#লেবু
৫৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
বনানী থানার সামনে উৎসুক জনতার ভীড় তো কমছেই না, বরং বেলা বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে চলছে ক্রমশ। সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্লাস আর উৎসুক জনতার চেঁচামেচিতে মাথা ধরে গেছে সাবার। মাথার দুপাশের রগ দপদপ করে জ্বলছে। শাফকাত কেমন অবস্থায় আছে, কল্পনায় ফুটে উঠতেই গা গুলিয়ে যাচ্ছে।
অরুণ খবর পেয়েই ছুটে এসেছে থানায়। তাকে নিয়ে কিছুটা দূরেই একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে। এসির হিমশীতল হওয়ার মাঝেও দরদর করে ঘামছে সাবা। নিঃশ্বাস ফেলতে যে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে, তা তার চোখেমুখেই স্পষ্ট।
অরুণ সাবার কাঁধে হাত রেখে বলল, “শান্ত হ
সাবা। স্ট্রেস তোর শরীরের জন্যে ভালো না।”
দুটো গুলি লাগার পরও যে মেয়েটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে এটাই অনেক। এমনিতেই তার বহুদিনের শ্বাসকষ্টের সমস্যা। তার ওপরে আবার ফুসফুসের অতটা কাছ থেকে একটা গুলি চলে গিয়েছিল, ডক্টর বারবার বলে দিয়েছেন মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকতে। স্ট্রেস নিলেই সাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। এই শ্বাসকষ্ট তার শরীরকে আবারও দূর্বল করে ফেলবে।
সাবার চোখেমুখের বিধ্বস্ত দশা। এলোমেলো চুলগুলো কপালের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কাজল চোখের জল সাথে মিশে দুই গালের ওপর সরু কালো রেখা বসিয়ে দিয়েছে।
সাবা ধৈর্যহারা কণ্ঠে বলল, “কী বলছিস অরুণ? তুই নিজেও বুঝতে পারছিস কী বলছিস? শাফকাত জেলে, আমি জানিও না ঠিক কী কারণে ওকে অ্যারেস্ট করা হলো। আর তুই আমাকে বলছিস শান্ত হতে?”
অরুণ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শুকনো গলায় বলল, “জানিস তো। একটা মেয়েকে গুম করার জন্যে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।”
সাবা জোর গলায় বলল, “কিন্তু এটা আমি বিশ্বাস করি না। কিছুতেই না।”
“আমিও বিশ্বাস করছিলাম না। কিন্তু শাফকাত ভাইয়া আরশাদ হকের সঙ্গে যা করেছে তা
জানার পর থেকে বিশ্বাসটা ভেঙে গেছে।”
অরুণ আজ সকাল থেকে সাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভূমিকাই পালন করছিল। সাবার সাথে সেও বিশ্বাস করছিল, নির্ঘাত শাফকাতের গ্রেফতারের পেছনে তার প্রগাঢ় ষড়যন্ত্র জড়িয়ে আছে। তবে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায় আরশাদের সঙ্গে করা শাফকাতের নিষ্ঠুরতার গল্প শোনার পর থেকে।
একটা মানুষ তার থেকে বেশি সফল হয়েছে বলেই সারা দেশের সামনে তাকে অপদস্ত করতে হবে? তার ইমেইজ নষ্ট করতে হবে? আরশাদের প্রোডাকশন হাউজ কে ফিল্মস শাফকাতের প্রোডাকশন হাউজ সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার তুলনায় বেশি সফলতা পেয়েছে বলেই তাকে অন্যায়ভাবে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামানোর ষড়যন্ত্র লিখেছে শাফকাত। কোন এক নায়িকার সঙ্গে তার নকল অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কোনো ভালো মানুষ করতে পারে এমন কাজ?
সাবা থেমে থেমে বলল, “তার মানে তোর ধারণা শাফকাত সত্যিই এই কাজটা করেছে।”
“হুঁ। তোর কেন বিশ্বাস হচ্ছে না কে জানে!”
সাবা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “কারণ আমি ওকে খুব ভালো করে চিনি অরুণ। আরশাদ হকের সাথে ও যে কাজটা করেছে সেটা একদমই ঠিক হয়নি, আমি মানছি। রাগের মাথায় ও প্রায়ই এমন কাজ করে। কিন্তু যে অভিযোগ ওকে অ্যারেস্ট করা হলো, সেটা তো ছোটখাটো কোনো অভিযোগ নয়। গুরুতর ক্রাইম। শাফকাত এমনটা করতেই পারে না।”
অরুণ খানিকক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বলল, “শাফকাত ভাইয়ার ফ্যাক্টরির ম্যানেজার নিজে এসে স্বীকার করেছে, ওই মেয়েটাকে তার নির্দেশেই গুম করা হয়েছিল।”
সাবা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি!”
অরুণের এবার একটু খারাপই লাগলো প্রিয় বান্ধবীর জন্যে। জীবনে যতবার বিপদের সম্মুখীন হয়েছে ততবার এই মেয়েটাই তাকে পথ দেখিয়েছে। দৃঢ় ভঙ্গিতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার। তার পক্ষেই লড়ে গেছে আশেপাশের সকলের সঙ্গে। তবে তার সংকটময় মুহূর্তে অরুণ কেন পিছিয়ে যাবে।
অরুণ কী যেন ভেবে পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “দেখ সাবা, ওই মেয়েটা এতদিন ধরে নিখোঁজ। কোনোভাবে ওকে খুঁজে পেলে তবেই কোর্ট বিশ্বাস করবে, ওর গুমের পেছনে শাফকাত ভাইয়ার হাত নেই। তার আগ পর্যন্ত সেই কিন্তু একমাত্র অভিযুক্ত।”
দুশ্চিন্তায় মাঝে হঠাৎ যেন আশার আলো দেখলো সাবা। আসলেই তো, এতসব ঘটনায় কেন্দ্রে তো ওই মেয়েটাই রয়েছে। যাকে শাফকাত গুম করেনি, কিন্তু সে নিখোঁজ। কোনো ক্রমে মেয়েটাকে খুঁজে বের করে কোর্টে হাজির করতে পারলেই তো প্রমাণিত হয়ে যাবে শাফকাত তাকে গুম করেনি।
আচমকা শীতল একটা হাওয়া বয়ে গেল সাবার গা বেয়ে। মেয়েটাকে যদি আর খুঁজে না পাওয়া যায়? তবে তাকে কি করে কোর্টে হাজির করবে সাবা? কী করে প্রমাণ করবে যে শাফকাত নির্দোষ?
মানুষের সুসময়ে তার আশেপাশে অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীকে দেখা যায়। প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের পরামর্শও পাওয়া যায়। তবে মানুষ যখন খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যায়, তখনই বেরিয়ে আসে এসব মানুষের প্রকৃত চেহারা।
এত এত গণ্যমান্য, প্রভাবশালীদের সাথে শাফকাতের চেনাজানা। অথচ আজ সকালে তার গ্রেফতারের পর থেকে সকলেই পালন করছে নীরব দর্শকের ভূমিকা।
শাফকাতের সঙ্গে দেখা করার জন্যে সাবা বিকেল পর্যন্ত থানায় বসে রইলো। তার দিকটা শোনার প্রয়োজন আজ সবথেকে বেশি। ইতোমধ্যেই গণমাধ্যম নিজেদের মতো করে যুক্তি দাঁড়িয়ে মনগড়া শিরোনামে নিউজ করতে শুরু করেছে। প্রকৃত সত্যটা কেউই জানতে পারছে না। তা জানা কেবলই শাফকাতের।
পাঁচটার দিকে শাফকাতের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মিললো ওসি সাহেবের কাছ থেকে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সময়ে হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠলো সাবার হৃদয়টা। আজ সারাদিন ধরে ছেলেটাকে দেখার জন্যে ছটফট করছে সে, তবে অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছা করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। লকআপের ভেতরে বন্দী অবস্থায় কি করে দেখবে সে শাফকাতকে? বুকের ভেতরটা ছারখার করে দেওয়া দৃশ্যগুলো কেন বারবার তাকেই দেখতে হয়?
লকআপের জায়গা কেমন গুমোট-অন্ধকারাচ্ছন্ন। চারিদিকে তামাটে একটা গন্ধ। একেকটা পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে সাবার হৃদস্পন্দন। শাফকাতের লকআপের সামনে থমকে দাঁড়ালো সাবা।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা কনস্টেবল ভাবলেশহীন কণ্ঠে “বেশি সময় নেওয়া যাবে না।” বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল।
জেলখানার লোহার শিক শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সাবা। ভেতরে একটা মাটির বেঞ্চের ওপর বসে আছে শাফকাত। তার হাতদুটো মাথার দুপাশে চেপে ধরা। চোখদুটো বুজে রাখা। যে মানুষটা সবসময় নিজের চারপাশে অদৃশ্য একটা আধিপত্য ছড়িয়ে বেড়ায়, যাকে দেখলেই সকলের মাঝে সুপ্ত একটা ভয় কাজ করছে – সেই মানুষটাকে দেখে আজ মনে হচ্ছে জীবনে সে পরাজিত।
দৃশ্যটা সাবার বুকের মাঝে হাহাকার সৃষ্টি করলো। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শক্ত রাখলো সাবা। জীবনে বহুবার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সে। প্রত্যেকবারই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কিন্তু এবার কিছুতেই ভেঙে পড়তে দেবে না নিজেকে। শক্ত হাতে সামাল দেবে পরিস্থিতির।
সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো, “শাফকাত!”
শাফকাত মাথা তুলে তাকালো। লকআপের ক্ষীণ আলোর মাঝেও তার বিস্মিত চোখদুটো দেখতে মোটেও অসুবিধা হলো না সাবার। আরেকদফা মোচড় দিয়ে উঠলো তার বুকের ভেতরটা। নিজেকে সামলে রাখার হাজার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। সরু অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়লো তার দুচোখ বেয়ে।
শাফকাত ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এল লোহার শিকের কাছে।
সাবার হাতের ওপর নিজের হাতটা রেখে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “সাবা! তুমি এখানে কী করছো?”
সাবা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ছুঁড়ে দিলো ভিন্ন এক প্রশ্ন, “মেয়েটা কোথায় শাফকাত?”
তার এই প্রশ্নের জবাবও শাফকাত দিলো না। বরাবরের মতো নির্দেশের সুরে বলল, “তুমি এক্ষনি বাসায় চলে যাবে। আমি তোমাকে এখানে দেখতে চাই না।”
সাবা অস্থির কণ্ঠে বলল, “আমিও তোমাকে এখানে দেখতে চাই না শাফকাত!”
আবারও সাবার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অবাধ্য অশ্রুধারা। নিজের হাতের পিঠে চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নিলো সাবা।
ধৈর্যহারা কণ্ঠে বলল, “মেয়েটা কোথায়?”
শাফকাত ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমি জানি না।”
“সত্যি করে বলো প্লিজ।”
“সত্যি বলছি। আমাকে বিশ্বাস করো না?”
সাবা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “করি তো। তোমার ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ছেলেটা, কী যেন নাম!”
“রাব্বি।”
যে ছেলেটা শাফকাতের আশেপাশে ছায়ায় মতো ঘুরে বেড়ায়, শাফকাতের এক কথায় যে কিনা জীবন দিতে প্রস্তুত – সে কেন পুলিশের কাছে এসে তার নামে এত বড় একটা মিথ্যার স্বীকারোক্তি দিলো তাই মাথায় ঢুকছে না শাফকাতের।
সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “ও পুলিশের কাছে এসে স্বীকার করেছে তোমার নির্দেশেই না-কি মেয়েটাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন মেয়েটা কোথায় তা সে জানে না। একমাত্র তুমিই না-কি জানো।”
শাফকাত কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “রাব্বি আমাকে বলেছিল একটা মেয়ে ফ্যাক্টরির কাজ সেরে আর বাড়ি ফিরে যায়নি। পুলিশ একবার ওকে ধরেও নিয়ে গিয়েছিল। অনেক ঝামেলা করে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছিল।”
“সেই ছেলেটাই কেন এখন তোমাকে নিয়ে এত বড় একটা মিথ্যা বলল?”
“আমার মনে হয় আরশাদ ওকে বাধ্য করেছে।”
সাবা খানিক চমকে উঠে তাকালো শাফকাতের দিকে।
শাফকাত আবারও বলল, “আমি আরশাদের এত বড় একটা ক্ষতি করলাম। আমার ক্ষতি করার জন্যেই তাই রাব্বিকে জোর করে পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
আরশাদ প্রতিশোধের তাড়নায় রাব্বিকে পুলিশের কাছে পাঠালেও, শাফকাতের নামে মিথ্যা ষড়যন্ত্র লেখেনি। রাব্বির তাকে যা বলেছে, ঠিক তাই পুলিশকে বলার জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই ছেলেটা কতটা সত্যি বলছে জানে না শাফকাত ছাড়া কেউই।
সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “কিন্তু মেয়েটা তো সত্যিই নিখোঁজ তাই না?”
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “হুঁ।”
“খুঁজে বের করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
শাফকাত সতর্ক কণ্ঠে বলল, “খুঁজে বের করার মানুষ আছে। তুমি খবরদার নিজেকে এসবের মধ্যে জড়াবে না।”
বেশ অনেকটা সময় চুপ করে থেকে সাবা আর্দ্র গলায় বলল, “আমি সবসময় তোমার কথার অবাধ্য হই তাই না? বিয়ের পর থেকে তুমি যা যা বলেছো, তার এক্সজ্যাক্ট অপজিট কাজগুলো করেছি। এই শেষ, প্রমিজ! শেষবারের মতো তোমার কথার অবাধ্য হবো। এরপর থেকে তুমি যা যা বলবে, ঠিক তাই তাই করবো।”
শাফকাত মৃদু কড়া গলায় বলল, “লেবু না।”
সাবা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “I’m sorry. আমাকে এই কাজটা করতেই হবে।”
ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাফকাত। সে যতটা কড়া তার লেবু ঠিক ততটাই জেদি। একবার যখন ঠিক করেছে ওই মেয়েটাকে খুঁজে বের করবে, তখন খুঁজেই দম নেবে। তাকে আটকানোর সাধ্য আর কারো নেই।
সাবা লোহার শিকের মধ্য দিয়ে হাত বাড়িয়ে শাফকাতের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি শাফকাত। তোমাকে পৃথিবীর আর কেউ বিশ্বাস না করলেও আমি করি।”
হাজারো অস্থিরতার মাঝে হঠাৎ আশার ক্ষীণ আলো দেখতে পেলো শাফকাত। সেই আলোয় ঝলমল করছে সাবার চোখদুটো। সেই আলো জানান দিচ্ছে প্রগাঢ় ভালোবাসা আর একরাশ আস্থার।
•
মেয়েটার নাম যূথী। বয়স বাইশ-তেইশ বছর। বছর খানেক হলো শাফকাতের ফ্যাক্টরিতে। কাজ করছে। ফ্যাক্টরির কাছেই একটা ভাড়া বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। সেদিন কাজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। কাজেও এসেছিল। তবে কাজ শেষে ফ্যাক্টরির বাইরে তাকে কেউ দেখেনি। শাফকাত গ্রেফতার হওয়ার একদিন পেরিয়ে গেলেও। এর থেকে বেশি তথ্য জানতে পারলো না সাবা।
রাব্বির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, সেদিন কাজ শেষে শাফকাতের নির্দেশে মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে কাছেই একটা গুদামে বন্দী করে রাখে। পরদিন আর ওই গুদামে মেয়েটাকে দেখেনি সে। শাফকাত তাকে কোথায় পাঠিয়েছে তাও তার জানা নেই। পুলিশ এখন মেয়েটার অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্যে শাফকাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
সাবার মন বারবার বলছে হয় রাব্বি এই মেয়েটাকে লুকিয়ে রেখে শাফকাতের ঘাড়ে সব দোষ চাপাচ্ছে, না হয় মেয়েটাই নিজেই রাব্বির সঙ্গে হাত মিলিয়ে শাফকাতকে ফাঁসানোর জন্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু দুটো কারণের একটাও সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। রাব্বি শাফকাতের বহুদিনের বিশ্বস্ত। এই ছেলেটা কেন শুধু শুধু তার বিরুদ্ধে গিয়ে এমন ভয়ঙ্কর কাজ করবে? তাছাড়া সামান্য এক ফ্যাক্টরির কর্মচারীও বা কেন এতটা তীব্র রাগ পুষে রাখবে শাফকাতের প্রতি?
দিনভর দৌড়ঝাঁপ করতে হলো সাবাকে। শাফকাতের মামলা কাল কোর্টে উঠছে। প্রথমদিনেই তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করবেন। তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপে বসতে হলো। গাজীপুরের সেই ফ্যাক্টরির কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করলো সাবা। সেখান থেকেই যূথীর ব্যাপারে তথ্যগুলো পেয়েছে সে।
কাল শাফকাতের জামিন মঞ্জুর হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। বুকের পাথর চাপার মতো সত্যটা মেনে নিয়ে সাবা কাল গাজীপুর যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলল। সেখানে গিয়েই বোঝা যাবে আসল পরিস্থিতি।
বিকেলের পর সাবা বাড়ি ফিরলো ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত হয়ে। ক্লান্তি শেষেও বিন্দুমাত্র স্বস্তি নেই। মনটা তো আগে ঠিকই বিক্ষিপ্ত, তার ওপরে আবার বিক্ষিপ্ততায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে আতিয়া আলমের অসুস্থতা। অকস্মাৎ ছেলেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারেননি। একদিনেই ভেঙে পড়েছেন। ব্লাড প্রেশার কমে গিয়ে এখন তার একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থা। সাবা বাড়ি ফেরার পর থেকে রাত নয়টা অবধি যত্ন নিলো শ্বাশুড়ি মায়ের।
আতিয়া আলম ঘুমিয়ে পড়লে সাবা ফিরে এলো নিজেদের ঘরে। এই ঘরটায় তো আজ তার সঙ্গে আরও একটা মানুষের থাকার কথা ছিল। যে মানুষটা আজ তার পাশে নেই। লক আপে এই মূহূর্তে কী অবস্থায় আছে ভাবতেই সাবার সবগুলো হাড় হিম হয়ে গেল। হৃদয়টা যেন পুড়ে ঝারখার হয়ে গেল নিমিষেই।
হঠাৎ সাবার সংবিৎ ফিরলো দরজার টোকায়।দুচোখের জল মুছে উঠে গিয়ে সাবা দরজা খুলে দিলো। বাইরে শামা দাঁড়িয়ে আছে।
শামা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল, “ভাবি তুমি ঠিক আছো?”
সাবা মলিন হাসি হেসে বলল, “ঠিক থাকার অবস্থায় কি আমরা কেউ আছি শামা?”
শামা ভাবির হাত ধরে বলল, “ভাবি তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে। তুমি যদি নিজের দিকে খেয়াল না রাখো, তাহলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি অসুস্থ হলে চারিদিকে এত ছোটাছুটি কে করবে? ওষুধগুলোও নিশ্চয়ই ঠিকমতো খাচ্ছো না?”
সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তোমার ভাইয়া প্রতি দুপুরে আমাকে ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। আর রাতে নিজেই প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে ওষুধ আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। কাল থেকে কেউ মনে করিয়েও দেয়নি, আমার ওষুধ খাওয়াও হয়নি।”
কথাগুলো বলতে বলতেই সাবার গলা জড়িয়ে এলো। দুচোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অবাধ্য অশ্রুধারা। সাবা বিছানার ওপর বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
শামার চোখেও জল চলে এলো। তবুও বহুকষ্টে নিজেকে সামলে ভাবির পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরলো শামা।
আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “তুমি চিন্তা কোরো না ভাবি। ভাইয়া দ্রুতই চলে আসবে।”
অনেকটা সময় নিঃশব্দে চোখের জল ফেলল দুজনে। অবশেষে সাবাকে শান্ত করে শামা উঠে গিয়ে তার ওষুধগুলো নিয়ে এলো। হাজার জোরাজুরির পর সক্ষম হলো তাকে ওষুধগুলো খাওয়াতে।
শামা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “ভাবি তোমার গায়ে তো জ্বর!”
সাবা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “ওসব কিছু না।”
“কী বলছো ভাবি? ডক্টর তো তোমাকে সামান্য জ্বর হলেও তার কাছে যেতে বলেছে।”
সাবা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এখন আমি ডক্টর দেখানোর মতো অবস্থায় নেই শামা।”
শামা জোর গলায় বলল, “আমি এতক্ষণ কী বোঝালাম তোমাকে? সবকিছু ঠিক করে দিতে হলে আগে তো তোমার নিজেকে ঠিক থাকতে হবে। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে কে ভাইয়াকে নির্দোষ প্রমাণ করবে?”
সাবার হাজার বারণ সত্ত্বেও শামা ডায়াল করলো ডক্টর আফরোজার নম্বরে। তিনি চেম্বারেই আছেন। সাবাকে চেকআপের জন্যে নিয়ে গেলেই দেখা মিলবে তার। শামার জোরাজুরিতেই ডক্টর দেখাতে এত রাতে বাইরে যেতে রাজি হলো সাবা। জ্বরের সঙ্গে কাল থেকে তার মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। দীর্ঘদিন এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো অবহেলা করলে দেখা যাবে সত্যিই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে সাবা।
ডক্টর আফরোজা সাবার চেকআপ করলে। কতগুলো টেস্টও দিলেন। ইমার্জেন্সীতে টেস্ট করিয়ে এক ঘন্টার মধ্যেই রিপোর্ট পাওয়া গেল।
রিপোর্টগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডক্টর আফরোজা মিষ্টি একটা হাসি হেসে বললেন, “Congratulations Saba, you’re pregnant.”
সাবার নিঃশ্বাস আটকে গেল। যে সংবাদটা একটা মেয়ের সারা পৃথিবীতে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়, সেই সংবাদে বিন্দুমাত্র খুশি হতে পারলো না। বরং কান্নারা দলা পাকিয়ে গেল গলায়। এই আনন্দ তো তার একার নয়। আনন্দের ভাগিদার তো তার পাশেই নেই। একা একা কী করে খুশি হবে সাবা?
(চলবে)
#লেবু
৫৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
গাড়ির ব্যাকসিটে গা এলিয়ে বসে আছে সাবা।জানালা বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে এসে উড়িয়ে দিচ্ছে তার রুক্ষ চুলগুলোকে। শূন্য দৃষ্টিতে সাবা তাকিয়ে রইলো জানালার বাইরে বিস্তৃত ধানক্ষেতের দিকে। তার ধারণাই সত্যি হলো। শাফকাতকে জামিন দেওয়া হয়নি। তবে পুলিশের রিমান্ডের আবেদনও মঞ্জুর করা হয়নি। আদালত শাফকাতকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে।
একেকটা নিঃশ্বাস ফেলতে প্রবল কষ্ট হচ্ছে সাবার। মনে হচ্ছে কোনো অদৃশ্য মানব যেন অদৃশ্য পাথর চেপে ধরে রেখেছে তার বুকের ওপর। বিধ্বস্ত জীবনটাকে একটু একটু করে যখন সাজাতে শুরু করেছিল সাবা, ঠিক তখনই প্রলয়ঙ্করী ঝড় এসে আবারও এলোমেলো করে দিলো সবটা।
অরুণ সাবার পাশের সিটেই বসে আছে। সামনের সিটে ড্রাইভার আর সাবার বডিগার্ড জহুরুল। অরুণের উদ্বিগ্ন চোখদুটো সাবার দিকেই আটকে আছে। যথেষ্ট সাহসী মেয়ে সে। তবে জীবনে সংকটের কালো ছায়া নেমে এলেই যেন সেই সাহসী মেয়েটা মুষড়ে পড়ে যায়, ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়।
অরুণ চিন্তিত গলায় বলল, “এই অবস্থায় তোর ছোটাছুটি করে বেড়ানো একদমই ঠিক হচ্ছে না সাবা।”
সাবা মলিন কণ্ঠে বলল, “হচ্ছে। তাছাড়া এখন তো আমি একা না। আরও একজন শাফকাতের জন্যে অপেক্ষা করছে। তার জন্যে হলেও মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
আনমনে পেটের ওপর একটা হাত রাখলো সাবা। অন্যরকম গা শিরশিরে একটা হাওয়া বয়ে গেল তার গা বেয়ে। ভাবতেই অবাক লাগে তার শরীরের মাঝেই না-কি একটু একটু করে বেড়ে উঠছে ছোট্ট একটা প্রাণ। এই মানুষটা এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল? লুকিয়ে ছিল শাফকাত আর তার ভালোবাসার মাঝে।
আচ্ছা শাফকাত যখন জানতে পারবে সে বাবা হতে চলেছে, তখন তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? সে কি খুশি হবে? না-কি রেগে যাবে? না, না! রেগে যাবে কেন? নির্ঘাত খুশিতে আত্মহারা হয়ে সাবাকে জড়িয়ে ধরবে।
শাফকাতের প্রক্রিয়ার কল্পিত দৃশ্য কল্পনায় ভেসে উঠতে নিজেই অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো সাবার ঠোঁটে। ছেলেটা যেদিন বাড়ি ফিরবে, সেদিনই তাকে খবরটা দেবে বলে ঠিক করে রেখেছে সাবা। হঠাৎ সংশয়ের ঝড়ো হাওয়ার মোচড় দিয়ে উঠলো তার বুকের ভেতরটা। শাফকাত যদি দ্রুত বাড়ি ফেরার সুযোগ না পায়?
মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলল সাবা। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চাইছে, আগামী সপ্তাহে আদালতের পরবর্তী শুনানিতে যূথী নামের মেয়েটাকে হাজির করতে পারবে সে।
পুলিশ যদিও যূথীকে খুঁজে বের করার ওপর জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তবুও তাদের ওপর ভরসা করে উঠতে পারছে না সাবা। তাদের ধারণা একমাত্র শাফকাতই জানে যূথীর প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে, তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদেই অধিক জোর দিচ্ছে তারা।
তার ওপরে বাদীপক্ষের আইনজীবী আজ আদালতে এমন সব উদ্ভট যুক্তি দিয়েছেন, তাতে যে কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য শাফকাত আলম একজন খারাপ মানুষ আর যূথীর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে একমাত্র ভূমিকা তারই। বাদীপক্ষের আইনজীবীর একটা যুক্তি হলো, শাফকাত আন্তর্জাতিক মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসার খাতিরে বড় বড় মাফিয়াদের খুশি করতেই ওই মেয়েটাকে পাচার চক্রের হাতে তুলে দিয়েছে। আবার আরেকটা যুক্তি হলো, যূথী শাফকাতের ব্যাপারে এমন একটা সত্যি জেনে গিয়েছে যা জনসাধারণের সামনে এলে তার ইমেজ সংকটে পড়ে যাবে। তাই শাফকাত তার ফ্যাক্টরির ম্যানেজারকে দিয়ে প্রথমে মেয়েটাকে কিডন্যাপ করিয়েছে। পরবর্তীতে ঠান্ডা মাথায় খু/ন করেছে।
সেসব যুক্তি শুনে সাবার গা গুলিয়ে উঠলেও, সে জানে পুলিশও এসব যুক্তিই বিশ্বাস করছে। মেয়েটা যে নিজ থেকেও আত্মগোপনে থাকতে পারে – এমন দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে খোঁজার চেষ্টা করছে না।
গাজীপুরে পা রাখতেই সাবার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। এই জায়গাতেই তো শাফকাতের সঙ্গে ঘুরতে এসেছিল সে, মুখোমুখি হয়েছিল জীবনের সবথেকে বড় জাদুময় দিনটায়। এই জায়গাটাই তো তার জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল চিরতরে। এমন পরিস্থিতিতে আবারও যে এখানে ফিরে আসতে হবে, কে জানতো?
সবার আগে যে ফ্যাক্টরিতে যূথী কাজ করতো, সেখানেই গেল সাবা। বিভিন্ন কর্মচারী আর সুপারভাইজারদের সাথে কথা বলে যূথীর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করলো। তবে নতুন কিছুই জানতে পারলো না। তারা যূথীর ব্যাপারে যেসব তথ্য দিচ্ছে, সেসব আগে থেকেই সাবার জানা।
একটা মেয়ে কেবল দিলো ভিন্ন তথ্য, “মাইয়াটা কারও সাথে মিশতো না ম্যাডাম। আমরা কথা বলতে গেলেও চুপ কইরা থাকতো। চোরের মতো কামে আসতো, আবার বিকালের দিকে চোরের মতো পালায় যাইতো।”
চুপচাপ থাকা দোষের কিছু না হলেও সাবার ক্ষীণ সন্দেহ জাগলো যূথীর এই বৈশিষ্ট্যে। যার কাছে গোপন করার মতো কিছু থাকে, সেই তো বেশির ভাগ সময় মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলে। ভুলক্রমেও যাতে মনের কথা প্রকাশ্যে চলে না আসে। এই মেয়েটারও কি তবে লুকানোর মতো কিছু ছিল?
যূথীর ফাইল থেকে সাবা জানতে পারলো, গত বছরের নভেম্বরে ফ্যাক্টরিতে চাকরিটা পেয়েছে সে। আর আগে অন্য কোথাও কাজ করতো বলে লেখা নেই। ফ্যাক্টরিতে রাব্বিই নিয়োগ দিয়েছে তাকে।
আরও একবার সন্দেহের ক্ষীণ হাওয়ায় গা ভাসালো সাবা। যে মেয়ের কাজের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাকে কীসের ভিত্তিতে চাকরিটা দিলো রাব্বি? তবে কি সাবার ধারণাই সত্যি? এই দুজনের মাঝে সত্যিই কি কোনো যোগসূত্র রয়েছে?
যূথীর বাবা-মায়ের পুলিশ স্টেশনে ঘন ঘন যাতায়াতের সুবাদে এলাকার সবার চোখে পড়ে গেছেন এতদিনে। বাজারে, রাস্তা-ঘাটে যাকে জিজ্ঞেস করা হয়, সেই এক বাক্যে বলে দেয় তাদের ঠিকানা।
ঠিকানা অনুযায়ী যূথীদের বাড়িতে পৌঁছেও গেল সাবা আর অরুণ। সারিবদ্ধভাবে দু তিনটি টিনের ঘর, সামনে উঠানের মতো সরু একটা জায়গা। সেখানেই দড়ি বেঁধে কাপড় শুকাতে দিয়েছেন বাড়ির বাসিন্দারা।
প্রথম টিনের ঘরের বাইরেই এক মাঝবয়সী মহিলাকে পাওয়া গেল। সাবা তাকে উদ্দেশ্য করে ভদ্রভাবে বলল, “খালা? যূথীদের বাড়ি কোনটা?”
ভদ্রমহিলা পান চিবুতে চিবুতে আঙুল তাক করলেন বাম দিক থেকে শেষ টিনের ঘরটার দিকে।
“ওই যে! ক্যান? ওই বাড়িতে তোমাগো কাম কী?”
সাবা উত্তর দেওয়ার আর অবকাশ পেলো না। ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেল ওই বাড়িটার দিকে। তার হয়ে অরুণ শিষ্ট গলায় বলল, “আমরা টিভি চ্যানেল থেকে এসেছি। যূথীর বাবার সাথে একটু কথা ছিল।”
সাবার ছুটে যাওয়ার কারণ, বাড়ির সামনেই সে দেখতে পেয়েছে এক বৃদ্ধ লোককে। লোকটার দু হাতে ব্যাগ ভর্তি বাজার। অদ্ভুত ব্যাপার! যার মেয়ে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ, মেয়ের মামলা কোর্টে উঠেছে – সেই মানুষটা মনের সুখে বাজার করে বেড়াচ্ছে?
সাবা লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, “চাচা! আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।”
বৃদ্ধ থতমত খেয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন সাবার দিকে। অবশেষে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আমার সাথে? আমার সাথে আবার কীসের কথা?”
“আপনার মেয়ের ব্যাপারে।”
মেয়ের কথা শুনতেই বৃদ্ধ নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
সাবা পকেট থেকে নিজের আইডি কার্ডটা বের করে বলল, “আমি বাংলার বাতাস থেকে এসেছি, আপনার মেয়ের নিউজ কভার করতে।”
যদিও কথাটা মিথ্যা। সাবা চ্যানেলের হয়ে এখানে আসেনি। এসেছে, শাফকাতের হয়ে। কিন্তু এই তথ্য এখনই বৃদ্ধকে দেওয়া যাবে না। সবার আগে তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।
তবে বৃদ্ধ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না সাবাকে। ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, “আমি কিছু বলতে পারবো না। যা বলার পুলিশরে বলে আসছি। কিছু জানতে হইলে তাদের জিগান।”
সাবার বৃদ্ধের পিছু নিয়ে বলল, “চুপ করে থাকবেন না চাচা প্লিজ। এই নিউজটা হলে আপনার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে। আপনি কি চান না আপনার মেয়েকে খুঁজে পেতে?”
বৃদ্ধ লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বললেন, “জ্বালাইয়েন না তো! এমনিতেই অনেক ঝামেলার মধ্যে আছি!”
সাবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিলেন বৃদ্ধ। ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাবা। যূথীর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলাটা খুব দরকার ছিল। তাদের সঙ্গে কথা বলে রহস্যের জট অনেকাংশেই খুলে যেতো।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে সাবা আবারও ফিরে এলো সেই প্রথম টিনের ঘরের কাছে। অরুণ সেই মাঝবয়সী ভদ্রমহিলার পাশে দাঁড়িয়েই এতক্ষণ দেখছিল সাবার কর্মকান্ড।
ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ম গলায় বললেন, “মন খারাপ কইরো না। ওই বুইড়া-বুড়ি এমনই। সবাইরে তেজ দেখায়। যবে থেকে দুইজন আইসে, তবে থেকে জ্বালাইতেছে।”
অরুণ কৌতূহলের সুরে বলল, “এসেছে মানে? এরা এখানকার না?”
“আরে না। এই মনে করো ফাল্গুন মাসে আইসে।”
সাবা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “আর দুইজন এসেছে মানে কী? তাদের মেয়ে আসেনি সাথে।”
ভদ্রমহিলা মুখ বিকৃত করে বললেন, “শুরুতে তো ওই মাইয়ারে দেখি নাই। দুজনই উঠছিল। পরে মাঝেমধ্যে মাইয়ারে দেখতাম, কিন্তু থাকতে দেখি নাই কখনো।”
ভদ্রমহিলা চুলায় তরকারি পুড়ে যাওয়ার গন্ধ পেয়ে দ্রুত ঘরের ভেতরে চলে গেলেন।
অরুণ চিন্তিত গলায় বলল, “কিছু বুঝলি?”
সাবা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ। এই বাবা-মা আর মেয়ের অনেক বড় একটা রহস্য আছে।”
“তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখ। যূথীর চাকরি হয়েছে গত বছর নভেম্বরে। আর এই বুড়ো-বুড়ি এখানে থাকতে এসেছে ফাল্গুন মাসে। মাঝের এই দিনগুলোতে মেয়ে কোথায় ছিল? তাছাড়া বাবা-মা এখানে আসার পরও মেয়ে কেন তাদের সাথে থাকতো না?”
“যূথী অন্য কোথাও থাকতো অরুণ। যেখানে বসেই এত বড় ষড়যন্ত্র সাজিয়েছে।”
“কিন্তু সেটা কোথায়?”
“সেটা তো তার বাবা-মাই বলছে।”
“তারা তো মুখই খুলতে চাইছে না।”
সাবা দৃঢ় গলায় বলল, “খুলবে। কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে মানুষের মুখ খোলাতে হয়, আমার খুব ভালো করেই জানা।”
অরুণ শুকনো ঢোক গিলে বলল, “কী করবি তুই?”
সাবা নিচু গলায় বলল, “আজ রাতে আমরা ওই বাড়ির পেছনে ওত পেতে থাকবো।”
“হ্যাঁ?”
সাবা জোর গলায় বলল, “আজ সকাল পর্যন্তও আমি কনফিউশনে ছিলাম। কিন্তু এখন মোটামুটি নিশ্চিত এই মেয়েটা নিখোঁজ নয়। নিজে থেকেই কোথাও লুকিয়ে আছে। আর একে খুঁজেও আমিই বের করবো।”
(চলবে)