#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ৯( ১ম অংশ)
Sidratul Muntaz
রেস্টুরেন্টের পরিবেশটা বাচ্চাদের জন্য বেশ উপযোগী। রোজা এখানে এসে খুব উৎফুল্ল বোধ করছে। নেটের খেলনা ঘরটার ভেতরে ঢুকে রঙিন রঙিন সব বলগুলো নিয়ে খেলছে, স্লিপারে উঠছে, অন্য বাচ্চাদের সাথে হাসি-মজা করছে। মাত্র এই কিছুক্ষণেই দু’টো মেয়ের সাথে তার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।
দিবা দূর থেকে নজর রাখছে রোজার উপর। মেয়েটাকে দেখতে প্রাণোচ্ছল লাগছে। তার ঘন- লম্বা চুলের দু’টো মোটা বেনী দুই পাশে দুলছে। কি মিষ্টি লাগছে! দিবার মাঝে মাঝে মনে হয়, রোজা যদি তার নিজের বাচ্চা হতো তাহলে ব্যাপারটা মন্দ হতো না। এমন মিষ্টি একটা মেয়ের মা হওয়াও তো সৌভাগ্যের বিষয়!
রোদেলা তাকিয়ে আছে দিবার দিকে। তাদের সামনে বিভিন্ন ধরণের খাবার। কিন্তু দিবা কিছুই খাচ্ছে না। কারণ সবকিছু রোদেলা অর্ডার করেছে। বোধহয় সে লজ্জা পাচ্ছে খেতে। রোদেলা শরবতে চুমুক দিয়ে বলে,” তুমি খাচ্ছো না কেনো দিবা?”
” আমার ক্ষিদে নেই।” গম্ভীর মুখে এই কথা বলে দিবা। তারপর পুনরায় রোজার দিকে তাকায়।
রোদেলাও সেদিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভঙ্গিতে বলে,” তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, রোজাকে আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য। আমি তোমার এই উপকার সবসময় মনে রাখবো।”
দিবা শক্ত মুখে বলে,” আমি আপনার জন্য কিছু করিনি। সবটা রোজার জন্য করেছি। কারণ ও আপনাকে খুব দেখতে চাইছিল। ওইটুকু একটা বাচ্চাকে মায়ের থেকে আলাদা করার মতো নিষ্ঠুরতা আর কিছু হয় না। আমি ঈশান সাহেবের এই বর্বরতাকে সাপোর্ট করি না৷ সেজন্যই রোজাকে নিয়ে এসেছি।”
রোদেলা কিঞ্চিৎ হেসে প্রশ্ন করে,” এর মানে তুমি যে রোজাকে আমার সাথে দেখা করতে এনেছো, এটা ঈশান জানে না, তাই তো?”
” না। জানে না উনি।”
” তুমি নিশ্চিত? ও কিছুই জানে না?”
দিবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়,” কি বলতে চান?”
রোদেলার ঠোঁটে কেমন একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটে ওঠে৷ সে খানিকটা ফিসফিস করে বলে,” ঈশান যে কতটা টক্সিক, সেই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই দিবা। তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে জানার পরেও ও এখনও তোমার পেছনে নজরদারি করতে লোক লাগায়নি এই কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
দিবার মুখের র’ক্ত সরে যায়। আ’তঙ্কে কেমন সাদা হয়ে আসে চেহারা। ঈশান সাহেব এটা করতেই পারেন। যদি আসলেই করে থাকেন তাহলে ভীষণ খারাপ হবে। দিবা মিথ্যা কথা বলে রোজাকে নিয়ে এসেছে। এই কথা ঈশান সাহেব জানলে কেলেংকারী কান্ড ঘটে যাবে।
রোদেলা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে। দিবা কঠিন মুখে বলে,” হাসছেন কেন?”
” তোমার ভ’য় পাওয়া দেখে হাসি পাচ্ছে। এখনি স্বামীকে এতো ভ’য় পাও? বাকি সময় তো পরেই আছে।”
” আমি ভ’য় পাচ্ছি সে কথা আপনাকে কে বলল? শুধু একটু অবাক হয়েছি।”
” তুমি কি জানো আমাদের বিচ্ছেদ কেনো হয়েছিল?”
” না, কেউ আমাকে এই ব্যাপারে কিছু জানায়নি৷ আয়েশা ফুপু একবার বলতে চেয়েছিলেন। আমি শুনিনি।”
রোদেলা টেবিলের উপর হাত দু’টো জড়ো করে তার উপর থুতনি ঠেকিয়ে বলে,” তাহলে আমি বলছি শোনো। বিয়ের প্রথম থেকেই ও খুব সন্দেহপ্রবণ ছিল। সবসময় আমাকে কন্ট্রোল করতে চাইতো। আমি কোথায় যেতাম, কি করতাম, কোন ধরণের পোশাক পরতাম, কাদের সাথে মিশতাম, সব বিষয়ে ওর কৌতুহল ছিল সীমাহীন। আমাকে যেন ওর পছন্দমতোই চলতে হবে, ওর পছন্দের কাজই করতে হবে, আমার নিজের বলতে কোনো জীবনই ছিল না৷ এক পর্যায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ”
কথাগুলো বলতে বলতে রোদেলা একটু থামে। সামান্য হাঁফ ছেড়ে আবার বলতে থাকে,” বিয়ের আগে আমার একজন প্রাক্তন ছিল। এই কথা আমি ঈশানের থেকে গোপন করেছিলাম৷ সামহাউ ও এই বিষয়টা জানতে পেরে যায়। তখন রোজার বয়স মাত্র আড়াই বছর। আমি না এতো দ্রুত বাচ্চা নিতে চাইনি জানো দিবা? কিন্তু ঈশান বাচ্চা চেয়েছিল। শুধু ওর জন্য বাধ্য হয়ে আমি কন্সিভ করেছিলাম। আর মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কখনও ঈশানকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করিনি। ওর হাজারো টর্চার সহ্য করে থেকে যেতে চেয়েছিলাম।
ও ছোটখাটো বিষয়ে অযথাই এতো রিয়েক্ট করতো! জানো একবার শুধু ওকে না জানিয়ে আমি আমার বন্ধুদের সাথে ট্যুর প্ল্যান করেছিলাম বলে ও আমার হাত কেটে দিয়েছিল। ওকে না জানিয়ে আমি যেতাম না, শুধু প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু কোথা থেকে যেন ও শুনে এসে ঘরে ভাঙচুর শুরু করল। গ্লাস ভেঙে সেই কাঁচ দিয়ে আমার হাত কেটে দিল।”
দিবা বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রোদেলা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,” বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না? ও যে এমন সাইকো সেটা ওকে উপর থেকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। তো আমার প্রাক্তনের ব্যাপারটা জানার পর ও কি করল জানো? শারীরিক ও মানসিকভাবে আমার উপর টর্চার শুরু করল। এতো মার-ধোর করতো যে আমি মা’রাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমার একটাই দোষ, কেনো ওর থেকে এই কথাটা গোপন করলাম। ওর ধারণা আমি ওকে ধোঁকা দিয়েছি। কিন্তু আদৌ কি এটাকে ধোঁকা দেওয়া বলে? আমি আমার অতীতের সবকিছু ভুলে ওর সাথে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু ও কি করল? আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিল৷ হাত-পা ভেঙে আমাকে ঘরে বসিয়ে রাখতে চাইল৷ শেষমেষ আমি ওর থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম কারণ এভাবে আর পারছিলাম না। যদিও ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা ঈশান আগেই নিয়ে রেখেছিল। তারপর দুই পরিবারের মধ্যে শালিশ বসে, শেষ পর্যন্ত আমাদের মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে যায়।”
কথা শেষ করে রোদেলা চোখ তুলে তাকায় দিবার দিকে। মাথা নিচু করে কিছু একটা চিন্তা করছে সে। রোদেলা দিবার হাতের উপর হাত রেখে বলে,” তুমি ভেবো না, আমার সাথে যা হয়েছে তোমার সাথে সেসবের কিছুই হবে না। মানুষ একই ভুল বার-বার করে না। এখন হয়তো ঈশান অনেকটা বদলে গেছে। মেয়ের দায়িত্ব পুরোটা ওর কাঁধে তো, তাই হয়তো নিজেকে সংশোধন করেছে। তবুও তুমি সাবধানে থেকো। ছোটবোন মনে করে তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি। যদি বিয়ের খবরটা আগে জানতাম, তাহলে আমি আরও আগে তোমার সাথে দেখা করতাম। আর তোমাকে এই বিয়ে করতে নিষেধ করতাম। কিন্তু ভাগ্যে যা ছিল তা হয়েই গেছে। নিয়তিকে মেনে নিতে হবে।
কিন্তু তুমি ওর অন্যায় সহ্য করবে না। অবশ্যই প্রতিবাদ করবে। যেটা আমি করতে পারিনি সেটা তুমি করে দেখিও।”
দিবা কিছু বলে না৷ চুপচাপ শুধু কথাগুলো শোনে। একপর্যায়ে ঘড়ি দেখে বলে,” আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখন ওঠা দরকার।”
রোদেলা চোখ মুছতে মুছতে বলে,” নিশ্চয়ই। তার আগে আমার মেয়েটাকে একটু মন ভরে আদর করে নেই। আবার কবে না কবে দেখা হয়, বলা যায় না।”
রোদেলা বাচ্চাদের খেলার জায়গায় গিয়ে রোজাকে কোলে নেয়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে গালে, কপালে চুমু দিতে থাকে। দিবা নরম গলায় প্রশ্ন করে,” আপনি রোজাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করেননি?”
রোদেলা মাথা নেড়ে বলে,” করেছিলাম। কিন্তু ঈশানের সাথে পারিনি। ও কিছুতেই মেয়ের কাস্টাডি দিবে না। তাছাড়া, ঈশান ভালো স্বামী হতে না পারলেও খুব ভালো বাবা। আমার মেয়ে ওর কাছেই সবচেয়ে সুরক্ষিত থাকবে। আর আমিও নিশ্চয়ই সারাজীবন সিঙ্গেল থাকবো না। কখনও না কখনও আমাকে একটা ভিন্ন সম্পর্কে জড়াতে হবে। তখন রোজাকে ওই লোক কিভাবে ট্রিট করে, সেটাও চিন্তার বিষয়। এসব ভেবে, রোজার সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই আমি ওকে ঈশানের কাছে ছেড়ে দিয়েছি। আমি শুধু চাই আমার সোনামণি ভালো থাকুক। সেটা যদি আমাকে ছাড়াই সম্ভব হয়, তাহলে ক্ষতি কি?”
রোদেলার সাথে কথা বলে দিবার মনটা কেমন ভার হয়ে যায়। তবে সে রোদেলার সব কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। ঈশান সাহেব যদি আসলেই এতো এগ্রেসিভ হতো, তাহলে দিবার বয়ফ্রেন্ড আছে জেনেও তাকে বিয়ে করতো না। তাছাড়া যেই লোক মেয়ের প্রতি এতো যত্নশীল সে কিভাবে স্ত্রীর প্রতি এতো নির্দয় হবে? কথাগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
আবার সত্যি হতেও পারে। একই মানুষের কত ধরণের রূপ হয়। দিবা এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। ঈশান যেমনই হোক, তার কিছু যায়-আসে না। নিজের জীবনের প্রতি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বহু আগেই। এখন স্রোত যেদিকে তাকে নিয়ে যায়, সে শুধু সেদিকেই যাবে৷ এছাড়া তার কাছে অন্যকোনো রাস্তা নেই। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বহু আগেই। এখন স্রোত যেদিকে তাকে নিয়ে যায়, সে শুধু সেদিকেই যাবে৷ এছাড়া তার কাছে অন্যকোনো রাস্তা নেই।
রোজাকে দিবার কোলে দিয়ে রোদেলা বলে,” তোমরা চলে যাও। আমার এখানে একটা ছোট্ট কাজ আছে। একজনের সাথে দেখা করব।”
” ঠিকাছে, আমরা তাহলে আসি। রোজা মামণি, মাম্মাকে বাই বলে দাও!”
রোজা তার ছোট্ট হাত নেড়ে বিদায় জানায় মাকে। দিবা তো ভেবেছিল রোদেলাকে ছেড়ে আসার সময় সে খুব কান্নাকাটি করবে অথবা ওর কাছে থেকে যাওয়ার জেদ করবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। বরং দুইহাতে সে দিবার গলা জড়িয়ে ধরে হাসি মুখে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
রোদেলা এই অবস্থা দেখে কপট হেসে বলে,” অল্পদিনেই আমার মেয়ের মন জয় করে নিয়েছো দেখছি। ভালো থেকো তোমরা। ওকে আমার অভাব কখনও বুঝতে দিও না।”
দিবা শান্ত গলায় বলে,” মায়ের অভাব তো পূরণ করা সম্ভব না আপু, তবে আমি চেষ্টা করব৷ আপনি চিন্তা করবেন না। আসি।”
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই একটা বড় গাড়ি এসে দিবার সামনে থামে। হোসেন জানালা থেকে মাথা বের করে বলে,” স্লামালিকুম ম্যাডাম, গাড়িতে উঠেন। আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।( সালামের সঠিক উচ্চারণ আসসালামু আলাইকুম।)
দাঁত কেলিয়ে কথাটা বলে হোসেন। দিবার মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে যায়। পরমুহূর্তেই পেছন থেকে গাড়ির দরজা খুলে দেওয়া হয়। দিবার আত্মা ছলাৎ করে উঠে। ভেতরে ঈশান বসে আছে গম্ভীর মুখে। দিবার মনে হয় সে মাথা ঘুরে এক্ষুণি পড়ে যাবে। বুকের ভেতর থেকে হঠাৎ যেন সব রক্ত নেমে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, পা যেন কাঁপছে। সে বুঝতে পারে, আজ কিছু একটা ভয়ংকর ঘটতে যাচ্ছে। যা সামলানোর সাধ্য তার নেই।
চলবে
#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ৯ ( ২য় অংশ)
Sidratul Muntaz
বাবাকে দেখেই মুখজুড়ে হাসি ফোটে রোজার। দিবার কোল থেকে লাফিয়ে নেমে যেতে চায় ঈশানের কাছে যাওয়ার জন্য৷ রোজাকে কোল থেকে নামিয়ে স্থাণুর মতো গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে দিবা। গায়ের ওরনা ঠিক করে ইতস্তত ভঙ্গিতে। কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারে না।
ঈশান মেয়েকে কোলে নিয়ে মেয়ের গালে চুমু দেয়। আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,” আমার মাম্মা কোথায় গিয়েছিল?”
রোজা আসল কথা কিছু বলে না৷ দিবা তাকে নিষেধ করেছিল। হাত নেড়ে শুধু বোঝায়, সে খেলতে গিয়েছে। অনেক মজা হয়েছে। মায়ের ব্যাপারে একটা কথাও বলে না। ঈশান আঁড়চোখে তাকায় দিবার দিকে। নিরেট কণ্ঠে বলে,” উঠে আসুন।”
দিবা মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠতে উঠতে খুব ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে,” ঈশান সাহেব, আমি আসলে…”
” উহুম!” দিবাকে থামিয়ে দেয় ঈশান। গুমোট কণ্ঠে বলে,” বাসায় গিয়ে কথা হবে এই বিষয়।”
তার ওই নীরবতা যে আসন্ন ঝড়েরই পূর্বাভাস তা বুঝতে অসুবিধা হয় না দিবার। প্রচন্ড আশঙ্কায় কেমন হাসফাঁস লাগছে৷ যতক্ষণ সে গাড়িতে ছিল ততক্ষণই এমন লেগেছে।
বাসায় পৌঁছানোর পর মেইন গেইট পেরিয়ে মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে যায় ঈশান। দিবা ধীরে ধীরে ভেতরে যেতে থাকে। পেছন থেকে হোসেন হাসি মুখে বলে,” ভ’য় পাইয়েন না ম্যাডাম৷ স্যার অত্যন্ত ভালো মানুষ। যদিও আপনি বড়-সড় একটা ভুল করছেন। কিন্তু স্যার আপনাকে কিছু বলবে না।”
দিবা হোসেনের কথার জবাবে সামান্য হাসে। তারপর আবার থেমে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,” উনি কিভাবে খবর পেলেন এটা? কেউ কি কিছু বলেছে উনাকে?”
” হয়তো আগেই বুঝতে পারছিলেন। স্যারের তো মাথা ভরা বুদ্ধি। বুদ্ধির অন্ত নাই।”
দিবা আর কিছু বলে না। চুপচাপ বাড়ির ভেতরে ঢুকে। তার বুকের ভেতর কেমন ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে। এই শব্দটা সে ছাড়া যদি অন্যকেউ শুনলে তার কানে তালা লেগে যেতো! ড্রয়িংরুমে রোজা খেলছে, আজ সে খুব প্রাণবন্ত। উৎফুল্ল! তৃষা তার দুপুরের খাবার প্রস্তুত করে এনেছে। দিবা বলে,” থাক তুমি রাখো৷ আমি পরে ওকে খাইয়ে দিবো। এমনিতেও বাইরে থেকে ও খেয়ে এসেছে। এখন পেট ভরা।”
আয়েশা দিবার দিকে তাকান মলিন দৃষ্টিতে। ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,” তুমি নাকি রোজাকে নিয়ে রোদেলার সাথে দেখা করতে গেছিলে? এই কথা সত্যি?”
দিবা একটু থতমত খায়। মাথা নিচু করে ক্ষীণ স্বরে বলে,” সত্যি!”
আয়েশা কটমট করে বলেন,” সর্বনাশ করেছে! কি করলে তুমি এটা? আমি তোমাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে ওই মেয়ে ভালো না। ও একটা অনেক বড় অপরাধ করেছে। কিন্তু তুমি শুনলে না আয়োজন করছে। শুধু শুধুই বিপদ ডেকে আনলে। এখন যাও, সামলাও ঈশানের মেজাজ। ও তোমাকে ঘরে যেতে বলেছে।”
ভ’য়ে ততক্ষণে দিবা হৃৎস্পন্দন হাজার মেইল বেগে ছুটলেও যে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করে।এখানে এতো ভ’য় পাওয়ার কিছুই নেই। সে অন্যায় তো কিছু করেনি৷ শুধু রোজার খুশি দেখতে চেয়েছিল। দিবা মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে ঈশানের রুমে যায়।
রকিং চেয়ারের হাতলে দুইহাত ঠেকিয়ে মুখের কাছে জড়ো করে বসে আছে ঈশান। দিবা ভেতরে প্রবেশ করতেই দরাজ কণ্ঠে বলে,” বিয়ের প্রথমরাতে আমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল মিস দিবা? এতো দ্রুত সেটা আপনি ভুলে যাবেন আমি কল্পনাও করিনি।”
দিবা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,” কিছুই ভুলিনি। মনে আছে আমার।”
” কি মনে আছে?” রুক্ষ কণ্ঠে প্রশ্ন করে ঈশান।
দিবা ঢোক গিলে বলে,” আপনি বলেছিলেন রোজার মাথা থেকে ওর মায়ের স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এটা অন্যায়। একটা বাচ্চাকে এভাবে আপনি ওর মায়ের থেকে দূরে রাখতে পারেন না৷ এতে ওর…”
” এখন ন্যায়-অন্যায় আপনি শেখাবেন আমাকে?” ঈশান গর্জে ওঠে।
দিবা খানিক কেঁপে দুই পা পিছিয়ে যায়। ঈশান তীব্র আওয়াজে উচ্চারণ করে,” কোন সাহসে আপনি এই কাজটা করলেন? বলুন কোন সাহসে? হাউ ডেয়ার ইউ?”
দিবা কাঁপা কণ্ঠে বলে,” আমি যেটা করেছি সেটা রোজার ভালোর জন্যই। ও ওর মাকে দেখে কতটা খুশি হয়েছে সেটা যদি আপনি দেখতেন তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতেন৷ রোজার আসলেই ওর মাকে ভীষণ প্রয়োজন।”
ঈশান কঠিন স্বরে বলে,” রোজা আমার মেয়ে মিস দিবা। ওর কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা প্রয়োজন নেই সেটা আমি বুঝবো। আপনি না। আজকে আপনি আমার অগোচরে যেই কাজটা করেছেন সেটা কতবড় ভুল তা কি বুঝতে পারছেন?”
ঈশানের চোখ দু’টো এতো বড় হয়ে গেছে, রোষানলে জ্বলছে! যেন এক্ষুণি ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। দিবা কোনো জবাব দিতে পারে না। মুখ কুঁচকে মাথা নিচু করে রাখে। ঈশান কট্টর স্বরে আবার বলে,” এখানে আসার পর থেকে একের পর এক ভুল করেই যাচ্ছেন আপনি। মনে হচ্ছে যেন আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। যদি সংসার করার ইচ্ছাই না থাকে তাহলে এখনি বলুন। ডিভোর্স দিয়ে দেই। আপনার মতো মেয়ে অনেক যাবে-আসবে আমার জীবনে।”
দিবা মাথা তুলে তাকায়। রাগে গা কাঁপতে থাকে। লোকটা কি বলছে এসব? এভাবে দিবাকে অপমান করছে! তবে এই মুহূর্তে দিবা নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে৷ কারণ ভুলটা আসলেই তার ছিল। সে অনধিকার চর্চা করেছে। তাই নরম স্বরে বলে,” আ’ম স্যরি। আমি ভুল করেছি। আর কখনও এমন হবে না৷”
” আর কখনও এমন হওয়ার সুযোগই দেওয়া হবে না আপনাকে। ফারদার যদি আমাকে না জানিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করতে যান, তাহলে এই বাড়িতে সেটাই আপনার শেষ দিন হবে। মনে থাকে যেন।”
দিবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। লোকটা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে! সে কি দয়া করে থাকতে দিয়েছে নাকি দিবাকে এখানে? আর বিয়েটাও বুঝি দয়া দেখিয়ে করেছে? ভাব তো সেরকমই দেখাচ্ছে। ওই মুহূর্তে দিবার এতো রাগ হলো যে সে নিজেও জানে না কি করবে। হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে আসে। কিছুক্ষণ পায়চারী করে৷ তারপর কি একটা ভেবে নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করে। সে আর থাকবে না এখানে। অসম্ভব!
আয়েশা দিবার ঘরে ঢুকে তাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে অবাক হয়ে বলেন,” কি করছো তুমি? কোথাও যাচ্ছো নাকি?”
” হ্যাঁ, আমি একটু আমার বাসায় যাচ্ছি।”
আয়েশা চোখ বড় বড় করে বলেন,” সর্বনাশ! ঈশান তোমাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে?”
দিবা কোনো উত্তর দেয় না। শুধু জোর করে একটু হাসে। আয়েশা মাথায় হাত রেখে আফসোসের ভঙ্গিতে বলেন,” হায় আল্লাহ, আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। তুমি এই কাজটা কেনো করতে গেলে বলোতো? জানোই যখন ঈশান রোদেলার নামটা পর্যন্ত শুনতে পারে না। যেখানে রোজাকে ও মায়ের সাথে ফোনে কথা পর্যন্ত বলতে দেয় না সেখানে তুমি কিভাবে ওকে নিয়ে ওর মায়ের সাথে দেখা করতে গেলে বলো? তোমার কি কান্ড-জ্ঞান নেই?”
দিবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” আমি চলে যাচ্ছি ফুপু। এখন থেকে আমাকে নিয়ে আপনার আর ঝামেলা পোহাতে হবে না। আমার কান্ড-জ্ঞান নিয়েও চিন্তা করতে হবে না। নিশ্চিন্ত থাকুন।”
আয়েশা ফ্যাল ফ্যাল করে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন,” ওই মেয়ে এতোদিন তো রোজার খোঁজ নেওয়ার একটুও প্রয়োজন বোধ করেনি। হঠাৎ তুমি আসাতেই ওর মেয়ের প্রতি এতো দরদ উথলে উঠছে কেন? আসলে ও চাইছে তোমাদের নতুন সংসারে ঝামেলা লাগাতে। যেটা তুমি বুঝতে পারছো না।”
” উনি কেনো শুধু শুধু এটা চাইবেন?”
” তুমি ওই মেয়েকে চেনো না৷ তাই বুঝতে পারছো না। ও প্রথম থেকেই ভীষণ হিংসুটে। ঈশানের কয়টা বিয়ে যে ভেঙেছে তার ইয়ত্তা নেই। নিজে তো ঈশানের সাথে সংসার করতে পারেনি, অন্যকাউকেও করতে দিবে না। তাই এবার তোমার সাথে বিয়ের সময় এতো সাদামাটা আয়োজন করেছি যেন রোদেলা কিছু জানতে না পারে। নয়তো এই বিয়েও সে হতে দিতো না। আর এখন যখন বিয়ে হয়েই গেছে, তখন সংসারে অশান্তি লাগানোর সুযোগ খুঁজছে। বেহায়া মেয়েমানুষ! ভাবছে এসব করলে ঈশান আবার তার কাছে ফিরে যাবে। তবে আমি আমার ভাতিজাকে ভালো করেই চিনি৷ ম’রে গেলেও ওই মেয়ের দিকে ফিরে তাকাবে না সে।”
দিবা মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনে। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করে,” রোদেলা আপা কি এমন অপরাধ করেছিল যে কারণে ঈশান সাহেব এতো রেগে?”
আয়েশা মুখ কুঁচকে বলেন,” ওসব বলতে গেলেও আমার বমি চলে আসবে। শুধু জেনে রাখো প্রতারণা করেছিল। ঈশান তখন আমেরিকায় ছিল। সে রোজাকে কাজের মেয়ের কাছে রেখে প্রতিদিন প্রেমিকের সাথে হোটেলে গিয়ে থাকতো। ছি, ছি, বলতেও আমার গা ঘিনঘিন করছে৷ এত্তো নোংরা ওই মেয়ে।”
দিবা হতবাক হয়ে যায় এই কথা শুনে৷ আয়েশা বলেন,” আমার কথা বিশ্বাস হয়নি তাই না? অবশ্য হবে কিভাবে? ওই মেয়ে তো আগেই তোমার ব্রেইন ওয়াশ করে দিয়েছে। আমাদের আগের কাজের মেয়ের নাম কুসুম। ওর এখন বিয়ে হয়ে গেছে। এই সবকিছুর সাক্ষী ছিল ও। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমাকে ওর নাম্বার দেই। কথা বলে দেখো।”
দিবা সাথে সাথে বলে,” না, না, আপনার কথা কেনো বিশ্বাস হবে না? আমি বিশ্বাস করেছি। কিন্তু অবাক লাগছে৷ একটা মেয়ে কিভাবে এরকম কাজ করতে পারে?”
” বেহায়া মেয়ে মানুষ সবই পারে। তুমি বলো, এতোকিছুর পরেও কি ওই মেয়েকে ক্ষমা করা যায়?”
দিবা মাথা নাড়ে দুইপাশে। আয়েশা তার ব্যাগটা টেনে ভেতর থেকে কাপড় বের করতে করতে বলেন,” রাখো এসব। তোমার কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আমি ঈশানের সাথে কথা বলবো।”
” না ফুপু, এটা করবেন না প্লিজ। আমাকে যেতে হবে৷ এমনিতেও এইখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।”
” সম্ভব না কেন? এর মানে রোদেলার কথাই বিশ্বাস করেছো। ঈশানের নামে যা নয় তাই বলেছে তাই না? ওসব বিশ্বাস করলে পস্তাবে। নিজের কপাল নিজে খেও না।”
দিবা আয়েশার হাত থেকে তার ব্যাগটা নিয়ে ঠিকঠাক করে গুছিয়ে নেয়৷ তারপর বলে,” আমাকে যেতে হবে ফুপু। প্লিজ নিষেধ করবেন না।”
তারপর আর কিছু না বলে সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যায়। আয়েশা ততক্ষণে ছুটে গেছেন ঈশানের ঘরে। মাত্র শার্ট ছেড়ে টি-শার্টে গা গলিয়েছে ঈশান। আয়েশা অস্থির হয়ে বলেন,” তুই দিবাকে কি বলেছিস বাবা? মেয়েটা এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, ওর বাড়ির লোকেরা কি বলবে?”
ঈশান অবাক হয়ে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,” চলে যাচ্ছে মানে? কেন যাচ্ছে?”
” সেটা আমি কিভাবে বলবো কেন যাচ্ছে? তোদের মধ্যে কি হয়েছে সেটা কি আমি জানি?”
ঈশান ফট করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়৷ দিবা লিফটে উঠে গেছে। ঈশান ধুপধাপ সিঁড়ি থেকে নামে। লিফটের আগে সে নিজেই নিচে পৌঁছে যায়। সার্ভিস কোরটা বেশ বড়। আশেপাশে তখন নীরব, তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সদর দরজায় দারোয়ানরা বসে আছে, কিন্তু এদিকে কেউ নেই। দিবা লিফট থেকে বের হতেই সামনে ঈশানকে দেখে হকচকিয়ে যায়, খানিকটা ভ’য়ও পায়।
ঈশান র’ক্তাভ দৃষ্টিতে দেখে দিবাকে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,” কোথায় যাচ্ছেন?”
দিবা মাথা নিচু করে বলে,” আমার বাড়িতে।”
” কার অনুমতি নিয়ে যাচ্ছেন?”
” আমার কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই।”
ঈশানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। তীক্ষ্ণ মেজাজটা সংযত করে বলে,” চুপচাপ ভেতরে চলুন।”
” স্যরি, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব না৷ তাছাড়া আপনি কেন আমাকে আটকাচ্ছেন?”
ঈশান ঝুঁকে এসে স্পষ্ট কণ্ঠে বলে,” বিকজ ইউ আর মাই ওয়াইফ। আপনাকে আটকানোর হান্ড্রেট পারসেন্ট রাইট আমার আছে। ভেতরে চলুন নয়তো উঠিয়ে নিয়ে যাবো। ডন্ট ফোর্স মি টু ডু দ্যাট।”
দিবা কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়। শিরদাঁড়ায় অনুভব করে একটা ঠান্ডা স্রোত। ঈশান হাত ধরে টেনে দিবাকে লিফটের ভেতরে ঢোকায়। সামনে আরও কি কি হবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে দিবার। দরজা বন্ধ হতেই সে নিঃশ্বাস থামিয়ে প্রশ্ন করে,” আপনি তো বলেছিলেন আমাকে ডিভোর্স দিবেন। আমার মতো মেয়ে নাকি অনেক যাবে-আসবে আপনার জীবনে!”
ঈশান তাকায় দিবার মুখের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। মুখটা থমথমে। ঈশান একটু হেসে বলে,” ঠিকই বলেছি। আপনার মতো মেয়ে অনেক যাবে-আসবে। কিন্তু কাউকে আমি আটকাবো না৷ আটকে রাখবো শুধু একজনকেই। দূর্ভাগ্যবশত সেটা আপনিই।”
” দূর্ভাগ্যবশত? ”
” হ্যাঁ, দূর্ভাগ্যই তো। বয়ফ্রেন্ডের বুকভরা জন্য ভালোবাসা নিয়েও আমার মতো পাষাণ মানুষের সাথে আপনাকে সংসার করে যেতে হবে। এটা দূর্ভাগ্য ছাড়া আর কি?”
দিবা মুখ গোঁজ করে বলে,” বার-বার ওই প্রসঙ্গ টেনে খোচা দিবেন না। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। নয়তো আপনাকে বিয়ে করতে পারতাম না।”
” তার মানে এখন আমার প্রতি ভালোবাসা শুরু হয়েছে বলতে চাচ্ছেন?”
দিবা অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বলে,” এই কথা কখন বললাম?”
তারপর লিফটের দিকে নজর যেতেই বলে,” বাটন ক্লিক করা হয়নি৷ এভাবে তো আমরা সারাদিন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব।”
ঈশান পাঁচ নম্বর বোতাম টিপতে টিপতে বলে,” আপনিও বাটন ক্লিক করুন মিস দিবা। নয়তো সারাজীবন এক জায়গাতেই থেমে থাকতে হবে। সামনে আর আগানো হবে না।”
চলবে