শর্তসাপেক্ষে পর্ব-১৯+২০

0
11

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১৯
Sidratul Muntaz

আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে,আমি বড় হই, সকলের ভালবাসা নিয়ে, আমার দুচোখে অনেক স্বপ্ন থাকে, আমি পড়ালেখা শিখতে চাই…

আমি মিনা নই, আমি দিবা। বাবা-মায়ের শত আদরের মেয়ে। তবে আমি যে তাদের শত আদরের মেয়ে- এই ব্যাপারটা যতদিনে বুঝতে শিখেছি ততদিনে তারা কেউই আর আমার সাথে নেই। নিয়তি আমাকে জীবনের প্রতি মুহূর্তে তাদের অভাব উপলব্ধি করানোর জন্য প্রস্তুত করে ফেলেছে।

অভাগী আমি, রাতে ঘুমানোর সময় হঠাৎ উপলব্ধি করলাম মা আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে না। রাতে খেতে বসলে বাবা মাছ বেছে আমার পাতে তুলে দিবে না। বরং এখন থেকে একাই শুতে হবে, একা! আর শোয়ার আগে খেয়েছি কি খাইনি সেই নিয়ে কারো মাথাব্যথাই থাকবে না। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে কি আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল আমার জীবনে!

আমার বাবা-মায়ের মৃ’ত্যুটা প্রায় একই সাথে হয়েছিল৷ বাবা অফিসের কাজে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে গুরুতর এক্সিডেন্ট করলেন। তার মৃ’ত্যুর মাত্র তিনদিনের মধ্যে আমার মা মারা গেলেন ব্রেইন স্ট্রোক করে।

আমি না কখনও মাকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাইনি। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম, এখন থেকে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে একাই ঘুমাতে হবে। আমার জন্য খালামণির শ্বশুরবাড়িতে কোনো রুম বরাদ্দ নেই। কখনও-সখনও বারান্দাতেও শুতে হয়েছে। ওখানে সিলিং ফ্যান ছিল না। স্টোর-রুম থেকে চার্জার ফ্যান এনে চালিয়ে দিতো খালামণি। সেই ফ্যান ভীষণ নোংরা। তা থেকে ধুলো এসে আমার চোখে-মুখে ঢুকে জ্বর এসে বেহাল দশা হলো।

এতো জ্বর হলো, আমি বিছানা ছেড়েও উঠতে পারলাম না, তখন না খেয়েই ছিলাম। কারণ জ্বর হলে বাবা আর মা আমার পছন্দের খাবার মিষ্টি আর মাংস এনে দিতো।বাবা-মায়ের আহ্লাদী মেয়ে ছিলাম। তাদের মৃ’ত্যুর পর এখন কেউ আমায় নিয়ে এমন আহ্লাদ করবে না।

আমাকে নিয়ে খালামণির সংসারে খুব অশান্তি হচ্ছিল। আমার মায়েরা ছিল চারবোন। তাদের মধ্যে ঢাকায় যে খালামণি ছিলেন, তার কাছেই আমাকে রাখা হলো।সে অবস্থাসম্পন্ন ছিল। আমার খরচ বহনের সামর্থ্য তার ছিল। কিন্তু সেখানে এমন জঘন্য একটা ঘটনা হলো…

প্রায় তিনবছর আমার লেখাপড়া বন্ধ ছিল। আমি উন্মুক্তে এসএসসি শেষ করেছিলাম। তারপর শুরু হয় আমার বিয়ের তোড়জোড়। ততদিনে আমি নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে শিখেছি। আমি বুঝতে শিখেছি আমার কোনো পরিবার নেই। আমি কোনো বাড়ির মেহমান নই, আশ্রিতা। তারা চাইলে আমায় এতিমখানায়ও রেখে আসতে পারে। রেবা আপার হয়তো তখন কিছু করারও থাকবে না।

আমার বিয়ে দেওয়া নিয়ে রেবা আপার শ্বশুরবাড়িতে বিরাট একটা ঝামেলা হলো একবার। আপা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে নিয়ে বের হয়ে যেতে চাইল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আপা সাবলম্বী ছিল না। সে লেখাপড়া শেষ করার আগেই তো বিয়ে হয়ে গেছিল। তাই মাথা গোজার ঠাই কোথাও ছিল না৷ এটা সবাই জানতো৷ আর সেজন্যই বোধহয়, ওই বাড়িতে আপা পড়ে ছিল জঞ্জালের মতো। আর আমি তার আবর্জনা!

নিয়তির এক জঘন্য পরিহাসে আমি তো আমার নারীত্বের অর্ধাংশ হারিয়েছিলাম। কিন্তু তখনও আমি এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করিনি। আরও বেশি অবহেলিত হতে লাগলাম। মাঝে মাঝে আপার শাশুড়ী এসে ফিসফিস করে বলতো,” আমার বাসায় যেমন টুকটাক কাজ করো, ওখানেও টুকটাক কাজ করবে। কোনো ঝামেলা নেই। তোমাকে রানীর মতো করে রাখবো। শুধু বয়সটা বেশি।”

আমাকে কারো গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার খুব চেষ্টা করা হয়েছিল। যেহেতু আমার কোনো গার্ডিয়ান নেই, ছন্নছাড়া, ঠিকানাহীন, সুতো কাটা ঘুড়ি আমি। আমার ব্যাপারে যে কেউ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতো। কারো ইচ্ছে হলে আমাকে মাঝ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে এলেও তাকে কেউ কিছু বলবে না। এমনটাই ছিল আমার অবস্থান।

তবে তুহিন ভাই আমাকে খুব সুরক্ষা দিয়ে রাখতো, এ কথা আমি অস্বীকার করব না। তার সাহায্যেই আমি এতোদূর আসতে পেরেছি। নয়তো আমার মতো জলে ভাসা পদ্মের অস্তিত্ব কবেই বিলীন হয়ে যেতো! কোনো অশিক্ষিত, কানা ল্যাংরা, কিংবা এক ঠ্যাং কবরে এমন বয়স্কলোকের কাছেই আমাকে বিয়ে দেওয়া হবে। অবশ্য কোনো অন্ধ বা লুলাও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে কি-না সন্দেহ। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে অসম্ভব সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও আমার কখনও বিয়ে হবে না।

অন্য মেয়েরা যেমন সংসারের স্বপ্ন দেখে, রাজকুমারের স্বপ্ন দেখে, আমার মতো অভাগীর জন্য সেই স্বপ্নটুকুও হারাম ছিল! তবে আমার খুঁতের কথা জেনে আমার জন্য আজে-বাজে প্রস্তাব নিয়ে আসা মানুষের অভাব ছিল না।

রেবা আপার জা একবার আমার মাথায় বুলিয়ে বলল,” দিবা, ভালোর জন্য বলছি শোনো। বিয়ে করে নাও এই লোকটাকে। তোমাকে খুব পছন্দ করেছে। সব জেনেও বিয়ে করতে চাইছে। শুধু একটা হাত নেই, তাতে কি? হাত ছাড়া কি মানুষ হয় না?”

আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম,” হাত না থাকায় ভালোই হয়েছে। একহাত চেপে ধরলেইলেই বেটা শেষ। আমার সাথে লাগতে আসতে পারবে না।”

আমার মনের মধ্যে খুব জেদ চেপে গেছিল। বিয়ে আমি অবশ্যই করব। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই তো মানুষের আকর্ষণ বেশি হয়। আমার একটা সংসারের সাধ হলো। পড়ালেখা বাদ দিয়ে আমি সারাক্ষণ সেই কাল্পনিক সংসারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম। ইশ, কেউ যদি এসে বলতো আমার তোমাকেই লাগবে। তোমার সব ত্রুটি মেনে নিয়ে আমি শুধু তোমাকেই চাই! এমন কেউ কি থাকতে পারে না আমার জন্য?

সুন্দর দেখতে একটা ছেলে আমার পেছনে খুব ঘুরতো। কলেজে যাওয়ার পথে চুপচাপ আমাকে ফলো করতো। একদিন আমি তাকে ডেকে বললাম,” বিয়ে করবে আমাকে?”

সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল। উৎফুল্ল, উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলেছিল,” তুমি রাজি? আমাকে পছন্দ হয়েছে তোমার?”

আমি ম্লান হেসে বলেছিলাম,” তুমি তো আমার স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর! ”

তার চোখ দু’টো আনন্দে চকচক করছিল। কিন্তু আমি তাকে আমার সত্যিটা যখন জানালাম, সে একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। একটু বিভ্রান্ত হয়ে বলেছিল সে আমাকে সাতদিন পর জানাবে। তারপর সাতমাস কেটে গেল, তার আর কোনো খোঁজ ছিল না।

আমি তো জানতাম এটাই হবে। অথচ মানতে পারছিলাম না কেন? মানুষের মন খুব বিচিত্র। তারা অনিশ্চিত আশায় থাকতে ভালোবাসে। রেবা আপা ওই ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করতো খুব। আমি একদিন হাসতে হাসতে বললাম,” ওসব বিয়ে-টিয়ে আমার পক্ষে সম্ভব না আপা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় সমাজের বাইরে চলে যাই। যেখানে মেয়েরা তাদের শরীর ভেঙে টাকা কামায়? আমার কোনো চিন্তা থাকবে না। পেট বাঁধানোরও কোনো ভয় থাকবে না। নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারবো। আর অঢেল টাকা কামাবো৷ আমি তো দেখতে সুন্দর। জনে জনে মানুষ আসবে আমার কাছে…”

রেবা আপা আমায় চড় মারল৷ আর আমি পাগলের মতো হাসতে লাগলাম। দুইদিন আপা এর জন্য আমার সাথে একদম কথা বলেনি।তারপর খুব হঠাৎ করেই আমার জীবনে রাফিন চলে এলো। সে আমার প্রতি এতো পাগলামি দেখাতো, মনে হতো আমার জন্য সে দুনিয়া ছেড়ে দিবে। আমিও তার প্রতি ঝুঁকে পড়তে লাগলাম। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল রেবা আপা। আমাকে সবসময় বলতো রাফিনকে যেন সত্যিটা জানিয়ে দেই। কিন্তু আমি ভ’য়ে জানাতাম না। নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ভয়!

আমাদের প্রেমের সম্পর্কটা চলতে লাগল খুব স্বাভাবিক নিয়মে। আমি তো ভুলেই গেছিলাম নিজের অপূর্ণতার কথা। আর খুব বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম যে রাফিন এই সত্যি জানলেও আমায় ছাড়বে না। তবে আমি সবসময় তার কাছে নিজের ঠাঁট বজায় রেখেছি। কারণ আমার উদ্দেশ্য ছিল বিয়ে, একটা সংসার, একটা স্বপ্নের মতো স্বামী।

কিন্তু রাফিন আমাকে বিয়ে করার সাহসটুকুও যোগাতে পারল না। আগেই বলে দিল আমি তার বোঝা। আর আমার আসল সত্যি জানলে নিশ্চয়ই আমায় আবর্জনা বানিয়ে পায়ে পিষে চলে যেতো!

ঈশান সাহেবের বিয়ের প্রস্তাবটা একদম মেঘ না চাইতেও বৃষ্টির মতো ছিল তখন। অথচ রেবা আপা নিষেধ করে দিতে চাইল৷ কারণ আমার আর রাফিনের যে ব্রেকাপ হয়েছে, এই কথা সে জানতোই না। আমি যখন বিয়েতে মত দিয়ে ফেললাম, আপা ভেবেছিল আমি বোধহয় রাফিনের সাথে অভিমান করে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। পরে এই জন্য ঠিক পস্তাবো, আফসোস করবো। কিন্তু সবচেয়ে বড় অভিমান তো আমার নিজের জীবনের প্রতি ছিল!

যাইহোক, ঈশান সাহেবের সাথে বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পর হুট করেই আমি তার বাড়ি চলে গেলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল তাকে সত্যিটা জানানোর। আমার নারীত্বের অপূর্ণতার সবচেয়ে নির্মম সত্যি। নিচে দারোয়ান আমাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তারপর ঈশান আহসানের নাম বলা মাত্রই ‘স্যরি ম্যাডাম’ বলে বিরাট একটা স্যালুট ঠুকল। আমি চমকে তাকালাম। তারপর পা রাখলাম ঈশান আহসানের বাড়ির ভেতর। দেখা হলো এক সুদর্শন ভদ্রলোকের সাথে, যাকে দেখে মোটেও অফিসের রগচটা বস মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল কোনো নায়কের বাড়িতে ঢুকে পড়েছি আমি।

হাতে কফির মগ, শান্ত মুখ, গম্ভীর চেহারা, টি-শার্ট আর ট্রাউজার গায়েও কি অসাধারণ দেখতে লাগছিল। না, আমি ক্রাশ খাইনি। তবে অবাক হয়েছিলাম৷ এমন স্বামী পেয়েও কোনো মহিলা কিভাবে ছেড়ে যায়? অবশ্য সেই রাতে কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলাম, লোকটিকে দেখতে যত ভদ্র মনে হয় আদতে সে তত ভদ্র নয়। আসলে মানুষ দূর থেকেই চাঁদের মতো সুন্দর লাগে দেখতে। কাছে গেলেই নজরে পড়ে সেই চাঁদের কলঙ্ক।

একটা আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি যে কথা বলার জন্য গেছিলাম সেই কথা বলাই হলো না ঈশান সাহেবকে। উল্টো বললাম রাফিনের চাকরির ব্যাপারটা। আমি আমার বান্ধবীর বাবাকেও বলেছিলাম যেন রাফিনের চাকরির একটা ব্যবস্থা করে। ভেবেছিলাম সে চাকরি পেয়ে আমাকে বিয়ে করবে। বিয়ের ঠিক আগের রাতে আমি তাকে সব জানাবো। তখন সে আমার হাত ধরবে নাকি ছাড়বে- এটা সে নির্ধারণ করবে।

তবু সেদিন ঈশান সাহেবকে আসল কথা না বলে চাকরির কথা কেনো বললাম তা আমি নিজেও জানি না। তবে একটা ব্যাপার আমি উপলব্ধি করেছিলাম খুব ভালো করে। ঈশান আহসান আমাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। এমনিতে তার চাহিদা ছিল, একমাত্র মেয়ের জন্য একজন আদর্শ মায়ের। কিন্তু আমাকে সেদিন দেখেই সে বউয়ের চাহিদা অনুভব করল। হা-হা-হা, পুরুষ মানুষের ওই নজর আমি ভালো করেই চিনি। তবে সেদিন সত্যিটা বলা হয়নি তাকে।

ভেবেছিলাম বিয়ের দিন বলবো। কিন্তু কিভাবে যে সব হয়ে গেল… বাসর ঘরে একা বসে আমি এসব চিন্তা করছিলাম। তাকে কিভাবে সত্যিটা জানাবো? কিংবা জানানোর সুযোগ কি সে দিবে নাকি আগেই আমাকে ছুঁয়ে ফেলবে? সবকিছু আমার ভাবনার উল্টো ঘটল। বাসর রাতে সে আমাকে তার মেয়ের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল। আর নিজেকে রাখল আড়ালে। তবুও আমি দিন গুণতে লাগলাম। আস্তে আস্তে জানাবো তাকে। সে নিশ্চয়ই আমাকে ডিভোর্স দিবে না!

ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খুব বদলে যাচ্ছিল। হঠাৎ এমন একটা সময় চলে এলো, যখন আমি তাকে সত্যিটা জানানোর বদলে লুকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম৷ নিজের পরিবর্তনে আমি নিজেই হতভম্ব! ঈশান যদি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমি ম’রে যাবো! জীবনে প্রথমবার আমি যদি কোনো পুরুষকে ভালোবেসে থাকি, সে রাফিন নয়। সে ঈশান!

রাফিনের প্রতি ওটা আমার ভালোবাসা নয়, মায়া ছিল। কিন্তু ঈশান আমার স্বামী, আমার ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি তাকে ঘিরেই তৈরী হয়েছিল। তাকে নিজের অজান্তেই আমি পাগলের মতো চাইতে লাগলাম। আর সমস্ত দুনিয়াবি নৃশংসতা ভুলে আমি এক স্বপ্নের জগতে বিভোর হয়ে গেলাম।

যেখানে ছিল আমার স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর সংসার, রাজপুত্র নয় বরং রাজা, আর রোজার মতো একটা ছোট্ট পুতুল! আমি কিভাবে এই সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব? ঈশানকে তখন সত্যি জানানো মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। ঈশান আমার অপূর্ণতা নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও আমার লয়্যালিটি নিয়ে সে অবশ্যই প্রশ্ন তুলবে। বিয়ের আগে কেনো তাকে বিষয়টা সিরিয়াসলি জানালাম না, এই আফসোস আমার কোনোদিন মিটবে না!

মানুষ মাত্রই তো ভুল করে। আমারও ভুল হয়েছিল। কিন্তু সেই ভুলের শাস্তি যে এতোটা হবে, আমি ভাবতে পারিনি। অবশ্য আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি ইচ্ছে করেই ঈশানকে সত্যিটা জানাইনি। আমার অবচেতন মনই আমাকে সে সুযোগ দেয়নি।

ভাগ্যের পরিক্রমায় ঈশানের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু যদি রাফিনের সাথে হতো? তাকেও কি জানাতাম এই সত্যি? হয়তো কখনোই না। আমি আমার জীবনের এই ভ’য়ংকর তিক্ততা কাউকে জানাতে চাই না! কোনোদিন না!

দিবা হাউমাউ করে কাঁদছে। ঘরের দরজা বন্ধ৷ তার মুখটা বালিশে গুজে রাখা৷ বদ্ধ ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রগাঢ় বিষণ্ণতা ভর করেছে।

ঈশান রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। আকাশে মস্তবড় একটা চাঁদ। ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, চাঁদটা বুঝি কাঁদছে। কি অদ্ভুত চিন্তা! চাঁদ কেনো কাঁদবে? চাঁদ কি মেয়েদের মতো নাটকবাজ? আচ্ছা চাঁদ ছেলে না মেয়ে? হঠাৎ কি সব অদ্ভুত কথা মাথায় আসছে। তার মাথাটা একদম ঠিক নেই৷ শান্তিতে একটু ঘুমাতে হবে। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ঈশানের বুকের উপর ছোট্ট রোজা ঘুমিয়ে আছে খুব নির্বিঘ্নে। আলতো করে মেয়ের লম্বা চুলে বিলি কাটছে ঈশান। যখন বোঝে মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে, তখন সন্তর্পণে তার চাঁদ কপালে চুমু এঁকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর আনমনেই ডেকে উঠে,” অবুঝ বালিকা….”

ঈশান থামে। অবুঝ বালিকা বলতে কেউ নেই। সে অতি বিচক্ষণ। ওইটুকু একটা মেয়ে হয়ে কি সুন্দর বত্রিশ বছরের সফল বিজনেস ম্যান ঈশান আহসানকে পাঁচমাস ধরে বোকা বানিয়ে রেখেছে!

হাফসা রোজার দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকে, দেখে বিছানায় ঘুমিয়ে গেছে সে। ঈশান বলে,” রেখে যা। যদি উঠে খাওয়াবো নয়তো নিয়ে যাবি।”

” আচ্ছা।” হাফসা টেবিলে দুধের পাত্র রেখে চলে যেতে নেয়। এদিকে ঈশান নিজেকে আটকাতে পারে না। জিজ্ঞেস করেই ফেলে,” তোর ভাবী কি করছে?”

হাফসা ঠোঁট উল্টে বিরক্তের ভঙ্গি করে বলে,” সইন্ধ্যায় আইসা যে দরজাটা আটকাইলো, আর তো খুলে নাই।”

ঈশান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয় খুব৷ রাত ১টা বাজে। অথচ ১০টার পাঁচমিনিট আগেই তার শুয়ে পড়ার অভ্যাস! আজ যেনো সময়ের কোনো খেয়ালই নেই। ঈশান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,” ডিনার করেছে?”

” কেডা?”

ঈশান রাগে কটমট করে বলে,” তোর ভাবীর কথা বলছি, আর কার কথা বলবো?”

হাফসা মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে,” না, দরজাই তো খুলে নাই। তো খাইবো কখন?”

” যা, এখনি গিয়ে দরজায় নক কর। তাকে বের হয়ে খেতে বসতে বল। ”

” দরজা যদি না খুলে?”

” বলবি আমি এসে দরজা ভেঙে ফেলবো।”

হাফসা খাবার বেড়েই দিবার ঘরের সামনে যায়। তারপর একনাগাড়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে। আজ দিবা দরজা না খুললে তার কপালে শনি আছে! অনেকক্ষণ পর দিবা দরজাটা খোলে। চোখ দু’টো ফোলা, কিন্তু সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। ভ্রু কুঁচকে বলে,” কি ব্যাপার?”

” ভাবী, খায়া লন। ভাইয়ে পাঠাইছে আপনার কাছে।”

” এসব নিয়ে তোমার ভাইকেই দাও। আমি খাবো না।”

দিবা দরজা আটকাতে নিলেই সামনে থেকে বাধা পায়। কিছুতেই আটকাতে পারে না। আরে, হাফসার গায়ে এতো শক্তি কোথা থেকে এলো? দরজার কোণা দিয়ে মুখ বের করে তাকাতেই দেখে ঈশান৷ দিবার মুখ কঠিন হয়ে আসে। দরজা ছেড়ে ভেতরে চলে যায়।

ঈশান হাফসাকে ইশারা করে খাবারের প্লেট রেখে চলে যাওয়ার জন্য৷ মেয়েটা চুপচাপ নির্দেশ পালন করে। ঈশান একটু এগিয়ে এসে পকেটে হাত রেখে খুব দায়সারা কণ্ঠে বলে,” চুপচাপ খেতে বসুন। এসব নাটক আমি সহ্য করব না বেশিক্ষণ। ”

দিবা অগ্নিদৃষ্টিতে প্রশ্ন করে,” তো কি করবেন?”

” ঘাড় ধাক্কা মেরে বাসা থেকে বের করে দিবো।”

ঈশানের এমন বেপরোয়া জবাবে দিবাও ক্ষেপে উঠে। হঠাৎ সে ওয়ারড্রোবের কাছে গিয়ে একটা ব্যাগ বের করে। কয়েকটা জামা-কাপড় সেখানে ঢোকাতে শুরু করে। ঈশান এসব দেখে ভ্রু কুঁচকায়। এগিয়ে এসে তার হাত চেপে ধরে বলে,” কি হচ্ছে?”

দিবা জবাব দেয় অগ্নিমূর্তি হয়ে,” আমি বের হয়ে যাচ্ছি।”

ঈশান রুঢ় স্বরে ধমকে উঠে,” ঠ্যাং ভেঙে ফেলবো বাড়ির বাইরে এক পা রাখলে।”

দিবার হঠাৎ কি হয় সে জানে না। খাবারের সাথে যে পানির গ্লাস ছিল, সেটা নিয়ে ঈশানের মাথায় ঢেলে দেয়। তার এমন আচরণে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ ঈশান৷ প্রথম কয়েক মুহূর্ত বিশ্বাসই করতে পারে না যে এটা কি হলো! দিবার এতো সাহস?

*দিবার এক্সিডেন্ট কিভাবে হয়েছিল সেটাও একটা টুইস্ট। সামনের পর্বে জানবেন। সবাই বেশি বেশি লাইক কমেন্ট করবেন।

চলবে

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২০
Sidratul Muntaz

ঈশানের মুখে পানি ছুঁড়ে মারার সময় দিবার মনটা জ্বলছিল রোষের আগুনে। মাথা তখন একদমই কাজ করেনি, কোনো হুশই ছিল না। কিন্তু যখন সে ঈশানের ভিজে যাওয়া মুখটা ভালো করে দেখে যা ইতোমধ্যে ক্রোধে লাল হয়ে এসেছে, দিবা তার বক্ষপটে অনুভব করে তীব্র কম্পন। ঢোক গিলে সামলায় নিজেকে। হালকা পিছিয়েও যায়।

হ্যাঁ কাজটা সে বাড়াবাড়িই করেছে। এমনটা তো করা উচিৎ হয়নি। সে নিজের দুঃখ ভুলতে এভাবে অযাচিত রাগ ঝারতে পারে না। এতে তো কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। তাছাড়া কষ্ট সয়ে তার অভ্যাস আছে। শুধু পাঁচটি মাস স্বপ্নের মতো কেটে গেছিল ভুল করে। এখন যখন দুয়ারে বাস্তবতা কড়া নাড়ছে, সে এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা মানতে পারছে না কেনো? কেনো ছেলেমানুষী করছে?

দিবা একটু সরে ভ’য়ে ভ’য়ে আঁড়চোখে তাকায় ঈশানের দিকে। চোয়াল শক্ত করে মুখ থেকে পানিটা মুছে নিচ্ছে ঈশান। অর্ধভেজা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকায় সে। ওই চোখে যেন আগুনের শিখা দপদপ করছে। দিবার বুকের ভেতরেও ঢিপঢিপ করছে। তবে সে নিজেকে শক্ত রাখে। যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে বলে,” চলে যান এই ঘর থেকে। আপনি আর আমার সামনে না এলেই খুশি হবো।”

ঈশান ফট করে তেড়ে আসে দিবার কাছে, যেন এখনি তাকে ধরে একটা আছাড় মা’রবে এমন দুঃসাহস দেখানোর জন্য। দিবা আৎকে উঠে দ্রুত দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়ায়। চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে তার থেকেও কমপক্ষে নয়-দশ ইঞ্চি বেশি লম্বা মানুষটির দিকে। দিবার চোখে-মুখে এমন ভয় দেখে ঈশান থামে, ভেবেছিল শক্ত করে তার ডানহাতটা টেনে মুচড়ে ধরবে পেছনে। কিন্তু নিজের রাগটা সে সামলে নেয়। মনে পড়ে দিবার বয়সের কথা। এইটুকু মেয়ের থেকে সে আর কি আশা করবে? এই মেয়ে তো নিজেই জানে না সে কি চায়। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল- সেই সম্পর্কে তার ধারণাই নেই। এমনকি ভালো-মন্দের পার্থক্য করার বয়সটাও তার হয়নি।

ঈশান চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নেয় জোরে, রাগ নিয়ন্ত্রণ করে চুপচাপ চলে যায় রুম থেকে। দিবা তখনও দেয়ালে পিঠ ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশান চলে যেতেই সে হাঁফ ছেড়ে, ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে চুপচাপ। দুইহাত একত্র করে মুখে ঠেকায়। কাঁদতে শুরু করে আবারও। জীবনে কত দুঃখ এসেছে, কখনও এভাবে কান্না পায়নি তো! অথচ আজ দিবা এমনভাবে কাঁদছে, যেন উনিশ বছরের জমিয়ে রাখা কান্না একদিনেই সেরে ফেলবে!

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দিবা আরও একটা দুঃসাহসিক কাজ করে। তার নামে একটা ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিয়েছিল ঈশান। সেখান থেকে নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করতো দিবা, ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে। এমনকি ঈশানের নিজের ক্রেডিট কার্ডের এড-অনও তার কাছে ছিল। দিবার হাতের দামী ফোন, মাত্র দুইমাস আগেই ইউএসএ থেকে আনিয়েছে ঈশান। তাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। দিবা যখন জিজ্ঞেস করল,” হঠাৎ এতোবড় সারপ্রাইজ কেনো?”

ঈশান দিবার কোমর চেপে ধরে বলল,” মাঝে মাঝে বউকে এভাবে সারপ্রাইজ দিতে আমার ভালো লাগে!”

দিবা হা করে তাকিয়ে ছিল, দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাস আর বিস্ময় নিয়ে। ঈশান আঙুল দিয়ে দিবার নিচের ঠোঁটে টোকা মেরে বলেছিল,” তবে এখন থেকে আমার কথা আরও বেশি বেশি শুনতে হবে।”

দিবা মাথা নেড়ে বলেছিল,” ওকে।”

এই সবকিছু দিয়ে ঈশান নিজেকে যেমন বেস্ট হাজব্যান্ড প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল, ঠিক তেমনি দিবাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা অন্যতম হাতিয়ার হিসেবেও এসব কাজে লাগাচ্ছিল। তার কি ধারণা? দিবাকে এসবের জন্য সারাজীবন তার গোলামি করে যাবে? না, দিবা তাকে বুঝিয়ে দিবে যে সে আসলে কি!

দিবা একসময় ভাবতো শুধু টাকাই সর্বসুখের উৎস। টাকা থাকলে মানুষ সব পারে। কিন্তু গতকালকের পর থেকে এই টাকা-পয়সা, জৌলুস, ধন-সম্পদ, সব তার কাছে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে৷ মনে হচ্ছে এই বিশাল মহলের মতো বাড়ির দেয়ালগুলোও তার গলা চেপে ধরবে। এই দামী পোশাক, দামী কসমেটিক্স, জুয়েলারি, দামি ফোন সব যেন কাটার মতো বিঁধছে শরীরে। তাই কাটা উপড়ে ফেলতেই সকাল সকাল প্রস্তুত হয়ে ঈশানের ঘরে প্রবেশ করে সে।

ঈশান ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে মাত্র। রোজা এখানে নেই, করিডোরে বেবি সিটার তৃষার সাথে ডল হাউজ বানাচ্ছে। দিবাকে দেখে খুব দায়সারা একটা ভঙ্গিতে তাকায় ঈশান। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে,” কিছু লাগবে?”

” কিছুই লাগবে না। বরং এই পর্যন্ত যা কিছু দিয়েছেন, সব ফেরত দিতে এলাম। ”

এটুকু বলেই দিবা কার্ডগুলো আর ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দেয়। ঈশান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করতে উদ্যত হতেই দিবা বলে উঠে শক্তমুখে, অসম্ভব গম্ভীর স্বরে,” এসব কিছুই আমার লাগবে না।”

কথাটা শুনেই মাথা নিচু করে মুচকি হাসে ঈশান। দিবা চোখ গরম করে বলে,” এখন থেকে আপনিও আমাকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না৷ আমি হিজাব ছাড়াই ভার্সিটি যাবো৷ ওরনা যেভাবে খুশি গায়ে দিবো, স্ক্রিন ফিটেড ড্রেস পরবো। নিজের পছন্দমতো।”

” রোদেলা হতে চাইছো সেটা বললেই হয়।”

দিবা বিষণ্ণ হেসে বলে,” আমি রোদেলা হতে চাইনি, বরং আপনি নিজেই আমাক রোদেলার জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন।”

কথাটা বলে দিবা বের হয়ে যায় রুম থেকে। ঈশান কিছুই বলে না। মনে মনে সে কি ভাবছে? সে কি দিবার অনুভূতি বুঝবে?উফ, দিবা এসব নিয়ে ভাবছে কেন? সে আর নিজের মাথাটা খারাপ করতে চায় না। ঘরে এসে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে সে। নিজের পুরনো জামাগুলো বের করে। এসব দেখতে এখন কেমন যেন লাগে। সে আগে এই ধরণের জামা পরতো, বিশ্বাস হচ্ছে না। কিভাবে পরতো? তবে যাই হোক, এখন থেকে ঈশানের দেওয়া কিছুই সে গ্রহণ করবে না। শুধু মোহরানার টাকাটুকু ছাড়া। ওই টাকা তার অধিকার! সে ওই টাকায় একটা ব্যবসা শুরু করবে ভেবেছে। আচ্ছা, সে কি রোদেলার পথেই হাঁটছে?

দরজায় শব্দ হতেই দিবা পেছনে ঘুরে তাকায়। হাফসা ফিসফিস করে বলে,” ভাবী, ভাই আপনারে ঘর থেকা বাহির হইতে নিষেদ করছে।”

” মানে? ভার্সিটি যেতে পারব না আমি?”

” জানি না, আমারে কইল দরজাটা বাইরে থেকা লক কইরা দিতে।”

দিবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাফসা সত্যি সত্যি দরজা লক করে দেয়। মৃদু আওয়াজে দিবা হালকা কেঁপে উঠে। তারপর, তারপর থমথমে নীরবতা! সিলিং ফ্যান ঘুরছে মাথার উপর। ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে দিবা, দিবা রহমান। এসব কি হচ্ছে? কি হচ্ছে?

একটা বিষণ্ণ ভোরের সূচনা। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাস্তায় দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সাদা রঙের টয়োটা। গন্তব্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। জানালার ভেতর থেকে মুখ বের করে উদাসীন দৃষ্টিতে বাহিরটা দেখছে দিবা। নীল আকাশে সাদা ধোঁয়ার মতো কুন্ডলী পাকিয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘ। সকালের বাতাসটা কত স্নিগ্ধ! আজকে খুব সুন্দর একটা দিন হওয়ার কথা ছিল। দিবার কত শখের এই আমেরিকা ট্রিপ। কত-শত পরিকল্পনা ছিল! অথচ যেতে হচ্ছে মুখ ভার করে, মনের আকাশে একরাশ কালো মেঘ জমিয়ে।

সামনে ড্রাইভার হোসেনের পাশে বসেছে ঈশান। দিবার কেন যেন মনে হচ্ছে, রিয়ার ভিউ মিররে সে বোধহয় দিবাকেই দেখছে। কিন্তু দিবা তাকাতেই দৃষ্টি সরিয়ে রোজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা ভেবেই একটু তাচ্ছিল্য হাসে দিবা। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না যাওয়ার। কিন্তু সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। হঠাৎ রাতে এসে ঈশান জানালো ভোরে ফ্লাইট। দিবা ঝাঁঝ মাখা গলায় প্রশ্ন করল,” আমি ওখানে কেনো যাবো?”

ঈশান তার ভাব গম্ভীরতা বজায় রেখেই বলেছে,” রোজার দেখা-শুনার জন্য কাউকে তো দরকার!”

” তাহলে বেবি সিটার তৃষা আপাকেই নিয়ে যান। পাসপোর্টে আমার ছবির উপর তার একটা ছবি নিয়ে স্ট্যাপলার মেরে বসিয়ে দিন।”

” আর ইউ কিডিং মি?” অত্যন্ত ভারী কণ্ঠে বলল ঈশান।

” আমি কোথাও যাবো না।”

দিবা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল নিজের সিদ্ধান্ত। কিন্তু বর্তমানে সে গাড়িতে রোজার পাশেই বসে আছে। কোমল দৃষ্টিতে তাকায় রোজার দিকে তাকায় দিবা। বাচ্চারা কি নিষ্পাপ, সবসময় নিজস্ব জগতে বুদ হয়ে থাকে। দেখে মনে হয় এখনি কিছু বলবে সে! তারপর হঠাৎ মনে পড়ে, বাচ্চাটা কথাই বলতে জানে না। ইশ, কি নির্মম! অযথাই রোজার মুখ টেনে নিয়ে গালে একটা চুমু দেয় দিবা। লম্বা, ঘন আর সিল্কি চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

রোজার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায় সে চোখ তুলে তাকায় একটু। তারপর আবার গভীর মনোযোগে রুবিক্স কিউব মেলানোর কাজে ব্যস্ত হয়। সাড়ে চারবছরের একটা বাচ্চা সে, অথচ এই রুবিক্স কিউবের একপাশ কি সুন্দরভাবে মিলিয়ে ফেলতে পারে! মেয়েটির পর্যবেক্ষণশীলতা খুব প্রখর। বড় হলে নিশ্চয়ই খুব ট্যালেন্টেড হবে।

কিছুক্ষণ পর গন্তব্যে চলে আসতেই তারা গাড়ি থেকে নামে। ঈশান একহাতে রোজাকে কোলে নিয়ে অন্যহাতে তুলে নেয় লাগেজ। দিবা আলতো স্বরে বলে,” ওকে আমার কোলে দিন।”

” আপনি শুধু নিজের শরীরের ভার বহন করে হাঁটুন। তাতেই চলবে।”

গম্ভীর গলায় এই কথা বলে সামনে এগিয়ে যায় ঈশান দিবা অবাক হয়ে তাকায়। কি বলল এই লোকটা? দিবা কি খুব মোটা যে তার শরীরের ভার বহন করতে হবে? মাত্র তিপ্পান্ন কেজি তার ওজন। উচ্চতা পাঁচফুট দুই।

চেকপোস্ট, বোর্ডিং পাস সংগ্রহ, ইমিগ্রেশন,এসব প্রাথমিক ফরমালিটিজ শেষ করে দিবা আর রোজাকে নিয়ে ঈশান ঢুকে পড়ে ভিআইপি লাউঞ্জে। রোজা খুব ক্লান্ত লাগছে এমন ভঙ্গিতে বসে পড়ে আরামদায়ক সোফায়। দিবা জিজ্ঞেস করে,” তোমার ক্ষিদে পেয়েছে বার্বী ডল?”

রোজা দুইপাশে মাথা নাড়ে ভ্রু কুঁচকে। যেন ক্ষিদে পাওয়াও একটা বিরক্তির ব্যাপার। সে খেলতে চায়। এদিক-ওদিক দৌড়াতে শুরু করে। দিবা চুপচাপ বসে দেখতে থাকে মেয়ের কর্মকান্ড। ঈশান একটা কথা না বলেই বের হয়ে যায়৷ দিবা একঝলক সেদিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে উচ্চারণ করে,” ইবলিশ!”

বিয়ের প্রথম দিকে সে ঈশানের নাম্বার সেভ করেছিল ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’ লিখে। মাঝে কয়েকদিনের উষ্ণ ভালোবাসায় সেটা হয়ে গেছিল ‘ beloved’.

তবে এখন আবার সেটা চেঞ্জ হয়ে ‘ ইবলিশ’ এ কনভার্ট হয়ে গেছে।

ঈশান চলে আসে তার টিমের কাছে। সবাই আগেই এসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। পিআর তামান্না তো খুব উৎসুক হয়েছিল দিবাকে একবার দেখবে। ঈশানের দ্বিতীয় বউ নিয়ে তাদের মধ্যে একটা চাপা আগ্রহ বিরাজ করছে। ঈশানের মতো নাকউঁচু, ব্যক্তিত্ববান পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করেছে মানে মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব স্পেশাল! তামান্নার এতো আগ্রহ দেখে আসিফ ফিসফিস করে বলে,”লাভ নেই। দেখতে পাবেন না। ভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকে গেছে ফট করে।”

তামান্না হেসে বলে,” আমি স্যারকে রিকয়েস্ট করব যেন ম্যাডামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।”

” ঈশান স্যার এটা করবেন বলে মনে হয় না।”

তাদের আলোচনা শুনে রাফিনের মুখ ভীষণ মলিন হতে থাকে। মনে হয় এইভাবে আর কিছুক্ষণ চললে তার দমবন্ধ হয়ে আসবে। আগে জানলে সে কখনোই রাজি হতো না এখানে আসার জন্য। কিন্তু এখন কিছু করার নেই।

ঈশান লাউঞ্জে ঢুকতেই সবাই সচেতন হয়ে যায়। উঠে সালাম দেয়। মার্কেটিং হেড মিজান সাহেব এসে তাকে সবকিছুর আপডেট জানাতে থাকেন। হঠাৎ ঈশানের নজর রাফিনের উপর থমকে যায়। হালকা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,” ও এখানে কেনো?”

সবার নজর এবার রাফিনের দিকে চলে যায়। মাথা নিচু করে গাঁট হয়ে বসেছিল রাফিন। আলতো হাসার চেষ্টা করে বলে,” স্যার, আমাকে…”

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিজান সাহেব বলেন,” স্যার আমাকে ট্রেইনি সিলেক্ট করতে বলেছিলেন না? ওকেই সিলেক্ট করলাম আর কি। ভাবলাম নতুন মানুষ, একটু এক্টিভ হবে, শিখবে!”

ঈশান নিজের বিস্ময় আর মেজাজ খুব সন্তর্পণে ধামাচাপা দেয়। এইরকম একটা ব্লেন্ডার যে হবে সে একটুও বোঝেনি। মিজান সাহেব যে ট্রেইনি হিসেবে রাফিনের মতো অনভিজ্ঞ কাউকেই সিলেক্ট করবে সেটা কে জানতো? তবে ঈশান চায় না এই নিয়ে তার প্রফেশনাল লাইফে বিন্দুমাত্র গসিপ সৃষ্টি হোক। তাই বিষয়টা এড়ানোর ভঙ্গি করে বলে,” এনিওয়ে..”

একবার হাতের ঘড়িটা দেখে নেয়। তারপর কিছু অফিশিয়াল কথা-বার্তা সেরে সবাইকে গাইড করে সে চলে আসে নিজের ভিআইপি লাউঞ্জে।

দিবা তখন রোজাকে যত্ন করে চকলেট কেক খাইয়ে দিচ্ছে। ঈশান খুব অস্থিরবোধ করতে থাকে। ঠিক দিবাদের বরাবর সোফাতেই এসে বসে। উত্তেজনা দমাতে মুখে হাত ঠেকায়। দিবার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, রাফিনকে দেখার পর কি করবে সে?

ঈশানকে একদৃষ্টে নিজের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে দিবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ইতস্তত ভঙ্গিতে মাথার চুল, গায়ের ওরনা ঠিক করে। তারপর রাশভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?”

ঈশান বিরক্তে ‘চ’কারান্ত শব্দ তুলে বলে,” কই তাকিয়ে আছি?”

দিবা অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলে,” এখানে আসার পর থেকে আপনি শুধু আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন এমনকি এখনও তাকিয়ে আছেন।”

ঈশান এবার ধমকের মতো বলে,” তো তাকিয়ে থাকলে কোনো প্রবলেম? অসুবিধা হচ্ছে তোমার?”

” আশ্চর্য! আপনি কিছু বলতে চান কি-না সেটা জিজ্ঞেস করছিলাম…” দিবার গলার স্বর নরম হয়ে আসে।

ঈশান এবার সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে খুব অবজ্ঞার স্বরে বলে,” ওদিকে রাফিনও আছে।”

” হোয়াট?” দিবা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে না।

ঈশান ঝুঁকে বলে,” রাফিন, তোমার বয়ফ্রেন্ডের নাম।”

দিবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ঈশান রহস্যের ভঙ্গিতে বলে,” ও এসেছে! বাইরে, আমার টিমের মধ্যেই আছে।”

কিছুক্ষণের জন্য পুরো স্তব্ধ হয়ে যায় দিবা। রোজা হা করে আছে মুখে কেক নেওয়ার জন্য। কিন্তু দিবার হাত তো থেমে গেছে। ঈশান খুব স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে এসে দিবার হাত থেকে কেকের টুকরোটা নিয়ে মেয়ের মুখে পুরে দেয়। তারপর আবার নিজের জায়গায় বসে দিবার দিকে তাকায় আগ্রহ নিয়ে।

দিবা এই কিছুক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করে প্রশ্ন করে,” ওর কি এখানে আসার কথা ছিল?”

” আমি জানতাম না কিছু। আমি ওকে সিলেক্ট করিনি। তুমি কি যাবে বাইরে? দেখা করে আসবে নাকি একবার?”

দিবার চোখ দু’টো র’ক্তবর্ণ ধারণ করে। ঈশান যে তাকে ‘তুমি’ করে বলছে, ক্রোধে সেটা খেয়ালও করে না। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,” আপনি কি আমাকে খোচা মারছেন?”

ঈশান তাচ্ছিল্য হাসে। রোজার দিকে তাকিয়ে বলে,” মাম্মা, এদিকে আসো৷ পানি খেয়ে যাও। বাবার কাছে ওয়াটার পট!”

দিবা তখনও তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। তারপর হঠাৎ বলে, ” রোদেলা আপু এলে আপনিও নিশ্চয়ই দেখা করতে যেতেন তাই না? নাহলে আমাকে বললেন কেন?”

ঈশান অকপটে বলে,” আমাকে না জানিয়ে রোদেলা, রাফিন, এদের সবার সাথে তুমিই দেখা করেছো। আমি তো করিনি। তাই আমাকে এই কথাটা বলা মিনিংলেস।”

দিবার গা জ্বলে যাচ্ছে রাগে। কাঁপা গলায় বলে, “আমার ব্যাপারে তো সব খবরই রাখেন দেখছি৷ আগে কি কোথাও স্পাই ছিলেন?”

ঈশান কোনো কথা বলে না। রোজার খেলার বলটা হাতে নিয়ে টস এন্ড ক্যাচ খেলতে থাকে দায়সারা ভঙ্গিতে। বাসায় হলে এতোক্ষণে দিবা উঠে গিয়ে বলটা তার হাত থেকে নিয়ে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলতো। কলার ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঝগড়া শুরু করতো। আর এখন চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কিন্তু গা টা জ্বলে যাচ্ছে। অথচ ঈশান কি স্বাভাবিক! যেন দিবার কষ্টেই তার স্বস্তি!

চলবে