শর্তসাপেক্ষে পর্ব-১১

0
1

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১১
Sidratul Muntaz

রাফিনরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে দু’দিন হলো। বাসার গোছ-গাছ করতে ভীষণ ব্যস্ত সবাই। এক মুহূর্তও যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। সন্ধ্যায় আবার রাফিন তার বন্ধুদের দাওয়াত করেছিল। তারা সময়মতো চলে এসেছে নতুন বাসা দেখতে। রাফিনের বন্ধু নিয়াজ সদ্য বিয়ে করেছে৷ তার বউ ডাক্তারী পড়ছে, ঢাকা মেডিকেলের স্টুডেন্ট। বাবাও ডাক্তার। মেয়েটির নাম সুপ্রভা।

শাহনাজ বেগম সুপ্রভাকে দেখে ভীষণ আপ্লুত হোন। তার চিবুকে হাত রেখে মুগ্ধ কণ্ঠে বলেন,” বাহ, কি সুন্দর মেয়ে! তুই এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করতে পারলি না বাবা? কোথা থেকে কোন অনাথ জুটিয়েছিলি। ভালোই হয়েছে আপদ গেছে। এখন তোর জন্য আমি সুপ্রভার মতোই লক্ষীমন্ত মেয়ে খুঁজবো। যার রূপ-গুণের পাশাপাশি বংশ, মর্যাদা সব থাকবে।”

সুপ্রভা একবার নিয়াজের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,” আন্টি কার কথা বলছে?”

নিয়াজ এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,” রাফিনের এক্স গার্লফ্রেন্ড। বাদ দাও, তোমার ওসব জানতে হবে না।”

রাফিন মুখ অন্ধকার করে নিজের ঘরে চলে আসে। বন্ধুরা তার ফ্ল্যাট দেখে খুব প্রশংসা করেছে। আগের বাসাটার চেয়ে এটা হাজার গুণ ভালো। আর হবেই না কেনো? দাম যে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। আগের বাসার ভাড়া ছিল আটহাজার। আর এখন এই বাসার ভাড়া সতেরো হাজার পাঁচশো! চৌদ্দশো স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটি দুটি বেডরুম ও বিশাল বিশাল বারান্দা সমৃদ্ধ। তারা মানুষ যেহেতু অল্প, এখনি বেশি রুমের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া ড্রয়িং রুম, ডাইনিং স্পেস, সবকিছুই বেশ বড় বড়।

বেডরুমের বারান্দা থেকে সামনে খোলা সবুজ মাঠ দেখা যায়। দক্ষিণ পাশে জানালা হওয়ায় বারান্দায় দাঁড়ানো মাত্র হিমশীতল বাতাসে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। ভীষণ স্বস্তি লাগে। এমন একটা বাসার স্বপ্নই তো দেখেছিল দিবা। সবসময় হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলতো,” আমরা কিন্তু খুব বড় বারান্দাওয়ালা একটা বাসা নিবো রাফিন। সবসময় বাতাসে ভাসতে থাকবে ঘর। আমি বারান্দায় রজনীগন্ধা আর গোলাপের চারা লাগবো। ফুলের গন্ধে মো মো করবে সবকিছু। ”

রাফিন আগ্রহ নিয়ে বলতো,”দারুণ হবে তো! আমি মাঝে মাঝে গাছ থেকে গোলাপ ছিঁড়ে তোমার খোপায় গুজে দিবো। ”

দিবা রেগে চোখ বড় বড় করে ফেলতো,” গোলাপ খোপায় গুজতে হলে তুমি টাকা দিয়ে কিনে আনবে। খবরদার আমার শখের গাছে হাত দিবে না৷ একদম কাঁটা গেঁথে দিবো।”

দিবার হাসিটা যেন এখনও কানে বাজছে৷ রাফিন বারান্দার মেঝেতে বসে উদাস মুখে একটা সিগারেট ধরায়। আজ-কাল খুব সিগারেটের নেশা হয়েছে তার। দিনে কম হলেও দুই-তিন প্যাকেট লাগে। দিবা এটা একদমই পছন্দ করতো না। তাই রাফিন কখনও সিগারেট খাওয়ার কথা ভাবেনি। কিন্তু এখন আর দিবা নেই তার জীবনে। সুতরাং সিগারেটের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই।

নিকোটিনের ধোঁয়ায় ভাসতে ভাসতে রাফিন যেন হারিয়ে যায় সেই পুরনো স্মৃতিতে। বুকের বামপাশে চিনচিনে এক তীব্র ব্যথা গ্রাস করে নেয় সারা শরীর।

দুইহাজার বিশ সালের ঘটনা। তখন দিবা মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। আর রাফিন সাত কলেজের ছন্নছাড়া ছাত্র। কোনোমতে স্টুডেন্ট পড়ায় আর বাচ্চাদের কোচিং করায়। সেখানেই দিবার সাথে তার প্রথম দেখা। খিলখিল শব্দে হাসতে হাসতে মেয়েটি প্রশ্ন করেছিল,” আপনার নামটা যেন কি স্যার?”

সেই হাসিতেই বুঝি রাফিন কুপোকাত হয়ে যায়। না,না, শিক্ষক হয়ে ছাত্রীকে লাইন মারার মতো ছ্যাচরামি সে করেনি। আসলে পুরোটাই ছিল দিবার আশকারা। সুন্দরী হওয়ায় নিজের রূপের প্রতি তার অহংকার ষোলআনা। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে রাফিনকে ফেসবুকে মেসেজ দেয়। ফ্লার্ট করে যেন রাফিন তার প্রতি আগ্রহী হয়। রূপবতী আর চতুর দিবার প্রেমে অসহায় যুবক হিসেবে একরকম পিছলে পড়েছিল রাফিন। তখনও তারা জানতো না যে তাদের সম্পর্কটা একসময় এতো সিরিয়াস হয়ে যাবে।

দিবা তার বোনের বাসায় থাকতো। পড়াশুনা করতো দুলাভাইয়ের টাকায়। জন্মের কিছুমাস আগেই তার বাবা মা’রা গেছিল। মায়ের মৃ’ত্যুটাও খুব অপ্রত্যাশিত। অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন। মায়ের মৃ’ত্যুর ঠিক দুইমাস পর তার নানীও মারা গেল। অসহায় অবস্থায় দিবাকে তার বোন নিজের বাসায় তুলে আনে।

দিবা একটা কথা সবসময় বলতো,” আমি যতই স্টাবলিশ হতে চাই, আমার আপা কিন্তু আমাকে দ্রুত বিয়ে দিবে৷ তাই আমাকে পেতে হলে যত দ্রুত সম্ভব নিজের জীবন গোছাও। হুট করে বিয়ে করে নিবো, তখন কিন্তু দোষারোপ করতে পারবে না!”

রাফিন হাসতো দিবার কথায়। কখনও তেমন পাত্তা দেয়নি। কিন্তু কে জানতো মেয়েটা যে সত্যি এভাবে মাঝপথে হাত ছেড়ে দিবে! রাফিনকে ধ্বংস করে ঠিকই নিজের জীবন গুছিয়ে নিবে! বেইমান! মেয়ে মানুষ এতো বেইমান!

দিবার সাথে কাটানো আরও কিছু স্মরণীয় মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। যখন তারা পরিবার থেকে লুকিয়ে পাগলামি করে কক্সবাজার চলে গেছিল। রাফিনের সাথে তার ছেলে- মেয়ে অনেক বন্ধুরাও ছিল। তাই দিবাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। একই হোটেলের দু’টো রুমে দিবা আর রাফিন থেকেছে। মাঝরাতে দু’জন হাত ধরাধরি করে হাঁটতেও বের হয়েছে। রাফিন খুব চেয়েছিল একটু ঘনিষ্ট হতে। কিন্তু দিবা চোখ গরম করে বলেছিল,” খবরদার, মাথাতেও আনবে না এসব। আমাকে টাচ করা এতো সহজ না। আগে আমার যোগ্য হতে হবে, বিয়ে করতে হবে, মোহরানা পরিশোধ করতে হবে, তারপর যদি আমার মুড হয় তাহলেই চান্স পাবে। এর আগে কিচ্ছু না।”

রাফিন অনুরোধ করে বলেছিল,” প্লিজ জান, জাস্ট একটা কিস…”

দিবা ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলেছে,” প্রশ্নই আসে না!”

রাফিন একবার অভিমান করে বলেছিল,” আমাকে কি তুমি বিশ্বাস করো না দিবা?”

দিবা উত্তরে বলেছে,” অবশ্যই তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু নিজের ভাগ্যে বিশ্বাস করি না একদম। ছোট থেকেই আমি কপাল পোড়া। যাকে ভালোবাসি সেই ছেড়ে চলে যায়৷ তাই ভ’য় হয়৷ কখন জানি তুমিও ছেড়ে চলে যাবে।”

রাফিন হাসে ওসব মনে করে। উল্টোটাই তো হলো শেষমেষ। সবসময় রাফিনকে হারানোর ভ’য়ে ছটফট করা মেয়েটি দিনশেষে নিজেই রাফিনকে ছেড়ে চলে গেল। স্বার্থপরতা করল। ভ’য়ানক স্বার্থপর মেয়ে ওই দিবা রহমান।

ধীরপায়ে ঈশানের ঘরে প্রবেশ করে দিবা। ঈশান তখন মাত্র শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। মেনস শ্যাম্পুর গন্ধে ভরে গেছে ঘর। গায়ে সাদা রঙের একটা টি-শার্ট জড়িয়ে বসে আছে চেয়ারে৷ দৃষ্টি ল্যাপটপে। ব্যস্ত আঙুল চলছে কি-বোর্ডের কালো বোতামে। চুল থেকে তখনও টপটপ করে পানি ঝরছে। দিবার একবার ইচ্ছে হয় তোয়ালেটা নিয়ে লোকটার মাথাটা ভালো করে মুছে দিতে। অন্যকেউ হলে দিবা সেটাই করতো। মানুষটা চমকে যেতো নিশ্চয়ই। দেখতে মজা লাগতো।

কিন্তু এটা যে ঈশান আহসান! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা বিলগেটস এর মতো এটিটিউড নিয়ে চলা মানুষ।

” দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন কেনো দিবা? ভেতরে আসুন।”

ঈশানের ভারী কণ্ঠ শুনে দিবা তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢুকে। । কৈফিয়ৎ দেওয়ার মতো বলে,” আসলে বিকাল থেকে রোজার মনটা খুব খারাপ ছিল। ওকে এন্টারটেইন করার জন্যই আমি টিভিতে গান ছেড়ে কিছু নাচের স্টেপ দেখাচ্ছিলাম৷ আর বাচ্চা মানুষ, সেও মজা পেয়ে গেল। আগ্রহ করে আমার সাথে ডান্স স্টেপগুলো ফলো করছিল। কিন্তু এতে যে ঘরের এমন বেহাল দশা হবে সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি এখুনি সব ঠিক-ঠাক করে দিবো। আয়েশা ফুপু আমাকে বলেছে আপনি এলোমেলো ঘর একদম পছন্দ করেন না!”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে দিবা। ঈশান এতোক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই তাকিয়েছিল৷ সে থামতেই জিজ্ঞেস করে,” হয়েছে? আর কিছু বলবেন নাকি এবার আমি বলবো?”

” জ্বী, জ্বী প্লিজ বলুন আপনি। মানে আমি আগে আমার দিকটা ক্লিয়ার করে নিলাম।”

” আমি আপনাকে এই সিলি বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য ডাকিনি। আমার মেয়েকে নাচ-গান শেখাচ্ছেন খুব ভালো ব্যাপার। আপনার যদি এই বিষয়ে বেশি আগ্রহ থাকে তাহলে আমি আপনাকে একটা ড্যান্স একাডেমিও খুলে দিতে পারি। ছাদে আমাদের একটা ঘর খালি আছে। সেখানে ইজিলি আপনি মেয়েদের নাচ শেখাতে পারবেন। আর ইউ ইন্টারেস্টেড?”

দিবা চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে সে একদম বুঝতে পারে না এই লোকটা মজা করছে নাকি সিরিয়াস মুডে আছে৷ তাই কি উত্তর দিবে সেটাও ঠিক করতে পারে না। এই যেমন এখন! কি মুশকিলে পড়া গেল! নিজের সেন্স অফ হিউমার নিয়ে মনে মনে ভীষণ হতাশ হয় দিবা।

” আপনি মজা করছেন তাই না?” অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্নটা করে দিবা।

” থ্যাংক গড আপনি বুঝতে পেরেছেন। রাজি হয়ে গেলে আমি প্রবলেমে পড়ে যেতাম৷ কারণ আমার ওয়াইফ বাইরে থেকে মেয়েদের ধরে এনে নাচ শেখাচ্ছে, বিষয়টা আমার পছন্দ হতো না।”

ঈশান হালকা হেসে কথাটা বলে। দিবাও মাথা নেড়ে জোর করে হাসার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালায়। ঈশানের মধ্যে একটা ব্যাপার সে ভালো করেই লক্ষ্য করেছে। লোকটা সবসময় কৌশলে নিজের পছন্দ-অপছন্দ দিবাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। যেন দিবা কখনও তার পছন্দের বাইরে কিছু করার চেষ্টাও না করে! একেই বলে মাথাভরা হিটলারি বুদ্ধি!

” যাইহোক, যে কারণে ডেকেছি সেটা বলি। কাল আপনি ভার্সিটি যাবেন?”

” হ্যাঁ যাবো।”

” যাওয়ার সময় আমি আপনাকে ড্রপ করে দিবো। আর আসার সময় আমার এসিস্ট্যান্ট গেইটের বাইরে থাকবে। নাম হোসেন, ওইতো সেদিনই দেখা হলো। চিনেছেন নিশ্চয়ই। ”

দিবা হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ে। ঈশান গম্ভীর মুখে বলে,” আজ-কাল খুব আননেসেসআরি ইনসিডেন্টস হচ্ছে। ওসব এড়াতেই এই ব্যবস্থা। এখন থেকে আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কি করছেন, সবকিছু আমার নজরদারিতে থাকবে। তাই সেটা মাথায় রেখেই কাজ করবেন।”

দিবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মনে হয় এই মাত্র ঈশান তাকে একটা নীরব হুমকি দিল। খুব ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে দিল যে দিবা তার অনুমতি ছাড়া কিচ্ছু করতে পারবে না।

” ঠিকাছে, কিছু বলার না থাকলে এখন যান।” একথা বলে ঈশান কাজে ব্যস্ত হয়।।

দিবা ইতস্তত করতে থাকে। যেতে নিয়েও একটু থেমে দাঁড়ায়। কথাটা বলবে কি-না সে বুঝতে পারছে না। একটু অস্বস্তি হচ্ছে।

ঈশান তাকে আঁড়চোখে দেখে নিজেই প্রশ্ন করে,” বলুন কি বলবেন? মনের কথা চেপে রাখবেন না। সমস্যা না বললে বুঝবো কিভাবে?”

দিবা নিজেকে ধাতস্থ করে ফটাফট বলে,” আসলে আমার কিছু হাত-খরচ দরকার ছিল।”

ঈশান ঘুরে তাকায়। দিবা অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বলে,” না মানে… হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়ে গেল। আমার ফ্রেন্ডসদের ইনভাইট করা হয়নি৷ রিসিপশন হতে তো এখনও দেরি। ওরা ট্রিট চায়।”

এটুকু বলে দিবা একটু থামে। তারপর উশখুশ করে বলে,” তাছাড়া আমারও পারসোনাল কিছু খরচ ছিল।”

ঈশান হঠাৎ উঠে গিয়ে আলমারি থেকে কিছু একটা বের করে। কাগজে মোড়ানো বেশ ভারী একটা জিনিস। দিবার কাছে এসে তার হাতে জিনিসটা তুলে দিয়ে বলে,” এটা আরও আগেই দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম।”

দিবা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,” কি এটা?”

” আপনার মোহরানার টাকাটা।”

যে হাতে জিনিসটা ধরা ছিল সেই হাতটা যেন কেঁপে উঠে দিবার৷ সাথে ঢিপঢিপ শুরু হয় বুকের ভেতর৷

ঈশান বলে,” আর টাকা সবসময় ওই ড্রয়ারেই থাকে। চাবিটা আমি ফুপুকে বলে দিবো যেন আপনার কাছে দেয়। যখন যা লাগবে ওখান থেকে নিয়ে নিবেন। আমি হিসাব চাইবো না।”

দিবা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর একটাও কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। পরদিন ভার্সিটি যাওয়ার সময় আয়েশা নিজেই এসে গম্ভীরমুখে দিবাকে চাবি দেয়।

দিবা যখন জিজ্ঞেস করে,” এটা কিসের চাবি?”

আয়েশা থমথমে মুখে বলে,” লকারের। এখন থেকে তো তুমিই সবকিছুর মালকিন হয়েছো৷ দেখো আবার, রোদেলার মতো ফূর্তি শুরু করো না। ঈশান যেমন দড়ি ছাড়তে জানে তেমনি সময় হলে রাশ টেনেও ধরতে জানে৷ তাই সাবধান!”

দিবা বুঝতে পারে না ওতো জটিল কথার অর্থ। তবে প্রয়োজনীয় কিছু টাকা নিয়ে সে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। এই নিয়ে ঈশান তাকে কোনোরূপ প্রশ্ন করে না৷ আর তাকে একটা আলাদা গাড়িও দেওয়া হয়। সে যখন যেখানে যেতে চায়, হোসেন নিয়ে যায়। দিবা বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে, অনেক টাকাও খরচ করে, কেউ তার কাছে হিসাব চাইতে আসে না৷

এরপর থেকে দিবা ব্যাপারটায় খুব মজা পেয়ে যায়। প্রতিদিনই চার-পাঁচহাজার টাকা সে হাত খরচ হিসেবে রাখে। এতোদিনের যত অপূর্ণ শখ ছিল, দিবা সব পূরণ করে নেয়। মোহরানায় সে যত টাকা পেয়েছে তা দিয়ে কমপক্ষে একবছর শপিং করলেও ফুরাবে না! তবে এখনও সে ওই টাকা স্পর্শ করেনি। ঈশান যে ড্রয়ারের মালিকানা তাকে দিয়েছে, সেখান থেকেই সে একটু-আধটু করে খরচ করছে। ভার্সিটি থেকে বের হয়েই বন্ধুদের নিয়ে শপিংয়ে চলে যায়। কতকিছু কেনে।

আগে যেসব দোকানে ঢোকার সাহস হতো না, শুধু দূর থেকে দেখতো; এখন সে ওসব দোকানের নিয়মিত কাস্টমার হয়ে গেছে! ওইদিন তো বিনা কারণেই একটা ডায়মন্ডের নেকলেস কিনে ফেলল। আয়েশা হা-হুতাশ করতে করতে ঈশানকে ঘটনাটা বলে।

ঈশান বলে,” ওর পছন্দ হলে কিনবে। সমস্যা কি?”

আয়েশা বলে,” মেয়েটাকে এতো লাই দিস না। পরে মাথায় উঠে গেলে আছাড় দিয়েও নামাতে পারবি না।”

ঈশান মৃদু হেসে বলে,” আমার বউ, আমি বুঝে নিবো ফুপু। তোমাকে টেনশন করতে হবে না।”

দিবা আড়াল থেকে তাদের কথা শুনে হাওয়ায় ভাসতে থাকে। তার মনে হয় ঠিক এমন লাক্সারিয়াস লাইফই সে চেয়েছিল জীবনে। তার প্রতিটি দিন এভাবেই স্বপ্নের মতো কাটছিল। মাঝে আবারও একদিন রোদেলার সাথে দেখা হয়ে যায়।

দিবা তখন বন্ধুদের নিয়ে একটা দামী রেস্টুরেন্টে এসেছে।

” আজকে ট্রিট কে দিবে?” মণি জিজ্ঞেস করে।

শাম্মী আর রেখা দিবার দিকে আঙুল তাক করে বলে,” আমাদের বিল গেটস ভাইয়ের বউ ছাড়া আর কে দিবে?”

মণি সিরিয়াস মুখে বলে,” আচ্ছা দিবা, তুই যে আমাদের পেছনে এতো টাকা খরচ করিস ভাইয়া কখনও কিছু বলে না?”

দিবা ঠোঁট উল্টে বলে,” উহুম, উনি কখনোই আমার কাছে হিসাব চায় না।”

শাম্মি বলে,” ইশ, কত লাকিরে তুই! এমন হাজব্যান্ড পেলে আর কি লাগে? আল্লাহ, আমার কপালেও এমন একটা জুটিয়ে দাও।”

দুইহাত উপরে তোলে মোনাজাত ধরার ভঙ্গিতে বলে শাম্মি। রেখা টিপ্পনী কেটে বলে,” তোর জন্যও দেখবো নাকি দুই বাচ্চার বাপ?”

” না বাবা, থাক! সবাই তো আর ঈশান ভাইয়ের মতো হবে না।”

দিবা আর হেসে উঠে। তাদের খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন বিল পেমেন্ট করতে কাউন্টারে যায়, তখন ক্যাশিয়ার জানায়,” আপনাদের তো বিল পেমেন্ট হয়ে গেছে।”

দিবা অবাক হয়ে তার বন্ধুদের দিকে তাকায়। রেখা, শাম্মি কিংবা মণি তারা কেউই বিল দেয়নি। পেছন থেকে একটা সুরেলা কণ্ঠ বলে উঠে,” বিল আমি দিয়েছি দিবা।”

পেছনে তাকাতেই দিবা থমকে যায়। রোদেলা দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। খানিকটা এগিয়ে এসে বলে,” তোমার বন্ধুদের চলে যেতে বলো। তোমার সাথে আমার কিছু পারসোনাল কথা আছে।”

দিবা শক্ত মুখে বলে,” আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না।”

” কেনো? ঈশান নিষেধ করেছে তাইতো? জানতাম, ও এটাই করবে। আমার সাথে মিশলে তো ওর আসল রূপ তুমি জেনে যাবে। তাই ভ’য় পেয়ে এই কাজ করেছে।”

দিবা মণিদের উদ্দেশ্যে বলে,” তোরা যা, আমি একটু পর আসছি।”

মণি, রেখা আর শাম্মি চলে যায় রেস্টুরেন্টের বাইরে৷ গাড়িতে বসে অপেক্ষা করবে তারা। দিবা হাত ভাঁজ করে এবার রোদেলার দিকে তাকায়। কটমটে স্বরে প্রশ্ন করে,” সমস্যা কি আপনার? এভাবে কেনো পেছনে লেগেছেন?”

” তুমি হঠাৎ এতো রুড বিহেভ কেনো করছো আমার সাথে? আমি তো তোমাকে কিছুই বলিনি!”

” ঈশান আমাকে আপনার সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছে। যদি ও এই ঘটনা জানে তাহলে রাগারাগি করবে। তাই দয়া করে আমাকে ছাড়ুন। এভাবে আমাদের সংসারে ঝামেলা বাঁধানোর চেষ্টা করবেন না।”

রোদেলা মুচকি হেসে বলে,” বাহ, মাত্র কয়েকদিনেই এতো উন্নতি? ঈশান সাহেব থেকে সরাসরি ঈশান?”

” এটাই স্বাভাবিক। এখানে অবাক হওয়ার কি আছে?”

রোদেলা হাত ধরে টেনে দিবাকে নিয়ে একটা টেবিলে বসে। কোল্ড্রিংকস অর্ডার করে এসে বলে,” রোজা কেমন আছে?”

দিবা সগর্বে বলে,” খুব ভালো। এখন ও আপনার কথা খুব একটা বলে না। সবসময় আমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এইযে এতোক্ষণ ধরে বাইরে আছি, এর মধ্যে পাঁচবার ওর সাথে ভিডিওকলে কথা বলতে হয়েছে।”

” বাহ, মেয়েকে তো ভালোই হাত করে ফেলেছো। আর মেয়ের বাবার কি খবর? সেও কি…”

দিবা সঙ্গে সঙ্গে রোদেলাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,” আমি আপনার সাথে আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক নই।”

রোদেলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে বলে,” ঈশানকে তোমার চেয়ে অনেক ভালো আমি চিনি দিবা। তাই এসব অভিনয় আমার সামনে করে লাভ নেই। আচ্ছা একটা কথা বলোতো? তোমরা ঘনিষ্ট হয়েছো কতবার? এতোদিনে তোমার বুঝে যাওয়া উচিৎ ওর প্রবলেমটা। বিছানায় কি পরিমাণ ভায়োলেন্ট ও। জানোয়ারের মতো আচরণ করে। কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মেয়ের পক্ষে সম্ভব না ওর মতো সাইকোকে হ্যান্ডেল করা।”

দিবার গা কাটা দিয়ে উঠে। চোখ-মুখ শুকিয়ে যায়।

রোদেলা বলে,” আর শুধু ঘরের বউয়ের সাথেই ও এমন৷ কিন্তু বাইরের মেয়েদের সাথে যখন ফূর্তি করে, তখন আবার সব ঠিকঠাক। কেউ কিছু বুঝতেও পারবে না। অবশ্য তোমার এসব জেনে কি কাজ? তুমি তো ওর টাকা-পয়সা নিয়েই খুব হ্যাপি আছো দেখছি। আনন্দে-উল্লাসে দিন কাটাতে পারছো। ওর চরিত্র নিয়ে তোমার মাথাব্যথা থাকার কথা না।”

দিবা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। খানিকটা চিৎকার করেই বলে,” আমার এখানে আপনার সাথে বসাই ভুল হয়েছে। আর কখনও আপনি আমার আশেপাশে এলে আমি পুলিশ কল করব। মাইন্ড ইট।”

এটুকু বলেই সে ভীষণ রেগে গটগট করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায়। রোদেলার ঠোঁটে তখনও লেগে থাকে একটা প্রচ্ছন্ন হাসি। দিবা রেগে গেছে মানে তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সে দিবার মনে সন্দেহের বীজ বপন করতে পুরোপুরি সক্ষম।

ওয়েটার দুই গ্লাস কোল্ড্রিংক্স এনে জিজ্ঞেস করে,” ম্যাম, আরেকটা কি করব?”

রোদেলা হাসি মুখে বলে,” রেখে যান৷ দুই গ্লাসই আমি খাবো। চিয়ার্স!”

চলবে