#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১৩
Sidratul Muntaz
ঘড়িতে রাত তিনটা বাজছে। পাশেই ঈশান ঘুমিয়ে আছে বিভোর হয়ে৷ তার উষ্ণ নিঃশ্বাস দিবার গলায় এসে পড়ছে। নিজেকে সামলে ধীরে ধীরে উঠে বসে দিবা। পুরো শরীর ব্যথায় টনটন করছে। তবু সে বিছানা থেকে নামে। এই মুহূর্তে আবার শাড়ি পরার ঝামেলা করতে ইচ্ছে করছে না। তাই মেঝেতে পড়ে থাকা ঈশানের টি-শার্টটাই তুলে গায়ে জড়িয়ে নেয়। তারপর মোবাইল হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসে।
আজকে সারাদিন রাফিনের কথা তার একবারও মনে হয়নি। এমনকি ঈশানের সাথে ঘনিষ্ট মুহূর্তের সময়ও না। তবে এই মুহূর্তে হঠাৎ খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কেমন আছে রাফিন? দিবার মতো সেও কি নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে? নাকি এখনও আটকে আছে অতীতে!
গ্যালারি খুঁজে তার আর রাফিনের কিছু ছবি বের করে দিবা। কত-শত রঙিন স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷ অবশ্য ওসব এখন আর রঙিন নেই, ধূসর হয়ে গেছে। অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে ফিসফিস করে বলে,” আজ থেকে সব শেষ হয়ে গেছে রাফিন। আমি এখন থেকে পুরোপুরি অন্যকারো। এখন তোমার ছবি দেখাও আমার জন্য পাপ! আ’ম স্যরি।”
দিবা কাঁদতে কাঁদতে রাফিনের সব ছবি ডিলিট করে দেয়৷ তার হাতের আঙুল কাঁপছে৷ রাফিনের ফোন নাম্বার এখনও মুখস্ত, ঠোঁটের আগায় এসে আটকে আছে৷ একবার কি সে ফোন করবে রাফিনকে? অন্তত শেষবারের মতো কথা বলুক। কিন্তু রাফিন কি জেগে আছে এখন? ঘুম ভেঙে সে কি ফোনটা ধরবে?
দিবা জানে না, তখন রাফিনও নিজের ফোনের গ্যালারিতে ঢুকে দিবার ছবিই দেখছিল৷ রাতটা তার প্রায়শই নির্ঘুম কাটে। নিকোটিনের ধোঁয়ায় স্মৃতিগ্রস্ত রাফিন বিষণ্ণ চিত্তে নিঃসঙ্গ বারান্দায় হেঁটে বেড়ায়৷ অস্থিরতা তার পিছু ছাড়ে না। দিবার বন্ধ সিমের নাম্বারে সে প্রতিদিন ফোন করে।
দিবা ডায়াললিস্টে গিয়ে রাফিনের নাম্বারটা তুলে নেয়। ডায়াল করবে কি-না দ্বিধায় পড়ে যায়। ঠিক তখনি ভেতরের ঘর থেকে ঈশান ডেকে ওঠে,” দিবা, দিবা কোথায় তুমি?”
দিবা তড়িঘড়ি করে নাম্বারটা মুছে ফেলে। তারপর মোবাইল লক করে দ্রুত উঠে রুমে যায়। ঈশান তাকিয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে। বালিশ থেকে মাথা তুলে প্রশ্ন করে,” কোথায় গেছিলে?”
দিবা ইতস্তত করে বলে,” বারান্দায়৷ এমনি একটু সাফোকেশন লাগছিল তাই।”
ঈশান দেখতে পায় দিবার হাতে ফোন। আর ওই হাতটা সামান্য কাঁপছে৷ দিবা নিজের হাত আড়াল করে বলে,” ফোনে গান শুনছিলাম।”
তারপর দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। তার মনে হয় ঈশান হয়তো চোখ দেখেই তার মনের কথা বুঝে ফেলবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঈশান বলে,” এদিকে এসো দিবা।”
দিবা ঈশানের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঈশান তাকে টেনে নিয়ে তার বুকে মাথা রেখে কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো বলে,” দিবা আই ট্রাস্টেড ইউ। আই কান্ট এক্সেপ্ট বিট্রেয়াল।”
দিবা কেঁদে ফেলে এই পর্যায়। নিজেকে সামলে বলে,” ঠিকাছে সত্যিটাই বলছি আপনাকে। আমি রাফিনকে ফোন করব ভেবেছিলাম৷ মনে হচ্ছিল লাস্ট টাইম কথা বলা উচিৎ। এমন না যে ওকে আমি মিস করছি। বিশ্বাস করুন, ওকে নিয়ে আমি এখন আর একটুও ভাবি না৷ আমার সবকিছু জুড়ে এখন আপনি। কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে…”
ঈশান দিবার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে গভীর আওয়াজে বলে,” শশশ, আমি বুঝেছি তোমার মনের অবস্থা। এটা নরমাল। কিন্তু আমি খুবই ঈর্ষাকাতর পুরুষ দিবা। আমার ওয়াইফ আমাকে ছাড়া অন্যকোনো পুরুষের ব্যাপারে চিন্তাও করতে পারবে না। এটাই আমার নীতি। তবুও আমি তোমাকে স্পেস দিয়েছি। যেন রাফিনকে মন থেকে মুছে ফেলার পুরোপুরি সুযোগ তুমি পাও।”
দিবা ব্যাকুল হয়ে বলে,” ও আগেই আমার মন থেকে মুছে গেছে। বিশ্বাস করুন এখন আর কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই..”
ঈশান আবারও থামিয়ে দেয় দিবাকে,” শশশ, বললাম তো চুপ। আগে আমার কথা শোনো। যখন আমার বাবার ডিভোর্স হয়েছিল, মাত্র বারো বছর ছিল আমার। শৈশবের পুরো দশটি বছর, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি শুধু বাবা-মায়ের মধ্যে ঝামেলাই দেখে বড় হয়েছি। কখনও ঘরে শান্তি ছিল না৷ তারা দু’জন এতো ঝগড়া করতো যে আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো এই অশান্তি সহ্য করার চেয়ে কোথাও পালিয়ে যাই। ডিভোর্সের পর বাবা অন্যত্র বিয়ে করলেন৷ সেখানেও একই অবস্থা। ঝগড়া! প্রচন্ড অশান্তি! ওই অসুস্থ পরিবেশে আমিও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম।
ধীরে ধীরে যখন বড় হলাম, বুঝতে শিখলাম, তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি কখনও আমার পার্টনারের সাথে ঝগড়া করব না৷ তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিবো। বিনিময়ে সেও যেনো আমার প্রতি লয়্যাল হয়। রোদেলা আমার ভার্সিটির জুনিয়র ছিল। আমাকে পছন্দ করতো, প্রপোজ্যালটা ও নিজে থেকেই দিয়েছিল৷ ভেবেছিলাম এই মেয়েকে বিয়ে করলে আমার জীবনে সুখের অভাব হবে না। সে নিশ্চয়ই জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে আমাকে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।
বিয়ের কয়েক বছরেই রোদেলা কেমন বদলে গেল। আমাদের সম্পর্কটা হঠাৎ এতো টক্সিক হয়ে উঠল যে মনে হতো এই সম্পর্ক থেকে বের হতে না পারলে আমি দম আটকে মরে যাবো! শুধু মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আটকেছি। আমি চাইনি আমার মেয়েটার শৈশব আমার জন্য নষ্ট হোক। ও নিজের পরিবারে অশান্তি দেখে বড় হোক, এটা আমি কখনও চাইনি। তাই ডিভোর্সের কথা কখনও মাথায় আনিনি।
বাট আই হেইট বিট্রেয়াল। সবকিছু এক্সেপ্ট করতে পারলেও এটা এক্সেপ্ট করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই রোদেলা যখন আমার সাথে বিট্রে করল, আমি ওকে ছেড়ে দিতে একবারও ভাবলাম না৷ নিজের মেয়ের দায়িত্ব নিজেই নিলাম। কারণ আমার মেয়ের জন্য আমি একাই যথেষ্ট।
এখন এই দুনিয়ায় মেয়েই আমার একমাত্র স্বস্তির জায়গা। তবে আমি এখনও একটা সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্কের জন্য তৃষ্ণার্ত। একটা ভরসাযোগ্য হাত, পরম স্নেহ নিয়ে আমার মাথায় রাখবে কেউ। তোমাকে প্রথম দেখে আমার ঠিক সেরকমই মনে হয়েছিল।”
দিবা চুপ থাকে অনেকটা সময়। হঠাৎ বলে, ” কিন্তু অনেকেই তো বলে, আমি বিলাসবহুল জীবনের লোভে আপনাকে বিয়ে করেছি। আপনারও নিশ্চয়ই তাই মনে হয়।”
” মোটেও না। বিলাসবহুল জীবনের প্রতি লোভ থাকলে বিয়ের আগে এসে তুমি আমার কাছে রাফিনের জন্য চাকরি চাইতে না। তুমি তো তখন এই বিষয়ে নিশ্চিতই ছিলে না যে তোমার বয়ফ্রেন্ডকে চাকরি দিতে আমি রাজি হবো। আর তোমার সব শর্ত মেনে নিয়ে তোমাকেই বিয়ে করব। বরং তুমি নিশ্চয়ই এটা ভেবেছিলে যে সব শোনার পর আমি বিয়ে ভেঙে দিবো। তাই না?”
দিবা শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ঈশান বলে,” কিন্তু রাফিন কখনও চেষ্টা করলেও তোমাকে বিয়ে করতে পারতো না, সেটাও আমি বুঝতে পেরেছি তোমার একটা কথায়। যদি আমার সাথে বিয়ে না হতো, তোমার অন্যকোথাও বিয়ে হতো। কিন্তু রাফিনের সাথে কখনোই হতো না। কিন্তু তবুও তুমি ওই ছেলেটার জন্য যেই পরিমাণ রিস্ক নিয়েছো, তোমার সাহসে আমি অবাক হয়েছিলাম। সত্যি বলতে রাফিনের উপর কিছুটা ঈর্ষাও হয়েছিল।”
” তবুও কি দেখে আমার প্রতি এতো ভরসা হলো আপনার? আমি তো এই ভরসার যোগ্য ছিলাম না! ”
” তুমিই যোগ্য ছিলে, দিবা। সেটা তুমি নিজেও জানো না। যে প্রেমিককে এতো ভালোবাসতে পারে, সে স্বামীকে আরও বেশি ভালোবাসবে। প্রেমিকের প্রতি ভালোবাসা টেম্পোরারি। কিন্তু স্বামীর প্রতি সেটা পার্মানেন্ট। মেয়েদের নেচারই এরকম। ছেলেদের ক্ষেত্রে উল্টো হতে পারে। দিবা আমি জানি না তোমার আর রাফিনের মধ্যে সম্পর্ক কতটা গাঢ় ছিল। তবে এখন তুমি আমার স্ত্রী, আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমি তোমার থেকে সর্বোচ্চ লয়্যালিটি এক্সপেক্ট করতেই পারি। আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না।”
দিবা ব্যাকুল হয়ে বলে,” আমি কখনও আপনাকে নিরাশ করব না৷ এর আগে যেন আমার মৃ’ত্যু হয়!”
ঈশান মৃদু হাসে দিবার কথায়। কপালে চুমু দেয় আলতো করে। দিবা কাঁদছে, ঈশান তার চোখের জল মুছে দেয়। দিবা তার মুখটা ঈশানের বুকে গুজে কাঁদতেই থাকে অবুঝের মতো। একটু আগে করা ভুলের জন্য সে অনুতপ্ত ভীষণ। ঈশান হেসে বলে,” এইযে অবুঝ বালিকা, আর কাঁদতে হবে না। ”
” আগে বলুন, আপনি আমাকে মাফ করেছেন?”
ঈশান হালকা গম্ভীর গলায় বলে,” মাফ না করলে আমার এতো কাছে থাকতে পারতে না তুমি।”
দিবা কাঁদে আবারও। ঈশান তার মন ঘুরানোর উদ্দেশ্যে ভ্রু কুঁচকে বলে,” গায়ে এটা কি পরেছো দেখি?”
দিবা মুখ তুলে তাকায়। নরম স্বরে বলে,” আপনার টি-শার্ট৷ আসলে কিছু পাচ্ছিলাম না তাই…”
ঈশান বলে,” আমার টি-শার্ট তোমার গায়ে দেখতে একদমই ভালো লাগছে না। খোলো।”
দিবা হকচকিয়ে যায়৷ ঈশান আদেশ করে,” খুলতে বলেছি।”
দিবা বাধ্যের মতো টিশার্ট খুলে বলে,” নিন।”
” কি নিবো? ”
” আপনার টিশার্ট নিন।”
ঈশান দিবার থেকে টি-শার্টটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অবজ্ঞার স্বরে বলে,” টি-শার্ট নিয়ে আমি কি করব? আমার দরকার তোমাকে।”
লজ্জায় পুরোপুরি শিটিয়ে যায় দিবা। ঈশান নিচু হয়ে দিবার গলায় মুখ গুঁজে। শেষ রাতে পুনরায় স্বামীর মিষ্টি আদরে মন ভুলিয়ে রাফিন নামটি সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে দেয় দিবা।
তখন দুপুরবেলা, অতিথিরা সব চলে গেছে। দিবার শরীর এখন অনেকটাই ভালো। গোসল সেরে চোখে মোটা করে কাজল লাগিয়ে হালকা সাজ-গোজ করেছে সে। ভীষণ নরম আর আরামদায়ক একটা সুতির শাড়ি পরেছে। এই শাড়িটার দাম খুব বেশি। দিবা কখনও কল্পনা করেনি যে এমন শাড়ি সে ছুঁতে পারবে। অথচ এখন এই শাড়ি সে ঘরেই পরছে! জীবন কত দ্রুত বদলায়।
ইলোরা হঠাৎ ঘরে ঢোকেন। ঈশানের রুমটা বেশ পরিপাটি করে সাজিয়েছে দিবা। তিনি আশেপাশে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলেন,” নাইস!”
দিবা বারান্দার বসেছিল। হাত মগভর্তি কফি৷ মৃদু হেসে বলে,” আরে মা, আসুন!”
ইলোরা হাসি মুখে এসে বসেন দিবার পাশে। মিষ্টি করে বলেন,” তোমাকে সুন্দর লাগছে তো খুব!”
” ধন্যবাদ!”
ইলোরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে চোখে একটা হিসেবি ভাব নিয়ে বলেন,” যে কারণে এসেছি সেটা বলি, লকারের চাবিটা দাও তো মা দিবা। আয়েশা আপা বললেন ওটা নাকি এখন তোমার কাছে? আমি আজ একটু জুয়েলারি বের করব। সঙ্গে কিছু কাগজপত্রও আছে ওখানে, তোমার বাবার রেখে যাওয়া কিছু শেয়ার সার্টিফিকেট।”
দিবা একটু তাকায়, তারপর নরম হেসে বলে,” কি কি লাগবে লিস্ট করে দিন। আমি বের করে আপনাকে দিয়ে আসবো।”
ইলোরা হালকা গম্ভীর মুখে বলেন,” তুমি মনে হয় আমার কথা বুঝতে পারোনি। চাবিটা আমার কাছেই সবসময় থাকে৷ ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে ঈশানের কাছে রেখে গেছিলাম জাস্ট।”
দিবাও সিরিয়াস মুখ করে বলে, ” কিন্তু মা, ঈশান তো আমাকে সেরকম কিছু বলেনি। বরং চাবিটা এখন ও আমাকে দিয়েছে। সব ফিনান্সের দায়িত্ব আমার উপরই। আপনি চাইলে যা লাগবে, আমি এনে দেব।”
ইলোরা ভ্রু কুঁচকে বলেন,”মানে? আমি নিজের লকারে হাত দিতে পারব না? সেটা তো আমাদেরই টাকা, আমাদের সম্পত্তি!”
দিবা স্বভাবসুলভ নম্রতায় হাসে। কিন্তু গলায় দৃঢ়তা নিয়ে বলে,”জ্বী, বুঝতে পারছি। তবে এখন যেহেতু ঈশান সংসারের হেড, ও-ই সিদ্ধান্ত নেয় কিভাবে টাকা খরচ হবে। আর সে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে।”
ইলোরা রেগে উঠেন,”তোমার কি মনে হয়? আমি কি তোমার কাছ থেকে টাকা ভিক্ষা চাইছি? আমি তোমার শ্বশুরের বউ। তুমি কিসের জোরে এসব বলছো? একটা নতুন বউ হয়ে তুমি এখন থেকেই এই রকম…”
দিবা একটু থেমে, শান্ত গলায় চোখে স্পষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,”আমি কিচ্ছু অন্যায় বলছি না মা। আপনি নিজেই বলেছেন, আব্বু এখন ব্যবসায় নেই, বরং ঘোরাঘুরি আর রিল্যাক্স করে লাইফটা উপভোগ করছেন। তার সেভিংস আছে, সেগুলোই যথেষ্ট আপনাদের জন্য৷ তাই না? আপনার যা প্রয়োজন, ওখান থেকে নিয়ে নিবেন।”
ইলোরা অপমান বোধ করে বলেন, “মানে তুমি চাইছো আমি এ বাড়ির টাকা ছুঁতে পারব না?”
” এই বাড়ির টাকা না, আমার স্বামীর টাকা। আর তাতে আমার শতভাগ অধিকার আছে।” দিবা হাসে মিষ্টি করে।
ইলোরা কটমট করে বলেন,” দুইদিন হয়নি এই সংসারে এসেছো৷ একজন বাইরের মেয়ে হয়ে আমার পরিবারের লকারের অধিকার নিয়ে কথা বলছো?”
দিবা গম্ভীর তবে সরাসরি ভঙ্গিতে বলে,” আমি বাইরের কেউ নই। আমি ঈশানের স্ত্রী। আর একজন স্ত্রী হিসেবে স্বামীর উপার্জনে আমার অধিকার থাকবেই। সংসারের খরচ, দায়িত্ব, সিদ্ধান্ত এসব আজ ঈশান দেখে, আর সে আমাকে বিশ্বাস করে। তাই আপনি যদি কিছু চান, আমাকে বললে আমি ব্যবস্থা করে দেবো। কিন্তু চাবি… সেটা আমার কাছেই থাকবে।”
কথা শেষ। দিবা চুপচাপ উঠে চলে যায়। ইলোরা শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। প্রথম দেখায় তো মেয়েটাকে নিতান্তই সরল মনে হয়েছিল। ইলোরা ভেবেছিলেন আঠারো-উনিশ বছরের পিচ্চি মেয়ে আর কতটুকুই বা বুঝবে? কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে এই মেয়ে বয়সের তুলনায় আসলে কত চালাক! মাত্র কয়েকদিনেই সবকিছু নিজের দখলে নিয়ে ফেলেছে।
ঘরে থমথমে নীরবতা। দিবা চুপচাপ গম্ভীর মুখে নিজের আলমারি গুছাচ্ছে। ইলোরা বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে সরাসরি দিবার দিকে তাকান। দিবা পাত্তা না দেওয়ার মতো করে কাজ করতে থাকে।
ইলোরা রাগ দমিয়ে রাখতে না পেরে বলেন,”ঠিক আছে। তুমি বড্ড চালাক মেয়ে। এখন বোঝা যাচ্ছে, ঈশানকে তুমি পুরোটাই কন্ট্রোল করো। সাবধানে থেকো, দিবা। তুমি আজ যা করছো, কাল সেটা তোমারই ঘাড়ে ফিরে আসবে।”
দিবার চোখে তীব্র দৃঢ়তা। মুখে শান্ত হাসি ফুটিয়ে বলে,” এই নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি নিজের জায়গা জানি আর দায়িত্বও বুঝি। আপনার মতো অনধিকার চর্চা করতে যাবো না। তাই আমার সাথে এমন কিছু হবে না।”
ক্ষোভে ইলোরার মাথার শিরা দপদপ করছে। ঘরে এসে তিনি অবিরত পায়চারী করতে থাকেন। আলিফ সাহেব একমাত্র স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে বলেন,” কি হয়েছে তোমার?”
ইলোরা স্বামীর কাছে কাঁদুনী গাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন না। তুমুল অস্থিরতা মেশানো কণ্ঠে বলেন,” ঈশান এটা কাকে বিয়ে করল? রোদেলা এই মেয়ের চেয়ে হাজারগুণ ভালো ছিল!”
” মানে? কি বলছো? রোদেলার সাথে তোমার যে খুব সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিল তা আমি জানি। কিন্তু তাই বলে দিবাকে অপছন্দ করছো কেন?”
” কারণ রোদেলা ছিল স্মার্ট, আত্মনির্ভরশীল একটা মেয়ে। আমাকে সবসময় মান্য করেছে। অথচ দিবা তো দেখা যাচ্ছে প্রথম দিনই আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা শুরু করেছে!অল্প পানির মাছ বেশি পানি পেলে যা হয় আর কি।”
” এই কথার কি অর্থ?” আলিফ সাহেবের গলা গম্ভীর হয়ে আসে।
ইলোরা বুঝিয়ে বলেন,” রোদেলা আত্মনির্ভরশীল মেয়ে ছিল, ঈশানের টাকা-পয়সা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। সব নিজের খরচে করতো। অথচ দিবাকে দেখে মনে হচ্ছে ঈশানকে সে বিয়েই করেছে শুধু টাকার জন্য। একটা বিলাসবহুল জীবন পাওয়ার লোভে। জানো আজ লকারের চাবি নিতে গিয়েছিলাম বলে ও আমায় কি কি বলেছে?”
দিবার সাথে সম্পূর্ণ কথোপকথন স্বামীকে বিস্তারিত জানান ইলোরা। তবে তিনি নিজের দোষ ঢেকে একপাক্ষিকভাবেই কথাগুলো বলেছেন। তিনি যে লকারের চাবি নিজের বলে দাবি করেছেন এই কথা স্বামীকে জানাননি। উল্টো বলেছেন, মাত্র কিছুসময়ের জন্য লকারের চাবি চাওয়ায় দিবা তাকে অপমান করে দিয়েছে। তার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আরও নানান অসংগতিপূর্ণ মন্তব্য করেছে।
এসব শুনে স্বভাবতই আলিফ সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। সন্ধ্যায় ঈশান বাড়ি ফিরলে তিনি ছেলেকে নিজের ঘরে ডাকেন। দিবার দুপুরের কর্মকান্ড জানিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলেন,” তোমার বউকে সামলাও বাবা। সে আসতে না আসতেই ইলোরাকে অসম্মান করতে শুরু করেছে। ইলোরা যদি তোমার নিজের মা হতো, তুমি কি তার এই অপমান সহ্য করতে? সে ডিরেক্ট বলেছে তোমার উপার্জনে একমাত্র তার অধিকার। ইলোরাকে এই বাড়িতে থাকতে হলে নাকি তার কথা শুনেই চলতে হবে। ওইটুকু পুচকে মেয়ের এতো সাহস? ওকে নিশ্চয়ই তুমিই লাই দিয়েছো।”
ঈশান একটু হকচকিয়ে যায় বাবার কাছে এগুলো শুনে। দিবার মতো নরম-সরম মেয়ে ওমন কঠিন কথা বলতে পারে তা যেন বিশ্বাসই হয় না। ঘরে গিয়ে ঈশান নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ হয় না। গলা থেকে টাই টেনে খুলতে খুলতে রুক্ষ মেজাজে দিবাকে ডাকে।
দিবার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের একটা শাড়ি, মুখে সামান্য প্রসাধন, চুলগুলো একপাশে এনে সুন্দর বিনুনী করেছে। মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে সে ঈশানের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে কফির মগ। সেটা টেবিলে রেখেই কোমল কণ্ঠে বলে,” ডাকছিলেন? আপনার জন্য কফি বানাচ্ছিলাম।”
ঈশান গম্ভীর স্বরে বলে,” এদিকে এসো। একটা জরুরী বিষয়ে কথা বলবো। ঠিকঠাক উত্তর দিবে কিন্তু।”
দিবা আলতো করে ঈশানের গলায় হাত রেখে বলে,” কি কথা? বলুন না!”
ঈশান তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,” আমি সিরিয়াস বিষয়ে কথা বলছি দিবা, তুমিও সিরিয়াস হও।”
দিবা জোরপূর্বক মুখটা গম্ভীর করে ভ্রু কুঁচকে-টুচকে নিয়ে বলে,” জ্বী বলুন স্যার, কি করতে পারি আপনার জন্য?”
তার এমন বাচ্চাসুলভ আচরণে ঈশান না চাইতেও হেসে গেলে। দিবাও খিলখিল করে হেসে ওঠে।
ঈশান জিজ্ঞেস করে,” দুপুরে মিসেস ইলোরা তোমার কাছে লকারের চাবি চেয়েছিল?”
দিবার মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায়। মুখ মলিন করে সে বলে,” হুম।”
” তুমি তাকে কি বলেছো?”
” বুঝেছি, আপনার কাছে বিচার দিয়েছে আমার নামে। এখন আমার কথা তো আর বিশ্বাস করবেন না। তাই বলে লাভ নেই।”
অভিমানে গটগট করে সে চলে যেতে নেয়। ঈশান হাত টেনে ধরে বলে,” আমি কারো কথা বিশ্বাস করিনি। তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই আগে।”
দিবা একটু কান্না কান্না ভাব করে বলে,” উনি আমাকে বলছিলেন লকারের চাবিটা নাকি উনার। অথচ ওইটার মালিকানা আপনি আমাকে দিয়েছেন। আমিও সেটা জানিয়েছি। কিন্তু উনি মানতে পারলেন না। আমাকে বাইরের মেয়ে বলে অপমান করলেন। সেটা আমি সহ্য করিনি। ছোট থেকে আপার সংসারে থেকে তার শাশুড়ীর মুখে বাইরের মেয়ে কথাটা শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে। নিজের স্বামীর সংসারে এসেও এই কথা শুনতে হবে আমি কল্পনা করিনি!”
এই পর্যায়ে দিবার চোখে অশ্রুধারা নামে। ঈশান আলতো গলায় বলে,” এদিকে এসো, বসো। আর কি বলেছে তোমাকে মিসেস ইলোরা?”
” আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে? আমাকে অবস্থান বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এই কথাটাই তো যথেষ্ট। ”
” তোমার অবস্থান আমার বুকে, এসব নিয়ে মনখারাপ করার কিচ্ছু হয়নি। দেখি চোখ মোছো।”
” হুম, হয়েছে থাক। তখন আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেক কিছু বলে ফেলেছি উনাকে। সেসবই আপনার কাছে বিচার দিয়েছে। আর আপনিও শুনেছেন।”
ঈশান হতাশ স্বরে বলে,” উনি তোমার মায়ের বয়সী দিবা, উনার সাথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কথা বলা তোমার উচিৎ হয়নি।”
” ও তাই? আর উনি আমায় যা নয় তাই বলতে পারবে? এসবের কোনো বিচার নেই আপনার কাছে?”
ঈশান বলে,” উনি এখন থেকে আর কখনও তোমাকে কিছু বলতে পারবে না, সেই ব্যবস্থা আমি করব। এবার কান্না থামাও অবুঝ বালিকা।”
দিবাকে ঘুরিয়ে ঈশান যত্ন করে চোখ মুছে দেয়। লাজুক হেসে কান্না থামায় দিবা। বিয়ের প্রথম প্রথম ঈশানকে সে খুবই ভ’য় পেতো। এখন আর সেই ভ’য় একদম নেই। বউয়ের চোখের জল দেখামাত্র যে পুরুষ মোমের মতো গলে যায়, তাকে ভ’য় পাওয়ার কারণ আছে? মোটেও না!
চলবে
#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১৪
Sidratul Muntaz
বেশ কিছুদিন ধরে রাফিন খুব উগ্র আচরণ করছে। কারো সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে না। অফিস থেকে ফিরেই ঘরে দরজা আটকে ঘরে বসে থাকে। রাতে সবার সাথে খেতেও আসে না। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে অনেক চেঁচামেচি করে।
এই যেমন, আজ সন্ধ্যায় সে অফিস থেকে ফিরে দেখে রায়া টিভিতে গান ছেড়ে নুডলস খাচ্ছে। রাফিন রিমোট নিয়ে খট করে টিভি বন্ধ করে দেয়। কঠিন মুখে বলে,” সমস্যা কি তোর? পড়াশুনা বাদ দিয়ে এসব কি হচ্ছে? আবার ফেইল মারতে চাস? একবছর ইয়ার লস দিয়ে শিক্ষা হয়নি? এবার যদি কোথাও চান্স না পাস তোকে ডিরেক্ট রিকশাওয়ালা খুঁজে বিয়ে দিয়ে দিবো। আ’ম সিরিয়াস!”
ছেলের উঁচু গলা শুনে ভেতর থেকে শাহনাজ ছুটে আসেন। রায়া ততক্ষণে ভ’য়ে গুটিয়ে গেছে। ইদানিং রিতু পর্যন্ত রাফিনকে ভ’য় পাচ্ছে। রায়া তো তার সামনেই পড়ে না।
” কি হয়েছে বাবা? ও কি কোনো ভুল করেছে?”
রাফিন হাতের ব্যাগ সোফায় ছুঁড়ে ফেলে বলে,” তোমার আদরের মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে একদম মাথায় তুলেছো। পড়াশুনা বাদ দিয়ে টিভিতে কি ওর? সন্ধ্যায় মানুষ পড়তে বসে আর ও গান ছেড়ে টিভির সামনে হা করে আছে। আর কখনও যদি ওকে আমি টিভির রুমে দেখি ঠ্যাং ভেঙে ফেলবো বলে দিলাম।”
উগ্র মেজাজে কথাগুলো বলে রাফিন ঘরে চলে যায়। রায়ার চোখে ইতোমধ্যে পানি এসে গেছে। এর আগে কখনও ভাইয়ার কাছে এমন বাজেভাবে বকা খায়নি সে।শাহনাজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,” আহারে, কষ্ট পাস না সোনা। জানিসই তো তোর ভাইয়ের আজ-কাল মাথাটা খারাপ থাকে। আমার সাথেও কত দুর্ব্যবহার করে! আসলে সারাদিন অফিসে খেটে-খুটে বাসায় আসে তো, তাই মেজাজটা মনে হয় খিচড়ে থাকে।”
রিতু ডাইনিং রুম থেকে শান্ত আওয়াজে বলে,” ওসব কোনো কথা না আম্মা। তুমি খুব ভালো করেই জানো রাফিনের মেজাজের এই কারণ কি?”
” কি বলতে চাস তুই? ওই অনাথ মেয়ের শোকে আমার ছেলে দেবদাস হয়েছে?”
রিতু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,” কথাটা তো মিথ্যা না।”
শাহনাজ রেগে বলেন,” তো এখন আমি কি করব শুনি? ওই মেয়ের কাছে গিয়ে পায়ে ধরে বলবো সংসার ছেড়ে আমার ছেলের ঘরে চলে আসো! এটাই চাস তুই?”
রিতু মলিন হাসে একটু। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” সেটা তো আর সম্ভব না। কিন্তু তুমি যদি সেদিন দিবাকে একবার মেনে নিতে, আমার মনে হয় না তাহলে মেয়েটা এতো দ্রুত বিয়ে করতো। আজ বউ হয়ে হয়তো দিবা আমাদের ঘরেই আসতো।”
” তুই কি এখন সবকিছুর জন্য আমাকে দোষারোপ করছিস? আশ্চর্য! ওই মেয়ের চুলকানি উঠেছিল, তাই বিয়ে করে নিয়েছে। এটাও এখন আমার দোষ হয়ে গেল? বরং ভালোই হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি যে ওই মেয়ে আমার ঘরে আসেনি। ক’দিন গেলে রাফিন এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। ”
রিতু পানি খেতে খেতে বলে,” থাক বাদ দাও মা। এসব বলে এখন আর লাভ নেই।”
শাহনাজ নিজের জেদ বজায় রেখে বলেন,” আমি রাফিনের জন্য আরও অনেক ভালো মেয়ে দেখেছি। দিবার চেয়েও হাজার গুণ সুন্দরী আর যোগ্য। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো। কালই যাবো মেয়েটাকে দেখতে। তোর বড়মামাকে বলেছিলাম, সে-ই ব্যবস্থা করেছে। আমি গিয়ে মেয়েটাকে আংটি পরিয়ে আসবো। বিয়ে হলে রাফিন অটোমেটিক ঠিক হয়ে যাবে।”
রায়া মলিন মুখে বলে,” কিন্তু বড় আপার বিয়ে না দিয়ে আগেই রাফিন ভাইকে বিয়ে করাবে মা?”
” তোর বড়আপারও বিয়ে হবে। আগে রাফিনের জন্য মেয়ে ঠিক করে রাখি, আংটি পরিয়ে রাখি! তারপর রিতুকে তুলে দিয়ে রাফিনের বউকে ঘরে নিয়ে আসবো। একঢিলে দুই পাখি মারবো।”
শাহনাজ খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাগুলো বলেন এবং পরদিন শুক্রবার বিকালে সত্যি তিনি রাফিনকে নিয়ে মেয়ে দেখার জন্য যান। মেয়ের বাবা ইঞ্জিনিয়ার, মা গৃহিনী। বড় বড় দুইজন বোন ছিল, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ের বড় ভাইও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মেয়েটির নাম ইলা, মাত্র এইচএসসি পাশ করেছে। বয়স খুবই অল্প। আর দেখতে ভীষণ মিষ্টি। শাহনাজ গদগদ হয়ে বলেন,” মাশআল্লাহ, মাশআল্লাহ, তোমার প্রিয় শখ কি মা?”
ইলা লজ্জায় আড়ষ্ট একদম। একবারও মাথা তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। বড় একটা ওরনা দিয়ে ঘোমটা টানা তার মাথায়। কোনমতে ঠোঁট নেড়ে বলে,” জ্বী, আমি বাগান পরিচর্যা করতে খুব পছন্দ করি আন্টি।”
” বাহ, এটা তো আমারও শখ। আমাদের বারান্দায় প্রচুর গাছ। তোমার নিশ্চয়ই পছন্দ হবে। আপা, ওকে কিন্তু একদিন আমার বাসায় নিয়ে যাবো, আপনি না করতে পারবেন না।”
ইলার মা হেসে বলেন,” আমি আর নিষেধ করার কে?আপনি চাইলে শুধু একদিন কেন? সারাজীবনের জন্যই নিয়ে যেতে পারেন। অনুমতি দিয়ে দিলাম।”
ভদ্রমহিলার রসিকতায় শাহনাজ হেসে উঠেন শব্দ করে। একটু পর রাফিনের সাথে মেয়েটাকে আলাদা কথা বলতে পাঠানো হয়। পরিবেশে কেমন অস্বস্তি নেমে আসে। ইলা কোনো কথাই বলছে না। ভ’য়ে অস্থির সে। সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে এতো রাগী মনে হচ্ছে কেন? যেনো এখনি তুলে আছাড় মা’রবে ইলাকে!
হঠাৎ রাফিন বলে,” একটা প্রশ্ন করব তোমাকে?”
মেয়েটি তার দরাজ গলার আওয়াজে হালকা কেঁপে উঠে যেন। নরম-সরম ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। রাফিন বলে,” তুমি করে বলছি কারণ তোমার বয়সী অনেক স্টুডেন্ট ছিল আমার। হঠাৎ এতো দ্রুত বিয়ে করার সিদ্ধান্ত কেনো নিয়েছো?”
ইলা ইতস্তত করে বলে,” জ্বী, আসলে আমি তো সিদ্ধান্ত নেইনি। বাবা-মা যেটা ভালো মনে করেছে…”
” তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?”
ইলা চোখ বড় করে তাকায়। মুখটা খুব ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। লজ্জায় গুটিশুটি হয়ে বলে,” ছি, ছি, না। আমার কোনো ছেলে বন্ধুও নেই।”
” ভালো। আচ্ছা ধরো তোমার কাছে দু’টো বিয়ের প্রস্তাব আসলো। প্রথম জন আমেরিকায় থাকে। সেখানকার সিটিজেন। কারি কারি টাকার মালিক। আর দ্বিতীয়জন আমার মতো সাধারণ। তুমি কাকে বাছাই করবে? মিথ্যা বোলো না ”
ইলা একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। কিছুক্ষণ ভেবে-চিন্তে বলে,” যে ভালো মানুষ তাকেই বিয়ে করব।”
রাফিন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলে,” মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা! ভালো মানুষ, খারাপ মানুষ এসব কিছু না। তোমরা মেয়ে মানুষ মানেই লোভী। অবশ্যই বড়লোক ছেলে পেলে গলায় ঝুলে পড়বে। এখন ন্যাকা সাজার চেষ্টা কোর না। এসব মনগড়া নাটক অনেক দেখেছি। ”
তার উঁচু কণ্ঠের আওয়াজ শুনে ইলার মা দৌড়ে আসেন। ভ’য়ে ইলা তখন জুবুথুবু প্রায়। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে একদম। শাহনাজ ঢুকে বিচলিত গলায় প্রশ্ন করেন,” কি হয়েছে? কি হয়েছে এখানে?”
ইলার মা রেগে বলেন,” আপনার ছেলের মাথা খারাপ মনে হয়। পাগলের মতো চিৎকার করছিল। আমার মেয়েটাকে কিসব বলেছে, দেখুন ভ’য়ে কেমন কাঁপছে মেয়েটা!”
রাফিন একটাও কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। শাহনাজ কোনোমতে বলেন,” এই দূর্ঘটনার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ইলা মা, তুমি কিছু মনে কোর না। রাফিন কি বলেছে তোমাকে?”
ইলা মায়ের পেছনে গুটিয়ে যায়। ইলার মা বলেন,” থাক, মেয়েটা এমনিতেও ভ’য়ে আছে। ওকে আর প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করবেন না। আপনার পাগল ছেলের কাছে আমি বিয়ে দিবো না আমার মেয়েকে।”
অপমানে থমথমে হয়ে যায় শাহনাজের মুখ৷ হতাশ মনে তিনি ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।
আজ সন্ধ্যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের আর্মি গলফ ক্লাব রেস্টুরেন্টে দিবা-ঈশানের রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় সাদা লেহেঙ্গা গায়ে গর্জিয়াস লুকে দিবা গাড়ি থেকে নামে। তুহিন আর রেবা ভেতরেই অপেক্ষায় ছিল। নিজের বোনকে এমন রানীর মতো সাজে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যায় রেবা। কাছে এসে দিবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”কেমন আছিস দিবা? একদম ভুলেই গেছিস আমাকে। প্রয়োজন ছাড়া তো ফোনও করিস না।”
দিবা ব্যস্ত হয়ে বলে,” আস্তে আপা, ছাড়ো। সেফটিপিন খুলে ফেলবে তো।”
” ওহ, স্যরি স্যরি! তোর মেকাপটা তো অনেক সুন্দর হয়েছে রে। কোথা থেকে সেজেছিস?”
দিবা হেসে গৌরবের স্বরে বলে,” দামী পার্লারের মেকাপ তো সুন্দরই হবে।”
রেবা মাথা নাড়ে,” হ্যাঁ সেটাও ঠিক।”
দিবাকে এনে স্টেজে বসানো হয়। ঈশান তখন ব্লেজার গায়ে স্টেজের উপরেই ছিল। রোজা বিরাট সিংহাসনের মতো সোফায় বসে আছে বাবার সাথে। দিবা আসা মাত্রই ঈশান গিয়ে হাত ধরে দিবাকে স্টেজে তোলে। এই দৃশ্য দেখে অতিথিরা সবাই হাত-তালি দেয়। ক্যামেরাম্যান ছবি তুলতে শুরু করে।
ইলোরা আর আলিফ সাহেব সামনের আসনে বসে আছেন। ইলোরার মুখ মলিন। সে এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছে না। দিবার চেহারা দেখলেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। এর থেকে রোদেলা কত ভালো ছিল!
আলিফ সাহেব ফিসফিস করে বলেন,” তুমি বসে আছো কেনো? যাও একটু ওদের সাথে গিয়ে ছবি তোলো। মানুষ কি ভাববে?”
ইলোরা অবজ্ঞাসূচক কণ্ঠে বলে,” মানুষ যা খুশি ভাবুক। আমি ছবি তুলবো না ওই মেয়ের সাথে।”
মুখে এসব বললেও ঈশান যখন বাবা আর মাকে স্টেজে ডাকে, তখন আলিফ সাহেবের সাথে ইলোরাকেও যেতেই হয়। মনে বিদ্বেষ নিয়েও দিবার সাথে হাসিমুখে ছবি তোলে। দিবা টিপ্পনী কেটে বলে,” আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে মা। লকার থেকে যে জুয়েলারি বের করে দিলাম, ওগুলো পরেননি?”
ইলোরা খিটমিট করে বলে,” না প্রয়োজন হয়নি। আমার স্বামীই আমাকে যথেষ্ট জুয়েলারি কিনে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ওসব পুরনো জুয়েলারি দরকার নেই আমার।”
দিবা হেসে বলে,” তাহলে তো খুবই ভালো। আপনার না লাগলে আমাকে দিয়ে দিবেন। শুধু শুধু ফেলে রাখবেন কেন? আমি ওসব ভেঙে নতুন গয়না বানাবো।”
ইলোরার মেজাজ গরম হয়ে যায়, কঠিন করে কিছু বলতে চায় সে। কিন্তু ভীড়ের মাঝে নিজেকে সংযত রাখে।
তুহিন আসার পর থেকে শুধু খাওয়া-দাওয়াই করছে। একের পর এক কাবাব, ফিশ ফ্রাই, চিকেনে তার প্লেট ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। আবার খালি হলে সে আবার নিয়ে আসছে। রেবা বিরক্ত হয়ে বলে,” তোমার মতো পেটুক আমি একটাও দেখিনি৷ একমাত্র দুলাভাই হও তুমি, গিয়ে একটু ছবি তুলবে না?”
তুহিন খাওয়ায় ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,” ছবি তোলার সময় কি চলে যাচ্ছে? তুলবো একসময়, কিন্তু স্টার্টারের সময় চলে গেলে তো আর খেতে পারব না।”
” শুধু স্টার্টার খেয়েই যে পেট ভরে ফেলছো, ডিনার করবে না?”
” ডিনারের জন্য খালি রেখেই খাচ্ছি।”
” এটাকে খালি রেখে খাওয়া বলে? ছি!”
অনুষ্ঠানের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ভেন্যুতে রোদেলা এসে হাজির হয়। তাকে দেখে দিবার প্রাণবন্ত হাসি মাখা মুখ চিমসে যায়। ঈশানের কাছে গিয়ে সে রাগান্বিত হয়ে বলে,” উনি এখানে কি করছেন?”
ঈশান রোদেলাকে তখনও দেখেনি। দিবার কথায় সামনে তাকাতেই দেখে অতিথিদের বসার জায়গায় রোদেলাকে। ইলোরার সাথে হাসিমুখে বেশ গল্প শুরু করেছে সে। অনেক দিন পর ঘনিষ্ট বান্ধবী একত্র হলে যেমন হয় আর কি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় ঈশান। দিবা কটমট করে বলে,” আজ আপনি ঘরে চলুন। খবর আছে আপনার।”
ঈশান শান্ত স্বরে বলে,” আমি ওকে ডাকিনি।”
” মিথ্যা বলবেন না। নাহলে ও আসলো কিভাবে?”
” জানি না!”
একটু পর রোদেলা স্টেজে আসে। দিবার পাশে বসে হাসিমুখে বলে,” তোমাকে দেখতে সুন্দর লাগছে দিবা।”
দিবা কটাক্ষ স্বরে বলে,” আমি এমনিতেই সুন্দর। তাই সুন্দর লাগাটাই স্বাভাবিক।”
রোদেলা হেসে ফেলে। ফোড়ন কাটার উদ্দেশ্যে বলে,” শুনলাম তুমি নাকি ঈশানকে একদম বশ করে ফেলেছো?”
দিবাও হেসে উত্তর দেয়,” কোনটা বশ আর কোনটা ভালোবাসা সেটার বোঝার মতো জ্ঞান আপনার নেই। থাকলে আর সংসারটা ভাঙতো না।”
রোদেলা গায়ে মাখে না দিবার অপমান। ঠাট্টার স্বরে বলে,” দেখো আবার, সুতো বেশি টানলে ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
” চিন্তা করবেন না, আমি আপনার মতো না। ”
ছবি তোলার সময় রোদেলা ইচ্ছে করেই ঈশানের সাথে গিয়ে ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। দিবার ইচ্ছে করে তাকে লাথি মেরে স্টেজ থেকেই ফেলে দিতে৷ রোদেলা ঈশানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,” ইলোরা আন্টির কাছে শুনলাম, তুমি নাকি আজ-কাল জরু কা গোলাম হয়ে গেছো?”
ঈশান শীতল হেসে বলে,” এটলিস্ট তোমার মতো ছ্যাঁচরা তো আর হইনি যে বিনা ইনভাইটেশনে কারো রিসিপশনে চলে আসবো।”
রোদেলা কটমট করে বলে,” আমাকে ইলোরা আন্টি ইনভাইট করেছে।”
” সে নিজেই তো এখানের গেস্ট। সে কার পারমিশন নিয়ে তোমাকে ইনভাইট করল? আশ্চর্য!”
রোদেলা স্টেজ থেকে নেমে যায় একটু পর। ইলোরা জিজ্ঞেস করে,” ঈশানের সাথে তোমার কি কথা হলো?”
” জানি না, আমি চলে যাচ্ছি আন্টি।”
” ওমা কেনো? কিছুই তো খেলে না তুমি।”
” এই অনুষ্ঠানের খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না। শুধু রোজাকে একটু দেখার লোভে এসেছিলাম। আসি।”
রোদেলা বের হয়ে যায়। অনুষ্ঠান শেষ হয় তার দেড়টার দিকে। বাড়ি ফিরে সবাই ভীষণ ক্লান্ত। রেবাও দিবার সাথে চলে এসেছে। দিবাই তাকে জোর করে এনেছে। বেডরুমে গৃহকর্মী রোকসানা দিবাকে লেহেঙ্গা খুলতে সাহায্য করে। আর হাফসা তার মেকাপ তুলে দেয়, চুল খুলে দেয়। ইলোরা ড্রয়িং রুম থেকে চেঁচাতে থাকে,” হাফসা, রোকসানা, কোথায় তোরা?”
আয়েশা গিয়ে বলে,”ওরা তো দিবার ঘরে। দিবাকে লেহেঙ্গা খুলতে সাহায্য করছে। তোমার কি কিছু লাগবে?
ইলোরা ক্ষীপ্ত মেজাজে গজগজ করে বলে,” কেনো? ও কোন জমিদারের কন্যা যে দু’জন কাজের মেয়ে একসাথে লাগবে ওর লেহেঙ্গা খোলার জন্য? ”
” আহা, বাদ দাও না। ঈশান শুনলে আবার রাগ করবে।”
” কেনো বাদ দিবো? রোকসানা আর হাফসা তো আজ-কাল আমার কোনো অর্ডারই শোনে না। সারাক্ষণ শুধু দিবার ঘরে পড়ে থাকে। আমাকে নিজের কাজ নিজে করতে হয়। বাড়িতে এসব কি শুরু হলো? আমার কথার কি কোনো দাম নেই? ওদের তো আমার কাজের জন্যই রাখা হয়েছিল।”
ইলোরা চেঁচাতেই থাকে। কেউ তার কথা কানে তোলে না। একটু পর দিবা নিজেই বলে,” যাও তোমরা। বাকি কাজ আমি নিজেই করতে পারব।”
রেবা রোজাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দিবা না এলে সে ঘুমাবে না। একটু পর দিবা গোসল সেরে ভেতরে ঢোকে। রেবা হাসি মুখে বলে,” এইতো মা এসে গেছে! এবার খুশি?”
রোজা তার লম্বা চুল মুখ থেকে সরিয়ে দিবার দিকে তাকায় আঁড়ভোখে। মৃদু হাসে। দিবা তার গালে চুমু খেয়ে বলে,” আমার মাটা! এখনও ঘুমায়নি কেনো? গল্প শোনাতে হবে?”
রেবা একটু অবাক হয়ে বলে,” তোর গলায় ওটা কিসের দাগ দিবা?”
দিবা দ্রুত তোয়ালের আড়ালে গলাটা ঢেকে নিয়ে বলে,” তুমি কি পাঁচবছরের বাচ্চা আপা? বোঝো না কিছু?”
রেবা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এক মুহূর্ত পর হেসে ফেলে লজ্জায়। দিবা বলে,” এইটুকু দেখেই এতো অবাক হয়েছো? এটা তো বাইরে। ভেতরের গুলো দেখলে তো মনে হয় স্ট্রোক করবে। ”
রেবা তার বোনের এমন সরাসরি কথা শুনে হতবাক হয়। দিবা এসে রোজাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য মাথায় হাত বুলাতে থাকে। রেবা ফিসফিস করে দিবাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করে তার শ্বশুরবাড়ির ব্যাপারে। দিবা অবশ্য বোনের কাছে কারো নামে নিন্দা করে না। রেবা বলে,” তোর শাশুড়ীকে দেখে তো খুব দজ্জাল টাইপ মনে হলো। তোকে মনে হয় অনেক জ্বালায় তাই না?”
” আরে না, একটু বেশি খ্যাচখ্যাচ করে এই যা। আমি এসব পাত্তা দেই না।”
ঈশান বার-বার মেসেজ করছে। এদিকে রোজা এখনও ঘুমায়নি। দিবা বিরক্ত হয়ে বলে,” উফ আপা তুমি দেখোতো মেয়েটাকে। আমি গিয়ে মেয়ের বাবাকে আগে ঠান্ডা করে আসি।”
বোনের কথা শুনে আরেকবার হোচট খায় রেবা। সে দিবার থেকে প্রায় আট বছরের বড়। তবুও তার সঙ্গে কেমন নির্লজ্জের মতো বেফাঁস কথা বলছে। রেবা শুনেছিল মানুষ অতি শোকে পাগল হয়, কিন্তু দিবা তো মনে হচ্ছে অতি সুখে পাগল হয়ে গেছে!
চলবে