লেবু পর্ব-১৫+১৬

0
2

#লেবু
১৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

জীবনের যে অধ্যায়ের শুরুটাই তিক্ততা দিয়ে, সে অধ্যায় জুড়ে তিক্ততার ছড়াছড়ি থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এমন স্বাভাবিকতা কোনোকালেই আশা করেনি আহনাফ। ভেবেছিল বিয়ের পর ইতির সন্দেহ কমে যাবে। কিংবা ইতির ভাষায় যাকে ‘পাগলামি’ বলে, তা কমে যাবে। কিন্তু তা কমলো তো না-ই বরং ঢেরগুণে বেড়ে গেল।

বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার অভ্যাস আহনাফের জীবনে নতুন নয়। প্রায় ক্লাস শেষে বন্ধুদের নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে কিংবা রিসোর্টে আড্ডা দিতে চলে যায় সে। ইতির কাছে ব্যাপারটা অজানাও নয়। শুরুর দিনগুলোতে তো বন্ধুদের এই আড্ডায়ও আহনাফের পিছু নিয়েছিল সে। তাকে এক নজর দেখার লোভে।

সেই ইতি আহনাফের আড্ডা নিয়ে আপত্তি তুলল। সন্ধ্যার পর সে বাইরে কাটাতে পারবে না। ইতির অহেতুক অভিযোগ এক বাক্যে কখনো মেনে নেয়নি আহনাফ। এই নিয়ে তুমুল বাক-বিতন্ডায় জড়ালো দুজনে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে অবশ্য আড্ডা কমিয়ে দিলো আহনাফ।

ইতির সঙ্গে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকলেও সপ্তাহে দুয়েকদিন আহনাফ বাবা-মা আর বোনের সঙ্গে বাড়িতে ডিনার করতো। সেই ডিনারে উপস্থিতি ছিল না ইতির। যেহেতু বাবা-মা এখনো ইতিকে সেভাবে মেনে নেয়নি, ইতিও তাদের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে – তাই দু পক্ষকেই একটু সময় দিতে চেয়েছিল আহনাফ।

এ নিয়েও ইতির ঘোর আপত্তি। তার মতে, ঘন ঘন বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা ভাববে বউয়ে কাছে আহনাফ ভালো নেই। আসলেই কী ভালো ছিল? আহনাফ নিজেই বুঝতে পারছিল না। এতটুকু বুঝতে পারছিল, হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা চূড়ান্ত বোকামির কাজ হয়েছে।

বিয়ে মানুষ তাকেই করে, যার সঙ্গে অনায়াসে গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আর সেই অনায়েস বিয়ের দিন থেকে ছুটি নিয়েছে আহনাফের জীবন থেকে। তবুও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল ছেলেটা প্রতিনিয়ত। ভালো তো বাসে ইতিকে। জগতের সকল সত্য মিথ্যা হয়ে গেলেও এই ভালোবাসা জিনিসটা সত্যই থেকে যায়।

একদিন ক্যাম্পাসে আহনাফ হতাশ ভঙ্গিতে সাবাকে বলল, “ইতির সাথে কিছুতেই সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে না রে। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে হয় ঝগড়া, না হয় রাগারাগি করে মুখ দেখা বন্ধ। এসব আর কতদিন সহ্য করা যায় বল তো?”

সাবা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “এক কাজ করো ভাইয়া! ইতিকে নিয়ে ঘুরতে যাও।”

“আমাদের সম্পর্কের যে অবস্থা, তার মধ্যে আবার ঘুরতে যাবো?”

“হ্যাঁ যাবে। সম্পর্কটা ঠিক করার জন্যেই যাবে।”

বোনের কথা আমলে নিয়ে আহনাফ ইতির পাসপোর্ট করালো। দুজনে ঘুরতে গেল নেপালে। কাঠমান্ডু থেকে পোখারা, পোখারা থেকে নাগরকোট। সাত দিনের ভ্রমণ তার ভেঙ্গে পড়া সম্পর্কটাকে যেন আবারও জোড়া লাগিয়ে দিলো। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দুজনে হাতে হাত রেখে চালালো দীর্ঘ কথোপকথন। কথার অভাবে দুটো মানুষ বহু দিন ধরে একে অপরকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। কথা বলে দুজনেই বুঝলো একে অপরের ভেতরটা। ইতি স্বীকার করলো, ইদানিং সে একটু বেশিই কঠোর হয়ে পড়ছে আহনাফের প্রতি। কথা দিলো, অহেতুক সন্দেহ আর কখনোই করবে না।

ইতি তার কথা রেখেছে। ঢাকায় ফিরে সত্যিই আহনাফকে সন্দেহ করা থামিয়ে দিলো। দুজনের সম্পর্কটা ঠিক আগের মতোই উজ্জ্বল, রঙিন, প্রাণে ভরপুর। কয়েকটা মাস এভাবেই কেটে গেল।

ইতির আর সাবার মাস্টার্সের ফাইনাল সেমিস্টার চলছে। সাবা ওদিকে গ্র্যাজুয়েশনের আগেই চাকরির অফার পেয়ে গেছে নিউজ চ্যানেল ‘বাংলার বাতাস’ থেকে। আমির সাহেব এবং ফাহমিদা বেগম অভিমান ভুলে ততদিনে পুত্রবধূকে আপন করেও নিয়েছেন। ঠিক হলো ইতির গ্র্যাজুয়েশনের পর ধুমধাম করে আবারও বিয়ের অনুষ্ঠান হবে তাদের। ফাহমিদা বেগম নিজে বরণ করে ছেলের বউকে ঘরে তুলবেন।

জীবনে আনন্দের ছড়াছড়ি। সেবারই বোধ হয় শেষবারের মতো প্রশস্ত ঠোঁটে হেসেছিল আহনাফ। বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। এর পরের দিনগুলোতে আর কখনোই হাসি নেমে আসেনি তার ঠোঁটে।

ইতির কোনো আত্মীয়-স্বজন বা আপনজন নেই বলে আহনাফ বিয়ের পরপরই তাদের ফ্ল্যাটটা লিখে দিয়েছিল ইতির নামে। তার সমস্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নমিনীও ইতি। এ নিয়ে পরিচিত জনেরা আহনাফকে সাবধান করলেও সে উপেক্ষা করেছে। যখন টের পেলো কত বড় ভুল সে করে ফেলেছে, ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে।

ইতি আবারও বদলে গেল। তবে এবার ভিন্নরূপে। আহনাফের সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলে না, তার কথা শোনে না। আহনাফ হয়তো ভেবেছিল কোনো কারণে মেয়েটা ডিসটার্বড। তবে আদতে তেমন কিছুই নয়। ফোনে তার কথোপকথন চলে ঠিকই হাসিমুখে। আহনাফের বেলাতেই যত গাম্ভীর্য।

মেয়েদের চিরকালের অভিযোগ, ছেলেরা না-কি তাদের মুড সুইং বোঝে না। আহনাফ বরাবরই বুঝে এসেছিল। ভাবলো, ইতির মুড বোধ হয় সুইং করছে। দুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে ঠিক কিছুই হলো না।

আহনাফের প্রতি ইতির অদৃশ্য একটা অনীহা। আহনাফের দিকে তাকায়ও সে বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে। আহনাফ কিছুই বুঝে উঠতে পারে না, তার চিরচেনা ইতি কী করে বদলে গেল আচমকা?

দিন যতই কাটছে, তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের তারিখ ততই এগিয়ে আসছে। ফাহমিদা বেগম হুলুস্থূল কান্ড বাঁধলেন। নিজের হাতে পুত্রবধূর বিয়ের শাড়ি কিনে আনলেন। ছেলের শেরওয়ানি কিনলেন। বাড়ি মেরামত করালেন। রাজ্যের সব আত্মীয়দের খবর দিলেন।

ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে সাবার আগ্রহও নেহায়েত কম ছিল না। নিজের হাতে নতুন করে বাড়িটাকে সাজালো সে। বিয়ের অনুষ্ঠানের সমস্ত প্ল্যানিংও করলো নিজ হাতে।
পরিবারের মানুষগুলোর আনন্দে কেন যেন আনন্দিত হতে পারলো না আহনাফ। বিচিত্র ভঙ্গিতে খচখচ করতে লাগলো তার মনটা।
মন কেন যেন বলছিল, এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী নয়। মনের কথাটা অগ্রাহ্য করে দিনযাপন করতে লাগলো আহনাফ।

তবে শেষমেশ মনের কথাটিই সত্যি হলো। অনুষ্ঠানের ঠিক দুদিন আগে ইতি গম্ভীর গলায় বলল, “বিয়ের অনুষ্ঠান কোনমতে ক্যান্সেল করা যায় না আহনাফ?”

আহনাফ আঁতকে উঠে বলল, “কেন? ক্যান্সেল করতে হবে কেন?”

ইতি শুকনো গলায় বলল, “সম্পর্কটা আর রাখতে চাচ্ছি না। আমরা একে অপরের জন্যে পারফেক্ট নই আহনাফ। আমাকে বিয়ে তো লুকিয়ে লুকিয়ে করেছিলে। পৃথিবীর কেউ জানেও না আমাদের বিয়ে হয়েছে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে কাউকে জানানোর আগেই সম্পর্কটা শেষ করে দেওয়া উচিত।”

আহনাফ থ বনে তাকিয়ে রইলো ইতির দিকে। অথচ ইতির মাঝে কোনো অনুভূতি নেই, অনুতাপ নেই। যন্ত্রের মতো কথাগুলো বলে গেল সে। দুই বছর সংসার করার পর ইতির আজ হঠাৎ মনে হলো তারা একে অপরের জন্যে পারফেক্ট নয়?

অনেকটা সময় চুপ করে থেকে নিজেকে সামলালো আহনাফ। হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। কোন প্রশ্নের পর কোনটা করবে, তাই ভেবে হিমশিম খাচ্ছে অনবরত।

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে শীতল গলায় বলল, “কেন জানতে পারি?”

ইতি বিরস কণ্ঠে বলল, “বিয়ের শুরু থেকেই আমরা দুজনে ভালো নেই। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না। একটা ভুল করে ফেলেছি। এখনও ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ আছে। সেটা না করে লোকজন জানিয়ে নতুন করে বিয়ে করে ভুলটা চালিয়ে যাওয়ার তো কোনো মানে হয় না।”

চোখ বন্ধ করে লম্বা একট শ্বাস নিয়ে আহনাফ শান্ত গলায় বলল, “ছেলেটা কে?”

ইতি বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে বলল, “Don’t make this any harder. আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও আহনাফ। এতে তুমিও ভালো থাকবে, আমিও ভালো থাকবো।”

ইতির বলা একটি কথাও বিশ্বাস হচ্ছিল না আহনাফের। মনে হচ্ছিল এটা বাস্তব নয়। স্বপ্নদৃশ্য কোনো। ঘুম ভেঙে গেলেই স্বপ্ন শূন্যে মিলিয়ে যাবে। হাসিমুখে ইতিকে আবারও বিয়ে করে ঘরে তুলবে সে।

যে মেয়েটা তাকে না দেখে একটা দিনও কাটাতে পারতো না, আজ সেই মেয়েটাই মুক্তি চাইছে তার কাছে? আহনাফকে না পেলে না-কি তার জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে? পেয়েও ছেড়ে দিচ্ছে যে? এতে হবে না তার জীবন বৃথা?

ইতি সেদিনই স্যুটকেস গুছিয়ে বেরিয়ে গেল তাদের ফ্ল্যাট থেকে। কোথায় গেল আহনাফ জানে না। জানার চেষ্টাও করেনি। তার মস্তিষ্ক কেবলই সদ্য পাওয়া ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছে। বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।

বিয়ের অনুষ্ঠান আর হলো না। ফ্ল্যাট ছেড়ে বাবা-মায়ের কাছে বাড়িতে ফিরে গেল আহনাফ। ভেতরে ভেতরে নিমিষেই ভেঙে পড়লো ছেলেটা। কখনো হয়তো আশাই করেনি আচমকা এক সকালবেলা ইতি তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে। এবং সত্যি সত্যি ছেড়েও যাবে।

প্রথম প্রথম আহনাফ বুঝতে পারছিল না কষ্টটা ঠিক কোথায় হচ্ছে। পরবর্তীতে যদিও বুঝতে পারে। ভালোবাসা, কষ্ট দিয়ে দিয়ে নিঃশেষ করে ফেলছিল তাকে। অবাককর হলেও সত্য, তার মনটা ভালোবাসা নামক বেড়াজাল থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। ইতি কোনো কারণ ছাড়া তাকে ছেড়ে যেতে পারলেও, আহনাফের মনটা এখনো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ইতির পানে।

ভয়ানক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল আহনাফ। কাজে তার মন নেই। নিজের প্রতি তো একেবারেই নেই। দিনরাত এক করে কেবল একটিমাত্র প্রশ্ন সে করে নিজেকে। “ইতি কেন আমাকে ছেড়ে গেল?”

প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় কোনো কমতি রাখেনি আহনাফ। ইতির সঙ্গে অসংখ্যবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। ইতি তার ফোন রিসিভ করেনি, ইউনিভার্সিটিতেও এড়িয়ে চলছে। ইতি আহনাফের বাবা-মাকে এমনভাবে চেপে ধরলো যে তারা নিজেরাই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করলেন। চোখের সামনে এত যত্নে গড়া ভালোবাসা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। অথচ আহনাফের কিছুই করার ছিল না।

যেমন গোপনে তাদের বিয়েটা হয়েছিল, তেমনই গোপনীয়তার সাথে দুজনে সাইন করে দিলো ডিভোর্স পেপারে। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিলেও আহনাফের মন এক মুহূর্তের জন্যেও ভাঙতে চায়নি সম্পর্কটা। তখনো ছেলেটা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার।

ডিভোর্স পেপারে দুপক্ষ স্বাক্ষর করে দেওয়ার তিন মাস পর ডিভোর্স কার্যকর হয়। এই তিন মাসে যদি তাদের মনে হয়, ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে আসবে, তবে সেই সুযোগও রয়েছে। আহনাফ চেয়েছিল এই তিন মাসের আগেই সব ঠিকঠাক করে আবারও সম্পর্কটা আগের মতো করে নিতে।

ক্যাম্পাসে ইদানিং ইতিকে একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র। ইতির বয়সী, দেখতে শুনতেও ভালো। ছেলেটার সঙ্গে ক্যান্টিনে বসে হাস্যোজ্বল ইতির সিঙারা খাওয়া, ক্লাস শেষে ছেলেটার বাইকের পেছনে বসে তার কাঁধে হাত রাখা – আহনাফকে একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছিল।

একদিন ক্লাস শেষে সকলে বেরিয়ে গেলে ইতিকে ডাকলো আহনাফ।

গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ছেলেটার সাথে তোমার কী?”

ইতি বিরক্ত গলায় বলল, “তাতে তোমার কী? মনে রেখো আমি এখন আর তোমার বউ নই আহনাফ।”

“এই ছেলেটার জন্যেই আমাদের বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিলে তাই না?”

ইতি অবজ্ঞার সুরে বলল, “যেখানে সেখানে হুটহাট আমাকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করবে না আহনাফ। You’re embarrassing me!”

ইতির বদলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না আহনাফ। নিজের অজান্তেই ডিপ্রেশনের স্বীকার হয়ে যায় সে।

প্রাণপ্রিয় ভাইয়াকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে সাবা তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, “ইতিকে ভুলে যাও ভাইয়া। যে মানুষটা তোমার ওপরে চিট করলো, তার জন্যে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয়?”

আহনাফ শুকনো গলায় বলল, “ভালোবাসি তো এখনো। কী করবো বল?”

সাবা মলিন কণ্ঠে বলল, “ও তোমার ভালোবাসার যোগ্য নয় ভাইয়া।”

যোগ্য-অযোগ্যের বিচার করে ভালোবাসা গেলে বোধ হয় ভালোই হতো। এ পৃথিবীতে বেহায়া মনগুলো অযোগ্যদেরই ভালোবেসে যায়।

আহনাফের মনটা ততদিনে বড্ড অস্থির হয়ে উঠেছিল। বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল তার চিন্তাগুলো। ইতির সঙ্গে কথা বলার জন্যে মনটা ছটফট করে যাচ্ছে অনবরত। তবে ইতি না রিসিভ করছে তার ফোন কল, না দিচ্ছে দেখা করার সুযোগ।

সেদিন কাঁধে সাদা একটা টোট ব্যাগ ঝুলিয়ে করিডোর দিয়ে হেঁটে ক্লাসে যাচ্ছিল ইতি। আহনাফ আচমকা সবেগে পেছন থেকে এসে তার একটা হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তাকে চেপে ধরলো দেয়ালের সঙ্গে। ইতি এতটাই অবাক হলো যে, বিস্ময় স্পষ্ট ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। মৃদু ধাক্কায় আহনাফকে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।

আহনাফের চোখেমুখে একরাশ অস্থিরতা, প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

আহনাফ ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “আজ তোমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে ইতি! সত্যি করে বলো কেন ছেড়ে গেল আমাকে? না! তার আগে বলো কেন এসেছিলে আমার জীবনে?”

শান্ত-শিষ্ট আহনাফকে এই প্রথম পাগলামি করতে দেখে রীতিমত থ বনে গেল ইতি।

তার বিস্ময় উপেক্ষা করেই আহনাফ বলল, “আমি তো চাইনি তোমাকে। কেন পাগলপারা ভালোবাসায় ডোবালে আমাকে? আমাকে ভালোবাসায় পাগল করে কেন নিজেই আমার জীবন থেকে চলে গেলে? কেন করেছিলে এসব? আমাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে না-কি আমার সম্পত্তি পাওয়ার লোভে?”

আচমকা ইতি সজোরে আহনাফের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো তার হাতের পোক্ত বাঁধন থেকে। আহনাফ টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেল কয়েক পা।

ইতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমাকে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছিলাম আহনাফ। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এখন আমি কী করবো।”

লম্বা লম্বা পা ফেলে ইতি চলে গেল আহনাফের সামনে থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঝড়ের গতিতে পা বাড়ালো ভাইস চ্যান্সেলরের কক্ষে। ভিসি সাহেব আয়েশি ভঙ্গিতে কয়েকজন অতিথির সঙ্গে আলাপ করছিলেন। ইতিকে দেখে যারপরনাই বিরক্ত হলেন সে।

তার বিরক্তি আমলে না নিয়ে ইতি অগ্নি কণ্ঠে বলল, “আমাদের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের লেকচারার আহনাফ আমির, একটু আগে তিনতলার করিডোরে আমাকে অ্যাসল্ট করার চেষ্টা করেছে।”

(চলবে)

#লেবু
১৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সিসিটিভি ফুটেজ মিলিয়ে দেখা হলো, সত্যিই ফিক্সিজকের লেকচারার আহনাফ আমির মাস্টার্স ফাইনাল সেমিস্টারের ছাত্রী ইতিকে আচমকা পেছন থেকে এসে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরেছে। ইতি ছাড়া পেতে চাইছে কিন্তু আহনাফ তাকে শক্ত করে চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে কী যেন বলছে।

আহনাফকে জরুরি তলব করা হলো ভিসির রুমে। যখন সে জানতে পারলো তার বিরুদ্ধে এমন ভয়ঙ্কর অভিযোগ করেছে ইতি, তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। একটা মানুষ কতটা নিচে নেমে গেল এমন ভয়ঙ্কর মিথ্যা অভিযোগ করতে পারে তার বিরুদ্ধে?

এতকাল চেপে রাখা সত্যিটা অবশেষে বলেই দিলো আহনাফ, “ইতি আমার স্ত্রী। প্রায় দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে আমাদের।”

এবার ভিসি সাহেবের অবাক হওয়ার পালা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার মনে প্রশ্ন জাগে, “একটা মেয়ে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অ্যাসল্টের অভিযোগ আনবে কেন?”

ইতি বুঝতে পারছিল, নিজের বিছিয়ে রাখা জালে নিজের ফেঁসে যাচ্ছে সে। একবার তার মিথ্যা অভিযোগ প্রমাণিত হলে ইউনিভার্সিটি থেকে বহিস্কার করা হবে তাকে। এতদিনে বন্ধুমহলে তৈরি করা সুনাম মুহূর্তেই হয়ে যাবে ধুলিস্যাৎ।

ইতি দৌড়ে গিয়ে ক্যাম্পাসে জড়ো করলো ছাত্র-ছাত্রীদের। মূল ভবনের সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো। তার কান্না দেখে জড়ো হয়ে গেল আরো অনেক ছাত্র-ছাত্রী। বেশির ভাগের হাতেই মোবাইল ফোন। বাঙালির তো এই এক স্বভাব! ঘটনার আদ্যোপান্ত বুঝে ওঠার আগেই তার পকেট থেকে মোবাইল এসে পড়বে হাতের মুঠোয়। বিপদগ্রস্ত মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার তো দূরে থাক, আদৌ সে বিপদে পড়েছে কিনা বুঝে ওঠার আগেই ধারণ করা চাই তার ভিডিও।

ইতি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের স্রোতকে উদ্দেশ্য করে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। সেই কান্না সত্যি ছিল না-কি মিথ্যা কে জানে? একটা মানুষ মিথ্যা-মিথ্যি অমন তীব্রভাবে অশ্রু ঝড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে পারে? অবশ্য কান্না সত্যি হবারও তো কোনো আশঙ্কা নেই। এর অর্থ তবে একটাই, ইতি বরাবরই পাকা অভিনেত্রী।

কয়েক ছাত্র-ছাত্রী এক যোগে জিজ্ঞেস করলো তাকে, “আপু কী হয়েছে?”

প্রত্যুত্তরে ইতি আরও ঝড়ো গতিতে কেঁদে বলল, “দুই বছর ধরে আমার সাথে অন্যায় হয়ে আসছে। আমি প্রাণের ভয়ে চুপ করে ছিলাম। আজ আর চুপ করে থাকবো না। সবাইকে সব সত্যি জানিয়ে দেবো।”

ইতির বলা এই কয়েকটি বাক্য প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করলো ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে। সকলের কৌতুহল বেড়ে গেল এক লাফে। হাতে গোনা যে দুয়েকজন ইতির ভিডিও রেকর্ড করছিল না, তারাও শেষমেশ ধৈর্যহারা হয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো।

ইতি কান্নামাখা গলায় বলল, “আপনাদের আহনাফ স্যার সেই প্রথম থেকে আমার দিকে খারাপ নজরে তাকাতো। প্রতিবাদ করলে যদি ভার্সিটি থেকে বিতাড়িত হই, এই ভয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। কিন্তু আর না, আজ সব সত্যি জানিয়ে দেবো আপনাদের।”

উৎসুক জনতা একরাশ কৌতুহল নিয়ে বলল, “আপু! কী করেছে আহনাফ স্যার?”

ইতি নিখুঁত অভিনেত্রীর ন্যায় কাঁদতে কাঁদতে বলে গেল, “আহনাফ স্যার আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। আমি মানা করে দেওয়ায় সে আমার সাথে জোর জবদস্তি করে। আমি যাতে এর প্রতিবাদ না করতে পারি তাই সাথে সাথে জোর করে আমাকে বিয়ে করে। ঢাকায় আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই বলে কেউ আমাকে বাঁচাতে পারেনি। দুই বছর ধরে এই জানোয়ার লোকটা বিয়ের নামে আমার সাথে অন্যায় করে আসছে। আমি সাহস করে শেষমেশ তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এখনো নানাভাবে আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে না-কি জানিয়ে দেবে আমি দুশ্চরিত্রা।”

রীতিমত শোরগোল পড়ে গেল চারিদিকে। ছাত্র-ছাত্রীরা রাগে ফেটে পড়ে জড়ো হলো ফ্যাকাল্টি রুমের সামনে। সে করেই হোক আহনাফ আমিরকে ক্যাম্পাস থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবে তারা। এদিকে তাদের ধারণ করা ভিডিও নিমিষেই ছড়িয়ে পড়লো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

একটা ভিডিও যে কত দ্রুত ফেসবুকে ভাইরাল হতে পারে, এই ভিডিও তার প্রমাণ। ইতির অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে ফেসবুক জুড়ে। গ্রুপে গ্রুপ ছড়িয়ে গেল এই একটা ভিডিও। সকলের একটাই কথা, “আহনাফের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”

ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যাম্পাসের মধ্যেই শুরু করলো তুমুল আন্দোলন। গভর্নিং বডি আহনাফের কথা শোনার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করলো না। তাকে এক ঘন্টার মাথায় সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।

জীবনে বহু সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে আহনাফ। এই ইতিই তো না জানি কতশতবার আঘাত দিয়েছে তাকে। তবে কোনোবারই নিজেকে এতটা অসহায় বলে মনে হয়নি। কষ্টের থেকেও তার মাঝে যে জিনিসটা সবথেকে বেশি কাজ করছিল সেটা হলো বিস্ময়।

তার কি গুরুতর কোনো দোষ ছিল? দোষ তার ছিল একটাই। ইতিকে ভালোবাসা। ভালোবাসার কারণে তাকে আজ মুখোমুখি হতে হলো তীব্র অপমান আর যন্ত্রণার।

ক্যাম্পাসজুড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা মানববন্ধন শুরু করে দিয়েছে। ইতির ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করায় কয়েকজন সাংবাদিক এসে জড়ো হলো ইউনিভার্সিটির সামনে। ক্ষিপ্ত জনতার এক ভাগও এসে জড়ো হয়েছে আহনাফের শাস্তির দাবিতে।

আহনাফের কয়েকজন কলিগ সাবধানে পেছনের গেট দিয়ে তাকে বের করে দিলো। যেকোনো মুহূর্তে ক্ষিপ্ত জনতা চড়াও হতে পারে তার ওপরে। গাড়িতে উঠেই আহনাফ দেখলো তার মোবাইলে নতুন একটি ম্যাসেজ ইতির নম্বর থেকে।

“আশা করি এর পর কোনোদিন আমার সঙ্গে কথা বলার সাহস তুমি করবে না।”

আহনাফ চাইলেই পারতো এই ম্যাসেজটা গভর্নিং বডির সদস্যদের দেখাতে। কিংবা ফেসবুকে উন্মুক্ত করে দিতে। কিন্তু আহনাফ সেসবের কিছুই করলো না। তীব্র হাহাকার চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলো তাকে।

এই প্রথম সে উপলব্ধি করলো, ইতি কোনোদিন ভালোবাসেনি তাকে। ভালোবাসার নামে খেলেছে তার জীবনটা নিয়ে। আর আহনাফ বোকার মতো ভালোবেসেই গেছে তাকে।

বাড়ি ফিরে আহনাফ ঘরেই বসে রইলো সারাদিন। সাবার সেদিন ইউনিভার্সিটিতে কোনো ক্লাস ছিল সে। বান্ধবীদের সঙ্গে ঢাকা থেকে একটু দূরে ৩০০ ফিটে বেড়াতে গিয়েছিল সে। ফেসবুকে ঢুকে আচমকা ইতির ওই মিথ্যায় ভরা ভিডিওটা দেখে মাঝপথেই ইউটার্ন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

তাদের বাড়ির সামনে তখন প্রচুর মানুষের ভীড়। বেশির ভাগই তাদেরই ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী। কারও কারও হাতে লম্বা সব ব্যানার। তাতে লেখা, “লম্পট আহনাফ আমিরের ফাঁসি চাই।”

সাবার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। ভীড় থেকে কোনমতে গাড়ি নিয়ে ঢুকলো সে বাড়ির ভেতরে। ফাহমিদা বেগম এবং আমির সাহেবের চিন্তিত মুখগুলো দেখলো সে সবার আগে।

সাবা উদ্বিগ্ন-উৎকন্ঠিত স্বরে বলল, “এসব কী হচ্ছে মা?”

ফাহমিদা বেগম হতাশ কণ্ঠে বলল, “মেয়েটা আহনাফের সর্বনাশ করে ছাড়লো! আহনাফ না-কি ওকে জোর করে বিয়ে করেছিল।”

এই দুটো মানুষকে শুরু থেকে দেখে আসছে সাবা। ইতির পাগলামি, আহনাফের পাবার তৃষ্ণা কোনোকিছুই অজানা নয় তার। ইতির এই পাগলামির জন্যেই তো আহনাফ বিয়েটা করেছিল। জোর তো করেনি।

ইতি ছুটে গেল ভাইয়ার ঘরের সামনে। দুয়েকবার দরজায় টোকা দিতেই বেরিয়ে এলো আহনাফ। চির হাস্যোজ্বল ছেলেটাকে এতটা নিস্তেজ হয়ে পড়তে কখনো দেখেনি সাবা। মনে হচ্ছিল যেন প্রাণ নেই তার মাঝে।

দরজা খুলে দিয়ে আহনাফ দুর্বল ভঙ্গিতে গিয়ে বসলো বিছানার এক পাশে। সাবা তার পাশে গিয়ে বসলো। রাগে-কষ্টে হাত-পা রীতিমত থরথর করে কাঁপছে তার। অথচ আহনাফ বড্ড স্বাভাবিক। অবশ্য স্বাভাবিক বললে ভুল হবে, প্রাণহীন।

সাবা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “ভাইয়া! তুমি ইতির নামে কেস করবে।”

আহনাফ শান্ত গলায় বলল, “কীসের কেস?”

সাবা জোর গলায় বলল, “মান-হানির কেস। তোমার নামে কত বড় একটা অ্যালিগেশন এনেছে বুঝতে পারছো?”

আহনাফের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো। হাসিটা ধরে রেখেই সে বলল, “ও অ্যালিগেশন দিলেই কী সেটা সত্যি হয়ে যাবে?”

সাবা অবাক হয়ে দেখলো তার ভাইয়াকে। ইতির কাছ থেকে এতটা আঘাত, এতটা অপমান পাওয়ার পরও কোনো রাগ নেই তার মাঝে?

সাবা অনুরোধের সুরে বলল, “ভাইয়া, প্লিজ আমার কথাটা শোনো। তুমি এক্ষনি আমার সাথে থানায় যাবে।”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে না-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “না সাবা। আমাকে এটা করতে বলিস না।”

সাবা একরাশ আক্ষেপ নিয়ে বলল,“কেন ভাইয়া? তুমি এখনো ওই মেয়েটাকে প্রশয় দিয়ে যাচ্ছো? এখনো?”

সাবার চোখদুটোতে জল টলমল করছে। ভাইয়ার প্রতি এই অন্যায় অভিযোগ সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে।

অথচ আহনাফ শীতল ভঙ্গিতে তার চোখের জলগুলো মুছে দিয়ে বলল, “প্রশয় তো সেই শুরু থেকেই দিয়ে যাচ্ছি। শুরু থেকেই ভুল করে আসছি। আজ না হয় আরেকবার ভুলটা করলাম।”

সাবা বুঝতে পারলো না কী করবে সে। কী করে ভাইয়াকে বোঝাতে ইতির বিরুদ্ধে একটা পদক্ষেপ নিতে। বড্ড ভেঙে পড়েছে মানুষটা। তার মস্তিষ্ক নির্ঘাত আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো কাজ করছে না।

সাবা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই আহনাফ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই যা। বাবা-মা সামলা। আমি ঠিক আছি।”

সাবা চোখভরা জল নিয়ে বলল, “কেন ইতিকে ক্ষমা করছো ভাইয়া?”

আহনাফ আবারও সেই সূক্ষ্ম হাসিটা হেসে বলল, “নিজেকে ক্ষমা করছি সাবা। ইতিকে শুরু থেকে প্রশয় দিয়ে যে ভুলটা করেছিলাম, সেই ভুলকে ক্ষমা করার চেষ্টা করছি।”

আহনাফের এই কথাটার মানে সেই দিন সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেনি সাবা। আহনাফকে একা থাকতে দিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বসার সঙ্গে বসে রইলো সাবা। সকলের মাঝেই অদৃশ্য একটা ভয়, অজানা এক শঙ্কা। কীসের ভয়, তারা নিজেরাও জানে না।

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে বাড়ির বাইরের ভীড়ও কমতে থাকে। দুয়েকজন এখনও আছে, তবে তাদের মাঝে আন্দোলনের কোনো প্রবণতা নেই। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মাঝেই আড্ডা দিয়ে যাচ্ছে। কিংবা বলা ভালো, আহনাফ আমিরের চরিত্রহীনতা নিয়ে আলোচনা করছে।

মনের মাঝে একরাশ কালো মেঘ নিয়ে ফাহমিদা বেগম রান্না করতে গেলেন। সাবাও গেল তার পিছু পিছু তাকে সাহায্য করতে। তারা দুজনে একসঙ্গে রান্নাঘরে এলে পুরোটা সময় গল্পেই মেতে থাকে। তবে আজ কারও মুখেই কোনো কথা নেই। ওদিকে আমির সাহেব আত্মীয়-স্বজনদের একের পর এক ফোন কল সামলাতে ব্যস্ত।

ফাহমিদা বেগম রাতের খাবারের জন্যে ছেলেকে ডাকতে তার ঘরের দরজার টোকা দিলেন। একবার, বেশ কয়েকবার। অপরপ্রান্ত থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে তিনি ডাক দিলেন স্বামী-কন্যাকে।

সাবা দ্রুত পায়ে ভাইয়ার ঘরের সামনে এসে দরজায় অনবরত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। মুখে অনবরত অস্থির কণ্ঠে বলে যাচ্ছে, “ভাইয়া দরজাটা খোলো।”

আমির সাহেব ইতোমধ্যে ফোন বের করে কাকে কাকে যেন ফোন করতে শুরু করেছেন।
সাবা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “বাবা? ভাইয়া দরজা খুলছে না কেন?”

আমির সাহেব মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সবেগে কাঁধের ধাক্কায় দরজার লক ভাঙতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বার কয়েক তিনি দরজার ওপরে এসে পড়তেই খুলে গেল লক।

দ্রুত পায়ে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে পা রাখতেই থমকে দাঁড়ালো সাবা। তার হৃদয়টা কয়েক দফায় মোচড় দিয়ে উঠলো। শ্বাস-প্রশ্বাস তো বন্ধই হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে।

সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে চির হাস্যোজ্বল, প্রাণচাঞ্চল্যে ঠাসা আহনাফ। তার চোখে হাসি নেই। চোখে স্নিগ্ধতা নেই। চোখদুটো উল্টে আছে। ঠোঁট কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। পায়ের পাতা নীলাভ হয়ে উঠেছে।

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সাবা। ঠিক সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।

(চলবে)