#শব্দহীন_প্রণয়কাব্য(চৌদ্দ)
#Mst.Shah Mira Rahman
অতীত
রাজনীতিতে পদার্পণ করার কিছু বছর পর পরই হুমায়ূন জড়িয়ে যায় এক নারী পাচার চক্রের সাথে।প্রথম প্রথম শুধু প্রস্টিটিউডদের ব্যবহার করতেন বড় বড় নেতাদের হাত করার জন্য।তবে ধীরে ধীরে তিনি আরো গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে।বিভিন্ন জেলা থেকে মেয়েদের অপহরণ করে আনা হয় বিদেশে পাচার করার জন্য।আর এই কাজটা খুব নিখুঁত ভাবে করা হয়।তবে হুমায়ূন ফেঁসে গিয়েছিল।এই চক্রের সাথে সে জড়িত থাকলেও এসবের মাথা ছিল অন্য কেউ।কিন্তু পুলিশ যখন হুমায়ূনকে আটক করে তখন সে জানায় সে নিজেই এই চক্রের লিডার।সমস্ত তথ্য প্রমাণাদি ও তাই বলে।কোর্টে তিনি নিজের হয়ে কোনো সাফাই ও দেননি।সুনানি হয় তার।এবং তার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তার মৃত্যু। সুলেমানের কাছে তার মৃত্যু স্বাভাবিক মনে হয়নি।তাই সে কেসটা নিয়ে আবার স্টাডি করে এবং তার সন্দেহ হয় হুমায়ূন কে ফাঁসানো হয়েছে।সে আনোয়ারের কাছে যান কেসটাকে রিওপেন করার পারমিশন নিতে কিন্তু আনোয়ার এরকম কিছু করতে নাকচ করেন। সুলেমান কোর্টে আপিল করলেও তা বাতিল হয়ে যায়।যেহেতু এখানে সুলেমানের ব্যক্তিগত কোনো রেশ নেই তাই বিষয়টা নিয়ে সে মাথা ঘামানো বাদ দেয়।এমনি ও হুমায়ূন একেবারেই নির্দোষ ছিলেন না।তার বছর দুই পর বুশরা বাড়ি থেকে মীরার বিয়ের সম্বন্ধ আসে তার জন্য। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর আনোয়ার পা রাখেন রাজনীতিতে। তবে সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় বিরোধী দলের সাথেই বন্ধুত্বের হাত বাড়ান এই বিয়ের মাধ্যমে।মীরাকে দেখেন শাহীন মির্জা।পেশাগত দিক থেকে বাদ দিলেও ব্যক্তিগতভাবে মীরাকে তার বেশ পছন্দ হয়। সুলেমান ও পরিবারের সবার সামনে কথাটা তুললে সুলেমান তাদের পছন্দ কে সম্মান জানায়।বিয়ে হয় তাদের।ছোট্ট একটা সংসার হয়।তবে তার কিছুদিন পরই আবার বিভিন্ন জেলা থেকে একই ভাবে মেয়ে নিখোঁজ হওয়া শুরু হয়।সুলেমান সন্দেহ করে এসবকিছু হুমায়ূন কেসের সাথে সম্পৃক্ত।কিন্তু মাথা ঘামায়না কারণ এই কেস সিবিআই তদন্ত করছে।তার কিছুদিন পরই মীরার সাথে ওই দুর্ঘটনার পর কোনো একটা কারণ বশত সুলেমানের সন্দেহ যায় আনোয়ারের দিকে। তথ্য ঘেঁটে দেখা যায় তার সন্দেহ সত্যি।তিনি ও জড়িয়ে পড়েছেন ওই চক্রের সাথে।ওদের কাজ খুব নিখুঁত।কোনো প্রমাণ ছাড়াই নিজেদের মিশন কম্প্লিট করে। হুমায়ূনের মৃত্যুর পেছনেও আনোয়ারের পরিকল্পনা আছে।
এসব কিছু জানার পর সিদ্ধান্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তার বাবা এতবড় অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছিল সে ধারণা ও করতে পারেনি। সিদ্ধান্ত তাকালো সুলেমানের দিকে।নিভে আসা কণ্ঠে বলল,
“আর এখন আপনি আমাকে এই কেসে যুক্ত করতে চাইছেন।আমি কি করতে পারি এখানে?”
“খুব বেশি কিছু নয়।তুমি রাজনীতিতে পদার্পণ করেছ। তোমার চাচাও এসবের সাথে জড়িত।তাই তোমার জন্যে খুব একটা কঠিন কাজ নয় এটা।তুমি শুধু ওদের সাথে জড়িয়ে তাদের সকল ইনফরমেশন আমাকে দেবে।”
“আর আমি এসব কেন করবো?”
“কারণ তুমি আমার বোনের স্বামী আর আমি তার ভাই।”
সিদ্ধান্ত চমকে তাকালো সুলেমানের দিকে।
“আপনি জানেন সব?”
“সব।”
“মানে আমাদের বিয়ের দিন থেকে শুরু করে সব জানেন।আপনি চাইলে আটকাতে পারতেন আমাদের বিয়ে কিন্তু আটকাননি কারন আপনি চাইতেন আমাদের বিয়েটা হোক।”
সুলেমান চুপ রইল কিছু বলল না।
“আর আপনি আমার বোনকে ও আটকানোর চেষ্টা করেন নি কারন আপনি চাইতেন এই মুহূর্তে আমার বোন দূরে থাক এসব থেকে।”
“বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার ভবিষ্যৎ সুন্দর।”
“আপনি আমাকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন?”
“যাই ভাবো তবে তুমি বাধ্য।”
সিদ্ধান্ত চুপ করে যায়। সকাল আর তার সম্পর্কটা এখনও ততটাও গভীর হয়নি।যদি সুলেমান কিছু করে হতে পারে সকাল আর তার মুখ ও দেখল না।আবার সুলেমান যে সত্যি বলছে তার সত্যতাও তো জানা উচিৎ।তাই আবার মুখ খুলল সে,
“কিন্তু এসব করতে তো সময় লাগবে।বছরও লেগে যেতে পারে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে।”
“লাগুক।তুমি শুধু তোমার কাজ চালিয়ে যাও।আর আমাদের দুই পরিবারে ঝামেলা চলছে এটাই বোঝাও তোমার চাচাকে এবং সবাইকে।তুমি আমার বোনকে বিয়ে করেছো পরবর্তীতে যেন নিজের কাজ হাসিল করতে পারো সেই উদ্দেশ্যে।এটাই এখন তোমার কাজ।আশা করি বুঝেছ।আর ততদিনে আমার বোন আমার হেফাজতে থাকবে।”
সিদ্ধান্তর হুট করেই মনে হলো সুলেমান ব্যক্তিগত জীবনে শান্ত শিষ্ট শান্তি প্রিয় মানুষ হলেও কর্মজীবনে অনেক বেশি কঠোর।
“আপনি আমার কাছে সাহায্য চাইছেন সুলেমান ভাই।তাই আপনার উচিৎ আমার সাথে নরম গলায় কথা বলা।”
সুলেমান হাসল। সিদ্ধান্তর কাঁধে চাপড় মেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো।সিদ্ধান্ত ঠায় বসে রইল সেখানে।
______
বর্তমান
বসার ঘরে সোফায় বসে গভীর মনোযোগে নিজের কাজ করছিল সুলেমান।এমন সময় হুট করে মীরা কোথা থেকে এসে তার কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরলো।সুলেমান তাকালো তার দিকে।চোখে মুখে দীপ্ততা।ভালো লাগল তার।একহাতে মীরার কোমড় জড়িয়ে অন্য হাতে তার সামনে আসা ছোট ছোট চুল গুলো গুছিয়ে দিল।
“কী ব্যাপার!আজ এত আমোদ কেন মহারানীর?”
মীরা হাসল।সুলেমানের গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বলল,
“আজ আমি খুব খুশি।”
“আর খুশির কারণ কী?”
“আজ আমার এক কলিগের স্ত্রী আমাদের হসপিটালেই বাচ্চা জন্ম দিয়েছে।মেয়ে সন্তান।বাচ্চা টাকে যখন তার বাবার কোলে দেওয়া হলো বিশ্বাস করুন সে কি কান্না তার বাবার।দীর্ঘ বারো বছর পর সন্তানের মুখ দেখেছেন তারা।আমাদের পুরো সেকসনে মিষ্টি বিতরন করেছেন তিনি।”
কথাটা বলে মীরা চুপ করল। সুলেমানের গলা জড়িয়ে ধরে আবার বলল,
“আমাদের ও তো মেয়ে হয়েছিল।তাই না সুলেমান?”
মুহুর্তেই সুলেমানের বুক ধ্বক করে উঠল। তাকালো মীরার দিকে। মীরার চোখ ছলছল করছে।
“আমাদের সন্তান যদি জীবিত অবস্থায় আপনার কোলে দেওয়া হতো তাহলে কি আপনিও এভাবেই কাঁদতেন সুলেমান?এভাবে সবাইকে মিষ্টি বিতরন করতেন?আমার না খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনি কেমন বাবা হতেন।কঠোর নাকি নরম।আপনারা বাবা মেয়ে মিলে যখন আমায় জ্বালাতেন তখন আমি ধমকে দিতাম আবার দিন শেষে আদর ও করে দিতাম। সুলেমান আমাদের এরকম একটা জীবন কেন হলো না?আমি কি বড় কোনো পাপ করে ফেলেছিলাম যার কারনে আল্লাহ আমায় এত বড় একটা শাস্তি দিলেন।আমার খুব কষ্ট হয়।সুলেমান আপনার কষ্ট হয়না।আপনি এত কঠোর কি করে হতে পারেন?আমি আর কখনো মা হতে পারবো না এটা ভাবতেই আমার কষ্ট আরো দ্বিগুন বেড়ে যায়।আপনার কি রাগ হয় আমার ওপর?আমি আর কখনো আপনাকে বাবার সুখ দিতে পারবোনা।”
“না হয় না রাগ।এবার চুপ করো মীরা।আর একটা কথা নয়।”
“সুলেমান আমরা একটা মেয়ে বাচ্চা দত্তক নেব।তাকে লালন পালন করবো।খুব ভালো মা বাবা হবো আমরা আর ও একদম আমার মেয়ের মতো হবে। আচ্ছা, আমার মেয়ে দেখতে কার মতো হয়েছিল সুলেমান?আপনার মতো নাকি আমার মতো?আমি তো ওকে চোখের দেখাও দেখতে পাইনি….”
“মীরা স্টপ।স্টপ ইট মীরা।তোমার ঘুম প্রয়োজন।অনেক রাত হয়েছে।”
“আমার ঘুম আসে না।”
“আমি ঘুম পাড়িয়ে দিই?”
“দিন।”
মীরা মাথা পেড়ে দিল সুলেমানের কাঁধে। সুলেমান মীরাকে জড়িয়ে ধরেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।এক সেকেন্ড দুই সেকেন্ড সময় পাড় হলো। সুলেমানের হাত কাঁপল।টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। সুলেমান তাকালো মীরার দিকে।মীরা ঘুমিয়ে পড়েছে।তাকে কোলে তুলে ঘরের দিকে গেল।বেডের ওপর মীরার শরীর টা আলগোছে গুছিয়ে রেখে নিজেও শুয়ে পড়ল তার পাশে।দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মীরাকে।যতটা শক্ত করে ধরলে ওপর পাশের মানুষটার সব কষ্ট শুষে নেওয়া যেতে পারে।
____
ইনস্টিটিউট থেকে সকাল বাড়ি না ফিরে সপিং মলের দিকে গেল।কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার আছে।সপিং মলে গিয়ে এদিক ওদিক না ঘুরে সোজা নির্দিষ্ট একটি সেকসনের ভেতর ঢুকলো।এদিক ওদিক ঘুরে একটা হ্যাঙার নিজের হাতে নিতেই কেউ খপ করে তার হাত ধরে ফেলল।সকাল চমকালো। তাকালো সামনের দিকে। সিদ্ধান্ত দাড়িয়ে আছে। সকাল ভয় পেয়ে গেল।এদিক ওদিক তাকালো। সিদ্ধান্ত পাত্তা দিল না সেই দৃষ্টি। চোয়াল শক্ত করে বলল,
“সমস্যা কি তোমার?আমার ফোন ধরো না কেন?রাগ করবা ভালো কথা সেই রাগ ভাঙানোর সুযোগটাতো দিবা।ফোন ধরো না কথা বলো না দেখা করো না এখন কি আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছ তুমি।কি হলো এদিক তাকাচ্ছো কেন আমার দিকে তাকাও।”
সকাল অসস্থিতে গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সিদ্ধান্ত খেয়াল করল এবার।সকালের দৃষ্টি অনুসরণ করে আশেপাশে তাকালো।সাথে সাথে মুখ হা হয়ে গেল। মেয়েদের এরিয়ায় ঢুকে পরেছে সে। খেয়াল করেনি।সিদ্ধান্ত সকালের হাতের দিকে তাকালো।একটা ইনার ধরা। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই হুট করে প্রশ্ন করে বসল,
“সাইজ কত তোমার?”
সকালের কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে লাগলো।অসভ্য লোক কি ধরনের কথাবার্তা বলছে।সকাল নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল।সিদ্ধান্ত ছাড়ল না।সকালের হাত থেকে ইনার নিয়ে ওটা রেখে দিয়ে অন্য টা তুলে সকালের হাতে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে বলতে হবে না।এটা নাও এটা বেশি মানাবে তোমায়।”
লজ্জায় কান মুখ লাল বর্ন ধারন করল সকালের।ঝটকা মেরে সিদ্ধান্তর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ইনার ছুড়ে ফেলে উল্টো হাটা শুরু করল।
“জঘন্য লোক।লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে এসেছেন এখানে?”
সিদ্ধান্ত পিছু নিল তার।
“আজব এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে? কিছুদিন পর তো আমিই এসব কিনে দেব।”
_____
সালমানের কচুতে এলার্জি আছে। বাড়িতে কচু রান্না হলে তার জন্য সবসময় অন্য তরকারি করা হয়।তবে আজ হায়াত একটা দুঃসাহসীক কাজ করেছে। সালমানের তরকারির সাথে কচুর তরকারি মিশিয়ে দিয়েছে।এবার বুঝবে মজা।তার সাথে সংসার করার সাধ মিটে যাবে।
সালমান খুব কম সময়ই দুপুরে বাড়িতে খেতে আসে।আজ তাদের এলাকাতেই একটা সমাবেশ আছে।তাকে উপস্থিত থাকতে হবে।দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে বেরোবে।খাওয়ার সময় সালমান বোঝেনি সে কি খাচ্ছে।যখন বুঝল অনেক দেরী হয়ে গেছে।প্রায় অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে। সালমান বুঝল কাজ টা কার।হুট করেই তার অভিমান হলো।বাকি যেটুকু তরকারি ছিল সবটাই খেয়ে উঠে গেল।হায়াত তাকিয়ে রইল সেদিকে।বুঝতে পারার পরও সবটা এভাবে খেল কেন?লোকটা কি রাগ করেছে?সে তো একটু মজা করেছে শুধু।হায়াত নিজের ঘরে গেল। সালমান মাথার ওপর হাত রেখে শুয়ে আছে।হায়াত ভয় পেল।এখন সালমানের পাশে শুয়ে ভাতঘুম দেওয়ার মতো সাহস তার নেই।সে চুপচাপ পড়ার টেবিলে বসে বই দিয়ে মুখ ঢাকলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই সালমান এদিক ওদিক করল।হাত দিয়ে শরীর চুলকাতে লাগলো।এক পর্যায়ে চুলকানি বাড়ল।হাত দিয়ে চামড়া ছিড়ে দেওয়ার অবস্থা।হায়াত দৌড়ে গেল।তাকালো তার দিকে।চুলকানোর জায়গায় লাল হয়ে আছে।অনেক জায়গায় চামড়া উঠে গেছে।গুটি গুটি দানা বের হয়েছে। হায়াতের বুকের ভেতর মোচড় দিলো।ভাঙা গলায় বলল,
“সালমান ভাই উঠো ওষুধ খাও।তোমার তো ওষুধ ঘরেই থাকে।”
সালমান কথা বলল না।হায়াতের কণ্ঠ ভারী হলো।সালমান কে ধরে বলল,
“উঠো না সালমান ভাই উঠো।”
সালমান উঠলো না বরং ধমক দিল,
“সমস্যা কি তোর?বিরক্ত করছিস কেন?যা গিয়ে নিজের কাজ কর।খাব না আমি ওষুধ।”
হায়াত কেঁপে দিল।ফুঁপিয়ে উঠে সালমানের হাত ধরে টানল।
“না না তুমি ওঠো ওষুধ খাও।আর এরকম করবো না।সরি।এবারের মতো সরি।ওঠো না সালমান ভাই।”
সালমান উঠলো না দেখে নিজেই ঘরের এদিক ওদিক খুজতে লাগল।সালমানের ওষুধ কোথায় রাখা সে জানে না।কাঁদতে কাঁদতে এখানে ওখানে খুঁজছে।সালমান উঠে বসল।তাকালো তার জন্য কান্নারত হায়াতের দিকে।
নারীর মন বড্ড কোমল।যেখানে ভালোবাসা পায় সেখানেই ঝুকে পড়ে।হায়াত যেন তার চাক্ষুষ প্রমাণ।সালমানের বুকের ভেতর শীতলতা ছেয়ে গেল।অভিমান গুলো ঝুড় ঝুড় করে ঝরে পরল।বিছানা থেকে উঠে গিয়ে চুপচাপ নিজের ওষুধ বের করে খেয়ে আবার শুয়ে পরল। হায়াত দাড়িয়ে থেকে দেখল। কিছু বলল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সালমান স্বাভাবিক হলো। হায়াত তখনও দাড়িয়ে।সালমান পাশ ফিরে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই মুখ খুলল।
“এসে শুয়ে পড় হায়াত।”
বলতে দেরী হায়াতের শুতে দেরী না।সালমানের পাশে শুয়ে তার দিকে কাত হয়ে রইল।দুজনের দৃষ্টি দুজনের দিকে।তাকিয়ে দেখল একে ওপরকে।সেই দৃষ্টিতে হায়াত কি খুঁজে পেল জানে না।চট করেই এগিয়ে গেল সালমানের দিকে।শরীরের সাথে মিশে মাথা চেপে ধরল তার বুকে।সালমানের মনে হলো তার হৃদস্পন্দন এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল। অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল শরীর মন।মৃদু হেসে দুই হাতে হায়াত কে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল।ঠোঁটের কোণে হাসিটা তখন ও বজায় ছিল।
চলবে🌺
(১৮+এলার্ট)
#শব্দহীন_প্রণয়কাব্য(পনেরো)
#Mst.Shah Mira Rahman
রাত প্রায় দশটা।হসপিটালের সামনে গাড়িতে বসে মীরার জন্য অপেক্ষা করছে সুলেমান। কিছুক্ষণ পর মীরা বের হলো হসপিটাল থেকে।সাথে মিনহাজ ও।হেসে হেসে কথা বলছে একে ওপরের সাথে।সুলেমান চেয়ে রইল সেদিকে। মিনহাজ মীরার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের গাড়ির দিকে গেলো।মীরা এগিয়ে এলো সুলেমানের কাছে।গাড়ির দরজা খুলে সুলেমানের পাশে বসে ঠোট প্রসারিত করে হাসল।সুলেমান চুপচাপ মীরার সিটবেল্ট বেঁধে গাড়ি স্টার্ট করলো।কিছুদূর যেতে সুলেমান নিজেই মুখ খুলল।
“কী এত কথা বলছিলে?”
মীরা বুঝল সুলেমান মিনহাজের কথা বলছে।মুখের হাসি বজায় রেখেই বলল,
“তেমন কিছু না।”
“যেভাবে হাসছিলে মনে তো হচ্ছে অনেক কিছুই।”
মীরা তাকালো সুলেমানের দিকে।মুখশ্রী গম্ভীর ধারন করে আছে।মীরা খানিকটা জ্বালাতে চাইল সুলেমান কে।শান্ত গলায় উত্তর দিল,
“ও আমার কলিগ সুলেমান।দুই একটা কথা তো হবেই।”
“হুম…কলিগ হওয়ার সাথে তোমাকে বেশ পছন্দ ও করে।”
“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?ও জানে আমি বিবাহিতা।আমার হাজবেন্ড আছে।এসব জানার পর ও আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।একদিক থেকে বাদ দিলেও ছেলেটা অনেক বেশি আমায়িক।সবার সাথে হেসে খেলে কথা বলে।সবাই তাকে বেশ পছন্দ করে।এরকম একজন বন্ধু থাকাটাও ভাগ্য।”
সুলেমানের চোয়াল শক্ত হলো।মুখের অভিব্যক্তি একই রেখে বলল,
“কাল থেকে তুমি হসপিটালে আসবে না। তোমার ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করছি আমি।”
মীরা চমকালো। অবাক দৃষ্টি ফেলল সুলেমানের দিকে।
“ট্রান্সফার!কিন্তু কেন?”
“কারণ আমি বলছি।”
“সুলেমান সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছেন কেন আপনি?আমি তো মজা করছিলাম শুধু।”
“এটা নিয়ে একটা কথাও শুনতে চাই না আমি।”
“শুনতে হবে আপনাকে।আপনি সবকিছু আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।কিন্তু কেন? আমার দোষটা কোথায়?”
মীরার কথা শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি থেমে গেল।মীরা আশেপাশে তাকালো।তারা এপার্টমেন্টে চলে এসেছে।মীরা সুলেমানের দিকে তাকালো।সুলেমানের দৃষ্টি তখনও সামনে।মীরা হকচকিয়ে উঠল।
“আপনি যাবেননা উপরে?”
“না।”
“কেন?”
“কাজ আছে আমার।”
মীরা বুঝল সুলেমানের রাগ।এক হাতে সুলেমানের শার্টের কোণা খামচে ধরে বলল,
“না আপনি আমার সাথে যাবেন।প্লিজ সুলেমান প্লিজ।”
“আমার দেরী হচ্ছে মীরা।”
মীরার চোখ ছলছল করে উঠলো।গাঢ় অভিমানে মুখ ভার হলো।গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল গুলো হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে গাড়ি থেকেই বেরিয়ে গেলো।কিয়ৎক্ষণ সুলেমানের দিকে তাকিয়ে থেকেও আশানুরূপ কোনো ফল না পাওয়ায় মীরা হনহন করে এপার্টমেন্টের ভেতর ঢুকে পড়ল। সুলেমান ঠায় বসে রইল।প্রিয় নারীর মুখে অন্যকারো প্রসংসা কোনো পুরুষেরই সহ্য হয় না।আর সেই নারী যদি হয় তার স্ত্রী তার একান্ত ব্যক্তিগত নারী তাহলে তো কথাই নেই। সুলেমান এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল।সাথা সাথে ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠল।
“এসে গেছি।এবার চলে যান আপনি।”
লেখাটির ওপর নজর বুলিয়ে সুলেমান গাড়ি স্টার্ট করলো।নিজের ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল মীরা।নিষ্ঠুর লোক সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে।
____
রাত প্রায় বারোটা।নিস্তব্ধ নির্জন রাত।একটি শুনশান রাস্তার একপাশে গাড়ি থামালো সুলেমান।রাস্তার দুই ধারে ঘন জঙ্গল।দিনের বেলাতেও এখানে খুব একটা মানুষ আসা যাওয়া করেনা।রাতের বেলা তো কথাই নেই।এই আবছা অন্ধকার শুনশান রাস্তায় গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ঠোঁটে সিগারেট ধরালো সুলেমান।নিকোটিনের ধোঁয়া অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সামনে দিয়ে একটি লোক চলে গেল।যাওয়ার সময় তার হাত থেকে ফাইলের ন্যায় কিছু একটা পড়ল। সুলেমান নড়ল না।রয়ে সয়ে নিজের সিগারেট শেষ করে তা রাস্তায় ফেলে পায়ের বুট দিয়ে পিষে ফেলল।অতঃপর এগিয়ে গেল সেই ফাইলের দিকে।নিচু হয়ে ফাইল হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে গেল।জানালা দিয়ে ফাইল গাড়ির ভেতর রাখতেই কোথা থেকে তীব্র বেগে একটা বুলেট এসে লাগল সুলেমানের গাড়ির দরজায়। টার্গেট মিস বুঝল সুলেমান।সময় নষ্ট না করে ওপর পাশে গিয়ে গাড়ির আড়ালে বসল। কোমড়ের পেছন হতে সরকারি রিভলবার বের করে সাইলেন্সার লাগিয়ে খুব সন্তঃর্পণে তাকালো অপরপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘেরা জঙ্গলের দিকে।কান খাড়া করে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ম করলো।অতঃপর আবার নিজের জায়গায় বসে ফোন বের করে কল করল তার এসিস্ট্যান্ট আসিফ কে।সাথে সাথে রিসিভ হলো,
“স্যার!”
“আমাকে অ্যাটাক করেছে ওরা।”
“এখন কোথায় আপনি?”
“লোকেশন অন আছে আমার।”
“আমি এক্ষুনি পুলিশ নিয়ে আসছি।”
“সাথে এম্বুলেন্স ও এনো।”
সুলেমান ফোন কাটলো।হাতের রিভলবার আবার নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে সামনের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল মুহুর্তের মধ্যে।
বেশ কিছুক্ষণের মাঝেই আসিফ পুলিশ ও এম্বুলেন্স নিয়ে হাজির হলো সেখানে। সুলেমানের গাড়ি দেখে থামল তারা।আশেপাশে কাউকে না পেয়ে এদিক ওদিক খুঁজল।এরই মাঝে দুই হাতে কালো মোটা মতোন দুটো লোককে টানতে টানতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো সুলেমান।লোকদুটোর অবস্থা মর মর।পুলিশ দের দেখে পিচঢালা রাস্তায় ছুড়ে ফেলল তাদের।মুখে বলল,
“ওখানে আরো তিন জন আছে।ভালো ভাবে খাতির যত্ন করবেন এদের।আমি কাল আসবো।”
এম্বুলেন্সের সাথে আসা দুটো নার্স ধরা ধরি করে তাদের এম্বুলেন্সে ওঠাতে লাগলো।আসিফ এগিয়ে গেল সুলেমানের দিকে।
“স্যার আপনি ঠিক আছেন?”
“হুম।এদিকটা তুমি সামলাও আমায় যেতে হবে।”
“ওকে স্যার।”
সুলেমান আর এক মুহূর্ত দেরী না করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।নজর পরল গাড়ির দরজায়।স্ক্রেচ পড়ে গেছে।খানিকটা বেঁকেও গেছে। সুলেমানের চোয়াল শক্ত হলো।নিজের জিনিসের ওপর কোনো আঁচড় সহ্য হয় না তার।ঘুরে আবার ফিরে এলো ওই লোকগুলোর কাছে।তাদের মাঝে একজনের মুখ বরাবর ঘুষি বসালো।বাম হাত দিয়ে নাকের ডগায় ঘাম মুছে হিসহিসিয়ে শব্দ উচ্চারণ করল,
“ব্লাডি বা*স্টার্ড।”
এতক্ষণ যাবৎ আধমরা লোকটা সুলেমানের শক্ত হাতের ঘুষি খেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল।পুলিশ রা নার্সরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল সুলেমান কে।সুলেমান পাত্তা দিল না তাদের দৃষ্টি।আবার এগিয়ে গেল নিজের গাড়ির দিকে।
_____
মীরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।তার অবচেতন মন বলছে লোকটা আসবে।রাগ করে কখনোই তার থেকে দুরে থাকবে না সুলেমান।থাকতে পারে না।মীরা ঘড়ির দিকে তাকালো।একটা বাজে।এখনো আসছে না কেন?তাহলে কী সত্যিই আসবে না।মীরার কান্না পেল।সে কি এমন বলেছিল যার কারনে এত রাগ দেখাচ্ছে সুলেমান।তারও তো অভিমান হয়েছে।তার অভিমানের কি হবে?মীরার ভাবনার মাঝেই এপার্টমেন্টের সামনে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো।চমকে উঠে সেদিকে তাকালো মীরা। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।দৌড়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খোলার আগেই দরজা খুলে দিল মীরা।সুলেমান অবাক হলো।মীরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“ঘুমাও নি এখনো?”
মীরা উত্তর দিল না ঝাপিয়ে পড়ল সুলেমানের বুকে। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“আমি ভেবেছি আপনি আসবেন না।”
সুলেমান হাসল।দুই হাতে তাকে জড়িয়ে শূন্যে তুলে ভেতরে ঢুকল।দরজা লাগিয়ে তার সাথেই চেপে ধরল মীরার ছোট্ট শরীরটা।মীরা তাকালো সুলেমানের দিকে।চোখাচোখি হলো।মৃদু কণ্ঠে সুলেমান আবার প্রশ্ন করল,
“মিস করছিলে?”
মীরা এবার সুলেমানের বাদামী ঠোঁটের দিকে তাকালো।তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেল।শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“হুম।”
সুলেমানের দৃষ্টি এলোমেলো হলো।বৈধ ইচ্ছেরা প্রবলভাবে হানা দিল। জড়িয়ে আসা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“আমিও।”
আর এক মুহূর্ত দেরী নয়।দুই জোড়া অধর মিলিত হলো।শুষে নিতে চাইলো একে ওপরের সুধা।মীরা দুই হাতে জড়িয়ে ধরল সুলেমানের গলা। সুলেমান চুম্বনরত অবস্থাতেই তাকে কোলে তুলে ঘরে ভেতর এলো।বেডের ওপর ফেলল মীরার শরীরটা।দুই হাতে নিজের শার্ট খুলে ছুড়ে ফেলল দূরে কোথাও।ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকা মীরা তাকালো সুলেমানের শক্ত পক্ত শরীরের দিকে।সুলেমান ঝুঁকে এসে মুখ ডোবালো তার গলদেশে।নাক টেনে ঘ্রাণ নিল মীরার শরীরের। এলোমেলো অগোছালো মীরা সুলেমানকে নিজের আরো কাছে টেনে নিল।মিলে মিশে একাকার হলো দুটো শরীর দুটো মন।মধুকর হলো আরো একটি রজনী।
____
সালমান বাড়ি ফিরল রাত বারোটা বাজে। হায়াত তখন পড়ার টেবিলে বসে ঝিমুচ্ছে।তাকে এভাবে টলতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল সালমান।হায়াতের হাত থেকে বই সরিয়ে নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল তার দিকে।হায়াতের ঘুম হালকা হলো।চোখে মেলে সামনে তাকাতেই চমকে উঠল।নিজের এতো কাছে সালমান কে দেখে হুট করেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। সালমান বিরক্ত হলো।ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,
“এভাবে ঝিমুচ্ছিস কেন?ঘুমাতে সমস্যা কি?”
“তুমি এতো রাত করে বাড়ি ফেরো কেন? তাড়াতাড়ি ফিরলে সমস্যা কি?”
সালমানের ভালো লাগলো কথাটা।হায়াতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কেন,বাবুর আম্মু কি অপেক্ষা করছিলো?”
হায়াত চমকালো।বসা থেকে উঠে বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল,
“মোটেই না।”
সালমান আটকে দিল হায়াত কে।দুই হাতে পেছন থেকে জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল তাকে।কাঁধের ওপর ঠোঁট চেপে বলল,
“সত্যি!”
কেঁপে উঠলো হায়াত।নরম হলো হৃদয়। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো।ঘুরে দাঁড়ালো সালমানের দিকে।দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি কখনো তোমার বাবুর আম্মু হবো না।”
সালমান হায়াতের নাকে নাক ঘষে বলল,
“তাহলে কার বাবুর আম্মু হবি?”
“আমার স্বামীর।”
সালমান হাসল। গলায় কৌতুক মিশিয়ে বলল,
“তোর স্বামীর হাত পা ভেঙে ফেলে রাখবো সাহস কত বড় আমার বউয়ের দিকে নজর দেয়।”
“হুহ,ওতো সহজ নাকি?আমার স্বামী অনেক শক্তিশালী আর অনেক সাহসী।দেখনি কেমন তোমার বউকে জোড় করে বিয়ে করেছিল।”
সালমান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। হায়াত কে লজ্জা দিতে বলল,
“হুম,সাথে বাসর টাও।”
কিন্তু হায়াত কেনো জানি লজ্জা পেল না।খিল খিল করে হেসে উঠলো। সালমান তাকিয়ে রইল সেই সম্মহনী হাসির দিকে।
চলবে🌺