লেবু পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0
1

#লেবু
৫২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

যন্ত্রের মতো ইতির মুখের বাঁধনটা খুলে দিলো সাবা। তার হাত-পা কাঁপছে। কাঁপছে চোখের দৃষ্টিও। কতশত অনুভূতির তুফানে যে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে সে, তা কেবল তারই জানা। তার সামনে সেই মানুষটা বসে আছে, যার বিশ্বাসঘাতকতার তীরে বিদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণটা কেড়ে নিয়েছিল আহনাফ।

ভাইয়ার প্রাণহীন মুখটা স্পষ্ট ভেসে উঠলো চোখের সামনে। ভয়ঙ্করভাবে জ্বালাপোড়া করছে চোখদুটো। আহনাফের দৃষ্টিহীন ওই চোখদুটো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যাকে খুঁজে যাচ্ছিল, সেই ইতি আজ সাবার সামনে। অসহায় লাগছে সাবার। সেই সঙ্গে তার ভেতরে কাজ করছে মারাত্মক রাগ। তবে কোনো অনুভূতিই ফুটে উঠতে পারলো না তার চোখেমুখে। যন্ত্রের মতো শূন্য দৃষ্টিতে সাবা তাকিয়ে রইলো ইতির দিকে।

ইতি জানে সে ধরা পড়ে গেছে। তার পরিণতিও যে খুব একটা ভালো হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তবুও অদ্ভুতভাবে সে হাসছে। রহস্যে ঘেরা একটা হাসি। যে হাসি শীতল স্রোতে ভাসিয়ে দিলো সাবাকে।

নীরবতাটা ইতিই ভাঙলো। মেকি উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “সাবা আমির! কত দিন পর দেখলাম তোমাকে।”

সাবার চোখদুটোতে এখনো শূন্যতা ভর করছে। আর অবচেতন মনে সুপ্ত রাগ। এই মেয়েটার তো এত উচ্ছ্বাস নিয়ে আজ কথাই বলতে পারার কথা ছিল না। তবুও সে বলছে।

ইতি আবারও হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে তুমিই আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে এনেছো? সিরিয়াসলি, আমি ভাবতেই পারিনি আহনাফের রক্তের কারোর এতটা সাহস আছে।”

শাফকাত তাহলে ইতিকে কিডন্যাপ করিয়ে এনেছে? কীভাবে এনেছে, কোথা থেকে এনেছে, কোনো প্রশ্নই মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো না। ইতি তার সামনে, এতটুকুই যথেষ্ট।

মেয়েটাকে দেখামাত্র একরাশ প্রশ্নের তীর তার দিকে ছুঁড়ে দেবে বলে ঠিক করে রেখেছিল সাবা। সেসব প্রশ্নরা যে কোথায় হারিয়ে গেল? একটা মাত্র প্রশ্নের আনাগোনা তার মনে।

অস্ফুটস্বরে ইতিকে সেই প্রশ্নটাই করলো সাবা,
“কেন? কেন করলে এসব?”

আহনাফকে ইতির দেওয়া যন্ত্রণা বা বিশ্বাসঘাতকতা মারেনি। মেরেছে তার দেওয়া অপমান। সেদিন ক্যাম্পাসভর্তি মানুষের সামনে আহনাফের নামে মিথ্যা অপবাদ না দিলে হয়তো ছেলেটা আজও বেঁচে থাকতো তাদের মাঝে।

ইতির চোখেমুখে বিন্দুমাত্র অনুতাপের দেখা মিলল না। রহস্যময় হাসিটা ধরে রেখেই সে বলল, “তো কী করতাম? তোমার ভাইয়ার পাগলামি সহ্য করে যেতাম?”

এবার আর নিজের শান্ত রাখতে পারলো না সাবা। ইতির অসহ্যকর এই হাসি বাঁধ ভেঙে দিয়েছে তার ধৈর্যের।

চিৎকার করে সাবা বলল, “ভাইয়া তোমাকে ভালোবেসেছিল! জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালোবেসে গিয়েছিল তোমাকে। ওকে এত বড় অপমান কেন করলে?”

সাবার চোখদুটো বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। কাঁপছে তার সারা শরীর। ইতিকে চোখের জল দেখিয়ে তার কাছে কোনপ্রকার দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না সাবা। দুহাতে মুখ লুকিয়ে তাই কান্নাগুলো শুষে নেওয়ার চেষ্টা করলো।

কাঁধে দৃঢ় একটা স্পর্শ অনুভব করলো সাবা। এই স্পর্শ শাফকাতের ছাড়া আর কার হবে। মুখ তুলে তার দিকে তাকালো সাবা। শাফকাতের চোখদুটো সুপ্ত এক ভরসার জানান দিচ্ছে। জানান দিচ্ছে, “আমি আছি তোমার পাশে।”

একটা স্নেহের স্পর্শ আর ভরসামাখা দৃষ্টি, সংকটময় মুহূর্তগুলোতে এর থেকে বেশি আর কী লাগে? ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া সাবা মুহূর্তেই কোথা থেকে যেন সাহস সঞ্চয় করে তীক্ষ্ম চোখে তাকালো ইতির দিকে। উত্তরের প্রত্যাশায়।

ইতি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “সাবা তোমার ভাইয়ার গল্পের ভিলেন আমি নই। আমি যা করেছি, একদম ঠিক করেছি।”

সাবা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “তোমার মতো নিকৃষ্ট মানুষ এই পৃথিবীতে আর একটাও হয় না ইতি। নিজের হাসবেন্ডের নামে অ্যাসল্টের অভিযোগ করেছিলে তুমি!”

ইতি জোর গলায় বলল, “তোমার ভাইয়া জীবনের শেষ দিনে এসে আমার হাসবেন্ড ছিল না সাবা। তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে যায়। ভালোবাসার কথা বলছিলে না? ওই ভালোবাসা ফুরিয়ে গিয়েছিল বলেই ডিভোর্স হয়। যে মানুষটা আমার স্বামী নয়, নিতান্তই পর পুরুষ – তাকে নিশ্চয়ই কথায় কথায় আমার হাত ধরা, পথ আটকে দেওয়া মানায় না। সেদিনই প্রথম ছিল না, আমি এর আগেও সতর্ক করে দিয়েছিলাম আহনাফকে। আমার সতর্কতা সে মানেনি। কমপ্লেইন করা ছাড়া আর কোনো উপায় আমার ছিল না। আর তাছাড়া আমি তো তাকে বলিনি সু/ইসাইড করতে।”

অবিশ্বাসে গা জ্বলে গেল সাবার। এই মানুষটাকে ভালোবেসেছিল তার ভাইয়া? একটা মানুষ শুধুমাত্র তার কারণে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও যার মাঝে বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই। এমন মানুষকে কী করে ভালোবেসেছিল আহনাফ?

সাবা অতিষ্ঠ হয়ে বলল, “কেন এসেছিলে আমার ভাইয়ার জীবনে? ওকে তো কখনো ভালোবাসোনি তুমি। কেন ওর জীবনটা শেষ করে দিলে?”

আহনাফ নিজে থেকে বরণ করে নেয়নি ইতিকে তার জীবনে। গায়ে পড়ে, জেদ ধরে প্রেম করেছিল ইতি তার সঙ্গে। যাকে কখনো ভালোই বাসেনি, জোরপূর্বক তার জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনটা জড়ানোর অর্থ কী?

বাঁকা হাসি হেসে ইতি বলল, “সেই কেন’র উত্তর তুমি নিজেও জানো।”

মনে মনে যন্ত্রণাময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাবা। আহনাফের মৃত্যুর পর ইতির তার সম্পত্তির বেশির ভাগ অংশ নিয়ে নিরুদ্দেশ হাওয়াই সেই কেন’র উত্তর।

ইতি উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “দেখো আমি তোমার ভাইয়ার জীবনে গিয়েছিলাম…”

সঠিক শব্দটা খোঁজার জন্যে কয়েক মুহূর্ত দম নিলো ইতি। কিছুক্ষণ ভেবেই আবার বলল, “টাইম পাস করতে। Ahnaf was an attractive man after all!”

অবাক হলো না সাবা। তবে বুকের মাঝে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করলো? একটা মানুষ এতটা নিচে কী করে নামতে পারে? আহনাফকে কখনো ভালো না হয় বাসেনি। কিন্তু আহনাফ তো বেসেছিল। মৃত মানুষটার সেই ভালোবাসে একফোঁটা সম্মানও করা যায় না?

ইতি জোর গলায় বলল, “আমি তো কখনো ওকে বলিনি এই সম্পর্কটা নিয়ে এতটা সিরিয়াস হয়ে যেতে। আমাকে ভালোবাসতেও বলিনি। ও যখন ভালোবেসেছে, ভালোবাসাটাকে সম্মান করেছি। ওকে বিয়ে করেছি।”

সাবা শীতল গলায় বলল, “সবই তোমার লোভ তাই না? তোমার লোভের কারণে একটা মানুষ ধ্বংস হয়ে গেল।”

“ওহ প্লিজ! আমি আমার জীবনটাকে নষ্ট করে ওকে বিয়ে করলাম, বদলে কিছুই নেবো না? আজ তো আহনাফ নেই, ওর ভালোবাসাও নেই। ওর সম্পত্তিগুলো নিজের করে না নিলে কী নিয়ে বাঁচতাম?”

“তোমার মধ্যে বিন্দুমাত্র রিগ্রেট নেই? একটা মানুষ আজ পৃথিবীতে নেই, শুধুমাত্র তোমার জন্যে। আর এই সত্যিটা স্বীকার করতেও তোমার মুখে আটকাচ্ছে না।”

“আমি চাইলেই তোমার সামনে কষ্ট পাওয়ার অভিনয় করতে পারতাম সাবা। দুয়েক ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে পারতাম। কিন্তু আমি অভিনয় করতে করতে সত্যিই ক্লান্ত। কম অভিনয় তো করিনি তোমার ভাইয়ের সামনে।”

চুপ করে রইলো সাবা। কিছু বলার বা আর কোনো প্রশ্ন করার ভাষা রইলো না তার কাছে। কিছু মানুষ আজন্ম নিকৃষ্ট। এদের শুধরাবার চেষ্টা করেও লাভ নেই, মানবিক আচরণ প্রত্যাশা করেও লাভ নেই।

হঠাৎ কানে এলো শাফকাতের ভারী কণ্ঠের ডাক, “সাবা?”

সাবা দুর্বলভাবে তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, “হুঁ?”

শীতল মেটাল জাতীয় কিছুর স্পর্শ পেলো সাবা হাতের মুঠোয়। চমক উঠে লক্ষ্য করলো, কালো রঙয়ের একটা পি/স্তল!

পিস্তলটা শাফকাত তার হাতের মুঠোয় সাবধানে রেখে বলল, “তুমি চাইলে ওকে এখানেই শেষ করে দিতে পারো। কেউ জানবে না কী হয়েছে ওর সাথে।”

অবাক চোখে সাবা একবার তাকালো তার হাতের মুঠোয় থাকা জিনিসটার দিকে। আরেকবার তাকালো ইতির দিকে। তার চোখমুখ থেকে সকল রহস্য, সকল উচ্ছ্বাস এক পলকে ছুটে পালালো। জায়গা করে নিলো ভয়। ভয়ে পাথরের মতো জমে গেছে ইতি। কিছু একটা বলতে হয়তো চাচ্ছে, কিন্তু বলতে পারছে না। নড়তে হয়তো চাচ্ছে, কিন্তু নড়তে পারছে না। অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো সাবার দিকে।

দৃশ্যটা উপভোগ্য। আরও বেশি উপভোগ্য দৃশ্য হবে পি/স্তলটা তার দিকে তাক করে, ট্রিগার চেপে তার বুকে বু/লেট বিদ্ধ করতে। এতগুলো দিন ধরে সহ্য করে আসা যন্ত্রণার অবসান ঘটবে। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবে সাবা।

কয়েক মুহূর্ত যন্ত্রের মতো বসে থেকে সাবা পি/স্তলটা ফিরিয়ে দিলো শাফকাতকে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “না শাফকাত। ভাইয়া খুশি হবে না।”

শাফকাত জানতো এতটা হৃদয়হীনা হওয়া সম্ভব নয় সাবার পক্ষে। ইতি তার জীবনের সবথেকে মূল্যবান মানুষটাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিলেও, তার ক্ষতি সাবা কিছুতেই করতে পারবে না।

আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল তার পরবর্তী পদক্ষেপটা কী হবে। ইতিকে বেজমেন্টে রেখেই সাবাকে নিয়ে ওপরে উঠে এলো শাফকাত। কল করলো পুলিশকে। মানহানী, প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, আ/ত্মহত্যায় প্ররোচনাসহ নানা অভিযোগে পুলিশ এসে গ্রেফতার করলো তাকে।

মুহূর্তের খবরটা ছড়িয়ে গেল চারিদিকে। তাকে অফিস থেকে বের করে গাড়িতে তোলার সময়ে বাইরে জড়ো হলো সাংবাদিকদের দল। দুই বছর আগে আহনাফ আমিরকে ঘিরে যে চাঞ্চল্যকর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল, তা নতুন মোড় পেলো আজ। তার বিরুদ্ধে অ্যাসল্টের অভিযোগ আনা মেয়েটা না-কি তারই প্রাক্তন স্ত্রী ছিল!

চারিদিকে মারাত্মক শোরগোল হচ্ছে। অফিস থেকে ফোন এলো সাবার কাছে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে সাবা জানিয়ে দিলো এই নিউজ সে কাভার করতে পারবে না।

শাফকাত সযত্নে তাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। আতিয়া আলম আর শামা সকালেই আহনাফের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ওই বাড়িতে চলে গিয়েছিল। বাড়িতে কয়েকজন স্টাফ ছাড়া আর কেউ নেই।

শাফকাত সাবাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে যত্ন করে শুইয়ে দিলো। উঠে যেতে উদ্যত হলেই সাবা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “একটু থাকো না প্লিজ।”

শাফকাত ক্ষীণ হেসে সাবার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আছি তো।”

শূন্য দৃষ্টিতে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে সাবা। ইতির মতো ভয়ানক একটা মানুষ আহনাফের জীবনে না এলে কখনোই তাকে এই সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে নিজের প্রাণটা কেড়ে নিতে হতো না।

ইতির কী শাস্তি হবে সাবা জানে না। আদৌ কোনো শাস্তি হবে কিনা তাও জানে না। তবুও পৃথিবীর সামনে তার আসলটা রূপটা এসেছে। সবাই জেনেছে আহনাফ আমির একজন চরিত্রহীন লম্পট শিক্ষক ছিল না।

শাফকাত শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কাঁদতে ইচ্ছা করছে?”

চমকে উঠে তাকালো সাবা তার দিকে। তার মনের কথাটা কি করে বুঝে গেল শাফকাত? আসলেই তো কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু আজ তো কান্নার কোনো কারণ নেই। ভাইয়ার ওপর থেকে সমস্ত অপবাদ মুছে গেছে। ভাইয়াও নিশ্চয়ই অদৃশ্যলোক থেকে হাসছে আজ। সে কেন কাঁদবে?

সাবা না-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “ইচ্ছা করছে। তবুও কাঁদবো না। আজ তো আমার আনন্দের দিন।”

জোরপূর্বক হাসার চেষ্টাও করলো সাবা। কিন্তু সেই হাসি স্থায়ী হলো না। আবার ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো তার চোখমুখ।

শাফকাত নরম স্বরে বলল, “চাইলে কাঁদতে পারো লেবু। মাঝে মাঝে কেঁদেও আনন্দ পাওয়া যায়।”

এবার সত্যিই নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না সাবা। ঝড়ের গতিতে উঠে বসে শাফকাতকে জড়িয়ে তার বুকে মুখ লুকিয়ে, অঝোরে কেঁদে ফেলল। নিঃশব্দে কাঁদছে সাবা। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। শাফকাতও কাঁদতে দিচ্ছে তাকে। কান্নার আনন্দ উপভোগ করতে দিচ্ছে।

শাফকাতের বুকে মুখ লুকিয়েই সাবা আর্দ্র গলায় বলল, “তুমি ওকে কোথায় খুঁজে পেলে শাফকাত?”

শাফকাত তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “কক্সবাজারে। তোমার ভাইয়ার টাকা দিয়ে একতলা বাড়ি করে সেখানেই থাকতো। বিয়ে করেছিল হয়তো আহনাফের মৃত্যুর পর পর। একটা ছেলেও সেখানে থাকতো।”

“কীভাবে খুঁজে পেলে?”

ক্ষীণ হেসে শাফকাত বলল, “তোমাকে কথা দিয়েছিলাম না? যে করেই হোক ওকে খুঁজে আনবো।”

কৃতজ্ঞ চোখে সাবা তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই মানুষটার ভালোবাসাই পেয়েই তো অন্তঃসারশূন্য জীবনটা পূর্ণতা পেয়েছে। আজ নতুন করে তাকে প্রাণ ফিরিয়ে দিলো শাফকাত। তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আদৌ কি জানা আছে সাবার?

(চলবে)

#লেবু
৫৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

পিয়ানোর মৃদু সুর ভেসে আসছে দূর থেকে। ‘The Paradise’ এর প্রাইভেট রেস্টুরেন্টে শাফকাত আর সাবা ছাড়া কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই মাঝেমধ্যে তারা ডেটে আসে এখানে। যে দিনগুলোতে তারা আসে, সেদিন সন্ধ্যা থেকেই সাধারণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় এখানে।

পিয়ানোর সুর থেমে গেল। দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। সাবার কাঁচের তিরামিসুর বাটিতে স্টিলের চামচের শব্দ নীরবতা ভঙ্গ করলো। শাফকাতের চোখদুটো আটকে আছে মোবাইলের দিকে। সাবা তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই মুখে পুরে নিলো তিরামিসুর শেষ অংশ।

ডেটে এসে ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকা না-কি নিতান্তই অবহেলার লক্ষণ। তবে সাবার নিজেকে অবহেলিত বলে মনে হলো না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শাফকাত ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে না। তাছাড়া তার চোখদুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা সামাল দিতে ব্যস্ত সে।

কতক্ষণ তার দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সাবা ডাকলো, “শাফকাত? You seem tensed. কিছু হয়েছে?”

শাফকাত স্ক্রিনের ওপর থেকে চোখ তুলে একদফা তাকালো সাবার দিকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার দৃষ্টি স্ক্রিনের দিকে ফিরিয়ে হালকা গলায় বলল, “কিছু হয়নি তো। তুমি খাও, আরেকটা তিরামিসু বলবো?”

“উহুঁ।”

সাবার ভেতরটা কেমন অদ্ভুতভাবে উশখুশ করছে। ইতিকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পর থেকে একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে সে। বুকের ভেতরের সার্বক্ষনিক অস্থিরতা এখন আর নেই। আগের থেকে অনেকটাই উচ্ছ্বসিত থাকে আজকাল সে। তবে শাফকাতের ক্ষেত্রে ঘটনা উল্টো।

সারাক্ষণ ব্যস্ততা আর ক্লান্তির আবছা একটা ছায়া লেগে থাকে তার চোখেমুখে। দিন কয়েক আগেও স্বাভাবিক ছিল ছেলেটা। এর মাঝে কী জানি কী হলো, দুশ্চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে সর্বক্ষণ চোখদুটো আটকে রাখে ফোনের স্ক্রিনে। অফিস থেকে কারও ফোন এলেও কথা বলে ধমকের সুরে।

প্রথম প্রথম বিষয়টা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি সাবা। এত বড় বড় বিজনেস তার। সমস্যা একটা না একটা লেগেই থাকে। এবারের সমস্যাটা হয়তো একটু বেশিই গুরুতর। সমাধান হয়ে গেলেই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে শাফকাত।

কিন্তু প্রায় সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেল, সমস্যার সমাধানও হচ্ছে না। ছেলেটার মাঝে। ফিরে আসছে না স্বাভাবিকতাও। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না।

সাবা আদরমাখা গলায় ডাকলো,“শাফকাত?”

শাফকাত এখনো ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই অন্যমনস্ক সুরে বলল, “হুঁ?”

“তাকাও আমার দিকে।”

শাফকাত চোখ তুলে তাকালো সাবার দিকে। সুপ্ত অনুতাপের স্রোত বয়ে গেল তার গা বেয়ে। প্রতিটা মেয়ের মতো সাবাও নিশ্চয়ই আশা করে একান্ত সময়ে স্বামীর সবটুকু মনোযোগ পাবার। অথচ আজ এই রেস্টুরেন্টে প্রবেশের পর থেকে শাফকাতের মনোযোগের কেন্দ্রে ফোন। নিজের অজান্তেই কি তবে অবহেলার স্বাদ দিয়ে ফেলল সাবাকে?

পাওয়ার বাটন চেপে ফোনের জ্বলজ্বলে স্ক্রিনটা বন্ধ করে ফেলল শাফকাত। সাবার একটা হাত মুঠোয় পুরে অনুতপ্ত স্বরে বলল, “সরি।”

সাবা হাসিমুখে বলল, “আরে বাবা সমস্যা নেই তো।”

আসলেই কোনো সমস্যা নেই সাবার। শাফকাতের কাজের প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই। এমনকি তার থেকে কাজ শাফকাতের বেশি মনোযোগ পেলেও কাজের প্রতি কোনো ঈর্ষা কাজ করে না সাবার। তার অভিযোগ অন্য জায়গায়। অভিযোগ ঠিক না, উদ্বেগ।

শাফকাতের চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে সাবা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “তোমাকে আজকাল অনেক ক্লান্ত দেখায়। সেই গাজীপুর থেকে ফেরার পর একটা দিনও ব্রেক নাওনি। রাতে চার-পাঁচ ঘন্টার বেশি ঘুমাও না। সারাদিন অফিসে খাওয়া-দাওয়াও নিশ্চয়ই ঠিকমতো করো না। এভাবে তো চলে না শাফকাত।”

ক্লান্ত হাসি হেসে শাফকাত বলল, “জানি লেবু।”

সাবা গোমড়া মুখে বলল, “জেনেও তো এভাবেই চলছো। এই যে এখন বাসায় গিয়েই স্টাডি রুমে ঢুকবে। সেখানে থেকে তোমাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করারও সাধ্য কারও আছে?”

শাফকাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে আমি একদমই সময় দিতে পারি না, না?”

সাবা সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “আমার কথা বলছি না। আমার পাওনা সময়টুকু আমি ঠিকই আদায় করে নিই। এই যে এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে নিয়ে ডেটে এলে, এটা সময় দেওয়া না? কিন্তু নিজের দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে।”

“আমি খেয়াল রাখবো কেন? আমার খেয়াল রাখার জন্য তুমি আছো তো।”

“আছি কিন্তু, চব্বিশ ঘন্টা তো তোমার আশেপাশে থাকতে পারি না।”

শাফকাত তার হাতের মুঠোয় থাকা সাবার হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলল, “এত চিন্তা কোরো না সাবা। আমার জীবনটা এভাবেই কেটেছে, কাজের মাঝে ডুবে থেকে। এই জীবনটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। খুব একটা সমস্যা আমার হয় না।”

সাবা দৃঢ় গলায় বলল, “আমার হয়। আগে কী করেছো আমাকে শোনাতে আসবে না। তোমার জীবনটা এখন আর আগের মতো নেই। তোমার জীবন এখন কেমন বলো তো?”

শাফকাত কোনোকিছু না ভেবেই সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, “লেবুময়।”

খিলখিল করে হেসে উঠলো সাবা। হাসিটা চেপে না রেখেই বলে উঠলো, “আচ্ছা? তাই যদি হয় তবে এই লেবুনয় জীবনে কোনো অনিয়ম চলবে না।”

“As you wish Mam.”

সাবার ইচ্ছা আজ সত্যিই পূরণ করলো শাফকাত। বাড়ি ফিরে আর পা রাখলো না স্টাডি রুমে। ফ্রেশ হয়ে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। সাবাও ফ্রেশ হয়ে তার বসলো চুল বাঁধবে বলে। কিন্তু তার এলোমেলো চুলগুলো পরিপাটি হওয়ার অবকাশ আর পেলো কোথায়?

শাফকাত সাবাকে হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে বুকের মাঝে এনে ফেলল।

সাবা আঁতকে উঠে বলল, “শাফকাত! চুলটা তো বাঁধতে দিবে!”

শাফকাত তার এলোমেলো চুলে মুখ ডুবিয়ে বলল, “বাঁধতে হবে না। এভাবেই তোমাকে সুন্দর লাগে।”

সাবার সর্বাঙ্গে শিহরণের স্রোত জাগিয়ে শাফকাতের ঠোঁটদুটো বিচরণ করে বেড়াচ্ছে তার ঘাড়জুড়ে। কম্পিত হাতে খামচে ধরলো শাফকাতের টি শার্ট। ঘাড় থেকে মুখ তুলে একনজর ঘোরলাগা চোখে সাবার লজ্জারাঙা চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো তার ঠোঁটে।

প্রশান্ত ভঙ্গিতে সাবার ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে শাফকাত। কোনো তাড়াহুড়ো না থাকলেও আছে একরাশ অস্থিরতা। আলতোভাবে সাবার চুলগুলো মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো শাফকাত।

সাবাকে আরেকদফা শিহরণে পাগল করতে উদ্যত হলেও, তাতে ব্যাঘাত ঘটালো ফোনের রিংটোন। অন্যান্য দিনে কিছুতেই ঘোর ভাঙে না শাফকাতের। তবে আজকাল মানসিকভাবে একটু ডিস্টার্বড থাকে বলেই হয়তো অল্পতেই ঘোরের জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো।

উল্টো করে রাখা ফোনটা হাতে নিয়েই দেখলো ফোন এসেছে সিনেব্লাস্টের অফিস থেকে। সাবাকে ফেলে ফোনটা নিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে গেল শাফকাত।

ধীরেসুস্থে উঠে বসলো সাবা। তার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকলে এই মুহূর্তে রেগেমেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। তবে সাবার মাঝে সত্যিই কোনপ্রকার রাগ কাজ করছে না। তার মাঝে যে জিনিসটার ছড়াছড়ি তা হলো বিভ্রান্তি।

দীর্ঘ সময়ে ব্যালকনিতে ফোনের কথোপকথন সেরে ঘরে ফিরে এলো শাফকাত। সাবাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আরেকদফা অনুতাপের স্রোতে গা ভাসালো।

তড়িৎ গতিতে তার পাশে বসে গালের চুমুর বর্ষণ করে বলল, “সরি লেবু! অনেক অনেক সরি!”

সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “শাফকাত? কী হয়েছে সত্যি করে বলো তো!”

সাবার এবার সত্যিই চিন্তা হচ্ছে শাফকাতকে নিয়ে। চিন্তার বহিঃপ্রকাশ তার চোখেমুখে স্পষ্ট।

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে শাফকাত ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “অনেক বড় একটা সমস্যা হয়ে গেছে সাবা। আর এই সমস্যা থেকে কীভাবে বের হবো আমি জানি না।”

সাবা চিন্তিত ভঙ্গিতেই বলল, “সমস্যাটা কী?”

“সিনেমার প্রতি আমার বরাবরই আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকেই প্রায় দশ-বারো বছর আগে গড়ে তুলেছিলাম সিনেব্লাস্ট মিডিয়া।”

গত দশ বছর ধরে এদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে রাজত্ব করা প্রোডাকশন হাউজের নাম সিনেব্লাস্ট মিডিয়া। ধ্বংসে পড়া ইন্ডাস্ট্রি আবার যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে সিনেব্লাস্টের উত্থানের পর। দর্শককে একের পর এক মানসম্মত সিনেমা উপহার দিয়ে এসেছে সিনেব্লাস্ট। দর্শকও প্রতিদানস্বরূপ তার প্রত্যেকটা সিনেমাকে বানিয়েছে সুপারহিট কিংবা ব্লকবাস্টার।

শাফকাত স্মৃতি রোমন্থন করে বলল, “সিনেব্লাস্ট নামটা শামার দেওয়া জানো?”

সাবা কিঞ্চিৎ অবাক সুরে বলল, “তাই?”

“হুঁ। প্রোডাকশন হাউজের জন্য নাম খুঁজে বেড়াচ্ছি। শামা তখন একেবারেই বাচ্চা। একদিন কথায় কথায় বলে ফেলল, ভাইয়া তোমার সিনেমাগুলো একেকটা ব্লাস্ট হবে! সেখান থেকেই পেলাম সিনেব্লাস্ট। কিন্তু বেশি সাফল্য পেলে যা হয় আর কি! সফলতার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। একদিন হঠাৎ করেই সিইও হিসেবে দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম।”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কিন্তু কেন?”

“ওই যে বললাম, সফলতার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম প্রোডাকশন হাউজটাকে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে ফেলেছি, যে কেউ দায়িত্বে থাকলেই এর সফলতায় কোনো আঁচ পড়বে না। সবগুলো সিনেমা আগের মতোই সুপারহিট হবে। But I was wrong.”

শাফকাতের চোখেমুখে অস্পষ্ট একটা রাগ ফুটে উঠলো। রাগটা দমন করে সে বলল,
“যাকে সিইওর দায়িত্ব দিয়েছি, রাশেদ, তাকে শুরু থেকেই একটা ইউজলেস লুজার মনে হতো। মানে, সিনেমাগুলো বক্স অফিসে একেবারেই চলছে না। কী করলে সেগুলো চলবে তার ব্যবস্থাও সে করছে না। আমি মাঝেমধ্যে অ্যাডভাইস দিই, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না।”

“তুমি আবার সিইও হিসেবে জয়েন করলেই তো পারো।”

“সময় করে উঠতে পারিনি সাবা। আমার অ্যাটেনশন অন্য বিজনেসগুলোর সবথেকে বেশি দরকার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই সময় না করে উঠতে পারাটাই আমার সবথেকে বড় ভুল ছিল।”

সাবা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “মানে?”

শাফকাত কঠিন গলায় বললেন, “রাশেদ সিনেমাগুলোর লস কমানোর জন্যে বিদেশি প্রডিউসাররা সাথে যৌথ প্রযোজনায়। সিনেমা বানানো শুরু করেছে। লস কিছুটা কমেছে ঠিকই, কিন্তু সিনেব্লাস্টের ইমেজ এখন ধ্বংসের মুখে।”

“কেন?”

“লস হবে জেনেও ওই বিদেশি প্রডিউসাররা সিনেব্লাস্টের সিনেমায় ইনভেস্ট করে যাচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম হয়তো রাশেদের এই একটা গুণ আছে, বিদেশি প্রডিউসারদের রাজি করানোর গুণ। কিন্তু এখন জানতে পারলাম সে কাউকেই রাজি করাতো না। তারা দেশে এলে তাদের হোটেল রুমে পাঠিয়ে দিতো উঠতি কিংবা নাম করা নায়িকাদের।”

সাবা বিস্মিত গলায় বলল, “সে কী?”

শাফকাত আক্ষেপের সুরে বলল, “বিষয়টা এতদিন গোপনীয়তার মধ্যে ছিল। আমিই জানতে পারিনি! অফিসের হাতেগোনা কয়েকজন কর্মচারীই জানতো। কিন্তু এখন ওই হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে একজনের সাথে রাশেদের কী একটা ঝামেলা হয়েছে। সেই গোটা অফিসে ছড়িয়ে দিয়েছে এই সত্যিটা।”

সাবা তিক্ততার সুরে বলল, “তুমি এই রাশেদকে ফায়ার করে দাওনি?

“না সাবা।”

“কেন?”

“যেভাবে বিষয়টা সারা অফিসে ছড়িয়ে পড়েছে, অফিসের বাইরে ছড়াতেও খুব একটা সময় লাগবে না। তাছাড়া রাশেদ প্রত্যেকটা সিনেমার টেকনিশিয়ানদের টাকা আটকে রেখেছে। এসব নিউজ বাইরে চলে গেলে পুরো দায়টা তো আমার ওপরেই এসে পড়বে। আমি চেষ্টা করছি যাতে নিউজটা বাইরে যেতে না পারে, কিন্তু কতদূর সামলাতে পারবো বুঝতে পারছি না।”

সাবা প্রায় অনেকটা সময় চুপ করে থেকে শাফকাতের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “চিন্তা কোরো না শাফকাত। তোমার দিকে আঙুল তোলার সুযোগ কারও নেই। তুমি তো কিছুই জানতে না। তাছাড়া তুমি তো সিনেব্লাস্টের সিইও না। ভেতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তোমার জানার কথাও না।”

কথাগুলো শুনতে সহজ মনে হলো, ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি টের পেলো সাবা। সিনেব্লাস্টের সিইওর এই কুকীর্তি আবার কোনো সংকট না বয়ে আনে তাদের সুখময় জীবনে!

(চলবে)

#লেবু
৫৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সিনেব্লাস্টের সত্যতা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে তা হজম করতে কয়েকটা দিন সময় লাগলো শাফকাতের। তবে মুষড়ে পড়লো না। মুষড়ে পড়া স্বভাবে নেই শাফকাত আলমের। সিনেব্লাস্ট ছাড়াও একাধিক সফল কোম্পানি আছে তার। একাধিক সফল কোম্পানির একাধিক সমস্যা। সব সমস্যাতেই মনোযোগ দিতে হয় তাকে। তবে সিনেব্লাস্টের ব্যাপারটা একেবারে মাথা থেকে ঝেড়ে দিতে পারলো না শাফকাত।

সমস্যার সমাধান করতে করতে শাফকাতের মস্তিষ্ক যখন ক্লান্ত, তখনই সকাল সকাল নতুন সমস্যার আগমনী বার্তা নিয়ে এলো রাব্বির ফোন।

ফোনটা রিসিভ করে শাফকাত বিরক্ত মুখে বলল, “কী ব্যাপার রাব্বি?”

অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল রাব্বির ভীত কণ্ঠ, “স্যার। একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”

মোটেও বিচলিত হলো না শাফকাত। কর্মচারীদের প্রধান কাজই তো হলো ঝামেলা বাঁধানো। এ আর নতুন কী?

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “কী ঝামেলা?”

গাজীপুরে তার একটা ফ্যাক্টরি সামলানোর দায়িত্ব রাব্বিকে দিয়ে রেখেছে শাফকাত অনেকদিন ধরেই। সেই ফ্যাক্টরির কোনো কর্মীর কথাই বলছে হয়তো।

রাব্বি চাপা গলায় বলল, “ফ্যাক্টরির একটা মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।”

শাফকাত বিরক্তির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে বলল, “তো আমি কী করবো? আমি কি পুলিশ যে মিসিং পার্সনকে খুঁজতে বসবো?”

“ওই মেয়েটা কাজে যাওয়ার নাম করে বাসা থেকে বের হয়েছিল স্যার। কিন্তু আর বাসায় ফিরে যায়নি। মেয়েটার বাবা-মা ফ্যাক্টরির সামনে এসে অনেক ঝামেলা করছে স্যার।”

“কী আশ্চর্য! মেয়ে কোথায় গেছে না গেছে সেটা নিয়ে ফ্যাক্টরির সামনে ঝামেলা করবে কেন?”

রাব্বি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ওদের ধারণা…”

শাফকাত তীক্ষ্ম স্বরে বলল, “ওদের ধারণা কী?”

“ওদের ধারণা আমরা মেয়েটাকে গুম করেছি। আমি যেহেতু ফ্যাক্টরির সুপারভাইজার, দোষ সব আমার ঘাড়েই এসে পড়ছে।”

তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাফকাত। স্বল্পশিক্ষিত মানুষের এই এক সমস্যা। নিজেদের জীবনে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এলে তার দায় কী করে সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের ওপর চাপিয়ে পাড় পাবে!

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি জানো মেয়েটার ব্যাপারে কিছু?”

রাব্বি আবারও ভয়ে ভয়ে বলল, “না স্যার!আমি কিছুই জানি না। মেয়েটাকে তো চিনতামও না সেভাবে। ফ্যাক্টরিতেই দেখে এসেছি। মেয়েটার বাবা-মা বলছে, তাদের মেয়েকে খুঁজে না দিলে না-কি পুলিশের কাছে যাবে।”

শাফকাত কঠিন গলায় বলল, “তো খুঁজে বের করো! খুঁজতে না পারলে জেলে যাও। ছোটখাটো ব্যাপারে আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দিলো শাফকাত। মুখে ব্যাপারটাকে ‘ছোটখাটো’ আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দিলেও বুকের ভেতরে বিচিত্রভাবে খচখচ করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে ছোট্ট এই ঘটনা বেশ ভোগাতে যাচ্ছে তাকে এবং তার এই বিশাল সাম্রাজ্যকে।

‘Beyond Borders’ এর অফিসে আজ সকাল থেকে একের পর এক মিটিং অ্যাটেন্ট করছে শাফকাত। বিদেশি কয়েকটা কোম্পানির সঙ্গে ডিল ফাইনাইলাইজ করলো। সেই সঙ্গে শরীরে ঢুকলো কাপের পর কাপ ব্ল্যাক কফি। সাবা ঠিকই বলে, কাজের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের যত্ন নিতে ভুলেই গেছে শাফকাত।

মিটিংয়ের মাঝে কয়েকবার ফোন এলো মেয়েটার। এমন না যে শাফকাতের কথা বলার ইচ্ছে নেই। কিন্তু এমন জরুরি একটা মিটিংয়ের মাঝে ফোন রিসিভ করা নিতান্তই শোভন কোনো আচরণ নয়।

কলের বিপরীতে ছোট করে ম্যাসেজ লিখে পাঠালো, “মিটিংয়ে আছি। পরে ব্যাক করছি।”

ফোনটা ডেস্কে উল্টো করে রেখে আবারও মিটিংয়ে ডুব দিলো শাফকাত। সে নিজেও টের পায় আজকাল তার মাঝে ভর করা এই যান্ত্রিকতা। যান্ত্রিক সে আগেও ছিল। পড়াশোনা শেষ করার আগেই নিজের ব্যবসা করে তুলতে শুরু করে শাফকাত। কাজের বাইরে ছেলেটা কখনো কিছু বুঝেছে কিনা কে জানে। এই যান্ত্রিকতা একটা সময়ে বড় আপন ছিল তার। কিন্তু আজকাল কেন জানি এই যান্ত্রিক জীবনটাকে বড় অসহনীয় বলে মনে হয়।

যে শাফকাতের মস্তিষ্কে আগে তুচ্ছ কোনো চিন্তা-ভাবনা জায়গা করে নিতে পারতো না, আজকাল মাঝেমধ্যে তারও ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে সাবাকে নির্জন কোনো দ্বীপে চলে যেতে। যেখানে কাজের দুশ্চিন্তা থাকবে না, থাকবে শুধুই প্রশান্তি।

কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের কেন যে এই বিস্তর ফারাক! বাস্তবে যেখানে প্রশান্তির খোঁজ করে বেড়াচ্ছে শাফকাত, সেখানে প্রশান্তি তো মিলছেই না। বরং সমস্যাগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

গাজীপুর থেকে আবারও ফোন এলো তার কাছে। তবে এবারের ফোনটা রাব্বির নয়। ফ্যাক্টরির অন্য এক কর্মীর। ভীত ভঙ্গিতে শাফকাতকে সে জানালো, রাব্বিকে না-কি কিছুক্ষণ আগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে!

উত্তপ্ত একটা স্রোত বয়ে গেল শাফকাতের গা বেয়ে। একেকটা কোম্পানিতে এত এত কর্মচারী তার। এদের কেউ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে শাফকাতের যতটা না বিচলিত হওয়ার কথা, তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি বিচলিত হলো সে রাব্বির গ্রেফতারে।

কারণ রাব্বি তার আর দশটা সাধারণ কর্মচারীর মতো নয়। যতবারই নিয়মের সীমারেখা সে পাড় করেছে, ততবারই তার সাক্ষী হয়েছে রাব্বি। হোক সে সাবার ওপর আক্রমণকারী প্রভাবশালী নেতার বাড়িতে পাল্টা হামলার ঘটনা কিংবা ফাহিমের গায়ে গুলি করে সাবাকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল ঠিক সেখানেই ফেলে আসার ঘটনা।

যদিও রাব্বি তার যথেষ্ট অনুগত। কিন্তু জগতের তিক্ত সত্যগুলোর অন্যতম সত্য হলো, নিতান্ত আপন ছাড়া কেউই শতভাগ বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার কালো সত্যগুলো ধারণ করে থাকা ছেলেটার পুলিশের কাছে থাকা নিশ্চয়ই কোনো কাজের কথা নয়।

কাজের মোবাইলের কন্ট্যাক্ট লিস্টে লয়ারের নম্বর খুঁজছে শাফকাত। আগামীকাল সকালে কোর্টে তোলা হবে রাব্বিকে। কালকের মধ্যে জামিনে তাকে ছাড়িয়ে আনতে পারলেই হয়!

ওদিকে ব্যক্তিগত মোবাইলের রিংটোন অনবরত বেজেই যাচ্ছে। লয়ারের নম্বর খুঁজতে শাফকাত এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আরেক ফোনের স্ক্রিনের ওপরে নজরই পড়েনি। যখন পড়লো, তখন দেখলো তাতে ভেসে উঠেছে সাবার নাম।

রাব্বির আকস্মিক গ্রেফতার না-কি দিনভর কাজের চাপ কোনটার ধকলে কে জানে? অনবরত ফোন আসায় বিরক্তির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেল শাফকাত। ভুলেই গেল অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটা কে?

ফোন রিসিভ করে শাফকাত প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “কী ব্যাপার সাবা? যখন দেখছো রিসিভ করছি না, বারবার ফোন করছো কেন?”

সাবা বোধ হয় শাফকাতের আকস্মিক এমন আচরণে কিছুটা হকচকিয়ে গেল। মুখ খুলে কিছু বলতেও কয়েকটা মুহূর্ত সময় নিলো সে।

অবশেষে শুকনো গলায় বলল, “সকাল থেকে তুমি ফোন রিসিভ করছিলে না তাই ভাবলাম…”

শাফকাত ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “ব্যস্ত আছি বলেই তো রিসিভ করছি না। তোমাকে তো টেক্সটও পাঠিয়েছি। পাঠাইনি?”

সাবা কতটুকু মর্মাহত হলো কে জানে? নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলল, “হু‌ঁ, সরি।”

এক মুহূর্তেও আর অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে কলটা কেটে দিলো সাবা। কল কেটে যাওয়ার শব্দ কানে বাজতেই সংবিৎ ফিরে পেলো শাফকাত। উপলব্ধি করলো, আবারও একটা ভুল করে ফেলেছে সে। নিজের ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলো শাফকাত। বারবার নিজেকে প্রতিজ্ঞা করে, সাবাকে আর এক বিন্দুও কষ্ট দেবে না। আবার নিজেই নির্দ্বিধায় ভঙ্গ করে সেই প্রতিজ্ঞা।

শাফকাতের উচিত এই মুহূর্তে কলব্যাক করে সাবার কাছে ক্ষমা চাওয়া। কিন্তু সমস্যাটার একটা সমাধান দরকার আগে। তাই লয়ারকে ফোন করার সিদ্ধান্তই নিলো।

ঘটনার সারসংক্ষেপ বুঝিয়ে বলতেই তিনি আশ্বাস দিলেন, রাব্বির সঙ্গে কথা বলার জন্যে তিনি একটু পরেই গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। শহরের অন্যতম সেরা ক্রিমিনাল লয়ার তিনি। রাব্বির বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ যেহেতু নেই তাই তাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনা খুব একটা কঠিন হবে না তার পক্ষে।

লয়ারের সঙ্গে কথোপকথন সারতে সারতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। আরও একটা মিটিং বাকি ছিল। কিন্তু সেটা ক্যান্সেল করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শাফকাত। বাইরের জগতের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে করতে বুঝি নিজের জগতেও যেচে ডেকে আনলো সমস্যাকে।

বাড়ি ফিরেই সোজা নিজেদের ঘরে চলে গেল শাফকাত। কিন্তু কোথাও দেখা মিলল না সাবার। অথচ আতিয়া আলম বললেন, বিকেলের দিকেই বাড়ি ফিরেছে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো শাফকাত। নিশ্চয়ই ছাদে আছে সাবা। মন খারাপ থাকলে মেয়েটা সেখানে গিয়েই চুপচাপ বসে আছে।

শাফকাতের ধারণাই সত্যি হলো। ছাদের একেবারে কোণায় নিজের শখের টবগুলো ঘেঁষে বসে আসে সাবা। দৃষ্টি মাটিতেই আবদ্ধ। তার আশেপাশের প্রত্যেকটা টবে লেবুগাছ। কিছুদিন আগেই লেবুগাছগুলো শাফকাত উপহার দিয়েছিল তার লেবুকে। যতবারই সে এই গাছগুলোর যত্ন নিতে আসবে, ততবারই যেন মনে পড়ে শাফকাতের কথা। কিন্তু শাফকাতের কখনো ভাবতেও পারেনি তার কারণে মন খারাপ করে গাছগুলোর কাছে বসে থাকতে হবে সাবাকে।

ধীর পায়ে সাবার কাছে এগিয়ে গেল শাফকাত। তার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে কয়েক মুহূর্তের জন্যে তাকালো সাবা। সচরাচর ক্লান্তিময় দিনশেষে যখন দুজনের দেখা হয়, তখন সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাসে চকচক করে ওঠে সাবার চোখদুটো। উৎফুল্ল ভঙ্গিতে শাফকাতকে জড়িয়ে ধরে সে বলে, “জানো আজ কী হয়েছে?”

আজ সেসবের কিছুই হলো না। আজ উচ্ছলতার বদলে সাবার দুচোখে শীতলতা। শাফকাতের দিক থেকে চোখ নামিয়ে আবারও মাটির দিকে তাকালো সে।

শাফকাত নিঃশব্দে তার পাশে বসে জড়িয়ে নিলো তাকে বুকের মাঝে। অভিমানে সরে গেল না সাবা। গুটিসুটি মেরে চোখদুটো বুজে মাথা রাখলো শাফকাতের বুকে।

শাফকাত সাবার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল, “বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না?”

সাবা জোরপূর্বক একটা হাসি হেসে শুকনো গলায় বলল, “না।”

“I’m sorry Saba. আমি…”

আর কিছুই বলতে পারলো না শাফকাত। কী যেন মনে করে থেমে গেল। বারবার নিজের অজান্তেই মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলছে সে। অনুতাপের প্রবল হাওয়া বয়ে গেল তার গা বেয়ে। এমন তো নয় যে তার এই কষ্ট দেওয়া নতুন কিছু। বিয়ের শুরু থেকেই নানাভাবে কষ্ট দিয়ে আসছে সাবাকে। তখন তো তাও মেয়েটা তার দেওয়া কষ্টের প্রতিবাদে অগ্নিকণ্ঠে ঝগড়া করতো কয়েক দফা। কিন্তু একটা তাও করে না। চুপিসারে অভিমান বয়ে বেড়ায় নিজের মাঝে।

শাফকাত ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “বারবার একেকটা ভুল করে ক্ষমা চাওয়া আমার অভ্যাস হয়ে গেছে তাই না?”

সাবা মলিন হাসি হেসে বলল, “তা তো হয়ে গেছেই।”

শাফকাত অনুতাপের সুরে বলল, “তোমার হয়তো মনে হয় তুমি বারবার ক্ষমা করে দাও বলেই আমি সেটার সুযোগ নিচ্ছি। বারবার ভুল করে যাচ্ছি। কিন্তু সাবা বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে কখনোই কষ্ট দিতে চাই না।”

শাফকাতের বুক থেকে মাথা তুলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে সাবা বলল “শাফকাত, এত কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন? আমি জানতে চেয়েছি এতকিছু?”

শাফকাত ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কষ্ট তো পেয়েছো।”

সাবা আবারও সেই মলিন হাসিটা হেসে বলল, “পাইনি বললাম তো! আমি জানি তোমার কাজের অনেক প্রেশার যাচ্ছে। আমারই উচিত হয়নি অকারণে তোমাকে বিরক্ত করা।”

“তোমার কলে আমি কখনো বিরক্ত হই না লেবু, কখনোই না। আজ…”

“কী হয়েছে আজ?”

এমনিতেই আজ দিনটা ছিল ঝামেলাময়। ঝামেলা নিয়ে আলোচনা করে আরও একবার ঝামেলা পোহাতে চাইলো না শাফকাত।

তাই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, “বাদ দাও।”

সাবা শাফকাতের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সোজা হয়ে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, দিলাম বাদ। কিন্তু তুমি আমাকে একটা প্রমিজ করবে?”

শাফকাত দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “করবো।”

শীতলতার মাঝেও হেসে ফেলে সাবা বলল, “কী প্রমিজ না জেনেই বলে দিলে করবে?”

“হুঁ, বলেছি। এখন বলো কী প্রমিজ?”

বেশ অনেকটা সময় চুপ করে রইলো সাবা। যে জানে কী বলতে চায় সে, তবুও যেন কী করে বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মনে মনে কথা গোছাতেই ব্যয় হলো এতটা সময়। শাফকাতও কথা গোছানোর সময়টুকু দিলো তাকে।

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে সাবা কাতর কণ্ঠে বলল, “আমার কাছ থেকে কখনো দূরে সরে যেও না শাফকাত।”

শাফকাত জোর গলায় বলল, “কী যে বলো! কোথায় যাবো আমি?”

সাবা শুকনো গলায় বলল, “কোথাও যেতে হবে কেন? অনেক সময় মানুষ এক ছাদের নিচে থেকেও তো দূরে সরে যায়।”

অদ্ভুতভাবে মোচড় দিয়ে উঠলো শাফকাতের বুকের ভেতরটা। তবে কি তার এই ব্যস্ততা দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তাদের? দূরে সরিয়ে না দিলেও সাবার মনে হচ্ছে তারা দূরে সরে যাচ্ছে। নিজেকে, নিজের ব্যস্ততাকে না-কি পরিস্থিতিকে দোষ দেবে শাফকাত? নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।

সাবা থেমে থেমে বলল, “জীবনে অনেকটা কষ্ট সহ্য করার পর আমি তোমাকে পেয়েছি শাফকাত। লম্বা সময় ধরে আমি হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম। বেঁচে থাকার কারণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। জড়ো পদার্থের মতো বেঁচে থাকতাম। মনে মনে হয়তো জীবনের শেষ দিনটার জন্যে অপেক্ষাও করতাম। আমার যন্ত্রণাময় জীবনটা থেকে সব যন্ত্রণাগুলো মুছে দিয়েছো তুমি শাফকাত। আমার হাসির কারণ, বেঁচে থাকার অবলম্বন এখন তুমি। তোমাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারবো না।”

শাফকাত আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“আমাকে তুমি কখনোই হারাবে না লেবু। সবসময় এভাবেই তোমার পাশে থাকবো। প্রমিজ করলাম।”

(চলবে)