#লেবু
২৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
নিজের ওপরে নিজেই গর্বিত সাবা। এ বাড়িতে পা রাখার কথা কল্পনা করলেও আগে ভয়ে-যন্ত্রণায় শিউরে উঠতো সে। যন্ত্রণা যে আজও হচ্ছে না তা নয়। পদে পদে চোখের সামনে ভেসে উঠছে ভাইয়ার প্রাণহীন মুখটা। তবুও মুষড়ে পড়তে দিচ্ছে না সাবা নিজেকে। শক্ত হাতে সামাল দিচ্ছে নিজেকে। আহনাফের প্রাণহীন মুখটার দৃশ্য মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তার সঙ্গে কাটানো সুন্দর স্মৃতিগুলোই মনে করার চেষ্টা করছে। যে স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে সে বেঁচে থাকতে চায় আজীবন।
এই যে সাবার নিজেকে সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, এর পেছনে তো শাফকাতের অবদানই সবথেকে বেশি। সেই শাফকাত, যার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার ছক মনে মনে কষতে শুরু করেছে সাবা। আচ্ছা, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
প্রশ্নটা নিমিষেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সাবা। ঠিক না হওয়ার কোনো কারণ তো নেই। শাফকাতের মতো কন্ট্রোল ফ্রিক ছেলের সঙ্গে গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ওই একটা চড় সাবার চোখ খুলে দিয়েছে। সাবা এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, বিয়ের পর থেকে শাফকাতের কাছ থেকে পাওয়া অগণিত অদৃশ্য চড়গুলো। সেই অদৃশ্য চড় শরীরে আঘাত করে না, আঘাত করে মনে।
বসার ঘরের সোফায় বসে নিজেকে ধাতস্ত করতে ব্যস্ত সাবা। আমির সাহেব তার পাশের সোফাটায় বসে আছেন। মেয়ে যে তার গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, তা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। সে জন্যেই তার দুশ্চিন্তারা বেড়ে বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। এত রাতে অকস্মাৎ সাবার আগমনে তিনি খুশি হবেন না-কি উদ্বিগ্ন, তাই বুঝতে
হিমশিম খাচ্ছেন।
ফাহমিদা বেগম বসার ঘরে প্রবেশ করতে করতে চিন্তিত স্বরে বললেন, “কী রে সাবা? তাড়াহুড়ো করে চলে এলি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে?”
মায়ের প্রশ্ন বোধ হয় পৌঁছালো না সাবার কর্ণকুহরে। গভীর চিন্তাভাবনায় মগ্ন তার মস্তিষ্ক।
আমির সাহেব মেয়ের নীরবতায় বাড়তি চিন্তিত হয়ে বললেন, “কী রে মা?”
সাবা সংবিৎ ফিরে পেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, “মা লতিফা বাসায় আছে না?”
লতিফা এ বাড়ির কাজের মেয়ে। যদিও বাড়ির কোনো কাজই তাকে করতে হয় না। তার প্রধান কাজ ফাহমিদা বেগমকে সঙ্গ দেওয়া। সেই দশ বছর বয়সে তিনি লতিফাকে কোনো এক এতিমখানা থেকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন।
ফাহমিদা বেগম বিরক্ত গলায় বললেন,
“আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তুই লতিফাকে খুঁজছিস?”
সাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কঠিন গলায় মায়ের প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলল, “না কিছুই হয়নি। একটা জরুরি কাজে এসেছি।”
আমির সাহেব অবাক গলায় বললেন, “কী এমন কাজ?”
সাবা ভ্রু কুচকে বলল, “এত জবাবদিহি তো করবো না বাবা। বিয়ে হয়ে অন্য বাড়িতে চলে গেলেও এটা আমার বাড়িই থাকবে। যখন খুশি তখন আসার অধিকার আমার আছে।”
ফাহমিদা বেগম আহত গলায় বললেন, “আরে বাবা আমরা কী সে কথা বলেছি না-কি? আমি ভাবলাম কোনো সমস্যা…”
মায়ের কথা শেষ হবার আগেই সাবা উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো লতিফার ঘরের দিকে। সন্ধ্যার পর থেকে এ বাড়ির কোথাও লতিফাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নিজের ঘরে পায়ের ওপর পা তুলে গালে হাত দিয়ে বাংলা সিরিয়াল দেখতে বসে সে। সন্ধ্যা থেকে রাত
পর্যন্ত একটা চ্যানেলের সিরিয়াল মূল সম্প্রচারে দেখে। গভীর রাতে আবার আরেকটা চ্যানেলে দেখে রিপিট টেলিকাস্ট।
লতিফার ঘরে টিভির সামনেই তাকে পাওয়া গেল।
সাবা তাড়াহুড়োর স্বরে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই লতিফা! তোর ফোনটা বের কর তো।”
ফাহমিদা বেগম এতক্ষণে মেয়ের পিছু নিয়ে লতিফার ঘর পর্যন্ত এসে গেছেন। সাবার একের পর এক অদ্ভুত কান্ডে তার বিস্ময়ের সীমা ক্রমেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
লতিফা টিভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো। সাবাকে এতদিন পর বাড়িতে দেখে লতিফাও নেহায়েত কম অবাক হয়নি।
বিস্মিত স্বরে সে বলল, “আপামণি আপনে?”
সাবা কঠিন গলায় বলল, “কী আশ্চর্য! আমাকে দেখে এ বাড়ির সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠছে কেন?”
লতিফা কী বলবে ভেবে পেলো না। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ফাহমিদা বেগমের দিকে। যার চোখেমুখেও একরাশ অসহায়ত্বের ছড়াছড়ি।
সাবা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “ফোনটা দে!”
লতিফা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বিছানার ওপর থেকে তার ফোনটা নিয়ে বাড়িয়ে দিলো সাবার দিকে।
সাবা ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “এটা কাল সকালে ফেরত পাবি।”
যেমন ঝড়ের গতিতে সাবা লতিফার ঘরে এসেছিল, তার থেকেও দ্বিগুণ ঝড়ো গতিতে বেরিয়ে গেল।
লতিফা অবাক ভঙ্গিতে বলল, “খালাম্মা? আপামণি আমার ফোনটা নিয়া গেল ক্যান?”
ফাহমিদা বেগম বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কী জানি? আজকাল নিজের মেয়েকে নিজেই চিনতে পারি না!”
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়ালো সাবা আহনাফের ঘরের সামনে। হৃদয়টা অস্বাভাবিকভাবে ধড়ফড় করতে শুরু করেছে। সেদিন সাবাই সবার আগে এ ঘরে ঢুকেছিল। ঠিক এই দরজার কাছে দাঁড়িয়েই দেখেছিল, এ জীবনে দেখা সবথেকে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা।
লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে আবারও নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় মেতে উঠলো সাবা। না, সে ভাববে না ওই ভয়ঙ্কর দিনটার কথা। মনের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ভাইয়া মানেই এখন তার কাছে ওই বিভীষিকাময় দিনটা। অথচ ভাইয়া মানে তো তার কাছে অকারণে হাসির কারণ, অকারণে ভালো থাকার কারণ।
নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে এলোমেলো পায়ে সাবা পৌঁছে গেল নিজের ঘরটায়। তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও ফাহমিদা বেগম কোনো পরিবর্তন আনেননি ঘরটায়। সাবা যেভাবে সাজিয়ে রাখতো, ঠিক সেভাবেই রেখেছেন।
দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় পা দুটো ভাঁজ করে বসলো সাবা। হ্যান্ডব্যাগ থেকে নিজের ফোনটা বের করে একটা নম্বর খুঁজে বের করলো। নম্বরটা দেখে দেখে ডায়াল করলো লতিফার নম্বরে।
নিজের মোবাইল থেকে এই নম্বরে ফোন করে আর কোনো বিপদ ডেকে আনতে চায় না সে। এমনকি ও বাড়ির কারও মোবাইল থেকেও ফোন করেনি। শাফকাতের প্রতি এক ফোঁটাও বিশ্বাস নেই তার। দেখা গেল, ঠিক তার মতোই ট্র্যাপ করে রেখেছে ও বাড়ির প্রতিটা মানুষের নম্বর।
শাফকাতকে মোটেও ভয় পা সাবা। একটা চড়ে দমে যাওয়ার পাত্রী সে নয়। এত ঝামেলা পাড় করে লতিফার মোবাইল থেকে এই নম্বরে ফোন করার একটাই কারণ, শাফকাতের মনে আর কোনোভাবে যাতে সন্দেহ না ঢুকে যায়। শাফকাত যতই সাবাকে সন্দেহ করবে, তার মুক্তির পথ ক্রমশ জটিল হয়ে দাঁড়াবে।
দুটো রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ করা হলো ফোনটা। শোনা গেল ফাহিমের কণ্ঠে।
“হ্যালো? কে?”
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাবা। যে ফাহিমকে নিয়ে শাফকাতের মনে সন্দেহের শেষ নেই, তার সাহায্যের মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করছে সে। এ ছাড়া তো আর কোনো পথও খোলা নেই।
সাবা শুকনো গলায় বলল, “আমি।”
ফাহিম বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “সাবা?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি আমাকে ফোন করেছো সাবা?”
সাবা নিচু স্বরে বলল, “বারবার আমার নামটা না বললে হয় না?”
যদিও নম্বরটা লতিফার। তবুও ঠিক ভরসা করে উঠতে পারছে না সাবা। পাছে শাফকাত যদি এই নম্বরটাও ট্রাক করে ফেলে?
ফাহিম বিভ্রান্ত গলায় বলল, “মানে?”
সাবা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “শোনো ফাহিম, ফোনে বেশি কথা বলতে পারবো না। কাল তুমি একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে? বেশি সময় নেবো না। আধা ঘন্টা হলেই চলবে।”
ফাহিম জোর গলায় বলল, “অবশ্যই পারবো। কোথায় দেখা করবে বলো?”
“তোমাকে এই নম্বর থেকেই একটা এনজিওর আড্রেস পাঠাচ্ছি।”
“এনজিও? আমি তো ভাবলাম তোমার অফিসে…”
সাবা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “না, না! অফিসে দেখা করা যাবে না। এই এনজিওতেই দেখা করতে বলবে। প্লিজ! এখন কোনো প্রশ্ন কোরো না। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি কাল দেবো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। কখন দেখা করছি।”
সাবা খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “সকাল সাতটার দিকে?”
ফাহিম আবারও বিস্মিত হয়ে বিকেল, “সাতটায়? এত সকালে?”
সাবা তার একেকটা প্রশ্নে অধৈর্য হয়ে বলল, “বললাম তো ফাহিম, এখন কোনো প্রশ্ন কোরো না।”
ফোনটা কেটে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইলো সাবা। তার বাড়ন্ত হৃদস্পন্দন জানান দিচ্ছে, যে ছক সে কষেছে, তা অচিরেই মুছে ফেলার জন্যে। তবে সাবা তা মুছে ফেলবে না। শাফকাত আলমের গড়ে তোলা অদৃশ্য বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে তবেই সে দম নেবে।
(চলবে)