেশি কাজ করছে, তা হলো নার্ভাসনেস। বিয়ের পর থেকে শাফকাত তার কাছে আসার কোনো চেষ্টা করেনি, সেই হামলার রাত বাদে। তাই, তার নতুন অদেখা এই রূপটা দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছে মেয়ে।

পেছাতে পেছাতে ধবধবে সাদা একটা ক্লজেট এসে ঠেকলো সাবার পিঠে। আর পেছানোর পথ নেই। এগিয়ে গিয়ে পালানোর পথও নেই। তার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে শাফকাত। একটা হাত সাবার পাশ দিয়ে ক্লজেটে বেঁধে কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছে সাবার দিকে।

তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে সাবা জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বলল, “দেখুন আমি এসবের জন্যে প্রস্তুত নই।”

শাফকাত চোখের কোনে সূক্ষ্ম হাসির রেখা নিয়ে বলল, “আচ্ছা? কোনসবের জন্যে?”

সাবা আকুতির সুরে বলল, “প্লিজ আমাকে যেতে দিন।”

আচমকা শাফকাত আরেক হাতে ক্লজেটের দরজা খুলে সেখান থেকে বের করে আনলো হ্যাঙারে ঝোলানো একটা শাড়ি।

“রেডি হয়ে নাও! এই জিন্স-শার্ট পরে পার্টিতে গিয়ে আমার প্রেস্টিজের বারোটা বাজানোর প্ল্যান করছিলে?”

রীতিমত বোকা বনে গেল সাবা। ছি ছি! দিন-দিন তার বিবেক বুদ্ধি এতই লোপ পাচ্ছে? তাকে বোকা বানানো এতটাই সোজা হয়ে গেছে আজকাল?

হ্যাঙারটা সাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরে গেল শাফকাত। বিছানার পাশের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরালো। সাবার বড় বড় চোখদুটো যেকোনো মুহূর্তে হাসতে বাধ্য করবে তাকে। নিজের হাসি দেখাতে চায় না সে মেয়েটাকে।

নিজেকে সামলে স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লাগলো সাবার। নিজের বোকামি দেখে নিজেরই গা জ্বলে যাচ্ছিল রাগের।

কিছুটা স্বাভাবিক হতেই সাবা থমথমে গলায় বলল, “আমার শাড়ি পরা নিয়ে তো আপনার মাথাব্যথার শেষ নেই! তাহলে নিজেই আবার শাড়ি পরতে বলছেন কেন?”

শাফকাত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ভদ্রভাবে শাড়ি পরলে কোনো মাথাব্যথাই থাকবে না।”

সাবা প্রতিবাদের সুরে বলল, “দেখুন! আমি সবসময় ভদ্রভাবেই শাড়ি পরি।”

শাফকাত মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “এই মেয়ে! সারাক্ষণ শুধু তর্ক করো কেন? আর কোনো কাজ নেই? যাও, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো।”

ঘরের পাশেই একটা ড্রেসিং রুম আছে। সেখানে গিয়ে শাড়িটা পড়ে নিলো সাবা। সোনালী রঙের জর্জেট শাড়ি। পাড়ে লালাভ পাথর দিয়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাজ করা। ডিজাইনার শাড়ি হওয়ার সুবাদে ব্লাউজ সঙ্গেই ছিল। শাড়িটা পড়ে হালকা সাজলো সাবা। ব্যাগ থেকে লিপস্টিক আর কাজল বের করে এগুলো দিয়েই সেজে নিলো।

ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে সাবা দেখে ঠিকই একই থমথমে ভঙ্গিটা বজায় রেখে সোফায় বসে থাকা শাফকাতকে। মোবাইলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেন টাইপ করছে।

সাবা তার দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে বলল, “চলুন!”

শাফকাত অন্যমনস্ক চোখদুটো তুলে একবার সাবাকে দেখে আবারও তা ফিরিয়ে নিয়েছিল মোবাইলের দিকে। আচমকা আবারও চোখ তুলে তাকালো সাবার দিকে। শাড়ি আর খোলা চুলে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে সাবাকে। মেয়েটা এমনিতেই সুন্দর। তবে হঠাৎ হঠাৎ তাকে এমন অচেনা সৌন্দর্যে দেখে বুকের ভেতর বড়সর ধাক্কা খেয়ে ওঠে শাফকাত। ঠিক এই মুহূর্তে মনের মাঝে সুপ্ত ইচ্ছা জেগে উঠলো যে ভয়টা দেখিয়ে সাবাকে এ ঘরে নিয়ে এসেছিল সেই ভয়টা সত্যি করে তুলতে।

বহুকষ্টে নিজেকে সামলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো শাফকাত। সাবাও নামলো তার পিছু পিছু। সঙ্গে ফেলল ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসও। না জানি আজ আরও কত কী অপেক্ষা করছে তার ভাগ্যে!

(চলবে)