শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১
Sidratul Muntaz
” তুই কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিস? সেই এক বাচ্চার বাপকেই বিয়ে করবি?”
দিবা নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। তার মধ্যে কোনো সংকোচ, জড়তা কিংবা দ্বিধা দেখা যায় না৷ রেবা অনেক অবাক হয়। ঈশানের একটি চারবছরের মেয়ে আছে। নাম রোজা।সে বাক-প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না জন্ম থেকেই। এছাড়া ফ্যামিলিতে তেমন কেউ নেই। শুধু তার বাবা আর ডিভোর্সী এক ফুপু থাকে। রোজার দেখা-শুনা ফুপুটিই করেন। এমন একজনকে বিয়ে করতে দিবার কোনো আপত্তি নেই?
পুনরায় রেবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে,” তুই কি সত্যিই বিয়েতে রাজি?”
কিন্তু প্রশ্ন করে না রেবা। সে জানে দিবার উত্তর এবারও একই হবে। বার-বার প্রশ্ন করে উত্তর বদলানো যায় না। তবে রেবার খুব হতাশ লাগছে। তার এতো মিষ্টি একটা বোন! তাকে জলে ভাসিয়ে দিতে বিবেকে বাঁধছে। কিন্তু নিজে থেকেই যে ভাসতে চায় তাকে আটকানোর উপায় কি?
রেবার স্বামী তুহিন বলে,” পাত্রপক্ষকে কি তাহলে আসতে বলবো?”
রেবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অবহেলার স্বরে জবাব দেয়,” বলো।”
তুহিনের চেহারা ঝলমল করছে। খুব আগ্রহের সহিত সে মোবাইল হাতে তুলে ফোন করে। রেবা তুহিনের এতো আগ্রহের কারণটা বুঝতে পারছে না। লোকটা কেন এতো খুশি হচ্ছে এই বিয়ে নিয়ে? তার বোনটা জলে ভেসে যাচ্ছে। অথচ তার কি আনন্দ!
তুহিন যথারীতি ঈশানদের বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেয়। তার এই বিয়ে নিয়ে ব্যাপক আনন্দিত হওয়ার পেছনে যথোপযুক্ত কারণ আছে। ঈশান তার অফিসের বস। এখন থেকে সে হবে বসের দুলাভাই। তার প্রোমোশন ঠেকায় কে?
পরদিনই ঈশানের ফুপু আয়েশা সিদ্দীকা আসেন দিবাকে আংটি পরাতে। অফিসে একদিন দিবা তুহিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সেখানেই আয়েশা দিবাকে দেখে পছন্দ করে ফেলেন। ভাইপো’র বিয়ে নিয়ে তার আগ্রহ সীমাহীন। যদিও ঈশান এই ব্যাপারে একটু উদাসীন। কিন্তু আয়েশা শপথ নিয়েছেন, বেঁচে থাকতে তিনি ঈশানকে দ্বিতীয় বিয়ে অবশ্যই করাবেন।
ভদ্রমহিলা একদম ন্যাকার ষষ্টী। দিবাকে জড়িয়ে ধরে সে কি নাটুকে কান্না তার! রেবার চূড়ান্ত বিরক্ত লাগছে। আয়েশা কান্নাকাটির পাশাপাশি গল্পও জুড়ে দেন। ঈশানের প্রথম বউয়ের সাথে কিভাবে ছাড়াছাড়ি হয়, ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ঈশান কিভাবে এতোবছর ধরে একা আছে, কত স্ট্রাগল করেছে জীবনে, তালে তালে এটাও বলে ফেললেন যে ঈশান বিয়েতে রাজি নয়। এই কথা শোনার সাথে সাথে রেবার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। ঝাঁঝালো স্বরে রেবা প্রশ্ন করে,” কি বললেন? ঈশান বিয়েতে রাজি নয়?”
ভদ্রমহিলা সাথে সাথে কথা ঘুরিয়ে ফেলেন। মেকি হাসি দিয়ে বলেন,” রাজি হতেই তো চাইছিল না। কত মেয়ে দেখেছি! কাউকে পছন্দ করেনি। কিন্তু দিবার কথা শোনার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল। আর রাজি না হয়ে কি উপায় ছিল? এতো সুন্দর তোমার বোনটা। মাশআল্ললাহ, মাশআল্লাহ। মুখের দিকে তাকালেই তো নয়ন জুড়িয়ে যায়।”
আয়শা দিবার চিবুক ছুঁয়ে সেই হাতে চুমু খান। কিন্তু রেবার সন্দেহ তখনও কমে না। প্রশ্ন করে সতর্ক গলায়,” তাহলে আপনি একা এলেন কেন? ঈশান রাজি থাকলে তো তারও আসার কথা।”
” আরে, ঈশান আসলে কেমন সেটা তোমার স্বামী তুহিন খুব ভালো করে জানে। ও সবার থেকে একটু অন্যরকম। মানুষের সামনে আসতে চায় না। তুমি চিন্তা কোরো না তো মা। এই বিয়েতে ঈশান রাজি। নাহলে আমাকে পাঠাতো নাকি?”
রেবা মনে মনে স্বগতোক্তি করে,” এতো অস্বস্তি থাকলে বিয়ে করার দরকার কি? শুধু শুধু আমার বোনের জীবনটা নষ্ট!”
আদরের বোন বলে স্বেচ্ছায় বি’ষপানের জন্য কিছু বলতেও পারছে না রেবা দিবাকে। মা-বাবার মৃ’ত্যুর পর থেকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছে ছোট্ট বোনটিকে। আর সেই বোনের এখন বিয়ে। তাও ডিভোর্স হয়ে যাওয়া এক বাচ্চার বাপের সাথে। কি দুঃখজনক একটা ব্যাপার!
পাকা কথা হয়ে যায়। বিয়ে হবে সামনের মাসেরই প্রথম সপ্তাহে। এই নিয়েও রেবার আপত্তি। চলতি মাস শেষ হতে আর মাত্র দশদিন। এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ের আয়োজন কেন?
গায়ে হলুদের ঠিক আগের রাতে দিবা ঈশানের বাড়িতে হাজির হয়। ঈশান বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে। রোজা মাত্র ঘুমিয়েছে। সে বারান্দা থেকেই দেখে অন্ধকার রাস্তায় একটি মেয়ের ছায়ামূর্তি। দারোয়ানের সাথে মেয়েটি তর্ক করছে বাড়িতে ঢোকার জন্য। দারোয়ান তাকে চিনতে পারছে না বলে ঢুকতে দিচ্ছে না। একটু পরেই ইন্টারকমে ফোন আসে। নিশ্চয়ই দারোয়ান ফোন করেছে। ঈশান ফোনটা কানে ধরতেই দারোয়ান সালাম দেন এবং বলেন,” স্যার, দিবা আপা এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।”
ঈশান যারপরনাই বিস্মিত। দুইদিন বাদেই যার সাথে ঈশানের বিয়ে সে এসেছে দেখা করতে। তাও এতো রাতেরবেলা। ঘটনা কি? হঠাৎ করেই ঈশানের মনে হয়, দিবা তার কাছে আসবে বিয়ে ভাঙার অনুরোধ নিয়ে। যদি সত্যিই তেমন হয়, তাহলে খুব বিরক্তিকর ব্যাপার হবে। ঈশান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” আসতে দাও।”
দিবার গায়ে ফুলের কাজ করা সেলোয়ার কামিজ। মাথায় ঘোমটা। সে নত মাথায় বসে রয়েছে ঈশানের সামনে। ঈশান তাকে কোনো প্রশ্ন করে না।চুপচাপ চেয়ে থাকে। এমনিতেও সে প্রয়োজনের তুলনায় কম কথা বলে। আর এই মেয়েটির সাথে তার কথা বলতে একটু অস্বস্তিই হচ্ছে।
দিবা নীরবতা ভাঙে,” আপনার সাথে আমার খুব জরুরী কথা ছিল।”
ঈশান টেবিলের দিকে ঝুঁকে এসে বলে,” সেটা বুঝতে পারছি। জরুরী কথা না হলে নিশ্চয়ই এতোরাতে এভাবে বাড়ি আসতেন না।”
দিবা ইতস্তত করে বলে,” আসলে, আপনার ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই। তুহিন ভাইয়ের কাছে চাইতেও লজ্জা লাগছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনিই আমার নাম্বার নিয়ে আমাকে ফোন করবেন। সেই অপেক্ষাতে ছিলাম। কিন্তু বিয়ের তারিখ ঘনিয়ে এলো। আপনার ফোন এলো না। আমাদের আলাদা করে একটিবার কথা বলাও হলো না।”
ঈশান ঠান্ডা দৃষ্টিতে বলে,” আপনি কি তাহলে এই রাতের বেলা আমার সাথে আলাদা করে কথা বলতে এসেছেন? দিনে এলেও পারতেন।”
” রাতে এসে যদি আপনাকে বিরক্ত করে থাকি সেজন্য স্যরি।”
” স্যরি বলার কিছু নেই। আমি বিরক্ত হইনি। আপনাকে চা দিবো?”
” চা কে বানাবে?”
” আমিই বানাবো। আসলে এই বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই। সব কাজ আমি নিজেই করি।”
” আচ্ছা দিন।”
” আপনি বসুন।”
ঈশানের কণ্ঠে তীব্র আন্তরিকতা। এই আন্তরিক মানুষটি কি দিবার সমস্যা বুঝবে? দিবা ভরসা পাচ্ছে আবার পাচ্ছে না৷ তার কি বলা উচিৎ, সে কি চায়?
কিছুক্ষণ পর ঈশান চা নিয়ে আসে। সাথে ড্রাই কেক। দিবা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,” আমি অবিবাহিত একটি মেয়ে হয়ে কেন আপনার মতো একজনকে বিয়ে করতে রাজি হলাম, এই নিয়ে আপনার কখনও কৌতুহল জন্মায়নি?”
” না। কিন্তু আজ জন্মাচ্ছে। আপনাকে দেখার পর থেকে।”
দিবা অবাক হয়ে বলে,” মানে? এর আগে কি আপনি আমাকে দেখেননি?”
ঈশান অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,” না। আজ আপনি বাড়িতে না এলে একেবারে বিয়ের দিনই দেখা হতো।”
দিবা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার চায়ের কাপে চুমুক দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। এই যুগে সম্পূর্ণ না দেখে বুঝি কেউ কাউকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়? অথচ আয়েশা আন্টি যেদিন দিবাদের বাড়ি এলেন সেদিন তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, দিবা যথেষ্ট সুন্দরী বলেই ঈশান তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু আজ ঈশান বলছে অন্য কথা! দিবা প্রশ্ন করে,
” আমাকে দেখার পর কৌতুহল জন্মালো কেন?”
” আপনি অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে। আমার মতো ডিভোর্সি লোককে বিয়ে করার কোনো কারণ দেখছি না। চাইলেই আরও অনেক ভালো পাত্র পেতেন।”
দিবা মাথা নিচু করে বলে,” ডিভোর্সি তো কি হয়েছে? আপনি বিত্তবান মানুষ। হতে পারে আমি আপনার নাম, যশ, খ্যাতি আর টাকা-পয়সা দেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছি!”
” উহুম। আপনাকে দেখে আমার সেরকম মনে হচ্ছে না।”
” আপনি বুঝি চেহারা দেখেই মানুষ চিনে ফেলেন?”
ঈশান হাসে সামান্য। কিছু বলে না। দিবা বলে,” দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমি আপনার ক্ষমতার জন্যই আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। আপনি যদি সাধারণ মানুষ হতেন তাহলে আমি আপনাকে বিয়ে করতাম না।”
” ও আচ্ছা। এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু চাই রোজার জন্য একজন আদর্শ মা…” ঈশান কথা শেষ করার আগেই দিবা হড়বড় করে বলে,
” আপনি যা চান তাই হবে। আমি রোজাকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করবো। তাকে কখনও মায়ের অভাব বুঝতে দিবো না। কিন্তু…”
ঈশান তাকায় গভীর চোখে। খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলে,” আমি এখনও আমার কথা শেষ করিনি!”
দিবা একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মিইয়ে গিয়ে বলে,” ঠিকাছে, আগে আপনি শেষ করুন।”
” বিয়েতে আমার আগ্রহ ছিল না এটা ঠিক। তবে আমার বিয়ের প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। উপযুক্ত মেয়ে খুঁজে পাইনি বলেই রাজি হচ্ছিলাম না। রোজার জন্য যেমন আদর্শ মা দরকার তেমনি নিজের জন্যও আমার আদর্শ একজন স্ত্রী দরকার। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন? শুধু আমার মেয়ের দায়িত্ব না, আপনাকে আমার দায়িত্বও নিতে হবে। ”
দিবা হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। এই আধদামড়া বেটা বলে কি? তার দায়িত্ব দিবা কি করে নিবে? তার মেয়ের মতো তাকেও কি কোলে বসিয়ে খাওয়াতে হবে? প্রথমে তো বিয়েতেই মত দিচ্ছিল না আর এখন দিবাকে দেখার সাথে সাথে তার আদর্শ বউয়ের প্রয়োজন মনে পড়ল? সব পুরুষ জাত এক! যাক সেসব কথা, দিবা নিজেকে সামলে বলে,” ঠিকাছে, তবে আমারও একটা শর্ত আছে।”
ঈশান এতোক্ষণে বুঝতে পারে এই রাতের বেলা হুট করে দিবার এই বাড়িতে ছুটে আসার কারণ৷ ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি নিয়ে প্রশ্ন করে,” শুনি কি শর্ত?”
” রাফিন নামের একজনকে আপনার চাকরি দিতে হবে। আর চাকরিটা যেন পারমানেন্ট হয়।”
” কে এই রাফিন?”
দিবা নিঃসংকোচে বলে,” আমার বয়ফ্রেন্ড।”
ঈশান চায়ে চুমুক দিতে নিয়েও বিষম খায়। চায়ের কাপ উলটে তার উরু ভিজে যায়।
চলবে।