#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২২
Sidratul Muntaz
রাত তখন আড়াইটা বাজে। বিশাল পেন্টহাউজ নীরবতায় ছেয়ে আছে। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দিবার কান্না মাখা চাপা আর্তনাদ। মুখে হাত চেপে সে এতো কাঁদছে! কেনো কাঁদছে, কিসের আশায় কাঁদছে তা যেনো সে নিজেও জানে না। কিন্তু সে নিজেকে থামাতে পারছে না! ঈশান কিছু বলে না তাকে। চুপচাপ বিছানা থেকে উঠে যায়। দিবা ভাবে সে চলে গেছে।কিন্তু আসলে যায়নি তখনও।
দিবা মাথা তুলেই দেখে ঈশান কাউচের কাছে গিয়ে কোথাও ফোন করেছে। চিন্তিত মুখভঙ্গি নিয়ে বলে,”ইয়েস, আই নিড আ ফিজিশিয়ান সুইট ইন ফিফট বি৷ ফোর মাই ওয়াইফ, শী হ্যাজনট ইটেন এনিথিং। মেবি লাইট হেডেড.. অর সামথিং।”
তারপর ওইপাশ থেকে কিছু বলা হয়। ঈশান আন্তরিক কণ্ঠে বলে,” থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
সে ফোন রেখে তাকাতেই দিবা দ্রুত অন্যদিকে ঘুরে যায়। হাত দিয়ে ঢেকে নেয় নিজের মুখ। ঈশান পরিষ্কার গলায় বলে,” দশমিনিটের মধ্যে ডক্টর আসছে। তোমার যা যা সমস্যা হচ্ছে বলবে।”
” ডাক্তার আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।”
দিবা আগের মতো ত্যাড়া কণ্ঠেই জবাব দেয়৷ ঈশান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘর থেকে বের হতে নিলেই রাগে দিবা বেডের সাইড টেবিল থেকে একটা শোপিস তুলে নেয় ছুঁড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে। তখনি ঈশান বলে উঠে,” ডন্ট ডু দিজ। এখানের কিছু ভাঙলে জরিমানা দিতে হবে।”
” তো দিবেন। আপনার তো টাকার অভাব নেই। ভাঙবো আমি।” বলেই দিবা ফট করে জিনিসটা ভেঙে ফেলে।
জোরালো শব্দ হয়৷ ঈশান চোখ বন্ধ করে মেজাজ সামলায়। কি আর বলবে? বাল্যবিবাহ করার শাস্তি হয়তো এগুলোই।
অন-কল মেডিকেল সার্ভিসের ডাক্তার দশমিনিটের মধ্যেই চলে আসে। ঈশান তখন খুব ব্যস্ত হয়ে মেঝে থেকে ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো তুলে নেয়। দিবা জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে চুপচাপ।
মহিলা ডাক্তার মিস লিলি খুব আন্তরিক হেসে বলেন,” হ্যালো মিস্টার ঈশান, আ’ম লিলি। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
রিনরিনে মেয়েলি কণ্ঠ শুনে আঁড়চোখে তাকায় দিবা। ডাক্তার দেখতে বেশ সুন্দর। ঈশান বিনয়ের সাথে ইংরেজিতে বলে,” কষ্ট করে আসার জন্য থ্যাঙ্কস। আমার ওয়াইফ দিবা, এখানে আসার পর থেকে কিছুই খায়নি। ওর নাকি ক্ষিদে পাচ্ছে না। ”
দিবা চোখ বড় করে তাকায়। ডক্টর লিলি হেসে বলেন,” হ্যালো মিসেস দিবা। কেমন আছেন? আচ্ছা আপনি লাস্ট কখন খাবার খেয়েছেন?”
দিবা কোনো কথা বলে না। ঈশান নিজে থেকেই বলে,” এখানে আসার পর থেকে একবারও কিছু খায়নি। প্রায় আটঘণ্টা হয়ে গেছে।”
” ওহ, গড! আচ্ছা আপনি এখন কেমন বোধ করছেন? আপনার কি মাথা ঘুরাচ্ছে?”
দিবা জবাব দেয় না। ঈশান বলে,” আমার সেটা মনে হচ্ছে না। কিন্তু ওর বডি উইক। আপনি এমন কোনো মেডিসিন দিন যেনো ওর বেশি বেশি ক্ষিদে পায়। তাহলেই হবে। ”
কেমন নিয়ন্ত্রণের ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছে ঈশান। যেন জোর করে হলেও দিবাকে খাবার খাইয়েই ছাড়বে৷ ডক্টর লিলি বলে,” বেশি বেশি ক্ষিদে পেলেই তো প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে না মিস্টার ঈশান। আগে বুঝতে হবে প্রবলেমের সোর্সটা কোথায়? এটা কি শুধুই ফিজিক্যাল প্রবলেম? ”
দিবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করা হয়েছে। ঈশান ভাবে সে সামনে থাকলে দিবা ত্যাড়ামো করেই যাবে, কথা বলবে না। তাই সে শান্ত স্বরে বলে,” আমি বাইরে ওয়েট করছি।”
ঈশান চলে যেতেই ডাক্তার দিবার কাছে এসে বসে। জিজ্ঞেস করে,” আপনি আমার সাথে প্রবলেম শেয়ার করতে পারেন। এখন আপনার হাজব্যান্ড নেই।”
দিবা নিশ্চল কণ্ঠে বলে,” আমি ঠিকাছি ম্যাম, আপনাকে শুধু শুধুই আনা হয়েছে৷ আমার কিছু হয়নি।”
” তাহলে খাওয়া-দাওয়া করছেন না কেনো?”
দিবা চুপ করে থাকে। তার এই নীরবতায় ভদ্রমহিলা নিজে থেকেই বুঝে নেয় অনেককিছু। হেসে বলে,” ইউ হ্যাভ সাচ আ লভিং হাজব্যান্ড মিসেস দিবা! বেচারা তোমার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে৷ তাকে এভাবে জ্বালিও না প্লিজ। কিছু অন্তত খেয়ে নাও। ”
” আমি আমার হাজব্যান্ডকে জ্বালাচ্ছি এটা আপনার কেনো মনে হলো?”
” কারণ এই মাঝরাতে সে ইমারজেন্সী সার্ভিসের মাধ্যমে আমাকে কল করেছে, এই অবস্থায় আমি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ফিস চার্জ করি। এটা জেনেও যারা আমাকে ডেকে আনে তারা আসলেই খুব সিনসিয়ার। আর মিস্টার ঈশানের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে তোমাকে নিয়ে কত টেন্সড! ”
” আপনি কত ফিস চার্জ করেন? আমি কি জানতে পারি?”
” এইতো, ফাইভ হান্ড্রেড ডলার!”
দিবা ভ্রু কুঁচকে একটু হিসাবের চেষ্টা করে। বাংলাদেশী টাকায় এটা প্রায় ষাট হাজারের কাছাকাছি! তার মাথা ঘুরে আসার উপক্রম হয়। ডক্টর লিলি বলে,” আমি একটা ভিটামিন সাজেস্ট করছি। এটা খেলে আশা করি তোমার উইকনেস কেটে যাবে। আর কখনও খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম কোর না৷ সবার আগে নিজের হেলথ।”
কিছুক্ষণ স্বাস্থ্য-বিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার নামে বকবক করে ডক্টর লিলি। তারপর দিবার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে মিষ্টি স্বরে বলে,” ইউ আর অলসো আ সুইট গার্ল! ”
দিবা ফিসফিস করে বলে,” লভিং হাজব্যান্ড? হি ইজ আ ক্রুয়েল হাজব্যান্ড! আপনি জানেন না ডাক্তার, মাথাভরা কত শয়তানি আর পেটভরা কত অহংকার ওই লোকের। টাকার অহংকার! আমি আর তার টাকায় কেনা খাবার মুখেও তুলবো না।”
ডাক্তার লিলি রুম থেকে বের হতেই ঈশান উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,” ওর কি হয়েছে ডক্টর? খেতে পারবে তো এখন? আশা করি আর কোনো সমস্যা হবে না!”
ভদ্রমহিলা নরম হেসে বলে,” মনে হয় ও কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট, তাই এমন করছে। আপনি ওর সাথে একটু সুইট হোন, ওকে বোঝানোর চেষ্টা করুন৷ এছাড়া ওর ফিজিক্যাল কন্ডিশন সব ওকে। তবু আমি একটা ভিটামিন সাজেস্ট করছি।”
” ওকে।” ঈশান প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগে দেখে একবার। তারপর জিজ্ঞেস করে,” এটা কি আপনিই এনে দিয়ে যাবেন নাকি আমি হেল্পডেস্কে ফোন করব?”
লিলি মৃদু হেসে হলে,” আমার ব্যাগেই এক প্যাকেট আছে, আমি দিয়ে যাচ্ছি। তবে রেগুলার মিলে ওকে এটা খাওয়ানোর দায়িত্ব আপনার।”
ঈশান তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে পাঁচশো ডলার মিটিয়ে দেয়। সাথে কিছু টিপস। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সে প্রবেশ করে দিবার রুমে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,” আসবো?”
দিবা ঠেস মারা কণ্ঠে বলে,” নিশ্চয়ই আসুন, আপনার ভাড়া করা সুইট, আপনি কেনো অনুমতি নিচ্ছেন?”
ঈশান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত ভাঁজ করে বলে,” তোমার প্রবলেমটা কি?”
” আমার কেনো প্রবলেম হবে? আমি তো আমার কাজ মন দিয়ে করছি। আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে দয়া করে এতো বদার্ড হবেন না। আ’ম ফাইন।”
ঈশান টেবিলের কাছে যায়। খাবারগুলো সব তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। তার কান্ড দেখে দিবা হতবাক হয়। সে কি এখন দিবাকে না খাইয়ে রাখার চিন্তা করছে?আসলে সে এই বাসি খাবার দিবাকে দিতে চায়নিম গ্যাস হতে পারে। তাই কোথাও একটা ফোন করে দিবার পছন্দের চিকেন কর্ণ স্যুপ অর্ডার করেছে। কিছুক্ষণ পর ঈশানকে খাবার নিয়ে ঢুকতে দেখেই দিবা আঙুল উঠিয়ে শাসায়,” আমি কিন্তু খাবো না বলে দিচ্ছি।”
ঈশান কাছে এসে কটমট করে বলে,” হাঁ করো, নয়তো এই গরম স্যুপ মুখে ঢেলে দিবো একদম। ওই মুন ফেস পুড়ে একদম ব্ল্যাকহোল হয়ে যাবে ”
দিবা ভড়কে যায় এমন কথায়৷ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ঈশান তার মুখকে মুন ফেস বলছে? আবার বলছে গরম স্যপু ঢেলে ব্ল্যাকহোল বানিয়ে দিবে? এটা বুঝি প্রশংসা করতে করতে হুমকি দেওয়া? তবে সে সত্যি ভ’য় পায়। কারণ এই লোকের যেই মেজাজ, সত্যি সত্যি ঢেলে দিতেও পারে। দিবা তাই বেশি বাড়াবাড়ি করে না। চুপচাপ হা করে। ঈশান খুব যত্নশীল ভঙ্গিতে দিবাকে স্যুপটা খাইয়ে দিতে থাকে। টিস্যু দিয়ে ঠোঁট মুছতে নিলে দিবা বলে,” দিন আমি করছি। ”
ঈশান ছেড়ে দেয়। দিবা নিজেই নিজের মুখ মোছে। তারপর বলে,” দিন, আমিই খেতে পারব।”
” কেন? এতোক্ষণ তো খেতেই চাইছিলে না।”
” হুম, কিন্তু এখন পারব। তাছাড়া এভাবে আমাকে খাওয়াতে আপনার কষ্ট হচ্ছে। তাই বাদ দিন।”
” আমার কষ্ট হচ্ছে কি হচ্ছে না সেটা আমি বুঝবো।”
ঈশানের গলার স্বর অত্যন্ত ভারী। দিবা নিশ্চুপ খাওয়া শেষ করে। ঈশান তাকে ঔষধও খাওয়ায়। তারপর উঠে বলে,” ঘুমিয়ে যাও। গুড নাইট। আমি লাইটস অফ করে দিচ্ছি।”
” শুনুন।”
ঈশান একটু থামে, কিন্তু তাকায় না। দিবা জিজ্ঞেস করে,” আমি আপনাকে খুব জ্বালাচ্ছি তাই না?”
ঈশান শান্ত চোখে তাকায় এবার। দিবা মলিন হেসে বলে,” আসলে স্যরি, আমি আমার ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারছি না। অভ্যাস জিনিসটা খুব খারাপ। হঠাৎ আপনি আমাকে এতো গুরুত্ব দিয়েছেন যে আমি নিজের অপূর্ণতার কথা ভুলেই গেছিলাম। আর এটাও ভুলে গেছিলাম যে আমাদের বিয়ের একটা শর্ত আছে। আপনি তো শুধু রোজার দেখা-শুনার জন্যই আমাকে বিয়ে করেছিলেন…”
এই পর্যায় দিবা তার কথা শেষ করতে পারে না। ঈশান হঠাৎ কড়া স্বরে গর্জে উঠে,” রোজার দেখা-শুনার জন্য মানে? এই শর্ত আমি কবে দিয়েছি? বলো কবে দিয়েছি?”
দিবা থতমত খায়। ভীত কণ্ঠে বলে,” বিয়ের প্রথম রাতেই তো আপনি রোজার দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তাছাড়া সেদিন আমাকে বাড়ি থেকে বের করে গাড়িতে তুলেও বললেন যে আমি চলে গেলে রোজা মানসিক আঘাত পাবে তাই…”
ঈশান তাচ্ছিল্য হাসে একবার। চোখ সরু করে বলে,” তোমার কি সত্যি তাই মনে হয়? আমার মেয়ের জন্য আমি ছাড়া আদৌ কারো প্রয়োজন আছে? ও পুরোপুরি আমার উপর ডিপেন্ডেড। না তুমি, না রোদেলা, রোজার কারো সঙ্গের প্রয়োজন নেই। আমি যেখানেই যাই আমার মেয়েকে নিজের সাথে নিয়ে যাই। ও কখনও আমার অভাব অনুভব করবে না। তাই ওর মায়ের কোনো প্রয়োজন হবে না৷ বাবাই ওর জন্য এনাফ। তাহলে তুমি কিসের ভিত্তিতে ভাবছো আমি রোজার জন্য তোমাকে আটকে রেখেছি? ইন ফ্যাক্ট আজকে তুমি চলে গেলে কাল তোমার কথা ওর মনেও থাকবে না!”
দিবা হাঁ হয়ে যায় এসব শুনে। কেঁপে উঠে বক্ষস্থল। নিজেকে খুব ছোট লাগে। ঈশান কি তাকে তুচ্ছ করার জন্য এসব বলছে? দিবা বামহাত দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে প্রশ্ন করে,” তাহলে কেনো শুধু শুধু আটকে রেখেছেন আমাকে? ডিভোর্স দিয়ে দিলেই তো হয়। যেমন রোদেলাকে দিয়েছিলেন!”
” তুমি কি নিজেকে রোদেলার সমতুল্য ভাবছো?”
” তাছাড়া আর কি? আপনি তো সেভাবেই আমাকে ট্রিট করছেন।”
” আমি তোমাকে রোদেলার মতো ট্রিট করছি? আর ইউ সিরিয়াস?” ঈশানের শক্ত কণ্ঠের গর্জনে দিবা আরও একবার নড়ে উঠে।
ঈশান দাঁতে দাঁত পিষে বলে,” তোমার আটকে রাখার কারণটা কি সেটা যদি এখনও বুঝতে না পারো তাহলে আমার কিছু বলার নেই। জাস্ট মাইন্ড ইট, সম্পর্কে শর্ত তুমি বেঁধেছিলে। প্রতারণাও তুমি করেছো। আমি শুধু তোমাকে ক্ষমা করার চেষ্টা করছি৷ জানি না কবে সেটা পারব। ”
দিবা আহত চোখে তাকায়, দৃষ্টি টলমল। ঈশান একটা গভীর শ্বাস ফেলে দিবার গায়ে কমফোর্টার টেনে দেয়। তারপর এসির টেম্পরেচার স্বাভাবিক করে লাইট নিভিয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। দিবা শুয়ে থাকে খুব স্তব্ধ হয়ে, নিঃসঙ্গের মতোন। চোখের কোল ভরে যেতে থাকে নোনা অশ্রুতে।
চলবে
#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৩
Sidratul Muntaz
দ্যা গ্রোভ, লস এঞ্জেলসের অন্যতম অভিজাত ও বিখ্যাত শপিং সেন্টার। এখানে এসে দিবার মনে হচ্ছে সে বুঝি কোনো হলিউড সিনেমার সেটে চলে এসেছে। অত্যন্ত সুন্দর ও ঝকঝকে রাস্তা, পাশে বড় জলাধারে চিকন চিকন পানির ফোয়ারা গুলো যেন নৃত্য করছে। ঝিকমিক আলোয় মন ভরে যায়। চারপাশের দেয়ালগুলো পুরনো ইউরোপিয়ান আর্কিটেকচারের আদলে নির্মিত, মাঝখান দিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রাম, বৈদ্যুতিক ট্রেন। ট্রেনের ভেতরে মানুষগুলো কি স্বাচ্ছন্দ্যে বসে আছে।
দিবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,” এটা কি কোনো রাইড?”
সিমি রোজাকে কোলে নিতে নিতে হেসে জবাব দেয়,” নো ম্যাম, এটা যাতায়াতের সুবিধার জন্য। ট্রামে উঠে আমরা এই পাশ থেকে ওইপাশে যেতে পারব। আপনি উঠবেন?”
দিবা প্রবল আগ্রহ নিয়ে বলে,” নিশ্চয়ই উঠবো। কিন্তু এখন না। আগে এই পাশের সবকিছু ভালো করে দেখে নেই!”
কথাটা বলেই সে দৌড়ে ঢোকে কাঁচঘেরা একটি Dior এর শো-রুমে। এতো সুন্দর ব্যাগের কালেকশন এখানে! সিমি নীরবে দিবাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে। গত ত্রিশমিনিট ধরে তারা শুধু ঘুরছেই। সিমিকে ঈশান পাঠিয়েছে রোজা আর দিবার খেয়াল রাখার জন্য। কারণ দিবা শপিং-য়ের ব্যাপারে খুবই অবসেসড। শপিংয়ে এলে তার অন্যকোথাও আর নজর থাকে না।
দিবা গতকাল সারারাত কেঁদেছে, তারপর অনেক ভেবেছেও৷ এভাবে চলে না আসলে। সে না খেয়ে থেকে, কান্নাকাটি করে কিংবা নিজেকে কষ্ট দিয়ে তো কোনোকিছু হাসিল করতে পারবে না। তার ভাগ্যে যা আছে সেটা হবেই। তাই সকালে উঠে সে নিজের মন থেকে সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। বাথটাবে গিয়ে একটা ঠান্ডা শাওয়ার নেয়। শীতল জলে গা ভিজিয়ে মনের সব ক্লান্তি আর কষ্ট ঝেড়ে ফেলে।
অন্যকেউ তাকে ভালোবাসুক কি না বাসুক, সে নিজে ভালোবাসবে নিজেকে। নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে। লস এঞ্জেলসে যেহেতু সে ঘুরতেই এসেছে তাহলে কেনো ইঞ্জয় করবে না? এই কাঁচের পেন্টহাউজে বন্দী থেকে লাভ নেই। সে পুরো শহরটা মুক্ত পাখির মতো ঘুরে বেড়াবে। তার নিজের কাছে যে টাকাগুলো আছে, সেখান থেকেই খরচ করবে। ঈশানের কাছে একদম হাত পাতবে না।
গোসল শেষে দিবা একটা সুন্দর মেরুন কামিজ পরে সাজ-গোজ করে নেয়। মুখে সানস্ক্রিন আর ময়েশ্চারাইজার লাগায়। চোখে হালকা করে কাজল। ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে নিয়েও থেমে যায়। এমনি ভালো লাগছে।
ঈশান তখন মিটিং-য়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল৷ কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, হাতে রোল্যাক্স ঘড়ি, গলায় টাই। দিবা তার রুমের কাছে এসে নিচু গলায় ডাকে,” একটু কথা ছিল। বাইরে আসতে পারবেন?”
ঈশান অকপটে বলে,” তুমি ভেতরে আসলেই হয়।”
” না, আপনিই বাইরে আসুন। আমি আপনার প্রাইভেট স্পেসে ঢুকতে চাই না! তাছাড়া ওখানে তো রোজা ছাড়া অন্যকারো প্রবেশ নিষেধ!
আবারও খোচা মারা কথা বলে সে। ঈশানের মাঝে মাঝে মনে হয়, দিবা রোজাকে জেলাস করে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে একটা। আসলে শান্তিতে কাজ করার জন্যই নিজের জন্য এই জায়গাটা আলাদা করে নিয়েছিল ঈশান। এই ডিলটা খুব ইম্পোর্ট্যান্ট তার কোম্পানীর জন্য৷ তাই মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে এমন সব জিনিস দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। সেজন্যই এখানে দিবার প্রবেশ সবার আগে নিষেধ! কারণ ঈশানের সব মনোযোগ নষ্ট করার উৎকৃষ্ট উপাদান দিবা। সে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ালে ঈশান অবশ্যই মাইন্ড সেট করতে পারবে না। তাছাড়া এখন এমনিও সে দিবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। এটাও তো একটা যুদ্ধের মতো। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ, প্রবল আত্মসংযমের যুদ্ধ।
দিবা আবার জোরে দরজায় নক করে,” এইযে, শুনছেন!”
ঈশান বের হয়। দিবাকে ভেজা চুলে, পাটভাঙা নতুন কামিজে খুব খুব স্নিগ্ধ লাগছে! আর চোখের ওই কালো কাজলটা তো হৃৎস্পন্দন বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট!
” আমি রোজাকে নিয়ে একটু বের হবো।”
” অসম্ভব। কোথাও যাবে না।” ঈশান রুক্ষ গলায় খুব ধমকে উঠে।
দিবা ভ’য় পায়, যদিও সে একটু আগেই প্রতিজ্ঞা করেছে ঈশানের ধমকে ভ’য় পাবে না। সে দ্রুত পেছন থেকে একটা স্কার্ফ বের করে বলে,” চিন্তা করবেন না। আপনি যেভাবে চান সেভাবেই বের হবে। শুধু চুলগুলো শুকানোর অপেক্ষা৷ তারপর এটা মাথায় হিজাবের মতো বেঁধে নিবো। আর ওরনা পুরো গায়ে ছড়িয়ে দিবো। এবার ঠিকাছে?”
খুব চটপট করে দিবা কথাগুলো বলে। ঈশান হা করে তাকিয়ে থাকে, ওই সরল সরল চোখ আর মিষ্টি সুবাসে কেমন ঘোর লেগে আসে।
দিবা একটু অধৈর্য্য হয়ে হাতে তুরি বাজিয়ে বলে,” কি ব্যাপার? আপনি কি আমার কথা আদৌ শুনেছেন নাকি অন্যকিছু ভাবছেন?”
তারপর আবার বিড়বিড় করে,” অবশ্য শুনবেন কেন? এখন তো আমার দিকে কোনো মনই নেই। যাচ্ছেন তো মিটিংয়ে। সেসব নিয়েই চিন্তা করছেন নিশ্চয়ই। আমি কি ঘরে বসে থাকবো সারাক্ষণ? সেজন্য আমিও বের হচ্ছি।”
ঈশান ঘোর কাটিয়ে অপ্রস্তুত গলায় বলে,” যাও৷ তবে কাজলটা মুছে নিও।”
” সামান্য কাজলই তো লাগিয়েছি চোখে। এটাও আপনার সহ্য হচ্ছে না? এতো হিংসা কেনো পেটে?”
দিবা মনে মনে বলে কথাটা, মুখে বলার সাহস নেই। কারণ ঈশানের মুখ এখন প্রচন্ড গম্ভীর।
ঈশান ঘড়ি দেখে নিয়ে বলে ” যেতে চাইলে যাও। নিষেধ করছি না। কিন্তু তোমার সাথে আমি একজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
দিবা খুব অবাক হয়ে তাকায়। তারপর একটু তাচ্ছিল্য হেসে বলে,” হুম, সেটা তো অবশ্যই পাঠাবেন৷ স্পাই ছাড়া তো আমাকে কোথাও বের হতে দিবেন না। কি ভেবেছেন? আমি রাফিনের সাথে দেখা করব?”
মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেই দিবা জীভ কাটে। ঈশান রূঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। হালকা এগিয়ে আসে। দিবা ভড়কে যায়। দ্রুত পিছিয়ে বলে,” না মানে…”
ঈশান খরখরে শুকনো গলায় বলে,” যার মনে যা, বেজে উঠে তা! তোমার মনে রাফিন ঘুরছে এখনও? ওকে কি দেখার খুব শখ?”
দিবা দ্রুত দুইপাশে মাথা নাড়ে। ঈশান বলে,” রোজার দিকে খেয়াল রাখার জন্য সিমিকে পাঠাচ্ছি। তাছাড়া তুমি নিজেও এখানকার কিছু চেনো না। আর বুদ্ধি তো সব হাঁটুর নিচে, কখন কোন বিপদ বাঁধিয়ে বসবে…তারপর হবে আরেক ঝামেলা।”
রাগে দিবার সারা শরীর ঝংকার দিয়ে উঠে। এই লোক তাকে অপমান না করে একটা কথাও বলতে পারে না! উফ, উফ, দিবা নিজেকে শান্ত রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করে। ঈশান ঘরে ঢুকে কিছু জরুরী ফাইল দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে,” বাই দ্যা ওয়ে যাচ্ছো কোথায়?”
” একটু শপিংয়ে। ” গোমড়া মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই বলে দিবা।
ঈশান বের হয়ে তার কার্ড আর মোবাইল এগিয়ে দেয়। দিবা অবাক হয়ে তাকায়,” এগুলো কেনো দিচ্ছেন?”
” তোমার জিনিস, তাই দিচ্ছি! আর টাকা ছাড়া শপিং করবে কিভাবে?”
দিবা আলতো হেসে খুব ভাব নিয়ে বলে,” আপনার টাকার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার শপিং, আমি বুঝে নিবো।”
ঈশান ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, দিবা গটগট করে রুমে চলে যায়। চোখের কাজল মুছে, চুল খোপা করে মাথায় স্কার্ফ পরে। তারপর গায়ে ওরনা ছড়িয়ে ব্যাগ আর রোজার আইপ্যাড নিয়ে বের হয়। ঈশান আর কিছু বলে না তাকে।
Dior- এর শোরুমে ঢুকে দিবা খুব সুন্দর একটা টোট ব্যাগ পছন্দ করেছে। কিন্তু দাম এতোবেশি, একেবারে সাধ্যের বাইরে বলা চলে। তাই দিবা মনখারাপ করে ব্যাগটা রেখে দেয়। তারপর বাইরের স্ট্রিট মার্কেট থেকে একটা স্কার্ফ খুব পছন্দ হয়৷ সেটাই কেনার জন্য টাকা বের করতে গিয়ে দেখে, সে টাকার ব্যাগ হোটেলেই ফেলে এসেছে।
” উফ, শিট!”
” কি হয়েছে ম্যাম?” সিমি জিজ্ঞেস করে উদগ্রীব হয়ে।
দিবা প্রচন্ড মনখারাপ নিয়ে বলে,” আমি আমার পার্সটা ফেলে এসেছি। এখন কি হবে?”
” নো প্রবলেম, চলুন আমরা ফিরে যাই। আবার গিয়ে নিয়ে আসি।”
দিবা হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,” না থাক, আর ইচ্ছে করছে না। মুড চলে গেছে। তাছাড়া খুব টায়ার্ডও লাগছে। চলো ফিরে যাই।”
তখন রোজা তার ওরনা ধরে টানে। চোখে-মুখে একটা সিরিয়াস ভাব। এই মেয়ে যেনো তার বাবার জেরক্স কপি! দিবা জিজ্ঞেস করে,” কি হয়েছে বার্বী ডল? তুমি কিছু খাবে? কিন্তু আমার কাছে একদম টাকা নেই। তোমাকে কিছু কিনে দিতে পারব না, স্যরি।”
রোজা তার শোল্ডার ব্যাগপ্যাক খোলার চেষ্টা করছে। সিমি তাকে সাহায্য করে। তারপর সে তার হট পিংক ব্যাগ থেকে দু’টো কার্ড আর দিবার ফোনটা বের করে। দিবা হতবাক হয়ে যায়।
সিমি হেসে বলে,” এগুলো স্যার ব্যাগে দিয়ে রেখেছিলেন। আমি ভুলেই গেছি। দেখেছেন ম্যাডাম, স্যার মনে হয় আগেই জানতেন যে আপনি পার্স ফেলে আসবেন। তাই এই কাজ করেছেন।”
দিবা কিছু বলে না। তবে কার্ড আর মোবাইল নিজের হাতে নেয়। সে নিজের পছন্দের কিছু কেনে না ওই কার্ডের টাকায়। শুধু রোজার জন্যই শপিং করে। সিমি যেহেতু কষ্ট করে তার সাথে ঘুরেছে, মেয়েটাকে একটা ড্রেস কিনে দেয়। তারপর রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করে হোটেলে ফিরে আসে।
বিলাসিতা ও আভিজাত্যময় এই শহরে কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন বোধ হয় সবকিছু। দিবা বিষণ্ণ শ্বাস ছাড়ে। বিকালে বেলবয় এসে দরজায় নক করে। দিবার জন্য একটা বিরাট পার্সেল এসেছে। বেলবয় হাসি মুখে বলে,” এটা স্যার পাঠিয়েছে ম্যাম। আপনার জন্য প্রেজেন্ট।”
দিবা এতো বিরাট বাক্স ধরতে পারে না৷ ফ্লোরে ফেলে দেয়। বেলবয় চলে যাওয়ার পর সে একটা কাচি এনে ধীরে ধীরে বাক্সটা খুলে আর প্রবল বিস্ময়ে মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে। Dior- এর সেই প্রিমিয়াম টোট ব্যাগ, Jimmy-র গ্লিটার হিলস, Reformation-র সিল্কি, মিডি ড্রেস ল্যাভেন্ডার কালার, এছাড়াও জুয়েলারি, কসমেটিক্স, স্কার্ফ, এক কথায় শপিংমলে সে যতজিনিস পছন্দ করেছিল সবই এখানে আছে।
দিবা নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ কি যেন হয়, মুখে হাত চেপে কেঁদে ফেলে। কাঁদতেই থাকে। এদিকে এতোবড় বাক্সে এতো উপহার দেখে রোজা খুব আকর্ষণ নিয়ে তাকিয়ে ছিল৷ ভেবেছিল দিবা খুশি হবে। কিন্তু তাকে কাঁদতে দেখে মেয়েটা একটু অবাক হয়ে যায়। তার ধারণা দিবা খুব দুঃখী মেয়ে! তাই সে দিবার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কপালে চুমু দেয়। দিবা মুখ তুলে রোজাকে দেখে একনজর। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে শুরু করে।
আজ সকালের মিটিংয়ে রাফিন যায়নি। অসুস্থতার বাহানা দিয়ে রুমেই ছিল। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। সে দিবাদের পেন্টহাউজ খুঁজে পায়নি। অবশ্য এতোবড় স্কাইস্ক্র্যাপারে একটা নির্দিষ্ট সুইট খুঁজে পাওয়া তো মাঝসমুদ্রে আইল্যান্ড খোঁজার মতো ব্যাপার। না পাওয়াই স্বাভাবিক। তীব্র হতাশা আর ক্লান্তি নিয়ে সে নিজের ঘরেই বসে থআছে এখন।
কাজ শেষ হলে বিকালে সব সহকর্মীরা তাকে দেখতে আসে। আসিফ জিজ্ঞেস করে,” এখন কি অবস্থা রাফিন ভাই? শরীর ভালো? ”
রাফিন যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ে। মিজান সাহেব বলেন,” খাওয়া-দাওয়া তো করেন না আপনি ঠিকঠাক। একটু শরীরের যত্ন নেন। এভাবে চললে হবে? কত আশা নিয়ে আপনাকে এখানে এনেছিলাম বলুন তো। আপনার এখন উচিৎ স্যারের মন জয় করার চেষ্টা করা৷ তা না করে কি অসুস্থ হয়ে বসে আছেন!”
কিছুক্ষণ তাকে পরামর্শ দিয়ে সবাই যখন বিদায় নেয়, সে শুনতে পায় বাইরে জুনিয়র মেয়েগুলোর হাসাহাসির শব্দ। তারা দিবার ব্যাপারেই কথা বলছে। রাফিন বিছানা ছেড়ে উঠে আড়ি পাতে তাদের কথায়।
লিজা খুব উত্তেজনা মাখা কণ্ঠে বলে,” সিমি, তুই তো আজ সারাদিন ম্যাডামের সাথে ছিলি। কেমন লাগল?”
সিমি হেসে বলে,” দিবা ম্যাডাম অন্নেক সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর তার ফ্যাশন সেন্স। মেরুন কামিজের সাথে খুব সুন্দর ম্যাচিং করে মাথায় একটা স্কার্ফ পরেছিল। তাকে যে কি সুন্দর লাগছিল! ডিভা একদম। এজন্যই বুঝেছি, ঈশান স্যার কেনো তাকে এমন লুকিয়ে রাখে। এতো সুন্দর বউ হলে যে কেউ পজেসিভ হয়ে যাবে। ”
মেয়েরা হাসছে উচ্চস্বরে। রাফিনের বুকে যেন আগুন ধরে যায়। চোখ জ্বালা করতে থাকে। সে এই পরিস্থিতি সহ্য করতে পারছে না।
চলবে,