#লোভ
#পর্বঃ৫
লেখনীতে: #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
“এক্ষুনি চলে যাবে, বাপ? কোনোভাবে আর দু’টো দিন থেকে যাও না!”
মায়ের অবুঝ আবদার শুনে, ঠোঁট এলিয়ে অল্পস্বল্প হাসলো, ইরফান। আলগোছে মা’কে জড়িয়ে ধরে মৃদুস্বরে বললো,
“নট পসিবল, মা। উপরমহল থেকে অর্ডার এসেছে। দিস ইজ অ্যান ইমার্জেন্সি।”
মা তবুও মানছে না। মায়ের মন তো। সে আবারও বললো ভীষণ মনখারাপ নিয়ে,
“তুমি আজই চলে যাচ্ছো, ইরফান! আগামীকাল বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আর তুমি থাকবে না? আমার ভীষণ খারাপ লাগছে,বাবা। আটটা মাস পর তুমি বাড়ি এলে, অথচ দু’টো দিনও আমার কাছে থাকলে না।”
ইরফান মা’কে এবার আলতো জড়িয়ে ধরলো। মায়ের ডান হাত নিজের মুঠোবন্দি করে চুমু খেলো।বুক ফুলিয়ে বললো,
“তুমি কোনো সাধারণ মা নও, মা। তুমি একজন সৈনিকের মা। তাদের এতো ইমোশনাল হতে নেই, জানো না? একজন সৈনিকের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার দেশ, দেশের মানুষ, এবং তার দায়িত্ব।”
মা চোখের জল মুছে ছেলেকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, যেন সমস্ত কষ্ট সয়ে নিয়েও ছেলের পথচলায় কখনো বাঁধা হতে না চান। কিন্তু, অবাধ্য চোখজোড়া থামে না। চুয়ে চুয়ে জল পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে ছেলের কাঁধটা। একজন সৈনিকের মা হওয়া যেমন গর্বের, তেমনই যন্ত্রণার এবং আত/ঙ্কের। তাদের সন্তানের জীবন অজানা, অনিশ্চিত। আজ যে সন্তান সশরীরে তার কাছে ফিরে এসেছে, “আগামীকাল যে সে কাফনে মুড়ে আসবে না” এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই। দেশ ও দেশের জন্য তাদের জান দিতে হলে-ও পিছিয়ে যায়না তারা। পিছিয়ে যাওয়ার নিয়ম যে তাদের নীতির বাইরে।
ইরফান মা’কে আগলে ধরে, ফোঁস করে শ্বাস টানলো। হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলো। মা কাঁদছে। তাকে এভাবে ফেলেও যেতে ইচ্ছে করে না। আবার দেরি করার মতোও সময় নেই। ইরফান অসহায় বোধ করে তাকালো দাদির মুখপানে। ইসাবেলা অমনি পুত্র বধূকে ধামকিয়ে উঠলো,
“তোমার কি কোনো আক্কেল-জ্ঞান নেই, বড় বউ? ছেলেটা চলে যাচ্ছে, আর তুমি তাকে কাঁদিয়ে দুর্বল করে দিচ্ছো! আমাকে কখনো দেখেছো, ছেলেদের সামনে এমনভাবে কাঁদতে? একজন সৈনিকের মা হতে হলে চোখের জলে নয়, বুকের জোরে শক্ত থাকতে হয়। মা হতে হবে, কিন্তু গর্বের সঙ্গে, দুর্বলতার সঙ্গে নয়। তুমি তোমার ঘরে যাও, বড় বউ।”
মৌসুমি তালুকদার নিজেকে সামলে ছেলেকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু, ঘরে আর গেলো না। নাক টানতে টানতে দরজার এক কোণায় দাঁড়ালো। নিচু স্বরে শ্বাশুড়ি মা’কে বললো,
“আমি আপনার মতো এতো শক্ত নই, আম্মা।”
ইসাবেলা গোপনে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আসলেই কি সে এতো শক্ত? সবাই তার শক্ত খোলস দেখলো, কিন্তু আড়ালে-আবডালে তার শ্বাসরুদ্ধকর কান্নার ভাণ কেউ দেখলো না! যদিও সে সুযোগ উনি কাউকে দেননি। ইসাবেলা আর কথা বাড়ালো না। নাতিকে দু’টো ভালোমন্দ বলে গেইট অব্ধি এগিয়ে দিতে গেলো। তার পিছনে পিছনে আরাফাতও এলো। এতক্ষণে, সে-ও ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে।
ইরফান যাওয়ার আগে শেষবার মা’কে বললো,
“তুমি মন খারাপ করিও না,মা। আমি এইতো তোমার পাশাপাশিই থাকছি এখন। চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আমাদের বাসার পথটা বড়জোড় আধঘন্টার। এরপর আমি সুযোগ পেলেই তোমাকে দেখে যাবো।”
মা জানে,ছেলে তার সেই সুযোগ পাবে না। ওদের মিশন-ফিশনের অভাব আছে না-কি? হুটহাট পোস্টিং বদলায়। আবার কোথায়, কোনদিকে ছুটতে হবে কে জানে! তবুও মা ছেলেকে বললো,
“সাবধানে থেকো, বাবা। মা তোমার ফেরার অপেক্ষা করবে।”
ইরফান মুচকি হেসে পা বাড়ালো সামনের পথটায়। গেইটের কাছে আসতেই তার মনে হলো, কি যেন আজ মিসিং। ইরফান আরো একবার হাত ঘড়ি দেখলো। অহেতুক বাড়ির আশপাশটায় তাকালো।
হুট করেই সেখানে লুঙ্গি হাতে উঁচিয়ে দৌড়ে আসলো, শাওন। ইয়াসিন ফারুকের একমাত্র ছেলে সে। বাচ্চাটাকে কিছুদিন আগেই “সুন্নাতুল খতনা” করানো হয়েছে। আগামীকাল সেটার আবার অনুষ্ঠান হবে। শাওনের শখ। বাচ্চাটা খুব চঞ্চল, দুষ্টও বটে! এই বয়সে এতো বেপরোয়া! গল্পের আসল লেখিকা, সুমাইয়া আফরিন ঐশী। একমাত্র ছেলের আবদারে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজনই করেছে, ওর বাবা-মা। এরমধ্যে, কি একটা বি’শ্রী ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু, অনুষ্ঠান থামিয়ে রাখা যাবে না। সবাইকে দাওয়াত টাওয়াতও দেওয়া শেষ।
এতো ভোরে শাওনকে এখানে দেখে শাহনাজ পারভীন ছেলেকে ধমকে উঠলো,
“তুমি এখানে কেনো এসেছো,শাওন? বাবা তোমাকে হাঁটতে নিষেধ করছিল না?”
শাওন মায়ের কথা গ্রাহ্য করলে তো! সে এসেই ছোটছোট হাত দিয়ে ইরফান ভাইয়ের হাঁটু ঝাপটিয়ে ধরলো। আদুরে স্বরে ডাকলো,
“ও ইরফান ভাই?”
ইরফান মৃদু হেসে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শাওন আবারও বললো,
“তুমি চলে যাচ্ছো, ইরফান ভাই? আমার “ছোট পাখির” অনুষ্ঠান খেয়ে যাবে না?”
পাশ থেকে আরাফাত অবাক হয়ে একই শব্দ আওড়াল,
“ছোট পাখি! ছোট পাখি! এই ছোট পাখিটা কি-রে? এটার আবার অনুষ্ঠানও হয় না-কি?”
শাওন ছোটছোট মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“ওমা, তুমি ছোট পাখি চেনো না? তোমার ছোট পাখি নেই না-কি, আরাফাত ভাইয়া?”
আরাফাত বোকাবোকা কণ্ঠে বলে বসলো,
“না তো। তোর ছোট পাখিটা একটু দেখা তো ভাই। দেখি কোনটাকে ছোট পাখি বলে?”
শাওন ফট করে নিজের লুঙ্গিটা উঁচিয়ে আরাফাতকে দেখিয়ে ফোকলা দাঁতে হেসে বললো,
“এই যে দেখো, আমার ছোট পাখিটা। একদম ছোট হয়ে গেছে! এটাতে খুব ব্যথা, জানো?”
আরাফাত ফাঁকা ঢোক গিললো। এতক্ষণের সবটা বুঝতে পেরে, মুহুর্তেই তার মুখটা লজ্জায় নতো হয়ে গেলো।
ভাইবোন, মা-চাচিদের সামনে ইরফানও লজ্জায় এদিক সেদিক চাইলো।সেই সাথে ভাইয়ের দিকে কটমট করে তাকালো। যদিও প্রথমে এরকম উদ্ভট শব্দ শুনে সে-ও বুঝতে পারছিলো। কিন্তু, যতক্ষণে বুঝলো ততক্ষণে আরাফাতকে আর থামানো গেলো না। দু’টোই বাদাইম্মা!
ছেলের উদ্ভট কথাবার্তা, তার হালচালে বড়বড় ছেলেদের সামনে বেজায় লজ্জায় পড়লো, শাহনাজ পারভীন ও ওদের মেঝো মা, আফসানা। শুধু মিটমিট করে হাসছে, ইসাবেলা ও ইরা।
তান্মধ্যে,শাহনাজ নিজের ছেলেকে পুনরায় ধমক দিলো। নাক-মুখ কুঁচকে বললো,
“ছি। এসব কি পঁচা কথা! এ্যাঁই, তুমি এগুলো কই থেকে শিখেছো?”
শাওন ফোকলা দাঁতে হাসছিলো। মায়ের ধমকে তার মুখটা চুপসে গেলো। সে আর কালবিলম্ব না করে বললো,
“মম, আই ডোন্ট নো। আমাকে এসব সিদরা আপু শিখিয়েছে। আপু বলেছে, ছেলেদের এটার নাম “ছোট পাখি”। আর এটার অনুষ্ঠান করলে সেটাকে বলতে হয়, “ছোট পাখির অনুষ্ঠান।” আচ্ছা মম, আপু কি আমায় ভুল শিখিয়েছে? তুমি আমায় বকছো কেন?”
শাওনের সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। সিদরা নামটা শুনেই, নাক কুঁচকায় ইরফান। মেয়েটা এতো উদ্ভট! এরমধ্যে, ক্ষেপে যায় মেঝো মা। বড় মেয়েটা তার এতো বাঁদর! আজ ধরবে সে। শ’য়তানটা আজ শুধু ঘুম থেকে একবার উঠুক। একদম উচিত শিক্ষা দিবে। সেই সঙ্গে ওদের বাপটাকেও একটা শিক্ষা দিতে হবে। দু’টো মাত্র মেয়ে তার। সিদরা আর মিথিলা। দু’টো মেয়েকেই ওদের বাপ আদর দিতে দিতে বাঁদর বানিয়েছে।
°
মুখ অবধি চাদর টেনে বেঘোর ঘুমাচ্ছিল সিধরা। আচমকা কেউ তার সাধের ঘুম ভেঙে দিলো। কেউ খুব তাড়াহুড়ো করে জানালো,
“তোর লেফটেন্যান্ট চলে যাচ্ছে, সিধরা! তুই এখনো ঘুমচ্ছিস?”
ঘুমকাতুরে সিধরা প্রথমে কথাটা আমলেই নিলো না। কিন্তু কেউ যখন ধাক্কাধাক্কি শুরু করল, তখন বিরক্ত চোখে তাকিয়ে দেখল- ইরা দাঁড়িয়ে আছে। ওরা দু’জন সমবয়সী, একই ঘরে থাকে, আর চুলোচুলি সম্পর্কও কম নয়।
অমনি সিধরা বিরক্ত স্বরে বলল,
“ঘুমাতে দে তো, বা ল! মরছে কে এই ভোরবেলায়? রাতভর তো নাক ডাকিস, আমি একদম ঘুমাতে পারি না। এখন একটু শান্তি দে, বোইন।”
ইরা ঝংকার তুলল। মুখ বাঁকিয়ে হনহন করে আবার বাইরে চলে গেল। তার এত কিসের ঠেকা? তার এতো ঠেকা পড়েনি তো!
সিধরা বোনের থেকে নিস্তার পেয়ে আবারও গলা অবধি চাদর টেনে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু আচমকা মনে হলো- ইরা কি যেন বলছিল?
লেফটেন্যান্ট সাহেব চলে যাচ্ছে? মানে? কোথায় যাচ্ছে উনি?
অমনি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সিধরা। আচমকা, বাইকের হর্ন কানে যেতেই দৌড়ে বারান্দায় চলে গেলো মেয়েটা। মুহূর্তেই তার মুখখানা অন্ধকার হয়ে এলো, চোখের কোঠরে জল জমল।
প্রতীক্ষার দীর্ঘ আটটা মাস! অপেক্ষারত এক প্রেমিকের ন্যায়, সে-ও মানুষটাকে একনজর দেখার জন্য দিন গুনছিল। কতো সেই অপেক্ষার পর মানুষটা এলো, আবার চলেও যাচ্ছে!
এতদিন পর এলো, অথচ তাকে দু’টো দিনও মন ভরে দেখা হলো না।
সিধরার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। এতদিন যে কথা জমিয়ে রেখেছিল সে, যে অনুভূতি বুকে পুষে রেখেছিল, সেটা এবারও বলা হলো না।
চোখের সামনে ইরফান ভাই একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে, দূরে… আরও দূরে… অথচ সে দাঁড়িয়ে আছে একটুখানি ভালোবাসার ওজন নিয়ে, যা কখনো প্রকাশ পায়নি।
মেয়েটার চোখের কোণ বেয়ে নীরব জল গড়িয়ে পড়ল। ঠোঁট কাঁপল, গলা ধরে এলো, তবুও মৃদু স্বরে ফিসফিস করে বলল,
“এবারও বলা হলো না, ইরফান ভাই… আমি আপনাকে ভালোবাসি… খুব ভালোবাসি…”
ইরফানও না… ছেলেটা একটা বারও পিছনে তাকাল না। যদি তাকাত, তাহলে দেখত— কয়েক জোড়া ছলছল চোখ তার চলে যাওয়াকে নিঃশব্দে বিদায় জানাচ্ছে।
ইরফান জানে, সেই চোখগুলো এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জানে, এই মায়া ছিন্ন করা এতো সহজ নয়।
ওই যে, ঘোলাটে একজোড়া বিশেষ চোখ… সেই মেয়েটা… যে প্রতিবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, একটিবারও কিছু বলে না, তবুও তার চোখ বলে দেয় না বলা হাজারও কথা। কতো আকুতি ভরা সেই চোখ!
কিন্তু একজন সৈনিক জানে, তার পথটা শুধু সামনে। তাদের পিছনে তাকানোর নিয়ম নেই…..
চলবে…..