শখের বালা পর্ব-০১

0
1

#শখের_বালা (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মায়ের শখের বালা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছি কাকার হাতে। কাকা আমাকে একটি থাপ্পড় মে রে মায়ের কাছে নিয়ে এলো। আমি বারবার কাকাকে বলছিলাম,“কাকা আমাকে আম্মার কাছে নিয়েন না। আমাকে মাফ করে দেন।”
তবে কাকা আমার কোন কথা না শুনে আমাকে টেনে মায়ের কাছে নিয়ে আসে। মা যখন জানতে পারে আমি কাকার বাসায় তার বালা চুরি করতে গিয়েছি তখন সে আমাকে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। অতঃপর বলে,“চোরের বাচ্চা চোর। বাবার মতো চোর হতে চাচ্ছিস? সেই পথে পা বাড়ালি? এই দিন দেখার জন্য তোর মুখের দিকে তাকিয়ে এখানে পড়ে ছিলাম?”
এই কথা বলে মা আমাকে আবারও থাপ্পড় মা রতে শুরু করলেন। একের পর এক থাপ্পড় মা রতে থাকে। এটা দেখে কাকা থামায়। তারপর বলে,“ছেলেকে বোঝাও। বয়স কম ভুল করে ফেলেছে। তাকে বুঝিয়ে এসব করতে বারণ করো। এভাবে মা রলে তো সমাধান হবে না।”
আম্মা কাকার দিকে অসহয় চোখে তাকায়। কাকা তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,“আপনি চিন্তা করবেন না ভাবী। এই কথা আমি বা আমার পরিবার কাউকে বলবো না।
এমনিতেই কাশেম ভাই চুরি করে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর থেকে এই এলাকার কেউ আপনাদের এখানে রাখতে চায়নি। তার মাঝে এসব কথা জানাজানি হলে সবাই মিলে আপনাদের তাড়িয়ে দিবে। আমি এমনটা চাই না। তাই আপনার ছেলেকে আপনার হাতে দিয়ে গেলাম। আশা করি পরবর্তীতে এমন কিছু হবে না।”
মা কাকার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কাকা চলে যায়। আমি কান্নারত অবস্থায় মাকে বললাম,“আম্মা আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আম্মা আমি আর এমন করবো না।”
মা আমার সাথে কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন ঘরে। আমি তার পিছনে যেতে নিলে মা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর উচ্চশব্দে বললেন,“একজন চোরের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারবো না। আজ থেকে তুই আমার সাথে একটা শব্দ অব্দি উচ্চরণ করবি না। তুই আমার সঙ্গে কথা বলার সব অধিকার হারিয়ে ফেলেছিস। নিজের বাবার পথে পা বাড়িয়ে।”
এই কথা শুনে আমি চিৎকার দিয়ে ‘না’ বলে উঠলাম। আমার মা আমার দিক দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া আমি সহ্য করতে পারবো না। আমি দরজার এপাশে বসে বারবার বলেছি,“আম্মা আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আর করবো না। আম্মা তুমি তোমার বালার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছিলে, তাই আমি বালা জোড়া চুরি করতে গিয়েছিলাম। আম্মা আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

মা আমার এত কথা, এত আহাজারি, এত ডাকাডাকি শুনেও সাড়া দেয়নি। আমি জানি ঘরের ভেতরে বসে সেও কান্না করছে। আমার মা আমার জন্য কান্না করছে, আমার সঙ্গে কথা বলছে না। এই বিষয়টি আমার মধ্যে অনুশোচনার জন্ম দেয়। আমি যে মস্তবড় একটি ভুল করে ফেলেছি সেটা উপলব্ধি করতে পেরে আমি হাউমাউ করে কান্না করে মাকে ডেকে যাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম মা একটা সময় ঠিক আমার ডাকে সাড়া দিব। কিন্তু না।মা বুকে পাথর চেপে ভেতরে বসে ছিলেন। তাও আমার ডাকে সাড়া দেয়নি। এদিকে মায়ের নিরবতায় আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো। সেই সঙ্গে মাথার মাঝে সেই স্মৃতি ঝেঁকে বসেছে, কিভাবে কী হয়ে গেল? বারবার মাথার মাঝে সেই সময়টা ভেসে উঠছিলো যেই সময়ে বালার জন্য আমি মাকে কান্না করতে দেখে চুরি করার মতো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
___
আমাদের এলাকায় আমাদের সবাই খুব খারাপ চোখে দেখতো। এর অবশ্য কারণ ছিলো। এর কারণ আমার বাবা। সে একজন চোর। তার জন্য এলাকার কেউ শান্তিতে থাকতে পারতো না। আমার মা তাকে এই পথ থেকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। আমার বাবা কম পরিশ্রমে বেশি অর্থ আয়ের উৎস হিসাবে চুরিকেই বেছে নিয়েছিলেন। আর এমনই একদিন চুরি করতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। এবার প্রথম নয় যে সে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। আগেও বহুবার হয়েছে। কিছুদিন পর বেরিয়ে আবার সেই পথেই পা বাড়িয়েছে। তবে এবার একজন প্রভাবশালীর বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে৷ তাই তাকে ছাড়ানো বেশ জটিল। সেই সাথে তার পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। মাও না। আগে অবশ্য মা কয়েকবার ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলো। কারণ বাবা সবসময় মাকে বলতো সে ভালো হয়ে যাবে। তার থানায় কষ্ট হয় থাকতে। নানা ধরনের ইমোশনাল কথা বলে সে মাকে বোঝাতো। মাও তার কথায় গলে যেতো। তবে এবার আর মা গলেনি। মা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আমাকে নিয়ে একাই থাকবে।

বাবার জন্য এলাকার কেউ আমাদের দেখতে পারতো না। তার রেশ ধরেই বাবার কিছু শ ত্রু যাদের সাথে বাবা নানা সমস্যা জড়িয়ে গিয়েছিলো। তারা সবাইকে নিয়ে আমাকে এবং মাকেও তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো। তাদের কথা ছিলো, থানা থেকে আসলে আমরা আবার বাবাকে ঘরে তুলবো। সে আবার তাদের উৎপাত করবে। তাই তারা চোরের কোন অস্তিত্ব রাখতে চায় না। ঘর বাড়ি সব জ্বালিয়ে দিতে চায়। সেদিন আমার মা অসহয়ের মতো তাদের হাতে-পায়ে ধরে, সেই সঙ্গে কিছু ভালো মানুষও আমার মায়ের হয়ে কথা বলায় সবাইকে থামানো যায়। মা অবশ্য তাদের বলে দিয়েছিলো, এই ঘরে আর বাবাকে জায়গা দিবে না। যদি সে ফিরে আসে। সেই সঙ্গে আমাকেও মানুষের মতো মানুষ বানাবে। আমি আমার বাবার মতো হবো না।

কিন্তু! আমি আমার মায়ের কথা রাখলাম না। কাকার সামনে তার মুখটা ছোট করে দিলাম। সেই ঘটনার পর বেশ কয়েক মাস ধরে মা, সেলাইয়ের কাজ, অন্যের বাড়ির ধান সেড়ে দেওয়ার কাজ, সেই সঙ্গে টুকটাক অনেক কাজ করে আমাদের মা ছেলের সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলো। এরই মাঝে মা জানতে পারে আমাদের ঘরটি যেখানে আছে তার একাংশ অন্য একজন পায়। যেই জমিটা আমাদেরই ছিলো। কিন্তু তার বাবা বন্ধক দিয়ে দিয়েছিলো। আমার বাবা চোরের সঙ্গে একজন জুয়া খোর ছিলো। যে সব টাকায় জু য়া খেলেই নষ্ট করতো। যাই হোক, এই কথা জানার পর মা খুব হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ যারা জমিটা বন্ধক নিয়েছে তারা হয় টাকা নয় ঘর ভেঙে তার জমি চাচ্ছিলো। মায়ের কাছে জমিটা রক্ষা করার জন্য কিছুই ছিলো না। শুধুমাত্র তার বাবার শেষ স্মৃতি এক জোড়া বালা ছাড়া। এই বালা জোড়া আমার মায়ের খুবই শখের। সেই সঙ্গে নানার দেওয়া একমাত্র উপহার। নানার অবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় সে তেমন কিছুই মায়ের জন্য করতে পারেনি। তবে এই বালাজোড়া নানীর ছিলো, এই জোড়া নানা মামীকে না দিয়ে মাকে দিয়ে দিয়েছিলো। এই বালা নিয়ে নানাকে মামা মামীর কাছে শেষ বয়সে অনেক কথা শুনতে হয়। সব মিলিয়ে মায়ের কাছে এই বালা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এই বালা জোড়া যে মায়ের কাছে কত শখের ছিলো সেটা তার বালাজোড়া বুকে নিয়ে সারারাত কান্না করা দেখেই আমি বুঝতে পারি। পরবর্তী দিন সকালে মা বালাজোড়া পাশের বাড়ির কাকা, কাকীর কাছে বিক্রি করবে। তাই আগের দিন রাতে শেষবারের মতো বালাজোড়া হাতে পড়ে৷ সেই জোড়া নিয়ে ভীষণ কান্না করে। বিছানায় ঘুমের ভান ধরে থাকা আমি মায়ের কান্নার শব্দ শুনে খুবই ভেঙে পড়ি। পরে যখন বালাজোড়া সকালে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি মাকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করছিলাম,“আম্মা বালাজোড়া বিক্রি না করলে হয় না?”

“না বাবা। মাথার উপর ছাদই যদি না থাকে তবে বালা দিয়া কী করবো?”
মায়ের এই কথার মাঝে কতটা বেদনা ছিলো সেটা সন্তান হয়ে আমি উপলব্ধি করতে পারি। সেদিন সারাটা দিন মা মনমরা ছিলো। বন্ধকের টাকা শোধ করে জমির কাগজ বুঝে নিয়েও মা খুশি ছিলো না। মায়ের এই বিষন্ন মুখ আমাকে খুব পুড়িয়েছে। তাই তো আমিও ভুল পথে পা বাড়ালাম। সেই সময়ে আমার মাথায় কিছুই ছিলো না। একমাত্র মায়ের বিষন্ন মুখ ছাড়া চোখে কিছুই দেখতে পারছিলাম না। মস্তিষ্ক এক প্রকার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। তাই এতটুকু উপলব্ধি করতে পারিনি মাত্র দশ বছরের আমার দ্বারা এই চুরি করা অসম্ভব।
____
এসব ভাবছি আর কান্না করছি। এভাবেই রাত কেটে যায়। সকাল হলে মা দরজা খুলে বাহিরে বের হয়। আমি মায়ের পা জড়িয়ে বলি,“আম্মা আমাকে ক্ষমা করে দাও। আম্মা আমি আর কখনো চুরি করবো না। আম্মা…।”
মা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বারবার মাকে অনুরোধ করি কথা বলার জন্য। অতঃপর মা বলে,“একটি শর্তে আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি।”

”তোমার যেকোন শর্ত আমি মানতে রাজি আম্মা। আমি তোমার কথায় সব করতে পারি। বলো আম্মা কী করতে হবে?”
আমার এই কথা শুনে মা নিরব চোখে আমার দিকে তাকায়। আমার বুকের ভেতর অন্যরকম উদ্দীপনা, এই বুঝি মা এমন কিছু বললো যাতে আমার সব থমকে যায়। অতঃপর মা বলে….


চলবে,