#লোভ
#পর্বঃ৩
লেখনীতে: #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
“হোয়াটস গোইং অন হিয়ার? দাদি আপু, তুমি একটা ডিসপিকেবল, ইমপোলাইট গার্লকে তালুকদার বাড়ির বউ হতে রিকোয়েস্ট করছো? হোয়াট কোয়ালিফিকেশনস ডাজ শি হ্যাভ টু বি মাই ব্রাদার’স ওয়াইফ?”
উত্তপ্ত মরুর বুকে এক ফোঁটা শিশির বিন্দু পড়লে যেমন প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, আকস্মিক ইরফান তালুকদারের আগমনে আরাফাতের বক্ষেও তেমনই এক শীতল হিমস্রোত বয়ে গেল। অকুল জলের গভীরে দাঁড়িয়ে সে আরো একবার অনুভব করল, তার হয়ে প্রতিবাদ করার জন্য, অন্তত তার একজন বড় ভাই রয়েছে—যে অ/গ্নিস্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও বিশ্বাসযোগ্য, যাকে ভরসা করা যায়। তিনি অটল, অবিচল, এক বিশাল বটবৃক্ষের মতো, যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আরাফাত আজ নির্ভার বোধ করছে। ছেলেটা এতক্ষণ পর এক দীর্ঘ শ্বাসে শান্তি অনুভব করলো।
উফ, এতক্ষণ তো ওর শ্বাসটাই গলার কাছটাতে এসে আঁটকে ছিল। না অধরাকে ফেলে দিতে পারছিলো, না গি/লতে পারছিলো। দাদি আপুর মুখের উপর না বলার মতো, সেই সাহস কি ওর ছিল? কক্ষনো না। একমাত্র ইরফান ভাইয়া ছাড়া এই সাহস আর কার আছে? আদৌ কারও আছে কি?
আরাফাত এতক্ষণ পর নতজানু মাথাটা তুললো। একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে চাইলো। ভীড়ের শেষ মাথায় লম্বা-চওড়া উঁচু মাথাটা, সবার আগে তার চোখে পড়লো।
অপ্রত্যাশিতভাবে, ইরফানকে এখানে দেখে মমতা বারকয়েক ফাঁকা ঢোক গিললো। অজানা এক ভয়ে তার বক্ষঃস্থল আরো একবার কাঁপলো। চেতনাহীন অধরা’রও ততক্ষণে হুঁশ ফিরেছে। এতক্ষণে, ইরফান এদিকটাতে চলে এসেছে। নিজের সামনে, ইরফান ভাইকে দেখে পুনরায় থরথর করে কাঁপলো মেয়েটা। আচ্ছা, ইরফান ভাই সব জেনে যায়নি তো?
বুকের মাঝে লালনকৃত ত্রাসের মাঝে অধরা জড়ানো কণ্ঠে আওড়াল,
“আমি কিছু করিনি, আমি কিছু করিনি, ইরফান ভাই।”
ইরফান ভয়ার্ত মেয়েটাকে দেখে বাঁকা হাসলো। অথচ তার চোখ-মুখে সবসময়ের থেকে-ও আজ অতিরিক্ত কাঠিন্য ভাব বিরাজমান। কেমন অদ্ভুত সব আচরণ করছে ছেলেটা। যা উপস্থিতি কারোই চোখ এড়ালো না। এরমধ্যে, তাকে-ও হিমশীতল কণ্ঠে ইসাবেলা প্রশ্ন করলো,
“হয়েছেটা কি, ইরফান? তুমি হঠাৎ আমার সিদ্ধান্তের মধ্যে বাগড়া দিতে এলে যে?”
“কি হয়েছে?” এটা তো আমি না বরং অধরাই বলবে।”
ইরফান ভাইয়ের ঠান্ডা স্বরের শীতল হু/মকি শুনে, অধরার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা জমা হলো। মেয়েটা ফ্যাকাশে মুখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরমধ্যে, ইরফান এসে টানটান সোজা হয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। বেশ ঠান্ডা স্বরে বললো,
“অধরা, একটু আগে আমার রুমে ঠিক কি হয়েছিল?”
অধরা ফ্যাকাসে মুখে বললো,
“আমি জানি না, ইরফান ভাই।”
“আই রিপিট অধরা, একটু আগে কি হয়েছিল? তুই স্বেচ্ছায় বলবি, না-কি আমি আমার রুম থেকে ল্যাপটপ নিয়ে আসবো। তুই বোধহয় জানিস না, আমার রুমের প্রতিটা কোণায় কোণায় সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে।”
ইরফানের চোখের দৃষ্টি শান্ত, শীতল কণ্ঠ, অথচ চোয়াল শক্ত। ছেলেটা ভয়াবহ রকমের রেগে আছে কি? মৌসুমি তালুকদার ছেলেকে আলগোছে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিলো। এরপর অত্যন্ত কোমল গলায় বললো,
“শান্ত হও, ইরফান। ছেড়ে দেও, মেয়েটা ভয় পাচ্ছে তেমাকে।”
“তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছো, মা? তুমি জানো, এরা তোমার ছেলেকে আজ ফাঁ/সাতে চাইছিলো?”
গমগমে আওয়াজে ইরফানের বলা শব্দগুলো, রুমের প্রতিটি কোণায় কোণায় প্রতিধ্বনি হলো। সুনসান নীরব রুমটাতে আরো একবার লোকের গুঞ্জন ভেসে এলো। অধরা অনুভব করলো, তার নিশ্বাস আঁটকে আসছে, পুরো শরীর আসড় হয়ে আসছে। এ কোন পাপের মাঝে আঁটকে গেলো অধরা? শেষ সময়ে এসে কি-না, নিজের পাতা ফাঁ দে, নিজেই আঁটকে গেলো?
কি করবে অধরা? চুপ থাকবে? কিন্তু, পরে যদি ইরফান ভাই সত্যি সত্যিই তার এসব কৃতকর্ম সবাইকে দেখায়? এমনিতেই তো তার আর ইজ্জতের কিছু অবশিষ্ট রইলো না, এরপরও কি আরো একবার নিজের ইজ্জত হারাবে সে? গল্পের আসল লেখিকা, সুমাইয়া আফরিন ঐশী। এই যে, এতোগুলা চোখ তার দিকে কেমন কেমন করে তাকিয়ে আছে, অধরার তো এক্ষুনি ম রে যেতে ইচ্ছে করে। এরপর, এরপর একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হলে আদৌও সে বাঁচতে পারবে?
না না, অধরা আর সেরকম রিস্ক নিতে রাজি হলো না। মেয়েটা শুকনো ঠোঁট জোড়া একবার জিভ দিয়ে ভিজিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শুধালো,
“আমি-আমি কিছু করিনি, ইরফান ভাই। আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে।”
মৌসুমি তালুকদার বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“কে করিয়াছে?”
অধরা নিজের মায়ের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করলো,
“আম্মু, আম্মু।”
এরপর, কি হয়েছে? কি করিয়েছে? তা আর কাউকে বলতে হলো না। শিক্ষিত, বিচক্ষণ তালুকদার বাড়ির প্রতিটি সদস্য সে রহস্য বুঝে নিয়েছে নিজ নিজ উদ্যোগে।
পুরো বসার ঘরটাতে অমনি বিস্ময়ের ভীড় জমলো। কতোগুলো চোখের দৃষ্টি আঁটকে গেলো মমতার দিকে। মমতা অবলীলায় মাথা নিচু করে নিলো, পা দিয়ে ফ্লোর খামচে ধরলো। তবুও মমতার চোখ এড়ালো না, বোনের সেই ঘৃণিত দৃষ্টি, মেয়ের চোখের অঝোর পানি। মমতা হঠাৎ অনুভব করলো, তার জগতের সব পাপ একত্রিত হয়ে তাকে গি লে ফেলছে। আর মমতা কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না। কেবল, ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে ভেতর থেকে ফা/লা-ফা/লা হয়ে যাচ্ছে ! হঠাৎ, রাগে-দুঃখে, অপমানে তার নিশ্বাস আঁটকে আসছে। মমতা ম রে যাচ্ছে, তীব্র যন্ত্রণা তার সারা শরীরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে। এ কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে ভিতরটাতে? আহ, বাঁচা গেলো না আর!
আচমকা,পিনপতন বসার ঘরটাতে তীব্র এক শব্দ হলো। মমতা গালে হাত দিয়ে, মৃদু আ/র্তনাদ করে উঠলো। চোখ তুলে তাকিয়ে বুঝলো, তার গালখানাতে বড়বোন সজোরে এক থা/প্পড় বসিয়েছে। মমতা টু শব্দটিও করতে পারলো না। লজ্জায় আরো একবার মাথা নিচু করতে হলো। তান্মধ্যেই, শোনা গেলো মৌসুমি তালুকদারে কঠিন স্বর,
“তোর এতো অধঃপতন হয়েছে, মমতা? ছি! ছি! তোকে বোন ভাবতেও, আমার গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে। তুই, তোরা এক্ষুনি বেড়িয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। আমার বাড়ির ত্রিসীমানাটাও আজ থেকে তোদের জন্য নিষিদ্ধ। আর কক্ষনো যেন আমার ছেলেদের আশেপাশেও তোদের ছায়াটাও না পড়ে। সাবধান মমতা। গো এওয়ে, গো এওয়ে, লিভ, লিভ।”
অপমানে মমতার চোখে জল চলে এলো। এলোপাথাড়ি পায়ে, মমতা তালুকদার বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো। তার পেছনে পেছনে, অধরাও মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো। হঠাৎ তার কানে প্রতিধ্বনি হলো ইরফান তালুকদারের কণ্ঠস্বর,
“ইরফান তালুকদারকে লোভনীয় কাম দিয়ে কখনো নিজের করে পাওয়া যায় না, মেয়ে। ইরফানদের অর্জন করতে হয় নিঃশব্দ আরাধনা আর নির্বেজাল প্রেম দিয়ে।”
ইরফানের বলা স্পষ্ট বাক্যগুলো শুনে পাশ থেকে একটি অষ্টাদশী শ্যামমুখ ততক্ষণে বিড়বিড় করে উঠলো,
“দরকার হলে আমি আরো কয়েক যুগ প্রেমের আরাধনা করবো, তবুও আপনাকে পাওয়ার লোভ আমি ছাড়ছি না, ইরফান ভাই।”
ইরফান কি শুনতে পেলো, অষ্টাদশী মেয়েটার সেই তীব্র অনুভূতি? হয়তো শুনলো, সে তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকালো রুমের কোণায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই শ্যামময়ী মেয়েটার মুখপানে। আচমকাই তাদের নীরব দৃষ্টি বিনিময় হলো একবার। অমনি শুকনো ঠোঁটে হাসলো, সিদরা মেয়েটা।
এক্ষণের পুরোটা সময় ধরে, তার জানটা গলার কাছটাতে এসে আঁটকে ছিলো। যখন ঘুমঘুম চোখে সে শুনলো, ইরফান ভাইয়ের রুম থেকে মেয়েলী এক চিৎকার, অমনি তার ছোট্ট মনটা ভয়ে আড়ষ্ট হলো। সে-কি ভয়! অদ্ভুত এক ব্যাথা, প্রিয় হারনোর উৎকণ্ঠা। কিশোরী মনে লালন করা সেই গাঢ় অনুভূতি! মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সব তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। সিদরাতুল মুনতাহা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। এরপর, এরপর সব যেতে-যেতেও আবার ম্যাজিকের মতো সবকিছু মানুষটা ঠিক করে দিলো। ভাবতেই, মেয়েটা গাল ভরে হাসলো, বুক ভরে স্বস্তির শ্বাস টানলো। আরো একবার চোরাচোখে ইরফান ভাইকে দেখে নিজের রুমটার দিকে ছুটে গেলো।
উপস্থিত বাকি সবাই, এইমাত্র তিনজন মানুষের ছুটে চলার দৃশ্যটা কেবল নিরব দর্শকের মতো দেখলো।
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া গল্প কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ!]