#লেবু
৫৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
শাফকাত-সাবা দুজনেরই ব্যস্ততা বেড়ে গেছে গত কয়েকটা মাসে। শাফকাত তার কাজের সমস্যাগুলো গুছিয়ে এনেছে একটু একটু করে। রাব্বি জামিন পেয়েছে, যে মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তার পরিবারেরও সাড়াশব্দ নেই। সিনেব্লাস্ট অনিয়মগুলো শুধরে নেওয়ার জন্যে নতুন একটা টিম গঠন করা হয়েছে।
এদিকে সাবাও একেকটা রিপোর্ট করার জন্যে ছুটে বেড়াচ্ছে দেশের একেক প্রান্তে। তার জনপ্রিয় অপরাধ অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান ‘বাতাসে কীসের গন্ধ?’ – এর দ্বিতীয় সিজনের শুটিং চলছে মহাআড়ম্বরে।
এত ব্যস্ততার মাঝেও সাবাকে দেওয়া কথা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে শাফকাত। একই ছাদের নিচে থেকেও দূরে সরে যায় না তার কাছ থেকে। হাজার ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলেও, সাবাকে সময় দেয় সবসময়। সাবার সারাদিনের গল্প শোনে, তার সঙ্গে পুরোনো দিনের কোনো একটা সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। কাজের ভার মস্তিষ্কে থাকলেও বাড়ি ফিরে সাবাকে জড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভার কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। সব ভুলে কেবল সাবাই হয়ে ওঠে তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।
শাফকাতের এই বাড়তি যত্নের কারণেই অদৃশ্য ওই ভয়টা কেটে গেছে সাবার। কয়েক মাস আগে শাফকাত ফোন করে যখন কড়াভাবে ধমক দিলো তাকে, তখন মনে হয়েছিল হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষটাকে। আবারও পূর্বের সেই তিক্ততা এসে বাসা বাঁধতে চলেছে তাদের মাঝে।
ভালোবাসার উজ্জ্বলতা, উচ্ছলতা আজীবন একই রকম থাকে না। একটা সময় পর তাকে নিষ্প্রভ হয়ে যেতেই হয়। দুটো মানুষের চেষ্টাই পারে সেই উজ্জ্বলতায় আবারও ভাসাতে ভালোবাসাকে। শাফকাত আর সাবা দুজনেই দুদিক থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে বলেই তাদের ভালোবাসা আজ সেই প্রথম দিনের মনে উচ্ছলতায় পরিপূর্ণ।
আজ অফিসে সকলের মাঝেই কেমন ঢিলেঢালা ভাব আর চাপা উত্তেজনা। সাবা সকাল থেকেই নিজের কেবিনে বসে রিপোর্ট লিখছে। একবার বের হলো ক্যাফেটেরিয়া থেকে কফি আনতে। তখনও দেখে চারপাশে ফিসফাস।
এ আর নতুন ঘটনা নয়। দেশে চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটলেই অফিসের সকলের মাঝে ফিসফাস শুরু হয়ে যায়। নিজের অভিমত একে অপরের কাছে তুলে ধরতে ঘন্টার পর ঘন্টা পাড় করে দেয় তারা। আর একজনের সঙ্গে আরেকজনের মতের বিরোধ ঘটলেই নিজেদের মধ্যে বেঁধে যায় তুমুল বাক-বিতণ্ডা।
সকলের এই ফিসফাসকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে, কফি নিয়ে নিজের কেবিনে ফিরে এলো সাবা। শাফকাতকে সাবধান করতে করতে এখন তার নিজের অবস্থাও হয়েছে তার মতোই। অনুষ্ঠানের নতুন সিজন শুরু হওয়ার পর থেকে কাজের চাপ এমন হারে বেড়ে গেছে যে রাতে চার-পাঁচ ঘন্টার বেশি ঘুম হচ্ছে না কিছুতেই। তাও ভাগ্যিস কাল শুক্রবার। রাতভর ঘুমিয়ে কাল সারা দিনটা শাফকাতের সঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করে মনে মনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো সাবা। কিন্তু তার এই উচ্ছ্বাস যে দীর্ঘস্থায়ী হবে না, সুখময় পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন যে হবে না – কে জানতো?
‘বাতাসে কীসের গন্ধ?’ – এর
পরবর্তী পর্বের কয়েকটা ফুটেজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। সেই ফুটেজগুলো খুঁজে বের করার দায়িত্ব সাবা তার ক্যামেরাম্যানকে দিয়েছিল। ক্যামেরাম্যান সময়মতো তার দায়িত্ব পালন করে ফুটেজগুলো খুঁজে দিয়ে গেল সাবার কেবিনে।
নিজের কম্পিউটারে একবার সেগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে হার্ডড্রাইভ নিয়ে এডিটিং সেকশনের দিকে পা বাড়ালো সাবা। নতুন পর্বের এডিটিং চলছে। এই
ফুটেজগুলো পর্বের মাঝখানে বসবে। এডিটরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে না দিলে ভুল হতে পারে।
এডিটিং সেকশনে পৌঁছে সাবার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। এতগুলো এডিটরের ডেস্ক পাশাপশি, অথচ একজনেরও কাজে মন নেই। চায়ের কাপ হাতে কিংবা চায়ের কাপ বাদেই আড্ডায় মেতে উঠেছে সকলে নিজেদের মাঝে। সাবার উপস্থিতিতে অবশ্য থামলো বেশির ভাগ। হাতেগোনা কয়েকজনের মাঝে এখনো ফিসফাস চলছে।
তারাও থেমে গেল সাবার বিস্মিত কণ্ঠ শুনে,
“কী ব্যাপার?”
ক্লাসরুমে বাচ্চারা বেশি কথা বলার পর শিক্ষকের হুংকারে যেমন দমে যায়, ঠিক তেমনি দমে গেল সকলে। কেউ কেউ ডেস্কের দিকে তাকিয়ে কাজে মন দেওয়ার ভান করতেও পিছপা হলো।
এডিটরের মধ্যে সাবার সবথেকে কাছের নিহা। সাবা রেগে যেতে পারে তাকে সামলাতে সেই হাসিমুখে এগিয়ে এলো।
হাসি হাসি গলায় বলল, “আপু তুমি জানো না কী ব্যাপার?”
সাবা বিরক্ত গলায় বলল, “না।”
নিহার হাতেই তার মোবাইলটা ছিল। বোতাম টিপে স্ক্রিন অন করে কী যেন খুঁজলো সে মুহুরতখানেক। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা খুঁজে পেতেই উজ্জ্বল হাসি হেসে মোবাইলের স্ক্রিনটা ফেরালো সাবার দিকে।
উজ্জ্বল গলাতেই বলল, “এই দেখো! আরশাদ হকের স্ক্যান্ডাল ভাইরাল হয়েছে।”
সাবা এক পলক তাকালো তার মোবাইলের স্ক্রিনে। সাধারণ মানুষের মনযোগ আকর্ষণ করার মতোই একটা ছবি। সুপারস্টার আরশাদ হকের সঙ্গে কোনো এক নায়িকার অন্তরঙ্গ ছবি। এই ছবি ভাইরাল হওয়ার পর কারই বা কাজে মন বসে?
তবুও সাবা কঠোর গলায় বলল, “তো? এখন এই খুশিতে কাজ বন্ধ করে দিতে হবে?”
সাবার এই কথাটায় এবার পুরোপুরি দমে গেল সকলে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার আর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ফুটেজগুলো নিহাকে বুঝিয়ে দিয়ে সাবা আবারও সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, “Everyone please get back to work!”
আবারও কেবিনে ফিরে এসে নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো সাবা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সকলকে যে কারণে শাসিয়ে এলো, সেই একই কারণে কাজে ব্যাঘাত ঘটছে তারও। চাপা কৌতুহল উঁকি দিচ্ছে বারবার মনের মাঝে।
নিজেকে সামলাতে না পেরে মোবাইলটা হাতে তুলেই নিলো সাবা। আরশাদ হক দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার। তার এত বড় একটা স্ক্যান্ডাল সামনে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্ঘাত এ নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে!
সাবার ধারণাই সত্যি হলো। ফেসবুকে প্রবেশ করতেই নিউজ ফিডের শীর্ষে তিনটা ছবি। আরশাদ আর একটা নায়িকার ঘনিষ্ট ছবি। মেয়েটাকে সাবা চেনে না। ক্যাপশন পড়ে জানলো তার নাম সুজানা।
নিউজ ফিডে যতদূর স্ক্রল করা যায়, ততদূর এই ঘটনা নিয়েই পোস্ট। লোকে আরশাদের উপর নিজেদের ক্ষোভ ঝাড়ছে লম্বা লম্বা ক্যাপশনে। সকলের মতে, আরশাদ হকের মতো চরিত্রহীন মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। নিজের স্ত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাও আবার যখন তার স্ত্রী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
মেয়েটার জন্যে খারাপই লাগলো সাবার। কিন্তু এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালো না। সেলিব্রিটিদের জাঁকজমক জীবন নিয়ে এমনিতেই তার কোনো আগ্রহ নেই। এরা উপরে উপরে জীবনটাকে একভাবে প্রকাশ করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের জীবনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কাজ সেরে আজ আগে আগেই বাড়ি ফিরলো সাবা। ফেরার পথে গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে বলল রেডিওটা অন করতে। কিন্তু সেখানেও আরশাদকে ঘিরেই আলোচনা। কতদিন ধরে সুজানার সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতে পারে এই নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে রেডিওটা বন্ধ করে দিতে বলল সাবা। একটা মুখরোচক খবর পেয়েছে গণমাধ্যম। এই নিয়ে নিউজ করে করে দর্শকের আগ্রহ মাটিতে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত কী করে দম নেয় তারা।
আতিয়া আলম আর শামা একটা বিয়ের দাওয়াতে গেছে। আতিয়া আলমের বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে। ফিরতে রাত হবে জানা কথা। বাড়িতে স্টাফরা ছাড়া আর কারোর থাকার কথা নয়। তবুও সাবা অভ্যাসবশত একজন স্টাফকে জিজ্ঞেস করলো, “শাফকাত ফিরেছে?”
সেই স্টাফ ভদ্রভাবে জবাব দিলো, “জি ম্যাম। স্যার স্টাডি রুমে।”
মনে মনে কিঞ্চিৎ অবাক না হয়ে পারলো না সাবা। ইদানিং শাফকাতের বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ দেরিই হয়ে যায়। আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলো কেন কে জানে?
যদিও বিস্ময়ের থেকে সাবার মনে খুশির পরিমাণই বেশি। ক্লান্তিময় দিনগুলো শেষে সে যেন মুখিয়ে থাকে, কখন শাফকাতকে দেখবে আর কখন উৎফুল্ল ভঙ্গিতে তার সারাদিনের বর্ণনা দেবে।
স্টাডি রুমে কোথাও পাওয়া গেল না শাফকাতকে। তবে ব্যালকনি থেকে ভেসে আসছে তার কণ্ঠস্বর। সাবা ব্যালকনির কাঁচের দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো, রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় কার সঙ্গে যেন ফোনালাপে ব্যস্ত সে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট একটু পর পর ফিরে যাচ্ছে দুই ঠোঁটের মাঝে।
সাবাকে দরজার ওপারে দেখে গাম্ভীর্যের মাঝেও স্নিগ্ধ ভঙ্গিতে ইশারায় তাকে বসতে বলল শাফকাত। সাবাও ক্ষীণ হাসি হেসে শাফকাতের ডেস্কে এসে বসলো। শাফকাতের স্টাডি রুমে লেদারের এই লম্বাটে চেয়ারটা তার ভীষণ পছন্দের। যতবারই এই চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়, ততবারই নাকে ভেসে আসে শাফকাতের গায়ের গন্ধ। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
চোখদুটো বুজে অনেকটা সময় শাফকাতের চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিলো সাবা। তবুও ছেলেটার ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। কী যেন মনে করে সাবা সোজা হয়ে উঠে বসলো। অসাবধানতা বশত তার হাতটা পড়লো শাফকাতের ল্যাপটপের মাউসে।
ল্যাপটপের স্ক্রিন এতক্ষণ বন্ধ ছিল। মাউসে সাবার হাত পড়তে তা আবারও জ্বলে উঠলো। সাবার চেয়ার ছেড়ে উঠেই পড়েছিল, কিন্তু হতবাক হয়ে বসে পড়লো আবারও। তার চোখদুটো আটকে গেল শাফকাতের ল্যাপটপ স্ক্রিনে।
একটা ফাইলটা ওপেন করে রাখা। কতগুলো ছবির ছোট ছোট শটকাট ভেসে উঠেছে। একটা ছবিও ওপেন না করে সাবা নিশ্চিত হয়ে গেল, এগুলো সেই ছবি যা আলোড়ন তুলছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। এই ছবিগুলোই তো একটু আগে দেখছিল সে অফিসে বসে। কিন্তু এই ছবি শাফকাতের ল্যাপটপে কী করছে?
সাবার মনে হলো, হয়তো সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই ভুলে ডাউনলোড হয়ে গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভাঙলো তার। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে তিনটি ছবি। কিন্তু এখানে দশটারও বেশি। সাবা একটু খেয়াল করতেই দেখতে পেলো ফাইলটা তৈরি করা হয়েছে আরও এক মাস আগে।
গলা শুকিয়ে গেল সাবার। অদ্ভুতভাবে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। অজানা ভয়ের আশঙ্কায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো সাবা।
পা বাড়িয়ে কোথাও যাওয়ার আগেই থমকে যেতে হলো তাকে। পেছন থেকে দুটো দৃঢ় হাত এসে আটকে দিলো তাকে। শাফকাত তার কোমর জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে টেনে নিলো তাকে। মুখ ডুবিয়ে দিলো তার চুলের মাঝে।
গাঢ় স্বরে শাফকাত বলল, “লেবু! I missed you.”
ভালোবাসাময় মুহূর্তে ভালোবাসার সাড়া দিতে পারলো না সাবা। তার মস্তিষ্কজুড়ে ভর করছে গভীর দুশ্চিন্তারা।
সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “শাফকাত…”
শাফকাত পেছন থেকেই সাবার ঠোঁটের ওপর তর্জনী রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “কোনো কথা না।”
শাফকাত আলতোভাবে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো সাবার ঘাড়ে। শিহরণের উষ্ণ স্রোতে কোথায় ভেসে যাওয়ার কথা সাবার! কিন্তু বুকের মাঝ থেকে চাপা অস্বস্তিটা কিছুতেই দূর হতে চাইছে না।
সাবা অস্থির গলায় বলল, “শাফকাত শোনো না!”
শাফকাত বিরক্ত সুরে বলল, “কী?”
সাবা শাফকাতের দিকে ঘুরে বলল, “আরশাদ হকের ভাইরাল ছবি তোমার ল্যাপটপের ফাইলে কী করছে?”
শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার অ্যাবসেন্সে আমার ল্যাপটপ দেখার অভ্যাস তোমার গেল না, না?”
“That doesn’t answer my question. এসব কী হচ্ছে শাফকাত?”
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “ইন্টারনেট জুড়ে এখন শুরু এই ছবিই। আমার ল্যাপটপে থাকলে সমস্যা কোথায়?”
সাবা তীক্ষ্ম স্বরে বলল, “সমস্যা হলো এই ফাইল তৈরি করা হয়েছে আরও একমাস আগে। আর এখানে এমন সব ছবি আছে যা ইন্টারনেটেও নেই।”
শাফকাত আবারও সেই হালকা স্বরেই বলল, “তুমি এতসব বুঝবে না সাবা, ঘরে চলো।”
সাবা জোর গলায় বলল, “তাহলে বোঝাও!”
শাফকাত বিরক্ত হয়ে সাবার হাত ধরে তাকে নিয়ে স্টাডি রুমের দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল, “উফ চলো তো!”
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে সাবা অস্থির হয়ে বলল, “শাফকাত তুমি এই বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারো না।”
“তো কী করবো সাবা? এ নিয়ে মিটিংয়ে বসবো তোমার সাথে?”
সাবা ভীত ভঙ্গিতে বলল, “Shafkat don’t tell me you’re involved in this.”
শাফকাত শান্ত ভঙ্গিতেই বলল, “I’m not telling you anything.”
ঘরে এসে শাফকাত নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে টাই আলগা করে ব্যস্ত।
ওদিকে সাবা চিন্তায় অস্থির হয়ে বলল, “এই মেয়েটাকে তুমি আরশাদ হকের কাছে পাঠিয়েছ? তুমি কি কোনো কারণে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছো?”
সাবার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলো না শাফকাত।
সাবা আবারও বলল, “শাফকাত ওই ছবিগুলো কি আদৌ আসল?”
শাফকাত ধৈর্যহারা হয়ে বলল, “না।”
সাবা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “না মানে?”
শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “এ আই দিয়ে বানানো ওই ছবিগুলো। আমার অফিসের ছেলেরাই বানিয়েছে। হয়েছে শান্তি?”
সাবা হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল, “মানে কী এসবের? এই নকল ছবি দিয়ে তুমি আরশাদ হকের ইমেজ নষ্ট করার চেষ্টা করছো? কেন?”
“বললাম না তুমি বুঝবে না। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে
টিকে থাকতে হলে এমন ছোটখাটো পলিটিক্স করতে হয়।”
“একটা মানুষের সংসার ভেঙে যাচ্ছে তোমার
ছোটখাটো পলিটিক্সের জন্যে।”
“আমার নিজের হাতে গড়া এম্পায়ারও ভেঙে গেছে ওর জন্যে।”
“মানে?”
শাফকাত অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুরু থেকে সবটা বলল সাবাকে। আরশাদের প্রতি, তার সাফল্যের প্রতি শাফকাতের ক্ষোভের কারণ। সাবাকে সঙ্গে শাফকাতের বিয়েটা যখন শেষের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছিল, তখন আরশাদের সুখময় জীবন দেখে তাকে ঝেঁকে ধরা তীব্র রাগ – সব।
সবটা শুনে যেন থ বনে গেল সাবা। শাফকাতের এই রূপটা যে তার অচেনা তা নয়। কিন্তু এই রূপটা যে এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে কে জানত?
সাবা বিড়বিড় করে বলল, “একটা মানুষের এত বড় ক্ষতি তুমি কি করে করতে পারলে শাফকাত? আরশাদ তো তোমার কোনো ক্ষতি করেনি। সে নিজের প্রোডাকশন হাউজ গড়ে তুলেছে। তোমার প্রোডাকশন হাউজের ক্ষতি করা তো তার লক্ষ্য ছিল না।”
শাফকাত উত্তপ্ত গলায় বলল, “কিন্তু ক্ষতি তো করে ফেলেছে। Now he has to face the consequences.”
শাফকাতের কর্মকাণ্ডের জন্যে এই মুহূর্তে রাগ করা উচিত সাবার। কিন্তু রাগের থেকেও যে জিনিসটা তার শিরদাঁড়া প্রকম্পিত করছে তা হলো ভয়। সাবা বিনোদন বিটের সাংবাদিক না হলেও সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছে, আরশাদ হক কেমন। এমনিতে তার মতো শান্তশিষ্ট মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই, কিন্তু তার ওপর কেউ অহেতুক আক্রমণ চালালে তাকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আরশাদ নয়।
সাবা শুকনো গলায় বলল, “কাজটা ঠিক হয়নি শাফকাত। একদম ঠিক হয়নি।”
শাফকাত আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না লেবু।”
যদিও সাবাকে ভাবতে হবে না, তবুও এ নিয়ে ভেবে ভেবেই রাতটা পার করলো সে।
(চলবে)
#লেবু
৫৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
আরশাদের বিরুদ্ধে যে আগুনে ঘি শাফকাত ঢেলেছিল, সেই আগুন বোধ হয় ভিন্ন বাঁকে মোড় নিয়ে এবার তার দিকেই ধেয়ে আসছে। রাতটা সে যতটা নিশ্চিন্তে পাড় করেছে, আরশাদ নিশ্চয়ই পাড় করেছে ততটাই ব্যস্ততার মাঝে। শাফকাতের নির্দেশ অনুযায়ী সুজানা ওই এআই জেনারেটেড ছবিগুলোকে সত্যি হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস করে বেনাপোল বর্ডারের দিকে রওনা করেছিল।
আরশাদ হক যে আসলেই দমবার পাত্র নয়, তার প্রমাণস্বরূপ মাঝরাস্তা থেকে তাকে বাসের ভেতর থেকে তুলে নিয়ে যায় তার বন্দুকধারী দুজন বডিগার্ড। মাহমুদও পৌঁছে গিয়েছিল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। তাকেও সেখান থেকে ধরিয়ে আনে আরশাদ।
বলাই বাহুল্য, এতক্ষণে শাফকাতের নাম ফাঁস করে দিয়েছে আরশাদের কাছে। যদিও তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল শাফকাতের নাম গোপন করে রাখতে, সব দোষ নিজেদের কাঁধে নিতে। কিন্তু যে মানুষ মাঝরাস্তা থেকে কাউকে তুলে আনতে পারে, তার পক্ষে তাদের অত্যাচার করে সত্যি উগলে নেওয়া অসম্ভব কোনো কাজ নয়। আরশাদ নিশ্চয়ই তাই করেছে।
রাগে রক্ত ফুটে উঠলেই তার বহিঃপ্রকাশ
করলো না শাফকাত। তাকে এই মুহূর্তে শান্ত থাকতে হবে। তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই কারো কাছে। মাহমুদ-সুজানা যতগুলো চেক পেয়েছে, তার সব সিনেব্লাস্ট থেকেই দেওয়া। আর সিনেব্লাস্ট মিডিয়া পরিচালনার দায়িত্বে যেহেতু এখন আর শাফকাত নেই, তার ওপরে আঙুল তোলার কোনো সুযোগও কারও নেই।
খুব ভোর বেলা জেগে উঠলো শাফকাত। মস্তিষ্ক তার যথেষ্ট উত্তপ্ত। হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তাতে অনবরত। সাবা কি কাল রাতে ঠিকই বলল? আসলেই কি আরশাদের বিরুদ্ধে এই খেলায় নেমে কোনো ভুল করে ফেলল সে?
মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম একটা অংশ বারবার জানান দিচ্ছে কোনো ভুলই সে করেনি। যা করেছে, তাই আরশাদের প্রাপ্য। আরশাদ নিশ্চয়ই মনে মনে প্রতিশোধের চিত্রনাট্য সাজাতে ব্যস্ত। সাজাক গিয়ে। কিছুতেই দমে যাবে না শাফকাত। শাফকাতের প্রতিশোধের জন্যেও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবে।
উঠে বসতেই চোখ পড়লো সাবার ঘুমন্ত মুখটার ওপরে। হাজার দুশ্চিন্তার ভিড়েও সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। লেবুটা তার বড্ড চিন্তা করে তাকে নিয়ে। সাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার কপালে গাঢ় একটা চুমু খেল শাফকাত। ঘুমের মাঝেই মৃদু কেঁপে উঠলো সাবা।
ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “আরেকটু থাকো না!”
শাফকাত ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসিটা বজায় রেখেই বলল, “তুমি ঘুমাও সাবা। আমাকে উঠতে হবে।”
আক্ষেপে ভ্রু কুঁচকে আবারও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল সাবা। শাফকাত যদি জানত, সাবার কাছে আরেকটু থেকে যাওয়ার সুযোগ আর মিলবে না, তাহলে বোধ হয় থেকেই যেত।
শাফকাত ভেবেছিল সবার আগে সিনেব্লাস্টের অফিসে যাবে। কিন্তু মাথার ভেতরটা এমনভাবে জট পাকিয়ে গেছে যে কোনো কাজেই নিজের সর্বোচ্চ মনোযোগটা দিয়ে উঠতে পারবে না শাফকাত।
জট পাকানো মস্তিষ্কটাকে হালকা করার জন্যেই শাফকাত চলে গেল ‘গলফার্স প্যারাডাইস’ এ। উচ্চবিত্তদের জন্যে বিশাল জায়গা জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে গলফ কোর্স, নাম দেওয়া হয়েছে ‘গলফার্স প্যারাডাইস’। এখানে যে কেউ চাইলে এসে গলফ খেলতে পারে না। তাকে গুনতে হয়, মোটা অংকের মেম্বারশিপ ফি।
তার পরনে পরনে সাদা পোলা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার, চোখে খয়েরী সানগ্লাস। ছেলেটা এই মুহূর্তে দেখলে যে কেউই বলবে, তার মতো প্রফুল্ল মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই।
আগে প্রতি শনিবার নিয়ম করে এখানে গলফ খেলতে আসতো শাফকাত। আজকাল আর আসা হয় না বলেই হয়তো মস্তিষ্কের মাঝে জট পাকিয়ে যাওয়ার প্রবণতা এতটা বেড়ে গেছে।
অনবরত যান্ত্রিক কাজের ফাঁকে কেবল বিশ্রাম নিলেই চলে না। প্রশান্তিদায়ক অন্য কোনো কাজ করতে হয়। এতে বিশ্রাম পায় মস্তিষ্ক। নতুন উদ্যমে কাজ করার আগ্রহ পায়। শাফকাত ভিআইপি কোর্সে গলফ খেলে। সাবধানতাস্বরূপ ভিআইপি এরিয়ার বাইরে স্ক্যানার হাতে নিজের বডিগার্ডকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কেন জানি শাফকাতের অবচেতন মন বলছে আজ, এই গলফ কোর্সেই ঝড় আসতে চলেছে।
ঝড়টা বোধ হয় সত্যিকার অর্থে চলেই এলো। শাফকাত গলফে মনোনিবেশ করেছে সবে মিনিট দশেক হয়েছে, হঠাৎ ভিআইপি এরিয়ার পার্কিং লট থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ ভেসে এলো। কতশত মানুষ রোজ গলফ খেলতে আসে এখানে! গাড়ি তো যে কারোই হতে পারে। কিন্তু এবারও শাফকাতের সজাগ অবচেতন মন সাবধান করে দিলো তাকে।
শাফকাতের দুজন বডিগার্ডের একজন ভিআইপি এরিয়ার বাইরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। আরেকজন রীতিমত ছুটতে ছুটতে এলো তার কাছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “স্যার! আরশাদ হক এসেছে। আপনার সাথে দেখা করতে।”
তীক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। আরশাদ হক তাহলে মুখোমুখিই প্রতিশোধটা নিতে চায়? না-কি দিতে এসেছে প্রতিশোধের আগাম বার্তা? যেটাই হোক, নেহায়েত কম উপভোগ্য হবে না। ।
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “আসতে দাও।”
মিনিট খানেকের মাথায় ভিআইপি এরিয়ার দরজা দিয়ে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে গলফ কোর্সে প্রবেশ করলো সুপারস্টার আরশাদ হক। পরনে সাদা টিশার্ট, কালো লেদার জ্যাকেট আর কালো জিন্স। লাখো তরুণীর স্বপ্নের বসবাসকারী সুদর্শন পুরুষ।
শাফকাতের দেওয়া আকস্মিক এই ধাক্কায় তার জীবনটা ভয়ানকভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে। দক্ষ অভিনয়ের আড়ালে যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক, তার চোখদুটো তার জানান ঠিকই দিচ্ছে। এক রাতেই সকলের প্রিয় সুপারস্টার থেকে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে সে। অস্পষ্ট একটা খুশি অনুভূত হলো শাফকাতের মাঝে। এটাই তো চেয়েছিল সে!
আরশাদের পিছু পিছু তার বডিগার্ড আসছে। তাকে কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে এবার সে একাই এগিয়ে এলো।
শাফকাতের তীক্ষ্ম হাসি প্রস্তুত হলো। হাসিটা বজায় রেখেই একটা হাত আরশাদের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আরশাদ হক! কত দিন পর! কী খবর?”
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে তার হাতটা নিয়ে হ্যান্ডশেক করলো। তবে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। যেন দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় জানান দেওয়া, শাফকাতের জীবনে ঝড় বয়ে আনতে যাচ্ছে। যদিও সে এও জানে, শাফকাত কিছুতেই দমবার পাত্র নয়।
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “অবশ্য তোমার খবর জানার জন্য একজন টিভির পর্দাই যথেষ্ট।”
দুজনেই জানে তার আকস্মিক শিরোনামে জায়গা করে নেওয়ার পেছনে দায়ী শাফকাত। তবুও তীব্র শীতলতা বিরাজ করছে দুজনের মাঝেই।
শাফকাত সৌজন্যের ভঙ্গিতে তাকে নিয়ে গেলো কিছুটা দূরে মুখোমুখি থাকা দুটো সাদা চেয়ারের কাছে। দুটো চেয়ারের মাঝে একটা গোলাকার কাঁচের টেবিল। আরশাদ গিয়ে বসলো একটা চেয়ারে, শাফকাত তার বিপরীতে। কিছুটা দূরেই দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আরশাদের বডিগার্ড।
শাফকাত চোখের ওপর থেকে সানগ্লাসটা সরিয়ে ফেলতে ফেলতে বলল, “বলো, কীভাবে সাহায্য করতে পারি তোমাকে?”
আরশাদ এবার সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “কী করে মনে হলো সাহায্য চাইতে এসেছি তোমার কাছে?”
রাতের ভয়ানক স্রোতে গা ভাসালো শাফকাত। আরশাদকে অপছন্দের হাজারটা কারণ আছে তার। তার বাঁকা বাঁকা কথাগুলো সেসব করণেরই একটা।
রাগ আর বিরক্তি চেপে রেখে শাফকাত মেকি আফসোস করে বলল, “বলা তো যায় না। দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না তোমার। অবশ্য খারাপই লাগে তোমার জন্য। এত সুখ্যাতি, এত সুনাম – একদিনের মাথায় সব পানিতে? তাও আবার সামান্য একটা মেয়ের জন্য?”
আরশাদ ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার খারাপ লাগে তোমার জন্য। ইন্ডাস্ট্রির এক সময়কার টপ প্রোডিউসার! তোমার অফিসে সেলিব্রিটিরা গিজগিজ করতো সারাদিন। সিনেব্লাস্ট মিডিয়ায় রীতিমত ব্লাস্ট লেগেছে।”
এ জীবনে কোনকিছুতেই ব্যর্থতার মুখ দেখেনি
শাফকাত। ব্যবসায়ীরা একটার পর একটা ব্যবসায় লস করেই শেষমেশ জীবনের সফলতম ব্যবসার সন্ধান পায়। তবে শাফকাতের জীবনে তেমনটা ঘটেনি। সে নিজের হাতে যে ব্যবসাই গড়ে তুলেছে, সেটাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেখেছে সর্বোচ্চ সফলতার মুখ। একমাত্র এই সিনেব্লাস্ট বাদে। ব্যর্থতায় অভ্যস্ত নয় বলেই হয়তো যখন কেউ চোখে আঙুল দিয়ে ব্যর্থতার সম্মুখীন করে তখন রাগে রীতিমত গা জ্বলে যায়।
শাফকাতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজের কথা ভাবো। আপাতত তোমাকে সেটাতেই মানাবে।”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি তো সারাক্ষণ নিজের কথাই ভাবি। তুমি যাতে ভাবতে শুরু করো, সেই ব্যবস্থা করতে এসেছি।”
শাফকাত বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “মানে?”
আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “এক কথা বারবার এক্সপ্লেন করতে ভালো লাগে না। বুঝে নাও।”
আবারও সেই বাঁকা বাঁকা কথা! হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের ভেতরের উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির লাভা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না।
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “তুমি যে কতটা নোংরা আমি সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম। টাকার জন্যে বিদেশি প্রোডিউসারদের কাছে দেশের সুনাম বিক্রি করতেও তোমার রুচিতে বাঁধেনি।”
আরশাদের সঙ্গে শাফকাতের শত্রুতার শুরুটাই হয় আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে যখন যৌথ প্রযোজনার ওই সিনেমায় আরশাদ কাজ করবে না বলে জানিয়ে দেয়। বিদেশি প্রযোজকদের সঙ্গে সেবারই প্রথম মোটা অঙ্কের বাজেটের সিনেমা নির্মাণের চুক্তি হয়েছিল। তাদের দুটো শর্ত, স্ক্রিপ্ট তাদের পছন্দমতো হবে আর সিনেমায় সুপারস্টার আরশাদ হককে থাকতে হবে।
শাফকাতের তৎকালীন সুসম্পর্কের জেরে আরশাদ একদিনের নোটিশে স্ক্রিপ্ট না পড়েই চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল সেই সিনেমার সঙ্গে। কিন্তু পরবর্তীতে স্ক্রিপ্ট পড়ে যখন বুঝতে পারে, সিনেমায় বাংলাদেশের মানুষদের ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তখনই সরে আসে সে সিনেমাটা থেকে।
শাফকাত সেই স্ক্রিপ্ট পরে পড়েছিল ঠিকই। কিন্তু সিনেমা থেকে সরে আসার মতো কোনো কারণ তার চোখে পড়েনি। গল্পে একটা বিদেশী মেয়ে বাংলাদেশে ঘুরতে এসে কাঁদায় পা পিছলে রাস্তায় পড়ে মারাত্মকভাবে আঘাত পায়। তার পা কেটে র/ক্ত বের হচ্ছে আর আশেপাশের মানুষগুলো। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে না এসে দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। এমন অনেক দৃশ্যই ছিল সেই সিনেমায় যা দেখে বিদেশি কারও মনে হতে পারে, বাংলাদেশিরা রাগী এবং স্বার্থপর।
এদেশের মানুষ অমন নয় তা যেমন সত্যি, তেমন এও সত্যি যে কোনো এক বিদেশিনী আঘাত পেয়ে রাস্তায় কাদায় মাখামাখি হয়ে কান্নাকাটি করলে তাকে সাহায্য করার বদলে মানুষগুলোর বড় একটা অংশ দূরে দাঁড়িয়ে তার কান্ডকারখানা উপভোগ করবে। মোবাইল বের করে ভিডিও ও করবে।
সিনেমায় তো বাস্তব চিত্রই ফুটে ওঠে। এই সিনেমাটা বিদেশীরাও দেখবে বলে এতে মেকি উপস্থাপন তুলে ধরতে হবে কেন?
এতসব বিস্তারিত বর্ণনা না করে শাফকাত হালকাভাবে বলল,“ভালোমানুষি দিয়ে বিজনেস হয় না আরশাদ। আর এই পৃথিবীতে টিকে থাকার একমাত্র উপায় বিজনেস।”
“বিজনেস যেন তুমি একাই করো!”
আরশাদের এই তীক্ষ্ণ কটাক্ষ গায়ে না মেখে পারলো না শাফকাত। অভিনেতা আরশাদ ক্রমেই ব্যবসায়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এই সত্য তাকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
শাফকাত অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “এটা আমার ইন্ডাস্ট্রি। এই ইন্ডাস্ট্রিকে যদি আজ দেশের বাইরে কেউ চিনে থাকে সেটা আমার কারণে। আমি যতগুলো সিনেমা প্রডিউস করেছি, ততগুলো সিনেমা প্রডিউস করা কারো সাধ্যের বাইরে।”
শাফকাতের মাঝে সত্য লুকাবার কোনো প্রচেষ্টা নেই। সে যেন বরং চাইছে আরশাদ জানুক, তার এমন কাজের পেছনের প্রকৃত কারণটা কী।
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “বড় বড় কথায় কোনো লাভ তো হচ্ছে না। সেই জায়গাটা ইতোমধ্যেই অন্য কারো দখলে।”
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “আরেকজনের জায়গা দখলে নিয়ে খুব গর্ব হয় না তোমার? নিজের জায়গা নিজে তৈরি করলেও একটা কথা ছিল।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “এতই যখন বিজনেস বোঝো, নিজেকে বিজনেসম্যান বলে দাবি করো – তখন দিতে টক্কর! সেই চেষ্টা পর্যন্ত করলে না। ক্লাসের টপার একবার পরীক্ষায় খারাপ করলে, আরও বেশি পরিশ্রম করে আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য। নকল করে না। অন্তত তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।”
শাফকাত স্পষ্ট বুঝতে পারছে কোন দিকে ইঙ্গিত করছে আরশাদ। তার মাঝে কোনো অপরাধবোধ দেখা গেল না। আরশাদকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল শাফকাতের একমাত্র লক্ষ্য। যাতে সুপারস্টারের খ্যাতি মিশে যায় মাটির সঙ্গে। যাতে সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে না পারে আরশাদ।
শাফকাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “You deserved it.”
আরশাদ মেকি বিস্ময় নিয়ে বলল, “Did I?”
“হুঁ। এই জীবনে আমি যা যা চেয়েছি, তার সব তুমি পেয়েছো। পেয়েছো বললে ভুল হবে, আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছো।”
আরশাদ খানিক বিস্ময় এবং বিভ্রান্তিমাখা চোখে তাকালো শাফকাতের দিকে।
শাফকাত কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই বলতে শুরু করলো, “মেয়েদের প্রতি আমার বাড়তি কোনো ইন্টারেস্ট নেই। একটা মেয়েকে পছন্দ করেছিলাম। প্রাইভেট জেটে প্রপোজ করেছিলাম। দুবাই থেকে আনা এক্সপেন্সিভ আংটি দিয়ে। আর সে কিনা বলে তোমাকে ভালোবাসে! তোমাকে!”
ভ্রু ওপরে তুলে তাকালো আরশাদ। বিস্ময়ে তার রীতিমত হাসি পেয়ে গেল।
হেসে ফেলেই সে বলল, “তাই না-কি? অবশ্য নওশীনের তোমার সাথেই বিয়ে হওয়া উচিত ছিল। একেবারে মেড ফর ইচ আদার জুটি! আমি যদি টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যত ঘুরতে এসে দেখতে পারতাম, তোমরা দুজনেই একই প্রকৃতির – ট্রাস্ট মি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিতাম তোমাদের।”
“কিচ্ছু বলিনি সেবার। চুপচাপ মেনে নিয়েছিলাম সবটা। নওশীনের অনুরোধে তোমাকেও জানতে দিইনি এই ঘটনা এতবছর। যে মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখলাম, তাকে বিয়ে করে তুমি হয়ে গেল আইডিয়াল হাসবেন্ড! মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার হাতে গড়া ইন্ডাস্ট্রি একটু একটু করে যখন নিজের হাতে মুঠোয় নিতে শুরু করলে, তখনই বুঝলাম অনেক হয়েছে। তোমাকে আর প্রশয় দেওয়ার কোনো অর্থ নেই।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমাকে প্রশয় দেওয়া বা না দেওয়ার দায়িত্ব কে দিয়েছে তোমাকে?”
শাফকাত থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো আরশাদের দিকে। আরশাদ সেই দৃষ্টির ধার না ধেরে বলল, “ইন্ডাস্ট্রি তোমার একার না। তোমার জন্মেরও আগে থেকে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। অবদান রেখেছো ঠিক আছে। যোগ্যতা থাকলে আরও অবদান রেখে দেখাও।”
শাফকাত সতর্কতার সুরে বলল, “আমার যোগ্যতা তোমার কল্পনারও বাইরে।”
আরশাদ হেঁয়ালির সুরে বলল, “তাই না-কি? কাজে লাগলো তথ্যটা।”
“তোমার উড়ে বেড়ানোর দিন শেষ আরশাদ হক। এখন থেকে শুধুই পতনের মুখোমুখি হবে। তোমার অভিনয়ের ক্যারিয়ারও শেষ, প্রোডাকশন হাউজও শেষ। আমি চাইলে সব করতে পারি।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “ক্ষমতার গরম কাকে দেখাচ্ছো তুমি? আমি চাইলে ঠিক এই মুহূর্তে নরক বানিয়ে দিতে পারি তোমার জীবনটা।”
“পারবে না। আমার কিছুই করতে পারবে না তুমি। কোনো প্রমাণই নেই আমার বিরুদ্ধে।”
“এই কেসে এমনিতেও জড়াবো না তোমাকে। কুকীর্তি তো মাশাল্লাহ কম করোনি জীবনে। শুধু দেখো, নিজের কুকীর্তি কীভাবে নিজেই তোমাকে শেষ করে দেয়।”
শাফকাত যেন কিছুটা দমে গেল। আরশাদ হককে বিন্দুমাত্র ভরসা নেই তার।
দমে যাওয়া কণ্ঠে বলল, “কী করবে তুমি?”
আরশাদ ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির আভা ফুটিয়ে তুলে বলল, “শাফকাত আলম, ধ্বংস করে ছাড়বো তোমাকে আমি।”
উত্তপ্ত কথপোকথনে শাফকাতের বিগড়ে যাওয়া মস্তিষ্ক আরও প্রবলভাবে বিগড়ে গেল। গলফে মনোনিবেশ করার মতো অবস্থায় আর তা রইলো না। গলফ কোর্স থেকে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওনা দিলো সে।
বাড়িতে পা রাখতেই সবার আগে চোখে পড়লো বসার ঘরে সাবা, আতিয়া আলম আর শামার উদ্বিগ্ন মুখগুলো। বিভ্রান্তি গায়ে মেখেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো শাফকাত। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলো সাবা। দুশ্চিন্তার আর উদ্বেগের ছায়া তার চোখেমুখে স্পষ্ট।
“কোথায় ছিলে তুমি শাফকাত?”
সাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শাফকাত বলল, “কী হয়েছে?”
তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী শাফকাতের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না, বাড়ির সকলের আকস্মিক এই উদ্বেগের কারণ কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
সাবা কিছুই বলল না। কেবল ইশারায় টিভির দিকে তাকাতে বলল শাফকাতকে। সাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে টিভির দিকে তাকালো শাফকাত।
শিরোনামে ভেসে উঠছে, “সিনব্লাস্ট মিডিয়ায় অপকর্ম ফাঁস। যেকোনো সময় সিইও হতে পারে গ্রেফতার।”
(চলবে)
#লেবু
৫৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
দুহাতে মাথার দুপাশ চেপে বসে আছে সাবা। পা দুটো তার থরথর করে কাঁপছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন ব্যস্ত স্বরে ফোনালাপ সারছে শাফকাত। সেদিকে অবশ্য কর্ণপাত করছে না সাবা। তার সমস্ত মনোযোগ টিভি থেকে ভেসে আসা সংবাদের শিরোনামে।
এই মুহূর্তের শীর্ষ খবর, সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার সিইও রাশেদ সাহেবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কুকীর্তি ফাঁস হওয়ার পর থেকে অভিযোগের সব তীর তার ওপরেই এসে পড়েছে।
গলা শুকিয়ে গেল সাবার। টেবিলের ওপরে থাকা পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে নিমিষেই গ্লাস ফাঁকা করে ফেলল। তবুও তৃষ্ণা মিটছে না। সাবা জানে তার ভয় পাওয়ার কোনোই কারণ নেই। সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার এসব অনিয়ম সমদ্ধে কিছুই জানা ছিল না শাফকাতের। আর জানা থাকলেই বা কী? শাফকাত তো সেই কবেই চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে এসেছে। ভয়ের কোনো কারণ না থাকলেও ভয়ে হাড় হীম হয়ে আসছে সাবার।
ফোনালাপ সেরে সাবার পাশে এসে বসলো শাফকাত। সাবা তার কাঁধে মাথা রাখতেই বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে শাফকাত।
সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “আমার খুব ভয় করছে শাফকাত।”
শাফকাত আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “ভয় কোনো কারণ নেই তো। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো তুমি।”
সাবা ঢোক গিলে বলল, “সত্যিই কি ভয়ের কোনো কারণ নেই?”
শাফকাত সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, “না নেই।”
সাবা অতিষ্ট গলায় বলল, “তুমি কেন আরশাদ হকের এত বড় ক্ষতি করতে গেলে বলো তো? সে কি এত সহজে ছেড়ে থামবে?”
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “যা হওয়ার হয়ে গেছে। অতীত নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই। তুমি শুধু শুধু টেনশন করে শরীর খারাপ কোরো না তো লেবু।”
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাবা। শুধু শুধু টেনশন সে করছে না। শাফকাত আরশাদের সঙ্গে যা করেছে তাতে ভয়ের যথেষ্ট কারণই রয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে ভয়ানক একটা ঝড় ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। সেই ঝড়ের তীব্রতা এতটাই প্রবল যে তা শাফকাতকে তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
এক জীবনে আর কতবার সংকটের মুখোমুখি হতে হবে সাবাকে? ভাইয়াকে হারানোর যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠে মেয়েটা সবে যখন সুখময় জীবনে পা রাখলো, ঠিক তখনি ভিন্ন জাতের যন্ত্রণা এসে কড়া নাড়ছে তার জীবনে।
শাফকাত অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “আমার ওপর তোমার অনেক রাগ তাই না লেবু?”
সাবা শাফকাতের বুকের ওপর থেকে মাথা তুলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “রাগ থাকবে কেন?”
“এই যে আমি তোমার প্রিয় সুপারস্টারকে এত বাজে ভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করলাম।”
হাজার দুশ্চিন্তার মাঝেও মলিনভাবে হেসে উঠলো সাবা। হাসির রেশ ঠোঁটের মাঝে ধরে রেখেই সে বলল, “তা অবশ্য আছে। তবে মানুষটা আমার প্রিয় সুপারস্টার না হয়ে অন্য কেউ হলেও একই ভাবে রাগ হতো।”
শাফকাত ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ তো দেখছি না। আগের সাবা হলে এতক্ষণে কত কড়া কড়া কথা যে আমাকে শুনিয়ে দিতো, তার কোনোই হিসাব নেই।”
সাবা আবারও মলিন হাসি হেসে বলল, “দেখবে তো। এটা রাগ করার সঠিক সময় না বলে দেখতে পাচ্ছো না।”
শাফকাত হঠাৎ আনমনে বলল, “আমাকে অনেক ভালোবাসো না লেবু?”
সাবা শাফকাতের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “প্রচুর, ভীষণ, মারাত্মক!”
শাফকাত ম্লান হাসি হেসে বলল, “মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী?”
“আমি কি সত্যিই তোমার এত ভালবাসা ডিজার্ভ করি?”
“নাটক-সিনেমায় নায়ক বা নায়িকার কেউ যখন এই প্রশ্নটা করে, উত্তরে আরেকজন বলে তুমি এর থেকেও বেশি ভালোবাসা ডিজার্ভ করো। কিন্তু আমি সেটা বলবো না। কারণ আমার থেকে বেশি ভালো কেউ তোমাকে বাসতেই পারবে না।”
শাফকাত এগিয়ে এসে গাঢ় একটা চুমু খেলো সাবার কপালে। সাবাও চোখ বুজে উপভোগ ভালোবাসার মানুষটার অবাধ্য আদর। দুজনেই বুঝতে পারছে ঝড়ের পূর্বের শান্ত আবহাওয়া বইছে তাদের ওপর দিয়ে। তবে কেউই যেন নিজের কাছে স্বীকারোক্তি দিতে চাইছে না।
দরজায় টোকা পড়লো হঠাৎ। শাফকাত সাবাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল। সাবাও গেল তার পিছু পিছু। দরজা খুলতেই দেখা মিললো একজন স্টাফের। তার চোখেমুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ।
আতঙ্কিত কণ্ঠেই সে বলল, “স্যার পুলিশ এসেছে। আপনাকে খুঁজছে।”
হকচকিয়ে গিয়ে সাবা তাকালো শাফকাতের দিকে। দম নিয়ে দরজাটা ফের বন্ধ করে দিলো শাফকাত। সাবার দিকে ঘুরে এগিয়ে আসতেই সাবা ভীত গলায় বলল, “এসবের মানে কী শাফকাত? বাড়িতে পুলিশ কেন?”
শাফকাত সাবার দুই গালে দুটো হাত রেখে বলল, “আমাকে একটা প্রমিজ করবে লেবু?”
সাবার আতঙ্কের চূড়ান্ত শিখরে উঠে বলল, “আমার কথার উত্তর দাও শাফকাত।”
“আমি জানি না কেন। সত্যিই জানি না। তবে আমাকে প্রমিজ করো যাই হোক না কেন, এবার আর ভেঙে পড়বে না তুমি।”
শাফকাতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সাবা। গলা পর্যন্ত কান্না এসে আটকে গেছে। ইচ্ছা করছে বাকিটা জীবন ঠিক এভাবেই শাফকাতকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিতে।
কিন্তু তা আর হবার কোথায়? মানুষের মনে তো কত ইচ্ছাই জেগে ওঠে। সব ইচ্ছা পূরণ হবার নয়। নয় স্বপ্ন সত্যি হবার নয়। নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি একটা না একটা সময় হতেই হয় মানুষকে।
বসার ঘরে পুলিশের একটা টিম অপেক্ষা করছিল শাফকাতের জন্যে। তাকে দেখতেই তাদের প্রধান গম্ভীর গলায় জানান দিলেন, “শাফকাত আলম, আপনার গাজীপুরের একটি ফ্যাক্টরির কর্মচারী ফরিদাকে গুমের অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।”
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো সাবার। সব ধরনের ধাক্কার জন্যে প্রস্তুত ছিল সে। কিন্তু এই ধাক্কাটা যেন একেবারেই অপ্রত্যাশিত। সাবা তো ভেবেছিল সিনেব্লাস্টের ব্যাপারেই কথা বলতে পুলিশ এসেছে। কিন্তু গুম? শাফকাত একটা মেয়েকে গুম করেছে?
শাফকাতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সাবা। এতদিনে ছেলেটার চোখ পড়তে শিখে গেছে সাবা। তার বিস্মিত চোখদুটো বলছে, এই অভিযোগ সাবার কাছে যতটুকু অপ্রত্যাশিত, ততটুকু তার কাছেও।
শাফকাতকে হ্যান্ডকাফ পড়ানোর আগে এক মুহূর্তের জন্যে চোখাচোখি হলো দুজনের। দৃঢ় দৃষ্টিতেই সাবা জানান দিচ্ছে, “আমি তোমার প্রমিজ রাখবো শাফকাত। ভেঙে পড়বো না কিছুতেই।”
•
পুলিশ স্টেশনের বাইরে উৎসুক জনতা আর মিডিয়ার ঢল। দেশের সবথেকে বড় বিজনেস টাইকুন শাফকাত আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাও আবার নারী কেলেঙ্কারির। সাংবাদিকরা ব্যস্ত রসালো শিরোনামে রিপোর্ট করতে, আর উৎসুক জনতা নিজেদের মধ্যেই তদন্ত করে রায় জানাতে।
ভীড় ঠেলে কোনমতে পুলিশ স্টেশনে এসে পৌঁছালো সাবা। হাঁপাচ্ছে সে রীতিমত। অপারেশনের পর আজই প্রথম এতটা দৌড়ঝাঁপ করলো সে। তবুও শ্বাসকষ্টের ধার না ধেরে সাবা সোজা পা বাড়ালো ওসি সাহেবের টেবিলের দিকে।
ওসি সাহেব আয়েশি ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একজন কনস্টেবলের সঙ্গে খোশগল্পে মত্ত। সাবা ঝড়ের গতিতে তার সামনে দিয়ে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ম গলায় বলল, “শাফকাতকে কোন অভিযোগের ভিত্তিকে অ্যারেস্ট করা হলো? কে মামলা করেছে তার নামে?”
সাবার আকস্মিক আগমনে ওসি সাহেব কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি কে?”
সাবা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “আমি শাফকাত আলমের ওয়াইফ।”
ওসি সাহেব তার পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কী করো তোমরা? কতবার বলেছ এসব বাড়ির লোকদের আমার কাছে আসতে দেবে না। এদের সাথে আমি কথা বলি কখনো?”
সাবা অগ্নিকণ্ঠে বলল, “বাড়ির লোকেরা সঙ্গে কথা বলেন না তাই না?”
ওসি সাহেবকে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই পকেট থেকে আইডি কার্ডটা বের করে সশব্দে টেবিলের ওপর রেখে বলল, “সাংবাদিকের সঙ্গে নিশ্চয়ই বলেন। সাবা আমির, ক্রাইম রিপোর্টার, বাংলার বাতাস।”
এবার নড়চড়ে বসলেন ওসি সাহেব। দুশ্চিন্তার একটা হাসি হেসে বললেন, “আরে ম্যাডাম আপনি তো রেগে যাচ্ছেন। বসুন, বসুন।”
সাবা ওসি সাহেবের বিপরীতে থাকা চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল, “কে মামলা করেছে?”
“দেখুন ম্যাডাম অফিসিয়ালি কিছুই বলতে পারছি না। অফিসিয়ালি বলছি, আপনিও একটু দেখবেন যেন টিভিতে না যায়…”
“আপনি বলবেন?”
ওসি সাহেব নিচু গলায় বললেন, “মামলা ওই মেয়ের বাবা-মাই করেছে।”
সাবা ব্যস্ত গলায় বলল, “কবে?”
“প্রায় মাস খানেক আগে।”
“তাহলে এখন ওকে কীসের ভিত্তিতে অ্যারেস্ট করা হলো?”
“আজ সকালে আমাদের কাছে একটা ছেলে আসে। রাব্বি নাম। আপনার হাসবেন্ডের একটা ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। সে নিজেই এসে সব স্বীকার করলো। আপনার হাসবেন্ডের নির্দেশেই না-কি মেয়েটাকে কিডন্যাপ করেছিল।”
সাবা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “একজন এসে আপনাদের কাছে যা খুশি তাই বলবে, আর আপনারা সেটা বিশ্বাস করে আরেকজনকে অ্যারেস্ট করতে চলে যাবেন?”
ওসি সাহেব অসহায় হাসি হেসে বললেন, “দেখুন ম্যাডাম, যে এসেছে সে ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। আপনার হাসবেন্ড ফ্যাক্টরির মালিক। একজন কর্মচারী নিশ্চয়ই তার মালিকের নামে বানিয়ে বানিয়ে এত বড় অভিযোগ করবে না।”
“কিন্তু শাফকাত যে মেয়েটাকে কিডন্যাপ করিয়েছে, এর কোনো প্রমাণই তো নেই।”
“প্রমাণের হিসাব কোর্টে হবে। আপনি দয়া করে উঠুন এবার। সাংবাদিককে এই মুহূর্তে এতকিছু জানানো আমার প্রটোকলের বাইরে।”
সাবা মলিন কণ্ঠে বলল, “শাফকাতের সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে?”
“এখন না ম্যাডাম। সময় হলে আমরাই জানাবো।”
উঠে দাঁড়ালো সাবা। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। কী করবে এবার সে? কী করে এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠবে?
(চলবে)